বাংলা সাহিত্যে কবিতার ইতিহাস সবচেয়ে পুরানো। মধ্যযুগে হিন্দু ও মুসলমান কবিরা প্রায় কাছাকাছি সময়ে লিখতে শুরু করেন। তখন তাদের রচনার মূল বিষয় ছিল কাহিনিকাব্য। এর কয়েকশ’ বছর পর উদ্ভব হয়েছে বাংলা গদ্যের। কবিতার শুরুটা গদ্যসাহিত্যের অনেক আগের। তাই দীর্ঘকাল কবি-সাহিত্যিকদের সমস্ত অনুভব-অনুভূতি প্রকাশের মাধ্যম ছিল কবিতা।
বাংলা ভাষায় এমন অসংখ্য কবির আগমন ঘটেছে যারা কবিতায়—ছন্দে, চিত্রকলায়, রূপক উপমায় ও প্রতীকী ব্যবহারে ফুটিয়ে তুলেছেন প্রিয়নবি মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে। নবিজীবনের বাঁকে বাঁকে ঘটে যাওয়া আখ্যান কবিতার মোহন ভাষায় বর্ণনা করেছেন। অভিনব ছন্দের ঝংকারে লিখে গেছেন পৃথিবীর শ্রেষ্ঠতম সুন্দরের অনুপম সৌন্দর্যের কথা। রচনা করেছেন নবিপ্রেমের কালজয়ী কবিতা, যা আপন শিল্পশক্তিতে সূর্যের ঔজ্জ্বল্য নিয়ে মিনারের মতো দাঁড়িয়ে আছে বাংলা সাহিত্যে।
কবিরা সুন্দরের প্রেমে পড়েন। সমস্ত সুন্দরের পায়েই অর্চনা নিবেদন করেন তারা। নির্মাণ করেন ভালোবাসার সৌধ। সে ভালোবাসার উষ্ণ স্পর্শে সৃষ্টি করেন কবিতা। প্রেমময় সৌরভে রচনা করেন ছন্দ। শব্দের বুননে তৈরি করেন মাত্রা। স্রোতস্বিনী নদীনালা, দিগন্ত বিস্তীর্ণ সবুজের সমারোহ, বিপুল সমুদ্র, উঁচু পাহাড়, প্রকৃতির অপার সৌন্দর্যের বাইরে গিয়ে সহস্র বছর আগে ধরার বুকে আগমন করা এক মহামানবের স্তুতি গেয়ে কবিরা রচনা করেছেন অনিন্দ্য কবিতাগুচ্ছ। সেই শ্রেষ্ঠ সুন্দরের নাম মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম। জন্মকালে যার সৌন্দর্যের স্ফুরণে আলোকিত হয়ে উঠেছিল পূর্ব-পশ্চিম। সুদূর রোম ও পারস্যের ইমারতগুলো চমকে উঠেছিল মক্কার দ্যুতি-কিরণে।
বাংলা ভাষা ও সাহিত্যে রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নাম ‘মুহাম্মদ’ শব্দটি প্রথম লিখেছেন রামাই পণ্ডিত তার ‘শূন্যপুরাণ’ গ্রন্থে। সেখানে তিনি লিখেছেন—
ব্রহ্মা হৈল্যা মঁহামদ বিষ্ণু হৈল্যা পেকাম্বর
আদম্ফ হৈল্যা শূলপাণি
গণেশ হৈল্যা গাজী কার্তিক হৈল্যা কাজি
ফকির হৈল্যা যত মুনি।[1] বাংলা সাহিত্যে রসূল চরিত, মুহাম্মদ মজিরউদ্দীন মিয়া, বাংলা একাডেমি (১৯৯৩)
মধ্যযুগে হিন্দু কবিরা প্রথম কবিতা (কাহিনিকাব্য) লেখা শুরু করেন। তারপর কাছাকাছি সময়েই লেখা শুরু করেন মুসলমান কবিরা। স্বভাবতই হিন্দু কবিদের রচিত কবিতাগুলো ছিল দেবদেবী-নির্ভর। পক্ষান্তরে মুসলমান কবিদের কবিতাগুলো ছিল মুসলিম পুরাকাহিনি ও ইতিহাস-নির্ভর। মুসলমান কবিরা তাদের কবিতা শুরু করতেন আল্লাহ ও রাসুলের গুণকীর্তন দ্বারা। মূলত ইসলামের শুরুর যুগ থেকেই আরবি-ফারসি গদ্য-পদ্য ‘হামদ’ ও ‘নাত’ দ্বারা শুরু করার প্রচলন হয়েছে। মধ্যযুগে বাঙালি মুসলমান কবিরা যখন প্রথম কবিতা লেখা শুরু করেন তখন তারাও সে একই পথের অনুসরণ করেন। এভাবে মুসলমান কবিরা শুরু থেকে বাংলাভাষায় আল্লাহর প্রশংসার পাশাপাশি রাসুলের গুণকীর্তন লেখার সূচনা করেন।
বাংলা সাহিত্যের প্রাচীন ইতিহাস অনুসন্ধান করে পাওয়া যায়, মুসলমান কবিদের প্রথম কাব্যগ্রন্থ লিখেছেন শাহ মুহাম্মদ সগীর। তিনিই প্রথম ‘ইউসুফ-জোলেখা’ নামে সর্বপ্রথম কাহিনিকাব্য রচনা করেছেন। সে গ্রন্থে তিনি প্রসঙ্গত রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের প্রশংসা ও বন্দনায় বেশ কিছু পঙ্ক্তি রচনা করেছেন। সেখানের কয়েকটি লাইন যেমন—
জিবাত্মা পরমাত্মা মোহাম্মদ নাম।
প্রথম প্রকাশ তথা হৈল য়নুপাম।।
জথ ইতি জিব আদি কৈল ত্রিভোবন।
তারপরে মোহাম্মদ মাণিক্য সৃজন।।
কবি শাহ মুহাম্মদ সগীরের পর মধ্যযুগের প্রায় সকল কবি রাসুলের প্রশংসায় কবিতা রচনা করেছেন। সে সকল কবির মধ্যে বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে যারা স্মরণীয় হয়ে আছেন তারা হলেন সৈয়দ সুলতান, দৌলত উজির বাহরাম খান, সৈয়দ মুর্তজা, দৌলত কাজী, সৈয়দ আলাওল, আবদুল হাকিম, ফকির গরীবুল্লা, সৈয়দ হামজা প্রমুখ।
গোটা মধ্যযুগের অন্যতম শ্রেষ্ঠ কবি হলেন সৈয়দ আলাওল। বিশেষত মুসলিম কবিদের মধ্যে তাঁকে শ্রেষ্ঠ কবি বলে গণ্য করা হয়। তিনি তাঁর প্রতিটি গ্রন্থে রাসুলকে নিবেদন করে কবিতা রচনা করেছেন। তাঁর বিখ্যাত ‘সপ্ত পয়কর’ কাব্যে রাসুল বন্দনায় লিখেছেন—
‘আদ্যেতি নিরুপ ছিল প্রভুর নির্বাকার।
চেতন স্বরূপ যদি হইল প্রচার।।
অতি ঘোরতর তমঃআকার বর্জিত।
মহা জ্যোতিমংয় হৈল আল্লার-ঈঙ্গিত।।
জ্যোতি সমুদ্রে আদ্যি নুর মহাম্মদ।
জগৎ বিজয়ী হৈতে পাইল সম্পদ।।
সপ্ত স্বর্গ উদ্যানের আদ্য নব ফুল।
বৃদ্ধি বাক্যে শিরোমণি ভুবনে অতুল।।
সেই পুষ্প হৈতে আদ্যে আদম উজ্জল।
সকল কদর্মপূর্ণ সে-ই নির্মল।’[2]সিদায়ে ন’মান, অনুবাদক, ড. মুহাম্মদ ফজলুর রহমান, প্রকাশক গাউছুল আ’যম ও আলা … Continue reading
অন্য এক কবিতায় সৈয়দ আলাওল লিখেছেন,
পূর্বেতে আছিল প্রভু নৈরূপ আকার।
ইচ্ছিলেক নিজ সখা করিতে প্রচার ॥
নিজ সখা মহাম্মদ প্রথমে সৃজিলা।
সেই সে জ্যোতির মূলে ভুবন নির্মিলা ॥
সেইসাথে বাংলা লোকসাহিত্যের যে অপরিমেয় ভান্ডার রয়েছে সেখানেও নানাভাবে ছড়িয়ে আছে রাসুল প্রশস্তি। সতরো শতকে বিখ্যাত লোককবি লালন শাহ লিখেছেন নবিকে নিয়ে—
‘তোমার মতো দয়াল বন্ধু আর পাবো না
দেখা দিয়ে দীনের রাসুল ছেড়ে যেও না।।
আমরা সব মদিনাবাসী
ছিলাম যেমন বনবাসী
তোমা হতে জ্ঞান পেয়েছি, পেয়েছি সান্ত্বনা।।’
আঠারো শতকের আরেক কিংবদন্তি লোককবি হাসন রাজা গেয়েছেন রাসুলকে নিয়ে এই গান—
‘আমি হৈতে আল্লাহ্ রাসুল, আমি হৈতে ফুল।
পাগলা হাসন রাজা বলে তাতে নাই রে ভুল।।
আমা হৈতে আসমান জমিন, আমা হৈতে সব।
আমি হৈতে ত্রি-জগৎ আমি হৈতেই রব।।’
এর বাইরে আরও অনেক কবি, লোককবি ও গীতিকবি রাসুলকে নিয়ে কবিতা ও গান-গজল রচনা করেছেন। বাংলা সাহিত্যের বিবিধ ভান্ডারে গচ্ছিত থেকে শুকনো গোলাপের মতো কালব্যাপী তা সুবাস বিতরণ করছে। আঠারো শতকের অন্যতম শ্রেষ্ঠ মুসলিম মনীষা, সমাজসংস্কারক ও ধর্মপ্রচারক মুন্সী মেহেরুল্লাহ লিখেছেন গ্রামবাংলায় বহুল পঠিত এই ‘নাত’—
‘গাও রে মোসলেমগণ, নবীগুণ গাও রে।
পরান ভরিয়া সবে সাল্লে-আলা গাও রে।
আপনা কালামে, নবীর সালামে, তাকিদ করেন বারী।
কালেবেতে জান, কহিতে জবান, যে তক্ থাকে গো জারি।
যে বেশে যে ভাষে, যে দেশেতে যাও রে
গাও গাও গাও সবে সাল্লে-আলা গাও রে।।’
বাংলা সাহিত্যে রাসুলের প্রশংসা ও নিবেদন করে এযাবৎ শতাধিক কাব্যগ্রন্থ, পুঁথিকাব্য, মহাকাব্য ও কাহিনিকাব্য রচিত হয়েছে। এর মধ্যে মধ্যযুগ ও আধুনিককালের কয়েকটি বিখ্যাত গ্রন্থের নাম হলো—
-
- রাসুল বিজয়, প্রকাশকাল ১৪৭৪, জৈনুদ্দীন বা জয়েন উদ্দীন (১৪৭১-১৫৮১)।
- রাসুল বিজয়, শাবিরিদ খান (১৪৪০-১৫৫০)
- রাসুল বিজয়, সৈয়দ সুলতান ( ১৫৫০-১৬৪৮)
- নবীবংশ, রচনাকাল ১৫৮৪-৮৬, সৈয়দ সুলতান
- রাসুল চরিত, রচনাকাল ১৫৮৪-৮৬, সৈয়দ সুলতান
- রাসুল বিজয়, শেখ চান্দ (১৫৬০-১৬২৫)
- নূরনামা, আবদুল হাকিম, (১৬০০-১৬৭০)
- নূর-নামা, আবদুল করিম খোন্দকার (আঠারো শতক)
- হালাতুন্নবী, মুনসী সাদেক আলী (১৮০১-১৮৬৯)
- হযরত মুহাম্মদ, রচনাকাল (১৯০৩-১৯১০), মোজাম্মেল হক (১৮৬২-১৯৩৩)
- মদীনার গৌরব, মীর মশাররফ হোসেন (১৮৪৮-১৯১২)
- আশেকে রাসুল, মুহম্মদ দাদ আলী (১৮৮৫-১৯১২)
- হযরত মহাম্মদ, জয়নাথ নন্দী মজুমদার (১৮৬৩-১৯৪২)
- মরুভাস্কর (অসম্পূর্ণ মহাকাব্য), কাজী নজরুল ইসলাম (১৮৯৯ –১৯৭৬)
- সিরাজাম মুনীরা, প্রকাশকাল ১৯৫২, ফররুখ আহমদ (১৯১৮-১৯৭৪)
- মহানবী, আবদুর রশীদ ওয়াসেকপুরী, প্রকাশ ১৯৮০
আধুনিক মুসলিম কবি প্রায় প্রত্যেকেই রাসুলকে নিবেদন করে কবিতা সৃষ্টি করেছেন। জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম এক্ষেত্রে সকলের অগ্রগামী। কবিতা ও হামদ (গজল) সবমিলিয়ে শখানেক কালজয়ী রচনা তিনি রাসুলকে উপজীব্য করে লিখেছেন। ‘মরুভাস্কর’ নামে একটি মহাকাব্যও তিনি শুরু করেছিলেন। অসুস্থতার কারণে তা সম্পন্ন করতে পারেননি। বোধ করি যদি সম্পন্ন করতে পারতেন তাহলে বাংলা সাহিত্যে একটি স্মরণীয় অধ্যায় হয়ে থাকত এই মহাকাব্য। রোগশয্যার পূর্বে অসমাপ্ত এই কাব্যগ্রন্থে তিনি আঠারোটি বড় কবিতা লিখতে পেরেছেন। সেসব কবিতায় রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের জন্ম, শৈশব-কৈশোর, তারুণ্য ও বৈবাহিক জীবনসহ জীবনের বেশকিছু দিক উঠে এসেছে। কাজী নজরুল ইসলামের সামগ্রিক কবিতা ও গজলে রাসুলের জীবন ও সৌন্দর্য ফুটে উঠেছে অসামান্য ব্যঞ্জনায়। কী গভীর আবেগ ও ভালোবাসা মেখে আছে কবিতার শব্দে শব্দে। বাংলা ভাষা গর্বিত জাতীয় কবির এই কাব্যপ্রয়াসে। রাসুল প্রশস্তিকে তিনি এক অনন্য উচ্চতায় সমাসীন করেছেন।
নজরুল পরবর্তী বিখ্যাত যে আধুনিক কবিদল রাসুলকে নিবেদন করে কবিতা সৃষ্টি করেছেন তাদের মধ্যে শাহাদৎ হোসেন, গোলাম মোস্তফা, জসীমউদ্দীন, বে-নজীর আহমদ, বন্দে আলী মিয়া, কাজী কাদের নেওয়াজ, সুফিয়া কামাল, ফররুখ আহমদ, তালিম হোসেন, সৈয়দ আলী আহসান, রওশন ইজদানী, আব্দুর রশীদ ওয়াসেকপুরী, আব্দুল মান্নান সৈয়দ, আল মাহমুদ, ফজল শাহাবুদ্দীন, আবিদ আজাদ, আসাদ চৌধুরী, আল মুজাহিদী ও আবদুল হাই শিকদার সবিশেষ উল্লেখযোগ্য।
মধ্যযুগের শাহ মুহাম্মদ সগীর থেকে আজকের একুশ শতকের দ্বিতীয় দশকের হাসান রোবায়েত পর্যন্ত রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে নিবেদিত কবিতার যে সিলসিলা জারি আছে তা সমগ্র বাংলা ভাষার ইতিহাসে শ্রদ্ধা ও ভালোবাসার এক অনুপম নজির। জরুরি দলিলও বটে। বহু শতাব্দীকালব্যাপী এই শ্রদ্ধার্ঘ্য কবিতাগুচ্ছের শব্দ ও ছন্দের ভেতর মহত্তম রাসুলের গুঞ্জনধ্বনি পাখির কূজনের মতো বাজতে থাকবে। রূপসি বাংলার ওপর দিয়ে উড়ে যাওয়া সবুজ হাওয়ার মতো এই সুন্দরতম কবিতা হৃদয় থেকে হৃদয়ে ছড়িয়ে যাবে অনিবার্য নবিপ্রেম।
তথ্যসূত্র:
উল্লিখিত প্রবন্ধটি ‘রাসুলকে নিবেদিত বাংলা সাহিত্যের কালজয়ী কবিতা’ গ্রন্থের ভূমিকা এবং ভূমিকাটির দ্বিতীয় পর্ব। প্রথম পর্বটি প্রকাশিত হয়েছে যোগাযোগের পূর্ববর্তী সংখ্যায়।
উল্লেখ্য যে, এই প্রবন্ধে বিশ শতকের কোনো কবির কবিতা রাখা হয়নি, প্রসঙ্গত কেবল নাম উল্লেখ করা হয়েছে। বিশ শতকের কবিদের কবিতা সরাসরি বইয়ে চলে এসেছে। এ সম্পর্কে বিস্তারিত জানার জন্য বইটি সংগ্রহ করতে পারেন। বইটি প্রকাশ করেছে ইলহাম।