১.
স্নিগ্ধ সুষম ভোর। আলো ফুটতে শুরু করেছে মাত্র। সকালের মিষ্টি রোদ ছুঁয়ে যাচ্ছে আমের মুকুল। সোনাঝরা রোদ্দুরে ঝিকমিক করে উঠছে পৃথিবী। সুবহে কাযিব যখন সুবহে সাদিকের দিকে গড়াচ্ছে তখন থেকে কুরআন তেলাওয়াত শুরু করেন আম্মু। ফজরের সালাত, তাসবিহ-তাহলিল পড়েই হয়তো শুরু করেছেন। এখনো পড়ছেন। এটা ছিল আম্মুর দৈনিক রুটিন। আম্মু যখন তেলাওয়াত শুরু করেন সুললিত কণ্ঠে মাখনমাখা সুর ওঠত তখন কুরআনের। কী এক মায়াকাড়া মিহি সুর গুঞ্জরিত হতো ভোরের ঝিরিঝিরি হাওয়ায়। কুরআনের কুসুমিত আয়াতের নিচে শাহাদাত আঙুলি ঠেলে গুনগুনিয়ে পড়ে যেতেন খোদার কালাম। দেয়ালে দেয়ালে ঝুলত যেন একেকটা আরবি হরফ। কুরআনের সেইসব মোহনীয় তেলাওয়াত হৃদয়ের অলিন্দে এক অন্যরকম শিহরন জাগাত। হৃদয়ের মখমলে রোপণ করত কুরআনের প্রেম, আম্মুর তেলাওয়াতের মায়া। মনে নাড়া দেয়। বিগলিত করে। অন্তরে ঢেউ তুলে এক নৈসর্গিক অনুভূতির। বাপ-দাদারা যখন মরিচভাঙা পান্তা খেয়ে মাঠের কাজে চলে যেতেন তখন আম্মু কুরআন পাঠ শেষ করতেন। কুরআনের উপর একটা দীর্ঘ চুমু খেয়ে গিলাফে জড়িয়ে রেহালসহ তুলে রাখতেন পুরোনো কাঠের তাঁকে। তারপর জড়িয়ে পড়তেন সাংসারিক কাজেকর্মে।
যখনকার কথা বলছি তখন আমি কিশোর। এক নৈসর্গিক সৌন্দর্য নিয়ে চালতা ফুলে ঝুলে আছে আমার বোকা শৈশব। তখন থেকেই জেনেছি আম্মু ভালো কুরআন পড়তে পারেন। আম্মু যখন এমন মোহনীয় সৌন্দর্যের তেলাওয়াত করতেন তখনই জিগ্যেস করতাম। আপনি কার থেকে শিখেছেন কুরআনের এমন জাদুময়ী তেলাওয়াত? আম্মু চেহারায় হাসির রেখা টেনে বলতেন—তোর নানার বাড়ির পূর্বপাশে যে একটা পুরোনো মসজিদ আছে না? সেখানে নিয়োজিত এক মৌলভী সাহেব আমাদের কুরআন শেখাতেন। আমার চোখেমুখে ঝিলিক খেত এক আশ্চর্য আলো। একজন গ্রাম্য মৌলভী কীভাবে দিতেন এমন মোহনীয় তেলাওয়াতের সবক! আম্মুর এইসব কথা শুনে মস্তিষ্কের ঝিল্লিতে ধাক্কা খেতো নানান ভাবনা। আম্মুকে আরো জিগ্যেস করতাম,
মসজিদের সেই মৌলভী শিক্ষককে আপনারা কত করে মাইনে দিতেন? আম্মু তখন এক গাল হেসে বলে ওঠেন—এখনকার মতো ছিল না আগের দিনগুলো। তখন আমরা ফ্রীতেই শিখেছিলাম আরবির পহেলা সবক থেকে কুরআন খতম পর্যন্ত। তবে কুরআন খতম হলে সবার মাঝে মিষ্টি বিতরণ আর মৌলভী সাহেবকে একটা তাঁতের লুঙ্গি দিয়েছিলেন তোর নানাজি। আম্মুর কথা শুনার পর থেকে আজও দেখতে ইচ্ছে করে আম্মুর গরিবানা হালের সেই মৌলভীকে।
২.
সারাবছর আম্মু কুরআন পাঠ জারি রাখতেন। মাঝেমধ্যে হয়তো কখনো কখনো ছুটেও গেছে। কিন্তু, রমযান মাস আসলে আম্মু কোমর বেঁধে যেন বসতেন কুরআন তেলাওয়াতে। সাংসারিক কাজের ফাঁকে ফাঁকে যখনই ফুরসত মিলত তখনই কুরআন নিয়ে তেলাওয়াতে মগ্ন হতেন। একেক রমযানে হয়তো কুরআনের কয়েক খতম দিতেন। গ্রামের মহিলারা কুরআন পাঠের প্রতিযোগিতায় নামতেন যেন। পরিশুদ্ধির মাঝে গ্রামের বাড়ির আঙিনায় আঙিনায় কুরআনের নিসর্গিত আয়াতের সুর। আমি অনেক সময় পুরো মহল্লা চষে বেড়াতাম আর কুরআনের এমন জাদুময় তেলাওয়াত শুনতাম গ্রামের দাদুদের। আম্মুকে প্রায়ই রমযানে বলতে শুনতাম, এইবার তিনটে বা চারটে কুরআনের খতম দিব। একটা তোর নানা-নানুর নামে আরেকটা তোর দাদা-দাদির নামে। আরেকটা আমাদের জন্য। আমি অবুঝ মনে কখনো বলতাম, মাশাল্লাহ। তখন খুশিতে কার্তিকের সোনালি ফসলে রোদের মতো ঝলমল করে উঠত আম্মুর চেহারা। হৃদয়ে হয়তো চিকচিক করে উঠত সুখকর অনুভূতি।
এক রমযানে মাদ্রাসা ছিল বন্ধ। আমি সারাদিন মহল্লায় ঘুরে বেড়াই বাউন্ডুলের মতো। আমি যেন বন্দি খাঁচা থেকে সদ্য মুক্তি পাওয়া কোনো ছাইরঙা পাখি। বাড়িতে একটুও বসে থাকতে মন চাইত না। দু-চোখে খেলাধুলার তুমুল নেশা। কিন্তু আম্মু চাইতেন আমি বাড়ির আঙিনায় থাকি। বখাটে ছেলেদের সাথে মেলামেশা না করি। তাই, একদিন আমাকে বললেন, পুকুরের ঘাট থেকে ওজু করে এসে আমার সাথে কুরআন পড়তে বস। ততদিনে আমি গ্রামের মাদ্রাসায় কুরআনের সবক দিতে শুরু করেছি। শত নারাজি সত্ত্বেও ওযু করতে গেলাম ঘাটে। বেখেয়ালি ওযু যেন মুহূর্তের মধ্যেই করে ফেলি। হাতের কব্জিতে নিদারুণভাবে চিকচিক করছিল ওজুর পানি। বিকেলের ঝিরিঝিরি হাওয়া যেমন বিষণ্ণ মনকে ভালো করে দেয় সেদিন ওজু করার পর ভোরের রোদে চিকচিক করে ওঠা ওযুর পানি আমার মনখারাপের আকাশে ছড়িয়ে দেয় এক পশলা মুগ্ধতার বৃষ্টি। আমি ওযু করে আম্মুর পাশে কুরআন খুলে বসি। অস্ফুট স্বরে পড়তে শুরু করি আল্লাহর নামে। কুরআনের বৃহৎ সূরা বাকারার ‘আলিফ-লাম-মিমে’ শুরু হয় আম্মুর কাছে আমার পহেলা সবক। আম্মুকে প্রায়ই বলতাম, আলিফ, বা, তা’র সবক কী আপনিই আমাকে দিয়েছেন? আম্মু আমাকে কী উত্তর দিতেন সেসব বেমালুম ভুলে গেছি। একদম মনে করতে পারছি না। সেদিন আম্মুর সাথে বসে দীর্ঘ সময় কুরআন পাঠ করেছিলাম আর শুনছিলাম হৃদয় বিগলিত করা আম্মুর তেলাওয়াত। আম্মুর একেকটা গুন্নাহ, মদের টান ঢেউ খেলে যেত অল্পবয়সি কুমড়ো পাতায়। আম্মুর কুরআন পাঠ যে কাউকে মোহগ্রস্ত করে তুলবে নিশ্চিত।
৩.
তখন আম্মুর বয়স বেড়ে গেছে। চেহারা মলিন হয়ে গেছে। চামড়া কুঁচকে আছে। চোখদুটো বসে গেছে কোঠরে। চোখে আগের মতো জ্যোতি নেই; ঝাপসা দেখেন। আগের মতো আর মোহনমায়া সুরে কুরআন পড়তে পারেন না। জীবনের গোধূলিতে ভাসে এখন নানান প্রচ্ছদ। ধূসর কিংবা আলো-আঁধারির বৈচিত্র্যময় ছবি। আম্মু যখন আগের মতো কুরআন পড়তে পারেন না কিংবা না পড়তে পড়তে ভুলতে শুরু করছেন খোদার ঐশী কালাম। তখন আম্মু তুমুল দুঃখবোধ করতেন। তার উজ্জ্বল দিনদুপুর দেখাত আঁধার রাতের নিঝুম, নিস্তব্ধ। নিঃসীম দুঃখে ভেঙে পড়তেন কখনো কখনো। হৃদয়ের আকুতি তুলে ধরতেন রহমানের কাছে। যদি তার একটু রহম হয় এই বান্দির প্রতি। যদি খুলে দেন রহমের জানালা। তখন হয়তো পুনরায় পড়তে পারবেন ঐশী নূরে ছাওয়া কুরআন। হৃদয়ের সিন্দুকে সঞ্চিত সবটুকু আকুতি পেশ করেছেন মৃত্যুর প্রান্তরে দাঁড়ানোর আগ পর্যন্তই। জীবনের শেষ বছরগুলোতে দেখে দেখে কুরআন পড়তে না পারলেও দীর্ঘতম সূরাগুলো অবলীলায় লোকমা ছাড়া পড়ে যেতে পারতেন। বিড়বিড় করে সময়ে-অসময়ে সেসব সূরাগুলো আওড়াতেন আম্মু। এভাবে হয়তো মনকে তাসাল্লি দিতেন।
আম্মুর জীবনের শেষ কয়েক বছর যখন পরীক্ষার বন্ধে গ্রামে যেতাম তখন আম্মুকে কুরআন পড়ানোর চেষ্টা করতাম। আমি আপ্রাণ চেষ্টা করতাম ভুলে যাওয়া সূরাগুলো পুনরায় ইয়াদ করিয়ে দিতে; কিন্তু হতো না। আধো ভাঙা হলেও আগের মতো সাবলীল, সুললিত হয়ে উঠত না। এক তো বয়সের ভার; তাছাড়া ভুলে যাওয়া সূরা ইয়াদ করা মহাকঠিন। একবার বাড়ি গেলাম ছুটিতে। তখন ছিল বর্ষাকাল। পেঁজা তুলোর মতো আকাশে উড়ে বেড়াচ্ছে সাদা সাদা মেঘ। যখন তখন ঝুপঝুপ করে নামে ইলশেগুঁড়ি বৃষ্টি। ঘরের ঢেউটিন বেয়ে ঝরে পড়ে দেয়ালঘেঁষা বেলির গাছটার মাথায়। মেঘলা আষাঢ়ের বিকেলে মুক্তোর পাটি বিছিয়ে আম্মুকে নিয়ে বসলাম কুরআন পাঠের মজলিসে। আম্মুও মাথায় দীর্ঘ ঘোমটা টেনে পড়তে বসলেন। মশক্ব করালাম সূরা ইয়াছিনের প্রথম দুই মুবিন। মাঝে মাঝে যখন আম্মু ঠিকঠাক উচ্চারণ করতে পারতেন না তখন লজ্জায় আমার বৃদ্ধা মায়ের বদনখানি ডালিমের দানার মতো লাল টকটকে হয়ে যেত। আড়ষ্ট হয়ে পড়তেন যেন তিনি। আম্মুকে আমি অভয় দিতাম। আর পড়ে যেতেন শৈশবের সিঁড়ি ভেঙে কৈশোরে কুরআন পাঠের কথা। হৃদয়ের দহলিজে উঁকি দিত শৈশবে আম্মুর পাশে বসে অস্ফুট স্বরের কুরআন পাঠের স্মৃতি। আমি গুন্নাহ, মদ আর যাবতীয় তাজবিদ শিখিয়ে আম্মুকে যখন বলতাম আপনি শুনান আমাকে; আম্মুর তেলাওয়াত শুনে মনে হতো সেই আগের মতো চিরসজীব হয়ে আছে আম্মুর সুর। অবিকল ঠিক আগের মতোই শুনাচ্ছেন যেন তিনি আমাকে। অদূরের কামরাঙাগাছে বসে ছাইরঙা বকটাও যেন আয়ত্ত করছে আম্মুর তেওয়াতের লাহান। সেই মধুমাখা সুরের একান্ত আপন তেলাওয়াত আর শুনতে পারব না।
ওপার দুনিয়ায় ভালো থাকবেন, আম্মু।
আমাদের আম্মুরা এমনই! আমার আম্মু এখনও আছেন। সূর্য তেতে ওঠা পর্যন্ত আমাদের ধূসর দেয়াল, দরজার মলিন চৌকাঠ আর পলেস্তারায় গেথে থাকা কাঁটায় ঝুলে থাকা ক্যালেন্ডারের পাতা— তন্ময় হয়ে শুনতে থাকে আম্মুর তিলাওয়াতের সুর।
নক্ষত্রদের সমস্ত আয়ু আমাদের আম্মুদের নামে হোক।