মুরাদ কিবরিয়ার উপন্যাস নিনাদ পড়া শেষ হইল। সকালে ঘুম থাইকা উইঠা লাস্ট ৩০ পৃষ্ঠা পড়লাম। এরপরে একটা দীর্ঘ ঘুম দিলাম। একইরকম বেপার ঘটছিল ‘ওয়ান হান্ড্রেড ইয়ার্স অফ সলিচ্যুড’ পড়ার পরে। বা, ‘খোয়াবনামা’ পড়া বাদে। সলিচ্যুড পড়ার পরে প্রায় এক সপ্তাহ একটা ট্রাজিক ফিলিংসের মধ্য দিয়া গেছিলাম, এইরকম মনে পড়ে। ইলিয়াস, বা মার্কেজ আমার প্রিয় নভেলিস্ট নায় অতটা। মুরাদের নিনাদও ইলিয়াস, বা মার্কেজের লেভেলের নায়।
খিয়াল করবেন, একটা গ্রেইট ফিলিম বা উপন্যাস পড়লে আপনার ভিতরে কিছু হাহাকার তৈয়ার হয়। নিনাদ পড়ার পরে একই রকম বেপার ঘটল। ফলে, নিনাদ যে শক্তিশালী কিতাব, বলাই যায়। এইটারে আমি গ্রেইট বই বলব না যদিও, তাতে কিছু আসে যায় না।
কথা হইল, কাছাকাছি বয়সী একজন ইয়াং রাইটারের কুনু উচ্চাকাংখী বইয়ের ক্রিটিক করা টাফ। এতে ক্রিটিকের ইগো আহত হইবার কথা। আমরা সাম্প্রতিক বাংলাদেশে এইরকম কিছু পড়ি নাই। তাও আবার, ইয়াং কারো পক্ষ হইতে!
মুরাদের এই বই নিয়া কয়েকজনের লেখা চউখে পড়ল। এদের মধ্যে, রিফাত হাসানের লেখার কিছু পাঠ এইখানে আমলে নিব।
প্রথমেই বইলা রাখি, ‘নিনাদ’ বই কুনু ট্রাডিশনাল প্রকাশক পাবলিশ করে নাই। এই বই প্রকাশের বেপারে কারো কারো পরামর্শও, প্রকাশনীগুলা রাখে নাই। ফলে, বাধ্য হইয়া, প্রায় ব্যক্তি উদ্যোগের একটা প্রতিষ্ঠান হইতে বাহির হইছে এই কিতাব। এই কথা আমাদের সকলের বেপারেই খাটে—আমরা যারা ফিকশন বা কবিতায় বাঁক বদলমূলক চিন্তা ও তৎপরতার লগে যুক্ত, অর্থাৎ, যাদের কাম-কাজ গৎবান্ধা নায়, তাদের কিতাবাদী প্রকাশে অবহেলা সিরিয়াসলি নোট করার মতন।
মুরাদ এই ক্ষেত্রে ভাগ্যবান। কারণ, সে ফিকশন লেখছে। ফলে, কিছু পাঠক, আর কিছু প্রশংসা ত, অলরেডি পাইছেই। আমাদের বিশ্বাস, এই বই আরো পাঠকের কাছে যাইবে।
বইয়ের একেবারে শুরুতে কিছু কাব্যিকতা আছে। যেইটা শ্রীঘ্রই কাটাইয়া উঠবার কুশিশ খিয়াল করবেন। এছাড়া, এরই মধ্যে, পাঠক নিজেকে একটা থ্রিলার জগতের মধ্যেও আবিস্কার করবেন। বলা ভাল, এই থ্রিলার ওয়েস্টার্ন ঘরানার না। এইটা হইল এই বইয়ের বড় একটা অরিজিনালিটি। সে আমাদের এভারেজ নভেলিস্টদের মতন, কাহিনী নকল করে নাই। এছাড়া, তার গল্পের চরিত্রগুলাও আমাদের পরিচিত। এইগুলা আমাদের সাহিত্যে সচরাচর আসে না। বলা ভাল, গল্পের নায়ক রশিদের চরিত্র আসলে কি, সেইটা নিয়াও আলাপ করা যাইতে পারে। সে মোল্লা। মাদ্রাসায় পড়ছে। কিন্তুক, সে খালি এইটাই না। রেনেসাঁ নামের এক বামপন্থী ডাক্তারের মেয়ের প্রেমিকও সে। এইদিকে, লায়লা নামের এক ব্রিটিশ-পাকিস্থানী জার্নালিস্টের প্রেমিকও, সেই। রুকু নামের এক ঢাবি পড়ুয়া মেয়ে তার পরম আত্মীয়। তার চরিত্রের বিশালতারে কোন প্রথাগত টার্ম দিয়া আপনে ধরতে পারবেন বইলা মনে হয় না। আমাদের নভেলিস্টরা বাংলাদেশরে এই বিশালতার জায়গা হইতে না দেইখা, সবসময়ই, ক্যাটাগরি দিয়া দিয়া দেখছেন। তাদের পক্ষে নীল নয়না রেনেসাঁর লগে পাঞ্জাবী পিন্দা এতিম একটা ছেলের সম্পর্কের কথা চিন্তা করা কঠিন।
পড়ার একটা পর্যায়ে মনে হইল, ব্যক্তি রশিদ বোধয় বেশীই গুরুত্ব পাইল। অথবা, এই কিতাবে থ্রিলার কাহিনীটাই মনে হয় সার। লায়লার ঘটনার পরে, এমনটা মনে হইল না আর। অন্তত, সর্বাংশে ত নয়ই। লায়লা বিষয়ক আলাপের একটা পর্যায়ে, এক রেস্টোরেন্ট মালিক অসাধারণ কিছু কথা বলে। যেমন, ‘পেশোয়ারের কাউরে তুমি বন্দুকের ভয় দেখাইতে পারবা না।’ অথবা, ‘লায়লা কোথায় পেশোয়ারের সবাই জানে, তুমি ছাড়া’। এই পর্যায়ে আইসা লেখকের কারেক্টাররে নাম সিলেকশনের ফিলসফি বিষয়েও আপনে ভাবতে পারবেন!
স্পেশালি, এর ভিতরে আপনে বুইঝা যাইবেন যে, রশিদ একটা যেন-তেন কারেক্টার নয়। সে হুমায়ুন আহমেদের হিমুর মত, স্বাধীনচেতা। কুচ পরোয়া নেহি মনোভাবের। তফাত এই—হিমু একটা মধ্যবিত্তীয় বৃত্তের ভিতরে আটকাইয়া থাকা লোক। ফলে, তার জার্নি, আর ‘মুসাফির’ পকরিতি বিষয়ে চিন্তাচেতনা সম্পন্ন রশিদের জার্নি এক নয়।
উপন্যাসের শেষের অংশটা ইন্টারেস্টিং, এই অর্থে যে, এই অংশ আপনারে হতাশই করবে। আপনে থ্রিলের মজা ইতোমধ্যে পাইয়া গেছেন। একটা থ্রিলিং এন্ডিং আপনে চাইতেই পারেন। ওয়েল, বইয়ের এন্ডিং মোটেও থ্রিলিং নয়। অন্তত, আগের অংশগুলার তুলনায়।
এই অংশে গল্প আগের মত আগায় না। একটা ড্রিমি পরিবেশ বিরাজ করে সর্বত্র। পরতে পরতে দার্শনিক কথাবার্তা। এবসার্ডিজম। একেবারে শেষে আইসা, এই বোধও আসতে পারা সম্ভব—পাকিস্থানে গুলি খাইবার পরে, রশিদের গল্প আর বাস্তবতায় থাকে না। গল্পের এই অংশ তার ড্রিম-জার্নির অন্তর্ভুক্ত। যদিও, এই জার্নিতে, সে বাংলাদেশে সফর করে। রুকুর লগে ঢাবিতে ড্রামাটিক সাক্ষাৎ হয় তার।
রুকুর লগে এই সাক্ষাতটা জরুরী আছিল। গল্পটা পুরাপুরী রশিদের হইয়া যাইতেছিল। অন্যান্য চরিত্রগুলা কম জায়গা পাইতেছিল। ছোট্ট রুকুর লগে তার মোলাকাতও ডিউ আছিল। হাতের কব্জি কাটা ঐ বদমাইশটার লগেও তার সাক্ষাতের ঘটনারে একটা গুড কাহিনী বর্ণনার নমুনা হিসাবে নেওয়া যায়।
নোট হইল, শেষের দিকে বর্ণনাটা একটু একঘেয়ে। কথার তেজ কম। এইটা ড্রিম জার্নি কি না, তা অতটা বুঝাও যায় না।
রশিদের উপরে বেশী ফোকাস পড়ার কারণে, গল্পটা একটু বেশী থ্রিলিং হইছে বটে, অন্যান্য চরিত্র তাতে বিকশিত হইছে কম।
এইটা সইত্য, এই বই আমাদের সাহিত্যের কানুনের অংশ হইবার মতন। কেউ হয়ত এইটারে বেশী অসাধারণ বলবেন, কেউ একটু কম। কিন্তুক, এইটার ক্রিটিক এবং পাঠ চলবে। আমাদের অনুমান এমন।
নিনাদকে গ্রেট বলবা না কেন
গ্রেট উপন্যাস কি, এইটার নির্দিষ্ট উত্তর কি কেউ দিতে পারবে! কিছু গ্রেট উপন্যাস সামনে নিয়া আসতে পারি। তাদের কিছু ফিচার নিয়া আলাপ করতে পারি। যাতে গ্রেইটনেসের বৈশিষ্ট কি, বুঝি।
গ্রেট বা ক্লাসিক, যাই বলি, এইরকম উপন্যাসের প্রধান দুইটা বৈশিষ্ট হইল : ক. এদের কিছু কাহিনী বা বর্ণনা আমরা ভুলতে পারি না। খ. এইসব কাহিনীকে বিচিত্র অর্থে ব্যবহার করা যায়।
উদাহরণ- ০১
হারুকী মুরাকামীর ‘উইন্ড আপ বার্ড ক্রনিকল’ উপন্যাসে কূপের যে বর্ণনা, এইটা আমাদের মনে থাকবার কথা। এইখানে কূপ একটা রূপক। এই কূপের রূপক অর্থ বিবিধ।
উদাহরণ- ০২
গুস্তাভ ফ্লবেয়ারের ‘মাদাম বোভারি’ একটা স্বীকৃত ক্লাসিক। এই কিতাবের অনেক এনেকটোডই অনেকের কাছে মনে থাকবার কথা। আমরা পাঠককে মাদাম বোভারির অভিসারে যাইবার বর্ণনার কথা মনে করাইয়া দিতে চাই। বোভারী তার প্রেমিকের লগে যেই ঘন আবেগ, আর অস্থিরতা নিয়া মিশতে যায়, এইটার যেইরূপ বর্ণনা, তা বোভারির একলার আবেগ হইয়া থাকে না। মানুষের প্রবৃত্তির এক অসাধারণ বিবরণ হইয়া উঠে সেইটা।
নিনাদ উপন্যাসে এইরকম বিবরণ, বা মুহূর্তের দেখা আমরা পাই কি! তা সর্বাংশে না বলবার সুযোগ কম। কারণ, এই কিতাবের শেষ অংশ, যেইটারে আমরা আগের লেখায় ‘ড্রিম-জার্নি’ বইলা সাব্যস্ত করছিলাম, সেইটার গ্রেইট হইবার একটা চান্স আছিল। (লেখকের বিবরণে সেই ক্যাপাসিটি ধরা পড়ে না আর কি।)
অন্যদিকে, মুরাদ কিবরিয়ার এই কিতাবে লেখকের বুদ্ধিমত্তার প্রশংসা করতেই হয়। একটার পর একটা ঘটনার যে বিবরণ তিনি দিছেন, তাতে ঘটনারে মিথ্যা মনে হইবার উপলক্ষ্য তৈয়ারই হয় না। পরিবেশ পরিস্থিতি অনুযায়ী শব্দের যে পরিমিত ও প্রায়োগিক ব্যবহার, তা অসাধারণ। বামপন্থীদের চালচলন ও কথাবার্তার যেই বিবরণ তিনি হাজির করছেন, তা রসালোও।
গ্রেইট বেপারটা শুধু বুদ্ধির মামলা নয়। এইটা প্রজ্ঞার বেপারও। আমাদের বাংলা সাহিত্য হইতে যদি বলি, ‘ডোড়াই চরিতমানস’, ‘রাজনগর’, বা কলকুমারের কিছু লেখায় যে প্রজ্ঞা ধরা পড়ে, সেই জিনিসটা নিনাদে দেখি না।
আমরা অবশ্য, গ্রেইট না হইবার কারণে নিনাদকে শাস্তি দিতে চাই না। কেন বা কিভাবে গ্রেইট হইল না, তার একটা পাঠ মাত্র হাজির করলাম এইখানে।
নিনাদ উপন্যাসে গল্পের ভিতরের গল্প
সকলেই একবাক্যে স্বীকার করবেন, কুফা রশীদের গল্পই এই উপন্যাসের উপজীব্য। তা বটে। কুফা রশীদ একটা ঘরছাড়া মানুষ। এতিম। সে এক নির্মম খুনী। এইটাই এই বইয়ের মূল স্টোরি।
এইটাই হয়, প্রত্যেকটা গল্পে, একটা মূল স্টোরি থাকে। এর আড়ালে থাকে, ছোট ছোট স্টোরি। অধিকাংশ পাঠক ঐসব মাইনর ডিটেইলসে আগ্রহী হন না। একটা ভালা উপন্যাসের বড় শক্তি হইল, মাইনররে মাঝে মাঝে, মেজর কইরা ফালানোয়।
নিনাদ উপন্যাসেরও একটা মাইনর স্টোরি আছে, যেইটারে আপনে চাইলে, মেজর ঘটনা হিসাবে পাঠ করতে পারবেন। এই স্টোরিটা লায়লার। লায়লার সূত্রে, তার হবু স্বামীর।
লায়লার হবু স্বামী একজন আর্মি অফিসার। আম্রিকায় প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত। সে পাকিস্থানের নাগরিক। বড় কথা, তার বাপ আছিল পাক হানাদার বাহিনীর সৈনিক।
লায়লার হবু স্বামী কুফা রশিদরে একটা গল্প বলে। তার বাপের তিক্ত পরাজয়ের। যেই গল্পে বাংগালিদেরকে সে অভুক্ত, ক্ষীণ আর তুচ্ছ হিসাবে তুইলা ধরে। রশিদ এতে বিগড়াইয়া গিয়া, একটা কঠিন কথা কয়। কাহিনী মোড় নেয় অন্যদিকে…
লায়লার হবু স্বামী ‘রশিদ বাংগাল’রে লোক লাগাইয়া ধইরা আনে। তারে খুন করতে চায়। রশিদও সেইম জিনিস চায়। তকদিরের লীলা, তাদের মূল এনকাউন্টার হয় পাহাড়ে। যেইখানে রশিদ একটা ডায়লগ দেয়, মনে মনে (ইন্টেরিয়র মনোলগ)। পাকিস্থানিটা আম্রিকা ট্রেইনড। সে ‘সেন্সের’ ব্যবহার জানে। কিন্তুক, রশিদ কুনু সেন্সের দাস নয়। (এই কথা রিভলিউশনারী। এইরকম রিভলিউশনারী কথা রশিদ আরো বলে। সে বলে যে, সে কারো হুকুম পালন করতে বাধ্য নয়।) আল্টিমেইটলি, রশিদ ওরে মাইরা ফেলায় সইত্য। এরপরে, সেও ক্রিটিকাল স্টেইজে চইলা যায়।
রশীদের লগে লায়লার হবু স্বামীর ফাইটে বাংলাদেশ জড়াইয়া পড়ে। এই সইত্যের আরেক পিঠে গাঁথা থাকে লায়লার লগে রশিদের সম্পর্কও। (এক পাকীরে সে মাইরা ফেলায়, আরেক পাকীরে মুক্তি দিবার খাতিরে!)
নিনাদ উপন্যাসে এই গল্পের আয়ুস্কাল অল্প পরিধির। কিন্তুক, ইন্টেনসিটির বিবেচনায়, এই এনেকডৌট নিনাদ উপন্যাসের মূল স্রোত ঘুরাইয়া দিবার শক্তি রাখে। ফলে, নিনাদের আসল গল্প কি, এই প্রশ্নের উত্তর জটিল হইয়া যায়।
মোটামুটি ভালো রিভিউ
যোগাযোগ একটি চমৎকার ব্লগজিন। আবু তাহের তারেক এর লেখাটিও অন্যরকম। ধন্যবাদ উভয়কেই