আবদুল্লাহ বিন সাঈদ জালালাবাদীর গুলবাহার

আবদুল্লাহ আল মুনীর

এক.

উসতাদ উচ্ছ্বাসের সাথে বললেন, ‘সচিবালয় মসজিদে জালালাবাদী সাহেবের বড় এক সংগ্রহশালা রয়েছে। তিনি পুরোটাই মাহাদে ওয়াকফ করে দিতে চাচ্ছেন।’ আমরা সচকিত হলাম। এরচে বড় খুশির খবর কী হতে পারে! সবাই আনন্দে লাফিয়ে উঠলাম প্রায়। তবে এই সংগ্রহ উদ্ধার করতে যে রাজ্যের ঝক্কিঝামেলা পোহাতে হবে, তা আমরা তখনও আন্দাজ করতে পারিনি। জালালাবাদী সাহেব ঘরবন্দি মানুষ। কোথাও বের হন না। ফোনে মৌখিক অনুমোদন তো দিয়েছেন, এবার বাকিটা আমাদের বুঝে নিতে হবে। সূত্র হিসেবে দিয়েছেন সচিবালয় মসজিদের মুয়াজ্জিনের ফোন নম্বর। আজ যাবো কি কাল যাবো—এভাবে পেরিয়ে গেলো কয়েকটা দিন। মুয়াজ্জিন সাহেব সময় দিচ্ছেন না। ধুলোর নিচে পড়ে থাকা কিছু বইপুস্তক নিয়ে আমাদের এমন প্রবল আগ্রহ বোধহয় তাকে কিছুটা বিস্মিত করেছিল। একদিন গ্রিন সিগন্যাল পেলাম। মুয়াজ্জিন সাহেব সদয় হয়েছেন। দেরি না করে উসতাদসহ আমরা কজন যতটা দ্রুত সম্ভব বেরিয়ে পড়লাম। যাত্রাবাড়ীর জ্যাম কাটিয়ে বেশ কিছুক্ষণ পর সচিবালয়ের গেইটে হাজির হলাম। মুয়াজ্জিন সাহেব গেইটের কড়া নিরাপত্তাবলয় থেকে আমাদের ছাড়িয়ে ভেতরে নিয়ে যাবেন, এমনটাই কথা। কিন্তু তিনি লাপাত্তা। ফোন ধরছেন না। আমরা একবার জিরোপয়েন্ট, আরেকবার পল্টনে চক্কর দিচ্ছি। দেশের সবচে গুরুত্বপূর্ণ প্রশাসনিক  এলাকায় কিছু আগন্তুককে বারবার চক্কর কাটতে দেখে নিরাপত্তাকর্মীরা কী ভেবে বসে আবার, এ চিন্তায়ও আমরা অস্থির হয়ে উঠলাম।

অবশেষে মুয়াজ্জিন সাহেব এলেন এক নম্বর গেইটে। আমরা দ্রুত ছুটে গেলাম। নিরাপত্তাকর্মীদের বুঝিয়ে বললেন—‘এরা জালালাবাদী সাহেবের লোক।’ তারা কোনো সন্দেহের চাউনি ও চেকিং ছাড়াই আমাদের যেতে দিলেন সচিবালয়ের অন্দরে। বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের ভবন, পরিচ্ছন্ন প্রান্তর, হরেক রকমের ফুলগাছ পেরিয়ে সুনসান নীরবতার ভেতর দিয়ে আমরা সচিবালয় জামে মসজিদে উপস্থিত হলাম। নীরব নিস্তব্ধ পরিবেশ। সিড়ি ভেঙে দ্বিতীয় তলায় উঠলাম। দেখলাম, এক অন্ধকার কোণে ময়লার স্তূপের ভেতর পড়ে আছে জ্ঞানের হিরকখণ্ড। বস্তাভর্তি বই, তার উপর বছরের পর বছর ধুলো জমে যা তা অবস্থা! ইঁদুরের আক্রমণে অনেক বইয়েরই পৃষ্ঠা গুঁড়ো হয়ে গেছে। এই ময়লার রাজ্য থেকে এতগুলো বস্তা অপসারণের কসরতটুকু করতে চায়নি সচিবালয়ের পরিচ্ছন্নকর্মীরা। ভাগ্যিস, এগুলো আস্তাকুড়ে নিক্ষিপ্ত হয়নি৷ হলে আমরা হারাতাম বহু অমূল্য সম্পদ। মুয়াজ্জিন সাহেব দূরে দাঁড়িয়ে আমাদের মতো পাগলদের পাগলামি দেখছিলেন। মনে মনে হয়তো বলছিলেন, ‘যা বাছা! এই আবর্জনা নিয়ে বিদেয় হ!’

আমরা জামা খুলে নাকেমুখে গামছা বেঁধে বই উদ্ধারে নেমে পড়লাম। একেকটি বস্তা টেনে বের করা হচ্ছে, ধুলো ঝেড়ে বস্তা থেকে বইগুলো মসজিদের মেঝেতে নামিয়ে রাখা হচ্ছে, আর উসতাদ মুসা আল হাফিজ উচ্ছ্বসিত কণ্ঠে বলে উঠছেন- ‘আহ! কী দুর্দান্ত বই!’ সংগ্রহশালার বইগুলো একে একে বেরোচ্ছিল, আর আমাদের উচ্ছ্বাস ক্রমাগত বেড়েই চলছিল। সে কি সংগ্রহ! সত্তরের দশকে ইফা থেকে প্রকাশিত সব মাস্টারপিস বইগুলো! (ইফার সম্পাদকমণ্ডলীর সদস্য হবার সুবাদে নিশ্চিতভাবেই জালালাবাদী সাহেব ইফা থেকে প্রকাশিত প্রতিটি বইয়ের সৌজন্য কপি পেতেন) বাংলা একাডেমির বিলুপ্ত হওয়া প্রাচীন সব বই! পাকিস্তান আমলে প্রকাশিত বিভিন্ন বইপুস্তক ও পত্র-পত্রিকা, অগণিত উর্দু-ফারসি-ইংরেজি ভাষার দুর্লভ গ্রন্থ আর অজস্র মহানবী স্মরণিকা! আমরা কোনটা রেখে কোনটা ধরব, সবার অবস্থা পাগলপ্রায়। আশকার ইবনে শাইখ, শাহেদ আলী, ফররুখ, আলী ইমাম, আবদুল মওদুদদের দুর্লভ সব বই আমি একদিকে গুছিয়ে রাখছিলাম। বাকি সঙ্গীরাও নিজেদের পছন্দের বইগুলো আলাদা করছিল। অবস্থা যেন এমন—যে যা পারো লুফে নাও, এ সব তোমার। ওদিকে বস্তার পর বস্তা বেরোচ্ছে। আমাদের অবস্থা কাহিল, গোটা শরীর ধুলোমাখা, হাত নিস্তেজ হয়ে আসছে, তবু উদ্যম সামান্য হ্রাস পাচ্ছে না। নতুন নতুন আবিষ্কারের নেশায় উন্মত্ত হয়ে উঠল সবাই।

সকাল গড়িয়ে দুপুর, দুপুর গড়িয়ে বিকেল। মুয়াজ্জিন সাহেব দুপুরে আমাদের ডিমসেদ্ধ খাওয়ালেন। এটুকুর জন্য আমরা তার প্রতি কৃতজ্ঞ। বিকেল নাগাদ আমাদের গোছগাছ শেষ হলো। সবাই ক্লান্ত, তবু মুখে তৃপ্তির হাসি। আচমকা মুয়াজ্জিন সাহেব এসে জানালেন, ‘উপর থেকে অর্ডার এসেছে, এভাবে সচিবালয় থেকে কাগজপত্র বের করা যাবে না।’ আমাদের হাসিমুখে বিষাদের ছায়া নেমে এলো। হঠাৎ কী হয়ে গেলো! কার পারমিশন লাগবে! কোন প্রসেসে এসব বের করা যাবে! এসব কথাবার্তা আমাদের মাথার উপর দিয়ে যেতে থাকল।

সেদিন বিকেলে আমরা পরাজিত যোদ্ধার মতো সচিবালয় ছেড়ে মাহাদে ফিরে এলাম। জালালাবাদী সাহেব সব শুনে দুঃখ পেলেন। তিনি আশ্বাস দিলেন, প্রয়োজনে উচ্চপদস্থ ব্যক্তিদের মধ্যস্থতায় এ সমস্যার সমাধান করবেন। ওদিকে মুয়াজ্জিন সাহেবের হুলিয়া বদলে গেল। গলার স্বর পালটে গেলো বলতে থাকলেন—‘এসব এইভাবে বের করা যাবে না। সমস্যা আছে। এইখানে মসজিদের বইপুস্তক আছে। সব বই জালালাবাদী হুজুরের না।’ পুরোটাই মিথ্যে। জালালাবাদী সাহেব বলছিলেন, মসজিদে থাকা সকল বইপুস্তক তার ব্যক্তিগত সংগ্রহ। এমনকি বই রাখার প্রকাণ্ড লোহার র‌্যাকটিও তার। এই সবকিছু তিনি আমাদের হাওয়ালা করতে চান। আমরা আরও পোক্ত নিয়ত করে বসলাম, যে করেই হোক, বইগুলো সচিবালয় থেকে বের করবোই।

দুদিন পর মুয়াজ্জিনের কল এলো। স্বর কিছুটা নরম হয়েছে ততক্ষণে। উর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের সম্মতি পাবার পর তিনি জানালেন, ‘বইগুলো নিয়ে যেতে পারেন।’ আমরা আবারও সোচ্ছাসে ছুটে চললাম সচিবালয়ে। সেদিন বিকেলে মাহাদে এসে পৌঁছল একটি মিনি ট্রাকভর্তি প্রায় ত্রিশ বস্তা বই। মাহাদের ছাদে বস্তাগুলো রাখা হলো। মুয়াজ্জিনের মতো আমাদের বাড়িওয়ালাও আশ্চর্যচোখে তাকিয়ে বোধহয় মনে মনে ভাবলেন, এ কেমন পাগলামি এদের! আমরা তখন উৎসবে মুখর। দ্বিতীয় দফায় মাহাদের ছাদ থেকে ধুলো ঝেড়ে ঝেড়ে বইগুলো নিচে নামানো হলো। র‌্যাকে তোলা হলো। তালিকা করা হলো। এরপর নবীন গবেষকরা গভীর নিমগ্নতায় ডুব দিল মহান জালালাবাদীর ব্যক্তিগত সংগ্রহশালায়।

দুই.

উল্লেখ্য, জালালাবাদী সাহেব তার বর্ণাঢ্য কর্মমুখর জীবনে যেখানে আস্তানা গেড়েছেন, সেখানেই গড়ে উঠেছে বই-পুস্তকের পাহাড়। আমরা শুধু সচিবালয়ে থাকা সংগ্রহ উদ্ধার করেছিলাম। এ ছিল তার সবচে ক্ষুদ্র সংগ্রহশালা। এর আগে তিনি তার সংগ্রহে থাকা প্রায় সমস্ত আরবি-উর্দু কিতাবাদি মারকাযুদ্দাওয়াহ আল ইসলামিয়ায় ওয়াকফ করে দিয়েছিলেন। আমরা শুনেছি, মোহাম্মদপুরের বাসা থেকে ট্রাকভর্তি কিতাবাদি উদ্ধার করেছিলেন মাওলানা আবদুল মালেক হাফিজাহুল্লাহ। তার এ বিশাল জ্ঞানভান্ডার ব্যবহারের উপযুক্ত হতে পারেনি পারিবারিক উত্তরসূরিরা। একদিন সাক্ষাতে এ নিয়ে কথা উঠতেই তিনি আবেগাপ্লুত হয়ে পড়েছিলেন।  

তিন.

মাহাদ থেকে ফারাগাতের পর আমি ইত্তিহাদ পাবলিকেশনে যুক্ত হই। চাকরিজীবনের কয়েক মাস পেরোতেই সিয়ারুস সাহাবা প্রোজেক্টের দায়িত্ব অর্পিত হয় আমার কাঁধে। বাংলা ভাষায় অনূদিত সর্ববৃহৎ সাহাবি-তাবেয়ি-তাবেতাবেয়ি বিশ্বকোষ যখন সমাপ্তির মুখে, আমরা এর অভিমত নেবার জন্য বরেণ্যদের তালিকা করলাম। শুরুতেই যে নামটি অনিবার্য হয়ে উঠল, তা হচ্ছে আবদুল্লাহ বিন সাঈদ জালালাবাদী। আমরা জানতাম তিনি এখনও লিখেন, কথাবার্তাও বলতে পারেন। তাই হিম্মত করে শুরুতেই তার সঙ্গে সাক্ষাতের বন্দোবস্ত করলাম। তরুণ গদ্যশিল্পী মুজিব হাসান ভাই আমাদের সহায়তায় এগিয়ে এলেন। তাকে সঙ্গে নিয়েই প্রথমবারের মতো হাজির হলাম পল্লবীতে, আমাদের স্বপ্নপুরুষ আবদুল্লাহ বিন সাঈদ জালালাবাদীর বাসায়।

কলিংবেল শুনে দরজা খুলে দিলেন তিনি নিজেই। হাসিমুখে সাদর অভ্যর্থনা জানালেন। প্রথমবারের মতো আমি তাকে দেখলাম। পরনে সাদামাটা পাঞ্জাবি-লুঙ্গি, চিরাচরিত লম্বা টুপি। কিছুটা নিচু হয়ে হাঁটেন। দেখে তো মনে হলো না—এ লোকটিই সদর্পে রাজত্ব করেছেন বাংলাভাষার জ্ঞানসাম্রাজ্যে। ইফার ঢাউস ঢাউস সব বিশ্বকোষ দক্ষহাতে সম্পাদনা করেছেন। দৈনিক ইত্তেফাকে ‘রমনার মৃত্তিকাগর্ভে বিদেহী আত্মার সম্মেলন’ লিখে কাঁপিয়ে দিয়েছেন, আলোচিত হয়েছেন বুদ্ধিজীবিমহলে। আমি অপলক তাকিয়ে রইলাম।

এরপর বৈঠকখানার সোফায় বসে কী সহজ-সরল ভঙিমায় বৈচিত্র্যময় জীবনের নানা স্মৃতি মেলে ধরলেন আমাদের সামনে। মনে হলো আমাদের সমবয়েসি অতি ঘনিষ্ঠ কেউ কথা বলছেন, অথচ তিনি আমাদের উসতাদকে নাতি সম্বোধন করেন। নেই কোনো আত্মঅহমিকা বা দম্ভ, মাটির মতো সহজ হয়ে আমাদের সাথে মিশে গেলেন। আমরা শুধু মুগ্ধতা নিয়ে তাকিয়ে রইলাম বহুদর্শী বিচক্ষণ চোখদুটোর দিকে। উদ্যমে উচ্ছ্বাসে ঠিকরে বেরোতে চাচ্ছে যেন। আর কত সহস্র পৃষ্ঠা হজম করতে পারে এ দুটি চোখ! জালালাবাদী সাহেব নম্র, সাবলীল, আত্মমর্যাদাবান, অভিজ্ঞতালব্ধ, নিষ্ঠাবান মানুষ। তার জীবনগল্প থেকেই এর প্রমাণ মিলছিল। সেদিন আমাদের আলোচনা বিকেল থেকে শুরু হয়ে রাত অবধি দীর্ঘায়িত হয়। ঠিক যা কিছু আলাপ হয়েছে আমাদের, তা আমার দুই সঙ্গী মুজিব হাসান ও রাশেদ মুহাম্মাদ ভালো লিখতে পারবে। আমি এ পর্ব ছেড়ে এগিয়ে যাই। মাগরিবের পর তিনি অভ্যাসমাফিক মামুলাত আদায় করলেন, মুখে মুখে উচ্চারণ করিয়ে আমাদেরও শিখিয়ে দিলেন ওজিফা। আমরা লিখেও নিলাম। ঠিক মামুলাতের পর প্রথমবারের মতো জানলাম, তিনি জাফর আহমদ ওসমানি রহ.-এর খলিফা। আরও শুনলাম, তকি উসমানি হাফিজাহুল্লাহ একসময় উনার বন্ধু ছিলেন। খুব চেয়েছিলেন তাকে পাকিস্তানে নিয়ে যেতে। বলেছিলেন, ‘তুমি আমার সঙ্গে করাচি চলো। দুজন মিলেমিশে ইসলামের খেদমত করব।’ কিন্তু জালালাবাদী সাহেব বন্ধুর এ আবদারে সাড়া দিতে পারেননি প্রিয়তম বাবার দিকে তাকিয়ে। বাবা তার স্নেহের সন্তানকে এতদূরে পাঠাতে চাননি।

সেদিন তার টেবিলে দেখেছিলাম তাফসীরে জিলানীর চতুর্থ খণ্ডের অনুবাদ-পাণ্ডুলিপি। তিনি তখন প্রুফ দেখছিলেন। তিনি জানালেন, ভারতীয় উপমহাদেশের সর্বপ্রথম উর্দু তাফসিরগ্রন্থ—মাওলানা মুরাদুল্লাহ রহ.-এর তাফসিরে মুরাদিয়্যার অনুবাদ করেছেন। ডক্টর হামিদুল্লাহ রচিত সিরাত মুহাম্মাদুর রাসুলুল্লাহসহ আরও বেশ কটি গ্রন্থের কাজ নিকট অতীতে শেষ করেছেন। আমরা তার কর্মতৎপরতা দেখে হতবাক হলাম। নিজেদের অলসতা ও কর্মউদ্যহীনতার ওপর আক্ষেপ জন্মাল খানিক। 

সিয়ারুস সাহাবার প্রথম খণ্ডের খসড়া পাণ্ডুলিপি আমরা সঙ্গে নিয়ে গিয়েছিলাম। তিনি তা দেখে ভূয়সী প্রশংসা করলেন। সেই সাথে বিভিন্ন বিষয়ে সমালোচনাও করলেন। তবে আমাদের উদ্দেশ্য সফল হলো। তিনি অভিমত দেবেন বলে জানালেন। কোরবানির ঈদ আসন্ন ছিল। তিনি বললেন ঈদের পর একদিন এসে অভিমত নিয়ে যেতে। তিনি লিখে রাখবেন। আমরা খুশিমনে সায় দিলাম। সেদিন সাহসী এক কাজ করে বসেছিলাম। আমার উপন্যাস শরিয়তনামা তখন প্রকাশিতব্য। পাণ্ডলিপি সঙ্গেই ছিল। আসার সময় তাকে দেখালাম। তিনি দেখে খুশি হলেন এবং উৎসাহ দিলেন। সুযোগ করে পড়বেন বলে পাণ্ডুলিপি রেখে দিলেন। অপার্থিব আনন্দের অনুভূতি নিয়ে সেদিন পল্লবীর বাসা থেকে বের হয়েছিলাম।

চার.

ঈদের পর অফিস খুলতেই একদিন ফোন দিলাম। হুজুর জানালেন, ‘অভিমত লিখে রেখেছি, তুমি আসো একদিন।’ বললাম, ‘তাহলে কালই যাই!’ তিনি বললেন, ‘হ্যাঁ এসো। বিকেল করে এসো।’ পরদিন দুপুরের পরই বেরোলাম। এবার আমি একা; সঙ্গিহীন। বেশ ভয়ও লাগছিল। তবে তার অমায়িকতার কথা ভেবে আবার নিশ্চিন্ত হচ্ছিলাম। বাংলাবাজার থেকে মিরপুরে যাওয়া চাট্টিখানি কথা নয়। আমি যখন পল্লবী ঝিল মসজিদে পৌঁছলাম, তখনও আসরের আজান হয়নি। এ সময় তিনি বিশ্রাম করেন। এ ভেবে বাসায় না গিয়ে মসজিদে বসে রইলাম। আসরের নামাজ হলো। তিনি মসজিদে এসেই নামাজ পড়েন, কিন্তু এদিন এলেন না। আমি নামাজ পড়ে বাসায় গেলাম। তিনি দরজা খুলে ঠিক সেদিনের মতো হাসিমুখে কিছুটা আড়ষ্টকণ্ঠে অভ্যর্থনা জানালেন। সেইসাথে বললেন, ‘ঘুমের তাড়নায় জামাতে শরিক হতে পারলাম না।’ তার মুখে আফসোস শুনে মনে হলো, বড্ড অপরাধ হয়ে গেছে। অথচ আশি পেরোনো ন্যুব্জ শরীর নিয়ে ব্যস্ত পথঘাট পেরিয়ে মসজিদে যাওয়াটাই আমার কাছে মহা-আশ্চর্যের বলে মনে হয়েছিল।

সেদিন আমরা বৈঠকখানায় বসেছিলাম। আজ সুযোগ পেলাম ভেতরঘরে যাবার। প্রকাণ্ড ফ্ল্যাটের শুরুরদিকে থাকা এ কামরাটি জালালাবাদী সাহেবের একান্ত নিজের। ভেতরে প্রবেশের পর বুঝলাম, এখানেই তিনি নিঃসঙ্গ জীবনযাপন করেন। পরিবারের অন্য সদস্যদের ঘর লম্বা ডাইনিং স্পেস পেরিয়ে আরও ভেতরে। কামরায় বড় একটি খাটে এলোমেলো বই-পুস্তক ও খাতা-কলম। একদিকের সেলফে বেশ কিছু বইপুস্তক সাজানো। এই শেষজীবনেও তিনি গড়ে তুলেছেন ছোট্ট একটি সংগ্রহশালা। দেখে অদ্ভুত এক অনুভূতি হলো আমার। ভাবলাম, তার জীবনের সকল ব্যক্তিগত বই-পুস্তক যদি সংরক্ষণ করা হতো, তাহলে পল্লবীর এ বিশাল ফ্ল্যাটেও জায়গা হতো কি? তিনি রাখেননি। যারা পড়ুয়া, তাদের খুঁজে খুঁজে বিলিয়ে দিয়েছেন। কেন রাখবেন? সন্তানরা পড়ুয়া নয়, বই-পুস্তক তাদের নিকট বোঝা। এ নিয়ে বড্ড আফসোস ছিল তার।

‘তোমার শরিয়তনামা তো সুন্দর কাজ হইছে। দারুণ লিখেছো। আমার আহলিয়াকেও দিয়েছিলাম পড়তে। আমিও পড়েছি। কিছু অংশ প্রুফ দেখে দিয়েছি। তোমার ইচ্ছে হলে ওগুলো কারেকশন কোরো। আমি আমার মতো করে দাঁগিয়েছি।’

আমি স্তব্ধ হয়ে গেলাম। চাপা আনন্দ আমাকে বিমূঢ় করে দিলো। কী বলবো বুঝতে পারছিলাম না। তিনি পরবর্তী আলাপে গেলেন।

‘তোমাদের সিয়ারুস সাহাবার অভিমত তো লিখলাম। দেখো তো পড়তে পারো কি না।’

আমি কাঁপা হাতে ডায়েরি হাতে নিলাম। জড়ানো প্যাঁচালো হস্তলিপির সামান্য অংশ উদ্ধারও আমার পক্ষে অসম্ভব হয়ে দাঁড়ালো। বললাম,

‘আমি তো বুঝতে পারছি না!’

তিনি রসিকতা করে বললেন, ‘তুমি বিচক্ষণ ছেলে। ‍বুঝবে বুঝবে।’

কিন্তু সত্যিই আমি বুঝতে পারিনি৷ শেষমেশ সাহস করে প্রস্তাব দিলাম, ‘আপনি আপনার লেখা পড়ে শোনান। আমি রেকর্ড করে নিই। পরে রেকর্ড শুনে এবং লেখা দেখে সমন্বয় করে নেবো।’ তিনি সহসা রাজি হয়ে গেলেন। আমার স্মার্টফোনে রেকর্ডার অন করলাম। তিনি তার স্বভাবজাত ভঙিতে পাঠ করে চললেন :

‘এই গতমাসেই (১৫ই জৈষ্ঠ্য, ২৯ মে, ২০২৩ সাল) সৌর হিসাবে ৮২তম এবং চান্দ্র হিসাবে ৮৫তম বছরে পদার্পণ করেছি। তাই লেখক-অনুবাদক-প্রকাশকরা যখন তাদের প্রকাশিতব্য পুস্তিকাদিতে একটি বাণী লিখে দেওয়ার দাবি নিয়ে গরিবালয়ে উপস্থিত হন, তখন কেন যেন মনে হয়, জীবনের পালা সাঙ্গ হতে যাচ্ছে মনে করেই তারা বাণী ও দু’আ গ্রহণের বাহানায় আমাকে সেই চিরসত্যটি স্মরণ করিয়ে দিচ্ছেন।…’

পুরো অভিমত রেকর্ড শেষ করলাম, ততক্ষণে মাগরিবের আজান হয়েছে। তিনি নিজহাতে সম্ভবত হরিণের চামড়ার তৈরি মুসল্লা বিছিয়ে দিলেন। আমার ইমামতিতে মাগরিব শেষ হলো। মামুলাত শেষে আবার আমরা বিছানায় বসলাম। এবার তিনি আমাকে জিজ্ঞেস করলেন, ‘তুমি কি ফার্সি বুঝো?’ বললাম, ‘জি কিছুটা।’ বিনয়সুলভ কণ্ঠে বললেন, ‘আমিও ভাঙাচোরা কিছুটা বুঝি। তোমাকে একটা উপহার দেবো। আমি তোমাকে উৎসর্গ করে আজই একটা কবিতা লিখেছি। তুমি একবার পড়ো।’ আমি বিস্ময়ে নির্বাক হয়ে গেছি ততক্ষণে। ঠোট কেঁপে কেঁপে উঠছে। তিনি আমাকে উৎসর্গ করে কবিতা লিখেছেন! আমি কে! আমার মতো নাচিজ কি এর ভার বইতে পারবে! এরইমাঝে তিনি আবার বললেন, ‘শেষ সময়ে এসে তোমার সঙ্গে পরিচয় হলো। আহ! আরও আগে হলে কত ভালো হতো।’ আমার বড্ড কান্না পেলো। মনে মনে নিজেকে বললাম, ‘তোমার জীবনখাতায় আরেকটি অর্জন যোগ হলো। তুমি এর যোগ্য নও। মোটেও যোগ্য নও।’

জালালাবাদী সাহেব ডায়েরির পৃষ্ঠা মেলে ধরে আবার বললেন, ‘পড়ো।’ আমি ভাঙাকণ্ঠে আবৃত্তি করলাম,

নয়নের নীরে বাধিয়াছ মোরে করিতেছি ছটফট

দহিত হৃদয়ে বারি সিঞ্চনে চলে এসো ঝটপট

چہل دوگانہ گذشت از حیات من

بحمد اللہ بہار نہ گذشت از ایں چمن

سر سبز ایں چمن است از گل و بہار

گل و بلبل موجود است ہر لیل و نہار

گرچہ عبد مشغول است در عبادت

لیکن ضبط چشم ایک مشکل ریاست

خالق ہر حسن و جمال لاٸق حمد

ناراض مکن بر  من از ایں شریت عبد

گفتی تو بنگاں را ضعیفا

چہ عجب ایں ضعیف است خلیفہ؟

জালালাবাদী, ৯ জুলাই ২০২৩

ফার্সি অংশটুকুর মর্মার্থ এমন দাঁড়ায়, ‘জীবন থেকে আশিটি বছর অতিবাহিত হয়ে গেছে, প্রভুর করুণায় বসন্ত ফুরোয়নি এ বাগানে। বসন্তের সবুজ শ্যামল এ বাগানে, দিবারাত্রি বিচরণ করে ফুল ও বুলবুলিরা। যদিও বান্দা ইবাদতে সদা মশগুল, তবে দৃষ্টিশক্তি নিয়ন্ত্রণ বেশ কষ্টসাধ্য হয়ে গেছে। সকল সৌন্দর্যের অধিপতি প্রভু কেবল প্রশংসার অধিকারী, তোমার এ বান্দার অসদাচরণে নারাজ হোয়ো না প্রভু। তুমিই তো বলেছ তোমার বান্দা অতিশয় দু্র্বল! হতবাক হই, এ দুর্বল বান্দাকেই তুমি বসিয়েছো পৃথিবীর নেতৃত্বে।’

আবদুল্লাহ বিন সাঈদ জালালাবাদীর হস্তাক্ষর

কাাঁপাকণ্ঠে আবৃত্তি শেষে আমার চোখ লাল হয়ে উঠলো। বিব্রত ও হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে রইলাম ডায়েরির পাতায়। তিনি কিন্তু আগের মতোই সাবলীল। শরিয়তনামার পাণ্ডুলিপি পাশেই রাখা ছিল। তিনি তা এগিয়ে দিয়ে বললেন,

‘দেখো! আমি তোমার সুর্যোদয়কে অরুণোদয় করে দিয়েছি। এভাবেই সুন্দর লাগছে। তবে তুমি রাখলে রাখতে পারো, চাইলে নাও রাখতে পারো। আমি আমার মতো করে দেখেছি।’ (শরিয়তনামার দ্বিতীয় পর্বের শিরোনাম ছিল ‘শামাইলে সুর্যোদয়’, তিনি তা ‘শামাইলে অরুণোদয়’ করে দিয়েছিলেন। বইয়েও তেমনটা রেখেছি।)

আমি পাণ্ডুলিপি নিয়ে খুলে দেখবার হিম্মত করলাম না। চুপচাপ বসে রইলাম। তিনি বলছিলেন, ‘এ বয়সে লেখালিখি জটিল হয়ে গেছে। আমার প্রয়োজন ছিল একজন সহকারী। যে আমার পাশে বসে শ্রুতিলিখন করবে।’ আমিও সায় দিলাম। বললাম, ‘এমন কাজের জন্য আমি কাউকে খুঁজে বের করব।’

আরও বিভিন্ন বিচিত্র আলাপসালাপের পর আমি বিদায় নিতে চাইলাম। তিনি বরাবরের মতো দরজা পর্যন্ত এগিয়ে এলেন। লিফটের দরজা বন্ধ হবার আগে সালাম দিলেন। এর আগেই বলেছিলেন, ‘আমার দরবারে তোমাকে যেকোনো সময় স্বাগতম।’

লিফটে দাঁড়িয়েই শরিয়তনামার পাণ্ডুলিপি খুলে দেখলাম। প্রায় ষোলো পৃষ্ঠা তিনি অত্যন্ত নিখুঁত দৃষ্টিতে দেখেছেন, সম্পাদনার পেশায় আছি বলে এ আমার বুঝতে বেগ পেতে হলো না। লাইনে লাইনে বাক্যাংশ কেটে নিজের মতো করে যুক্ত করেছেন নতুন কিছু। একটি পর্বের শেষে তিনি নোট লিখেছেন, ‘চমৎকার প্লট নাতি। চমৎকার ভাষার গাঁথুনি।’ এরপর স্বাক্ষর ও তারিখ। অযোগ্য হাতে এ সার্টিফিকেট নিয়ে আমি পল্লবী ছেড়ে বাংলাবাজার ফিরে এলাম।       

তার গলার স্বর এখনও ভুলিনি, মায়াবি চেহারা মনের ক্যানভাসে জ্বলজ্বল করছে, অথচ তিনি চলে গেলেন। শেষজীবনে আমাদের মতো অতি নগণ্য ভক্তের সাহিত্যানুরাগ দেখেই কি তিনি কবিতা বেঁধেছিলেন, ‘প্রভুর করুণায় বসন্ত ফুরোয়নি এ বাগানে। বসন্তের সবুজ শ্যামল এ বাগানে, দিবারাত্রি বিচরণ করে ফুল ও বুলবুলিরা।’ আমরা কি জালালাবাদীর সবুজ বাগানে সুবাসিত ফুল হয়ে ফোঁটার মতো যোগ্য হয়েছি? নাকি বয়সের ভারে ন্যুব্জ জালালাবাদী সাহেব একাকিত্বের বেদনাবিধুর স্মৃতি ভুলে যেতে আবেগতাড়িত হয়ে লিখেছিলেন পঙ্‌ক্তিগুলো! নয়নের নীরে কে বেঁধেছিল সময়কে শাসন করে দাপিয়ে বেড়ানো লেখককে! দহিত হৃদয়ে কাকে ডেকেছেন এ অগোছালো হুজরায়! কোটর ছেড়ে বেরিয়ে আসা বহুদর্শী চোখদুটোর বারি সিঞ্চনের হিম্মত আছে কার! প্রশ্নগুলোর উত্তর খুঁজে বেড়াব আমৃত্যু। গোলকধাঁধার এ কবিতা আমার আরও বহু রাতের নিদ্রা কেড়ে নেবে হয়তো। কানের কাছে খুব নিকট থেকে তার আবৃত্তি বেজে উঠবে, ‘সর সবজ ইঁ চমনাস্ত আজ গুল ও বাহার, গুল ও বুলবুল মওজুদাস্ত হার লাইল ও নাহার।’    

লেখকের পাণ্ডুলিপি পাঠ শেষে আবদুল্লাহ বিন সাঈদ জালালাবাদীর মন্তব্য

বিজ্ঞাপন

Subscribe
Notify of
guest
1 Comment
Oldest
Newest Most Voted
Inline Feedbacks
View all comments
রুহান আত্তাফ
রুহান আত্তাফ
1 year ago

বাহ

স্বত্ব © ২০২৩, যোগাযোগ | ই মেইল : jogajogbd.org@gmail.com

যোগাযোগ-এ প্রকাশিত কোনো লেখা, ছবি কিংবা শিল্পকর্ম লেখক অথবা কর্তৃপক্ষের অনুমতি ছাড়া কোথাও প্রকাশ করা অবৈধ৷