সমূহ দুঃখের কালাম

যিয়াদ বিন সাঈদ

আধো আলোয় টলতে থাকা একটা ছবি, আমার ভেতর এখনও কেমন করে মাতম তোলে আম্মাজান, আমি আপনাকে বোঝাতে পারবো না ঠিক। দৌর্মনস্য এক উতরোল আমাকে ভিজিয়ে দিতে চায় আম্মাজান। শ্রাবণ মাসের দিন, বিরামহীন বর্ষা যখন; এই বৃষ্টি আসছে, এই আবার পরিষ্কার হয়ে যাচ্ছে আকাশ; অথবা কখনোবা শীতের সন্ধ্যায়, গায়ে জড়িয়ে আলোয়ান, ঢাকা থেকে আব্বু এসেছেন, হাতে করে ছোট্ট একটি বৃক্ষ, যেখানে মুকুলিত অনেক অনেক মায়া এবং ভালোবাসার শরাব, আপনার স্মৃতিতে ওইসব দিনগুলো এখন কেমন আছে আম্মাজান? আব্বুর সঙ্গে কাঁধে ব্যাগ ঝুলতে-থাকা ভাইয়াও যখন হাসিহাসি মুখে আসতেন আম্মাজান, নানুবাসার বারান্দাটিতে গ্রীল ধরে দাঁড়িয়ে থাকা আমাদেরকে চমকে দিয়ে, সে দৃশ্যটিও আপনি খুব যতন করে আপনার হৃদয়ে বেঁধে রেখেছেন হয়তো আম্মাজান। মহাকাল ধরে শেষ হতে না চাওয়া সপ্তাহটি পেরিয়ে, ভাইয়া যখন আসতেন, লকলকিয়ে ওঠা চেহারার কোণে ভাসতো অদম্য কলবকে দমিয়ে রাখার নিঃসীম যন্ত্রণা।

কিন্তু আম্মাজান, এত দ্রুত চলে যেত কেন ছুটির ওই শুক্রবার? একদম হঠাৎ করেই বেজে উঠত যেন মাগরিবের আজান, ওই গ্রামীণ মুয়াজ্জিনের সুরে। নানুবাসার বারান্দায় দাঁড়িয়ে আব্বু আর ভাইয়ার চলে যাওয়া দেখতে হতো আমাদের। আপনি কাঁদতেন আম্মাজান। আপনার কান্না দেখে আমারও অনেক কান্না পেত। আব্বুর হাত ধরে ভাইয়া যখন একটু হাঁটতেন সামনে, আবার পেছনে ফিরে তাকাতে থাকতেন বারবার, দৃষ্টির সীমা যতদূর, তাকিয়েই থাকতেন, এই দৃশ্য আমাকে পোড়াতো বলে আমি একলা দরোজা বন্ধ করে মুখ থুবড়ে পড়ে থাকতাম আম্মাজান। জুমাবারের এই আধোনিভু সন্ধ্যায় যেন নিয়ম করে ভাইয়া আর আব্বু হারিয়ে যেতেন, হাওয়ায় মিশে গিয়ে অদৃশ্য হয়ে যেতেন, এভাবেই কি ভালোবাসা, মায়া আর মমতারা অদৃশ্য হয়ে যায় আম্মাজান, হঠাৎ হঠাৎ, একেবারে অকস্মাৎ?

কিন্তু আম্মাজান, আমাদের শৈশব তো আসলে ডাংগুলি খেলা বিকেলে হঠাৎ আছড়ে পড়া মাগরিবের আজানে মন খারাপ হয়ে যাওয়ার মতো ছিলো না আম্মাজান। বরং ঢাকার এই শহরে, ঝাঁঝালো রোদের দুপুরে, আপনাকে ফাঁকি দিয়ে ছাদে ঘুড্ডি ওড়ানোর স্মৃতিতে রঙিন আমাদের শৈশব। কিন্তু ওই বছরটিতে আম্মাজান, অপূর্ব শরতের বিকেল আমাদেরকে ডাকতে থাকত বনে-বাদাড়ে, ছুটে যেতে বলত সাঁকোর পরের ওই সবুজ গ্রামটিতে, নদী থেকে নদী, ঝাউবন পার হয়ে অনেক অনেক দূরে। কেন এমন হয়েছিলো আম্মাজান? আপনি কখনোই আমাদেরকে বলতে চাইতেন না, এমনকি বলতেন না পূর্ণিমার রাতে উঠোনে বসা গল্পের আসরেও।

আসা-যাওয়ার এই ছবিটা তো অনেক দীর্ঘ হয়েছিল আম্মাজান। ঢাকায় কী যেন সমস্যা হলো, আপনাকে আর আমাকে নানুবাসায় রেখে এসেছিলেন আব্বু। ময়মনসিংহ ইউনিভার্সিটির সুবিশাল ময়দানে নীরব পদচারণা আর প্রতীক্ষার যাতনা সয়ে সয়ে যেভাবে কেটে গিয়েছিল আমার শৈশবের একটা বৃহৎ সময়, এর জন্য কাকে দায়ী করবেন আপনি আম্মাজান? আকাশ থেকে আলো নিভে গিয়ে হঠাৎ অন্ধকারে ছেয়ে যাওয়া ইহসাসে যাতনাক্লিষ্ট কী সব সন্ধ্যা আমাকে চূর্ণবিচূর্ণ করত আম্মাজান, এর জন্য আমি কি কখনোই কারো কাছে কৈফিয়ত চাইতে পারব? সে আলাপ তোলা থাক আজকে আম্মাজান। আমি বরং একটু দুঃখবিলাস করি, চেপে রাখা মনে হঠাৎ ভেসে আসা আপনার ক্রন্দনরত হতবিহ্বল ছবিটি কল্পনা করি, অনুভব করি রক্তের প্রতি তীব্র সম্মোহন, অনাদিত্যের আলোয় হুব্বে-আখাবির এক হুলস্থুল আয়োজন।

কিন্তু আম্মাজান, এসব দৃশ্যের মুখোমুখি আমি আর কখনোই হবো না বলে বুক বাঁধলেও আমার জীবনে অদ্ভুতভাবে সেই দৃশ্যগুলো কীভাবে এসে উপস্থিত হয়ে গেল আম্মাজান? আমাকেও এখন ছেড়ে যেতে হয় আম্মাজান, আপনার দীঘল মায়াবী ডাকের ছন্দে দুলতে থাকা সম্মোহন।

ঘর ছেড়ে বের হয়ে যেতে যেতে পর্দার আড়ালে আপনি যখন কাঁদেন আম্মাজান, আমার অনেক কাঁদতে ইচ্ছে করে, আপনার সামনে দাঁড়িয়েই হাউমাউ করে কাঁদতে ইচ্ছে করে। কিন্তু আমিও তো আপনার মতোই। আড়ালে গিয়ে, নিজেকে লুকিয়ে, রাতের ছাত্রাবাসে শুয়ে-বসে কাঁদাতেই আমার সুখ আম্মাজান। কেউ দেখে ফেলছে কি না সে শঙ্কায় লজ্জাবনত হলেও কাঁদি, কাঁদতে আমার এখন ভাল লাগে আম্মাজান।

হঠাৎ মধ্যরাতে আম্মাজান, দূর থেকে ভেসে আসা উর্দু গজলের মাদকতায় যখন আমি মত্ত হয়ে থাকি, আমার সুমাইতার কথা অনেক মনে পড়ে আম্মাজান৷ তখনও আমি কেঁদে ফেলি। মানিব্যাগে সযত্নে আগলে রাখা ছবিটা আমি দেখি আম্মাজান। আপনি ওর চুলগুলো আঁচড়ে দিয়েছেন আজকে? সকালে নাশতা না খেলে আপনার ওই যে মধু-মাখানো শাসন, আজকে ওটা তোলা থাক আম্মাজান।

আম্মাজান, আপনি হয়তো চিনবেন না, এই যে এই মাঠটির কিনারায়, শিক্ষাভবনের দেয়ালঘেঁষে, বুকে বুক পেতে দিয়ে আব্বু যখন আমাকে কানে কানে বলেছিলেন, ‘আল্লাহর হাওয়ালা, ভালো থেকো তুমি, নিজের যত্ন নিয়ো’, বিশ্বাস করুন আম্মাজান, সেই শব্দগুলো ভেঙে ভেঙে, আমি নির্মাণ করেছি অনেকগুলো দুঃখের অক্ষর। সে অক্ষরগুলোও এখন পরিণত হয়েছে মস্ত বড় একটা বিষাদের প্রাসাদে আম্মাজান। এখানে বসেও আমি কাঁদি, আব্বুকে ভেবে, স্মরণ করে আব্বুর পাঞ্জাবি থেকে হুরহুর করে বের হতে থাকা আতরের সৌরভ। এসব দিন পেরিয়ে গেলে আমি আপনাকে দেখাব আম্মাজান, আমার সেই দুঃখের অক্ষর দিয়ে গড়া সুপ্রসন্ন প্রাসাদ।

তবে আম্মাজান, কটি মাত্র দিনের এই কান্নাগুলো নিপীড়নের মুখে আমাকে করে তুলেছে নির্ভীক। এইবার নদী পার হয়ে আকাশ ধরার দুঃসাহসী সংবাদ শোনাতে চাই আম্মাজান। ঠিক ঠিক পৃথিবীর আকাশ। আমি জানি আম্মাজান, আপনার হয়তো আবারও মন খারাপ হয়ে যাবে। নেচে উঠবে হয়তো মন খারাপের সেই পুরোনো সাম্পান। কিন্তু আম্মাজান, আপনি বিশ্বাস করেন, আমি এবার দেশান্তরের নীল ছোঁবোই। ওখানে আমার জন্য মিশরের বৈশ্বিক বিদ্যালয় অপেক্ষারত। আমার জন্য আম্মাজান, আমার সাথি ভাইদের হাতে মিশরীয় মুদ্রার মহাভার অথবা বসফরাশের কোলঘেঁষে দাঁড়িয়ে থাকা আয়া সোফিয়ার আজান। আমি এই কসম খোদার, স্বদেশের বুকে খুব মায়াকান্নার স্রোত হাঁকাব। আম্মাজান, আমি চলব, কতদূর—অনেকদূর। আমার কৈশোরবেলার হ্রস্ব-উ-এর কাছে। আম্মাজান, আপনার ঠিক মনে পড়বে কি না জানিনা, আপনি আমাকে পড়িয়েছিলেন, নারকেলের তলায়, কাজের ফাঁকে, ওই যে উঠোনটাতে আম্মাজান—এখন যেখানে স্বপ্নের পাথর-দালান হুরহুর করে বেড়ে উঠেছে। আপনি পড়িয়েছিলেন, ‘হ্রস্ব-উ তে একটি উট—উট চলেছে মরুর বুকে’। আম্মাজান আমার ধারণা, মিশরে অনেক ‘মরুর বুক’ আছে। ওখানে অনেক উট আছে। আম্মাজান, আমাদের পড়ার বইয়ের ছবিটার মতোন। কেমন কেমন উত্তপ্ত ধূসর, সুপ্রসন্ন বালিয়াড়ির ফাঁকে ফাঁকে উঁচুনিচু আস্তরণ। আপনি বুঝিয়েছিলেন আঙ্গুলির শাসনে—‘এই যে মরু, এই যে উট, উট চলছে মরুর বুকে’।

আম্মাজান, চুপিচুপি একটা কথা বলি, খুব বেশি হৃদয়ের কথা, একটু কাছে আসেন। আরেকটু আম্মাজান! আমার ভেতরেও এক সুবিশাল মরু প্রান্তর আম্মাজান। সেই প্রান্তরে জানেন? অনন্ত দুর্ভিক্ষ। পানি নাই একফোঁটা, শুধু তৃষ্ণাদগ্ধ কলবের অবিরাম ছোটাছুটি। এজন্যই কি না আম্মাজান, কীরকম অভদ্র দুপুরগুলোতে আমার চতুর্পাশে মিছিল করতে থাকে হতাশারা, স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে যেতে চায় মহাকাল ধরে জমাতে থাকা আত্মবিশ্বাস, সে মিছিলের বিরুদ্ধে আমি অকস্মাৎ দাঁড়িয়ে যেতে চাই আম্মাজান! আপনি কি আমাকে দাঁড়াতে দেবেন না আম্মাজান?

যাক গে, আম্মাজান আমি এইবার না হয় যাই? চলে যাই আম্মাজান। আমার কড়ুইটাকে নিয়ে ভালো থাকবেন আপনি। আপনার ওড়নার গিঁটে রেখে যাওয়া গোপন সংবাদে হঠাৎ মধ্যরাতে হাউমাউ করে কেঁদে উঠবেন জানি আম্মাজান, কিন্তু এখানেও তো কত কষ্ট, এই কলিজায় আম্মাজান। আপনি বুঝবেন না। বুঝবেন না জানি। না বুঝলেই কি, আমি তো যাবোই, অভিমানের ব্যাগে ভরে আপনার একশো একটি চুম্বন।

বহুদিন চুল্লিতে আগুন নাই। রান্নাঘরের গন্ধ নাই। আমি যাই, আমি ক্ষুধার্ত। জ্ঞানের তাড়নায় আমার পেটে পিঠ ঠেকে গেছে আম্মাজান। নিশি রাত্তিরে, মরু প্রান্তরে আমি চুম্বনগুলো খুব করে খাব। আর পিপাসার্ত হলে? অথবা গলায় আটকে গেলে? গলগল ঢেলে দেবো আপনার সমস্ত মধ্যরাতের অনুরাগ। ভয় নেই, কষ্টের থলিতে আমার তাও আছে আম্মাজান। আম্মাজান আপনার জীবনটা আমার সাথেই আছে। বদলিতে আপনাকে এই দেখেন, দেখেন না এক সুমিষ্ট কড়ুইয়ের অসাধারণ ছায়াপাত দিয়ে আগলে রেখেছি আম্মাজান।

যত যাই হোক, আপনাকে ছাড়া কষ্ট হবে ভীষণ। অনেক কান্না হবে। ছাত্রাবাসের শক্ত দেয়ালে মাথা রেখে কি করে ঘুমাব! অতো ঘুম পাব কই। অতোটা নিঠুর আমি হতে পারব না জানি আম্মাজান! আমি তো নিঠুর নই। আম্মাজান, তাহলে করবটা কী? বলেন, আমি কী করব? আম্মাজান, এইজন্য আমি চাচ্ছিলাম যে, বিকালের উকুনবাছা দিনগুলোতে আপনার পায়ে মাথা পেতে দেয়া সেই সোহাগও নিয়ে যাব। সেইসাথে আপনার আঁচলের দীঘল মায়াটুকু আম্মাজান।

আম্মাজান, দেরি হয়ে গেল খুব। এবার যেতেই হবে। যাই তাহলে। বিদেশিরা অপেক্ষা করছে। স্বাগতম বলবে বলে বন্দরে এসেছে ওরা। চলে যাবার সময় আমার বুকেও কি আপনি পুড়ে দিবেন কোনো বিশেষ সংবাদ?

বিজ্ঞাপন

Subscribe
Notify of
guest
4 Comments
Oldest
Newest Most Voted
Inline Feedbacks
View all comments
মুহাম্মাদ আব্দুল কাদির
মুহাম্মাদ আব্দুল কাদির
1 year ago

লেখাটা হৃদয় ছুঁয়েছে। 🌺

হাবীব মাওদুদ
হাবীব মাওদুদ

তোমার সাজেশনে লেখাটি পড়লাম।
ভালোই তো। বেশ সুন্দর 🩵

আহমদ আমিন
আহমদ আমিন
1 year ago

আম্মার কথা মনে পড়তেছে লেখাটা পড়ে। যোগাযোগ-এ পড়া এটাই প্রথম লেখা, বাকিগুলোও এরকম ভালো হবে আশাকরি।

উবাইদুল্লাহ নাঈম
উবাইদুল্লাহ নাঈম
1 year ago

একসঙ্গে সবটা লেখা পড়তে পারিনি। অর্ধেকটা পড়ার পর বউয়ের কল এসেছে। কথা বলেছি। পরীক্ষার কথা খাতা দেখেছি কটা। তারপর পরের বাকি লেখাটুকু পড়েছি। খুব ভালো লেগেছে ।

‘যোগাযোগ’ এর কাছে এমন আরো লেখা চাই

স্বত্ব © ২০২৩, যোগাযোগ | ই মেইল : jogajogbd.org@gmail.com

যোগাযোগ-এ প্রকাশিত কোনো লেখা, ছবি কিংবা শিল্পকর্ম লেখক অথবা কর্তৃপক্ষের অনুমতি ছাড়া কোথাও প্রকাশ করা অবৈধ৷