[1]Henry Kissinger, War Criminal Beloved by America’s Ruling Class, Finally Dies
–Ruling Stone
২৯ নভেম্বর আমেরিকান ম্যাগাজিন রুলিং স্টোনের করা এই সংবাদ শিরোনামের সহজ বাংলা–আমেরিকান শাসকগোষ্ঠীর প্রিয়জন যুদ্ধাপরাধী হেনরি কিসিঞ্জার অবশেষে মারা গেল। শিরোনামটিতে উটকো ঝামেলা দূর হবার ফলে বেরিয়ে আসা স্বস্তির দীর্ঘশ্বাসের ছাপ স্পষ্ট।
অথচ রেড ইন্ডিয়ানদের গণহত্যার মাধ্যমে ইতিহাসে নিজেদের একটি চিরন্তন বর্ণবাদী আগ্রাসি জাতি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করা আমেরিকানদের কাছে হেনরি কিসিঞ্জারের মতো একজন আগ্রাসি মাস্টারমাইন্ড ভালোবাসার পাত্র হওয়াটাই ছিল স্বাভাবিক। কিন্তু নিত্য নতুন সন্ত্রাস, গণহত্যা এবং যুদ্ধাপরাধের ইতিহাস রচনা করা আমেরিকানরা হয়তো চায়নি পুরনো কোনো কলঙ্কের কারণে তাদের স্মরণ করা হোক। তাই তো শত বছর হয়ে যাবার পরও যখন হেনরি কিসিঞ্জার নামক উটকো ঝামেলা দূর হচ্ছিল না, তখন আমেরিকারই আরেক ম্যাগাজিন The Nation সংবাদ শিরোনাম করেছিল–Henry Kissinger, War Criminal—Still at Large at 100.
কলঙ্কের গ্লানি কিংবা মানবিক পাপবোধ–যেটাই হোক হেনরি কিসিঞ্জার যখন আমেরিকানদের একটি বড় অংশের নিকট অপ্রিয় হয়ে উঠেছিল, তখনও এ যুদ্ধাপরাধী আমেরিকার বর্ণবাদী শাসকশ্রেণির কাছে ছিল অত্যন্ত প্রিয় পাত্র। এই প্রিয় পাত্র হবার পেছনে সবচেয়ে বড় যুক্তি–কিসিঞ্জারের হাতে লেগে থাকা লাখ লাখ নিরপরাধ আদম সন্তানের রক্ত। গণহত্যার শপথ নিয়ে ক্ষমতায় আসা আমেরিকার শাসকশ্রেণি ক্ষমতার পালাবদল সত্ত্বেও কিসিঞ্জারের রক্তে রঞ্জিত হাত ছাড়েনি কখনও। অবশ্য এর প্রতিদান দিতেও ভুলেনি কিসিঞ্জার। নিজের যুদ্ধপ্রিয় মগজ দিয়ে তাদের সহায়তা করে গেছে আমৃত্যু।
১৯২৩ সালে জার্মানির এক ইহুদি পরিবারে জন্ম নেওয়া হেইঞ্জ আলফ্রেড কিসিঞ্জার ১৯৩৮ সালে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় হিটলারের ইহুদিবিরোধী উত্তাপ থেকে বাঁচতে পরিবারের সঙ্গে আমেরিকায় পালিয়ে যায়। এরপর আমেরিকার নাগরিকত্ব পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে হেইঞ্জ আলফ্রেড কিসিঞ্জার হয়ে যায় হেনরি কিসিঞ্জার। জার্মান ভাষায় দক্ষতা এবং কূটনৈতিক পারদর্শিতার বদৌলতে ১৯৫২ সালে হার্ভার্ড ইউনিভার্সিটিতে পড়াশোনা চলাকালীন আমেরিকার সাইকোলজি স্ট্রাটিজিক বোর্ডে নিয়োগ দেওয়া হয় তাকে। এই বোর্ডের কাজ ছিল–দেশে দেশে গড়ে ওঠা সমাজতান্ত্রিক শাসনের বিরুদ্ধে কাজ করা এবং যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষে প্রোপাগান্ডা চালানো। পাশাপাশি তার আরেকটি দায়িত্ব ছিল–হার্ভার্ডে অনুষ্ঠিত বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সম্মেলনে আগত বিদেশি অতিথিদের উপর এফবিআইয়ের হয়ে গোয়েন্দাগিরি করা। তবে কিসিঞ্জার আন্তর্জাতিক মহলে আলোচিত এবং সমালোচিত হয়ে ওঠে যুক্তরাষ্ট্রের পারমাণবিক অস্ত্র এবং পররাষ্ট্রনীতি সম্পর্কে তার লেখা নিউক্লিয়ার ওয়েপেন এন্ড ফরেইন পলিসি নামক বইটি প্রকাশের পর। এই বইয়ে কিসিঞ্জার যুক্তরাষ্ট্রের বিজয় নিশ্চিত করতে নিয়মিত পারমাণবিক বোমা ব্যবহারের পরামর্শ দিয়েছিল। ১৯৫৭ সালে এ বই প্রকাশিত হবার পর সমালোচকরা তার নাম দেন–হেনরি কিলিঞ্জার। কুখ্যাত এই যুদ্ধাপরাধীও যথাযথ মর্যাদায় সমালোচকদের দেওয়া এই নামের মান রেখেছিল।
১৯৭৩ সালে যখন কিসিঞ্জারকে নিক্সন সরকারের পররাষ্ট্রমন্ত্রী করা হয় সে বছরই কম্বোডিয়ায় চলমান মার্কিন আগ্রাসনের গতি বাড়ানোর নির্দেশ দেয়। তার নির্দেশেই কম্বোডিয়ায় কার্পেট বোমা ফেলা শুরু হয়। যাতে কমপক্ষে দেড় লাখ নিরপরাধ বেসামরিক মানুষ নিহত হন। এ নৃশংস গণহত্যার ফলে যখন আন্তর্জাতিক মহলে সমালোচনা শুরু হয়, তখন কিসিঞ্জার বলেছিল–আমার মনে হয় কম্বোডিয়ানদের নিয়ে সমালোচকরা বেশি মাতামাতি করছে। কম্বোডিয়া ছাড়াও ভিয়েতনাম চিলি আর্জেন্টিনা লাওস অ্যাঙ্গোলা পূর্ব তিমুরসহ পৃথিবীর বিভিন্ন ভূখণ্ডে গণহত্যায় প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষ মদদ দিয়ে গেছে কিসিঞ্জার। বলা হয় পৃথিবীর প্রায় ২০ লাখ সাধারণ মানুষের রক্ত লেগে আছে এ ইহুদি সিরিয়াল কিলারের হাতে।
মার্কিন সাম্রাজ্যবাদী স্বার্থ হাসিলের লক্ষ্যে ড. হেনরি কিসিঞ্জারের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ মদদে চালানো এসব গণহত্যার তালিকায় আছে আমাদের বাংলাদেশের মুসলানও।
১৯৭১ সালে তৎকালীন পশ্চিম পাকিস্তানের পাঞ্জাবি শাসকগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে যখন পূর্ব পাকিস্তানের সাধারণ মুসলিম জনতা বিদ্রোহ করে, তখন এ শোষকশ্রেণি বাঙালি মুসলমানের উপর নৃশংস গণহত্যা শুরু করে। পূর্ব পাকিস্তানের মুসলমানও ন্যায্য স্বাধীন ভূখণ্ডের দাবিতে অস্ত্র ধারণ করে। শুরু হয় মুক্তিযুদ্ধ। এ যুদ্ধে কিসিঞ্জার আরও একবার তার চিরন্তন জুলুম সর্বস্ব পররাষ্ট্রনীতির ঝলক দেখায়। যুদ্ধের সূচনা কালেই এ খুনি পাকিস্তানি ঘাতক জেনারেল ইয়াহিয়া খানকে মৌখিক সমর্থন দেয়। কিন্তু যুদ্ধের পরিস্থিতি ক্রমশ বাঙালি মুসলমানের পক্ষে ঝুঁকে পড়তে শুরু করলে কিসিঞ্জার তৎকালীন মার্কিন প্রেসিডেন্ট নিক্সনকে জর্ডানের মাধ্যমে পশ্চিম পাকিস্তানের পক্ষে যুদ্ধ বিমান ব্যবহারের পরামর্শ দেয়। কিন্তু তীব্র সমালোচনার আশঙ্কায় এ পরিকল্পনা শেষাবধি বাস্তবায়িত হয়নি। তবে জালেম পাকিস্তানিদের পরাজয় ঠেকানোর শেষ প্রচেষ্টা হিসেবে কিসিঞ্জারের পরামর্শেই আমেরিকা বঙ্গোপসাগরে তাদের তৎকালীন সবচে বড় বিমানবাহী রণতরীসহ সপ্তম মার্কিন নৌবহর মোতায়ন করে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত জালিমের পরাজয় ঠেকানো যায়নি। ১৯৭১ সালের ১৬ই ডিসেম্বর প্রতিবেশী ভারতের সামরিক সহায়তায় পাকিস্তানের শাসকগোষ্ঠীকে পরাজিত করে বাঙালি মুসলিম গেরিলারা।
কিসিঞ্জার আমাদের স্বাধীনতার পরবর্তী এক দু বছরের মধ্যে মারা গেলে হয়তো কিসিঞ্জারের মতো একজন যুদ্ধাপরাধীর মৃত্যু এদেশের জনগণের নিকট তাৎপর্যপূর্ণ এবং প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠত। কিন্তু স্বাধীনতার ৫২ বছর পর বাংলাদেশ যখন জুলুম নির্যাতন এবং দুর্নীতিতে ৭১ পূর্ব সময়ে ফিরে গেছে, তখন আমাদের পূর্বপুরুষদের উপর গণহত্যা চালানো একজন খুনির মৃত্যু উদযাপন ভূখণ্ডকেন্দ্রিক পরিচয়ের দৃষ্টিভঙ্গি থেকে পুরো ফিকে হয়ে গেছে। তাই তো মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বলতে অজ্ঞান এবং দাদাদের কাঁচা অর্থে পালিত আমাদের সুশীল বাঙালি বুদ্ধিজীবীদের পক্ষ থেকে কিসিঞ্জারের মৃত্যু উপলক্ষ্যে উল্লাসপূর্ণ উল্লেখযোগ্য কোনো বক্তব্য পাওয়া যায়নি। বরং দাদাদের আদর্শে উজ্জীবিত কতিপয় বুদ্ধিজীবীর জন্যে হয়তো দাদাদের পরম বন্ধু কিসিঞ্জারের মৃত্যু–দিনটি ছিল একটি বেদনাবিধুর দিন।
তবে আফসোস! আমরা যারা ভূখণ্ডভিত্তিক পরিচয়ের সঙ্গে সঙ্গে মুসলিম হিসেবে একটি আন্তর্জাতিক পরিচয় ধারণ করি এবং সে পরিচয়টিকেই প্রাধান্য দিতে পছন্দ করি, তারাও কিসিঞ্জারের মৃত্যকে প্রাসঙ্গিক মনে করিনি। ঘেঁটে দেখবার প্রয়োজন বোধ করিনি এ মুসলিমবিদ্বেষী কুটনীতিকের ইতিহাস। যদি দেখতাম, তাহলে অন্তত সাময়িক সময়ের জন্যে হলেও আমাদের মাঝে ক্ষোভ জাগত। চোয়ালগুলোতে ভেসে উঠত প্রতিজ্ঞার ছায়া। ব্যাপারটি দুঃখজনক হলেও ২৯ শে নভেম্বর আমাদের জন্যে ছিল একটি উদযাপনের দিন। কারণ এদিন ১৯৭১ সালে আমাদের দাদা-নানাদের হত্যায় এবং মুসলিম মা-বোনের সম্ভ্রম হরণে প্রত্যক্ষ মদদদাতা একটি ঘাতক নরপশুর যবনিকাপাত ঘটেছে।
এর পাশাপাশি কিসিঞ্জারের মৃত্যু উদযাপন আমাদের কাছে আরও প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠেছে ৭ই অক্টোবর তুফানুল আকসার মাধ্যমে শুরু হওয়া জায়োনিস্ট ইসরাইলের বিরুদ্ধে মুসলিম ফিলিস্তিনের গর্বসঞ্চারী যুদ্ধের কারণে।
৭ই অক্টোবর হামাসের নেতৃত্বে অবশ্যম্ভাবী এক অসমযুদ্ধ শুরু করেছে ফিলিস্তিনের প্রতিরোধ আন্দোলনগুলোর সম্মিলিত বাহিনী। এ বাহিনী যুদ্ধ শুরু করার পূর্বেই জানত–যুদ্ধে আল আকসা এবং ফিলিস্তিনের একমাত্র প্রতিনিধি তারাই, আর তাদের সম্বল হাতে তৈরি কিছু অস্ত্রশস্ত্র। অপরদিকে প্রতিপক্ষ মধ্যপ্রাচ্যের মহা প্রতাপশালী ইসরাইল। সঙ্গে আছে সুপার পাওয়ার আমেরিকা এবং তাদের ইউরোপিয়ান সাঙ্গোপাঙ্গরা। এদিকে চতুর্পাশে মুসলিম অধ্যুষিত স্বার্থবাদী ধনী আরব রাষ্ট্র বেষ্টিত অসহায় ফিলিস্তিনের পক্ষে একাই লড়াই করেন গাজার মহা বিপ্লবীরা। অপরদিকে তাবৎ সুপার পাওয়ার এবং যাবতীয় অত্যাধুনিক সমরাস্ত্রের সহায়তায় আগ্রাসন বাস্তবায়ন করে দখলদার খুনিরা। এ এক অসম যুদ্ধ–যার ফলাফল প্রায় ২০ হাজার ফিলিস্তিনির শাহাদাত, লাখ লাখ উদ্বাস্তু এবং অপূরণীয় ক্ষয়ক্ষতি।
কিন্তু যুদ্ধের এই অসমতা বিধানের পিছনের কারিগর কে?
যুক্তরাষ্ট্রের কলম্বিয়া ইউনিভার্সিটির আধুনিক আরব রাজনীতি ও বুদ্ধিবৃত্তিক ইতিহাস বিষয়ের অধ্যাপক জোসেফ মাসাদের বক্তব্য থেকে এ প্রশ্নের প্রাথমিক উত্তরটা পাওয়া যায়। কিসিঞ্জারের মৃত্যুপরবর্তী সময়ে মিডেল ইস্ট আইয়ে লেখা তার একটি প্রবন্ধে তিনি বলেন–ট্রাম্প থেকে ওবামা, বুশ থেকে বিল ক্লিনটন–প্রত্যেকের সঙ্গে কিসিঞ্জারের ব্যক্তিগত সুসম্পর্ক ছিল। আজকের ফিলিস্তিনের যে দুর্দশা তার প্রধান নকশাকার ছিলেন এই কিসিঞ্জার। মূলত তার পরিকল্পনাতেই যুক্তরাষ্ট্র ইসরাইলকে অকুণ্ঠ সমর্থন দিয়ে গেছে। ইসরাইলের দমননীতি ও অবৈধ বসতি স্থাপনে যুক্তরাষ্ট্রের সমর্থনের ভিত্তিও তিনি গড়ে দিয়েছেন।
ইতিহাস অনুসন্ধান করবার পর কিসিঞ্জারের ব্যাপারে ড. মাসাদের এ বক্তব্য শতভাগ সত্য হিসেবেই প্রমাণিত হয়।
১৯৪৮ সালে আমেরিকা এবং ইউরোপের গরলে মধ্যপ্রাচ্যে সৃষ্ট বিষাক্ত ফাঙ্গাস ইসরাইলের জন্মের পর আরব রাষ্ট্রগুলো এই দখলদারদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে। কিন্তু পরস্পর মতানৈক্য এবং অপরিনামদর্শী যুদ্ধনীতির ফলে পরপর কয়েকটি যুদ্ধে আরবশক্তি পরাজিত হয়। কিন্তু ১৯৭৩ সালে ইয়ম কিপুর যুদ্ধে ইজরাইলের অবস্থা ছিল খুবই শোচনীয়। ফলে যুক্তরাষ্ট্র মধ্যপ্রাচ্যে তাদের একমাত্র বাজির ঘোড়াটির পতন ঠেকাতে কিসিঞ্জারের পরামর্শে ইসরাইলে শত শত টন অস্ত্র পাঠায়। শুধু তাই নয় আরব জোটের প্রধান শক্তি মিশরের প্রেসিডেন্ট আনোয়ার সাদাতকে পারমাণবিক অস্ত্র ব্যবহারেরও হুমকি দেয় কিসিঞ্জার। এতসব তদবির করে সেবার যুক্তরাষ্ট্র ইসরাইলের নিরাপত্তা নিশ্চিত করে। কিন্তু এতটুকুতেই ক্ষান্ত হয়নি এই কিলিং মেশিন, বরং ১৯৭৮ সালে বিতর্কিত ক্যাম্প ডেভিড চুক্তির সময়েও ইসরাইলের পক্ষে শক্ত অবস্থান নেয় সে।
মিশরের সাদাত এবং ইসরাইলের প্রধানমন্ত্রী বেগিনের মধ্যে সম্পাদিত সেই চুক্তি ছিল ফিলিস্তিনের ভূমিতে দখলদারদের অবৈধ অবস্থানের বৈধতার স্বীকৃতি। এ চুক্তির মাধ্যমে মিশর প্রথম আরব রাষ্ট্র হিসেবে অবৈধ জারজ ‘রাষ্ট্র’কে বৈধতার সনদ প্রদান করে। এই সনদের মাধ্যমেই ফিলিস্তিন ভূখণ্ড এবং তার অধিবাসীদের সঙ্গে মিশরের বিশ্বাসঘাতকতার সূচনা হয়। যার সমাপ্তি হয়নি আজও। অবরুদ্ধ গাযা, রাফা ক্রসিংয়ের বদ্ধ দুয়ার এবং কাঁটাতারের বেড়া যার জ্বলজ্যান্ত প্রমাণ।
মিশরকে বিশ্বাসঘাতকতায় বাধ্য করবার ৩ বছর আগে ১৯৭৫ সালে ইসরায়েলকে স্বীকৃতি দেওয়ার শর্তে কিসিঞ্জার যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষ থেকে ইয়াসির আরাফাতের পিএলও’কে ফিলিস্তিনের বৈধ প্রতিনিধি হিসেবে স্বীকৃতি প্রদানের প্রস্তাব দেয়। কিন্তু সেবার কিসিঞ্জারের প্রস্তাব ফিরিয়ে দিলেও ১৯৯২ সালে অসলো চুক্তির মাধ্যমে ইসরাইলকে স্বীকৃতি দিয়ে দেয় পিএলও। বিনিময়ে নিজেরাও পায় বৈধতার অবৈধ স্বীকৃতি। সম্পন্ন হয় ফিলিস্তিনি ভূমির চূড়ান্ত বিকিকিনি।
ইয়াসির আরাফাত কর্তৃক অবৈধতাকে বৈধতাদানের ঘৃণিত উত্তরাধিকারের রক্ষক হয়ে আজও ফিলিস্তিনিদের ঘাড়ে সওয়ার হয়ে আছে মাহমুদ আব্বাস। এই ফিলিস্তিনি মীরজাফর দখলদারদের দেওয়া ক্ষমতার গ্যারান্টির বিনিময়ে প্রতিনিয়ত বিকিয়ে যাচ্ছে পবিত্র ভূমি।
কিসিঞ্জার নামক কালো ছায়া পৃথিবীর আকাশ থেকে দূর হয়েছে ঠিক কিন্তু কালো ছায়ার আলোহীন অন্ধকারে জন্মানো ক্ষতিকর আগাছাগুলো রয়ে গেছে। পৃথিবীবাসী যদি এই আগাছাগুলো চিহ্নিত করে উপড়ে না ফেলে, তাহলে ভবিষ্যতে এসব আগাছা একসময় দীর্ঘমেয়াদি ক্ষতির কারণ হয়ে উঠবে নিশ্চয়।
আমাদের হয়তো ক্ষমতা নেই এসব আগাছা উপড়ে ফেলবার তবে আমাদের সাধ্য আছে আগাছা চিনে রাখবার। তাই আমরা এসব আগাছা চিনে রাখব। জেনে রাখব এসব গরলের ইতিহাস। এরপর আমরা এসব ইতিহাস পৌঁছে দিব আমাদের পরবর্তী প্রজন্মের কাছে।
আমরা ইতিহাস পাঠ করি–আমাদের পূর্বপুরুষগণের গৌরবের ইতিহাস। এরপর সভ্যতা সংস্কৃতি এবং প্রাচুর্যহীন ধুলোমলিন পতন-উন্মুখ বর্তমানে বসে প্রাচীন স্বর্ণযুগের কথা স্মরণ করে আত্মঅহমিকায় ফুলে ফেঁপে উঠতে থাকি। বলতে শুরু করি–উলায়িকা আবাঈ ফাজি’নী বি মিসলিহিম…
আমরা অতীতের কল্পনায় ভাসতে ভাসতে ক্রমশ অন্ধকারাচ্ছন্ন হতে থাকা বর্তমানের ব্যাপারে উদাসীন হয়ে পড়ি। ভুলে যাই আমাদের বর্তমানে অন্ধকারের কালিমা লেপন করা খলনায়কদের। কিন্তু এই খলনায়করা তাদের চরিত্র বাস্তবায়নে কখনোই উদাসীন হয় না। তারা একের পর এক আসে। ক্ষতি সাধন করে। এরপর উত্তরাধিকারী রেখে চলে যায়। কিন্তু আমরা উদাসীনই থেকে যাই। তাই হেনরি কিসিঞ্জারের মতো চিরশত্রুদের মৃত্যু আমাদের কাছে তাৎপর্যহীন এবং অপ্রাসঙ্গিক মনে হয়। এ তাৎপর্যহীনতা আমাদের জন্যে শত্রুর রেখে যাওয়া উত্তরাধিকারদের চিনবার ক্ষেত্রে অন্তরায় হয়ে দাঁড়ায়। ফলে আমরা আমাদের ছোট শত্রুদের চিনলেও বড় শত্রুরা আমাদের কাছে অপরিচিতই থেকে যায়। একসময় এ অজ্ঞতার কৃতিত্বে বড় শত্রুদের আমরা নিঃশর্ত ক্ষমাও করে দিই। ফলে শুধুমাত্র প্রাচুর্যের ইতিহাস নিয়েই আমরা বুঁদ হয়ে থাকি। ব্যর্থতার ইতিহাস এবং তিক্ত বর্তমান সম্পর্কে উদাসীনতার কারণে আমাদের মাঝে সৃষ্টি হয় না কোনো প্রতিজ্ঞা। জাগ্রত হয় না নব উদ্যম।
হেনরি কিসিঞ্জাররা আমাদের ইতিহাসের খলনায়ক। প্রতিটি ব্যার্থতার ইতিহাস।
তাই নায়কদের ইতিহাস জানার পাশাপাশি খলনায়কদের ইতিহাস জানাও জরুরি। যাতে আত্মঅহমিকার বদলে আমাদের মনে তৈরি হয় আত্মসমালোচনা–যে আত্মসমালোচনা আমাদের মনে তৈরি করবে বর্তমান এবং আগামী প্রজন্মের ভবিষ্যৎকে আলোকিত করবার প্রত্যয়। আমরা সেই প্রত্যয় নিয়ে এগিয়ে যাব। ব্যয় করব সাধ্যের সবটুকু। এরপর ভরসা আল্লাহর। আমরা আল্লাহর সাহায্য এবং করুণায় বিশ্বাসী। আর তিনি বিশ্বাসীদের নিরাশ করেন না।
পুরোটা মনোযোগ দিয়ে পড়লাম।চমৎকার লিখেছেন মাশাআল্লাহ।