একেকটা নির্লিপ্ত সন্ধ্যা কাটাই, মনে হয়—আস্তাটা জীবনের ভার বয়ে নিচ্ছে একটামাত্র সন্ধ্যা। তবুও জীবনের প্রতি মুগ্ধতা আমার। জীবনরে স্কুল-ফিরত পথে হারিয়ে ফেলা দুই টাকার সিক্কির মতন খুঁজি। মউতরে সন্দেহ করি ছিঁড়ে যাওয়া জুতার ফিতার মতন। স্মৃতির মধ্যস্থতায় মানুষের জলছবি আঁকি। রাজারগলি থেকে চৌহাট্টা হাঁটতে হাঁটতে কতো মানুষের সাথেই তো দেখা হয়ে গেল। স্মৃতির দস্তরখানায় আসলো-বা কজন! যারা এলো—খালি পায়ে হেঁটে যাওয়া পিতৃপরিচয়হীন বালক অথবা খিদে আর খোঁটায় বুকের স্তন শুঁকিয়ে যাওয়া নারী।
নিয়তর আলপনায় থাকে—সন্ধ্যার মখমল আলোয় গালের ওপরে ঝুলে থাকা চুল। তামাটে কপালের ওপর তিলের দানার মতন টিপ অথবা বুকের পকেট ভরে বরফের মতন ঠান্ডা অঙ্গুলি। কলের ওপাশে জীবনের দায়ে আটকা পড়া কারো ছাইরঙা অভিমান। তুমুল দীর্ঘশ্বাস। মনে হয় যেন এইখানে আবার আটকা পড়ে জীবন।
কোনো এক সন্ধায় বৃষ্টি থেমে গেলে জুঁইয়ের মিঠে-মিঠে ঘেরানের বদলে গাছতলায় শালিকের বাসা খুঁজি। একবার অনেক ছোটোবেলায় শালিকের ভেঙে যাওয়া ডিম দেখে বড় মায়া জেগেছিল মনে। শিক্ষক বলতেন—‘জীবন বড়ই সেকেলে। তারে বুঝতে শিখে গেলে, সে বড়ই বেদনা দেয়।’ একাকী কাক দেখলে মনে হয় যেন ভাঙা ভাঙা বেড়ার পাশে বসে আছেন এক মধ্যবয়েসি নারী। বড় আয়েশের বিয়েটাও ভেঙে গেল তার। ঘুমের ভেতরে সিঁড়িভাঙার শব্দের চেয়েও বড় বেদনা জাগায় একাকী এক কাকের বসে থাকা। পুবালি হাওয়ার বদলে কানে বাজে হৃদয়কাটার সেতার। আমি শুধু বেদনার শব্দ শুনি। দূরের বন্ধুর ফিলোসোফি কপচানো ভালো লাগে তখন—জীবনের বদলে আমরা বরং বেদনার সংসার করি। মনে পড়ে—
“আমরা মৃত্যুর আগে কি বুঝিতে চাই আর? জানি না কি আহা,
সব রাঙা কামনার শিয়রে যে দেয়ালের মতো এসে জাগে
ধূসর মৃত্যুর মুখ; একদিন পৃথিবীতে স্বপ্ন ছিলো—সোনা ছিলো যাহা
নিরুত্তর শান্তি পায়; যেন কোন মায়াবীর প্রয়োজনে লাগে।
কি বুঝিতে চাই আর? রৌদ্র নিভে গেলে পাখি পাখালির ডাক
শুনিনি কি? প্রান্তরের কুয়াশায় দেখিনি কি উড়ে গেছে কাক!”
জীবনের নিখুঁত ফাঁদে পড়ে যাবার পর মনে পড়ে এক বিকেলে মাকড়সা ধরতে গিয়ে তার নিখুঁত বিনুনিতে আটকা পড়ার কথা। নাকেমুখে লেগে যাওয়া জাল ছুটাতে ছুটাতে সন্ধ্যার আজান হয়ে যায় তখনও। ঘটা সাজাতে সাজাতে শুধু সন্ধ্যার আয়োজন দেখি। দেখি—এইসব সন্ধ্যায় আমাদের প্রথম খেলার সাথিরা ঘর ছেড়ে যায়, স্বামীর ঘর আলো করে আরেক সন্ধ্যায় স্বামীর খাটিয়াকে ছুঁইতে পারার স্বপ্ন নিয়ে। দেখি—জীবনের ধার ভিড়তে গিয়ে বাতাসে দোল খাওয়া হালকা দাঁড়ির কিশোরের মুখে জীবনের কালো কালো রেখা, যেই রেখাগুলো আর বাঁচতে দেয় না তাকে। চার পায়ের খাঁট বইতে থাকা লোকগুলোকে তখন জীবনের ওজন জিজ্ঞেস করতে মন চায় আমার।
বাহ্, স্বল্প কথায় বিস্তার জীবনের রং!
সেরা ভাই💚
মুগ্ধ হলাম