সে ছিল এক বাঙাল। জন্ম তার পূর্ববঙ্গে। ১৯২৪ সালের ডিসেম্বরে বিক্রমপুরে জন্ম সুরথনাথ বসুর। বহু পরে বাংলা সাহিত্যের পাঠক তাকে চিনলেন সমরেশ বসু নামে। আরো এক নাম আছে, কালকূট। সুরথনাথ সমরেশ হয়েছিলেন, কিন্তু তার সমস্ত জীবনের দ্বৈততা, দ্বৈধতা প্রকাশ হয় কালকূট নামে। অবশ্য সে নামে যা লিখেছেন তা ছিল সোজাসাপ্টা বয়ান। কিন্তু ব্যক্তি ও সাহিত্যিক সমরেশের গোটাটা ধরতে হলে কালকূট শব্দটিই বেশি মানানসই।
সমরেশ বসুর জীবনটা খুব সংক্ষেপে বলতে গেলে আর দশজন বাঙালের মতো। বাঙাল কেননা তাদের বাঙাল বলা হয় পূর্ববঙ্গ থেকে পশ্চিমবঙ্গে গিয়েছিলেন বলে। আর দেশভাগের আগে পরে পূর্ববঙ্গ থেকে পশ্চিমবঙ্গে তারা গিয়েছিলেন অনেকটাই বাধ্য হয়ে। সমরেশরা গিয়েছিলেন বেশ আগেই। তার শৈশব কাটে নৈহাটিতে। কিন্তু বুকের মধ্যে বিক্রমপুরের স্মৃতি ছিল। পরবর্তী সময়ে উপন্যাসে সে স্মৃতি এসেছে বারবার। সেই স্মৃতি থেকেই একেছিলেন ত্রিদিবেশকে।
যুগ যুগ জীয়ে উপন্যাসের চরিত্র ত্রিদিবেশ। বছর বারো বয়সে সে একদিন একটা নৌকা ভাড়া নিয়ে নিজেই দাঁড় বাইতে শুরু করে। ছোট গাঙ থেকে সে চলে যায় বড় গাঙে। মহাজনি নৌকার সামনে পড়ে তার ভাড়ার ছোট্ট ডিঙি। উপন্যাসে সে চিত্র যেভাবে আঁকেন সমরেশ, স্পষ্ট বোঝা যায় তিনি নিজে তা যাপন করে এসেছেন। নিশ্চিতভাবেই বলা যায় ঐ নদী ছিল বুড়িগঙ্গা। আজকের সরু হয়ে আসা নদী নয়, সেদিনের বিশাল সেই নদী যাতে চলত বড় বড় নৌকা। আর চেনা যায় সমরেশকে যে ছেলেবেলা থেকেই দুরন্ত।
দুরন্ত, খামখেয়ালি কিংবা বোহেমিয়ান—সমরেশের ক্ষেত্রে প্রতিটিই বলা যায়। পরিবারে ছিল অসচ্ছলতা। সে কারণে বিচিত্র সব কাজের সঙ্গে যুক্ত হতে হয়েছে। এক সময় মাথায় করে ডিম ফেরি করেছেন। ১৯৪৩ সাল, বয়স মাত্র ১৯ বছর। সেই সময় ইছাপুর বন্দুক কারখানায় চাকরি নেন সমরেশ। গল্পের নেশা তার আগে থেকেই ছিল কিন্তু এই সময় যুক্ত হয়েছিল আরেকটা বিষয়—রাজনীতি। অল্প সময়ের মধ্যেই কমিউনিস্ট রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত হন তিনি। কিন্তু সেখানে বেশিদিন থাকতে পারেননি।
প্রশ্ন করার মতো শিড়দাঁড়া থাকলে কিছু জায়গায় টেকা যায় না। ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি সম্পর্কে যারা কমবেশি জানেন, তারা জানবেন, পার্টি প্রশ্ন করা পছন্দ করত না। সমরেশ প্রশ্ন করেছিলেন। মতবিরোধ হয়েছিল। তাই পার্টিতে থাকতে পারলেন না। অবশ্য আরো একটি ধারণা আছে এ সম্পর্কে। ১৯৪৯-৫০ সালে তাকে জেলে যেতে হয়েছিল। পার্টির কাজের জন্যই তিনি জেল খেটেছিলেন। এই সময়ের মধ্যে তার মনে এক ধরনের পরিবর্তন আসে এবং তিনি রাজনীতি ছাড়ার সিদ্ধান্ত নেন। বাস্তবিক, এ পুরো সময়টা তিনি নানা বিষয় নিয়ে চিন্তাকরার সুযোগ পেয়েছিলেন। যে রাজনীতির সঙ্গে তিনি যুক্ত ছিলেন তার সারবত্তা নিয়ে প্রশ্ন জাগে। পাশাপাশি জেলে বসেই তিনি তার প্রথম উপন্যাস ‘উত্তরঙ্গ’ রচনা করেন। লেখালেখির যে ভুতটা বেতালের মতো ঘাড়ে ছিল সেটা এ সময় মাথায় চেপে বসলে তাকেই বেশি গুরুত্ব দিন সমরেশ।
নিজের জীবনকে উপন্যাসে, নিজের লেখায় রেখেছিলেন সমরেশ। বিশেষত ত্রিদিবেশ। যুগ যুগ জীয়ের এ চরিত্রের যে নানা সময়ের বাঁক বদল তা সমরেশের নিজের জীবনের সঙ্গে মেলে। অবশ্য ত্রিদিবেশ অনেকটাই পরিচিত। এ ধারার চরিত্র মিলবে বিশ্বসাহিত্যে অনেক। এমনকি কলকাতার সাহিত্যেও। সমরেশের এ উপন্যাসের গঠনশৈলীও পরিচিত। কিন্তু ভিন্নতা তার সার্বিক নির্মাণে। মাত্র ২২ বছর বয়সে প্রকাশ হয়েছিল তার গল্প আদাব। সময়টা সে হিসেবে ১৯৪৬ সাল। দাঙ্গার সময়। পরিচয় পত্রিকায় প্রকাশিত গল্পটি এক নতুন দিগন্ত উন্মোচন করে। প্রকাশের ৭৮ বছর পর আদাব আমাদের মনে করিয়ে দেয় মান্টোকে। মান্টো ও সমরেশ বসু পাশাপাশি রেখে পড়া যায় এর একটি কারণ তাদের বক্তব্য এবং আরেকটি কারণ তারা দুজনেই লিখেছেন মানুষের কথা।
সমরেশ বসুর বেশিরভাগ লেখাতেই এসেছে মানুষের কথা। সাধারণ মানুষ, খেটে খাওয়া মানুষ। বাংলা সাহিত্যে শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় প্রথম লিখেছিলেন তুলনামূলক নিচুতলার মানুষদের নিয়ে। তুলনামূলক কথাটি ব্যবহার করতে হচ্ছে কেননা শরতের সেই মানুষেরা অনেকাংশে দরিদ্র অর্থে নিচুতলার কিন্তু তারা মোটাদাগে ‘ভালো মানুষ’। এদের প্রতি মানুষের দরদ আসে। পরবর্তী সময়ে সাহিত্যে এসেছিল মধ্যবিত্ত এমনকি নিম্নবিত্তদের কথা। কিন্তু সেখানেও লেখকদের লেখা পড়ে ঐ মানুষদের প্রতি দরদ জাগে। সমরেশ বসু সেখান থেকে বেরিয়ে এমন মানুষদের কথা লিখেছিলেন যারা ‘ভদ্রলোক’ শ্রেণিতে পড়েন না।
মান্টোর সঙ্গে মেলাতে গিয়ে এত প্রসঙ্গ টানা হলো কেননা মান্টো লিখেছেন বেশ্যাদের কথা, মাস্তানদের কথা, টাকার জন্য মেয়েকে ভাড়া দেওয়া বাবার কথা। সমরেশ বসু তার লেখায় এনেছেন বস্তিবাসীদের কথা, গোরা সৈন্যদের কথা, যুদ্ধের সময়কার বেশ্যাবৃত্তির কথা। সমরেশ বসুর ত্রিদিবেশ থেকে শুরু করে ‘কোথায় পাবো তারে’ উপন্যাসের অনেক চরিত্রকেই সাদা বা কালো বলে চিহ্নিত করা যায় না। অন্যদিকে কালকূট নামে লেখা তার ভ্রমণ-উপন্যাসগুলোর প্রায় কোনো চরিত্রই সরলরৈখিক নয়। সহজিয়া মতের নারী-পুরুষ (চল মন রূপনগরে), বিধবাদের সুখদুঃখের মধ্যে চলে আসা একটি পুরুষ চরিত্রের (প্রণববাবু) ব্যক্তিগত ভোগবাসনা (যে কিনা নির্দিষ্ট গণ্ডির বাইরে কারো জন্য ক্ষতিকর নয়) উপস্থাপনা পাঠককে মনে করিয়ে দেয় দুনিয়ার মানুষ আসলে বিচিত্র আর সেই বিচিত্র মানুষেরই গল্প বলেছেন সমরেশ।
কিন্তু সেই গল্পের মধ্যে শরতের দরদের ছাপটা আছে। কালকূট নামে লেখা তার উপন্যাসগুলো মানুষ ও মানুষের চরিত্র প্রকাশের দারুণ উদাহরণ। ‘নির্জন সৈকতে’ তিনি লিখেছেন বিধবা বোনদের কথা। পুরীতে তাদের সঙ্গে লেখকের সম্পর্ক হওয়া। সমরেশ কালকূট নামে এ বইয়ের কথক। কালকূট নামে তার লেখা সবচেয়ে বিখ্যাত বই ‘অমৃত কুম্ভের সন্ধানে’। কুম্ভ মেলায় যাওয়া ও সংশ্লিষ্ট বিষয়আশয় নিয়ে লেখা। কুম্ভ মেলাকে তিনি তুলে এনেছিলেন দর্শকের সামনে। সেই মেলায় যাত্রা থেকে লেখকের তথা কালকূটের দেখা হওয়া প্রতিটি মানুষকে তিনি এঁকেছেন পরম যত্নে, লাবণ্যে।
মান্টোর সঙ্গে এখানেও সমরেশের মিল। মান্টো মানুষকে দেখেছিলেন খুব কাছ থেকে, মানুষের মধ্যে থেকে। মান্টো ভালোবাসতেন বম্বেকে। আর এদিকে সমরেশ নিজেকে নিয়ে গিয়েছিলেন মানুষের কাছে। তীর্থে যাওয়ার মতো করে তিনি প্রতি বছর বেরিয়ে পড়তেন কোথাও না কোথাও। মান্টো মানুষের দুর্দশা দেখেছেন আর তার কলম থেকে বেরিয়েছে স্ফূলিঙ্গ। কিন্তু সেই রোষের আড়ালে ছিল মানুষের প্রতি ভালোবাসা। শরৎচন্দ্রে আমরা সেই ভালোবাসা পাই সরাসরি। সমরেশও মানুষ দেখেছিলেন এই দুই লেখকের মতোই। তিনি মান্টোর মতোই নানা স্তরের মানুষকে দেখেছেন, মিশেছেন আর তাদের কথা লিখেছেন শরতের মতো করে। অবশ্য দরদের প্রকাশটা শরতের মতো নয়, সমরেশের নিজস্ব। কালকূট অর্থ তীব্র বিষ। সমরেশ মনে করতেন মানুষের মধ্যকার নানা বিষে তিনিও জর্জরিত। কালকূটের উত্তম পুরুষে বয়ানের মধ্যে তা মেলে। স্পষ্ট করে না বললেও মান্টোর মধ্যেও খুঁজে পাই সেই কালকূট।
কালকূটের উপন্যাসগুলো বাংলা সাহিত্যের এক ভিন্ন মাত্রার সম্পদ বলে মনে হয়। লেখাগুলো একদিকে ভ্রমণকাহিনি কেননা ভ্রমণকাহিনিতে যে প্রকার স্থান সম্পর্কে আলাপ থাকে, সমরেশের এই লেখাগুলোতে তা আছে। কিন্তু সেই বিষয়ের সঙ্গে তিনি ভ্রমণে দেখা হওয়া মানুষদের যুক্ত করে তৈরি করেছেন গল্প। সে গল্পের চরিত্ররা কাল্পনিক নয়। ঘটনাবলিও না। বাস্তব ঘটনা কিছুটা রঙ চড়িয়ে লিখেছেন সমরেশ। মানুষেরা আসত তার কাছে। গল্প করত তার সঙ্গে। কেননা মানুষের সঙ্গে মিশতে পারতেন তিনি। ছোটবড় ভেদ ছিল না। কালকূটের কথকের মধ্যে কিছুটা আদর্শবাদ, তথাকথিত সংস্কার দেখা যায়। সমরেশের মধ্যে তা ছিল না। অন্তত প্রথম জীবনে। সে জন্যেই লিখতে পেরেছেন মেথর সঙ্গমের কথা। প্রতিবাদ করেছিলেন ব্রিটিশ শাসনের, যুদ্ধের কারণে হওয়া ক্ষতির। চরিত্রদের এঁকেছিলেন সমাজের প্রচলিত নিয়মের বাইরের মানুষ হিসেবে। কেননা সমরেশ মিশেছিলেন নিয়মভাঙা মানুষের সঙ্গে। ভবা পাগলার বন্ধু ছিলেন তিনি।
সমরেশ বসুর পথপরিক্রমা বিচিত্র। লেখাকেই তিনি পেশা হিসেবে গ্রহণ করেছিলেন। বন্দুক ফ্যাক্টরির চাকরি ছেড়ে দেওয়ার পর অন্য কোনো ‘চাকরি’ তিনি করেননি। সমরেশ বসুকে নিয়ে লিখতে গিয়ে দেবেশ রায় বলেছেন, ‘জীবনের শেষদিন পর্যন্ত তিনি লেখক এবং পেশাদার লেখক। তিনি আমাদের মতো অফিস পালানো কেরানি লেখক ছিলেন না, যাঁদের সাহস নেই লেখাকে জীবিকা করার অথচ ষোলো আনার ওপর আঠারো আনা শখ আছে লেখক হওয়ার।’[1]প্রতিক্ষণ, ৫ম বর্ষ, ১৭ সংখ্যা, ২–১৬ এপ্রিল ১৯৮৮। কিন্তু সেই ‘পেশাদার লেখক’ হওয়ার কারণে কিছু বিষয়ে তাকে ‘আপস’ করতে হয়েছিল। কলকাতায় গড়ে ওঠা কর্পোরেট প্রকাশকশ্রেণির হাতে বন্দি হয়ে পড়েছিলেন তিনি। লিখেছেন তিনি খেটে খাওয়া মানুষদের নিয়েই কিন্তু লেখা প্রকাশ হতো বড় বড় প্রকাশনী থেকে। চাইলেও তাই সমরেশ বসু ঋত্বিকের মতো ‘কাঁচা খিস্তি’ দিতে পারতেন না। স্পেডকে স্পেড বলার সুযোগ তার কমে গিয়েছিল।
ঋত্বিক বাম রাজনীতি করেছেন। যুক্ত ছিলেন গণনাট্যের সঙ্গে। সেই সব কিছু তিনি ছেড়ে দিয়েছিলেন। কিন্তু যে আদর্শের জন্য ছেড়েছিলেন, সেই আদর্শ প্রথম দিনের মতোই ধরে রেখেছিলেন শেষ দিন পর্যন্ত–সিনেমায় হোক বা নিজের জীবনে। সমরেশ তা পারেননি। এই কারণে সমরেশের প্রতি ক্ষোভ ছিল ঋত্বিকের। এককালে যেই সমরেশের সঙ্গে খালাসিটোলায় বসে মদ গিলতেন, তাকে সিনেমাতেও বিদ্রূপ করেছেন ঋত্বিক। ‘যুক্তি তক্কো আর গপ্পো’ সিনেমার সত্যজিৎ বসু চরিত্রটিকে অনেকে সত্যজিৎ রায় মনে করে। আদতে সেটি ছিল সমরেশ বসুর প্যারোডি। ২০১৩ সালে কমলেশ্বর মুখার্জির ‘মেঘে ঢাকা তারা’য় সমরেশ বসুকে স্পষ্ট করা হয়েছে। অনির্বাণ গুহ অভিনয় করেছিলেন সমরেশের চরিত্রে, নাম ছিল সত্যব্রত। সিনেমায় নীলকণ্ঠরূপী শাশ্বত তাকে পরিচয় করিয়ে দেয় দুর্গার সঙ্গে। বলে, সত্যব্রত আসলে সত্যিকার খেটেখাওয়া মানুষকে নিয়ে লেখে।
সমরেশ বসু অনেকটা বাধ্যই হয়েছিলেন পুঁজিবাদের পথ নিতে। কেননা বিয়ে করেছিলেন অনেকটা অল্প বয়সেই। সন্তান ছিল। সংসার চালাতে হতো। ঋত্বিক ঘটকের মতো নিজের জেদ ধরে রেখে সংসারের সঙ্গে আপস করেননি। নিজে যা বলতে চেয়েছিলেন কাগজে কলমে তা লিখেছিলেন। কিন্তু কমিউনিস্টদের মুখপাত্র যেমন হতে পারেননি, তেমনি কলকাতার কর্পোরেট প্রকাশকদেরও মুখপাত্র হননি। ছিলেন মাঝামাঝি। সে কারণেই হয়তো নির্দিষ্ট কোনো পক্ষ সমরেশ বসুকে প্রতিষ্ঠান হিসেবে তৈরি করেছে। কিন্তু ঋত্বিকের মতোই যে তার মনেও জ্বালা ছিল সেই বিষয় উৎপল দত্তের মধ্যে ঋত্বিক কিছুটা দেখিয়েছিলেন। আর কমলেশ্বর দেখিয়েছেন, সেটা পুরোপুরিই ছিল। কেননা ক্লাবে মদ খাওয়ার সময় পূর্ব বাংলার অবস্থার কথা বলে যখন নীলকণ্ঠকে প্রতি-আক্রমণ করে সত্যব্রত তখন নীলকণ্ঠ বলে, ‘সেটা তোকে ভাবাচ্ছে?’ সত্যব্রত উত্তর দেয়, ‘ভাবাচ্ছে, আর ভাবাচ্ছে বলেই তো গিলছি রে শালা।’
আর সমরেশকে উদ্দেশ করেই ঋত্বিক তার সিনেমায় বলেছিলেন সেই বিখ্যাত সংলাপ, ‘ভাবো ভাবো, ভাবা প্র্যাকটিস করো।’
সমরেশ ভেবেছিলেন। অনেকই ভেবেছিলেন। তার ভাবনার ছাপ পাওয়া যায় প্রতিটা লেখাতেই। কালকূট নামে লেখা বইগুলোতে দেখা যায় মানুষকে নিয়ে তার ভাবনা। সেই ভাবনার সঙ্গে উঠে এসেছে সমাজকে নিয়ে তার ভাবনাও। সমরেশ বসুকে হালে এসে লোকে চিনেছে ‘প্রজাপতি’ দিয়ে। বাংলাদেশের নীলক্ষেতে বইটা বিক্রি হয় ‘একদা নিষিদ্ধ হওয়া’ ট্যাগ দিয়ে। সে কারণে বিক্রিও ভালো। কিন্তু আদতে ওই বইয়ে নিষিদ্ধ হওয়ার কিছু ছিল না। আরো বড় বিষয়, সমরেশের লেখক সত্তার যে উচ্চতা তার সামান্যই উপস্থিত ‘প্রজাপতি’তে। তবে, সমাজভাবনার একটা পরিচয় আছে। ওই বইয়ের খিস্তি, দুটো চরিত্রের মানস ওই সময়ের সমাজের একটা চিত্র তুলে ধরে।
সাহিত্যিক সমরেশ বসুকে মাপতে হয় তার লেখা দিয়েই। আর সেই লেখার দিকে তাকিয়ে প্রথমেই বলতে হয় এমন গোছানো ভাষা দুর্লভ। সুনীল, সমরেশ (মজুমদার), শীর্ষেন্দুদের ভাষা গোছানো কিন্তু তা হয়েছিল সমরেশের অনেক পরে। সেই গোছানো ভাষার একটা উদাহরণ যুগ যুগ জীয়ে। আরেকটি উদাহরণ বিটি রোডের ধারে। কিন্তু এসব বইয়ে কষাঘাত ছিল যা বদলে গেছে কালকূটে। সেখানে কষাঘাত নেই, আছে মরমী বয়ানের মধ্য দিয়ে প্রতিবাদ, কিংবা তার পাঠকের কাছে কিছু বার্তা পৌঁছনোর চেষ্টা। সেটা অবশ্যই করতে পেরেছেন লেখক। কেননা তার কালকূটের লেখাগুলো এক সময় পঠিত হয়েছে ঘরে ঘরে। মানুষের সঙ্গে মিশেছিলেন বলে মানুষের ঘর পর্যন্ত পৌঁছতে পেরেছিলেন।
তার আরেকটি গুণ ছিল যা যে কোনো ভালো লেখকেরই থাকে—পড়াশোনা ও বিশ্লেষণ। কেবল দেখা মানুষকে নিয়েই লেখেননি সমরেশ, লিখেছেন অদেখা মানুষদের নিয়েও। মহাভারত অবলম্বনে লিখেছেন ‘পৃথা’, ‘শাম্ব’। নিছক মহাভারতের গল্প পুনকথন নয়, তিনি করেছিলেন বিশ্লেষণ। পৃথা, তথা কুন্তীকে পৌরাণিক নারী হিসেবে উপস্থাপন না করে তাকে বাস্তবের এক রক্তমাংসের নারী করে তুলেছিলেন। তিনি উপন্যাসের ভূমিকা অংশে যুক্তি দিয়ে বোঝানোর চেষ্টা করেছেন কুন্তীর ক্ষেত্রে সূর্যদেব মূলত কে। একই প্রকারে শাম্ব হয়ে উঠেছে কুরুক্ষেত্র-পরবর্তী সময়ে যাদবদের অবস্থার দর্পণ। এই পুরো বিষয়গুলো সম্ভব হয়েছিল গভীর ও বিস্তৃত অধ্যয়নের মধ্য দিয়ে।
তা বলে মানুষকে দেখার বিষয়ও ছোট করে দেখা যায় না। সমরেশ বসুর আরেক মহৎ কীর্তি ‘গঙ্গা’। এ বই নিয়ে মূলধারায় আলোচনা নেই বললেই চলে। কিন্তু নদীভিত্তিক বাংলা উপন্যাসের নাম করলে গঙ্গা আসবে সবার আগে। ‘পদ্মা নদীর মাঝি’, ‘তিতাস একটি নদীর নাম’ হতেও নদীর বেশি কাছে গঙ্গা। এ উপন্যাসে সমরেশ ব্যবহার করেছেন জেলেদেরই ভাষা। আর পুরো উপন্যাস পড়লে মনে হবে পাঠক সম্পূর্ণ সময় সমুদ্রে বা নদীতে অবস্থান করছেন। এ বিষয়টি সম্ভব হয়েছিল জেলেদের দেখার মাধ্যমে। তাদের সঙ্গে মিশে গিয়ে জীবন, বোধ ও ভাষা আয়ত্ত করার মাধ্যমে। নদী, নদী জীবনের সঙ্গে নারীকেও এঁকেছিলেন সমরেশ। গামলি পাচি বাংলা সাহিত্যের অন্যতম জটিল নারী চরিত্র। বারবার সে মনে করিয়ে দেয় ফুলবাসিয়াকে (যুগ যুগ জীয়ে)।
সমরেশ বসুর এই অনুসন্ধানী যাত্রা অব্যাহত ছিল তার জীবনের শেষ দিন অবধি। উপন্যাস লিখেছেন নানা ধরনের। একটা সময় ব্যক্তির মনকে করেছিলেন লেখার মূল বিষয়। সেখান থেকে ছুটে গেছেন কুম্ভ মেলায়, গেছেন মহাভারতে আবার কখনো সৃষ্টি করেছেন অনুসন্ধানী গোয়েন্দা চরিত্র। এর মধ্যে তার সেরা কাজ হিসেবে অনেকেই নাম করেন ‘দেখি নাই ফিরে’র। রামকিংকর বেইজের জীবনী অবলম্বনে রচিত এ উপন্যাসে পাণ্ডুলিপি সমরেশ বসুর লেখার টেবিলেই ছিল, যখন তার মৃত্যু হয়, তখনো। বহুদিন তিনি সময় দিয়েছেন এর পেছনে। চাননি একটা শব্দও ভুল হোক। এই অভিনিবেশ দেখাতে পারেননি বহু লেখক। সেখানেই সমরেশ ভিন্ন হয়ে ওঠেন।
শুরুতেই বলা হচ্ছিল সমরেশের জীবনে ছিল দ্বৈততা আর দ্বৈধতা। এর কিছু প্রমাণ এখন পর্যন্ত লেখা থেকেই পাওয়া যাচ্ছে। তবু আরো স্পষ্ট করে বলে রাখা যায়, সমরেশ তার প্রথম জীবনে যে আদর্শকে ধারণ করেছিলেন তা পুরোপুরি অনুসরণ করতে না পারার একটা বোধ তার মধ্যে সব সময়ই ছিল। সে কারণেই লেখাকে তিনি বইয়ে দিয়েছেন একাধিক খাতে। এক স্রোতে প্রতিবাদ করতে না পারলেও অন্য স্রোতে করেছেন। কিন্তু তাকেও সংসার করতে হয়েছে। গল্প থেকে সিনেমা হতে পারে বলে গল্পকে করতে হয়েছে নাটকীয়। এই দ্বৈততার আরেক রূপ ছিল তার ব্যক্তিজীবনেও।
নবকুমার বসু, সমরেশ বসুর পুত্র। পিতার জীবন অবলম্বন করে তিনি লিখেছেন একটি বৃহৎ উপন্যাস–চিরসখা।[2]বসু, নবকুমার (২০১৪); চিরসখা, আনন্দ পাবলিশার্স। পিতার জীবন এবং নিজেদের জীবন তিনি তুলে ধরেছিলেন রাখঢাক না রেখে। তার দুই স্ত্রীর বিষয়টি নিয়ে বহুজন বহু রকম কথা বলেন। বিয়ে করেছিলেন সমরেশ ছোট শ্যালিকাকে। একদিকে নবকুমারের উপন্যাস বলে সমরেশের লেখক জীবনে গৌরী বসুর (প্রথমা স্ত্রী) অবদানই বেশি। বয়ান অনেকটা এমন যে গৌরী বসুর জন্যেই সমরেশ বসু লেখক সমরেশ বসু হয়েছেন। সে অন্য তর্ক, এ বিষয়ের অবতারণার প্রয়োজনই ছিল না। তবু করার কারণ, নবকুমারের আগে সমরেশ নিজেই নিজের বিষয়ে খোলাখুলি লিখেছেন। দাম্পত্য না হোক, তার ভক্তকুল এবং সেখানে নারী ভক্তদের বিষয়ে লিখেছেন ‘অমৃত বিষের পাত্রে’য়। এ বইকে অনেকে ‘অমৃত কুম্ভের সন্ধানে’র সিকুয়াল মনে করে। ধারণাটি ভুল এবং সাহিত্যের বিচারে অমৃত বিষের পাত্রের মান অনেকই কম। অমৃত কুম্ভের সন্ধানে সেখানে ক্লাসিক। তবে যে সময়ে এসে অমৃত বিষের পাত্রে তিনি রেখেছেন জীবনের সত্য, তা অনেককেই আশ্চর্য করবে। সে কারণেই সুস্নাত চৌধুরী তাকে নিয়ে লিখেছিলেন, ‘সন্দেহ নেই সমরেশ বসুর জীবন বিতর্কিত ও ব্যতিক্রমী। তাঁর জীবনে কেচ্ছা ছিল, কেচ্ছা থেকে না-পালানোর মতো মহত্ত্বও ছিল।’[3]চৌধুরী, সুস্নাত; দুই বোন দুই বউ, আনন্দবাজার পত্রিকা, ১৭ মে, ২০১৫।
কালকূট বলি, সমরেশ বসু বা ভ্রমর–যে নামেই লিখে থাকুন না কেন সমরেশ, যেই প্রকাশকের জন্যই লিখুন, লেখার ক্ষেত্রে তিনি ছিলেন সৎ। এটিই তার লেখার বড় গুণ। সমরেশকে নিয়ে তার পুত্র নবকুমার বসু লিখেছেন, ‘আটপৌরে, মধ্যবিত্ত, মিষ্টি ভাবনায় তিনি সত্যোচ্চারণকে আড়াল করে রাখেননি, যে কারণে ক্রমশ বোঝা গিয়েছিল, সমরেশ বসু শুধু কল্পনাবিলাস আর খালি হাতে সাহিত্যচর্চা করতে আসেননি। জীবনে ও যাপনে তাঁর সাহস তো ছিলই, তার সঙ্গেই ছিল প্রবল কষ্ট ও যন্ত্রণা সহ্য এবং বহন করার ক্ষমতা। লেখক হওয়ার জন্য আর যা কিছু বোধ, উপলব্ধির সঙ্গেই উল্লিখিত গুণ, তাঁকে ব্যতিক্রমী করে তুলেছিল প্রথম থেকে। অনেক রচনাকারের ক্ষেত্রেই তাঁদের মফস্সলি অথবা শহুরে অভিজ্ঞতা ও জীবনযাপনের সুখী কিংবা ম্লান পৌনঃপুনিকতায় যে একঘেয়েমির সুর ধ্বনিত হয় লেখায়, সমরেশ বসু সেখানে মূর্তিমান ব্যতিক্রম হিসাবে চিহ্নিত হয়েছিলেন, এবং তার জন্য শুধু নিন্দা বা প্রশংসা নয়, লেখকজীবনে খেসারতও কম দিতে হয়নি তাঁকে। স্রোতের বিপরীতে যাওয়া, ভাঙা এবং ভাঙতে ভাঙতেই তাঁর সাহিত্যসৃষ্টির কারিগর হয়ে উঠে আসা।’
আসলেই, কোনোকিছু বাদ দেননি সমরেশ বসু। প্রায় প্রতি দশকেই নিজের লেখার ধারা বদল করেছেন। এক ধারায় লিখে জনপ্রিয়তা পেয়ে লেখকরা সাধারণত ধারা বদল করেন না। সমরেশ করেছেন। নবকুমার লেখেন, ‘অথচ খুব দ্রুতই বোঝা গিয়েছিল লেখার আখর বদলানোর উদ্যোগ করেছেন সমরেশ। কুম্ভমেলায় যাওয়ার সুযোগে যেন আপনসত্তারই আর এক নতুন দিগন্তের সন্ধান পেলেন। কালকূট-এর জন্ম হলেও, অমৃতকুম্ভের সন্ধানে-তেই পায়ের নীচে মাটি পেলেন। কিন্তু না, সেই সাফল্যের মাটি আঁকড়ে না থেকেই রচনার বিষয় আর ক্ষেত্র আবার বদলে ফেললেন। গঙ্গায় মাছমারাদের বিচিত্র জীবন, অনিশ্চয়তা, জল আর তার গভীরে নিঃশব্দ পদসঞ্চারে উঠে আসে যে রুপালি ফসল…সেই দিবারাত্রের বারোমাস্যা সাহিত্য পদবাচ্য হয়ে উঠে এল সমরেশ বসুর কলমে। অথচ পদ্মানদী, তিতাস, ইছামতী থেকে তাঁর ‘গঙ্গা’-র বিস্তার বয়ে গেল।’[4]বসু, নবকুমার, সাহিত্য ও জীবন যখন অঙ্গাঙ্গি, আনন্দবাজার পত্রিকা, ২৯ মার্চ, … Continue reading
বলতে দ্বিধা নেই, একালে এসে সমরেশ বসুকে নিয়ে খুব বেশি আলোচনা হয় না। বাংলাদেশে বছর ছয়েক আগে প্রজাপতি নতুন করে বিক্রি শুরু হয়েছে ‘নিষিদ্ধ’ ট্যাগ দিয়ে। পশ্চিমবঙ্গে অবশ্যই তাকে নিয়ে চর্চা হয় কিন্তু আরও বেশিই হয়তো হওয়ার কথা ছিল। লেখকদের মধ্যে কেউ থাকেন জনপ্রিয় লেখক আর কেউ থাকেন লেখকদের লেখক। সমরেশ বসু একাধারে দুটিই ছিলেন। পাঠককে তিনি দিয়েছেন আনন্দ, দিয়েছেন চিন্তার খোরাক। বিটি রোডের ধারে, বিবর, বাঘিনী তার তুমুল জনপ্রিয় বই। অন্যদিকে কালকূট নামে লেখা বইগুলোও জনপ্রিয়। সমরেশের লেখা এতই জনপ্রিয় হয়েছিল যে তার রচনা থেকে সিনেমাও হয়েছে বেশকিছু। অন্যদিকে তিনি পরবর্তী প্রজন্মের লেখকদের জন্য রেখে গিয়েছিলেন নতুন ধারার ভাষারীতি। উপন্যাস রচনা, গল্প ফাঁদার বহু পথ তিনি রেখে গিয়েছেন এক একটা লেখায়। সমরেশ বসু আজও প্রাসঙ্গিক।
তাকে কালজয়ী বলা যেতেই পারে। না বললেও ক্ষতি নেই। অতিসম্প্রতি অনিতা অগ্নিহোত্রী লিখেছেন, ‘কালজয়ী লেখকের অন্যতম চিহ্ন নিজেকে অতিক্রম করার সাহস। লেখক হিসেবে নিজেকে বারবার ভেঙেছেন সমরেশ বসু। লিখনভঙ্গি, বিষয়, পটভূমি, বদল করতে করতে নয়নপুরের মাটি-র মহিম নামের মৃৎশিল্পীর স্রষ্টা পৌঁছে গেছেন দেখি নাই ফিরে-তে রামকিঙ্করের অরূপ সন্ধানে। উত্তরঙ্গ-র অলঙ্কারে সাজানো ভাষা গঙ্গা উপন্যাসে হয়েছে নদীপ্রবাহের মতো জঙ্গম অথচ গ্রামীণ, বিবর-এ পৌঁছে হয়েছে কৌণিক, ক্ষুরধার, বিদ্রুপ ও প্রত্যাখ্যানে মেশা। পাঠকের মুখ চেয়ে লেখার প্রয়োজনকে সরিয়ে রাখতে পেরেছেন বলে পাঠক তাঁকে অনুসরণ করেছে দীর্ঘ ছ’দশক, আজও করে চলেছে।’[5]অগ্নিহোত্রী, অনিতা, অমৃতের উত্তরাধিকার, দেশ, ১৭ জানুয়ারি, ২০২৪।
[এ বছর ডিসেম্বরে সমরেশ বসুর জন্মের একশ বছর পূর্ণ হবে। শত বছর পরও তাকে নিয়ে কথা বলে যাচ্ছেন উত্তরকালের পাঠক ও লেখক। এ লেখার লেখক ২০২১ সালে প্রকাশিত ‘শকুনি উবাচ’ উৎসর্গ করেছেন সমরেশ বসুকে।]
তথ্যসূত্র:
↑1 | প্রতিক্ষণ, ৫ম বর্ষ, ১৭ সংখ্যা, ২–১৬ এপ্রিল ১৯৮৮। |
---|---|
↑2 | বসু, নবকুমার (২০১৪); চিরসখা, আনন্দ পাবলিশার্স। |
↑3 | চৌধুরী, সুস্নাত; দুই বোন দুই বউ, আনন্দবাজার পত্রিকা, ১৭ মে, ২০১৫। |
↑4 | বসু, নবকুমার, সাহিত্য ও জীবন যখন অঙ্গাঙ্গি, আনন্দবাজার পত্রিকা, ২৯ মার্চ, ২০২২। |
↑5 | অগ্নিহোত্রী, অনিতা, অমৃতের উত্তরাধিকার, দেশ, ১৭ জানুয়ারি, ২০২৪। |