তালাল আসাদের জন্ম সৌদি আরবে। কিন্তু নাগরিকত্বে ব্রিটিশ-পাকিস্তানি। নৃতত্ত্ব নিয়ে গবেষণার হাতেখড়ি আফ্রিকায়। তার বাবা মুহাম্মদ আসাদ অস্ট্রিয়ান। ইহুদিধর্ম থেকে কনভার্টেড মুসলিম। তার মা সৌদি আরবের ধর্মপ্রাণ মুসলিম। পরিচয়ে এই বিপুল বৈচিত্র্যই চিন্তার ক্ষেত্রে তার বৈচিত্র্যের জানান দিচ্ছে।
তালাল আসাদ নিজেও বিষয়টা স্বীকার করেছেন। বাবা মুহাম্মদ আসাদের ইসলামচর্চা ছিল তার বুদ্ধিবৃত্তিক সফরের অংশ এবং ফলাফল। পক্ষান্তরে মা ছিলেন জন্মসূত্রে নিবেদিত মুসলিম। তালাল আসাদের নিকট মায়ের ধর্মটা ঠিক কেমন যেন মনে হতো—চিন্তাহীন, আবেগসর্বস্ব। কিন্তু মায়ের মৃত্যুর সময় পরিণত বয়সে দেড় বছর সৌদি আরবে থাকার অভিজ্ঞতার পর তার সেই চিন্তায় পরিবর্তন আসে। ধর্মের ‘আত্মনিবেদন’ তার কাছে অর্থবহ হয়ে উঠতে শুরু করে। শুধু কাঠখোট্টা ‘চিন্তা ও বুদ্ধিবৃত্তি’র বাইরেও জগৎ আছে, সেই জগতের নিজস্ব চিন্তা ও বুদ্ধিবৃত্তির সিলসিলা আছে, তা অনুভব করতে শুরু করেন।
পড়াশোনা করেছেন ইংল্যান্ডে। তার বাবা মুহাম্মদ আসাদ পাকিস্তানের জাতীয় কবি আল্লামা ইকবালের আহ্বানে পাকিস্তানে থিতু হয়েছিলেন। ফলে তালাল আসাদে শৈশব কেটেছে পাকিস্তানে। যেখানে সামাজিকভাবে রক্ষণশীল ‘গোঁড়া’ ধর্মীয় আবহ থাকলেও তালালের পরিস্থিতি ছিল ভিন্ন। উচ্চবিত্ত পরিবারের, ধর্ম যেখানে গোঁড়া না; যৌক্তিক, বুদ্ধিবৃত্তিক, চিন্তার সফর ও ফসল।
এই শৈশব থেকে বেরিয়ে পড়াশোনার জন্য যখন ইংল্যান্ডে পাড়ি জমান, আধুনিকতার রূপ-রস-রং-ঢং এ মুগ্ধ-বিমোহিত হয়ে যান। বিষয়গুলো তার নিজের সাক্ষাৎকারেই উঠে এসেছে। কী চমৎকার স্বাধীনতা, ব্যক্তির কী অনুপম খোদায়িত্ব! শান্তি।
কিন্তু পরবর্তীতে গবেষণার কাজে আফ্রিকা এবং সৌদি আরবে মায়ের কাছে থাকার পর আধুনিকতার যে রূপটা লন্ডনে বসে দেখেছেন, তার ভিন্ন রূপের হদিস মেলে। আধুনিকতার সংজ্ঞা এবং সুবিধা ইংল্যান্ডে বসে যেভাবে উপভোগ করা যায়, আফ্রিকায় তা ভিন্ন। সেখানে আধুনিকতা হাজির হয়েছিল প্রচণ্ড নির্মম, খুনে, ধ্বংসাত্মক, সর্বগ্রাসী, বিনাশী ও হন্তারক হিসেবে। শুধু ব্যক্তি নয়, গোটা সমাজ, গোষ্ঠী ও দেশ বিলীন হয়ে গেছে আধুনিকতার সর্বসংহারী উদরে।
ধীরে ধীরে মুগ্ধতা কেটে যেতে থাকে তালাল আসাদের। নতুন করে আধুনিকতা ও আধুনিকতাবাদী প্রকল্পগুলো—যেমন লিবারেলিজম, সেক্যুলারিজম, জাতিরাষ্ট্র, আধুনিকতা বনাম ঐতিহ্য ইত্যাদির সুলুক সন্ধানে ব্রতী হন। একই সাথে মনোনিবেশ করেন ধর্মের আত্মা অনুসন্ধানে। এই প্রচেষ্টার অংশ হিসেবেই আমরা তালাল আসাদের প্রথম বৃহৎকর্ম ‘জিনিওলজিস অব রিলিজিয়ন’র তোহফা পাই।
যাই হোক, উদারনৈতিকতাবাদী আধুনিকতার (লিবারেল মডার্নিটি) খুঁত অনুধাবনের জন্য তিনি সমাজতান্ত্রিক তাত্ত্বিকদের পড়তে শুরু করেন। জীবনের এই সময়টাতে সমাজতন্ত্রের প্রতি বেশ ভালোই সহানুভূতিশীল ছিলেন। হালকাপাতলা রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডেও অংশগ্রহণ করতেন। কিন্তু একটা সময় এসে তিনি উপলব্ধি করেন, তিনি যে আধুনিকতার আত্মা খুলে দেখতে চাইছেন, সমাজতন্ত্র সেই আধুনিকতারই ভিন্ন অংশ মাত্র। উদারনৈতিকতাবাদী আধুনিকতা আর সমাজতান্ত্রিক আধুনিকতা—আধুনিকতার দুই রূপ।
এ সময় তার মাথায় প্রচলিত আধুনিকতাবাদী সমস্ত প্রকল্পের বাইরে গিয়ে আধুনিকতাকে আবিষ্কার করার বাসনা জাগে। সম্পূর্ণ নতুন, স্বকীয় ও স্বতন্ত্র ধারায় তিনি আধুনিকতার সুরতহাল তৈরির প্রচেষ্টা শুরু করেন।
এখানে সর্বপ্রথম তার যে খটকা বাধে—আধুনিকতা কী? কোথেকে এলো? ভিন্নভাষায় বললে খোদ আধুনিকতার জিনিওলজি কী? আধুনিকতার পয়গম্বররা দেখাতে চান–আধুনিকতা মানবমুক্তির সর্বশেষ ঘাঁটি। ইতিহাসের পুরোটা সময় মানবজাতি চক্রাকার এক ঘেরাটোপে আবদ্ধ ছিল। তারা একে চিহ্নিত করেন ‘ঐতিহ্য’ বা ট্র্যাডিশন হিসেবে। ট্র্যাডিশন পশ্চাৎমুখী। এটি অতীতকে পুনরুৎপাদন করতে চায়। অতীতকে ধরে রাখতে চায়। বর্তমানকে অতীতের বাটখারায় মাপে এবং অতীতের আদলে বর্তমানকে গড়ে তুলতে চায়।
ফলে ঐতিহ্য মানবজাতির ইতিহাসে কখনো ‘প্রোগ্রেস’ বা সমৃদ্ধি নিয়ে আসেনি। যা নিয়ে এসেছে তা হলো পশ্চাৎপদতা আর পশ্চাৎমুখিতা। ফলে ইতিহাসের পাতায় হাজার বছর পেরিয়ে গেলেও মানবজাতি সমৃদ্ধি, চিন্তার অভিযাত্রা শৈশবও পেরোয়নি।
আধুনিকতা এসে এই অচলায়তন ভেঙে ফেলতে চায়। সে সমৃদ্ধি চায়, পশ্চাৎমুখিতা ছুড়ে ফেলে ভবিষ্যতমুখী হতে চায়। মানবজাতিকে এগিয়ে নিতে চায়। ফলে প্রশ্ন চলে আসে–ঐতিহ্য না আধুনিকতা? পশ্চাৎপদতা নাকি প্রগতিশীলতা? চক্রাকার ঘূর্ণন নাকি সম্মুখযাত্রা?
কিন্তু তালাল আসাদের চোখে এখানেও খুঁত ধরা পড়ে। তিনি দেখতে পান–উদারনৈতিক তাত্ত্বিকরা একদিকে ঐতিহ্যকে খারিজ করে সেখানে আধুনিকতাকে বসাতে চাচ্ছেন, একইসময়ে নিজেদের প্রচেষ্টাকেও তারা ঐতিহ্য হিসেবে উল্লেখ করছেন! তাদের ভাষায় সেক্যুলার ঐতিহ্য, লিবারেল ঐতিহ্য, সমাজতান্ত্রিক ঐতিহ্য–শব্দগুলো হরহামেশা এস্তেমাল হয়। তালাল আসাদের প্রশ্ন–যদি ঐতিহ্য আর আধুনিক প্রকল্পগুলো বিপরীতমুখী হয়, তাহলে ‘আধুনিক ঐতিহ্য’ শব্দবন্ধের অর্থ কী? আধুনিকতাবাদী তাত্ত্বিকরা নিজেদের বহু প্রকল্পেই ঐতিহ্য শব্দটি ব্যবহার করে থাকেন, এই ঐতিহ্য তাহলে কোন ঐতিহ্য?
দ্বিতীয় আরেকটা অসামঞ্জস্যের প্রতি তালাল আসাদের দৃষ্টি পড়ে–দেশ, সমাজ, অঞ্চলভেদে আধুনিকতার রকমফের এবং আধুনিকতাবাদী প্রকল্পগুলোর নিজেদের মধ্যকার বৈচিত্র্য বা ভিন্নতা। এখানে নতুন কিছু প্রশ্ন হাজির হয়। আধুনিকতা কি একমুখী? আধুনিকতার কি বিশ্বজনীন কোনো রূপ আছে? সহি আধুনিকতা বনাম গলত আধুনিকতা বলতে কিছু কি আছে? যদি না থাকে, তাহলে ফরাসি, ব্রিটিশ এবং আমেরিকান সেক্যুলারিজম-লিবারেলিজমের ভিন্নতাকে কীভাবে ব্যাখ্যা করা হবে?
এসব প্রশ্নের দুয়ারে দাঁড়িয়ে তালাল আসাদ তার চিন্তার সবচাইতে মৌলিক উপাদানটা আবিষ্কার করেন–ঐতিহ্য। একে তিনি গতানুগতিক নৃতাত্ত্বিকদের চাইতে সম্পূর্ণ ভিন্ন দৃষ্টিতে দেখেছেন। তার মতে–খোদ সেক্যুলারিজম, লিবারেলিজম, আধুনিকতা ঐতিহ্যেরই অংশ। পৃথিবীর প্রতিটি অঞ্চলের ঐতিহ্য আলাদা। এবং এই ঐতিহ্য মোটেই স্থবির কিছু নয়, যেমনটা আধুনিকতাবাদীরা দেখাতে চায়। বরং স্থান, সময় ও জীবনকে ধারণ করার তাগিদে ঐতিহ্য সতত পরিবর্তনশীল।
সময়ের ভেতর আমরা যেভাবে জীবনযাপন করি–সেটাই ঐতিহ্য। এটি অত্যন্ত গতিশীল এবং বহুমাত্রিক। এমনকি সময়ের সাথে ঐতিহ্যের খাপ খাইয়ে নেওয়ার যে প্রচেষ্টা, বিশেষ একটা সময়ে, বিশেষ একটা অঞ্চলে সেই প্রচেষ্টার বহিঃপ্রকাশ হলো ‘আধুনিকতা’ এবং আধুনিকতার অপরাপর অনুষঙ্গসমূহ। ফলে আধুনিকতা নিজেই একটা ঐতিহ্য। ঐতিহ্য বা ট্র্যাডিশনের বিরুদ্ধশক্তি নয়। প্রতিটি অঞ্চলে, সেই অঞ্চলের সময় ও জীবনের মত করে ঐতিহ্য ও আধুনিকতার মিশেল ঘটেছে বা বলা ভালো–সেখানকার আধুনিক ঐতিহ্য বিকশিত হয়েছে।
এই উদ্ভাবনের মাধ্যমে তালাল আসাদ দ্বিতীয় প্রশ্নেরও উত্তর পেয়ে যান–আধুনিকতার রকমফের কেন ঘটছে। ঐতিহ্য যেহেতু গতিশীল, স্থবির কিছু নয়, তাই এতে ক্রমাগত পরিবর্তন-পরিবর্ধন-পরিমার্জন চলমান থাকে। একই ঐতিহ্যের ভেতর বহুমুখী ধারা-উপধারা থাকতে পারে। তাদের ভেতরকার বাহাস আর ইজতেহাদ চলমান থাকে। নানা উপধারার মিশ্রণ ও বোঝাপড়ায় ঐতিহ্য সর্বদা পরিবর্তিত হতে থাকে।
এমনকি একই ঐতিহ্য ভেঙে নতুন ঐতিহ্যও গড়ে উঠে। এই পয়েন্টটা একটু ব্যাখ্যার দাবি রাখে। তার আগে অনলাইনে বাংলাদেশের অতিসাম্প্রতিক একটা বাহাসের কথা স্মরণ করা যাক।
ফ্যাসিস্ট আওয়ামী লীগের পতনের পরপরই তৎকালীন প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী জনাব মাহফুজের একটি বক্তব্য ঘিরে নেটিজেনদের মধ্যে চায়ের কাপে ঝড় উঠে–‘মেনি মেনি ইসলামস’। খুবই অনুমেয়–ধারণাটা তালাল আসাদের ‘মেনি মেনি ট্র্যাডিশনস’ থেকে আসা। ইসলাম এই অঞ্চলের ঐতিহ্যের প্রধান অনুষঙ্গ। ফলে স্বাভাবিকভাবেই এই ঐতিহ্যের ভেতরে বাহাস থাকবে। সেই বাহাস ঘিরে নানা উপ-ঐতিহ্য গড়ে উঠবে। যেমন গড়ে উঠেছে হানাফি, শাফেই, মালেকি, হাম্বলি, সালাফি, বেরেলভি, দেওবন্দি-সহ বিশ্বজুড়ে শত শত হাজার হাজার ইসলামি ধারা-উপধারা।
কিন্তু এখানে খোদ তালাল আসাদেরই চিন্তার যে মৌলিক জায়গাটা বাদ পড়ে যাচ্ছে সেটা হল–ঐতিহ্যের ভেতরকার বিতর্কের সীমা নির্ধারণ। তার ভাষ্যমতে এটা পৃথিবীর সমস্ত ঐতিহ্যের মূল বিতর্ক–কতটুকু পর্যন্ত দ্বিমতের সুযোগ আছে, কোন সীমা পর্যন্ত বিতর্ক করা যাবে। যেমন উদারনৈতিকতাবাদের কথাই যদি ধরি, এখানে যথেষ্ট পরিমাণ ‘মুক্তচিন্তার’ সুযোগ রয়েছে। কিন্তু একইসাথে সেই মুক্তচিন্তার একটা সীমারেখাও রয়েছে। এমন কিছু বিষয় রয়েছে–যেগুলো মুক্তচিন্তার আওতাভুক্ত না। গণতন্ত্রে নিজস্ব মত জানানোর সুযোগ রয়েছে, কিন্তু সেই সুযোগের একটা সীমাও রয়েছে। গণতান্ত্রিকভাবে যদি আপনি সিদ্ধান্ত নেন যে আপনি আর গণতন্ত্র অনুসরণ করবেন না, গণতন্ত্র একে মেনে নেবে কি না?
ভিন্নভাবে বললে–প্রতিটা ঐতিহ্যের কিছু মূলপ্রাণ রয়েছে। সেই মূলপ্রাণকে ধারণ করে আপনি ঐতিহ্যের নানারূপ চর্চা করতে পারেন। কিন্তু রূপান্তর ঘটাতে গিয়ে যখন সেই মূল প্রাণই বধ হয়ে যাবে, তখন সেটা এই ঐতিহ্যের অংশ বলে বিবেচিত হবে না। বরং সেখানে জন্ম নেবে নতুন ঐতিহ্য। বিষয়গুলো খোদ তালাল আসাদ তার বিভিন্ন সাক্ষাৎকারে খোলাসা করেছেন।
ফলে আমরা যদি আমাদের পূর্বেকার উদাহরণে ফিরে যাই–মেনি মেনি ইসলামস, তাহলে এখানেও একই প্রশ্ন প্রাসঙ্গিক এবং সেটা খোদ তালাল আসাদের চিন্তার মৌলিক অংশ বলেই প্রাসঙ্গিক যে কতটুকু বৈচিত্র্য ‘ইসলাম’ রূপে স্বীকৃত হবে আর কোন সীমা অতিক্রম করলে সেটা ইসলামি ঐতিহ্য থেকে ছিটকে পড়বে এবং নতুন ঐতিহ্যরূপে আবির্ভূত হবে? ইসলামের কোন মূলপ্রাণগুলো ধারণ না করলে একে মেনি মেনি ইসলামের কাতারে সারিবদ্ধ করা যায় না?
[২৬ ডিসেম্বর, ২০২৪]
আলহামদুলিল্লাহ, মুগ্ধ হয়েছি।