মাসের বিশ তারিখের পর থেকে বিবর্ণ হয়ে আসে প্রতিটি দিন। একটু একটু করে বিষণ্ণ হতে থাকে মন। যাপনের আনন্দ পরিণত হয় ঝরাপালকের বিস্বাদে। নিঃশব্দে ফেলা নিশ্বাসটুকুও হয়ে যায় হাহাকারের হাওয়া। তখন কেবল চোখের সামনে দেখতে পাই একটি ঝুলন্ত শেকল— যার আংটাগুলোতে ঝুলতে থাকে কতগুলো চিরকুট: বাসাভাড়া, খাবার বিল, মিলের বাজার, টুকটাক কেনাকাটা, যাতায়াত খরচ, ঋণ পরিশোধ, বাড়িতে টাকা পাঠানো এবং… এবং… ইত্যাদি।
শেষের দিনগুলো নিদারুণ টানাপোড়েনের মধ্যে কাটে। প্রায়দিনই নাস্তা করা হয় না। অফিসের সময় হলে ব্যাগ কাঁধে বেরিয়ে যাই। হাঁটার দূরত্বে অফিস, তাই গাড়িভাড়ার চিন্তাটা লাগে না। অফিসে এসে এটেন্ডেন্স দিয়ে কিচেনে ঢুকি; নিজেই বানিয়ে নিই বরাদ্ধ চা-টা। খালিপেটে এককাপ চা ফেলে কাজে বসি। ঘণ্টা দেড়েক পরে আসে হালকা নাস্তা। এটা খেয়ে আবারও কাজে নিরত হই। এদিকে পেটের একপাশ থেকে বেলুনের মতো ফুলতে থাকে দুপুরি-ভোজের খিদে।
অফিস শেষ হয় বিকেল পাঁচটায়। কিন্তু আমার বের হতে হতে সন্ধ্যা পেরিয়ে যায়। বাসায় গিয়ে কোনোদিন থাকে রান্নার দায়িত্ব, কোনোদিন মিলের বাজার। সেদিন রান্না ও বাজার দুটোই পড়ে গেল আমার ভাগে। খালি হাতে কীভাবে বাজার করব? আর বাজার না হলে তো রান্নাও হবে না! বাসায় যারা আছে, সবারই একই দশা। অগত্যা এক সহকর্মীর থেকে ২০০ টাকা ধার নিতে হলো। এই টাকায় কী কী বাজার করা যায়— এটা ভাবতে ভাবতে বাসার দিকে হাঁটতে থাকি।
গলির মুখের মুদি দোকানটায় ঢুকি। পেছনে ফেলে আসি মেরাদিয়া কাঁচাবাজার। পথের দুপাশে দোকানিরা কী চমৎকার শাক-সবজির পসরা সাজিয়ে বসেছে! আকাশছোঁয়া দামের কারণে মন চাইলেও কিছু কিনতে পারি না। ঠিক করি, আজ খিচুড়ি রাঁধব— কম টাকায় মজার খাবার। আতপ চালটা দেখিয়ে দোকানিকে জিজ্ঞেস করি—‘এই চাউলটা কত কেজি?’
‘৫৫ টাকা কেজি।’
‘আড়ইশো গ্রাম মসুর ডাল কত?’
‘৩৫ টাকা।’
‘মুগ ডাল আড়াইশো?’
‘৩৮ টাকা’।
‘আচ্ছা। এক কেজি পেঁয়াজ আর আড়াইশো রসুন দিয়েন।’
‘আর কিছু?’
‘ডিম দিয়েন একহালি।’
দোকানি সদাইগুলো একটি পলিথিনে ভরে মোট দামটা বলল—‘২২৬ টাকা হইছে।’
আমার কাছে আছে ২০০ টাকা, ২৬ টাকা টান পড়েছে। ভেবে দেখি, ডিম একহালি না নিয়ে দুটো নিলেই হবে। তখনই মনে পড়ে আদা নেওয়া হয়নি। সাথে সাথে ব্যাগ হাতড়ে পেয়ে যাই খুচরো ১৫ টাকা। দোকানিকে বলি—‘দুইটা ডিম রাইখা দেন। আর ১৫ টাকার আদা দিয়া দেন।’
বলতেই হয়, দোকানি সদয় হয়ে আদাটুকু দিয়েছে। নয়তো এই আক্রার বাজারে আদা আর জিরার যা দাম— গরুর মাংসের মতো এগুলোও সাধ্যের বাইরে চলে যাচ্ছে!
বাসার পাঁচতলার এক ইউনিটে থাকে চারজন সহকর্মী আর আমি থাকি ছাদের চিলেকোঠায়। রাতের খাবারটা তাদের সাথে হয়ে যায়; রান্নাও হয় তাদের কিচেনে। আমি এসে চাল-ডাল ধুয়ে খিচুড়ি বসিয়ে দিই। কাঁচামরিচ আনার টাকা ছিল না। একটি পলিথিনে পেয়ে যাই তিনটে মিয়ানো মরিচ। খিচুড়ির জন্য দুটো রেখে একটি দিয়ে দিই পেঁয়াজকুচির সাথে ডিমভাজির জন্য। ইচ্ছে ছিল দুটো ডিম ভেজে চারজনে ভাগ করে খাব। তখন এক সহকর্মী বদান্যতা দেখিয়ে আরও দুটো ডিম নিয়ে এল। রাতের খাবারটা সারা হয়ে গেল খিচুড়ি আর ডিমভাজি দিয়ে।
খাওয়া-দাওয়ার পর চলে আসি আমার রুমে। সারাদিন দরজা-জানালা বন্ধ থাকায় রুমটা গুমোট হয়ে ছিল। সব খুলে দিয়ে ছাদের কার্নিশে গিয়ে বসি। চোখে পড়ে আশপাশের বাসাগুলোর টুকরো টুকরো দৃশ্য। এক বাসার বেডরুমে দুজন বুড়োবুড়ি নতমুখে বসে আছেন। এক যুবক এসে তাদের সাথে কীসব কথাবার্তা বলল। একটু পরে এক যুবতী এসে বুড়ো লোকটিকে এককাপ চা দিল। লোকটি চা সামনে নিয়েও বসে রইলেন নতমুখে। আরেক বাসার কিচেনে এক নারী রান্না করছে। একটু পরপর এক পৌঢ় মহিলা এসে তাড়া দিচ্ছে তাকে। এক বাসায় ডাইনিং স্পেসে মনের আনন্দে খেলছে দুটি ছেলেমেয়ে। আরেক বাসায় সদ্য অফিস থেকে ফিরেছে এক লোক। ফ্যানের নিচে বসে হাঁপাচ্ছে। আরেক বাসায় ব্যালকনিতে ল্যাপটপে বুঁদ হয়ে বসে আছে এক তরুণী।
ছাদের কার্নিশে বসে দেখছি এমন জীবনছবির সরাসরি সম্প্রচার। হঠাৎ মনে হলো, আমাকেও কি কেউ এভাবে দেখছে? অন্ধকারের মুখোমুখি বসে এক তরুণ দিনযাপনের টালিখাতা নিয়ে খরচের কড়চা করছে— এটা কি কেউ বুঝতে পারছে? এই মনে হওয়াকে মনে মনে উত্তর দিই— কী জানি!
সাথে সাথে বোধ আসে, এটা আমাদের একটি মানুষিক অভ্যাস— আমরা নিজের অতল দুঃখগুলো চেপে রাখি আর অন্যকে দুঃখ পেতে দেখলে এর কারণ জানতে চাই। বেদনায় নীল হয়ে আছি, এসময় এসে কেউ যদি জিজ্ঞেস করল— ‘কী খবর! কেমন আছ?’ তখন ঠোঁটের কোণায় হাসির রেখাটি ধরে রেখে বলি— ‘এই তো, ভালো আছি!’ অথচ—
জীবনের সাথে রোজ খেলে যাই কানামাছি
ভালো নেই তবুও বলতে হয় ভালো আছি!
দক্ষিণ বনশ্রী, ঢাকা।
সুন্দর। লেখকের আর লেখা না পেয়ে হতাশ হলাম।
ভালোই লাগছিল। যদি আরেকটু লম্বা হত!
চমৎকার