নভেম্বরের এমন শীত শীত দিনেই তিনি চলে গেছিলেন। তখন নভেম্বর মাসেই ঠান্ডা পড়ত। কুয়াশা ঢাকা ঢাকায় ১৯৭৬ সালে তাঁর চলে যাওয়ার সঙ্গেই শেষ হলো এক দীর্ঘ অধ্যায়। প্রায় শতাব্দী প্রাচীন এক যুগের। কত বছর হয়ে গেছে, তিনি নেই। তবুও আফ্রো, এশিয়া, ল্যাতিন আমেরিকার জনতার লড়াই সংগ্রামের প্রেরণা হয়ে আজও জনমনে, গান, কবিতা, শিল্প-সাহিত্যের নানান মাধ্যমে, বাংলাদেশের কোনায় কোনায়, পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে, গণস্মৃতিতে ভীষণভাবে রয়ে গেছেন মজলুম জননেতা মওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানী।
১৮৮০ সালের ১৬ই ডিসেম্বর, সিরাজগঞ্জের হয়াধনগড়া গ্রামের এক মধ্যবিত্ত কৃষক পরিবারে জন্মেছিলেন, আব্দুল হামিদ খান। ডাক নাম ছিল চেকা। ছোটবেলা থেকেই দুরন্ত চেকা গান ভালবাসতেন। নিজেও গাইতেন। ফকিরি, দরবেশি, বাউল, মুর্শিদি শুনতেন তন্ময় হয়ে। অল্প বয়সেই খ্যাতি পেয়েছিলেন কবি গানের শিল্পী হিসেবে। সিরাজগঞ্জ ছিল কৃষক বিদ্রোহের ঘাঁটি। চেকা মিঞার জন্মের কয়েক দশক আগে অবিভক্ত বাংলার প্রথম সংগঠিত কৃষক বিদ্রোহ জমিদার ও বৃটিশ সরকারের রাতের ঘুম কেড়ে নিয়েছিল। আশৈশব চেকা কৃষি আন্দোলনের স্মৃতি, আখ্যান, লোকগাথা শুনতে শুনতে বড় হয়েছেন বলেই হয়তো ভবিষ্যতে তার জীবনে সবথেকে গুরুত্ব পেয়েছিল কৃষক জীবন। সারা জীবন তিনি কৃষক আন্দোলনের পক্ষে লড়াই করে গেছেন। হরেকৃষ্ণ কোঙ্গার পরবর্তীতে পুর্ব বাংলার কমিউনিস্ট নেতাদের বলেছিলেন, আপনারা ভাগ্যবান। ভাসানীর মতো নেতা পেয়েছেন। ভাসানী নিজে কখনো কমিউনিস্ট ছিলেন না। ছিলেন সান ইয়াৎ সেনের মতো জাতীয়তাবাদী নেতা। কিন্তু তিনি ছিলেন কমিউনিস্টদের পরম অভিভাবক। পুর্ব বঙ্গের কমিউনিস্টরা সব কাজে, সবসময় পাশে পেয়েছিলেন মওলানা ভাসানীকে। বাংলাদেশের অগ্রগন্য বাম নেতৃত্ব, রাশেদ খান মেনন, হায়দার আকবর খান রনো প্রভৃতি সব নেতাই ছিলেন মওলানা ভাসানীর লেফটেন্যান্ট।
খুব কম বয়সেই বাবা, মা, ভাই বোন সবাইকে হারিয়ে চেকা মিঞা আক্ষরিক অর্থেই অনাথ হয়ে পড়লেন। ঘটনাচক্রে বিশিষ্ঠ পীর নাসিরউদ্দিন বোগদাদী চেকার মধ্যে মানবিক গুণাবলি লক্ষ করে তাকে নিয়ে এলেন আসামের জলেশ্বর। বোগদাদী চেকাকে পাঠালেন দেওবন্দে। দেওবন্দ তখন ভারতের এক গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। সেখানে ধর্মীয় শিক্ষার পাশাপাশি অনেক বেশি গুরুত্ব ছিল স্বাধীনতা আন্দোলনের, স্বদেশী বোধের চর্চা। ডিগ্রি না নিয়েই ফিরে এলেন আব্দুল হামিদ খান। পীর হবেন না বলে সোজা চলে যান টাঙ্গাইলের সন্তোষে। স্কুল শিক্ষক হয়ে। তখন টাঙ্গাইল, ময়মনসিংহ, রাজশাহী পুব বাংলার সর্বত্রই জমিদারদের অত্যাচার ছিল প্রবল। ধীরে ধীরে কৃষক সংগঠন গড়ে তুলতে লাগলেন। ভাসানী ছিলেন পুরোপুরি অসাম্প্রদায়িক। দেওবন্দ থেকে ফিরে আসার অনেক পরেও অনেক জায়গায় তিনি বলতেন, ‘লোকে আমাকে মওলানা বলে জানে। আমার কিন্তু মাদ্রাসা পাসের ডিগ্রি নেই। তবুও দেওবন্দে যেটুকু যা শিখেছিলাম, তাই ভাঙ্গিয়েই মসজিদের ইমামতি করে জীবন কাটাতে পারতাম। কিন্তু আমার তা কোনকালেই পছন্দ হয়নি। আমি বরং তখন চুপচাপ বসে ভাবতাম, অধঃপতিত মুসলিম সমাজের কথা, গরিব চাষী মজুরের কথা। তাদের দৈন্যদশার কথা। জমিদার, মহাজনের অত্যাচার আর বিদেশি বেনিয়াদের শাসনে অতিষ্ঠ পরাধীন ভারতের কথা।’
ভাসানী বলতেন, রাশিয়া জেগে উঠেছে। রাজতন্ত্রকে ঝেঁটিয়ে বিদায় করে সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠা হয়েছে। বিশ্বাস করি চিরকাল এদেশেও মানুষ পশুর জীবন কাটাবে না। মওলানা বলতে যে ইমেজ অধিকাংশ লোকের মনে ভেসে ওঠে তা তিনি ছিলেন না। মওলানা উপাধি দেওয়া সম্ভবত হিন্দু সম্প্রদায়ের লোকজনের। মুসলিম হলে মুরব্বি অর্থে মওলানা বলার চল ছিলো। আসামের কৃষকদের নিয়ে ওঁর আপসহীন লড়াই রাতারাতি ওঁকে বিখ্যাত করে। তখন তিনি থাকতেন ধুবড়ীর ভাসানচর অঞ্চলে। সেখান থেকেই তিনি ভাসানী হন লোকমুখে। এমন এক মওলানা ছিলেন ভাসানী, যিনি জায়নামাজে বসেও গুনগুন করে বলতেন, তোমার পতাকা যারে দাও, তারে বহিবার দাও শক্তি। দলে দলে গরিব মানুষ ভাসানী হুজুরের মুরিদ হতে এলে তাদের ফর্ম ফিল আপ করতে হতো। সেখানে দুটি পয়েন্ট ছিল : ১, আজীবন কৃষক সমিতির সদস্য থাকব এবং ২, আমেরিকান সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে সোচ্চার থাকব।
১৯৪৯ এ মওলানা উপলব্ধি করেছিলেন পশ্চিম পাকিস্তানের ঔপনিবেশিক শোষন। তিনি গড়ে তুললেন আওয়ামী মুসলিম লীগ। শাসক মুসলিম লীগের পাল্টা আওয়াম বা জনতার মুসলিম লীগ। সভাপতি হলেন মওলানা ভাসানী। সাধারণ সম্পাদক শামসুল হক। দুই যুগ্ম সম্পাদক, খোন্দকার মুস্তাক ও শেখ মুজিবুর রহমান। তারপর তো একে একে গড়ে উঠতে লাগল গন-আন্দোলন। ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন। ১৯৫৪ সালে ফজলুল হক, সোহরাওয়ার্দী ও ভাসানীর নেতৃত্বে যুক্তফ্রন্টের মধ্যে দিয়ে মুসলিম লীগের নির্বাচনে ভরাডুবি। ১৯৫০ এ রাজশাহী জেলের খাপড়া ওয়ার্ডে কমিউনিস্ট কর্মীদের ওপর পুলিশের গুলিতে একাধিক বন্দির শহিদ হবার খবরে ভাসানী শুধু ব্যাথিত নন, ক্রুদ্ধ হয়ে সারা রাত অনশন করেন। ওই সময়েই জেলবন্দি ভাসানীকে ঠাট্টা করে দিনাজপুরের বিখ্যাত কমিউনিস্ট নেতা হাজী দানেশ বলেছিলেন যে, হুজুর চীনের মতো এ দেশেও বিপ্লব হলে কমিউনিস্টরা প্রথমেই আপনার দাড়ি কাটবে। ভাসানী জবাব দিয়েছিলেন, তাতে যদি সব মানুষ দুমুঠো ভাত পায় তাহলে কাটুক। অনেক পরে এই মওলানা ভাসানীই ঢাকার রাজপথে শ্লোগান তুলেছিলেন-কেউ খাবে আর কেউ খাবে না, তা হবে না, তা হবে না।
১৯৫৪ সালে আন্তর্জাতিক শান্তি সম্মেলনে গেলেন ভাসানী। সেখানে তাঁর সঙ্গে সম্পর্ক হয় পাবলো নেরুদাসহ পৃথিবীর প্রগতিশীল লেখক শিল্পী বুদ্ধিজীবীদের। দেশে ফিরে ১৯৫৭ সালে ভাসানী সন্তোষের কাগমারী গ্রামে আয়োজন করলেন এক ঐতিহাসিক সাংস্কৃতিক সম্মেলনের। সেখানে ভারত থেকে যোগ দিয়েছিলেন তারাশঙ্কর বন্দোপধ্যায়, প্রবধ সান্ন্যাল, নরেন্দ্র দেব, রাধারানী দেবী ও আরও অনেক বিশিষ্ট শিল্পী-সাহিত্যিক। ওই কনফারেন্সেই ভাসানী প্রথম পাকিস্তানের বিরুদ্ধে আলাদা হয়ে যাওয়ার ডাক দিয়েছিলেন। কথায় কথায় তারাশঙ্কর বন্দোপধ্যায়কে বলেও ছিলেন যে দশবারো বছরের মধ্যেই পুব বাংলা পাকিস্তান থেকে আলাদা হয়ে যাবে। কাগমারীতেই সেসময়ে বসেছিল আওয়ামী লীগের সর্বোচ্চ পর্যায়ের রাজনৈতিক বৈঠক। সেখানে দুটি প্রশ্নে মওলানা ভাসানীর সঙ্গে মূলত সোহরাওয়ার্দীর বিরোধ বাধে। সোহরাওয়ার্দী গোষ্ঠী মনে করতেন পাকিস্তান পুব বাংলার স্বায়ত্তশাসন ইতিমধ্যেই দিয়েছে। ভাসানী মানতে চাননি। সোহরাওয়ার্দী ছিলেন আমেরিকার সঙ্গে সমঝোতার পক্ষে। মওলানা বলেছিলেন, কোনো যুক্তিতেই তিনি সাম্রাজ্যবাদের সঙ্গে সমঝোতা করবেন না। এই দুই অভ্যন্তরীণ দ্বন্ধে ভাগ হয়ে গেল আওয়ামী লীগ। জন্ম নিল ভাসানীর নতুন দল ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি বা ন্যাপ। পশ্চিম পাকিস্তানের ন্যাপ কর্নধার হলেন সীমান্ত গান্ধী বাদশা খান। দুই বঙ্গেই ন্যাপ হয়ে উঠল প্রগতিশীল, কমিউনিস্টদের আশ্রয়স্থল। ভাসানী হয়ে উঠলেন রেড মওলানা। ভাসানী বলতেন, দুনিয়ার ধর্ম দুটি : জালিম ও মজলুম, ধনী ও গরীব। আপনাকে ঠিক করতে হবে আপনি কোন দিকে থাকবেন। মওলানা ভাসানী সারা জীবন থেকে গেছেন কৃষক শ্রমিক, জেলে, নাপিত, ধোপা ও সমাজের নিম্নশ্রেণির দিকে। তাই তো আজও তিনি প্রাতিষ্ঠানিক রাজনীতির বাইরে, জনমনে শুধুই মজলুম জননেতা হয়েই বেচেঁ আছেন।