‘বই’ শব্দটি এসেছে ‘ওহি’ থেকে। ওহি মানে তো আলো। সুতরাং বই যারা প্রকাশ করেন (ব্যাখ্যাসাপেক্ষে) তারা মূলত আলোই ছড়িয়ে দেন। ফলে ‘প্রকাশক’ খুব সহজ এবং সাধারণ কিছু নয়। এই গুরুত্বপূর্ণ এবং গুরুগম্ভীর পেশা বা ব্যবসার উপযুক্ত তাই যে–কেউ হতে পারেন না। যিনি আলো ছড়িয়ে দেওয়ার দায়িত্বটি কাঁধে নেবেন, সংগত কারণে তাকেও হতে হয় কিছু শর্তে আলোকিত; উত্তীর্ণ। আমাদের প্রকাশকরা সেই শর্তে কতটা উত্তীর্ণ—আজকের আলাপে আমরা তা–ই দেখানোর চেষ্টা করব।
জোয়ার শুধু কয়লা নয়, ময়লাও ভাসিয়ে আনে
দু’হাজার তেরোর পর ইসলামি ঘরানায় (গায়রে দরসি) বই প্রকাশ ও পাঠের একটা জোয়ার এসেছে বলা যায়। যেকোনো তর্ক ও সমালোচনায় এ কথা অস্বীকারের সুযোগ নেই—এই জোয়ারটা ছিল বহুল প্রতীক্ষিত এবং এর কারিগর ও শ্রমিকরা অবশ্যই প্রশংসার দাবিদার। তবু ওই যে একটা কথা আছে না—জোয়ার শুধু কয়লা নয়, ময়লাও ভাসিয়ে আনে—সেটাও যে তেরো–পর্বতী এই জোয়ারে বাস্তবায়িত হয়েছে, তা–ও অস্বীকারের বিন্দুমাত্র অবকাশ নেই। বরং এই জোয়ার কয়লার চেয়ে ময়লা–ই বেশি ভাসিয়ে এনেছে। এর স্পষ্ট দাগ আজকের এই অনাকাঙ্ক্ষিত সংকট। জোয়ারের বদলে স্বাভাবিক গতিতে উত্থানটা ঘটলে কয়লার সাথে এত ময়লা জমত না। এতে করে লেখক–পাঠক এবং সত্যিকার প্রকাশকরাও এই সংকটে পড়তেন না।
সংকটটা কী
জোয়ারের ফলে অবস্থাটা এমন দাঁড়িয়েছে যে, এই ঘরানায় বিরল–ব্যতিক্রম দুচারজন বাদে প্রকাশকরা বই বিক্রির বাইরে কিছুই জানেন না এবং জানার আগ্রহও লালন করেন না। যদি জানতেন, যদি লালন করতেন, তাহলে তাদের কর্মতৎপরতার এত অসহায়ত্ব আমরা দেখতাম না। দেখতাম না তারা বই নকল করছেন। (অকারণে) অনূদিত বইয়ের অনুবাদ আনতে মরিয়া হয়ে উঠছেন। বই খাওয়ানোর জন্য যুদ্ধে পরাজিত দলের মতো কেবলই ছাড় (!) দিচ্ছেন। বই কিনতে পাঠককে লোভ দেখাচ্ছেন অলোভনীয় এবং অপ্রয়োজনীয় জিনিস দিয়ে।
বই তো কাঁচামাল নয়
দেশের বিদ্যমান পরিস্থিতির যে ছাপ ও চাপ, তা অন্য সব সেক্টরের মতো বইয়ের সেক্টরেও দৃশ্যমান। জিনিসপত্রের দুর্মূল্যের কারণে মানুষের আর্থিক দীনতা এবং সেইভিং চিন্তা—দুটোর সমন্বয়ে কেউ কেউ বলতে চান, মানুষ এ কারণে আগের মতো বই কিনছে না। তাদের এই মন্তব্য অর্ধসত্য এবং আংশিক বাস্তবতা পর্যবেক্ষণের দুর্বলতার প্রকাশ। এখানে বরং ওই অর্ধসত্যকে পুরোপুরি সত্যতায় নিয়ে গেছে যা, তা হলো—অপ্রকাশকের প্রকাশক হয়ে যাওয়া। ফলে বই প্রস্তুত এবং বিক্রিতে তাদের দৌড়ঝাঁপের চিত্রটা হয়ে গেছে কাঁচামালের চাষি ও ব্যবসায়ীয়র মতো। বই তো কাঁচামাল নয়।
সমাধান কোন পথে
এই যে সংকট বরং অসুস্থতা, এর সুস্থতার জন্য মিলাদ পড়ালে কাজ হবে না। কাজ হবে না ভাত না খেয়ে পাঠক বই কিনলেও। এই রোগের একমমাত্র পথ্য হচ্ছে—প্রকাশককে বই বিক্রেতা থেকে ‘প্রকাশক’ হয়ে ওঠার চেষ্টা ও আন্তরিকতার পথে দৌড়ানো।
প্রকাশক প্রশ্ন
বাংলাদেশে জেনারেল এবং ইসলামি উভয় ঘরানায়ই দুটো প্রশ্ন উঠেছে—লেখক কে, মানে কাকে লেখক বলা যাবে; সম্পাদক কে মানে কে সম্পাদক হতে পারবে। আরও একটা প্রশ্ন ওঠার আছে—প্রকাশক কে? এই প্রশ্নটা এখনো সেভাবে আলোচনায় আসেনি; অথচ প্রথম দুই প্রশ্নের চেয়ে এই প্রশ্নটার জিজ্ঞাসা আরও জরুরি। কারণ, এই প্রশ্নে যে সংকট উঠে আসবে, তার সমাধানে আগের দুই প্রশ্ন অটো ‘নাই’ হয়ে যাবে। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনক সত্য হলো, এই প্রশ্ন তোলার মতো সচেতন সমালোচক আমাদের নেই।
আলাপ আরও হবে। অন্য কোথাও। আরও একদিন। এখানে চলুন ব্যতিক্রম ওই দুচারজন প্রকাশক কারা, যারা সত্যিকার অর্থেই প্রকাশক—তাদের চিনে নিই। তারা এরাই, যারা প্রকাশক হওয়ার শর্তে উত্তীর্ণ। প্রকাশক হওয়ার শর্ত তাহলে কী কী—এগুলো জানলে বুঝতে সহজ হবে তারা কারা।
প্রকাশক হওয়ার প্রধান এবং অপরিহার্য শর্ত হলো—
১. প্রকাশককে পাণ্ডুলিপি পর্যালোচনার জ্ঞান বুঝ ও যোগ্যতা রাখতে হবে।
২. মুদ্রণ ও বিপণনব্যবস্থাকে বুঝতে ও জানতে হবে।
৩. হাউজ ও প্রকল্প পরিচালনার দূরদর্শিতা ও অর্থবল থাকতে হবে।
সংখ্যা ও শব্দে শর্ত তিনটা ছোট দেখা গেলেও এর ব্যাপ্তি বহুল। শর্তগুলো আমাদের পকেট থেকে দেওয়া নয়। সবগুলোই আন্তর্জাতিক মহলে চারিত ও চর্চিত।
আমাদের চাওয়া
জোয়ারে ভেসে আসা অযোগ্য ও অপেশাদার ওই প্রকাশকদের আমরা আসলে হেলা করছি না। বই, পাঠক, লেখক এবং প্রকাশকের সংখ্যা বৃদ্ধিতে তাদের ঘামের বিন্দুও শ্রম দিয়েছে। ফলে কড়া শব্দে সমালোচনা করলেও আমরা তাদের থেকে বিমুখ বা হতাশ হতে চাই না। এই এমনতর সমালোচনাই তাদের প্রতি আমাদের ভালোবাসার দলিল—হৃদয়ের লাল চিহ্ন। ফলে আমরা চাই, তারা কেবলই বই–বিক্রিতা না হয়ে, না থেকে প্রকাশক হয়ে উঠুন।
সুন্দর সমালোচনা করেছেন।
মুতিউল মুরসালিন ভাইয়ের গল্প পড়তে চাই।
এই সাইটে কি মানসম্পন্ন লেখা দিলে যে কারো লেখা প্রকাশিত হবে? দয়া করে জানাবেন।
হুম। লেখকের বয়স, পেশা কিংবা শিক্ষাগত যোগ্যতা এখানে ধর্তব্য নয়। উপযুক্ত লেখা অবশ্যই অগ্ৰাধিকার পেয়ে থাকে।
যুক্তিসঙ্গত আলাপ।
জরুরি আলাপ। এইরকম আলাপ আরও হউক।
আলাপটা সুন্দরই। বেশ জরুরী বটে। তবে এতো দ্রুত শেষ করে দেয়া অনুচিত হয়েছে।
প্রকাশক আলোচনা অনেক ভালো ছিল মুরসালিন ভাই। যোগাযোগ এগিয়ে যাক অনেক দূর।
সুন্দর আলোচনা