তিন প্রহরের কড়চা

মুজিব হাসান

দুপুরের ছায়াবীথি

বাড়ির পেছনে অনেকগুলো পিটুলি গাছ। এলাকার ভাষায় আমরা একে ম্যাড়া গাছ বলি। গাছটাতে শীতের মরসুমে ফুল ধরে। ছোট ছোট হলদে ফুল, ছড়ায় ছড়ায় ঝুলে থাকে। খুব ঠুনকো, ঝরে পড়ে হালকা বাতাসে। ফুলঝরা শেষ হলে বসন্তকালে নতুন পাতা ধরে। এ পাতার সংসারে আসে তার ফলটি। গোল গোল লাটিমের মতো ফল। অখাদ্য, তবে খেলার উপকরণ হিসেবে চমৎকার। লাটিম ও মারবেল খেলা যায় এটি দিয়ে।

ঘণ্টা দুয়েক সময় ধরে এই গাছের নিচে বসে আছি। সামনে খোলা, এরপরে গাং। খোলায় আজ কোনো কাজ নেই। তাই বসে বসে গাংধোয়া বাতাস মাখছি গায়ে। আশপাশে অজস্র ঝোপঝাড়। তাতে তেলাকুচার লতাই বেশি। সবুজ গালিচা হয়ে তরতরিয়ে বেড়ে চলছে লতাগুলো। আজ সকালে এর পাতালতা দিয়ে দারুণ মজার শাক খেয়েছি। সেই স্বাদ এখনো মুখে লেগে আছে। ভাবছি কাল সকালে আবার নিয়ে খাব।

পিটুলি গাছটাতে এ সময়ে বিছার খুব উপদ্রব হয়। আর বিছা কীটটি এমন—একে ধরতে বা ছুঁতে হয় না, কাছেপিঠে থাকলে, বরং এর কাঁটালো শরীরের আঁচ যদি একটু গায়ে লাগে, তাহলেই সাথে সাথে সেই অংশটুকু ফুলে যায়। প্রচণ্ড চুলকানি শুরু হয়; চুলকাতে চুলকাতে লাল হয়ে যায় জায়গাটুকু। আর কী ব্যথা! এ কদিনে যে কয়বার এই গাছের তলায় বসেছি, প্রতিবারই হয়েছি বিছাক্রান্ত। শরীরের অনেক স্থান বিশেষত ঘাড়, পিঠ ও বাহুর অনেকাংশ লালচে ও ফোলা হয়ে আছে।

গুমোট গরমে ঘেমে উঠেছি। গাংধোয়া বাতাস এই বইছে এই উধাও। পাশেই আম্মা গোবর দিয়ে খলুই নিকুচ্ছেন। কদিন পরে ধানখেত কাটবে। ধান মাড়াইয়ের কাজে লাগবে এই খলুই। ওদিকে আব্বা অনেকক্ষণ ধরে রোদে কাজ করে ছায়ায় এসে বসেছেন। এই দাবদাহের সময়ে গাছের ছায়াটুকু সবাইকে দারুণ স্বস্তি এনে দেয়। তাই ঘরদোর ছেড়ে সবাই চলে আসে ছায়াবীথিতলে। দুপুরের আগের অলস কিংবা কর্মব্যস্ত সময়টুকু এভাবেই হয়ে ওঠে উপভোগ্য।

মায়াবী কাজল সন্ধ্যা

বাসার ব্যালকনিতে বসে সন্ধ্যা দেখেছি। বর্ষাদিনের শহুরে সন্ধ্যা। দিন থাকতে ফুরিয়ে গেছে দিনের আলো। আকাশটা দারুণ মেঘমেদুর হয়ে আছে। সব লেপ্টে থাকা ধূসর মেঘ, গাঢ় হয়ে জমে আছে। তাদের ওড়াওড়ির গতি ঠাওর করা যাচ্ছে না, বোঝা যাচ্ছে রংবদলের রকমফের। সাদা-কালোর মিশেলে ছাই রংটা বেশ চোখে পড়ছে। এরমধ্যে নিভু নিভু হয়ে আছে দিনের দীপটি।

আবহটা কেমন থ মেরে আছে; ঝিম ধরা কিন্তু চাপা গুমোট। বাতাসের আনাগোনা নেই। শহুরে কোলাহলও কানে আসছে না। আশপাশের বাসাগুলোও শব্দহীন। ভাবতেই অবাক লাগছে, এমন নৈঃশব্দের ভেতর দিয়ে শহুরে সন্ধ্যার গমন দেখছি! এই দৃশ্যটা হৃদয়পটে ফুটিয়ে তুলছে আমাদের গাঙের পারের সেই মায়াবী সন্ধ্যাটিকে—যার কাজলরেখার দিকে তাকিয়ে পার করে দিতাম মুহূর্তটি।

কয়েকটি বাদুড় ওড়াওড়ি করছে চুপটি করে। আর কোনো পাখির চিহ্ন চোখে পড়ছে না। কানে বাজছে না তাদের পাখসাট কিংবা কাকলি। পাশের ছাদের করমচা গাছটির লাল লাল ফলগুলোও কেমন কালো কালো দেখাচ্ছে। এ কদিনে সব বুঝি ডাঁসা বা পাকা হয়ে গেছে। আমার পাশে যে তিনটি গাছ—তুলসি, পুদিনা, বেলি—তাদের ডালপালা ও পাতাবাহারেও নেই প্রাণচাঞ্চল্য। কী গুমোট আবহ!

বসে বসে এসব দৃশ্যপট অক্ষরবন্দি করতে করতেই কানে এলো মাগরিবের আজান। গুমোট পরিবেশটা এবার যেন স্পন্দিত হয়ে উঠল শাশ্বত পবিত্র স্বরে। সম্মোহনী ডাক হৃদয়কে উতলা করে তুলল। সন্ধ্যার মায়াবী কাজলরেখা লেপ্টে থাকুক আকাশের কার্নিশে, আমি গিয়ে সিজদাবনত হই মহামহিমের কুদরতি পায়ে!

নিশুতির চন্দ্রকথা

দিনের আলো নিভে যেতেই জ্বলে উঠল আকাশের রুপালি বাতিটি। সন্ধ্যারাতে এত চমৎকার দশমীর চাঁদ! কী ফকফকে তার আলো; অবাক জোছনা! রুমের দরজা এঁটে ছাদের কার্নিশে এসে বসলাম। নির্নিমেষ তাকিয়ে রইলাম চাঁদটির দিকে। পাশে জ্বলজ্বল করছে শুকতারাটি। চাঁদ-তারার এ মানিকজোড়কে দারুণ লাগছে দেখতে।

উঠানের মতো বিশাল ছাদ। বিচ্ছুরিত জোছনায় ভেসে যাচ্ছে যেন। মন চাইছে নলের পাটি পেতে শুয়ে থাকি কিছুক্ষণ। আর কেউ একজন এসে মাথায় বিলি কেটে দিতে দিতে কমলা রানির গল্পটি বলুন। দাদু, বড়ো ফুফু, মতু নানু, মালেকা ফুফু, ছোট দাদু কিংবা আম্মা। আমার শৈশবের পৃথিবীটা তাদের গল্পেই রূপকথাময় হয়ে আছে।

ভাবতে ভাবতে চাঁদটির দিকে তাকিয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেললাম। এই শহুরে রোজগারি জীবনে চাঁদের দিকে তাকানোরই মওকা পায় না অনেকে; জোছনাবিলাস তো মহা বিলাসিতা! আটটা-পাঁচটার অফিস ডিউটি শেষে মটকা মেরে পড়ে থাকি বাসার খাঁচায়। কোথাও বের হতে মন চায় না। যেন জীবন এখানে মাটিচাপা আগ্নেয়গিরি অথবা বরফে ঢাকা হিমপ্রবাহ। লাভা আর শীতল স্রোত নিয়ে কেবলই বয়ে যায় ভেতরে ভেতরে। আর নীরবে সয়ে যেতে হয় সব।

আরেক দিন

রাত এগারোটার পরপর ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। ঘুম ভেঙে গেল প্রচণ্ড গরমে। সে কী গুমোট গরম! মাথার ঘামে বালিশের অড়ও ভিজে গেল। চোখভরতি রাজ্যের ঘুম নিয়ে লাফিয়ে উঠলাম। মোবাইল ঘড়িতে সময় দেখলাম, সোয়া একটা বাজে। তখুনি আদুড় গায়ে ছুটে এলাম ব্যালকনিতে।

এখানে এসে একরাশ ভালো লাগায় মন ভরে উঠল। কী মজার বাতাস বইছে; মেদুর হাওয়া! আদুরে তোড়ে মুহূর্তেই শুষে নিল গায়ের ঘাম। তারপর আকাশের দিকে তাকাতেই দারুণ অবাক। জষ্টি মাসের দ্বাদশী চাঁদ ফকফকে জোছনা বিলাচ্ছে। জোছনার সে কী বাহার! মুগ্ধ চোখে অনেকক্ষণ তাকিয়ে রইলাম।

খেয়াল এলো, এখানে রাতটা কাটিয়ে দিলে কেমন হয়? ভাবতে ভাবতেই রুম থেকে কাঁথা-বালিশ নিয়ে এসে পেতে দিলাম মেঝেতে। শোয়ার সাথে সাথে আনন্দের হিল্লোল দোলা দিয়ে গেল আমাকে। চোখ থেকে ঘুমকে খেদিয়ে দিলাম কিছুক্ষণের জন্য।

চাঁদের আলো এসে পড়ছে আমার মুখে এবং সারা দেহে। মনে হচ্ছে আমি জোছনার প্লাবনে ভেসে যাচ্ছি। এ এক অপার্থিব আনন্দ। মাথার দিকে তিনটি টব। তুলসি, পুদিনা আর বেলি। বেলিটার ফুল ঝরে গেছে। থাকলে বেশ হতো। তবুও বাতাসের তোড়ে পাতার মর্মর তুলে আমাকে সে অভিবাদন জানাচ্ছে। তারপর চাঁদের দিকে তাকিয়ে থেকে কখন যে ঘুমিয়ে পড়লাম, টেরই পেলাম না!

হাওড় হাওয়ার রাত

বাড়িতে আসার পর থেকে বৃষ্টি। দিনরাত এক হয়ে গেছে বৃষ্টির ধারাজলে। একনাগাড়ে পাঁচদিন বর্ষণের পর গেলকাল দেখা দিল সূর্যের রোদেলা মুখ। ততদিনে হাওড়ের ভাসান পানি লকলকে জিভে আছড়ে পড়েছে বাড়ির নামায়; একেবারে ঘায়েলের গোড়ায়। তোড়জোড় করে শুরু হলো বাড়ি বান্ধার কাজ।

এবারের পানির বেগ বেশ মারাত্মকভাবে বেড়ে গেছে; এখনো বাড়ছে প্রতিদিন। এটা বন্যার পূর্বাভাস বটে। তাই রোদেলা দিনে বাড়ি বান্ধার কাজে ব্যস্ত থাকতে হচ্ছে।  ঘায়েল বান্ধার রেওয়াজ যদিও অনেক জায়গায় কমে গেছে, অনেক জায়গায় নেই-ই। তবুও হাওড়ের ঝড় আফালের আক্রমণ থেকে ভিটেমাটি রক্ষা করতে এটা করতে হয় প্রতি বর্ষায়।

আজকের দিনটি ছিল ঝলমলে রোদেলা। সারাদিন হাওড় বেশ শান্ত ছিল। মৃদু ঢেউখেলানো আর দারুণ স্রোতা। দিনের আলো ফুরাতেই বইতে লাগল হাওড় হাওয়া। ইশার দিকে বিদ্যুৎ চলে গিয়েছিল; তার এখনো ফেরার নাম নেই। তাই খাবার খেয়ে চলে এলাম বাড়ির নামায়। দেখি সমগ্র নিসর্গ দোলায়িত করে কী চমৎকার হাওড় হাওয়া বইছে! পাড়ার ছেলেবুড়ো অনেকেই এসে আড্ডা বসিয়েছে এখানে। পাশের রাস্তা দিয়ে হেঁটে যেতে যেতে অনেকে বসে পড়ছে। হাওড় হাওয়ায় ভাসিয়ে দিচ্ছে শরীর।

রাত পোহালেই আমাকে চলে যেতে হবে। এবারের ছুটিতে বাড়িতে এটাই হয়তো আমার শেষ রাত। এই বর্ষায় আর আসা হবে কি না বলতে পারছি না। তাই দেহমন ভরপুর করে নিচ্ছি নিসর্গজ মধুরিমায়। এই অর্জন ও ঋদ্ধতাই আমার লেখালেখির প্রাণদ।

বিজ্ঞাপন

Subscribe
Notify of
guest
1 Comment
Oldest
Newest Most Voted
Inline Feedbacks
View all comments
মাহফুজ তাসনিম
মাহফুজ তাসনিম
6 months ago

দারুণ লেগেছে।
একরাশ কৃতজ্ঞতা ।

স্বত্ব © ২০২৩, যোগাযোগ | ই মেইল : jogajogbd.org@gmail.com

যোগাযোগ-এ প্রকাশিত কোনো লেখা, ছবি কিংবা শিল্পকর্ম লেখক অথবা কর্তৃপক্ষের অনুমতি ছাড়া কোথাও প্রকাশ করা অবৈধ৷