আমার একটা অভ্যাস আছে, কাজের চাপ বেড়ে গেলে ল্যাপটপের শাটার নামিয়ে ক্যাঁধে ব্যাগ ঝোলাই—বন্ধুদের সঙ্গে বেরিয়ে পড়ি পর্বত আরোহণে; ঝরনায় স্নানে; কিংবা সমুদ্র দর্শনে।
ইদানীং আমি একরকম ঘরবন্দি হয়ে পড়েছি। আমাদের সম্পাদনা হাউজ ‘বিন্যাস’ প্রতিষ্ঠার পর থেকে খুব ব্যস্ত সময় পার হচ্ছে। এখন যাচ্ছে সবচেয়ে কড়াকড়ি রকমের ব্যস্ততা। মাথার ওপর বিশাল বিশাল ফাইল জমে স্তূপ হয়ে আছে। দেশের পরিস্থিতি, ফিলিস্তিনের সংবাদ এবং নিজের সদ্য প্রকাশিত বইয়ের আশাহত রূপ দেখে মন আর শরীরজুড়ে নেমেছে ভীষণ অবসাদ।
কিন্তু এখন যে সিজন—শীত আসি আসি করছে, রাতের শেষ দিকে পাতায় পাতায় ছন্দ তোলে শিশিরের ফোঁটা, টিনের চালে হয় টুপটাপ শব্দ—এমন সময়টায় ঝরনায় পানি থাকে না। ঝিরিগুলো শুকিয়ে শক্ত হয়ে যায়। তবু বের হয়ে পড়লাম। গন্তব্য কাছেই সীতাকুণ্ড।
আমাদের দেশে ডে ট্যুরের জন্য সীতাকুণ্ড বেটার সল্যুশন। পাহাড়, ঝরনা, সাগরসহ প্রকৃতির অভিরাম রূপ ঘিরে আছে এই অঞ্চলটিকে। তরুণ ভ্রমণপিয়াসিরা ঢং করে বলেন—ঝরনার রাজা সীতাকুণ্ড।
আমরা অনেক ভেবে দেখলাম, এই সময়টায় নাপিত্তাছড়া ট্রেইল হতে পারে উত্তম সমাধান। অন্য ঝরনাগুলোয় পানি পাওয়া যাবে না; কোনোটিতে হাঁটাপথ আরও দীর্ঘ। অথচ আমাদের ইচ্ছে, ঝরনায় গোসল শেষে বিকেলের সূর্য ডুবুডুবু সমুদ্র দেখব।
সকাল সাড়ে নয়টায় আমরা রওনা হলাম নাপিত্তাছড়ার পথে। মেইন রোডে বাস থেকে নেমে গ্রামের ভেতর হাঁটতে হয় অনেক—প্রায় আধা ঘণ্টা; কিংবা তারও বেশি। রাস্তার দু পাশে ধানখেত, পুঁইশাকের মাচান আর কাস্তে হাতে রাখালের ঘাস কাটা দেখতে দেখতে আমরা পৌঁছে গেলাম ঝিরির কাছাকাছি—গ্রামের শেষ প্রান্তে।
নাপিত্তাছড়া ঝিরি শুরুর আগে হাতের দু পাশে অনেকগুলো স্থানীয় হোটেল পড়ে। এটাকে হোটেল বলে না অন্যকিছু, তা অবশ্য আমি জানি না। সীতাকুণ্ডসহ দেশের অনেক ঝরনায় এটার দেখা মেলে। দোকানিরা ভ্রমণকারীদের ডেকে ডেকে ঝরনায় যাওয়ার আগে খাবার অর্ডার করে যেতে বলে। তুলে ধরে বিভিন্ন প্যাকেজের বিবরণ। সাধারণত এসব হোটেলের খাবার ভালো হয় না; দাম নেয় অনেক বেশি।
কেউ খাবার অর্ডার করলে সঙ্গে থাকা ভারী ব্যাগ জুতো ইত্যাদি এখানে রেখে যাওয়া যায়। টয়লেটসহ আরও কিছু সুবিধা রয়েছে। অন্যথায় শুধু ব্যাগ রাখতে চাইলে সেটার জন্য বিল গুনতে হবে। সাধারণত দোকানিরা বলে দেয়—টাকা, ক্যামেরা, মোবাইল ইত্যাদি দামি বস্তু কেউ রেখে যাবেন না।
আমাদের ইচ্ছে ছিল এখানে খাবার অর্ডার করব না। সঙ্গে তেমন কিছুও নেই যে, ট্র্যাকিংয়ে বয়ে বেড়াতে কষ্ট হবে। তাও একদম শেষ দিকের একটা দোকানে অর্ডার দিলাম। ট্র্যাকিংয়ের জন্য পোশাক চেঞ্জ করে নিলাম। তারপর আল্লাহর নাম নিয়ে যখন ঝরনার ঝিরিতে পা রাখতে যাব, ততক্ষণে ঘড়ির কাঁটায় সোয়া দশটা বেজে গেছে।
তবে এবার নতুন একটা অভিজ্ঞতা হল। আগে এখানে যেতে কোনো কাউন্টার ছিল না। এবার দেখলাম জনপ্রতি বিশ টাকা করে প্রবেশমূল্য নিচ্ছে। অথচ পথে পথে কোথাও এর সুবিধা দেখতে পাইনি। আগের মতোই সবকিছু।
নাপিত্তাছাড়ায় আমি আগেও দুইবার গিয়েছি। দ্বিতীয়বার অবশ্য প্রথম ক্যাসকেডের গোড়ায় পৌঁছার আগেই আকাশে মেঘের থলি ফুটো হয়ে গেছে। অবিরত বৃষ্টি ঝরেছে অনেকক্ষণ। পাহাড়ি ঢল তৈরি হবে ভেবে আমরা দ্রুত ফিরে আসতে শুরু করলাম। আধাআধি এসে আর দাঁড়াতে কিংবা পা ফেলতে পারছিলাম না। পানির তোড়ে ভেসে যাবার জোগাড়। নিচে আবার পাথর—বড় ছোট এলোমেলো। প্রতি মুহূর্তে পানি বাড়ছে এবং দুরন্ত হচ্ছে তার গতি। কিন্তু যদি কোনো রকমে আমরা বের হয়ে না আসি, রাতে অপ্রস্তুত অবস্থায় এই বিশাল জঙ্গলে পড়ে থাকতে হবে। সঙ্গে তাঁবু নেই, মোবাইলের চার্জও সীমিত। সাপ, মশাসহ বিভিন্ন প্রাণীর উপদ্রব উপেক্ষা করে গোটা একটি রাত এই গভীর অরণ্যে একা থাকা মুশকিল। যে ঢল শুরু হয়েছে এবং আকাশ এখনো গোমড়া মুখে জল ঝরিয়ে যাচ্ছে, রাতেও এখান থেকে বের হওয়া যাবে না মনে হচ্ছে। আমরা হাত ধরাধরি করে চলতে শুরু করলাম। জলের তোড় ভীষণ শক্তিতে পেছন থেকে ধাক্কাচ্ছে। তবু আমরা চলছি। কেউ পড়ে গেলে অন্যরা টেনে তুলছি। মূলত স্রোতের টানে নিচের নুড়ি পাথরগুলো জায়গা থেকে সরে গিয়ে বারবার আমাদের পা হড়কে যাচ্ছিল।
স্রোতের সবচেয়ে ভয়ংকর থাকে মাঝখানটা। আমরা (ফিরতি পথে) ট্রেইলের ডানপাশ হয়ে আসছিলাম। কিন্তু রাস্তায় উঠতে হলে স্রোতের তোড় ডিঙিয়ে আমাদের বাঁ পাশে আসতে হবে। সবাই শক্ত করে হাত ধরাধরি করি গুনে গুনে কদম ফেলেও পারছিলাম না। শেষে যখন ডাঙায় উঠে এলাম, কারও পা ছিলে গেছে, পাথরের আঘাতে কেউ খোঁড়াচ্ছে, অনেকক্ষণ ঠান্ডা জলে হাঁটার দরুণ বাত পেয়ে বসেছে কারও আঙুলে।
এবার এই শুকনো মরসুমে ঝিরি বলা যায় একেবারে শুকনো। শুধু মাঝবরাবর মৃদু ছন্দ তুলে ঝরনার জল গড়িয়ে আসছে। পাশের পাহাড় থেকে মারমা রমণীরা নেমে এসে কাপড় কাচছে; শিশুরা গোসল করছে। শুক্রবার হওয়ায় মোটামুটি পর্যটক রয়েছে। কেউ যাচ্ছে, কেউ ফিরছে। আমরা হাঁটছি। এক পাথর থেকে আরেক পাথরে পা ফেলে সন্তর্পণে এগুচ্ছি। এমনিতে সব ট্রেইলে পাথর থাকে। বড় ছোট নানান আকারের পাথর। নাপিত্তাছড়া ট্রেইলে প্রচুর পাথর। বাড় পাথর অনেক। কিছু পাথর একাই একটি ছোটখাটো টিলার সমান। এরা এমনভাবে পথ আগলে দাঁড়ায়, মনে হয় সামনে আর রাস্তা নেই।
এখানে প্রবেশমুখে এই রকম একটা বড় পাথরের ওপর দিয়ে যেতে হয়। ওঠার সময় এক পাথর থেকে লম্বা কদম ফেলে—লাঠিতে ভর করে—সেই পাথরে পা ফেলতে হয়। তারপর এক কদম করে হাঁটার মতো সরু অংশ ডিঙিয়ে মূল পাথরে উঠতে হয়। নিচ দিয়ে প্রচণ্ড গতি আর শব্দে বয়ে যাচ্ছে জল। কোনোভাবে পা হড়কে গেল বড় রকমের সর্বনাশ হয়ে যেতে পারে। শুধু এই জায়গাটির কারণে আমি নাপিত্তাছড়াকে প্রচণ্ড ভয় করি।
তবে আজ পানি কম থাকায় খুব বেগ পেতে হল না। উচ্চতাভীতির কারণে একটু পা কাঁপলেও উঠে যেতে পারলাম সহজেই। তারপর আরও কতগুলো বড় ছোট মাঝারি পাথর ডিঙিয়ে সামনে পড়ল প্রথম ক্যাসকেড। অনেকে একে নাপিত্তাছড়ার প্রথম ঝরনা বলে; কেউ বলে এটা মূলত একটা ক্যাসকেড। যেখানে প্রপাতের মতো করে জল গড়িয়ে পড়ে। পর্যটকদের অনেকে এখানে ভিজছে গোসল করছে। পাহাড়ি শিশুরা হুটোপুটি খেলছে। আমরা বাঁ পাশ দিয়ে খাড়া ঢালু বেয়ে ওপরে উঠে গেলাম। আগে এখানে রশি পেয়েছিলাম। সেটা ধরে, গাছের শিকড়ে ঝুলে উঠতে হত। এবার বোধহয় শুকনো হওয়ায় সেসব নেই। সহজেই উঠে যাওয়া গেল এবং শেষ জায়গাটায় একটু অসুবিধা হওয়ায় অন্যের সহযোগিতা নিতে হল।
এবার ওপরে যে ট্রেইলটি আমরা পেলাম, নিচের ট্রেইলের তুলনায় এটি আরও সুন্দর। পাথরের খাঁজকাটা পাটাতন দিয়ে ক্ষিণ শব্দের কলকল ধ্বনিতে গড়িয়ে যাচ্ছে ঝরনার জল। এক পাথর থেকে জল গড়িয়ে পড়ছে আরেক পাথরে। পাথরের ফোঁকর দিয়ে চলতে চলতে তুলে যাচ্ছে মৃদুমন্দ ছন্দ। তার সেই চলন্ত পথে পাথরে পাথরে জমছে শ্যাওলা—পিচ্ছিল এবং আঁশটে। খুব ধীরে হাঁটছে কিছু শামুক; ছুটোছুটি করছে ছোট ছোট মাছ। পাহাড়ি শিশুরা সেগুলোর সঙ্গে খেলছে। আর আমরা একদল জলে পা চুবিয়ে পাথরে কদম ফেলে হেঁটে চলেছি আরও গভীর অরণ্যে।
সামনেই পড়ল নাপিত্তাছড়া ট্রেইলের প্রথম ঝরনা। নাম কুপিকাটাখুম। খুব বেশি উচ্চতার নয়। আগেরবার এখানে উথলে উঠে পানি নেমেছিল। এবার এত ক্ষীণ, আগ থেকে জানা না থাকলে কেউ বুঝবেই না নাপিত্তাছড়া ট্রেইলের প্রথম ঝরনা এটি। অবশ্য কেউ কেউ বলে এটি নাপিত্তাছড়ার দ্বিতীয় ঝরনা। প্রথমটি পেছনে ফেলে আসা ক্যাসকেড—সেটিকেই তারা কুপিকাটাখুম ঝরনা বলেন।
আমরা ঝরনা ঝিরি পাথর ডিঙিয়ে এগিয়ে চললাম। গন্তব্য বহুদূর। এবার সামনে তুলনামূলক অল্প উচ্চতার মস্ত এক পাহাড়। এটি ডিঙিয়ে যেতে হবে পরের ট্রেইলে। প্রথমবার যখন এসেছিলাম, ভেজা আর কাদামাটি হওয়ায় এটিতে উঠতে বেশ বেগ পোহাতে হয়েছিল। এবার একেবারে শুকনো টনটনে মাটি। আমরা বিসমিল্লাহ বলে কদম বাড়ালাম, শুরু করলাম পাহাড় বাইতে। যেহেতু নিয়মিত হাঁটাচলা হয়, পর্যটকরা আসেন, ওঠার সুবিধার জন্য মাটি কেটে থাক থাক করে সিঁড়ি বানিয়ে দেওয়া হয়েছে। যদিও একটির চেয়ে আরেকটি অনেক উঁচুতে—লম্বা কদম ফেলতে হয়, তবু বছরে একবার পর্বত ডিঙাতে আসা পর্যটকদের জন্য এই ঢের। অবশ্য বর্ষা নামলে পাহাড়ের কাদামাটিতে এই সিঁড়ি আবার এলোমেলো হয়ে যাবে।
পাহাড়ে উঠেই একটি দোকান। আছে বাঁশ দিয়ে বানানো বেঞ্চ। ক্লান্ত পর্যটক এখানে একটু বিশ্রাম নিতে পারে। আছে শরবতের দোকান। এক গ্লাস লেবুর শরবত শরীর থেকে ক্লান্তি অনেকখানি কমিয়ে দিল।
বাঁশের বেঞ্চিতে বসে গা এলিয়ে দিয়ে তাকালাম গভীর অরণ্যের দিকে। সবুজ যেন উপচে পড়ছে। এখনই এমন যার বিভা, বর্ষায় তো তার রূপ রমণীর লুটোনো আঁচলের মতো পর্যটকদের চোখে কমনীয় করে তুলবে।
আমরা উঠে আবার হাঁটা ধরলাম। পাহাড়ের পাশ ঘেঁষে চলার পথ। যার ডান পাশে পাহাড়ের উঁচু অংশ, বাঁ পাশে গভীর উপত্যকা। দু পাশেই অজস্র গাছ। কিন্তু সরুপথে এত খেয়াল করে হাঁটতে হয়, একটু দাঁড়ানো ছাড়া এতসব সবুজ সৌন্দর্য দেখার সুযোগ নেই। অবশ্য নাপিত্তাছড়া ভ্রমণে সবচেয়ে উপযুক্ত সময় বর্ষাকাল এবং তখন এই সরু পথটুকু অতিক্রম করা কিছুটা কষ্টকরই বটে। কারণ, বাংলাদেশের পাহাড়গুলো বৃষ্টিতে কাদায় থিকথিকে হয়ে যায়; আর থাকে পিচ্ছিল। যেদিন বৃষ্টি নেই শুকনো পাহাড়, সেদিনও ঝরনায় গোসল করে ঝিরি মাড়িয়ে আসা পর্যটকদের গা ছুঁয়ে পড়তে থাকা জলে এটি ভিজে পিচ্ছিল হয়ে যায়। এবার শুকনো পথ আমরা খুব সহজেই মাড়াতে থাকলাম।
খুব বেশি হাঁটতে হল না। নেমে গেলাম পরের ট্রেইলে। আবার সেই ঝিরি, পাথর, জলের শব্দ। দু পাশের পাহাড়ে গাছে গাছে গহিন বন। দু একটি গাছ গোড়া উপড়ে বেঁকে আছে মাথার ওপর। কোথাও ইয়া বড় পাথর পতনোন্মুখ হয়ে আছে। আর একটি প্রবল স্রোতে মাটি ধসে পড়তে পারে ঝিরির মাঝখানে।
এখানে বেশ পথ হাঁটার পর ঝিরির মুখ দুটি দুই দিকে চলে গেছে—অর্থাৎ এটি একটি তেমুখী মোড়। আমরা বাঁ দিকের ঝিরি ধরে হাঁটা ধরলাম। এখানে সব ট্রেইলের মধ্যে এই পথটা তুলনামূলক কঠিন। কখনো বিশাল পাথর পথ আগলে দাঁড়িয়ে আছে, কোথাও কোন পাথরে পা ফেলে এগুব সেটা বোঝা যায় না। কিছুদূর হাঁটার পর আমরা দাঁড়িয়ে গেলাম। অল্প একটু এগুনোর পরেই প্রধান ঝরনা পেয়ে যাওয়ার কথা; কিন্তু কোনো সাড়াশব্দ পাচ্ছি না। সুনসান এবং অরণ্যের অনেক গভীরে আমরা আছি মনে হতে লাগল। দুজন কয়েক কদম এগিয়ে গিয়ে মানুষের হইচই আর জল পতনের শব্দ শুনতে পেল। আমরা আবার হাঁটা ধরলাম। সামনেই অনেক উঁচু থেকে ক্ষিপ্র গতিতে জল পড়ছে।
আজ থেকে ঠিক ৫ বছর আগে (অর্থাৎ আজ ২৩ সালের অক্টোবর মাসের ২০ তারিখ; ৫ বছর আগে ১৮ সালের অক্টোবর মাসের ২১ তারিখে) এখানে এসেছিলাম। ঝরনাটি দেখে পরিচিত মনে হলেও স্মরণ করতে পারছিলাম না, এই পর্যন্ত আগে এসেছিলাম কি না! পরে ফেসবুক মেমোরি জানাল এবং মনে পড়ল, এই জায়গায় আমরা আগেই এসেছিলাম। তখন বেশ পানি ছিল। আমরা অনেক আনন্দ করেছি। বই নিয়ে কিছু ভিডিও ও ফটোগ্রাফি করেছি। কিন্তু ৫ বছরে জলে ঢলে ধসে ভাঙনে এবং এই শুকনো মরসুমে গোটা এলাকার রূপ কিছুটা বদলে যাওয়ায় প্রথমে চিনতে পারছিলাম না।
নাপিত্তাছড়া ট্রেইলের সবচেয়ে উঁচু ঝরনা এটি। কেউ বলে এর নাম বাঘবিয়ানী; কেউ বলে বান্দরখুম বা বান্দরিছড়া। অনেক উঁচু থেকে পানি পড়লেও এর নিচে তেমন একটা গভীর নয়। পানি ঝরেই গড়িয়ে নেমে যায় ঝিরি বেয়ে। অবশ্য বর্ষায় যথেষ্ট পানি থাকে। তখন জমে থাকা পানির ওপর অনেক উঁচু থেকে প্রবল বেগে জল পড়ে যে দ্যোতনা সৃষ্টি করে, ত্রিভুজ আকৃতির এই ঝরনাটিতে ধ্বনি প্রতিধ্বনিত হয়ে দারুণ এক আবহ ছড়িয়ে দেয়। দু পাশের খাঁজকাটা পাথর কিংবা মাটির দেয়ালে ধ্বনিত শব্দ খানিক দূর থেকেও শোনা যায়।
আমরা এখানে কতক্ষণ ভিজে আনন্দ করে ফিরে এলাম। তেমুখী মোড়ে এসে ডানের ঝিরিটিতে ঢুকলাম। এই ট্রেইলটি আরও বেশি ভালো লাগল। সুনসান এবং একটু ছায়াদার। যেন দক্ষ কোনো ডিজাইনার উন্নত সফটওয়্যার ব্যবহার করে একটি সুন্দর ইফেক্ট জুড়ে দিয়েছে। আধাআধি যাওয়ার পর একটু উঁচুতে উঠতে হয়। শুকনো মরসুম খুব বেগ পোহাতে হল না। পানির ধারাও তীব্র না। উঠে গেলাম ওপরে।
এই ঝরনটির নাম মিঠাছড়ি। বেশ চওড়া। একটু ওপর থেকে পানি পড়ে চওড়া দিয়ে দুই ভাগে নামতে থাকে। প্রথমবার এখানে প্রচুর পানি পেয়েছিলাম; এবার কম। অবশ্য চওড়া পাটাতন বেয়ে পানি ছড়িয়ে পড়ার কারণে বোধহয় খুব একটা চোখে লাগছে না।
আমরা কিছুক্ষণ উপভোগ করে ফিরতি পথ ধরলাম। একটু এগুতেই একজন সাপ সাপ বলে উঠল। দেখি প্রায় আড়াই–তিন হাত লম্বা একটি সাপ ঝিরির পানিতে ধীরে এগুচ্ছে। মতিগতি দেখে মনে হল খাবার খুঁজছে। যেমন লম্বা, গতরে তেমন স্বাস্থ্য নেই। পাহাড়ি সাপ হিসেবে এটি হয়তো এখনো কিশোর কিংবা তরুণ।
আমরা এবার আরও সতর্কতার সঙ্গে হাঁটতে লাগলাম। কারণ, দু পাশেই পাহাড় আর গভীর অরণ্য। এসব বনে অনেক বুনো আর হিংস্র–বিষাক্ত প্রাণী বাস করে। এমনও সাপ আছে—গাছ, পাথর বা পাতার সঙ্গে এমনভাবে মিশে থাকে—এখানে যে একটি সাপ আছে, খালি চোখে বোঝার উপায় নেই। বিশেষ করে একপ্রকার সবুজ সাপ পার্বত্য অঞ্চলে দেখেছি, এরা পাতার সঙ্গে সন্তর্পণে ল্যাপ্টে থাকে। প্রথম দেখায় বোঝার কোনো উপায় থাকে না।
অবশ্য, পর্যটন এলাকাগুলোতে মানুষের আনাগোনা বেশি হওয়ার কারণে এসব প্রাণী ঝিরি বা ঝরনায় তুলনামূলক কম আসে। তবু সতর্ক হয়ে হাঁটার তো বিকল্প নেই। বাড়ি থেকে বাজারে যেতেও আমরা সাবধানে হাঁটি।
তেমুখী মোড়ে দাঁড়িয়ে একবার ঝিরিগুলো দেখলাম। আমরা ‘নাপিত্তাছড়া ঝরনা’ বললেও নাপিত্তাছড়া কোনো ঝরনার নাম নয়। এই পুরো ঝিরিপথকে ‘নাপিত্তাছড়া ট্রেইল’ বলে—তিন অথবা চারটি ঝরনার জল একত্র হয়ে যেখানে রমণক্রীড়ায় মেতে ওঠে। প্রতিটি ট্রেইলে ছড়িয়ে থাকা পাথরে পাথরে তৈরি হওয়া বনে তারা কলকল ছন্দে আপন শব্দে বয়ে চলে। জলের রমণে সেসব পাথরে পড়ে শ্যাওলার দ্রবণ।
ঝিরি ডিঙিয়ে আমরা আবার আগের পাহাড়টিতে উঠে এলাম। যেখানে শরবত খেয়েছিলাম, এখান থেকে (ফিরতি পথে) নামবার আরেকটি পথ রয়েছে। এই পথে আর আগের মস্ত পাথর, প্রথম ঝরনা, দীঘল ঝিরি, চওড়া ক্যাসকেড পড়বে না।
আমরা হাঁটা ধরলাম। পাহাড়ের পাশ ঘেঁষে মানুষের পায়ের ছাপে তৈরি হওয়া পথ। এক পাশে বুনো পাহাড়, আরেক পাশে গিরি–উপত্যকা। চলতি পথে রাস্তা দেখে হাঁটতে গেলে ওপর থেকে পাহাড় সবুজ ঝিরির সৌন্দর্য উপভোগ করার সুযোগ নেই। আমি একটু দাঁড়ালাম। তাকালাম নিচে। নাম না–জানা অজস্র গাছ জড়ামড়ি করে দাঁড়িয়ে আছে। সবুজ ঢেউ খেলে মিলিয়ে গেছে পরের পাহাড়টিতে। আরেকটু এগুলে দেখা যায় নিচে বয়ে যাচ্ছে ঝিরির জল। পাতার ফোঁকরে সূর্যের আলো এসে পড়ছে পাথরে। কোনো পাথর কালো, কোনোটি শাদা। লাল–খয়েরির মিশেল আছে কোনোটিতে। রোদের রশ্মি যেটিতেই পড়ছে, রঙের সঙ্গে মিশে গিয়ে সৌন্দর্যের দারুণ দ্যোতনা সৃষ্টি করছে।
পাহাড় থেকে নেমে ঝিরির অল্প একটু অংশ পাওয়া যায়। স্থানীয় মারমা নারীরা পাথরে বসে ঝরনার জলে থালাবাসন মাজছে। ছুটন্ত পানিতে ময়লা কিংবা কালি ভেসে চলে যাচ্ছে দূরে। সেই পথ হয়ে সবুজের জাজিমে পা জড়িয়ে আমরা উঠে এলাম গ্রামে। ঘড়িতে তখন দুপুর ২টা। আমাদের তাড়াতাড়ি করতে হবে; ছুটতে হবে পরের গন্তব্যে। চোখের তারায় গিরি ঝরনা ঝিরির যে সৌন্দর্য লেগে আছে, তা রোমন্থন করতে হবে অনন্তকাল পর্যন্ত।
পড়ে ভালো লাগলো । মনে হলো আমি নিজেই ভ্রমণ করছি।
পড়তে পড়তে মনে হচ্ছিল ঝরনাগুলোতে যেনো আমি নিজেই ভ্রমন করছি।