ভারতবর্ষে আসিবার পথ, এইদিকে—

সালমান সাদ

একটা পাসপোর্ট কি তবে ইকারুসের ডানা

রাষ্ট্র নামক বদ্ধ ভূখণ্ড থেকে বহুদূর উড়ালের স্বপ্ন মানুষকে গ্রাস করে সবুজ রঙের এই বই হাতে এলে। এইসব ভাবতে ভাবতে পাসপোর্ট অফিস থেকে ঝিম ধরা এক দুপুরে বের হয়ে এসেছিলাম। অনেক ঝক্কি ঝামেলার পর, বেশ নির্ভার লাগছিল।

ফ্রেশ পাসপোর্টে একটা ভারতীয় ভিসা—একরকম প্রবণতা সবার থাকে। নতুবা অর্থ, সুযোগ ও সময়ের সামঞ্জস্যের অভাবে বইটা পৃষ্ঠার পর পৃষ্ঠা তেপান্তরের মাঠের মতো খালি পরে থাকে। আন্তর্জাতিক ছিলছাপ্পর, ইমিগ্রেশন এরাইভালের লাল নীল কালি ছাড়া পাতাগুলোকে নিষ্প্রাণ মনে হয়। সেবার সামান্য অর্থ, সুযোগ ও বন্ধুসঙ্গ—সব একত্রে মিলে গেল বলেই বোধহয় এক রাতে নিজেকে আবিষ্কার করলাম ঢাকা-কলকাতাগামী বাসের স্লিপার কোচে।

বিশ্বকাপ ক্রিকেট চলছিল। আমার খেলাধুলার দিকে তেমন আগ্রহ কোনোকালেই ছিল না। আমার ভ্রমণসঙ্গীর মনোবাঞ্ছা ছিল হিমালয়ের পাদদেশে বিছিয়ে থাকা হিমাচল প্রদেশ, যেখানে বাংলাদেশ ক্রিকেট দলের বিশ্বকাপের দুটো আন্তর্জাতিক ম্যাচ অনুষ্ঠিত হবে, সেটা উপভোগ করা। পৃথিবীর সবচেয়ে সুন্দর মনোরম ভিউর স্টেডিয়াম বলা হয়—ধর্মশালা আন্তর্জাতিক ক্রিকেট স্টেডিয়ামকে।

আমার ক্ষেত্রে পথই আমার মনজিল, পথই আমার লক্ষ্য। যেতে যেতে পথে দুচোখে যা ভেসে উঠবে হৃদয়ে তা ধরা থাকবে—আর কখনো আমার যত্নের অক্ষরে চিত্রিত হবে। সেটাই পরম কাঙ্ক্ষিত।

বাস-বিমান-বাস মিলিয়ে প্রায় দুদিনের যাত্রা সেটা। ঢাকা থেকে প্রায় ২২৭০ কিলোমিটার।

বাংলাদেশের ভূখণ্ডে কেবল শীত আসি আসি মধ্য অক্টোবর তখন। বেনাপোল বর্ডার আমার দেখা জীবনের প্রথম স্থলবন্দর, যেখানে আইনত সব অধিকার নিয়ে প্রবেশ করতে পেরেছি।

সারি সারি ট্রাক, শতবর্ষী গাছ, সীমান্তের কাঁটাতার আর বর্ডারগেট।

আমাদের শরীরী উপস্থিতি এলিমেন্ট ও সারফেসে, নানা ফর্মালিটিতে আটকে থাকে। কিন্তু চোখের আলো তো মুক্ত পাখির উড়ালের মতো বাঁধাহীন। ওপাশে বিস্তৃত অঞ্চলজুড়ে শুয়ে থাকা রহস্যময় ভারতবর্ষকে তাই এক মায়াবী পাড়ের দেশ বলে বোধ হলো। কে জানে কী বিপুল বিস্ময় আর অদেখা বিষয় অপেক্ষা করে আছে আগামী কয়দিনে। সিনেমা, বইপত্রে দেখা জানা অভিজ্ঞানমূলক আইডিয়াগুলো বাস্তবে আসলে কতটা কেমন?

সম্পূর্ণ নতুনত্ব অভিনবত্ব বলে একটা ব্যাপারের মুখোমুখি হতে যাচ্ছিলাম জীবনের প্রথম। আজন্ম নিজের দেশ, ভূমি, মাটি, মানুষ ও সংস্কৃতির অভ্যস্ত দেখার যে কাঠামো আমাদের ভেতর থাকে, এর বাইরে নতুন একটা অবয়বের সাথে পরিচয় ঘটার আনন্দ রোমাঞ্চকর। শত শত দরোজা খুলে যায় মনের ভেতর—জাগে দেশের সংকীর্ণ গণ্ডির বাইরেও বিপুল বিশ্বের তুলনামূলক বাস্তবতা, স্বাতন্ত্র্য বা ঘাটতি ও উপলব্ধির স্পষ্টতর পরিধি।

 

কলকাতা—সিটি অফ জয়

বর্ডারে স্বাভাবিকভাবেই শেষ হলো সব। সরাসরি বাসের যাত্রী হওয়ায় বিশেষ একটা লাইনে ইমিগ্রেশন অফিসে ঢোকা গিয়েছিল। ইন্ডিয়ার ইমিগ্রেশন নিয়ন্ত্রণ করে বিএসএফ, মিলিটারি অর্গানাইজেশন। ভেতরে তাই সব কেমন তটস্থ, ফিটফাট, মেশিনের মতো মানুষের বিনয়ী বাধ্য মুভমেন্ট। কোনো অনিয়মের ব্যাপারই সেখানে চোখে পড়ে না।

বাংলাদেশের ইমিগ্রেশন অফিস চালায় আধা সামরিক আনসার ও পুলিশ, এবং যথারীতি দালাল, ঘুস, স্পিড মানি, স্পিড লাগেজ ও বখশিশ চাওয়ার ব্যবস্থা। বাংলাদেশের সরকারি সবকিছুতেই কোথাও যেন এমন একটা সুপ্ত বিশৃঙ্খলা প্রকটভাবে অনুভূত হয়। সকালের মিষ্টি আলোয় বনগাঁ এলাকাটাকে ছোট একটা বাংলাদেশই মনে হলো। বাংলাদেশের বাস কাউন্টারে গিজগিজ। সোহাগ, হানিফ, সৌদিয়া, দেশ ট্রাভেলস, গ্রিন লাইন পরিবহন।

শুধু একটা জিনিসেই অনেক বড়ো তফাত লক্ষ করা যায়, সেটা হচ্ছে তাদের সাইনবোর্ড ও ব্যানারের বাংলা ফন্ট ও ভাষার ভঙ্গিমা। একটু মোটা মোটা করে একরকম হাতের লেখার মতো ফন্ট। অনেকটাই মানবিক স্পর্শমাখা মনে হয়। ভাষার অ্যাপ্রোচটাও, বিশেষত বিজ্ঞাপনে—অনেকটাই স্বাভাবিক দৈনন্দিন কথাবার্তার মতো। সরাসরি সম্বোধনে সরাসরি যোগাযোগের একটা ভঙ্গি, যেটা একরকম নির্ভরযোগ্যতা তৈরি করে।

বাংলাদেশে অফিসিয়ালি ইউজ হওয়া ফন্টগুলো অনেকটাই জ্যামিতিক, কৌণিক। ভাষাভঙ্গিটাও কিছুটা প্রান্তিক৷ মনে হয় পাশ থেকে কেউ কিছুটা ফর্মাল, বিজ্ঞাপন দিচ্ছি এই লজ্জা লজ্জা ভঙ্গিতে একটা কিছু বলে দিচ্ছে। আমাদের দেশের যানবাহনের আল্লাহু বা কালেমা শরিফের স্টিকারের মতো ওপাশের বেশিরভাগ বাস ও যানবাহনে জয় মা তারা স্লোগানটা লেখা থাকে। কলকাতার বাইরে পশ্চিমবঙ্গের বেশিরভাগ অঞ্চলেই দুর্গা নয়, এই মা তারার আর্চনা বেশি প্রচলিত। এটা একরকম আঞ্চলিক প্রচলন। দুর্গাপূজা ব্যাপারটা অনেকটাই কলকাতার ব্রাহ্মণ সম্প্রদায়ের একটা নাক উঁচু ঘটনা ও লিগ্যাসি—যেটা নানা জাত পাত নিয়ে থাকা বড়ো বাংলার রীতিকে কানেক্ট করে না। বাস কাউন্টারে কিছুক্ষণ অপেক্ষা করে এয়ারটেলের নতুন সিমকার্ড নেয়া গেল, সাথে সামান্য ক্যাশ রূপি। ডুয়েল কারেন্সি কার্ড থাকায় সাথে ক্যাশ রাখার প্রয়োজনীয়তা কম। ইন্ডিয়ায় ক্যাশলেস বিনিময়ের একটা রেভ্যুলেশন ঘটে গেছে। রাস্তার পাশের ঝালমুড়ি বা শরবতের ভ্যানেও ক্যাশলেস পেমেন্ট থাকে। ভারতীয় নাগরিকেরা নির্বিশেষে এই পলিসিকে অ্যাক্সেপ্ট করেছে। রাষ্ট্রীয় বিভিন্ন স্বার্থ-সিদ্ধান্তে একরকম স্বতঃস্ফূর্ত ঐক্য তাদের ভেতর লক্ষ করা যায়। এরপর এলো বিখ্যাত যশোর রোড ধরে আমাদের বাসযাত্রা। রাস্তার দুপাশে শতাব্দীপ্রাচীন এই গাছেরাই ১৯৭১ সালে হতভাগা বিহ্বল তাড়া খাওয়া উদ্ভ্রান্ত মানুষের ক্ষুধার্ত ভয়ার্ত মিছিলের সাক্ষী—সেই পথ আমরা পার করে যাচ্ছি কী নিরাপদে, ভাবতেই রোমাঞ্চকর একটা হাওয়ায় গা শিরশিরিয়ে গেল।

কলকাতা যাওয়ার জন্য বাসরুটের চেয়ে ট্রেনই সবচেয়ে ভালো, যদি সাথে অনেক বেশি মালপত্র না থাকে৷ যশোর রোড অপ্রশস্ত ও স্বাভাবিক হাইওয়ে নয়, বাসের গতি এভারেজে চল্লিশে থাকে৷ এ রুটের বাস তেমন উন্নত নয়, ভারতীয়দের রেগুলার যাতায়াতের পথও এটা নয়। সেখানে সবই রেলনির্ভর, তো বনগাঁ জংশন থেকে দু ঘণ্টায় মাত্র দশ রুপিতে সরাসরি কলকাতা যাওয়ারই পরামর্শ দেয়া হয়।

কলকাতায় সেবারে তেমন কাজ ছিল না। দুপুরে দিল্লির ফ্লাইট। সে অব্ধি অপেক্ষা। তার আগে শহরটা সামান্য ঘুরে দেখা৷ প্রচণ্ড স্যাঁতসেঁতে একরকম গরম টের পেলাম। রোদ, ধুলাবালি নিয়ে শহরটা যেন রাগী চোখে আমাদের দিকে তাকিয়ে আছে। দমদম এয়ারপোর্ট এরিয়ার প্রধান সড়কের পাশেই একটা সবুজ শাদা রঙের চারতলা বড়ো মসজিদ ও মাজার দেখে অবাক হলাম। আমার ধারণায় ছিল সেভাবে মসজিদ বোধহয় নেই এখানে, হয়তো অপ্রকাশ্য, কিছুটা গোপন জীর্ণ শীর্ণ অবয়বে অনেক ভেতর কিছু মহল্লায় দুয়েকটা মসজিদ থাকতে পারে। কিন্তু পশ্চিমবঙ্গ জায়গাটা আদতেই তুলনামূলক ধর্মনিরপেক্ষ একটা জায়গা। সেখানে স্কুল কলেজের মতো মাদরাসাও জেনারেল কারিকুলামের অংশ। কিছু জায়গায় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বা ভর্তিপরীক্ষার কোচিং সেন্টারের বিজ্ঞাপনী ব্যানারে দেখলাম সাধারণ এক্সামের পাশাপাশি মাদরাসা শব্দটাও ম্যানশন করা অবলিকের আগেপরে। স্বাভাবিকভাবেই সেগুলো আমাদের দেশের আলিয়া মাদরাসার মতো।

হাইওয়ে ধরে আসার পথপার্শ্বে একটা সুন্দর হাজি ক্যাম্পও দেখা গেল।

এক রিকশাওয়ালা উত্তর দমদম এয়ারপোর্ট এরিয়ায় আমাদেরকে দেখে এগিয়ে এসে জিজ্ঞেস করে বিমান টিকিট কিনতে চাই কি না। হ্যাঁ বলায় সে সুলভ মূল্যে টিকিট কেনা যাবে এমন একটা শপ আমাদেরকে রেফার করে নিয়ে যেতে চাইল। সম্ভবত এতে তারা কিছুটা কমিশন পায়। সেখানে টিকিট কনফার্ম করার পর দেখা গেল এজেন্টের কার্ড পেমেন্ট অ্যাক্সেপ্টের মেশিন নষ্ট। দোকানদার আমাদেরকে যে এটিএম বুথ রেফার করলেন গিয়ে দেখা গেল মেশিনে ক্যাশ নেই। বাংলাদেশে এটা একটা অসম্ভব ঘটনা। ইন্ডিয়ায় ক্যাশ অপ্রয়োজনীয় হয়ে উঠছে বা করা হচ্ছে, এগুলো তারই প্রসেস। এজেন্ট আমাদের আবারও আরেক বুথে পাঠালেন। সেখানে ক্যাশ থাকলেও আমাদের কার্ড অ্যাক্সেপ্ট করছে না।

স্টেট ব্যাংক অফ ইন্ডিয়ার এটিএম বুথই সিটিজেনরা সাধারণত বেশিরভাগ ব্যবহার করে। ক্যাশলেস মানি সিস্টেমটাই স্টেট ব্যাংকের অধীন।

আমরা ওই এলাকার সবচেয়ে বড়ো যে বুথ, সেটায় গিয়েও যখন দেখলাম কার্ড নিচ্ছে না, সেই বিদেশ বিভুঁইয়ে মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ল। পকেটে কোনো রুপিই নেই বলা চলে। দেশের ব্যাংকেও ফোন করা যায় না ইন্ডিয়ান সিম দিয়ে৷ বন্ধু তার রোমিং করে আনা সিম দিয়ে কল করতে সক্ষম হলেও দেশের ব্যাংক কলসেন্টার থেকে বিভিন্ন আজগুবি কথা বলে, সেগুলো কাজ করে না। মূল যে সমস্যাটা তারাও ধরতে পারেনি সেটা জানা গেল বুথের সাথেই লাগোয়া স্টেট ব্যাংকের ব্রাঞ্চে কথা বলে। তারা জানাল এই এটিএম বুথগুলো আসলে লোকাল, সরকারি ও আভ্যন্তরীণ লেনদেনের জন্য। এগুলো ভিসা বা মাস্টারকার্ড সাপোর্ট করে না। আপনারা কমার্শিয়াল ব্যাংকগুলোর এটিএমে যান। সেক্ষেত্রে HDFC BANK, CANARA BANK ইত্যাদি অসংখ্য ব্যাংক আছে।

তথ্যটা সিম্পল কিন্তু গুরুত্বপূর্ণ, না জেনে বিপদে পড়ে অনেকে।

কলকাতা এয়ারপোর্টে ঢুকে প্রথমেই চোখ ধাঁধালো আমাদের। একটা ডোমেস্টিক টার্মিনালই কাঠামোগতভাবে এত বিশাল যে দৃষ্টিভূমির সবটুকু জায়গা দখল করে থাকে এয়ারপোর্টই। অনেক মানুষের মধ্যেও নিরিবিলি প্রশান্তির ঠাহর হয় জায়গাটা।

ইন্টারন্যাশনাল হাই স্ট্যান্ডার্ডসহ আধুনিক ব্যবস্থা। ছিমছাম ফিটফাট। ঢোকার সময় স্বয়ংক্রিয় সিকিউরিটি, কম্পিউটারাইজড চেক ইন।

কলকাতায় বাঙলাভাষা কিছুটা কোণঠাসাই, তবে একেবারেই বিলুপ্ত হওয়ার পথে থাকত যদি স্থানীয় সরকারের প্রচুর প্রণোদনা ও উদ্যোগ না থাকত বাংলাভাষা নিয়ে। দেখলাম টার্মিনালের উঁচু সিলভার কালার সিলিং তার পুরোটাজুড়ে বাংলা বিভিন্ন বর্ণমালার ছাপ। বর্ণমালা, আহা আমার মধুর বর্ণমালা!

কত প্রদেশ, ভাষা ও জাতির মানুষ এখানে। পাঞ্জাবি ও শিখদেরকে আলাদা করা যায় বেশি, তাদের পোশাকের কারণে। এক দেশ এক সীমান্ত এক সংবিধানের ভেতরেই এ যেন এক তুমুল আন্তর্জাতিকতা! ভারত বিচিত্র, বিপুল, সম্ভবত পৃথিবীর সবকিছু নিয়েই একটা আলাদা বিশ্ব হয়ে আছে ভেতরে ভেতরে। তাদের মুদ্রার ভেতরে প্রায় ২৫টা ভাষা ও বর্ণমালা থাকে। আমরা ছোটো দেশ আর ছোটো একভাষী অঞ্চলের একরকম কালচার দেখে আসা মানুষরা আলোড়িতই হই এই বৈচিত্র‍্যপূর্ণ ব্যাপারটায়। আমাদের দেশের সবই আমাদের পরিচিত, একরকম বা কাছাকাছিই, আমাদের চিরচেনা ছাপ লেগে থাকে। আর তাদের কাছে তাদের দেশই কত নতুন কত অন্যরকম, একেক প্রান্তে একেক রকম আবিষ্কার—যা এক জীবনে পুরোপুরি শেষ হয় না।

আমার জীবনের প্রথম বিমানে চড়ার অভিজ্ঞতা হলো ভারতবর্ষে। কলকাতা থেকে দিল্লি ১৭০০ কিলোমিটার মাত্র দুই ঘণ্টার একটা সন্ধ্যাকালীন উড়ালে পৌঁছে গেলেও মনের ভেতর একটা কী যেন একটা খটকা খচখচ করে। কী যেন বিশাল একটা মিস করে গেলাম।

বিমান কি আসলে আমাদের নেসাসারি জীবনের অংশ? বিমানের যা খরচ, তাতে এটা তো সত্য, আকাশপথ সাধারণ জনতার ফ্রিকোয়েন্ট বা রেগুলার যাতায়াতের জন্য নয়। অত দ্রুত কোথাও পৌঁছানো কি মানুষের আদৌ দরকার? মানুষের দেহ কি শুধু ট্রান্সপোর্ট হওয়ার মতো কিছু? মানুষ যেখানে যাবে, তার সাথে যাবে দৃশ্য, অভিজ্ঞতা, উপলব্ধি, স্মৃতি, মানুষ, সম্পর্ক, গল্প, ঘটনা, সময়। মানুষ যেখান দিয়ে যাবে, করাঙ্গুলে সবকিছুর স্পর্শসুখ আস্বাদ করতে করতে যাবে। এটাই যাত্রা। এটাই মুসাফিরি।

কলকাতা থেকে দিল্লি ট্রেনে মাত্র ৬৫০ রুপি। টানা এক রাত এক দিনের যাত্রা। অনেকগুলো প্রদেশের মাটি, ভাষা, সংস্কৃতি, মানুষ ও দৃশ্যের ওপর দিয়ে ঝকঝক করে ছুটে যায় ট্রেন। স্টেশনে স্টেশনে মানুষ নামে, ওঠে। গল্প তৈরি হয়। বদলায় ভাষা, পোশাকের ধরন, ভাষাভঙ্গি, খাদ্য। বদলায় ঋতু, ভৌগোলিক পরিবেশ ও ছবি। এই এত বিশাল আয়োজন আমি ফেলে গেলাম আকাশের অনেক উঁচু দিয়ে মাটির দিকে তাকিয়ে, মাত্র ৬০ মিনিটে সবকিছু অতিক্রান্ত করে? মাটির কাছাকাছি থাকলেই তাই আসল মনুষ্যত্ব।

 

দিল্লির প্রাচীন সৌরভে কতিপয় সন্ধ্যা

রাত নয়টা নাগাদ দিল্লিতে নেমে বেশ শীত অনুভব করা গেল। যথারীতি এয়ারপোর্ট চোখ মন ধাঁধিয়ে দিল। সর্বত্রই একটা ট্রু লাক্সারি জাঁকজমক নিয়ে আছে। মরু অঞ্চলের কাছাকাছি হওয়ায় দিল্লির বাতাস বেশ শুষ্ক। কিন্তু সমস্ত শহরে, রাস্তায় এত বেশি পরিকল্পিতভাবে বনায়ন করা হয়েছে যে বুক ভরে সতেজ নিঃশ্বাস নিতে নিতে মনে হয়, এলেম কোথা!

দিল্লি বরাবরই মানুষের ট্রানজিট পয়েন্ট। সবচেয়ে সস্তার বিমান দিল্লি থেকে পাওয়া যায়। ধর্মশালা থেকে ফিরে আমরা তিন চারদিন দিল্লিতে থেকেছি, ঘুরেছি। ঢাকা শহরের মতোই লাগে কিছুটা। ঘিঞ্জি নোংরা প্রাচীন হাড়গোড় যথেষ্ট।

আমরা যেদিকে ছিলাম, পাহাড়গঞ্জ, রেলস্টেশনের পাশে একটা জায়গা। বেশিরভাগ ট্যুরিস্ট এইদিকেই থাকে। মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ অঞ্চল, কলকাতার নিউমার্কেট এরিয়ার মতো। প্রচুর মুসলিম হোটেল ও রেস্টুরেন্ট। দাড়ি-টুপি তথা আমাদের দেশের মাদরাসার বা মওলানাদের মতো পোশাকের অনেক মানুষ চোখে পড়বে। দেশ জাতি বর্ণের তফাত সরিয়ে দিয়ে মুসলিম কালচার ব্যাপারটা কী দারুণ সবাইকে এক চেহারার করে দিচ্ছে, একভাবে চেনা যাচ্ছে এরা মুসলমান। আমাদের গায়ে পাঞ্জাবি-পাজামা-টুপি না থাকলেও এই পোশাক এই রূপ খুব চেনা খুব নিজদের মনে হচ্ছে। বিদেশ বিভুঁইয়ে এ এক অদ্ভুত আত্মীয়তা বোধ!

মাদরাসা মসজিদ—চাঁদনি চকের দিকে কিছু গলি হুবহু আমাদের পুরান ঢাকার মতো। সংকীর্ণ গলি, নানার রকম ব্যাবসায়িক দোকান, ভ্যান, রিকশা, মানুষ, আতরের ঘ্রাণ, কাবাব বিরিয়ানির দোকান, মসজিদ আর মিহি লাউডস্পিকারে আজান। নতুনত্বের ছোয়া না লাগায় ৬০/৭০ বছর আগে ঘিঞ্জি নগরের বাজারছবি যেমন ছিল, এখনও পুরান ঢাকা আর পুরান দিল্লি তেমনই রয়ে যাওয়ায় মিলটা কি আসলে সেই পুরাতনের? পুরাতন স্ট্রাকচারের? পুরাতন রকমসকমের? ভাবতে অবাক লাগে, পাকিস্তান বা বাংলাদেশের মতো মুসলিম দেশের সমস্ত ইসলাম ও ইসলামি সংস্কৃতি, খাদ্যাভ্যাস, ইলমচর্চার উৎসভূমি কিনা এই হিন্দুস্তান, যেখানে মুসলিমরা আবার ইনফেরিয়র।

প্রচুর বাংলাদেশি, যারা ইউরোপের বিভিন্ন এম্বাসি ফেস করতে দিল্লিতে ডাবল এন্ট্রি ভিসায় আসে, তাদের দেখা পাওয়া গেল হোটেল রেস্টুরেন্ট এরিয়াতে। বিভিন্ন মুসলিম হোটেল ও বাংলাদেশি হোটেল গড়ে উঠেছে। যে হোটেল থেকে আমরা খাবার নিতাম সেখানে ওয়েটার ছিল কুমিল্লার এক ছেলে। কী সাবলীল বাংলায় কথাবার্তা, পরিচিত স্বাদের রুই মাছ, গরুর লাল ভুনা, বেগুন ভাজা, পুঁই শাকের তরকারি। কে বলবে এটা বিদেশ। বাংলাদেশের এক বন্ধুর সঙ্গে এক সন্ধ্যায় যাওয়া হলো দিল্লি ইউনিভার্সিটিতে, মেট্রো করে। হ্যাঁ জীবনের প্রথম মেট্র চড়াও আমার দিল্লিতে। দেখলাম শহর থেকে বিশ কিমি দূরের ইউনিভার্সিটিটা শুধুমাত্র মেট্রোর কারণে মূল শহরের ভেতরেই, এমন অনুভূত হয়। ইউনিভার্সিটির দুই ক্যাম্পাস শহরের দুই প্রান্তে, উত্তরে ও দক্ষিণে, কিন্তু মেট্রোতে এত দ্রুত যোগাযোগ যে মনে হয় এই রাস্তার এ পাশ আর ও পাশ যেনো। একদিন গেলাম দিল্লির নিজামুদ্দিন আউলিয়ার দরগায়—দরগা যতটা না আনন্দ দিল তারচেয়ে বেশি অবাক হলাম দরগার পাশেই বাংলাওয়ালি মসজিদ দেখে। বিশ্ব তাবলিগের মার্কাজ। আমার দাদা নানা, বাবা চাচা মামারা, আমার বংশ তাবলিগ-ঘনিষ্ঠ সেই শুরুর যুগ থেকেই। তাদের এই আনাগোনার স্থানে আমারও পদচারণা ঘটল, এই গেটে তারাও দাঁড়াত কত, আমিও—একজন পাহারাদার দরদি স্বরে আমাদের মসজিদের ভেতর আহ্বান করল। কিন্তু ঢোকা হলো না। বাইরে থেকে দেখলাম ভেতরের পরিবেশ, মানুষের বসে থাকা, বেডিংপত্র—বাংলাদেশের কাকরাইল মসজিদের মতো। শুধু এই ধর্মীয় যাপন কত আত্মীয়তার মুখোমুখি করে। ফাযায়েল আমল কিতাবে উল্লিখিত নিজামুদ্দিন মারকাজের সেই মাদরাসা কাশিফুল উলুমও দেখলাম। এই নামের ওপর প্রতিষ্ঠিত নারায়ণগঞ্জের একটা মাদরাসায় আমি হিফজ পড়েছিলাম। কত স্মৃতি মাথায় হুড়মুড় করে মিছিল নিয়ে এলো। বেশি কালক্ষেপণ না করে, যেহেতু কোন পার্পাসও ছিল না সেখানে থাকার মতো, তাই অনেক কিছু চিনেও না চেনা মানুষের মতোই আমরা ইন্ডিয়া গেট ও ময়দানের দিকে পা বাড়ালাম।

 

গালিব পথরোধ করে দাঁড়াল হঠাৎ!

পিনে দো ব্যায়ঠ কার মসজিদ মে জানিবাঁ,

ইয়া ও জাগা বাতা যাঁহা পার খুদা নেহি— মির্জা গালিব।

মসজিদ খোদার ঘর? মসজিদে বসে মদ খেতে দাও বন্ধু, নতুবা এমন জায়গা দেখাও যেখানে খোদা নয় বিরাজমান—

দিল্লিতে নেমে আমি আর বন্ধু নকীব সেভাবে প্ল্যান করে ঘুরছিলাম না। এদিক ওদিক ঘুরে-বেড়ানো, সামনে যাই আসে, চোখ ভরে দেখে নেয়া। কারণ আস্ত শহরটাই রহস্যের হাজারো পর্দা ঝুলিয়ে রেখেছিল, যেন এক জাদুমঞ্চ থেকে আরেক জাদুমঞ্চে ক্রমাগত এন্ট্রি ও এক্সিট।

সুতরাং গালিবের মাজারে যাব তেমন কোনো চিন্তা আমার ছিল না। এমনকি এটা কোথায় আছে তাই জানতাম না। নিজামুদ্দিন আউলিয়ার দরগা ও তার পাশে বিশ্ব তাবলিগের মারকাজের দিকে গেলাম—তার আশপাশে বিখ্যাত কাবাব ও স্ট্রিট ফুডের দোকানপাট, সন্ধ্যায় জমিয়ে খাওয়ার প্ল্যানে। দরগার গেটের দিকে যাওয়ার সরু গলি পথ ধরে আগাচ্ছি, আচমকা চোখ পড়লো একটা সাইনবোর্ডে, কী অবলীলায় পাশ কাটিয়ে চলে যাচ্ছিলাম শাহেনশাহে জুমলা—শের শায়েরি বেতাজ বাদশা—উর্দুকাব্যের মন্ত্রপূত পাখি, তার সমাধি।

যে যেই পথের, সেই পথ তাকে টানে। আমি আসলে কীসের লোক এটা যেন গালিব হঠাৎ উদিত হয়ে আমার পথ আটকায়ে চোখ আটকায়ে মনে করায় দিলেন দরগার সেই সন্ধ্যায়। দিল্লি তো নিজামুদ্দিন আউলিয়ার শহর, দিল্লি আমার মাতাল গালিবেরও। একজন তরিকতের আরেকজন কালামের—দুই রাজার দরবার মিলেমিশে একাকার, ধর্ম আর কবিতা মদ আর মোরাকাবা একই ঝংকারে বেজে ওঠে ঝম ঝম ঝম ঝম ঝম ঝম….

সেই বছর শীতের প্রথম ঘ্রাণটা আমি পেলাম দিল্লিতে। ঘাসের, বাতাসের, বহুদূর নদী থেকে ভেসে জলজ কণার, কুয়াশার মতো একটা নিবিড় শান্তি শান্তি ঘ্রাণ। পরদিন সকাল দশটার পূর্বে আমাদের ধর্মশালা পৌঁছুতে হবে, সুতরাং দিল্লিতে অপেক্ষার অবকাশ নেই। একটা ট্যাক্সি ঠিক করে কাশ্মিরি গেট—আমাদের গাবতলি বাস টার্মিনাল—যাওয়া হলো। রাত সাড়ে নয়টার ভেতর ৮০০ কিমি দূরের ধর্মশালার সব বাস ছেড়ে গিয়েছে—জানা গেল কাউন্টারে গিয়ে। তখন বাজে দশটা। কাউন্টার থেকে বলল, পাঞ্জাবের পাঠানকোট অব্ধি আমরা বাসে যেতে পারি। সেখান থেকে ৬০ কিমি ডান দিকেই ধর্মশালা। ট্যাক্সি করে যাওয়া যায়। টিকিট এজেন্ট দেখলাম চমৎকার বাংলা জানে ও বুঝে। অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলাম বাড়ি কলকাতায় বা বিহার-আসামের দিকে কিনা। জানালো সে দিল্লিরই উর্দুভাষী মানুষ। রেগুলার যাতায়াত করা বাঙালিদের মুখে মুখে বাংলা শুনে সে শিখে গিয়েছে।

কুল কুল ঠান্ডা ঠান্ডা নামের এক স্লিপার কোচ বাসে আমরা উঠে পড়লাম। সহযাত্রীদের চেহারাকাঠামো অনেকটাই অন্যরকম। সম্ভবত পাঠান তারা। অদ্ভুত একটা ভাষায় কথা বলছে, হিন্দি বা উর্দু না। কেউ একজন লাউড স্পিকারে গান ছাড়ল, সম্ভবত গুজরাটি ভাষা। খোদ একজন ইন্ডিয়ানই বা ইন্ডিয়ান বাঙালিরই কি এমন পরিবেশে নিজেকে ভিনদেশি ঠাওরাবার কথা নয়? একই দেশের ভেতর এই আন্তর্জাতিকতাকে তারা কীভাবে বোধ করে, তা জানবার কৌতূহল বোধ করি। পাঠানকোট বা পাঞ্জাব সম্ভবত মুসলিমপ্রধান অঞ্চল। আশপাশের বেশিরভাগ যাত্রীকেই মুসলিম বলে মনে হলো। মাথায় কাপড় দেয়া, মুসলমানি ভঙ্গির সালোয়ার-কামিজ-পরা মেয়েদের একটা পরিবারও দেখলাম। চোখাচোখি হচ্ছিল সবার সাথেই, কিন্তু কোনো কথা কি হয়? কথা কি বলা যায়? তেমন কোনো প্রসঙ্গ কি আসে? কোনো দরকার কোনো প্রসঙ্গ ছাড়া কি মানুষের সহজ স্বাভাবিক অকারণ যোগাযোগ হয়?

ভেতরে কোথাও একটা দারুণ আত্মীয়তা তাদের সঙ্গে বোধ হলেও আসলে ভাষা ও আজনবিতার কারণে সেই উপরি-অঙ্গেই রয়ে গেল ব্যাপারটা। নির্বাক ভাবের স্পর্শহীন একটা যাত্রাই চলল সারা পথ ধরে।

 

পাঞ্জাব—হরেক রঙের বাহারে সকাল হলো আহারে

স্লিপার কোচ আরামদায়ক ছিল না। বালিশ, কাঁথা কম্বলের বালাই নেই। ফ্ল্যাট একটা গদি৷ সম্ভবত বাসটা দূরপাল্লার স্লিপার লোকাল। চাহিদা অনুযায়ী ব্যবস্থা। অনেক দূরের যাত্রায় স্লিপার প্রয়োজন, আবার প্রয়োজনকে করতে হবে সাশ্রয়ী, সব মিলে যা হয়। ভাড়া নিয়েছিল ১২০০ রুপি৷ অন্যেরা শুনলাম ৭/৮ শ রুপিতে দরদাম করে নিয়েছে৷ এসি চলেছে, কিন্তু একধরনের আবদ্ধ মাথা ঘোরানো ভাব ছিল বাসের ভেতর। মাঝরাতে পানিপথ নামক জায়গায় খাবার বিরতি দেয়া হলো।

এই সেই পানিপথ, ইতিহাসের পাতায় পড়া পানিপথের প্রথম দ্বিতীয় তৃতীয় যুদ্ধ, মোঘল পাঠান মারাঠা—হুমায়ুন, বাবর, আহমদ শাহ আবদালিদের যুদ্ধের শহর। যেন এই নিস্তব্ধ রাতে খুব গভীরভাবে কান পেতে শুনতে পেলাম ইতিহাসের ঘোড়ার হ্রেষাধ্বনি, সৈনিকদের দৃপ্ত পদপাদের শব্দ আর ঢাল তলোয়ারের ঝনঝনানি। এই বাতাসে শ্বাস নিয়ে এই মাটিতে পা রেখেই সেই ইতিহাস, আজ সেই জনপদের ওপর আমি দাঁড়িয়ে, আধুনিক রাষ্ট্রব্যবস্থার নিরাপত্তার ভিসা হাতে।

এখানে রেস্টুরেন্টকে বলে ধাবা। আর সরাইখানা বা হোটেলের নাম হাভেলি। হাভেলি শব্দটায় মনে পরলো খুব ছোটবেলায় পড়া ঔপন্যাসিক নসিম হিজাজির রক্তাক্ত ভারত বইটার কথা । এই হাভেলি শব্দটা প্রথম সেখানে পাই । ভারত বিভাগের সময় পাঞ্জাব অমৃতসরের একটি জনপদের আখ্যানের ওপর ভিত্তি করে রচিত হয়েছিল উপন্যাসটা। এই সেই পাঞ্জাব। পাঠানকোট, শিয়ালকোট।

বাসবিরতি দেয় এমন হাইওয়ে রেস্টুরেন্টগুলো সম্ভবত সারা দুনিয়াতেই মাত্রাতিরিক্ত এক্সপেন্সিভ। সবচেয়ে সস্তার মেনুতে পেলাম এক ধরনের তন্দুর রুটি আর পনিরের তরকারি। রুটি সত্যিকার অর্থেই তন্দুর মেশানো, কারণ মুখে তোলার পর দাঁতের ফাকে পরিমাণমতো বালির কিচকিচ টের পাওয়া গিয়েছে। আর টকটকে মিষ্টি সেই অদ্ভুত স্বাদের পনির তরকারির কথা ভাবলে এখনো মাথার ভেতর কী যেন একটা পাক খেয়ে ওঠে, গা গুলায়। সে প্রথম বোঝা গেল অনভ্যস্ত খাওয়াদাওয়ার যন্ত্রণা। যেটা পুরো সফরেই আমাদেরকে তাড়িয়েছে। আদতে নিজের বাড়ির বিছানার ঘুম আর মায়ের হাতের খাবার ছাড়া পৃথিবীর কোনোকিছুই ঠিক প্রকৃত অর্থে আরামদায়ক নয়।

ভোরবেলা আরেকবার চা বিরতি এলো। আমার সফরসঙ্গী ঘুমেই ছিল। বাস থেকে নেমে দেখলাম মোসাহিবপুর নামক এক জায়গা। রীতিমতো হাড়কাঁপানো ঠান্ডা। দুধের মাসালা চা বিক্রি হচ্ছে। এক কাপ নিল ২০ রুপি। মুখে দিয়ে আবার সেই গা গোলানো ভাব। মাত্রাতিরিক্ত দুধ আর চিনি, কী একটা মশলা। চা পাতার স্বাদ বিন্দুপরিমাণে নেই। সবই অনভ্যস্ততা। বাস চলতে শুরু করলে সামান্য তন্দ্রায় চোখ লেগে এলো।

চোখ যখন খুলল, সকাল দশটা। আমাদের কেউ ডেকে দেয়নি। বাস মনে হলো পুরো ফাঁকা। রাত দশটায় রওনা করে পাঠানকোট পৌঁছুতে এত সময় লাগার কথা না। ধড়ফড় করে উঠে বসলাম। কন্ডাকটরের কাছে না হিন্দি না ইংরেজি অদ্ভুত এক জগাখিচুরি ভাষায় জিজ্ঞেস করলাম এটা কোন জায়গা? দেখি হিন্দি বুঝে না ইংরেজিও না। চোখে মুখে হাতে পায়ে যেভাবে পারা যায় নানা কসরতে, যেন আদিম যুগের মত গোঙানি ও ইশারাবিজ্ঞানের সাহায্যে কিছু কথাবার্তা হলো। জানা গেলো বাস পাঠানকোট ছেড়ে এসেছে সকাল সাতটায়। এটা জম্মু। পাঠানকোট ৬০ কিমি পেছনে। আমাদের দেশে যেমন গন্তব্য এলে ডেকে দেয়, এখানে কেউ ডাকেনি। কিন্তু অন্যেরা ঠিকই নেমে গেল। বাসের ড্রাইভার হেল্পার এরাও পরিবর্তন হয়ে গিয়েছে আমাদের ঘুমের মধ্যেই।

একেবারে আজনবি একটা জায়গা, হাইওয়ের পাশে, আমাদের ছেড়ে গেল বাস। আমাদের সিম এই অঞ্চলে কাজ করছে না। নো সিম দেখাচ্ছে সুতরাং গুগল বা এইধরনের কোনো কিছু অ্যাক্সেসের সুযোগ নেই। দুপুরের রোদ পড়েছে জনপদে। গরু পার হয়ে যাচ্ছে মেইন রাস্তা ধরে, আর ট্রাক ও লোকাল বাস ধুলা উড়িয়ে। আমরা হাঁটা শুরু করলাম ট্যাক্সি স্ট্যান্ডের খোঁজে।

যে খেলা দেখার উদ্দেশ্যে আমাদের যাত্রা, সেটা শুরু হয়ে যাবে বেলা এগারোটায়। এখন বাজে দশটা। আমার বন্ধু একেবারে মুষড়ে পড়ল। যে জন্য এত দূর থেকে আশা তাই হবে না? যেকোনো মূল্যে দ্রুত ধর্মশালা পৌঁছুতে হবে। লোকাল বাস বা ট্রেনের প্রশ্নই আসে না। নেটওয়ার্কও নেই যে কোথাও যোগাযোগ করব বা উবার/ইনড্রাইভ দেখব।

প্রায় আধা ঘণ্টার ওই পায়ে হাঁটা পথে গভীর কৌতূহলে পাঞ্জাবের একটা জনপদের খুঁটিনাটি নিবিড়ভাবে দেখার প্রয়াস হলো।

দুই পাঞ্জাবি অল্পবয়স্ক বালক ও বালিকা, সম্ভবত তারা প্রেমিক ও প্রেমিকা—তাদের পাশ দিয়ে হেঁটে যেতে যেতে মধুর অভিজ্ঞতা হলো। মেয়েটা সুন্দর, কিছু একটা নিয়ে অভিমান করেছে, গায়ে কামিজ মাথায় ওড়না—অল্পবয়সি ছেলেটা যাচ্ছে পাশে পাশে, কী ব্যাকুলভাবে যেতে যেতে, যেন একটা ছোট বাচ্চাকে বোঝাচ্ছে, সেইরকম কোমলতা ও অমায়িক নিষ্পাপ ভঙ্গিতে বলছে গুসসা কিউ কার রাহা হো…. রাগ কেন করতেসো বাবু একটু বুঝার চেষ্টা করো…

ভাবলাম পৃথিবীর পথেপ্রান্তরে বিভিন্ন জায়গায় বিভিন্ন কিছু বিভিন্ন রূপের হলেও নারী-পুরুষের মধ্যকার এই রসায়ন কি মান অভিমান প্রেমের রূপ সর্বত্রই কী অদ্ভুতভাবে একইরকম। কী অতীত কী বর্তমান!

ট্যাক্সি স্ট্যান্ড পৌঁছালে ছয় সিটের একটা গাড়ি পাই, ড্রাইভার যাবার জন্য প্রস্তুত। ১২০ কিলোমিটার রাস্তা। চাইল ৫৫০০ রুপি। ফুল রিজার্ভে যাবে কোন স্টেশনে অপেক্ষা বা শেয়ারিং ছাড়া। অনেক দামাদামি করে ৫ হাজারে রাজি করা গেল, সময় কম। পাঞ্জাবের লাল মাটি ও মরুভূমি প্রকার জনপদের মাঝে হাইওয়ে ধরে গাড়ি আবার ছুটল। যাত্রাপ্রারম্ভেই তেল নেয়া হলো গাড়িতে। প্রায় ২৫০০ রুপি খরচ হলো তেলে। ঘড়িতে তখন এগারোটা। ইন্ডিয়া ক্রিকেটপ্রেমী জাত। সবাই মোটামুটি খেলা দেখে। গ্যাস স্টেশনের টিভিতে দেখলাম খেলা শুরু হয়ে গিয়েছে৷ এখন যতক্ষণে পৌঁছানো যায়। ড্রাইভার আশা করলো তিন ঘণ্টায় পৌঁছানো সম্ভব হবে।


ধর্মশালা : হিমালয় আর দালাইলামার ভূমি

বেশিরভাগ রাস্তাতেই এদিকে অবকাঠামোগত উন্নয়নের কাজ চলছে ৷ সম্ভবত এর আগে এইসব জনপদ একটু আড়ালেই ছিল। বেশ কষ্টকরই বোধ হলো যাত্রাটা, পাহাড়ি উঁচুনিচু পথ। ভূমি থেকে অনেক ওপরে একটা রেস্টুরেন্টে বিরতি নিলাম। গাড়ি থেকে নামতেই যেন পা আর আগানো যাচ্ছিল না। অদ্ভুত আড়ষ্টতা মাথার ভেতর কী একটা ভার বা মধ্যাকর্ষণের নিম্নমুখী চাপ মাটিতে বসিয়ে দিতে চাচ্ছে আমাদের । অনেক উচ্চতার ভূমিতে মানুষের অনভ্যস্ত শরীর হঠাৎ পৌঁছে গেলে মানিয়ে নিতে একটু সময় নেয়। উঁচু সিড়ি ভেঙে রেস্টুরেন্টে উঠে দেখি মাথা ঘুরাচ্ছে, বিমান টেক অফ করার পর যেমন লাগে, কান মাথা থম মেরে যায়।

প্রদেশটা পাহাড়ের ওপর—ভূমি থেকে প্রায় ১৪ কিমি ওপরে।

হোটেলের নাম দাওয়াত রেস্টুরেন্ট। ১২০ রুপিতে যেই চিকেন নুডলস পেলাম তা দুইজনের জন্য যথেষ্ট হয়ে গেল। খাবারদাবার ইন্ডিয়াতে সস্তা। স্বাদ কিছুটা অন্যরকম, আমাদের দেশের পাহাড়ি অঞ্চলের খাবারের মতো। সম্ভবত একরকম ঝাঁঝের মশলা এরা ব্যবহার করে যেটা খাবারের ঘ্রাণও অন্যরকম করে দেয়।

পথে পথে ভারতবর্ষের নতুন হিন্দুত্ববাদী হাওয়া চোখে পড়লো। মাঝেমধ্যেই বজরংবলি দলের ট্রাক মিছিল দেখছিলাম রোডে, সাউন্ড বক্সে হিন্দি ধর্মীয় গান বাজছে উচ্চৈঃস্বরে, নাচছে মত্ত তরুণেরা, আর জয় বাজরাঙবলি জয় শ্রী রামের মুহুর্মুহু স্লোগান।

আমরা স্টেডিয়ামের গেটে পৌঁছুতে পৌঁছুতে হাফ টাইম বিরতি দিল। ইংল্যান্ড-বাংলাদেশের খেলা চলছিল। ইংল্যান্ড ততক্ষণে ৩৬০ রানের টার্গেট দিয়েছে। বাংলাদেশের অল্প সময়ে দুই উইকেট শেষ। আমরা গেট দিয়ে হাফ টাইমের পর বাংলাদেশের জার্সি পরে ঢুকছি দেখে একজন স্টেডিয়াম ভলান্টিয়ার মজা করে বলল, হারা ম্যাচ দেখতে এসেছো নাকি? পাশেরজনের মুখে দেখলাম হতাশাজনক বিরক্তি।

সেবার ইন্ডিয়া যাওয়ায় দুইটা ব্যাপার আমার জীবনে একেবারেই প্রথম অভিজ্ঞতা ছিল। বিমানে চড়া এবং স্টেডিয়ামে বসে খেলা দেখা, সেটাও বিশ্বকাপ।

খেলা নিয়ে বলি। টিভি ক্যামেরায় প্রচারিত খেলায় চোখ অভ্যস্ত যেহেতু, মাঠে বসে মনে হলে বিকেলে পাড়ার ম্যাচ দেখার মতো একটা ম্যাচ দেখছি৷ নির্দিষ্ট সেই টিভি ফ্রেমটা গ্যালারির বিশাল স্ক্রিনে চলছে। সামনাসামনি বসলে সব অন্যরকম মনে হয়। অমন ঠোকাঠুকি খেলাতে তবুও সুন্দর কিছু ছিল। লিটন দাসের ফিফটি উদ্‌যাপন দেখলাম, চোখের সামনে দেখলাম মুশফিকের এন্ট্রি নেয়ার সেই চিরচেনা ভঙ্গি, সাকিবের দাঁড়িয়ে ব্যাট করা, এক রানে ফিরে যাওয়ায় সে বিষণ্ণ হাঁটা ড্রেসিং রুমের দিকে—চারপাশের ভিনদেশ আর অপরিচিত মানুষের ভীড়ের মধ্যে এরা যেন কত আপন, ঢাকা বাংলাদেশের জল কাঁদা গায়ে মাখা সুবাদে যেন আমরা কতদিনকার প্রতিবেশী…

একটা জিনিস লক্ষ করলাম। পুরা খেলাজুড়ে মনে হলো মাঠে কি আসলে ইসলাম ভার্সেস হিন্দু খেলা হচ্ছে?

অল্পসংখ্যক নিরপেক্ষ ভারতীয় দর্শক ছাড়া ম্যাক্সিমাম ভারতীয়রা ছিল ইংল্যান্ডের পক্ষে। দলে দলে দাঁড়িয়ে স্লোগানে স্লোগানে বাংলাদেশকে টিজিং করা, স্লেজিং করা একের পর এক উইকেট গেলেই দাঁড়িয়ে পরে জিতে গা ভাই জিতে গা বাংলাদেশ জিতে গা টিটকারি।

একটু পরপর জয় শ্রীরাম, বন্দে মাতরাম এইসব শোনা। কেউ কেউ আবার আরো এগিয়ে খালিস্তান মুর্দাবাদ হিন্দুস্তান জিন্দাবাদ–শ্লোগান দিচ্ছে।

ম্যাচ ইংল্যান্ড-বাংলাদেশের অথচ তাদের গায়ে ইন্ডিয়ার জার্সি, তোলা হচ্ছে বাংলাদেশের বিপক্ষে ইন্ডিয়ার পতাকা। বন্দে মাতরাম স্লোগানটার বিশাল একটা প্ল্যাকার্ডও চোখে পড়ল গ্যালারির একপাশের উঁচু সারির দর্শকেরা উঁচিয়ে আছে।

আমাদের সামনের আসনে হিমাচল প্রদেশের দুইজন লোকাল দর্শক খেলা দেখছিল । পেছনে ফিরে তাদের একজন জিজ্ঞেস করলোকোত্থেকে এলাম আমরা। বললাম বাংলাদেশ থেকে। ফিক করে হেসে বলল আহারে দিল টুটা ম্যাচ…

ইন্ডিয়ার অল্পবয়সি তরুণেরা এত রাজনীতি সচেতন? কলকাতা বাদই দিলাম, রাজনৈতিক হিংসা ও গেরুয়া আধিপত্যের বাতাস সেই হিমাচল প্রদেশ অব্ধি এসে টিনেজার ছেলেপেলদেরও মন দুলিয়ে গেছে? এদিকে আমরা বাংলাদেশি তরুণেরা সবাই উই হেট পলিটিক্স জেনারেশন—! ধর্ম তো আউট অফ প্র‍্যাক্টিকাল একটা কনসেপ্ট।

কলকাতায়ও দেখেছিলাম, হিমাচলেও, ১৯৭১ এ যেন যুদ্ধ হয়েছিল বাংলাদেশ আর ইন্ডিয়ার মধ্যে, এমনই শত্রু আমরা। একটা ইন্টারন্যাশনাল ক্রিকেট ম্যাচে জয় শ্রীরাম বান্দে মাতরামের যে সাবলীল ট্যাবুহীন উৎসবমুখর শ্লোগান, পৃথিবীর কোনো মুসলিম অধ্যুষিত দেশের স্টেডিয়ামে আজ অব্ধি ওভাবে নারায়ে তাকবির আল্লাহু আকবার শোনা গেছে? এগুলো আসলে কেমন রাজনীতি?

ম্যাচ শেষ অব্ধি আর থাকা যায়নি অবশ্য। আমাদের মতো অনেকেই ম্যাচ দেখার জন্য বাংলাদেশ থেকে ধর্মশালা এসেছিল। বেশিরভাগই বের হয়ে গেল। আমরাও। পরে হোটেলে আসার পথে, হোটেলে ওঠার পর কারু কারু সাথে পরিচয়, চেনাজানা হলো।

কিন্তু এতকিছু ছাপিয়ে জীবনের প্রথম স্টেডিয়ামে বসে খেলা দেখা এবং বিশ্বকাপ দেখা, এইটুকু স্মৃতি তে উজ্জ্বল হয়ে আছে—আর এই সুন্দর হিমাচল প্রদেশ, তার ধর্মশালা শহর!

এখানে কবিতার মতো হিম হিম পাহাড়ি পরিবেশ, শীতের মন্দমধুর আবহাওয়া যেন শৈশবের স্বপ্নের মতো দিনগুলোয় ফিরিয়ে নিয়ে যায়। আর হিমালয় পাহাড়ের পাদদেশে বসে আকাশঘেঁষা চূড়ার বিস্ময় দেখে বাকরুদ্ধ হয়ে যাই। সকালে ঘুম থেকে উঠে চোখ খুলেই জানালার ওপাশে মাউন্ট এভারেস্টের শৃঙ্গগুলো, কী স্পষ্ট!

হিমাচল প্রদেশে পা পড়লে কলকাতা আর দিল্লিকে বহুদূর কোলাহল আর ঘামের এক জনপদ বলে মনে হয়। ভারতবর্ষ শব্দটা এখানে যেন পেছনের পাহাড়গুলোর মতোই মৌন মহান হয়ে, একটা রোমাঞ্চকর রহস্যে মুখ বুজে হাসে।

বাংলাদেশ আর কলকাতার তীব্র গরম এখানে কী বিস্ময় নিয়ে হয়ে গেল ঘোর শীতকাল। যে হিমালয়ের একটু ছায়া দেখতে মানুষ সেই পঞ্চগড় যায়, তাও আকাশ পরিষ্কার থাকলে—সেই হিমালয়কে চোখের সামনে নিয়ে দুই-তিনটা দিন বাস করা, ঘুম থেকে উঠেই জানালা দিয়ে প্রথম চোখে পড়া এইসব সবুজ মহান পাহাড় আর হিমালয়! রক্তের ভেতর আয়ু যেন বেড়ে যায়। মনে হতে থাকে আগের সমস্ত কালো ক্লেদ মিথ্যে হয়ে গেছে, এইখানে এই প্রভাতে আমার নব জন্ম!

ঠিক শৈশবে মানুষের মনের ভেতর যেমন একটা কোমল স্পর্শকাতর অনুভূতি থাকে, যা দেখা তাই ভালো আর নতুন লাগা, আশ্চর্য হয়ে খেয়াল করলাম সেই বিস্ময় আমার ভেতর আবার নতুন করে জেগে উঠেছে। স্থান ব্যাপারটা তাহলে সত্যই বাজিগরের মতো প্রভাবক? এমন জাদু দেখায় পরানের গহিন ভেতর!

এখানের স্থানীয় মানুষদের কোনো মেদ-ভুঁড়ি নেই। ঋজু সুঠাম শরীর সুন্দর জামাকাপড়ের ভেতরে। কাকে যেন বলছিলাম, এখানে এক মাস থাকা গেলে দেশে ফিরে জিম মেম্বারশিপ ক্যান্সেল করতাম।

রাস্তাঘাট সাংঘাতিক উঁচু হয়ে ওঠে নীচু হয়ে নামে—দশ মিটার রাস্তা হেটে হাঁফ ধরে যেতো আমাদের। শহরটা এত স্নিগ্ধ নীরব শান্ত, দালাইলামার শহর, একটা ধ্যানী শান্তি সর্বত্র ছড়িয়ে থাকে। প্রকাশ্যে সিগারেট খাওয়াও নিষেধ। মাঝেমাঝেই চোখে পড়বে বৌদ্ধ ভিক্ষুদের৷ একটা সুন্দর বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস আছে, আর আছে অদ্ভুত সুন্দর মেয়েরা তাদের অদ্ভুত চোখের ভাষা নিয়ে—হুট করে মনে হলো ICCR এর স্কলারশিপ আবেদনটা করে ফেললে পারতাম, এরকম একটা তুমুল সৃষ্টিশীল পরিবেশে চারটা বছর কেটে যেতো।

আমরা আকাশ হোটেলে ছিলাম। বাংলাদেশের খেলা থাকায় ওই সময়টায় ধর্মশালায় বহু বাংলাদেশির সমাগম। আমাদের হোটেলে চিটাগং থেকে আসা তিনজন চটপটে তরুণ, সিলেটের একজন চেয়ারম্যান ছিলেন। পুরা ধর্মশালা স্টেয়িংসটা এদের সবার কারণে আরও মনোমুগ্ধকর হয়ে উঠলো। সবসময় আশপাশে উচ্ছল খলবল বাংলাভাষার ধ্বনি! সহজ প্রকাশ, অচেনা দেশে সহজ চেনা অভিব্যক্তির বলয়ে বসবাস! যেন নিজের দেশ এক টুকরো।

মদের দোকান মুদি দোকানের মত অহরহ, আর আশ্চর্য রকম সস্তা৷ আমি খাই না। যারা খায় তাদের চোখে দারুণ আনন্দের ঝিলিক।

এখানে অদ্ভুত সন্ধ্যা নামে। একটু শীত একটু কুয়াশা, হিমালয়ের ওইপাশে সূর্য নেমে যেতে থাকে আকাশি আর কমলা রঙের মিশেলে। বিদেশি মানুষ, ইউরোপ আমেরিকার লোকজন রাস্তার পাশে সূর্যডোবার সময় বিস্ময়ে বিমূঢ় হয়ে, সেই এবস্ট্রাকট সুন্দরতায় বুঁদ হয়ে বসে থাকে।

নেটওয়ার্ক থাকে না প্রায়ই৷ থাকা উচিতও না হয়ত৷ ফোনের নীলের চেয়ে আকাশের নীল বেশি সুন্দর এটা উপলব্ধিতে আসে।

দুইদিন ধর্মশালায় স্বপ্নের মতো কেটে যায়৷ এরমধ্যে একদিন প্যারাগ্লাইডিংয়ে যায় আমার দলের সবাই। আমি সাথে গেলেও অর্থাভাবে গ্লাইডিং করি নি। প্রায় ২৫০০ রুপি করে জনপ্রতি।

কাজ হলো পাহাড়ের ওপর উঁচু চুড়া থেকে গাইড ও প্যারাসুট নিয়ে আকাশে পাখির মত ভেসে ভেসে পাক খেয়ে দূরের সমতল মাঠে নেমে আসা।

আমি ও আমাদের রিজার্ভ টাক্সির ড্রাইভার ও প্র‍্যারাগ্লাইডিং কোম্পানির একজন রিসিভার ও গাইড সহ কয়েকজন ল্যান্ডিং স্টেশনে, সবুজ মাঠে বসে অপেক্ষা করছিলাম। আধা ঘন্টা পর একজনের পর একজনকে আকাশে উড়তে, ভাসতে, নেমে আসতে দেখলাম। আমি বসেছিলাম ধানক্ষেতের একটা নালার পাশে। মাটির খুব কাছে। ভাবছিলাম এই মাটি এই ধুলা এই ধানের স্তুপ বাংলাদেশ থেকে কত দূর কত দূর….অথচ কী একইরকম। সেই মাটি সেই ঘ্রাণ, বাতাসে সেই শান্তি গাছে সেই সবুজ….

ভ্রমন তো শেষ হয়েই যায়, তবুও অনন্ত জাগে স্মৃতিতে, অন্য কোথাও —

বিজ্ঞাপন

Subscribe
Notify of
guest
2 Comments
Oldest
Newest Most Voted
Inline Feedbacks
View all comments
Naqeeb Mohammed
Naqeeb Mohammed
1 year ago

সুন্দর হইসে লেখাটা সালমান।

Mustafiz Tamim
Mustafiz Tamim
10 months ago

শেষ করে দিলেন এত অল্পতেই ! আর লিখবেন না ?

স্বত্ব © ২০২৩, যোগাযোগ | ই মেইল : jogajogbd.org@gmail.com

যোগাযোগ-এ প্রকাশিত কোনো লেখা, ছবি কিংবা শিল্পকর্ম লেখক অথবা কর্তৃপক্ষের অনুমতি ছাড়া কোথাও প্রকাশ করা অবৈধ৷