এটা কেউ অস্বীকার করবে না যে একটি পরিবার, জাতি ও দেশের উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ নির্ভর করে শিশুদের সঠিক শিক্ষা ও প্রশিক্ষণের ওপর। শিশুর ভালো মানসিক প্রশিক্ষণ এবং ব্যক্তিত্বের সর্বাঙ্গীণ ও সুষম বিকাশে সাহিত্য একটি কার্যকরী উপাদান হিসেবে প্রমাণিত। অপরদিকে, শিশুসাহিত্য সৃষ্টি করা কোনো শিশুখেলা নয়। একজন বয়স্ক মানুষের জন্য শিশুদের মানসিক স্তরে নেমে আসা কঠিন বৈকি। নিজেকে শিশুসম কল্পনা করে বিষয় চিন্তা করা, বুঝা এবং লেখা অত্যন্ত দক্ষতা ও মুনশিয়ানা দাবি করে।
শিশুসাহিত্য নিয়ে আলোচনার আগে আমাদের বুঝতে হবে শিশুসাহিত্য আসলে কী। একটি লেখার কোন কোন স্বভাব-বৈশিষ্ট্য এটিকে শিশুসাহিত্যের পর্যায়ভূক্ত করে। নানান পণ্ডিত শিশুসাহিত্যকে তাদের নিজস্ব ভাব-ভাষায় সংজ্ঞায়িত করেছেন। এই সংজ্ঞাগুলির মধ্যে একটি সাদৃশ্য-পয়েন্ট হলো শিশুসাহিত্য হতে হবে শিশুর মেজাজ ও চাহিদা অনুসারে। শিশুসাহিত্যের অন্তত এই গুণপনা থাকা উচিত যে, তা শিশুদের প্রবণতা ও কৌতূহল মেটাতে সক্ষম হবে। শিশুসাহিত্যের বোঝাপড়ায় আমরা অতএব বলতে পারি—যে সাহিত্যের মাধ্যমে শিশুর আগ্রহ ও শখ তৃপ্ত হয় এবং যা বিভিন্ন বয়সের শিশুদের মনস্তত্ত্ব ও চাহিদা, প্রবণতা, কৌতূহল এবং তাদের বোধ ও উপলব্ধি-ক্ষমতার কথা মাথায় রেখে সৃষ্টি করা হয়, সেই সাহিত্যই প্রকৃত অর্থে শিশুসাহিত্য হবার যোগ্য।
শিশুসাহিত্যে শিশুদের মনস্তত্ত্ব ও প্রকৃতির প্রতি খেয়াল রাখার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দিক হলো শিশুদের জন্যই তা লিখিত হওয়া উচিত। যেহেতু বাচ্চাদেরও বয়স্কদের মতো পছন্দ-অপছন্দ রয়েছে, তাই এতে এমনসব বিষয় থাকা উচিত, যা তাদের মানসিক স্বাচ্ছন্দ্য এবং বিকাশে সহায়তা করে। আর তাই, শিশুসাহিত্য সৃষ্টি করতে হলে একজন লেখককে শিশু-মনোবিজ্ঞানে পারঙ্গম হতে হবে। শিশুদের মনস্তাত্ত্বিক ভাবধারা এবং তাদের অ্যাকাডেমিক ও সাহিত্যিক চাহিদা সম্পর্কেও থাকতে হবে গভীর ধারণা। থাকতে হবে সহজ করে উপস্থাপনার ক্ষমতা। তবেই তিনি শিশুদের সাহিত্য সৃষ্টি তৈরি করতে পারবেন।
শিশুদের জন্য গল্প লেখা বা তাদের জন্য সাহিত্যের অন্যান্য ধারায় কিছু লেখা সহজ বলে মনে হয়। কিন্তু আপনি যখন শিশুসাহিত্য লেখার চেষ্টা করবেন, তখন জানতে পারবেন এটি সবচেয়ে কঠিন ধারা। এটি হলো একটি গঠনমূলক ও বস্তুনিষ্ঠ সাহিত্য। লেখককে খেয়াল রাখতে হয় যেন শিশুটি এই গল্প বা গদ্য থেকে কোনো ধরনের ভুল বার্তা না পায় কিংবা বিপথগামী হয়ে না যায়। এছাড়াও তাকে চেষ্টা করতে হবে গল্পটিতে যেন উপদেশাত্মক শৈলী প্রাধান্য না পেয়ে যায়। কারণ উপদেশের জন্য পিতা-মাতা বা শিক্ষকই যথেষ্ট, এবং এটি মানব-মনস্তত্ত্বের খাসিয়ত যে, সরাসরি উপদেশ, নিরস কথাবার্তা পাঠকের মধ্যে একঘেয়েমি ও বিরক্তিভাব তৈরি করে। পঠিতব্য বইতে শিশুরা নতুন এবং আকর্ষণীয় কিছু খোঁজ করে—অ্যাডভেঞ্চার, কল্পনা বা ফ্যান্টাসি। তাদের এটা বোঝাতে হবে যে বইটি কেবল তাদের জন্যই লেখা। তাই, শিশুসাহিত্য তার স্ব-ভাবে এমন হওয়া উচিত; যাতে শিশুর সাথে একটি মনো-সংযোগ তৈরি হয় এবং শিশু নিজেকে এর সাথে অন্তরঙ্গবোধ করে। একই সাথে, বইটি শিশুমনে আনন্দ দেওয়ার সাথে সাথে তার কল্পনা করবার ক্ষমতাকেও যেন জাগ্রত করে। ঘটাতে পারে তার উদ্যম এবং তার মনোবলের বিকাশ।
মনোবিজ্ঞানীরা শিশুদের বয়সকে দুটি ভাগে ভাগ করেন। একটি হলো জন্ম থেকে ছয় বছর এবং এরপরে ছয় থেকে চৌদ্দ বছর বয়স। এই দুটি অংশই শৈশবের আওতায় পড়ে। এই বয়সের শিশুদের মন রঙ্গপ্রিয় হয়। এ ছাড়া তারা সুন্দর ছবি-চিত্রের প্রতিও আকর্ষণ রাখে। তাই শিশুসাহিত্য তৈরির সময় কার্টুন, ফটোগ্রাফি ও গ্রাফিক্স ইত্যাদির ব্যবহার তাদের জন্য আকর্ষণীয় হতে পারে। গল্পের সাথে ছবি ও রঙ এমনই আকর্ষণীয় হতে হবে; যাতে শিশু টিভি ও মোবাইলের বদলে এসব রঙিন বইয়ের জগতে হারিয়ে যায়। এর ভাষা খুব সহজ এবং শব্দের সংখ্যা কম হওয়া উচিত। একটি শিশু কোন বয়সে কতটা ভাষা জানে তা-ও লক্ষ্য করা গুরুত্বপূর্ণ। একজন শিশুসাহিত্যিকের মানবপ্রকৃতি, প্রাকৃতিক দৃশ্য এবং শিশুদের মনস্তত্ত্ব সম্পর্কে পূর্ণ জ্ঞান থাকা দরকার।
চৌদ্দ বছর পর, শিশুরা বয়ঃসন্ধির সীমায় পৌঁছে যায় এবং তাদের পছন্দ ও অভিরুচি বদল হতে থাকে। ইংরেজি এবং অন্যান্য পাশ্চাত্য ভাষায়, বিশেষভাবে এই কিশোর-কিশোরীদের জন্য ইয়াং অ্যাডাল্ট লিটারেচার প্রস্তুত করা হয় এবং এটি একটি নিয়মিত ধারা হিসেবে বিবেচিত। এতে তেরো বছরের বেশি বয়সি শিশুদের রুচি অনুপাতে বই-পত্র রচিত হয়। যাতে থাকে বিভিন্ন থিম ও বিষয়-বৈচিত্র। এই গল্পগুলিতে, প্লট, চরিত্র, দৃশ্যকল্প এবং সংলাপের মতো উপাদান পাওয়া যায়।
আজকের শিশুরা তারা শৈশবে কী ধরনের প্রশিক্ষণ ও বিকাশ লাভ করছে তার ওপর দেশের ভবিষ্যৎ নির্ভর করে। তাদের মানসিক এবং আবেগিক উন্নতিও সমভাবে গুরুত্বপূর্ণ। শিশুদের মানসিক বিকাশ ও উন্নতির জন্য পাঠ্যক্রমিক শিক্ষার পাশাপাশি যেটি সবচেয়ে কার্যকর তা হলো তাদের মাতৃভাষায় ভালো সাহিত্যের জোগান দেওয়া। এই সাহিত্য শুধুমাত্র শিশুদের শেখানোর জন্যই নয়, বরং তাদের বিনোদন এবং তাদের স্বাভাবিক ঝোঁক-প্রবণতা বিকাশের জন্যও। শিশুসাহিত্যকে তাই এই মূল্যবোধ ও বৈশিষ্ট্যের ধারক হওয়া উচিত। শিশুসাহিত্যে শিশুদের নান্দনিক সৌন্দর্যবোধকে পরিতুষ্টি, তাদের প্রশিক্ষণ এবং বিকাশই প্রধান লক্ষ্য হওয়া উচিত।
শিশুদের জন্য আন্তর্জাতিক সাহিত্যেরও অতীব প্রয়োজনীয়; যাতে তারা জানতে পারে অন্য দেশের শিশু কী ধরনের পরিবেশে বেড়ে ওঠে। তারা কী ধরনের ভাবনা-চিন্তা করে। এ ছাড়াও তার মধ্যে যেন বৈশ্বিক জ্ঞান-কলার প্রতি আগ্রহ সৃষ্টি হয়। জাদুর পরী, জাদুর কাঠি ইত্যাদি গল্প আজকের শিশুকে খুব একটা প্রভাবিত করে না, আজকের শিশু বাস্তবতার রঙে সবকিছু দেখছে। নতুন প্রজন্মের ব্যক্তিত্ব বিকাশ ও মানসিক পরিপক্বতার জন্য শিশুসাহিত্যের মানসম্পন্ন হওয়া খুবই জরুরি। আর মানসম্পন্ন সাহিত্য সৃষ্টির জন্য পৃথিবীর অপরাপর ভাষায় শিশুসাহিত্যের অভিজ্ঞতা থেকে উপকৃত হওয়ার বিকল্প নেই।