গাযার জলপাই বন ঘেঁষে তুফান তোলা ঝড়ের রাতে নীরবে ঘুমিয়ে পড়া হে আমার ভাই, আমি জানি তুমি নিভৃতে বেছে নিয়েছো জান্নাতের অমল শ্বেতাভ এক উদ্যান। ঘুমের আবেশে নিথর পড়ে থাকা তোমার এই ছিন্নবিচ্ছিন্ন দেহটুকু দেখে তোমার মা হয়তো চিনতে পারেনি তোমাকে, তোমার পিতা হয়তো হন্যে হয়ে খুঁজে ফিরেছে তোমার আরেকটি হাত, মর্গে পড়ে থাকা অনিশ্চিত আরেকজনের দুটি পা হয়তো গুঁজে দেয়া হয়েছে তোমার কাফনে, কিন্তু ওই ফেরেশতাদের কাঁধে চড়ে তুমি যখন পৌঁছে গিয়েছো রবের দরবারে, তুমি তখন হাস্যোজ্জ্বল, তোমার হাতে বরং উদ্বেলিত এক পতাকা, যেখানে ভাসমান বিজয়ের সবুজ আলামত। ফেরেশতারা তখন হেঁকেছে তকবির, সমাধির উপর লিখে দিয়েছে এক চিরন্তন সত্য—‘অ–ম–র’।
কিন্তু তোমার বুকে পোষা পবিত্র ক্ষোভ এবং রেললাইন থেকে কুড়িয়ে পাওয়া দুটি নুড়ি পাথরের শক্তিতে জ্বলে ওঠা তোমার দুঃসাহস যখন তোমাকে দাঁড় করিয়ে দিয়েছে ধাতব ট্যাংকের সামনে, বিবস্ত্র আগ্রাসনের মুখে তোমাকে করেছে নির্ভীক পাহলোয়ান, তখন অস্ত্রসস্ত্রে সজ্জিত অন্তত একুশটি আরব মূলকের অধিপতিরা কফি হাতে বসেছে গ্যালারিতে, রক্ত–রক্ত খেলা দেখবে বলে, আজ। এমনকি পাথরখণ্ড ছুঁড়তে ছুঁড়তে ধিকিধিকি প্রাণ বুকে নিয়ে তুমি যখন চিৎকার করছো সকাতর পিপাসায়, তোমার এ চিৎকার ছুঁতে পারেনি ওই অধিপতি শুয়োরদের মন। তোমাকে তোমার অধিকার ফিরিয়ে দেবে কি, খাদ্য, ওষুধ কিংবা পানির সহায়তায় ওরা পাঠাতে পারেনি একটিমাত্র কন্টেইনার। বরঞ্চ মুখস্থ করে রাখা কিছু ‘উদ্বেগগ–বিবৃতি’ দিয়ে ওরা সটকে পড়েছে আস্তে, কিনারায়। অথচ তুমি ঠোঁটকাটা অমন বে–হায়াদের লক্ষ করে ‘খামোশ’ শব্দবন্ধনীতে ছুঁড়ে দিয়েছো এক তুমুল রকেট–বিবৃতি। গাজার আহত শিশুদের নিয়ে রাফা ক্রসিংয়ের দিকে যাওয়ার সময় একটি অ্যাম্বুলেন্সেও যখন বোমা ফেলেছে ইসরায়েলি বিমান বাহিনী, অন্তত ষাটটি শিশুকে এক আঘাতে শেষ করে দিয়েছে, পৃথিবীর নানা দিকে উতরোল ছড়িয়ে গেলেও এমন একটি দৃশ্য যাদের হৃদয়কে বিগলিত করতে পারেনি, রকেট–বিবৃতি এবার তাদের দিকেও ছোটাও।
আমি জানি না, কোন সে ভাষার কাঁধে সওয়ার হয়ে আজ আমি তোমার কাছে আবদার করব একটু ক্ষমার। আমার পকেটের টাকায় তোমাকে আজ সুবহে সাদিকের একটু আগে নির্মমভাবে হত্যা করে ফেলা হলো, নির্লজ্জ আমি কালই যাব আবার তোমার ভাইকে হত্যার রসদ দিতে নগরীর সবচেয়ে বড় সুপার শপটিতে। কোক–ফ্যান্টাই কি খাব গলগল, উঁহু, আমি বরং খাব ফিনকি দিয়ে ওঠা তোমার রক্ত। ‘বয়কট বয়কট’ চেঁচামেচি করে সোশ্যাল মিডিয়ায় মুখে ফ্যানা তুলব বটে, রাতের অন্ধকারে আমি ঠিকই গিয়ে হাজির হব ‘কোক স্টুডিও’র উন্মত্ত আয়োজনে। দ্বিচারিতার কী–ইবা দেখেছো, সেখানে আমি গায়ে জড়িয়ে রাখব স্বাধীন ফিলিস্তিনের পতাকা। কেননা আমি কী করে বুঝব, অ্যানেস্থেসিয়া ছাড়া গাযার মায়েদের সেই গর্ভপাতের যন্ত্রণা, ব্যাথানাশক মেডিসিন ছাড়াই বিভিন্ন অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ কেটে শিশুদের অস্ত্রোপচারের দুঃসহ কাতরতা!
কিন্তু অভিমান করবে তুমি? তোমার রক্ত, প্রাণ এবং প্রতিটি শ্বাস–প্রশ্বাস নিয়ে আমাদের এই নিঠুর বাণিজ্য বাণিজ্য খেলা দেখে তুমি মন খারাপ করবে ভেবেছো? কিন্তু তুমি কি জানো, হে গাযার পুতুল, তোমার মুখ ছলকে ওঠা এই মনখারাপের দৃশ্যে আমাদের কিচ্ছু হবে না। আমরা বরং তোমার নির্দ্বিধ রক্তপাত দেখে খুব ভণিতা করে যাব, মায়াকান্না ছোটাব অনেক, দিনশেষে তোমার এই রক্তই আমাদের অন্তর্নিহিত কামনা। তুমি রক্ত দিয়ে গেলে, নতুন এক ইস্যুর আগমন হয়েছে বলে আমরা নড়েচড়ে বসব। আমাদের ছা–পোষা রাজনীতিবিদগণ বহুদিন পর উত্তর গেইট থেকে বঙ্গবন্ধু এভিনিউ কিংবা শাহবাগ হয়ে শহীদ মিনারে দাঁড়িয়ে চিৎকার–চেঁচামেচির সুযোগ পেয়েছে বলে আহ্লাদিত হয়ে উঠবে। চেতনাদণ্ড খাড়া করে জাদুঘরের সামনে মোমবাতি হাতে দাঁড়িয়ে যাবে একদল সেক্যুলার ভেড়া। নাচ করে, গান গেয়ে এই বুঝি ওরা তোমাকে উদ্ধার করতে ছোটাবে ওদের ভ্যাঁ ভ্যাঁ ধ্বনিসর্বস্ব সৈন্যসামন্ত। সো–কল্ড ইসলামী শিল্পীরা গান–গজলের রমরমা ব্যবসার সন্ধান পেয়ে ছোটাতে থাকবে মেকি আবেগের প্রস্রবণ। বইয়ের বাজার গরম হয়ে উঠবে। প্রাণ ফিরে পাবে মজ্জাগত মতানৈক্য। যেনবা ঘরে চোর এলে, তাড়াবার কোশেশ দেখে সে–ই মাদখালি শিন্নিখোর দৌড়ে এসে বলতে শুরু করবে, ‘আগে তো আকিদা ঠিক কর’।
আর এদিকে সভ্যতার সবক দিতে গিয়ে দিস্তা দিস্তা খাতা খুইয়ে ফেলা মোড়লরা বসে যাবে অস্ত্রবাণিজ্যে। তুলনামূলক দেশীয় ছিঁচকে মোড়লদের দেখা যাবে স্থানীয় রাজনীতিতে ওরা তোমার কাঁধে বসে ওদের রাজনৈতিক উদ্দেশ্যকে পূরণ করে মেটাচ্ছে অন্তর্গত খাহেশ। লেনিন বলেছিলেন, সংসদ একটা শুয়োরের খোঁয়াড়। ওই খোঁয়াড়ে বসে বসে মাননীয় পিএমকে বলতে শোনা যাবে, ‘প্রভুদের ভয়ে বিরোধীদল ফিলিস্তিন বিষয়ে চুপ হলেও আমাদেরকে দেখুন, আমরা অন্যায়ের বিরুদ্ধে সবসময়, ইনসাফের পক্ষে প্রতিক্ষণ। অথচ তুমি জানবে কি–না, আমাদের এই ভূখণ্ডেও কখনো কখনো নেমে এসেছে তোমাদের সেই রোজকার ফিলিস্তিনি বাস্তবতা, রাতের অন্ধকারে, গাযা উপত্যকার মতো বিদ্যুৎ বন্ধ করে, এই জালিমও খুবলে খেয়েছে অসংখ্য নিষ্পাপ শিশুর প্রাণ, ক্ষমতার দুর্দমনীয় পিপাসায় আশ্রয় কেড়ে নিয়েছে সদ্য প্রস্ফুটিত বহু নবজাতকের।
গণমাধ্যমের একচোখা দাজ্জালি ক্ষমতায়নের মুখে আমি জানি হে গাযার পুতুল, তুমি এখন ক্লান্ত। আজ বিকেলে, স্কুল ফিরে যাওয়া বাসে নগ্ন বোমা হামলার কথা ওরা আমাদেরকে বলেনি একটুও। বলেনি, তোমার পিতার লাশটি একটু নিরাপদে কোথাও দাফনের সময়টুকু না পাওয়ার অসহায় আর্তনাদ। ‘আল–আকসা অ্যাটাকস : হাউ দ্য মিডিয়া গিভস ইসরায়েল আ ফ্রি পাস’ শিরোনামের একটি লেখা পড়ে ওয়েস্টার্ন মিডিয়ার এই একচোখা নীতি দেখে তোমার ভীষণ মনখারাপ হতে পারে। লেখক ফয়সাল হানিফ সেন্টার ফর মিডিয়া মনিটরিং নামের একটি সংগঠনের জোগাড় করা তথ্য–উপাত্ত বিশ্লেষণ করে দেখিয়েছিলেন, ২০১৮ থেকে ২০১৯ সাল—এই এক বছরে গাজায় ফিলিস্তিনিদের নির্যাতন–নিপীড়নের পেছনে ইসরায়েলের দমন–পীড়নের যতগুলো ঘটনা ঘটেছে, তার মধ্যে ১৮২টি ঘটনাই মূলধারার এই গণমাধ্যমগুলো চেপে গেছে। এর মধ্যে এএফপি, রয়টার্স ও এপি—এই তিনটি বিশ্বখ্যাত এবং কথিত ‘নিরপেক্ষ’ বার্তা সংস্থা চেপে গেছে ১৪৩টি খবর। শুধুই কি চেপে যাওয়া? যেমন ধরো, তোমাকে মেরে ফেলা হলে ওদের শিরোনাম হবে, ‘সংঘর্ষে বালক নিহত’। এখানে তোমাকে ‘ফিলিস্তিনি বালক’ও বলা হবে না। নিহত হওয়ার আগে যে ‘সংঘর্ষ’ হয়েছিল, তার প্রমাণ হিসেবে বলা হবে, ‘ওই বালক পাথর ছুঁড়ে ইসরায়েলি বাহিনীর ওপর হামলা চালিয়েছিল’। বরং ‘কিলড’ শব্দটি ব্যবহার না করে সেটিকে আরও মোলায়েম ভাষায় বলা হবে, ‘সীমান্ত উত্তেজনার সময় আঘাতপ্রাপ্ত হয়ে মারা গেছে’। কিন্তু যখন কোনো ফিলিস্তিনি ছুরি দিয়ে ইসরায়েলের কাউকে আঘাত করে এবং সেই আঘাতে যদি সেই ইসরায়েলি নিহত হয়, তাহলে এসব বার্তা সংস্থার বর্ণনার ভাষা আমূল বদলে যাবে। সেই খবরে বারবার ব্যবহৃত হতে থাকবে ‘স্ট্যাবস’, ‘কিলস’—জাতীয় শব্দ।
গতবছর শবে কদর ও তার পরের রাতগুলোতে আকসার আঙিনায় দখলদারদের বিরতিহীন হামলার প্রতিবাদে তোমরা সেরেফ পাথরখণ্ডের শক্তিতে জ্বলে উঠে প্রতিবাদ করেছিলে যখন, রয়টার্স তোমাদের এই পবিত্র আন্দোলনকে সংজ্ঞায়িত করতে তাদের সংবাদ শিরোনামে বারবার লিখে গিয়েছে ‘রমাদান ভায়োলেন্স’। অন্তত রমজানে হলেও আল আকসায় সিজদার অধিকার ফিরে পেতে তোমার এই আওয়াজকে বরদাশত করতে না পেরে যুক্তরাজ্যের ডেইলি মেইল কেটি হপকিন্সের একটি নিবন্ধে রমজান মাসকে ‘সিজন অব বম্বারস’ বা ‘বোমাবাজদের মৌসুম’ বলে আখ্যা দিয়ে গেছে অবলীলায়। এই তো সেদিন, মা’মাদানি হাসপাতালে ইসরাইলের বর্বরতম হামলায় প্রায় একহাজার বেসামরিক মানুষ মরে যাওয়ার ঘটনায় ওয়েস্টার্ন বার্তা সংস্থাগুলোর নির্লজ্জ ভূমিকাই তুমি দেখো, কী অমানবিকভাবে ওরা বলে যাচ্ছে, এ হামলা তোমরা নিজেরাই করেছো। কোথায় পুষে রাখবে তুমি এই অসহায়ত্ব? এডওয়ার্ড সাঈদের ‘ফিলিস্তিনিদের কোনো কিছু বলতে মানা’—উক্তির বাস্তবতাই বরং তোমার শেষ আশ্রয়।
কিন্তু কী বিস্ময়কর দেখো, মরেও তুমি অমর হয়ে আছো, অথচ বেঁচে থেকেও আমি পরিণত হয়েছি এক জীবন্ত লাশে। ‘আসো, আসো, দাঁড়াও এক কাতারে’ ধ্বনি তুলে আকসার মুয়াজ্জিন ডেকে যাচ্ছে, অথচ অনুধাবনের শক্তি নেই আমার। আমি অক্ষম, আমাকে ক্ষমা করো। রোজ ফজরে মহল্লার নীরব মসজিদটিতে কুনুতে নাযিলার কালিমায় মাথা ঠুকে দিয়ে আমি শুধু করতে পারি একটু রোনাজারি। তোমাকে ভেবে, বিধ্বস্ত ঘর জুড়ে ছড়িয়ে থাকা খাদ্যকণার কথা স্মরণ করে অথবা হামদানের শেষ উপহার হিসেবে প্রাপ্ত তোমার ওই যে খেলনার পুতুল কিংবা দুটি সাদা প্লাস্টিকের ব্যাগে ক্ষতবিক্ষত আটটি শিশুর মরদেহ, পরস্পরকে জড়িয়ে ধরে রেখেছে। প্রতি ব্যাগে চারটি করে শিশু। ব্যাগগুলোর গন্তব্য গণকবর। ওরা গাজার শিশু। ওদেরকে হত্যা করা হয়েছে গত রাতেই, এমনতর সব দৃশ্যে আমি ক্লান্ত হয়ে শুধু বলতে পারি, রব, অকস্মাৎ কুদরতের মহিমায় জেরুজালেমের পথ–ঘাট, আর গাযার বিধ্বস্ত মরু–প্রান্তরে এই এক্ষুণি আপনি ছড়িয়ে দিন ফুলের সমারোহ। তোমাদের ওই ‘অশেষ’ ইন্তিফাদার দুর্ধর্ষ ইতিবৃত্তগুলো আমরা শুধু পাঠ করে যাব আল জাজিরার বোমা হয়ে ফোটা সংবাদের পাতায় পাতায়। আমাদের কিছু বলো না ফুল হয়ে ফোটা হে গাযার প্রিয় ভাই, আমরা অক্ষম। আমরা শুধু আমরণ শুনে যাব আবু উবায়দার সেই মহাতেজস্বী শব্দ–বাক্য। মরে যাবে, তবু পিছু হটবে না, এমন অদম্য জেদ তোমাদের বুকে পুষে রেখেছো বলে তোমরা চিরবিজয়ী, স্বাধীন এবং মুক্ত। করুণা করে হলেও এবার আমাদের মুক্তির ফয়সালা করো, এ আমার সকাতর আবদার।
কী চুম্বকার্ষণ ভাইয়ের লেখায় মাশাআল্লাহ !
লা জবাব।
গা শিউরে ওঠার মতো এক রচনা। আল্লাহ লেখকের কলমে আরো বারাকাহ দিন ।
লা জবাব
রূদ্ধশ্বাস পাঠ।
কালি নয়,যেন কলিজার খুন দিয়ে রচিত একগুচ্ছ বাক্য। গাযার জন্য মুনাজাত করি।