কমবেশি প্রায় প্রত্যেক মহান ব্যক্তিত্বের সাথে এমনটা ঘটে থাকে—ভক্তকুল এবং নিন্দুকেরা লোকসম্মুখে নিজেদের খেয়ালখুশিমতো বানানো ফ্রেমে কল্পিত চেহারায় তাঁদের উপস্থাপনের চেষ্টা করে। কিন্তু কল্পনা আর বাস্তবতার ভিন্নতার কারণে তখন তাঁদের প্রকৃত চেহারাই অস্পষ্ট থেকে যায়। আর তিক্ত হলেও সত্য যে, এমনটাই ঘটেছে ইমামুল ইনকিলাব মাওলানা উবায়দুল্লাহ সিন্ধী রহ. এর সাথে। নির্বোধ ভক্তকুল ও নির্দয় সমালোচকদের এই মুর্খতাপূর্ণ আচরণ থেকে তিনিও রেহাই পাননি। যে কারণে তাঁর ইন্তেকালের অর্ধশতাব্দী পেরিয়ে গেলেও এখনো ইতিহাসের পাতায় তাঁকে অনুসন্ধানের কাজেই আটকে আছি আমরা। তাঁর চিন্তা-চেতনা ধরে এগিয়ে যাওয়া আর হয়ে ওঠে না। সমস্ত অর্জন, ত্যাগ, কুরবানি আর অমর কীর্তিসমগ্র খড়কুটোর মতো ভেসে যায় ঠুনকো সমালোচনার খরস্রোতে। মাওলানা সিন্ধীকে নিয়ে তেমনি এক সমালোচনার বিষয়বস্তু হলো, মাওলানা সিন্ধী তাঁর রাজনৈতিক চিন্তা ও দর্শনে পশ্চিমা পুঁজিবাদ বা সমাজতন্ত্রের দ্বারা প্রভাবিত ছিলেন কি না? এই আলাপের আগে সংক্ষেপে মাওলানা সিন্ধীর পরিচয় এবং পাকিস্তান, ভারত ও বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধে তার অবদান ও ভূমিকার আলাপ করা সমুচিত মনে করছি –
মাওলানা উবায়দুল্লাহ সিন্ধীর ব্যক্তিগত পরিচয়, তিনি একটি অমুসলিম পরিবারে জন্মগ্রহণ করেছিলেন, বন্ধুদের মাধ্যমে ইসলামের প্রতি প্রভাবিত হয়েছিলেন এবং স্কুলে পড়ার সময় কিছু বই পড়ে ইসলাম গ্রহণ করেছিলেন; এরপর বাড়ি ছেড়েছিলেন। তখন তার ভাগ্য তাকে সময়ের যুগশ্রেষ্ঠ আলেম ও সমাজসংস্কারক হযরত হাফেজ মুহাম্মাদ সিদ্দিক পীর সাহেব ভরচন্দি শরীফ সিন্ধ এর দরবারে পৌঁছে দেয়। এখানে তার হৃদয় ও মন এবং ব্যক্তিত্ব ও চরিত্র ইসলামী ছাঁচে গড়ে উঠেছিল। সেখান থেকেই ইসলামের আধিপত্য ও ইসলামী শরীয়তের প্রয়োগ এবং মুসলিম জাতির গৌরবময় ইতিহাস-ঐতিহ্য পুনরুদ্ধারের বাসনা তার মনে জায়গা করে নেয়। এই আন্দোলনের আরেক নাম “ওয়ালীউল্লাহি আন্দোলন” নামে পরিচিত।
এরপর মাওলানা সিন্ধীর পরিচয় ঘটে ওয়ালিউল্লাহি আন্দোলনের একজন কেন্দ্রীয় ব্যক্তিত্বের সঙ্গে। তিনি শায়খুল হিন্দ মাওলানা মাহমুদ হাসান দেওবন্দী রহ.। যিনি একাধারে মুসলিম উম্মাহর রাহবার এবং ইংরেজবিরোধী আন্দোলনের শীর্ষ নেতৃত্বের একজন। এখান থেকে মাওলানা উবায়দুল্লাহ সিন্ধীর প্রকৃত ব্যক্তিত্বের সাথে আমাদের পরিচয়।
কারণ মাওলানা উবায়দুল্লাহ সিন্ধী ছিলেন শায়খুল হিন্দ মাওলানা মাহমুদ হাসান দেওবন্দীর শিষ্য এবং স্বাধীনতা সংগ্রামে তাঁর একান্ত সহযোগী। তাঁর মাধ্যমে মাওলানা সিন্ধী ইমাম ওয়ালিউল্লাহ দেহলভীর দর্শন, সংগ্রাম ও আন্দোলনের সাথে পরিচিত হন এবং সেই আন্দোলনে নিজেকে পূর্ণরুপে সঁপে দেন। তিনি ওয়ালিউল্লাহী আন্দোলনের জন্য বুদ্ধিবৃত্তিক ও আদর্শিক কাজও করেছিলেন। শুধু তাই নয়, বিভিন্ন প্রতিকূল পরিবেশে এই আন্দোলনকে এগিয়ে নিতে নিজের জীবন বাজি রেখে কাজ করেছেন। প্রকৃতপক্ষেই ত্যাগ-কুরবানি, পরিশ্রম ও মেহনত এবং নিঃস্বার্থতার দিকে তাকালে এ যুগের অন্য কোনো নেতার সঙ্গে তার তুলনা চলে না।
হযরত মাওলানা শায়খুল হিন্দ রহ. যখন ময়দানে অবতীর্ণ হন তখন পর্যন্ত ইসলাম ও মুসলমানদের বিরুদ্ধে চলে আসা ঐতিহাসিক লড়াইয়ের ধারাবিবরণী অনেকটা এমন ছিল—
এক.
এই যুদ্ধের প্রথম পর্যায় ছিল, যখন গ্রীক দর্শন মুসলমানদের ধর্মীয় বিশ্বাসকে আক্রমণ করেছিল এবং মুসলিমদের বিশ্বাসের বাঁধ ভেঙে দিতে চেয়েছিল। কিন্তু গাযালী, ইবনে রুশদ এবং ইবনে তাইমিয়ার মতো প্রতিভাবান ব্যক্তিগণ এগিয়ে এসে গ্রীক দর্শনের ভাষা গ্রহণ করেন। প্রতিরোধ ও প্রতিরক্ষার অস্ত্র নিয়ে পথ আটকে দেন।
দুই.
হিন্দু সংস্কৃতি ও দর্শন মুসলিম সমাজকে নিজের মধ্যে আত্তীকরণ করার চেষ্টা করেছিল, কিন্তু হযরত মুজাদ্দিদে আলফে ছানী ও তাঁর সঙ্গীদের ধৈর্য্য হিন্দু দর্শন ও সমাজের হজম শক্তিকে অকার্যকর করে তুলেছিল।
তিন.
এই যুদ্ধের তৃতীয় পর্যায় ছিল ইউরোপীয় দর্শন ও বুদ্ধিবৃত্তিক আক্রমণ। হযরত শাহ ওয়ালিউল্লাহ দেহলভী সময়ের আগেই এই বিষয়টি অনুভব করেছিলেন এবং এর মোকাবিলায় একটি বুদ্ধিবৃত্তিক ও একাডেমিক সংগ্রামের ভিত্তি স্থাপন করেছিলেন, যা মাওলানা কাসিম নানুতুবির দারুল উলুম দেওবন্দ প্রতিষ্ঠার মধ্যদিয়ে মজবুত হয়ে মাথা তুলে দাঁড়াতে শুরু করে ।
মাওলানা সিন্ধী তাঁর চিন্তা ও দর্শনে পশ্চিমা পুঁজিবাদ বা সমাজতন্ত্রের দ্বারা প্রভাবিত ছিলেন কি না?— অনুসন্ধানের জন্য মাওলানা উবায়দুল্লাহ সিন্ধীর সংগ্রামী জীবনের লক্ষ্য-উদ্দেশ্য এবং সেজন্য তিনি কী ধরনের সমস্যা ও বাধার সম্মুখীন হয়েছিলেন—তা দেখা গুরুত্বপূর্ণ।
মাওলানা উবায়দুল্লাহ সিন্ধী যখন হযরত শায়খুল হিন্দের সহযোগী ও সহকারী হিসেবে এই আন্দোলনে যোগ দেন, তখন এই আন্দোলনের অবস্থা ছিল—উপমহাদেশ তথা পাকিস্তান, ভারত ও বাংলাদেশ সম্পূর্ণরূপে ব্রিটিশ শাসনের অধীন এবং তাদের বিরুদ্ধে বালাকোটের জিহাদ, বাংলায় ফরায়েজি আন্দোলন এবং ১৮৫৭ সালের স্বাধীনতা আন্দোলনগুলি সাময়িকভাবে ব্যর্থ হয়েছিল। শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে চলে আসা মুসলিম রাজনীতি, শিক্ষা, সমাজ ও অর্থনীতি দিল্লির ব্রিটিশ শাসকদের দ্বারা ধ্বংস হয়েছিল। তখন শায়খুল হিন্দ মাওলানা মাহমুদ হাসান দেওবন্দী বিদেশী দখলদারদের বিরুদ্ধে নতুন করে লড়াইয়ের জন্য নতুন ময়দানের মুজাহিদ বাহিনী প্রস্তুত করছিলেন।
বিগত তিন শতাব্দী যাবৎ সমগ্র পৃথিবীকে নিজেদের গোলাম বানাতে ইউরোপীয় জাতিগুলো সারা বিশ্বে যে নারকীয় আগ্রাসন চালিয়ে আসছে—এটি শুধু ব্রিটিশদের আগ্রাসন ছিল না, ফরাসি, ডাচ, পর্তুগিজ ও জার্মানরাও এতে শামিল হয়েছিল। কিন্তু ব্রিটিশদের ধূর্ত কৌশলের সামনে তাদের কেউই সুবিধা করতে পারেনি এবং অবশেষে তারা সবাই একের পর এক পিছু হটতে বাধ্য হয়। এমনকি এই সিরিজের শেষ সেমিফাইনালেও ইংরেজরা একাই কমিউনিজমের বিরুদ্ধে পরিচালিত স্নায়ুযুদ্ধে বিজয় লাভ করে। আর এখন মুসলিমদের সাথে ফাইনাল ম্যাচের জন্য আমেরিকার নেতৃত্বে পশ্চিমা সব দেশ ঐক্যবদ্ধ হয়েছে।
কিন্তু এই শতাব্দীর শুরুতে যখন শায়খুল হিন্দ দিল্লির ব্রিটিশ শাসকদের বিরুদ্ধে আন্দোলনের ছক তৈরি করছিলেন তখন পৃথিবীর রাজনৈতিক দৃশ্যপট আজকের থেকে একেবারেই আলাদা ছিল। তুরস্কের উসমানি খিলাফত পাঁচ শতাব্দী ধরে মুসলিম বিশ্বের রাজনৈতিক ঐক্য ও কেন্দ্রীয়তার প্রতীক ছিল। যেটা তখনও বাকি ছিল। আরেকদিকে জার্মানরা শক্তিশালী প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে ইংরেজদের বিরুদ্ধে একাই লড়াই চালিয়ে যাচ্ছিল। ইংরেজ বিরোধী শিবির হিসেবে তুরস্ক এবং জার্মান পরস্পরের বন্ধু ও সহযোগীতে পরিণত হয়ে গিয়েছিল।
এহেন পরিস্থিতিতে মাওলানা শায়খুল হিন্দ একজন বুদ্ধিমান সেনাপতির মতো ব্রিটিশ ও জার্মানদের পারস্পরিক দ্বন্দ্বের সুযোগ নিতে চেয়েছিলেন এবং এজন্য পরিকল্পনা করেছিলেন। যার বিশদ বিবরণ মাওলানা সাইয়্যিদ মুহাম্মদ মিয়াঁ তার বই তাহরীকে শায়খুল হিন্দ–এ লন্ডনের ইন্ডিয়া অফিস লাইব্রেরিতে সংরক্ষিত সরকারী নথির রেফারেন্সে লিপিবদ্ধ করেছেন। এছাড়া কিছুদিন পূর্বে জার্মান পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের একজন সাবেক উপসচিব ও বার্লিন বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞানের অধ্যাপক ওলাফ শ্যামেলের স্বীকারোক্তি সবার সামনে এসে গেছে। দৈনিক জং লন্ডনের ১৬ আগস্ট, ১৯৯৪ সালের রিপোর্টে অধ্যাপক ওলাফ শ্যামেলের সূত্রে বলা হয়—জার্মান, তুর্কি এবং আফগান সরকার বৃটিশ শাসনের অবসান ঘটাতে শায়খুল হিন্দের সাথে যৌথ উদ্যোগ নিয়েছিল।
এই সংগ্রামকে “রেশমী রুমাল আন্দোলন” নামে স্মরণ করা হয় এবং এই আন্দোলনটি ‘তাহরীকে শায়খুল হিন্দ’ নামেও পরিচিত। অধ্যাপক ওলাফ শ্যামেল এটিকে “বার্লিন পরিকল্পনা” নামে নামকরণ করেছেন। এই আন্দোলনে মাওলানা উবায়দুল্লাহ সিন্ধী ছিলেন শায়খুল হিন্দ মাওলানা মাহমুদ হাসান এর সহযোদ্ধা এবং জার্মান, তুর্কি ও আফগানদের সাথে আলোচনা ও চুক্তিতে তার ভূমিকাই ছিল মুখ্য। কিন্তু এই আন্দোলন যখন শোচনীয়ভাবে ব্যর্থ হয় সেসময় বিশ্ব রাজনৈতিক দৃশ্যপটও পাল্টে যায়। তুরস্কের অটোমান খিলাফতের অবসান ঘটে, প্রথম বিশ্বযুদ্ধে জার্মানরা পরাজিত হয় এবং কমিউনিস্ট বিপ্লবের পর রাশিয়া ব্রিটিশদের নতুন প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে আবির্ভূত হয়। এদিকে পরিকল্পনা ব্যর্থ হওয়ার পর এই আন্দোলনের কমবেশি সকল সদস্যই ইংরেজ সরকারের কারাগারে বন্দী হয়ে পড়েন। আর মাওলানা উবায়দুল্লাহ সিন্ধী তখন জেলের বাইরে একা। এহেন পরিস্থিতিতে একজন চৌকষ ও বুদ্ধিমান রাজনীতিবিদ মাওলানা সিন্ধী তখন ব্রিটিশের নতুন বৈশ্বিক প্রতিদ্বন্দ্বী কমিউনিস্ট রাশিয়ার সাথে জোটবদ্ধ হয়ে ময়দানে অবতীর্ণ হবেন—এটাই স্বাভাবিক।
যেমনিভাবে তার রাহবার ও মুরব্বি হযরত মাওলানা শায়খুল হিন্দ রহ. ব্রিটিশ এবং জার্মানদের মধ্যকার বিরোধকে কাজে লাগিয়ে বৃটিশ সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলন গড়ে তুলতে চেয়েছিলেন তেমনি তিনিও একইভাবে ব্রিটিশ এবং রাশিয়ানদের মধ্যকার বিরোধকে কাজে লাগাতে এই উদ্দেশ্যে মস্কো ভ্রমণ করেন। সেখানে অবস্থান করে কমিউনিস্ট নেতাদের সাথে দেখা করেন। কমিউনিস্ট বিপ্লব অধ্যয়ন করেন এবং পশ্চিমা পুঁজিবাদ ও কমিউনিজমের মধ্যে সংঘর্ষের পটভূমিতে রুশ বিপ্লবের কিছু ভালো দিকের উল্লেখ করে প্রশংসাও করেন।
এটা সেই প্রেক্ষাপট, যার সুযোগ নিয়ে বন্ধুরা এই ধারণা গড়ে তুলেছে যে, মাওলানা উবায়দুল্লাহ সিন্ধী কমিউনিজম দ্বারা প্রভাবিত ছিলেন এবং এখন পর্যন্ত তারা চোখ বন্ধ করে এই তসবিহ জপে যাচ্ছেন। দুর্ভাগ্যবশত, মাওলানা সিন্ধীর কিছু অনুসারী, তাদের উস্তাদ সিন্ধীর অনুসরণে কমিউনিস্ট বিপ্লব এবং ব্যবস্থা অধ্যয়ন করতে গিয়েছিলেন, কিন্তু তার মতো বুদ্ধিবৃত্তিক এবং আদর্শিক ভারসাম্য বজায় রাখতে পারেননি। বরং বিভিন্ন সমালোচনা ও অভিযোগের জালে জড়িয়ে পড়েছেন এবং সেই দায়ভার নিজ উস্তাদের কাঁধে চাপিয়ে নিজেকে হালকা করেছেন। এটা সমালোচকদের নির্মম হাতে পৌঁছে একটি নতুন বুদ্ধিবৃত্তিক যুদ্ধের শিরোনাম হয়ে ওঠে। দুঃখজনক হলেও সত্য যে, অজ্ঞ বন্ধু এবং নির্দয় সমালোচকদের কেউই মাওলানা উবায়দুল্লাহ সিন্ধির অবস্থান ও এ বিষয়ে তার মতামত জানার সামান্যতর কষ্টও স্বীকার করেনি। অথচ এ বিষয়ে তিনি নির্বাসন শেষে ভারতে ফিরে আসার কয়েক মাস আগে নিজ আত্মজীবনীতে লিখে গেছেন :
“তিনি ১৯২২ সালে তুরস্কে যান, সাত মাস মস্কোতে থাকেন, তার তরুণ বন্ধুদের সাহায্যে সমাজতন্ত্র অধ্যয়ন করেন। যেহেতু জাতীয় কংগ্রেসের সাথে আনুষ্ঠানিকভাবে সম্পর্কের দরুন সোভিয়েত রাশিয়া তাকে বিশিষ্ট অতিথি বানিয়েছিল এবং অধ্যয়নের জন্য সমস্ত সুবিধা প্রদান করেছিল। (এটা মিথ্যা যে আমি লেনিনের সাথে দেখা করেছি, কমরেড লেনিন সেই সময় এতটাই অসুস্থ ছিলেন যে তিনি তার ঘনিষ্ঠ বন্ধুদেরও চিনতে পারতেন না)। আমার অধ্যয়নের ফলস্বরূপ, আমি আমার ধর্মীয় আন্দোলন—যা ওয়ালীউল্লাহী দর্শনের একটি শাখা, সমাজতন্ত্রের ধর্মহীনতার আক্রমণ থেকে রক্ষা করার উপায় সম্পর্কে চিন্তা করতে সক্ষম হয়েছি।” (আমার জীবনকথা পৃ. ১২, মজলিসে কাসিমুল মাআরিফ দেওবন্দ)
মাওলানা উবায়দুল্লাহ সিন্ধীর এই স্পষ্ট বক্তব্যের পরেও যদি কেউ মাওলানার মস্কোতে অবস্থান, সমাজতন্ত্র অধ্যয়ন এবং উপমহাদেশের স্বাধীনতার জন্য রাশিয়ান নেতাদের সমর্থন পাওয়ার প্রচেষ্টাকে “কমিউনিজম দ্বারা প্রভাবিত” বলে আওয়াজ তুলতে চান তবে তাকে থামানো হবে না তো কি করা হবে!
মাওলানার কমিউনিজমের দ্বারা প্রভাবিত হওয়ার অভিযোগকে অন্য দৃষ্টিকোণ থেকেও পর্যালোচনা করা যায়। যেমন কমিউনিজম এবং কমিউনিস্ট বিপ্লবের তিনটি আলাদা দিক রয়েছে—
কমিউনিজমের বিশ্বাস : সর্বশক্তিমান আল্লাহকে অস্বীকার করা, ধর্মের প্রতি ঘৃণা এবং নৈতিকতা থেকে বিচ্যুতি।
পশ্চিমা পুঁজিবাদ এবং সাম্যবাদের অর্থনৈতিক নীতির মাঝে তুলনামূলক গবেষণায় অগ্রাধিকার নির্ধারণ করা।
রুশ বিপ্লবের প্রথম দিকে বিশ্বব্যাপী তাদের আন্দোলন ও স্বাধীনতার লড়াইয়ে তাদের প্রতি সনুভূতিশীল আচরণ।
বিশ্বাস ও চিন্তাচেতনার সম্পর্কে মাওলানা সিন্ধির সবচেয়ে বড় বিরোধীরাও বলতে পারবেন না যে, শেষ সময় পর্যন্ত তার ঈমান, চরিত্র, ইবাদত ও নৈতিকতায় কোনো দোলাচল ছিল। বরং তিনি ঈমান ও আমলে হযরত আবু যার গিফারী (রা.) এর মতো দৃঢ়তা ও অবিচলতায় অটল ছিলেন। এক জায়গায় মাওলানা সিন্ধী নিজেই লিখেন, আমাদের প্রথম কর্তব্য পৃথিবীর সমস্ত জাতির সামনে একথা প্রমাণ করা যে, মানবতার জন্য পবিত্র কুরআনের চেয়ে কার্যকর ও সঠিক কোনো কর্মসূচি নেই। এরপর আমাদের দায়িত্ব পবিত্র কুরআনের প্রতি যারা ঈমান এনেছে, তারা যে-কোনো জাতি-বর্ণেরই হোক না কেনো, তাদের সাথে সংঘবদ্ধ একটি প্লাটফর্ম তৈরি করা। ‘পবিত্র কুরআনে বিশ্বাস’ ছাড়া তাদের অন্য কোনো সম্পর্কের দিকে আমাদের তাকানো উচিত নয়। যখন আবার মুসলমানরা পৃথিবীতে বিজয়ী শক্তি হিসেবে আবির্ভূত হবে তবে মুসলমানদের এই আধিপত্য ও বিজয় প্রতিশোধের আকারে হবে না, বরং ইসলামের হেদায়েত ও নির্দেশনা অনুযায়ী হবে। যেমন একজন পিতা তার সন্তানদের উপর আধিপত্য বিস্তার করেন। বিপরীতে বিরুদ্ধবাদী সমস্ত শক্তির তখন ধ্বংস অবধারিত হয়ে যাবে, যারাই তাদের বিরুদ্ধে দাঁড়াতে চাইবে। (ইলহামুর রহমান, মাওলানা সিন্ধী রহ.)
অন্যত্র তিনি লিখেন, এ বিষয়ে আমার অটুট বিশ্বাস ও ইয়াকিন যে, ইসলামের ভবিষ্যৎ অত্যন্ত উজ্জ্বল ও মহিমান্বিত হয়ে দ্রুতই ফিরে আসবে। ইসলাম আবার পূর্ণ শক্তি ও ক্ষমতার সাথে আবির্ভূত হবে, কিন্তু এর বাহ্যিক কাঠামো এখনকার মতো থাকবে না। (আমার জীবনকথা, মাওলানা সিন্ধী রহ.)
তিনি আরো লিখেছেন, আমি এ বিষয়ে সুনিশ্চিত যে, ইসলামের পুনরুজ্জীবন এই দুটি নীতির উপর ভিত্তি করে হবে—
এক. আল্লাহ ছাড়া কোনো মাবুদ নেই। যে এ কথার উপর একমত হবে সে-ই এই জামাতের সদস্য হবে। এই একটি বাক্যই সব বিষয়ে যথেষ্ট বলে মেনে নেয়া হবে।
দুই. অর্থনীতিতে সুদকে পরিত্যাজ্য বিবেচনা করে সর্বোচ্চ শক্তি দিয়ে তার বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলা এবং সুদখোরদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করা। এ দুটি নীতি অনুসরণ ছাড়া কোনো মুসলমান বেঁচে থাকতে পারে না। (মাওলানা সিন্ধীর উলূম ও আফকার,পৃ. ২৪)
দ্বিতীয়ত মাওলানা সিন্ধী অবশ্যই পশ্চিমা পুঁজিবাদ এবং সাম্যবাদের অর্থনৈতিক নীতির মাঝে তুলনামূলক গবেষণায় অগ্রাধিকার নির্ধারণ করেছেন। আর এই সমস্ত বিষয়ে ইজতিহাদি দৃষ্টিসম্পন্ন প্রতিজন আলিমের অধিকার এটি। এ ব্যাপারে মাওলানা সিন্ধীর চিন্তাধারা ও মতের সাথে মিল-অমিল দুটোরই অবকাশ রয়েছে। এবং কুরআন ও সুন্নাহর সুস্পষ্ট বিধানের সাথে সম্পর্কিত নয়—এমন বিষয়ে মতামত দেয়ার বুদ্ধিবৃত্তিক অধিকার থেকে তাকে বঞ্চিত করা যায় না।
একইভাবে, মাওলানা সিন্ধী রুশ বিপ্লবের প্রথম দিকে পৃথিবীব্যাপী স্বাধীনতা আন্দোলনকারীদের প্রতি কমিউনিস্টদের সহানুভূতিশীল মনোভাবের জন্য তাদের প্রশংসা করেছেন এবং এই মনোভাবের কারণে ভারতের স্বাধীনতা যুদ্ধে তাদের সহযোগিতা নেওয়ার চেষ্টাও করেছেন তিনি। এটি একটি স্বাভাবিক স্বভাবজাত এবং যুক্তিসঙ্গত আচরণ ছিল। যেটা সেই পরিস্থিতিতে একজন স্বাধীনতাকামী নেতার জন্য অপরিহার্য ছিল। কিন্তু মাওলানা সিন্ধীর এই কৌশলকে পরবর্তী সময়েও প্রয়োগ করা উচিত নয়, যখন সোভিয়েত রাশিয়া নিজেই উপনিবেশবাদী হয়ে পূর্ব ইউরোপ ও মধ্য এশিয়ার জাতিগুলোর ধর্মের স্বাধীনতা হরণ করেছিল এবং তাদের সংস্কৃতি ও সমাজের স্বাতন্ত্র্য ধ্বংসের চেষ্টা করেছিল।
যেমনটা মহানবী (সা.) এর সময়ে রোমান ও ইরানীদের মধ্যে পারস্পরিক যুদ্ধের উল্লেখ করে পবিত্র কুরআনও রোমানদের প্রতি সহানুভূতি প্রকাশ করেছে এবং রোমানদের সাফল্যকে মুসলমানদের জন্য আনন্দের বলে অভিহিত করেছে। কিন্তু এটি ছিল একটি সাময়িক বিষয় এবং সেসময়ের ভিন্ন এক পরিস্থিতির পটভূমিতে। এর কয়েক বছর পর আল্লাহর রাসুল (সা.) স্বয়ং সাহাবাদের বাহিনী নিয়ে জিহাদের জন্য তাবুকের ময়দানে রোমান বাহিনীর জন্য অপেক্ষা করেছিলেন।
তেমনিভাবে মাওলানা সিন্ধী যদি তার সময়কালে রুশ বিপ্লবের প্রশংসাসূচক কিছু কথা বলে থাকেন, তবে সেগুলিকে সেই সময়ের অবস্থা ও পরিস্থিতির পরিপ্রেক্ষিতে বিবেচনা করতে হবে। অন্যথায় কমিউনিজমের আদর্শিক দিকগুলো সম্পর্কে মাওলানা উবায়দুল্লাহ সিন্ধীর দৃষ্টিভঙ্গি ও বিশ্বাস, এ যুগের অন্যান্য আলেমদের মতোই কমিউনিজমের দ্বারা প্রভাবিত বা ভীত হওয়ার পরিবর্তে পূর্ণ শক্তি ও সাহসের সাথে তাকে প্রতিহত করার চেষ্টা চালিয়েছেন এবং ইসলামী নীতি-আদর্শের সত্যতা ও কার্যকারিতা প্রমাণের চেষ্টা করেছেন।
পরিশেষে এরই পরিপ্রেক্ষিতে মাওলানা সিন্ধীর সেই বক্তব্য উপস্থাপন করছি, যার পরে এ বিষয়ে কোনো ব্যাখ্যার অবকাশ আর বাকি থাকে না—
“যে উম্মত পবিত্র কুরআনের কর্মসূচি গ্রহণ করবে না তারা কখনোই সফলকাম হবে না। মুসলিমরা পৃথিবীতে সর্বপ্রথম কুরআনের বিশ্বভ্রাতৃত্ব ও মানবতার দাওয়াতি কর্মসূচি নিয়ে জেগে উঠেছিল এবং তারা তাদের দাওয়াতি ক্ষেত্রে সফল হয়েছিল। কিন্তু এটি ছিল মাত্র পঞ্চাশ বছরের জন্য, অর্থাৎ সিফফীনের যুদ্ধের পূর্ব পর্যন্ত।
সুতরাং আজও যদি কোনো জাতি বিশ্বভ্রাতৃত্ব ও মানবতার দাওয়াতি কর্মসূচি নিয়ে জেগে ওঠে তাহলে কুরআনের কর্মসূচি গ্রহণ করা ছাড়া সে কখনোই সফল হবে না। এ কথা আমি আমার দীর্ঘ গবেষণা ও অনুসন্ধান থেকে পূর্ণ আস্থা ও বিশ্বাসের সাথে বলছি। এবং বর্তমান বৈশ্বিক আন্দোলনগুলির অধ্যয়ন ও পর্যবেক্ষণ করার পর আমার বিশ্বাস এ বিষয়ে আরো দৃঢ় হয়েছে।
মানুষ সাধারণত জানে যে রুশ বিপ্লব শুধুমাত্র একটি অর্থনৈতিক বিপ্লব। এটি ধর্ম এবং পরকাল নিয়ে আলোচনা করে না। অথচ প্রকৃত বাস্তবতা সম্পূর্ণ ভিন্ন। আমি এই রাশিয়ানদের পাশে বসে তাদের চিন্তা-চেতনা যাচাই করেছি। ধর্মের প্রতি তাদের দুর্বলতা ও জীবনের সংকীর্ণতা প্রত্যক্ষ করেছি, তখন আমি পর্যায়ক্রমে নম্রতা ও ভদ্রতার সাথে ইমাম ওয়ালীউল্লাহর অর্থনৈতিক কর্মসূচি উপস্থাপন করেছি যা তিনি ‘হুজ্জাতুল্লাহিল বালিগা’য় পেশ করেছেন।
তারা তখন খুবই খুশি হয়েছিল ও আনন্দ প্রকাশ করে বলেছিল—এই নীতির অনুসারী কোনো জাতি কি পৃথিবীতে আছে? উত্তরে যখন না বলতাম তখন তারা খুবই দুঃখিত হতো এবং বলত, “হায় যদি এমন একটি দল থাকত যারা বাস্তবে এই কর্মসূচি পালন করছে তবে আমরা তাদের সাথে যোগ দিতাম এবং তাদের ধর্ম গ্রহণ করতাম! তাহলে কৃষক-শ্রমিকরা যে অর্থনৈতিক সমস্যার মুখোমুখি হচ্ছে এখন সেগুলোর সমাধান হয়ে যেত।”
এ কথা শোনার পর আমি নিশ্চিত হয়েছিলাম যে, যদি ইনসাফভিত্তিক সমাজ তারা সত্যিই চায় তাহলে এই লোকেরা আমাদের কুরআনী প্রোগ্রামকে গ্রহণ করতে অবশ্যই বাধ্য, যদিও সেটা একটি নির্দিষ্ট সময়ের পরে হবে।
আমি আজকের যুগে বৈশ্বিক আন্দোলনগুলোর কোনোটিকে রাশিয়ার বিপ্লবী আন্দোলনের মতো কুরআনের কর্মসূচির বিরোধী ও অসামঞ্জস্যপূর্ণ খুঁজে পাইনি—এতদ্সত্ত্বেও বিশ্ব সাম্য-মৈত্রী ও ইনসাফ প্রতিষ্ঠায় তারাই যদি কুরআনী কর্মসূচি গ্রহণে বাধ্য ও অপারগ হয় তাহলে অন্যদের অবস্থা কী হবে! এই বিষয়টি কুরআনের প্রতি আমার ঈমান ও বিশ্বাস আরো শক্তিশালী করেছে যে, কুরআন নাযিলের পর হেদায়েত ও কল্যাণ কেবল পবিত্র কুরআন অনুসরণের মধ্যেই সীমাবদ্ধ।” (মাওলানা সিন্ধীর উলূম ও আফকার, ইলহামুর রহমান পৃ. ৭০)
খুবই দরকারি একটি বিষয়। আগামীর তরুণদের চিন্তানির্মাণে সহায়ক হবে লেখাটি
ওলিউল্লাহি দর্শনটি যদি স্পষ্ট করা হতো অন্য কোন লেখাই তবে আরো উপকৃত হতে পারতাম।