বই : নুন অব হ্যামলেট
লেখক : আতিক ফারুক
প্রচ্ছদ : রাজীব দত্ত
প্রকাশনী : বুককাম
পৃষ্ঠা : ৯৬
একটা জীবনের দিকে আরেকটা জীবন যেভাবে অবিরাম মুগ্ধতা নিয়ে তাকিয়ে থাকে। আমি তেমনই কেউ, উলুখড়ের গভীর বনে উড়তে থাকা ঘাসফড়িং। তুমি যা-কিছু ভেবে রেখেছো এই মহামহিম সূর্যাস্তের উপকূলে দাঁড়িয়ে—আমি তা বহুদিন আগেই ফেলে এসেছি প্রাচীর-ঘেরা একটা দীঘল বারান্দায়। এখনও গভীর রাত—আমার চোখে-মুখে কুয়াশার অভিমানি পলেস্তারা।
বড্ড আলগোছে জীবনটা বেঁকে গেল—যা ভাবনায় ছিল না কখনো, তা ঘটে গেল। যা চিরদিন ভেবে রেখেছিলাম তা হলো না—এ আবার কেমন সমীকরণ! আমি কোনো খোশনবিশ হলে নিশ্চয়ই তোমাকে মুড়িমুড়কির মতো চিঠি লিখতাম—কিন্তু এত বাজে হাতের লেখায় চিঠি লিখতে চাই না তোমাকে। তুমি যেমন, তোমার ভ্রুকুটি যেভাবে নড়ে ওঠে, সেই অদ্ভুত সৌন্দর্যের পাশে, তোমার চুলের ঘ্রাণের পাশে এতসব বেমানান আমার ভালো লাগে না।
কলকাতায় একদম শীত নেই। ঢাকা থেকে ফেরার পথে গাদাগাদা শীতের পোশাক নিয়ে এসেছিলাম—কিন্তু শীতের কোনো আবহ নেই, রাত বাড়তে থাকলে আমার বরং গা ভিজে যায়। ফ্যান ছেড়ে ঘুমোতে যেতে হয় শেষ অব্দি। কলকাতার জীবনটাকে শীঘ্রই গুছিয়ে ফেলতে হবে। আমরা যেই মাসিমার বাড়িতে উঠেছি—তিনি আমাদের সন্তানের মতো লালন করেন। আমরাও তাকে মাসিমার মতো সম্মান করি।
আজ ভোরে খুব অস্বস্তি নিয়ে ঘুম ভেঙেছে। দেখি মা টিউবওয়েল চেপে বালতিতে পানি ভরছে। আমার কাপড়চোপড় ধুয়ে দিচ্ছে—জেগে দেখি কেউ নেই পাশে, মা মা বলে তখন চিৎকার করতে ইচ্ছে হয়েছিল। বুকের ভেতরটা ধুধু মরুভূমি। কোথায় যেন এমন একটা লাইন পড়েছিলাম—আঠারো থেকে পঁচিশ বছর অব্দি সময়টুকুতে নাকি জীবনের অনেক কিছু হারিয়ে যায়—আমার আর কিছুই হারায়নি, শুধু মা হারিয়েছে এমন এক অরণ্যের গহিনে, যেখানে চিরদিন ঘুমিয়ে থাকতে হয়।
যে যাই বলুক—আমি আমার জীবনের সকল অধ্যায় জেনে গেছি। কোন সকল মানুষেরা বিপথে চলে যায়, অন্ধকার গলিমুখে দাঁড়িয়ে থাকে অবাক হয়ে। আমি তাদের সকল-কে চিনেছি। দুঃসময়ে কেউ পাশে থাকেনি।
বছর ঘুরে এলো আবার। জীবনের সেই পুরোনো প্রলাপই ফিরে আসে—সবকিছু নতুনভাবে শুরু করতে হবে, আগের চেয়ে ভালো হয়ে যাব—আরও কত কী ভাবনা নিয়ে শুরু হয়, ছেঁড়া ছেঁড়া মেঘের মতো স্বপ্নগুলো ধীরে ধীরে চলতে থাকে। কিন্তু কিছুটা ছায়াপথ পেরুলেই সেই হেঁয়ালি জীবনের দিকেই ক্রমাগত সন্ধ্যা এগিয়ে যায়।
জীবন—তুমি কী কখনোই ভালো হবে না!
*
আজ বহুদিন পর খাবারের টেবিল হতে মায়ের হাতে বানানো জলপাই আচারের বয়াম খুব অবাক দৃষ্টিতে আমার দিকে চেয়ে রইল। আমার খুব মায়া হলো ওর জন্য—মায়ের শেষ স্মৃতি হিসেবে আমার কাছে অনেকগুলো জলপাই আচারের বয়াম আর একটা সুরমাদানি আছে। প্রতিদিন গোসল শেষে আমি চোখে সুরমা দিই, মোটা মোটা কালো অশ্রুর সাথে আবার মুছে যায় সব। আমাদের দুঃখগুলো, আমাদের কান্নাগুলো কি উপেক্ষিত! একটা কাগজের নৌকায় সবকিছু ভেসে যেতে পারে।
খ—
আমাদের কোনো বাড়ি নেই। কোনোকালে দূর হতে একদলা থুতুর নিচে যে পশুদের জন্ম, তারাও আমাদের পথ আটকাতে চায়—আমরা নির্বাক চেয়ে থাকি। বলি, সরো আমার চক্ষুর সামনে থেকে, দূর হও বদমাশ! দরজা খোলো।
গ—
সেদিন দেখা হলো! আমরা পাশাপাশি বসে আছি—একটা লোক আমাদের পাশে এসে বসল, বলল—শুনুন! পৃথিবীর আয়ু ফুরিয়ে গেছে। আপনারা নিজেদের জীবন গুছিয়ে নিন—একদিন সকালবেলা ঘুম থেকে জেগে দেখবেন, চারপাশে বেগুনি রঙ, আকাশ বলতে কিছু নেই।
ঘ—
আমি বাড়ি যাব। আমাকে আমাদের বাড়ি নিয়ে চলো৷ আমার স্বপ্নের কুটির। আমার নিরালম্ব জীবনের আশ্রয়। নিয়ে চলো আমাকে। আমার দূরে কোথাও ভালো লাগে না। সারাদিন আমি ঘুমিয়ে থাকব, ঘুমঘুম শীতের স্বপ্ন। অবচেতন দিগন্তে জীবনের নীল ক্যানভাস।
জীবন—তুমি কী কখনোই ভালো হবে না!