যেভাবে ‘উপন্যাস’ হয়ে ওঠে

আবদুল্লাহ আল মুনীর

হোটেল নিয়ে এমন বিড়ম্বনায় পড়ব বুঝতে পারিনি। শিবচরের পথঘাটে তেমন প্যাঁচগোচ নেই। দোকানপাট সারিবদ্ধ, গোছানো। জীবনযাপনের প্রয়োজনীয় সকল উপকরণ এ বাজারে বিদ্যমান। একটি বিরিয়ানির দোকানও দেখতে পেলাম। ঢাকা থেকে খানিকটা দূরের একটি জেলায় বিরিয়ানির দোকান পাওয়া আমার জন্য বেশ আনন্দের। ইচ্ছে রাখলাম, রাতের ভোজন ওই দোকানেই হবে। মানুষজনকে জিজ্ঞেস করতে করতে অবশেষে খুঁজে পেলাম আবাসিক হোটেল। পর পর দুটো। সম্ভবত এ তল্লাটে এই দুটোই আছে। থাকবার কথাও তো নয়। না পর্যটন এলাকা, না শিল্পনগরী, এমন ছিমছাম সাদামাটা পল্লিতে আবাসিক হোটেলের চাহিদা কেন থাকবে? প্রথম হোটেলে ঢুকে লাভ হলো না। এলাকার পাতিনেতারা হোটেলের সবগুলো কামরা অজানা কারণে দখলে রেখেছে। পরের হোটেলে গিয়ে দেখি ম্যানেজার নেই। হোটেলের সবগুলো কামরা তালাবদ্ধ। এভাবে সব ফেলে রেখে ম্যানেজার কোথায় উধাও হয়েছেন, তা জানতে নোটিশবোর্ডে থাকা নম্বরে কল করলাম।

ক্রিং ক্রিং.. ক্রিং ক্রিং

‘কে? কে বলছেন?’

‘আপনার হোটেলে থাকতে এসেছি। এসে দেখি রিসিপশনে কেউই নেই।’

‘ওহ থাকতে আইছেন! এক কাম করেন। বোর্ডে চাবি ঝুলানো আছে। ১৩ নম্বর চাবিটা নিয়া রুমে যান গা। আমি ঘন্টাখানেক পর আসমু। তহন টাকাপয়সা দিয়েন।’

বোকা মানুষের মতো ‘আচ্ছা’ বলে ফোন রেখে দিলাম। এর আগে বোধহয় কোনোদিন এমন অদ্ভুতভাবে কোনো আবাসিক হোটেলে চেক ইন করিনি। তেরো নম্বর রুম নিতান্তই ছোট। সিঙ্গেল খাট। একটি টেবিল, মশারি, অ্যাশট্রেসহ প্রয়োজনীয় সবই আছে। টেবিল পেয়ে আমার ভালোই হলো। খাতা-কলম রাখলাম তাতে। ফ্রেশ হয়েই লিখতে বসে পড়ব। বাহাদুরপুরের স্মৃতিগুলো হারিয়ে গেলে বড্ড আফসোস হবে।

খুব ভোরে ঢাকা ছেড়েছিলাম। যাত্রাবাড়ী থেকে মাওয়াঘাট পৌঁছলাম বাসযোগে। মাওয়াঘাটে এক বিব্রতকর ঘটনা ঘটে গেলে। গাড়ি থেকে নামতেই আমাকে ঘিরে ধরল একদল বাইদানি। টাকা চাই তাদের। এর আগে বহুবার হিজড়ার মুখোমুখি হলেও বাইদানির অভিজ্ঞতা এই প্রথম। বড় নাকফুল পরা কালচে রঙা কপটচারিণী একজন আমার হাত ধরে রেখেছে, আর আমি কাঁপছি। মানিব্যাগ বের করে দশটাকার নোট বের করতে গিয়ে টুস করে বিশ টাকার দুটো নোট মাটিতে গড়িয়ে পড়তেই সে তা তুলে নিয়ে চলে গেল। আমি অকস্মাৎ ঘটে যাওয়া ঘটনাটি দ্রুত ভুলে যাবার ইচ্ছেপোষণ করে ঘাটের দিকে হাঁটলাম।

মাওয়াঘাটে দাঁড়িয়ে থাকা কাঠালবাড়িগামী ছোট্ট লঞ্চে মানুষ গিজগিজ করছে। লঞ্চ বোধহয় একদিকে কাত হয়ে ছিল। ভয় ও নতুন অভিজ্ঞতার অভিপ্রায় নিয়েই ওতে উঠলাম, গিয়ে বসলাম একদম উপরের পাটাতনের কিনারায়। মানুষগুলো সব আমার নিচে। দূরে দেখা যায় নির্মাণাধীন পদ্মাসেতু। লঞ্চটি ভটভটট শব্দে কালো ধোয়া উড়িয়ে সেতুর দিকে যাত্রা শুরু করল। আরও কাছে। একটা সময় সেতুর দুই পিলারের মাঝখান দিয়ে সশব্দে বেরিয়ে গেল নৌযানটি। এরইমধ্যে কয়েকবার পদ্মাসেতুর পিলারে দফায় দফায় লঞ্চের ধাক্কার ঘটনা ঘটে গেছে। আমাদের মানুষভর্তি লঞ্চটি তেমন কোনো অঘটন ঘটাল না।

ওপারে স্রোতবাহী পদ্মার দুধারে থাকা বালুচর আর কাশবন, মাঝে মাঝে জেলেদের সনের ঘর, সবুজ শস্যক্ষেত দেখতে দেখতে বিমোহিত হয়ে পড়লাম। হৃদয়ের ক্যানভাসে এঁকে নেবার চেষ্টা করলাম ‍দৃশ্যগুলো। উপন্যাসের চিত্রকল্পে এ আমাকে সহায়তা করবে। খুব বেশিক্ষণ নয়, আমরা কাঠালবাড়ি ঘাটে থামলাম। সবকিছু নতুন। অচেনা অঞ্চল। ঘাট ছেড়ে ওপরে উঠে বাহাদুরপুরের সিএনজি পেয়ে গেলাম। বাহাদুরপুর শব্দটি শুনতেই খুব চেনা মনে হলো। কল্পনায় বহুদিন ধরে এ গ্রামে আমি বিচরণ করেছি। সিএনজি মনোরোম হাইওয়ে হয়ে এগিয়ে চলছে, আমি মনে মনে এঁকে চলছি আমার গল্পের দৃশ্য। পাচ্চর হয়ে আমাদের সিএনজি বাহাদুরপুরের সরু সড়কে প্রবেশ করতেই আমার স্নায়ুচাপ বেড়ে গেল। সঠিক গন্তব্যে নেমে ঠায় দাঁড়িয়ে রইলাম খানিকক্ষণ। শ্বাস নিলাম প্রাণভরে। মাদারীপুরের বাতাস নাকি এদেশের সবচে স্বচ্ছ বাতাস। মনেও হলো তাই।

একজনকে জিজ্ঞেস করলাম, ‘হাজি শরিয়তুল্লাহর আস্তানা কোনদিকে?’ তিনি দেখিয়ে দিলেন। এর আগেই বাংলাদেশের বৃহত্তম মাদরাসা জামিয়াতুস সুন্নাহ পার করে এসেছি। এতদিন ধারণা করেছি, ওটাই বোধহয় ফরায়েজি আস্তানা। কিন্তু তা নয়। জামিয়াতুস সুন্নাহ থেকে কিছুদূরেই বিশালায়তনের জায়গাজুড়ে ফরায়েজি আস্তানা। হাজি শরিয়তুল্লাহর বর্তমান বংশধরদের অবস্থানও এখানেই। মাঠের একদিকে বড় মাদরাসা ও মসজিদ। আমি যখন মসজিদের সামনে পৌঁছেছি, তখন জোহরের নামাজ আসন্ন। মুসল্লিরা কাতারবদ্ধ হয়ে বসে আছে। সুনসান নীরবতা। এক ছাত্রের সঙ্গে আলাপ জমাবার চেষ্টা করলাম। সে জানাল, আজই নাকি বাহাদুরপুরের পীর সাহেব ঢাকা থেকে এসেছেন। ওই তো, সামনের কাতারে বসে আছেন। আমার ভাগ্য সুপ্রসন্ন বলা যায় তবে। সেই ঢাকা থেকে অনিশ্চিত ভ্রমণে বেরোতে গিয়ে আমিও তো চেয়েছি, কোনোভাবে যদি মহান হাজি শরিয়তুল্লাহর কোনো বংশধরের সঙ্গে সাক্ষাৎ হয়ে যায়!

নামাজের পর সবাই ধীরে ধীরে মসজিদ থেকে বেরোল। পীর সাহেবের পেছনে এক জটলা মানুষ। মুসাফাহার ভিড় কমিয়ে ধীরে ধীরে পীর সাহেব মাদরাসাপানে এগিয়ে চললেন। আমি চললাম পিছু পিছু। ভেতরে রাজ্যের উৎকণ্ঠা। একদম মাদরাসার সামনে তিনি দাঁড়ালেন। উসতাদদের হালপুরসি করছিলেন। আমি সামান্যদূরে সেই উৎকণ্ঠা নিয়ে দাঁড়িয়ে রইলাম। গুছিয়ে কথা বলতে পারি না, অপরিচিত কেউ হলে তো আরও ঝামেলা। তবু সাহস বুকে বেঁধে সালাম দিলাম। তিনি স্মিত হেসে মুসাফাহা করলেন। আমি কিছু বলব বুঝতে পেরে তিনি মুখের হাসিটুকু রেখে তাকিয়ে রইলেন।

‘আমি আবদুল্লাহ আল মুনীর। ঢাকা থেকে এসেছি। একটি গবেষণাকেন্দ্রের ছাত্র আমি। দীর্ঘদিন ধরে হাজি শরিয়তুল্লাহকে নিয়ে গবেষণা করছি। তার জীবন সম্পর্কে জানার চেষ্টা করছি। বলা যায়, বইয়ের পাতায় ছড়িয়ে থাকা তথ্যগুলোর অনেকাংশ আমি একত্রিত করেছি। আমার একান্ত ইচ্ছে, আপনাদের নিকট নতুন কোনো তথ্য থাকলে আমি সংগ্রহ করব। এ ব্যাপারে সহায়তা চাই।’

‘আরে মাশাল্লাহ! এই আপনারা শুনুন! আমাদের এই ভাই ঢাকা থেকে এসেছেন। আমাদের মেহমান। হাজি শরিয়তুল্লাহকে নিয়ে গবেষণা করছেন। বড় খুশির খবর। আসুন আপনি। আমরা অবশ্যই সহায়তা করবো। আপনি আসুন।’

আমার মনে পড়ে, পীর সাহেব আমার ডান হাতটি ধরে মাদরাসা ভবন পেরিয়ে বাবুর্চিখানার দিকে টেনে নিয়ে গেলেন। আমরা সর্বসম্মুখে, মাদরাসার উসতাদ ও ফরায়েজি নেতারা আমাদের পিছুপিছু। বেশ লজ্জায় পড়ে গেলাম। তবু মনের ভেতর অপরিসীম ভালো লাগা তৈরি হলো। পীর সাহেব বাবুর্চিখানা সংলগ্ন একটি কামরায় গেলেন। সাথে আমি ও পুরো দল। দুপুরের খাবার প্রস্তুত। কোত্থেকে হাজির হয়ে আচমকা কোনো মধ্যাহ্নভোজের আসরে ঢুকে যেতে ইতস্ততবোধ করছিলাম। কিন্তু পীর সাহেব বারবার আমার দিকে তাকিয়ে সেই স্মিত হাসিতে আমাকে স্বাভাবিক করতে চাইলেন। খাবারের বরতন এলো। ছোলার ডাল ও গরুর গোশতের তরকারি, সাথে সাদা ভাত। আমাদের মাদরাসাগুলোতে শুক্রবারে সচরাচর যে পদটি রাঁধা হয়। পীর সাহেব বুকে তোয়ালে বেঁধে নিজেই পরিবেশনে লেগে গেলেন। মাদরাসার সকল উসতাদ ও নিম্নপর্যায়ের কর্মচারিরা বসে ছিল। তিনি একে একে সবার পাত্রে খাবার তুলে দিলেন। আমি একনেত্রে তাকিয়ে ভাবছিলাম, হাজি শরিয়তুল্লাহ তো এমনই ছিলেন। উনিশ শতকের বাংলায় তাঁতি, কুলি, জেলে, মজদুরদের এক কাতারে দাঁড় করিয়ে মুসলিমদের ভেতর জেঁকে বসা জাতপাতের ভেদাভেদ দূর করেছিলেন তো তিনিই। মানুষ তাকে তাচ্ছিল্য স্বরে নাড়িকাটা মৌলভি বলত। কারণ তিনি সমাজের ধাত্রীশ্রেণির নারীদের অচ্ছুত মানতে নারাজ ছিলেন। সাবেকি কুসংস্কারপন্থিরা তাকে জোলার পীর বলে কটাক্ষ করত, কারণ তিনি জোলাশ্রেণির দরিদ্রদের মাথায়ও সস্নেহ হাত রাখতেন। এই অভাবী দরিদ্র মানুষগুলোকে নিয়েই তিনি গড়ে তুলেছিলেন বৃহত্তর শাসকগোষ্ঠী ইংরেজদের বিরুদ্ধে সুদৃঢ় প্রাচীর। দেড়শো বছর পর ফরায়েজি আন্দোলনের কেন্দ্রভূমিতে বসে তাঁর উত্তরসূরির মাঝে কি আমি তারই ছায়া দেখলাম? বোধহয় তাই। আমার পাত্রে খাবার তুলে দেবার সময় চৈতন্য ফিরে পেলাম। তিনি বারবার আমাকে যথাযথ আপ্যায়নের তাগিদ দিচ্ছিলেন। সাদামাটা খাবারটুকু আমি বেশ তৃপ্তির সঙ্গেই খেলাম। মনের ভেতর অদ্ভুত এক রোশনি ছেয়ে গেল।

আহারপর্ব শেষ হবার পর তিনি আলাপচারিতা শুরু করলেন। জানতে চাইলেন কীভাবে কী করছি। কথাপ্রসঙ্গে আমার মুখে ড. আহসানুল্লাহ ফয়সালের নাম শুনে জানালেন, তাদের কাছে থাকা সব তত্ত-উপাত্ত উনি পিএচডি থিসিসের জন্য নিয়ে গেছেন। নতুন কিছু তেমন নেই। আমার ভাগ্য ভালো, বায়তুল মোকাররমের পাঠাগারে অন্ধকার কক্ষ থেকে ধুলোঝেড়ে আহসানুল্লাহ সাহেবের সেই থিসিসটি উদ্ধার করেছিলাম। আনোখা কিছু তথ্য নিয়ে শরিয়তনামায় ব্যবহার করেছিলাম। পরবর্তীতে আরও যারা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কিংবা অন্য কোথাও থেকে হাজি শরিয়তুল্লাহ বা ফরায়েজি আন্দোলন নিয়ে থিসিস করেছে, তাদের প্রধানতম সূত্রগ্রন্থ হিসেবে বিবেচিত হয়েছে ড. মুঈন উদ্দিন আহমদ খানের ‘ফরায়েজি আন্দোলনের ইতিহাস’ এবং ড. আহসানুল্লাহ ফয়সালের ‘হাজী শরীয়ত উল্লাহর ফারায়েজী আন্দোলন : ইতিহাস, ধর্মীয় দাওয়াত ও রাজনৈতিক সংগ্রাম’। শরিয়তিয়া লাইব্রেরি থেকে থিসিসগ্রন্থটি প্রকাশিত হয়েছিল। বর্তমানে এটি কোথাও পাওয়া যায় না।

এছাড়াও আরেকজন ভাইয়ের সঙ্গে আমার পরিচয় করিয়ে দিলেন। তিনি হাজি শরিয়তুল্লাহকে নিয়ে এমফিল করেছেন। আমাকে সহায়তা করার নির্দেশ দিয়ে তিনি বিদায় নিলেন। পীর সাহেব ব্যস্ততার ভেতর আমাকে যে আন্তরিকতার সাথে গ্রহণ করলেন, এটুকু স্মৃতি আমি সহজে ভুলে যেতে পারব না। আমিও বিদায় নিয়ে বেরোলাম। বিদায়কালে জানতে চাইলেন, এখন কোথায় যাব! আমি জানালাম, এ মহিমান্বিত ভূমির আনাচকানাচে খানিকটা ঘুরে বেড়াতে চাই।

শিবচর বাজারের হোটেলটিতে কিছুক্ষণ বিশ্রাম নিয়েই বেরিয়ে পড়লাম। গুগল ম্যাপে আগের রাতেই ঘেটেঘুটে বের করেছি, শামাইল নামে একটি গ্রাম এখনও আছে। তবে নামে বিবর্তন ঘটেছে খানিকটা। বর্তমানে গ্রামের নাম চরশ্যামাইল। এটাই কি সেই শামাইল, যার ধুলিমেখে হাজি শরিয়তুল্লাহর মতো মহাপুরুষ বেড়ে উঠেছিলেন? দেড়শো বছর পর কীভাবে অবিকল থাকতে পারে শামাইল? আমরা হাজি শরিয়তুল্লাহর জীবনকথা পড়ে জেনেছি, তিনি দ্বিতীয়বার মক্কা থেকে ফিরে দেখেছেন, আড়িয়াল খাঁ তার ঘড়বাড়ি ভেঙে নিয়েছে। শামাইল ছেড়ে তিনি পাড়ি জমিয়েছিলেন ব্যাঙচড়ায়। পরবর্তীতে এই ব্যাঙচড়া গ্রামটি হাজিপাড়া নামে প্রসিদ্ধ হয়েছে। এরও বহুবছর পর, হাজি শরিয়তুল্লাহর কবর আরও একদফা স্রোতবাহী পদ্মার শাখানদী আড়িয়াল খাঁ ভেঙে নিয়ে যায়। পদ্মার সর্বনাশী আচরণ এখনও বদলায়নি। বছরের পর বছর নদীভাঙনের ফলে বিলুপ্ত হয় বহু গ্রাম। আবার আরেকদিকে মাথা গজিয়ে উঠে নতুন পলিমাটির চর। হয়তো তেমনই একটি চর এই চরশ্যামাইল। তবু, শামাইল শব্দটি যে গ্রামের সঙ্গে জুড়ে আছে, এত কাছে এসেও তা একবার দেখে যাব না, তা কীভাবে হয়!

বিকেলে বেরোলাম। গুগল ম্যাপের সহায়তায় চরের দিকে যে সড়কটি গেছে তার মাথায় এসে অটোভ্যান ভাড়া করলাম। ভ্যানচালক শুভ্রকেশী ও শুভ্রশ্মশ্রুমণ্ডিত। গম্ভীর মায়াবি অবয়বধারী। নিচুগলায় কথা বলেন। যেন এক আভিজাত্য রয়েছে তার মুখে। বয়স কত হবে! সত্তরোর্ধ তো বটেই। আমি ভ্যানে বসে গল্প জুড়ে দেবার চেষ্টা করলাম। কিন্তু তিনি বলেন কম। মাঝপথে জিজ্ঞেস করলাম,

‘আপনি কি দুদু মিয়াকে দেখেছেন?’

‘পীর দুদু মিয়া?’

‘হ্যাঁ!’

‘হুম দেখছি। বহুবার দেখছি।’

পরক্ষণে মনে হলো, আরে! দুদু মিয়া ইন্তিকাল করেছেন ১৮৬২ সালে। এই বৃদ্ধ তাকে কীভাবে দেখলেন? নিজেই বোকা বনে গেলাম প্রশ্ন করে। তবে কি বৃদ্ধ মিথ্যে বললেন? দেখে তো মনে হয় না উনি মিথ্যে বলার মানুষ। ধোয়াশা কেটে গেলো আরেকটি তথ্য মনে পড়ে। হাজি শরিয়তুল্লাহর বংশধরদের মধ্যে দুদু মিয়া দুজন। প্রথমজন হাজি শরিয়তুল্লাহর পুত্র মুহসিন উদ্দিন দুদু মিয়া। দুদু মিয়ার তৃতীয় পুত্র খান বাহাদুর সাইদ উদ্দিন আহমদ, তার পুত্র পীর বাদশা মিয়া, তার পুত্র পীর মুহসিন উদ্দিন দুদু মিয়া ২য়। ২য় দুদু মিয়া ছিলেন হাজি শরিয়তুল্লাহর পঞ্চম পুরুষ। তিনি ইন্তিকাল করেন ১৯৯৭ সালে। বৃদ্ধ ভ্যানচালক নিঃসন্দেহে তার কথাই ভেবেছেন। যাক, তাকে সত্যবাদী প্রমাণ করতে পেরে ভালো লাগল। আমরা এতক্ষণে চরশ্যামাইলে পৌঁছে গেছি।

ছোট্ট একটি বাজার পেরিয়ে দুদিকে দুটো পথ চলে গেছে। একদিকে নদীপাড়, তখন ব্রিজ হচ্ছিল; আরেকদিকে সরু ইঁটের সড়ক ঢুকে গেছে গ্রামে। আমার মনের ভেতর বারবার ভেসে উঠতে থাকল হাজি শরিয়তুল্লাহর শৈশব। আমবাগানের ঘটনা, আড়িয়াল খাঁর বুকে ঝাঁপিয়ে পড়ার দৃশ্য, আজিম তালুকদারের বাড়ি। চোখের সামনে সব জীবন্ত মনে হলো। পরবর্তীতে শরিয়তনামার পাতায় পাতায় ১৭৮১ সালের শামাইলে আমি ভ্রমণ করেছি মূলত এই চরশ্যামাইলের ভেলায় চড়েই। কল্পনার সাথে মিশে গেছে এ মাটির বাস্তবচিত্র। আমি আরও নিখুঁতভাবে দৃশ্যপট লুফে নিতে গ্রামের সরু সড়কে প্রবেশ করলাম। দুধারে কলাগাছের সারি। দীর্ঘ দূরত্বের পর একেকটি নিম্নবিত্ত কৃষকের বাড়ি। আমি ভেতরে তাকাই। শুকনো খরের জ্বালানির ধোঁয়া, উঠোনের কোণে দাঁড়িয়ে থাকা নারকেল গাছ, ছোট ছোট বালকের চাউনি, ঘোমটামুখে দ্রুত আড়ালে সরে যাওয়া গ্রামীণ নারী, সব আমি লুফে নিতে থাকি। গ্রামের বৃদ্ধরা আমাকে দেখে তাকিয়ে থাকে, অচেনা আগন্তুকের পদপাত তাদের মনে রহস্য তৈরি করে। আমি হেঁটে হেঁটে পূর্ণ করতে থাকি করোটির শূন্যস্থান। আরও খানিক বাদে ইঁটবিছানো সড়ক থেকে নেমে পড়ি ঝোঁপঝাড়ের আড়ালে থাকা ছোট্ট মাটির ট্রেইলে। যত সামনে এগোতে থাকি, দৃশ্যমান হতে থাকে ফসলের খেত, প্রজাপতি মৌমাছির উড়াউড়ি আর নিকট হতে থাকে আড়িয়াল খাঁ। আমি পাগলের মতো ছুটে চলি আড়িয়াল খাঁর দিকে। বিকেলের রোদে চোখ ধাঁধিয়ে আসে। দেখতে থাকি, চাঁদপুর ত্রিপুরা ভ্রমণ শেষে ওই তো ঘাটে কেরায়া নৌকা নিয়ে ফিরে এসেছেন হাজি শরিয়তুল্লাহ। পেছনে বলশালী জালালুদ্দিন মোল্লা। দুদু মিয়া বাবার ডান হাতটি ধরে বালুচরে নেমে আসছেন।

আমার মোহভঙ্গ হয় বহুক্ষণ পর। ইচ্ছে করেই আরও কিছুক্ষণ বুঁদ হয়ে রইলাম গল্পের ভেতর। তখনও শরিয়তনামার খসড়া প্রস্তুত হয়নি। ফিকশন নাকি নন-ফিকশন, এই দ্বিধায় দিন পেরোচ্ছিল। ঠিক আড়িয়াল খাঁর পাশে ঠায় দাঁড়িয়ে থাকা ডিঙিনৌকায় বসে যখন শীতল জলে হাত ছুয়েছি, তখন মনে হয়েছে, একটা উপন্যাসের জন্য আমি কিছুটা প্রস্তুত।

আড়িয়াল খাঁর নির্জন পাড়ে একাকী কাটানো সেই বিকেলটি আমার জীবনের অন্যতম সুন্দর একটি বিকেল। সূর্য যখন ডুব দিল, আমি পাড়ঘেঁষে হেঁটে হেঁটে ঠিক বাজারের নিকট এসে উঠলাম। সন্ধ্যার পর গ্রামীণ বাজারের সেই পরিচিত দৃশ্য, চায়ের স্টলে ভিড়, গল্পগুজব। পরিকল্পনা ছিল, এ অঞ্চলের ভাষা নিয়ে খানিকটা জানাশোনা করব। উপন্যাসে আঞ্চলিক ভাষার ব্যবহারে অভ্যস্ত হতেই এ সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম। সে অভিপ্রায়ে নিকটদূরত্ব থেকে বেশ লম্বা সময় গ্রামীণ মানুষের কথাবার্তা, প্রবাদ, উপমা, স্বর ইত্যাদি বুঝতে চেষ্টা করলাম। খুব একটা সফল হলাম না এ যাত্রায়। রাত তখন আটটা কি নয়টা। যাবার সময় হয়েছে। অচেনা পল্লিতে খুব বেশি রাত করা অনুচিত। এমনিতেই গ্রামের সবাই আমাকে নিয়ে ঢের কানাকানি শুরু করেছে। বৃদ্ধ ভ্যানওয়ালাকে খুঁজে পেলাম না। নতুন এক ভ্যানে রওনা হলাম শিবচরের দিকে।

হোটেলে ফিরে দিনলিপির খাতা নিয়ে বসলাম। আজ যা ঘটেছে, যা দেখেছি, যা শুনেছি, খচখচ করে সব লিখে চললাম। মশার কামড় খেতে খেতে আলোকস্বল্পতা নিয়ে লেখা অগোছালো সেই দিনলিপি পরবর্তীতে আমার ব্যাপক উপকারে লেগেছে। রাতে যখন হিসেবপত্তর গুছিয়ে দোকানিরা বাড়ি ফিরবে, আমি তখন বেরোলাম শিবচরের বিরিয়ানি খেতে। লেখায় নিমগ্নতার ফলে এর মধ্যে অনেক সময় গড়িয়ে গেছে। ভাগ্যিস লাল কাপড়ে মোড়ানো ডেগে আমার আহার্যটুকু বাকি ছিল। ভালোমন্দ বিচারের চেয়ে তখন উদরপুর্তিই মুখ্য ছিল বলে আজ বিরিয়ানির স্বাদ মনে করতে পারছি না।

বিজ্ঞাপন

Subscribe
Notify of
guest
6 Comments
Oldest
Newest Most Voted
Inline Feedbacks
View all comments
Tanjil Arefin Adnan
Tanjil Arefin Adnan
1 year ago

ভ্রমণসাহিত্য পড়তে বেশ ভালোই লাগে। মুনীর ভাইর লেখাটা বেশ ঝরঝরে, নদীর স্রোতের মতো লেগেছে। এটা পড়ে শরীয়তনামা উপন্যাসটা পড়ার লোভ লেগে গেল।

আব্দুল্লাহ আল মুনীর
আব্দুল্লাহ আল মুনীর
Reply to  Tanjil Arefin Adnan
1 year ago

জাযাকাল্লাহ ভাই। আপনার মন্তব্য আমাকে অনুপ্রাণিত করেছে।

Hossain Ahmad
Hossain Ahmad
1 year ago

লেখক যেখানে যেখানে গিয়েছেন, এ জায়গাগুলো একাধিকবার যাওয়া হলেও আমার কখনো এভাবে ভাবা হয়নি। দ্রুতই শরিয়তনামা পড়তে হবে।

মাহমুদুল হাসান
মাহমুদুল হাসান
1 year ago

শরীয়তনামা পড়ে শেষ করেছি গতকাল। এখনো রেশ কাটেনি। শেষ অধ্যায়টি পড়তে পড়তে গড়িয়ে পড়েছে দু’ফোটা চোখের জল। আর আফসোস হয়েছে, এই কীর্তিমান মানুষটিকে নিয়ে কেন আলোচনা হয় না!

মুনীর ভাইয়ের প্রতি কৃতজ্ঞতা।

মাহফুজ তাসনিম
মাহফুজ তাসনিম
1 year ago

মা শা আল্লাহ।
অনবদ্য রচনা।

মাহদি হাসান
মাহদি হাসান
1 year ago

সুন্দর লিখেছেন ভাই।

স্বত্ব © ২০২৩, যোগাযোগ | ই মেইল : jogajogbd.org@gmail.com

যোগাযোগ-এ প্রকাশিত কোনো লেখা, ছবি কিংবা শিল্পকর্ম লেখক অথবা কর্তৃপক্ষের অনুমতি ছাড়া কোথাও প্রকাশ করা অবৈধ৷