বহুদিন পর সাইবার ক্যাফেটার রাস্তার পাশ ধরে বাসায় ফিরছি— রাত দশটা, বৃষ্টি হয়ে গেছে বোধহয় খানিক আগেই। মালিবাগ বড়ো মাদরাসার কাছেই জায়গাটা, আমাদের টিনএজে, প্রথম প্রথম ইন্টারনেটের জগতে বিস্ময় সাঁতারের তন্ময় বিকেলগুলোর স্মৃতি, অতীত দিনের ছায়াগুলো এইখানে জমা হয়ে আছে।
আমার এক বন্ধু ছিল ফয়সাল নাম। প্রথম সে-ই এই জায়গাটা আমাকে চেনায়, চৌদ্দ সালের দিকে হবে হয়তো। তবে সাইবার ক্যাফে যাওয়ার শুরু তারও আগে— আরেকটা সাইবার ক্যাফেতে আমি যেতাম, মগবাজারে। জামায়াতে ইসলামীর পুরনো তিনতলা বিল্ডিংয়ের ঠিক উল্টোপাশেই, এক ঘিঞ্জিমতো সরুপথের মোড়ে একটা সাইবার ক্যাফে ছিল। ঘণ্টায় ষাট টাকা নিত। আধ ঘণ্টা ত্রিশ টাকা। সালামির জমানো টাকাগুলো এই ক্যাফেতে সুপার কার্ডরিডারের দ্রুত ডাটা ট্রান্সফারের মতো গতিতে ফুরিয়ে যেত। যেন অলৌকিক কোনো সুতায় টাকাগুলো টেনে নিজের ম্যাগনেটিক পকেটে টেনে নিচ্ছে মুহিদ ভাই, ক্যাফে অউনার।
তখন ফোরজি ছিল না, থ্রিজি কেবল এসেছে টেলিটকে। মেমোরি কার্ড আর ডাউনলোডের যুগ। সেই হিসেবে গতি বোঝাতে কার্ডরিডারের উপমাই যথাযথ। একটা ভালো গতির কার্ডরিডার ছিলো আত্মিক প্রশান্তি। সমস্ত ডাউনলোডের শেষে বিপ বিপ বাতি জ্বেলে কার্ডরিডারের কাজ শুরু হতো।
সাইবার ক্যাফেতে খুব যে বেশি যেতাম, এমন না। প্রথম যাওয়া হয় ২০১২ সালে। সবে হেফজ শেষ করে বাসার কাছেই, মগবাজারের একটা মাদরাসায় ভর্তি হয়েছি দাওরের জন্য। দাওর মানে পুরা কোরান যা মুখস্থ করেছি গত তিন বছরে, টানা একবছর সেটা ঝালাই করা। তখন বয়স আমার তেরো। তখনও হেফাজত, শাপলা, ব্লগ এইসব আসেনি মাদরাসার রাজনৈতিক সাংস্কৃতিক বাস্তবতায়। আমরা কেবল পৃথিবীতে, বাংলাদেশে, ঢাকা শহরে অবাক বিস্ময়ে চোখ খুলছি, আত্মপরিচয়য়ের অনুভব করছি ঘুমন্ত তাগিদ।
তো, আগের মতো আর চাপ নেই। দাওরের জন্য যারা ভর্তি হয়, তারা থাকে মোস্ট সিনিয়র ব্যাচত। যেন প্রাইমারি স্কুলের পঞ্চম শ্রেণি। প্রতিদিন নতুন সবক দেয়া নেই। কোরান পাক তখন হয়ে যায় অতি পরিচিত মহল্লার গলিঘুপচির মত। সব বাড়ি সব পথের বাঁক, সমস্ত ল্যামপোস্ট , সাইনবোর্ড মুদি দোকান, কোন কুকুরগুলো কোথায় রাত পাহারা দেয়, অমন করে সব চেনা। সমস্ত আয়াত ও শব্দের ওপর আমাদের বহু বহু স্পর্শ লেগে থাকা। নির্ভার কাপ্তেনের মতো মুখস্থ আওড়ে যেতে পারি সে মহাগ্রন্থ।
তো, সেইসব নির্ভার বিকেলবেলাগুলোতে সাইবার ক্যাফেতে আমার কম্পিউটারে একাকী হাতেখড়ি হয়।
কেউ শেখায়নি, কীভাবে যেন নিজে নিজেই শিখে গিয়েছিলাম কম্পিউটারের বেসিক। অবশ্য একদমই স্বশিক্ষা নয়, পূর্ববর্তী নানা কৌতূহলী পঠনপাঠনের অভ্যাসটা সাহায্য করেছে।
মাদরাসায় জেনারেল পরীক্ষার্থী ছিল কয়েকজন, যারা পার্শ্ববর্তী স্কুলে ম্যাট্রিকের রেজিস্ট্রেশন করেছিল। তারা হেফজ শেষ করে কিতাব বিভাগে পড় বিধায় পরীক্ষা দেয়ার সুযোগ পেয়েছি মাদরাসা থেকেই। কিতাব বিভাগে ছিল জেনারেল ও আরবি-উর্দু শিক্ষার কো-কারিকুলাম।
আদর্শলিপি হাতেখড়ির পর থেকেই আমি বইকীট। ওই বয়সে গোগ্রাসে পড়ি মাদ্রাসায় যেখানে যার ডেস্কে যেই বই পাই। বিকেলে তো পড়িই, সকালেও তিন ঘণ্টা ঘুমের সময় দিত, সে সময় না ঘুমিয়ে পড়ি। অনূদিত তকি উসমানির তাসাউফের বই যেমন পড়ি, স্কুলের আইসিটি বই-ও মুগ্ধ বিস্ময়ে পড়ি। মোটা আইসিটি গাইড খুলে দেখি HTML, Internet, web browsing, Download, Email, Yahoo, altravista, Microsoft এর জগৎ। বিভিন্ন বক্স ছবি। নানান নির্দেশনা। যেন অজানা কোনো গ্রহের ধুলোঝাপসা গলিতে ঢুকে পড়েছি, রক্তের ভেতর তেমন গুঞ্জন। আমি জানি না কেন অমন হয়েছিল আমার, দেহমনে অমন নতুনের অনুরণন, যেন সভ্যতার প্রারম্ভিক যুগের কোনো প্রাচীন মানুষ পেয়েছে পাথরঘষা আগুনের সন্ধান।
বিকেল হবে, সাইবার ক্যাফেতে যাব। একটা হটমেইল একাউন্ট খুলব জীবনের প্রথম—যেমন দেখেছি বইয়ের পাতায়। সেই উত্তেজনায় ছটফট করতাম কোরান পাকের সামনে ঢুলেঢুলে, ইমেইলে কী আছে, কী করা যায় তা ভাবতাম মনে মনে, মুখে আরবি আয়াতের অন্যমনস্ক আবৃত্তি। অলস দুপুরের আমুখতা পড়ায় আর মন বসত না।
পরে অনেক দেরিতে, আমার সত্যিকার উন্মুক্ত থেকে ম্যাট্রিক পরীক্ষার সময়— দুহাজার বিশে। আইসিটি বইয়ে একই জিনিসগুলো পুনরায় পড়লেও তেমন আনন্দ আর পাইনি, সেই বিস্ময় তো কেটে গেছে। স্মার্টফোন এসে গেছে দুনিয়ায়, আমার হাতেও সর্বক্ষণ।
তো, সেই থেকে মগবাজারের ক্যাফেটায় যাওয়া শুরু। অত তো আর টাকা পেতাম না ওইটুকু বয়সে। মাসে দুই চারদিন যেতাম । ফেসবুকও খুললাম, ওই সময়ের ক্রেজ ক্বারী মিশারি রাশেদ আল আফাসির সমুদ্রেপাড়ে দাঁড়ানো হাস্যোজ্জ্বল একটা ছবি প্রোফাইল পিকচারে দিয়ে রাখলাম।
সবই একরকম কৌতূহল থেকে। ওইসময় ফেসবুকে একাউন্ট থাকাটা কেমন একটু আপডেট, কেমন একটু পশ বিষয়। কাজিনরা, কিছু অভিজাত বন্ধু, পরিচিতর পরিচিতরাও ফেসবুকে ছিল। বিশেষ করে, বিদেশে থাকা আত্মীয়স্বজনদের সাথে এত সহজ যোগাযোগ, তাদের প্রাত্যহিক আপডেট, বিদেশে তাদের নানাবিধ কাজকর্মের ছবি দেখা, এত সহজে!
যে চাচ্চু—বাবার খালাতো ভাই ধরা যাক, আমার ছয় বছর বয়সে যিনি লন্ডন চলে যান, এরপর আর যার সাথে কোনোদিন কথাবার্তা হয়নি, খোঁজখবর পাইনি (সুযোগও ছিল না। ফোনকল প্রতিমিনিট বিশ টাকা, ফোনও সবার হাতে ছিলো না) সেই মানুষটা এক সেকেন্ডে টেক্সট করছে, চাচ্চু কেমন আছো, কত বড় হয়ে গেছো, ভাইয়া কেমন আছে? আমিও পরের সেকেন্ডেই উত্তর করছি!
আবার দেখা গেল, এক ফুপাতো ভাই ওমরায় গিয়ে নবিজির রওজা, সবুজ গম্বুজের সামনে থেকে ছবি আপলোড করেছে, মাদরাসাপড়া কিশোর আমি বাংলিশে কমেন্ট লিখলাম, কবে যাব সোনার মদিনায়। লাইক ছাড়া আর কোন রিয়েকশন তখনও নাই। এই কমেন্ট আবার আরেক ফুপাতো ভাইয়ের চোখে কেমন হ্যাংলার মতো, গরীবের আফসোসজনিত কথা মনে হয়। তাদের বড়লোকিত্বের সাথে ঠিক যায় না। তারা ঘন ঘন আরবদেশে যায়। এত আহামরি কী এসব! আমার মনে মদিনাওয়ালার প্রেম, আমার মন মরমে মরে যায় সাইবার ক্যাফেতে বসেই। যেন রিকশাওয়ালার ছেলের ভালোবাসা কোটিপতির মেয়ের প্রতি, কিন্তু সহসা সেই ভালোবাসার কথা লোকে জেনে যাওয়ায় সে বিব্রত। সে জানে, তার ডাক আসবে না। তার নেই রাহাখরচ।
প্রবাসী আত্মীয়দের বিদেশের বিভিন্ন ইভেন্ট, যেমন সিনেমায় যাওয়া, বা সার্ফিং করছে সমুদ্রতীরে, বিদেশি স্কুলের ভিনদেশি ছেলেমেয়েদের সাথে হ্যালোইনের ছবি—এইসব আমরা দেখতাম চিঠিতে এয়ারমেইলে পাঠানো ওদের ছবিতে, বা ওরা দেশে এলে ওদের সাজানো এলবামে। সেই জিনিসটা ফেসবুকে কত সহজ হয়ে এলো!
আমরা যারা দুই হাজারের সন্তান, তারা এনালগ ও ডিজিটাল দুই যুগেরই সন্ধিক্ষণটা পেয়েছি। দুই যুগের বিস্ময় দুই যুগের অনুভূতি, যথাক্রমে মন্থর ও গতিপ্রযুক্তির ভেতর আমাদের উন্মেষ। আমরা মানবজাতির সবচেয়ে ভাগ্যবান টাইমপিরিয়ডের অংশ আসলে।
বিদেশ বা দূরের আত্মীয়দের মনে হতো, তারা যোগাযোগহীন কোনো এক মায়াবি পাড়ের দেশে আছে, যাকে শুধু কল্পনাই করা যায়, পৌঁছানো যায় না। তাদের মুখ, তাদের স্মৃতি, তাদের উষ্ণতা সবই যেন গভীর ঘুমে গাঢ় স্বপ্নের মতো কিছু। এক ঝটকায় সেইসব দূরত্ব আর যোগাযোগহীনতাও উবে যেতে দেখলাম আমরা।
ফয়সালের কথায় ফিরি। এই বন্ধুটা আমাকে জানাল মালিবাগের এইখানে এই ক্যাফেটায় ঘণ্টায় মাত্র বিশ টাকায় নেট চালানো যায়। কই ষাট টাকা আর কই বিশ টাকা!
তখন অবশ্য ২০১৪/১৫ সাল এসে পড়েছে পৃথিবীতে। আমিও আরও বেশ কয়েকটা সাইবার ক্যাফের কাস্টমার হয়েছি। ফেসবুক, সামহোয়্যারইনব্লগ চলছে। আমি টুকটাক কবিতা টবিতা লেখার চেষ্টা করি ফেসবুকে। মাঝেমাঝে রাগী জজবাওয়ালা রাজনৈতিক স্ট্যাটাস। মাদরাসায় তখনও পড়তাম, ততদিনে হেফজ শেষ, কিতাব বিভাগ বা মাদরাসার উচ্চমাধ্যমিক। স্মার্টফোন ছিল নিষিদ্ধ, সপ্তাহান্তে বাসায় এলে এই মালিবাগের ক্যাফেটায় যেতাম। ফয়সালও যেতো। মাঝেমাঝে আমার বিল ও দিয়ে দিত। পরে সে ইতালি চলে যায়। ওর আব্বু আম্মুসহ পুরো পরিবারই ইতালিতে থাকে।
খাতায়, সাদা কাগজে কালো কলমের কালিতে লেখালেখি চর্চা করতাম টুকটাক, প্রচুর বই আর পত্রিকা তো আছেই। এমনও হয়েছে কখনো, নামাজের সময় নামাজে না গিয়ে মাদরাসার বিল্ডিংয়ের বাউন্ডারি দেয়ালের কর্নারে দাঁড়ায়ে বা বসে দৈনিক পত্রিকা পড়ছি । মজা পুকুর, নোংরা ডোবা আর রান্নাঘরের সমস্ত উচ্ছিষ্ট জড়ো করা থাকত ওদিকটায়, স্বাস্থ্যবান মশার কামড় খেতে খেতে পড়তাম, সে কী পড়ার নেশা, তুমুল আনন্দে পড়তাম সৈয়দ হক, কাজী আনোয়ার, হুমায়ূন, আল মাহমুদ, ফররুখ, রবীন্দ্রনাথ।
কী উন্মাদনা তখন লেখা নিয়েও। খাতার একটা অংশ বরাদ্দ ছিল ‘ফেসবুক স্ট্যাটাস’ শিরোনামে। এখানে লিখে রাখতাম হুটহাট মনে উদয় হওয়া ফেসবুকে দেয়ার মতো বিভিন্ন আলাপ বা কথা। হাসি পায় যদিও। সেই খাতা একদিন হুজুরের কাছে ধরাও খেলাম। ফেসবুক অংশ নিয়ে কঠিন বিদ্রূপ করলেন। কী কী বোকা বোকা দিন সেইসব আমার।
কেন লেখা? লিখলে কী হয়? আমার কয়টা কথা কী এমন যে লিখতেই হবে? আরও অনেকেই বলছে! কিন্তু ওই যে, মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের ওই ঔদ্ধত্যের সংলাপ—আমি লিখি কারণ আমি যা যেভাবে জানি, লোকে তা জানে না… কোনো ব্যাখা নেই, কোনো কারণও নেই। মনে হলো তাই।
আজ ২০২৫। স্মৃতিকথা লিখলাম। আমরাও কি স্মৃতিকথা লেখার ম্তো বয়সে চলে আসছি তাহলে? পুরনো সাইবার ক্যাফেটার ছায়া গলির মুখ থেকে হাতছানি দিয়ে ডাকে। বাসাতেই পিসি আছে, ওয়াইফাই আছে, বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ি। সেইসব রেস্ট্রিকশন নাই আর। ইচ্ছে করে পা বাড়াই ওদিকে, আবার কী মনে করে বাড়াই না। মামুন মামা ছিল, কাজশেষ হলেই কার্রিডার নিয়ে আগায় আসতেন। কতজনের কত বাকি ছিল স্মৃতি ছিল, উদযাপন ছিল— আমারও, সেগুলোর চিরঋণ রয়ে গেল। উনি এখন কোথায় কী করে কে জানে।
ঘোরলাগা সন্ধ্যায় সোজা মালিবাগ রেলগেটের দিকে হাঁটতে থাকি। হয়তো গেলে দেখতাম সাইবার ক্যাফেটা আর নাই। না থাকারই কথা, হাতে হাতে স্মার্টফোন। কোথাও আর তেমন সাইবার ক্যাফে নাই। আমাদের পাখিযুগ আমাদের কু ঝিকঝিক ফুরিয়েছে। কী কাজ ক্যাফেটার না থাকা জেনে, খালি খালি অন্ধকার ছবিটা মাথায় নিয়ে?
বরং সে থাকুক পু্রোনো সময়, পুরোনো বন্ধু আর প্রাক্তন প্রেমিকা ও মফস্বলের স্মৃতির মতো জ্যান্ত, যেন তারা নাচছে হাসছে গাইছে কোনো ভিন্টেজ ফ্রেমে হাওয়াই সমুদ্রের পাড়ে—উড়ুক উড়ুক তারা হৃদয়ের শব্দহীন জোছনার ভেতর…