শিরোনামের কৈফিয়ত দিয়েই শুরু করি।
এ আলোচনা পড়ে যদি পাঠকের অতৃপ্তি থেকে যায়, আপত্তি সৃষ্টি হয়, কিংবা, পিপাসা বাড়ে, তাহলে ওই ‘খসড়া পাঠানুভূতি’র কাছে অতৃপ্ত পাঠককে চলে যেতে হবে। সে কৈফিয়তি শব্দবন্ধে তিনি পেয়ে যাবেন আপত্তির উত্তর, কিংবা, অতৃপ্ত ঠোঁটের শরাবান তহুরা!
ত্রিশোত্তর কাব্যজগতের ‘শুদ্ধি-মুজাদ্দিদ’ ফররুখ আহমদের (১৯১৮-১৯৭৪) অনন্য সৃষ্টি দিলরুবা। এ কাব্য-মোহনায় এসে মিলেছে খৈয়াম-রুমি-ইকবাল; যোগ হয়েছে পশ্চিমা কাব্যজগৎকে নতুন পাঠ শেখাবার প্রয়াস। খৈয়ামের প্রেমরহস্য, রুমির কাব্য-পরিচ্ছন্নতার পলেস্তারা এবং ইকবালের দরদে দিল একাকার হয়ে মিশে আছে দিলরুবায়।
দিলরুবা প্রকাশিত হয় ১৯৮৪ সালে কবির মৃত্যুর দশ বছর পর। সম্পাদনা করেন আবদুল মান্নান সৈয়দ (১৯৪৩-২০১০)। গ্রন্থটি সাতটি স্তবকে সমাপ্ত একটি পূর্ণাঙ্গ সনেট-পরম্পরা (Sonnet Sequences) । প্রথম প্রকাশিত হয়েছিল সৈয়দ আলী আশরাফ সম্পাদিত ‘দিলরুবা’ নামক মাসিক সাহিত্যপত্রে। ‘দিলরুবা’র অন্তর্ভুক্ত কবিতাগুলো লেখার সন-তারিখ, বিষয়বস্তু ও আঙ্গিক নিয়ে দীর্ঘ একটি ভূমিকাও লিখেছেন সম্পাদক আবদুল মান্নান সৈয়দ।
দিলরুবা আ-শুরুশেষ প্রেমের কবিতা। সকলেই তা কবুল করেছেন। সাত স্তবকে সমাপ্ত মোট ৪৯টি সনেটের মধ্যে ৩০টি সনেটে ‘প্রেম’ শব্দটি এসেছে ৫৪ বার। ১৫টি সনেটে এসেছে একবার করে, আর ১৫টি সনেটে এসেছে একাধিকবার করে; মোট ৫৪ বার ব্যবহৃত হয়েছে শব্দটি।
আমি সর্বপ্রথম যখন দিলরুবা পড়ি, তারপর বারবার পড়ি; এবং এখনো যখন পুনরায় পড়ছি, তখনো-এখনো সবসময় আমার সুদৃঢ় বিশ্বাস, দিলরুবা পুরোটাই আধ্যাত্মিক প্রেমের কবিতা। তবে এ আধ্যাত্মিক প্রেম ভর করেছে অন্য দু’টি প্রেমের ওপর। তা হলো নিসর্গপ্রেম ও মানবপ্রেম। নারীপ্রেম কিছুতেই নয়। দেহসম্ভোগ-লিপ্সার কথা তো দূর কী বাত! নারীপ্রেমের কবিতা তিনি শুধু স্ত্রী লিলিকে লিখেছেন, অন্য কাউকে নয়। এটাকে বলে বিবাহপ্রেম। এটা কোনোদিক থেকে অশোভন নয়। দিলরুবার প্রেমকে নারীপ্রেম বলে পাঠকরা সন্দেহ করবে বলেই মনে হয় কবি দু’টি উৎসর্গপত্র লিখে আবার কেটে দিয়েছেন। উৎসর্গপত্রদু’টি ছিল এরকম : ‘পূর্ব দিগন্তের নায়িকার প্রতি’ (To the Lady of Eastern Horizon), ‘সহস্র রাত্রির অপরিচিতার প্রতি’।
তাঁর আধ্যাত্মিক প্রেম মানবপ্রেম ও নিসর্গপ্রেমের ওপর ভর করেছে, এ বক্তব্যের একটু ব্যাখ্যা দেওয়া দরকার। আজকের পরিভাষাবদ্ধ যে সাহিত্য ও তার স্বভাবের কথা বলা হয়, তার অনেক অনেক ওপরে ওঠে আমরা যখন আধ্যাত্মিক প্রেমের কথা চিন্তা করি, তখন বোঝা যায়, আধ্যাত্মিক প্রেমের সাথে সৃষ্টিপ্রেম ও নিসর্গপ্রেমের কতটুকু ঘনিষ্ঠ-গভীর সম্পর্ক। মহাগ্রন্থ কুরআনের শত শত আয়াতে বান্দাদেরকে আহ্বান জানানো হয়েছে সৃষ্টিপ্রেমের প্রতি এবং সৃষ্টি নিয়ে গভীরভাবে চিন্তা করার প্রতি।
একটি আয়াতের মর্মার্থ মোটামুটি এরকমই : ‘আসমান ও জমিনের সৃষ্টিতে, রাত ও দিনের বিবর্তনে, নদীতে নৌকাসমূহের চলাচলে, আকাশ থেকে বৃষ্টিবর্ষণের মাধ্যমে মৃত জমিনকে সজীব করে তোলার মধ্যে, আবহাওয়া পরিবর্তনে, আসমান ও জমিনের মাঝে বিচরণশীল মেঘমালায় আল্লাহর নিদর্শন বিদ্যমান। নিদর্শন ঐসব ব্যক্তি ও সম্প্রদায়ের জন্য যারা সুবুদ্ধির অধিকারী।’
এখানে সৃষ্টিপ্রেম ও নিসর্গপ্রেমের কথা স্পষ্টভাবে বলা হয়েছে। তেমনিভাবে অসংখ্য হাদিসের ভাষ্য এরকম : ‘আমাকে (আল্লাহকে) যদি পেতে চাও গরিবদের মাঝে তালাশ কর’, ‘আমি মুমিনের হৃদয়ে আসন পেতে থাকি’, ‘আমি ভগ্নহৃদয়ের কাছেই আছি’ ইত্যাদি। এসব ভাষ্য স্বয়ং আল্লাহরই ভাষ্য। এগুলোতে মানবপ্রেমের কথা ব্যক্ত হয়েছে সুস্পষ্টভাবে। সৃষ্টিপ্রেম, বিশেষ করে, মানবপ্রেমের সিঁড়ি বেয়েই আধ্যাত্মিক প্রেমের চূড়া স্পর্শ করা যায়।
সঙ্গত কারণেই আমি জোর দিয়ে বলব, দিলরুবার অন্তর্ভুক্ত কবিতাগুলো আধ্যাত্মিক প্রেমের কবিতা। তবে এখানে কবি আধ্যাত্মিক প্রেমের সবুজ প্রান্তরে প্রবেশ করেছেন মানবপ্রেম ও নিসর্গপ্রেমের হাত ধরে। এখানে যে প্রেমের কথা কবি বলেছেন ‘ধূসর স্বপ্নের মত অচিন্ত্য সে প্রেমের স্বদেশ’। আধ্যাত্মিক কবিতায় সাধারণত বিলাস থাকে না, থাকে বেদনার দাহ। থাকে নিসর্গসম্পর্কিত আল্লাহর বড় বড় নিদর্শনসমূহের বর্ণনা, যেমন : চাঁদ-সূর্য-নক্ষত্র, পাহাড়-নদী-সাগর, রাত-দিন-প্রভাত ইত্যাদি। আধ্যাত্মিক প্রেমের মিলনমেলা চলে গভীর রজনীতে, যখন আল্লাহ নিজেই নেমে আসেন নীচের আসমানে, এবং খাস বান্দারা দুহাত তুলে আল্লাহর দিকে চেয়ে থাকেন প্রাপ্তি আশায়। দিলরুবার কবিতাগুলোতে নিসর্গের কথা তো আছেই, সেই সাথে ‘রাত’, ‘ঘুম ভাঙা রাত’, ‘রাত্রির প্রতিভাস’, ‘বিশ্রান্ত ঘুম ঘোর’, ‘রাত্রি জাগরণ’, ‘তন্দ্রাহারা’ ইত্যাদি শব্দ ফিরে-ফিরে এসেছে, যা ইঙ্গিত করে আল্লাহকে পাওয়ার জন্য কঠোর সাধনার প্রতি, রাত্রিজাগরণের প্রতি।
দিলরুবা গ্রন্থের আলোচনা হয়তো অনেকে করেছেন। আমি পড়েছি দু’জনের মাত্র : আবদুল মান্নান সৈয়দের, যা গ্রন্থের ভূমিকা হিসেবে লিখিত; আরেকটি মোহাম্মদ মাহফুউল্লাহর (১৯৩৬-২০১৩) যা তাঁর গ্রন্থ ‘বাংলা কাব্যে ফররুখ আহমদ : তাঁর শক্তি ও স্বাতন্ত্র্যের স্বরূপ’-এর অন্তর্ভুক্ত। উভয়জনই ফররুখ-কাব্যের আলোচনার ক্ষেত্রে প্রমাণ্যতার সনদ রাখেন। তবে সত্যের খাতিরে বলতে হয়, মোহাম্মদ মাহফুজউল্লাহ সরাসরি কবির স্নেহধন্য ও সান্নিধ্যপ্রাপ্ত হিসেবে তাঁর কাব্যের মূল মেজাজ বোঝার ক্ষেত্রে আবদুল মান্নান সৈয়দের চেয়ে একটু এগিয়ে আছেন, যদিও সৃষ্টিকর্মের সার্বিক বিবেচনায় আবদুল মান্নান সৈয়দ অনেক এগিয়ে।
আবদুল মান্নান সৈয়দ বর্ণনাকে বিভিন্নভাবে ঘুরিয়ে-পেচিয়ে দিলরুবা’য় ব্যক্ত প্রেমকে নারী-পুরুষের প্রেম সাব্যস্ত করার চেষ্টা করেছেন। অবশ্যি তিনিও স্বীকার করেছেন, ‘নজরুলের প্রবল ইন্দ্রিয়লিপ্সা ও সর্বপ্রেমবাদ থেকে ফররুখের কবিতা স্বতন্ত্র’ এবং ‘ঠিক প্রত্যক্ষভাবে শরীরী প্রেমের কবিতা যাকে বলে তা কবি একটিও লেখেননি।’ মান্নান সৈয়দ নিজের ধারণার দ্বন্দ্বের ভেতরই কোনোরকম একটি সিদ্ধান্তে পৌঁছুতে চেয়েছেন। অথচ ‘দিলরুবা’ গ্রন্থের আলোচনায় মোহাম্মাদ মাহফুজউল্লাহ নিশ্চিদ্র-নির্দ্বিধ ভাষায় বলেছেন,
“ফররুখ আহমদের চতুর্দশপদী কবিতা ও সনেটের উপজীব্য বিষয় বিচিত্র এবং বহুমুখী, এবং প্রেমের তুলনায় সেখানে প্রকৃতিরই প্রাধান্য। বস্তুত, ফররুখ আহমদের সমগ্র কবিকর্মে প্রেমের স্থান ও অধিষ্ঠান গৌণ, এবং ব্যক্তিকেন্দ্রিক ও শরীরী প্রেমের উপস্থাপনা এবং উদ্ভাসন এক রকম নেই বললেই চলে। একান্তরূপে প্রেমের আবেগ ও অনুভূতি এবং ব্যর্থতা, বিষাদ ও স্মৃতিময়তার কবিতা হিসাবে ফররুখ আহমদের ‘দিলরুবা’র অন্তর্গত পঞ্চাশটি (শুদ্ধ হবে উনপঞ্চাশটি) সনেট এদিক থেকেও বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ। কেননা, এ প্রেম-কাব্যে কোনোরূপ শরীরী বিলাস ও দেহ-উপভোগের উদগ্র কামনা নয়, বরং এক ধরণের অন্তর্গত উপলব্ধিজাত এবং ছলনামুক্ত শাশ্বত ও সুন্দর প্রেমের রূপই সেখানে চিত্রিত এবং ব্যঞ্জিত হয়েছে।”
(ফররুখ আহমদের ‘দিলরুবা’, ‘বাংলা কাব্যে ফররুখ আহমদ : তাঁর শক্তি ও স্বাতন্ত্র্যের স্বরূপ’, মোহাম্মাদ মাহফুজউল্লাহ, ফররুখ একাডেমী, ঢাকা, ২০০৩।)
আধ্যাত্মিক প্রেমের একটি বৈশিষ্ট্য হলো, সে প্রেমের কোনো কূল-কিনারা নেই, অনন্ত-অসীম পরিধিহীন সে প্রেম। সে প্রেমের রহস্যজট কেউ খুলতে পারে না। সে প্রেমে যারা পড়েছে, তারা শুধু জ্বলে মরে বেদনার দীপ্ত শামাদানে। তবু সে প্রেম বেঁচে থাকে যুগ যুগ ধরে। বেঁচে থাকে দিশারি তারার মতো, অন্তহীন আলোর জগতে বেঁচে থাকে চন্দ্রসূর্যের মতো, সে আলোতে কেউ কোনোদিন বিভ্রান্ত হয় না। সে আলো কখনো ম্লান হয় না পৃথিবীর চন্দ্রসূর্যতারকার সকল আলো নিভে গেলেও। সে প্রেম রাত্রি ললাটে জোছনায় প্লাবিত তারকার মতো ঝিলমিল করতে থাকে। উক্ত বৈশিষ্ট্য বিমূর্ত হয়েছে কবির অসাধারণ ভাষাভঙ্গিতে,
প্রেমের রহস্যে কেন কোনদিন কেহ নাহি জানে
সে হৃদয় জ্ব’লে মরে বেদনার দীপ্ত শামাদানে।
***
প্রেম তবু বেঁচে আছে, বেঁচে থাকে প্রেম যুগে যুগে
প্রেম তবু বেঁচে থাকে সময়ের বেড়া পার হ’য়ে
ক্ষুদ্র লালসার শিখা নিভে যায়; জ্বলে ওঠে বুকে
দিশারী তারার মত প্রেম–তার অশেষ বিস্ময়ে।
রাত্রির ললাটে দীপ্ত সে তারকা জানায় ইশারা
লালসা ম্লানিমা ছেড়ে অন্তহীন আলোর জগতে
যে আলো হয়না ম্লান নিভে গেলে লক্ষ সূর্য তারা;
হয়না বিভ্রান্ত যদি আলেয়ার শিখা জ্বলে পথে।
(দিলরুবা, পৃ. ৩৪-৩৫)
এখানেই দিলরুবা মিশে গেছে খৈয়ামের প্রেমরহস্যজগতে।
‘দিলরুবা’ গ্রন্থে পাঠকগণ বিস্ময়ের সাথে লক্ষ করবেন যে, কবিতা যতই সামনের দিকে অগ্রসর হয়েছে ততই আধ্যাত্মিকতার লক্ষণ স্পষ্ট থেতে স্পষ্টতর হয়ে চলেছে। গ্রন্থের সর্বশেষ সনেটটির আগের (৪৮তম) সনেটটি একটু মনোযোগ দিয়ে পড়ে দেখুন,
চিরন্তন সত্তা থেকে বিচ্ছুরিত যে প্রেম আকাশে
জ্বালালো তারার দীপ, পৃথিবীকে অরণ্যে সাজালো
যার প্রতিচ্ছায়া মোর মনে, মেঘে জ্বালিয়াছে আলো,
সে বিদ্যুৎ শিখা নিয়ে অস্পষ্ট রাত্রির প্রতিভাসে
দেখেছি তারার দলে লক্ষ স্মৃতি ভিড় ক’রে আসে
(উজ্জ্বল হীরার মত জীবনের সেই ক্ষণ গুলি
দীর্ণ করি তমিস্রার পটভূমি বাড়ায় অঙ্গুলি
নতুন দিগন্ত পানে নবতম প্রাণের আশ্বাসে)।
তৃষাতপ্ত পান পাত্রে আজো আমি পাই নাই যারে
পাই নাই পূর্ণ ভাবে তারে আজ মেনে যাই প্রেয়
শূন্য আধারের বুকে একদিন হবে যে আধেয়
ধূসর দিগন্ত মোর সাজাবে যে দীপ্ত দীপাধারে
খুঁজে পাবো তারে কভু একদিন পূর্বাশার দ্বারে
–অন্তহীন পথে মোর অফুরন্ত প্রাণের পাথেয়।
(দিলরুবা, পৃ. ৮৩)
যে প্রেম চিরন্তন সত্তা থেকে বিচ্ছুরিত হয়ে আকাশে তারার দীপ জ্বালায়, পৃথিবীকে দৃষ্টিনন্দন অরণ্যে সাজায়, এবং আলো জ্বালিয়ে দেয় মেঘমালায়, সে প্রেম আধ্যাত্মিক প্রেম তথা স্রষ্টাপ্রেম ছাড়া আর কী হতে পারে? তৃষাতপ্ত পানপাত্রে প্রেমিককুল যাকে কোনোদিন খুঁজে পায় না, মিলনশূন্য বুকে একদিন (জান্নাতে) যিনি আধেয় হবেন, যাকে একদিন সত্যি খুঁজে পাওয়া যাবে (জান্নাতের মেলায়), এবং সেদিন তিনি অন্তহীন স্বর্গপথে অফুরন্ত প্রাণপাথেয় হবেন, তিনি একমাত্র আল্লাহ ছাড়া আর কে হতে পারেন?
এভাবেই আমরা ধরতে পারি, দিলরুবায় এসে ঘর করেছে রুমির পরিচ্ছন্ন অলৌকিক বাগান!
পৃথিবীর বুকে বান্দা যতই চেষ্টা করুক, সাধনা করুক, নিজেকে ফানা করে দিক, কিন্তু আল্লাহকে সম্পূর্ণ বুঝতে পারে না, জানতে পারে না। পরিপূর্ণভাবে তাঁকে জানা হয় না বলে খাস বান্দাদের তেমন কোনো খেদ বা ক্ষোভ থাকে না। বরং পরজগতে আল্লাহর সাথে মিলনের কাতরতায় উন্মুখ হয়ে থাকে তাদের হৃদয়। মধুপিপাসু যে চিত্ত তারা সবসময় দুনিয়াতে বহন করে চলে, একদিন মৌচাক হাতের কাছে পাওয়ার আশায় বিভোর হয়ে শুধু করে যায় সাধনা, সাধনা এবং সাধনা। তাই কবির গ্রন্থ শেষ হচ্ছে এভাবে,
পরিপূর্ণ রূপে তাই তোমাকে যে হয় নাই জানা
তাতে মোর নাই ক্ষোভ, শুধু আমি আশা ক’রে আছি
যে মধু পিপাসু চিত্ত একদিন মেলিয়াছে ডানা
তোমার রাত্রির স্বপ্নে ঠাঁই পাবে কভু সে মৌমাছি–
জাগ্রত চেতনা মাঝে অথবা বিশ্রান্ত ঘুম ঘোরে
আত্মার স্মরণালোকে-প্রেমের প্রোজ্জ্বল স্মৃতি ডোরে।।
‘দিলরুবা’ গ্রন্থটি ভাষা, ভঙ্গি ও মেজাজসহ সম্পূর্ণই আধ্যাত্মিক প্রেমের কবিতা, যা বাঙময় হয়ে ওঠেছে সৃষ্টিপ্রেম ও মানবপ্রেমের আদলে। গ্রন্থভুক্ত সকল সনেট ও সনেটভুক্ত সকল পঙক্তির মর্মার্থ খুঁটিয়ে-খুঁটিয়ে বিচার-বিশ্লেষণ করলে সুস্পষ্ট হয়ে ওঠবে আধ্যাত্মিক কবিতার সমূহ বৈশিষ্ট্য ও লক্ষণ। পশ্চিমাপ্রীতির আদলে ‘অতিআধুনিক’ হয়ে ওঠার জন্য যারা বাংলাকাব্যকে নিক্ষেপ করেছিল অপবিত্র প্রেমের নোংরা ডোবায়, সেখান থেকে তুলে এনে বাংলাকাব্যঘরে পরিচ্ছন্নতার পলেস্তারা করেছেন যে কবি, তার নাম ফররুখ আহমদ। সে অর্থে এ কাব্য পশ্চিমা কাব্যজগৎকে নতুন পাঠ শেখাবার দুর্দান্ত প্রয়াস।
সে এক অনন্য পাঠজগতের সাথে আমাদের পরিচয় করিয়ে দিবে নিচের পঙক্তিমালা :
হে ক্রন্দসী দিলরুবা আজিকার বিদায় লগনে
রাখিও না মনে আর যদি থাকে মুহূর্তের ক্ষোভ।
বিজয়িনী তুমি, তব গীতোচ্ছ্বাস জাগুক নির্ভয়
তোমাকে তুলিবে উর্ধে (ঊর্ধ্বে) মোর প্রেম মানি পরাজয়।
(দিলরুবা, ৪৪)
দুর্বোধ্য অজানা তুমি চিরদিন, হায় অজানিতা!
বহিরাবরণে তব রহস্যের সেই নীলাম্বরী–
পারেনি খুলিতে যার মর্মগ্রন্থি দিনের সবিতা
যার বেদনার গান জানে শুধু অতন্দ্র শর্বরী,
যে অজ্ঞাত অন্তঃপুরে অশ্রু ঝরে, কখনো বাঁশরী
উজাড় করিয়া বক্ষ হয় তব জীবনের মিতা।
(দিলরুবা, ৫২)
কথা বলিও না কোন, রাখো বক্ষ এ বুকে আমার
স্পর্শে, গন্ধে, বর্ণে মিশে দুই সত্তা হোক একাকার।।
(দিলরুবা, ৬২)
চাঁদ সিতারার কক্ষে আমন্ত্রণ করো যে যাত্রীকে
সে র’য়েছে বহু নিম্নে প্রশাখায় জড়ায়ে সত্তারে,
সহস্র বন্ধনে বদ্ধ ছাড়িয়া সে যেতে নাহি পারে
পাওয়া না-পাওয়ার দ্বন্দ্বে ভারাক্রান্ত করে সে রাত্রিকে।
(দিলরুবা, ৬৫)
বলেছিলাম, পাঠক অতৃপ্ত থাকবেন। আসলে অতৃপ্তি কি একসাগর তৃপ্তি-স্বাদের দিকে আহ্বান করে না? সে আহ্বানই ধ্বনিত হয়েছে কবির কণ্ঠে :
তৃষাতপ্ত পান পাত্রে আজো আমি পাই নাই যারে
পাই নাই পূর্ণ ভাবে তারে আজ মেনে যাই প্রেয়
শূন্য আধারের বুকে একদিন হবে যে আধেয়।
ভালো লাগলো