কুয়াশায় থেমে থাকা ট্রেন

আবদুল্লাহ আল মাহমুদ

সালমান ভাই আজ রাতে একবাক্স লাড্ডু এনেছেন। ভিডিও কলে নাকি দেখা গেছে তার একমাত্র পুত্র হাঁটতে শিখে গেছে। একজন বাবার এই নির্মল আনন্দ আমাদের চোখে লাড্ডুর চাইতে মিঠা লাগে। আজ কদিন যাবত আমার শরীরটা ভালো না, নভেম্বরের শীত এদিকটায় বেশ জেঁকে বসেছে। কয়েক কিলোমিটার দূরেই যমুনা নদী, সন্ধ্যার পর পরই হাঁড়কাপানো শীতে জবুথবু হয়ে বসে থাকতে হয়। তিন চিল্লার সফরের শেষ চিল্লা পড়েছে সিরাজগঞ্জ সদরে, আজ তৃতীয় মসজিদ। শহরের সীমানা ছাড়িয়ে রেললাইন ঘেঁষে একটা মসজিদ, সামনে বিশাল খোলামাঠ, উপরে নির্মাণাধীন মিনার। সামনে দিয়ে স্টেশনের রেললাইনটা চলে গেছে উত্তরবঙ্গের দিকে। এই মসজিদের সবচেয়ে আকর্ষণীয় দিক হচ্ছে ইমাম সাহেবের কুরআন তিলাওয়াত। প্রথম দিন উনি ছিলেন না, দ্বিতীয় দিন ফজরে নামাজে দাঁড়িয়ে একরকম অদ্ভুত মুগ্ধতায় ছেয়ে গেল গোটা শরীর। সুরা ফাতেহার শুরুতেই তাঁর সেই জলদগম্ভীর কণ্ঠের তিলাওয়াত যেন খোদা তায়ালার বিরাটত্বের সামনে আমাদের মানবিক ক্ষুদ্রতার নমুনা করে তোলে। প্রশংসা পেরিয়ে প্রার্থনার অংশে যেতে যেতে সুরটা কোমল হতে শুরু করে, বান্দার চাওয়ার কোমলতা, আকুলতা, বিষয়হীনতাকে সঙ্গে নিয়ে ফাতেহার শেষ শব্দটি উচ্চারিত হয়ে গেলে পরে মনে হয় আমার আর চাইবার কিছু নেই, বলবার কিছু নেই, সব কামনা উজার করে প্রার্থনার দাস্তান যেন তুলে ধরা হলো মহামহিমের দরবারে।

দ্বিতীয় দিনের সন্ধ্যায় মাওলানা রাহমাতুল বারী এলেন তাঁর সেই পুরনো আমলের ফিফটি সিসি হোন্ডাটায় চড়ে। এই একটি বাহন দেখলেই আমার চোখে ভাসে খুব রোদে ভেসে যাওয়া একটা একাকী সকাল, কোনো এক উপশহরের কুয়াশা কাঁধে করে কেউ ছুটে চলেছে কোথাও। এই অতীতমাখা দৃশ্যটি অমন একটা লাল মোটর সাইকেলের সঙ্গে জুড়ে যাওয়া একটু অদ্ভুত বৈকি। শীতকালের এশার নামাজ ঝটপট হয়ে যাওয়ায় রাতটা হয়ে ওঠে অস্বাভাবিক লম্বা, এই রাতগুলোতে আমরা কুরআন পড়া শিখি, নামাজ শেখাই, মাসআলা-মাসায়েলের হালাকা হয়। কোনো কোনো রাতে বাইরের কোনো আলেম এলে তিনি আমাদের নিয়ে কথা বলেন। আজ কথায় কথায় উঠল যাকাতের কথা, কাজা নামাজের কথা।

রাত দশটায় খেতে বসার আগ পর্যন্ত একটা নরমাল দিন কাটায় ওঠার পর আমাদের সেই রাতটা এমনভাবে বদলায় গেল, যেটা আমরা কেউই আশা করি নাই। সিরাজগঞ্জ সফরের শুরুতে আমরা ছিলাম পনেরোজন, সেখানে এক চাচা ছিলেন, লিভার সিরোসিসের রোগী। ডাক্তার যে সময় নির্ধারণ করে দিয়েছিলেন তার মেয়াদ দুই মাস পেরিয়ে যাওয়ার পর তিনি ভেবেছিলেন, একটু আল্লাহর রাস্তায় সময় দিয়ে আসা যাক। কিন্তু প্রথমদিনই তার লিভারের ব্যাথা চূড়ান্ত আকারে পৌঁছে গেলে পরে সেই রাতটি আমরা তিনজন হাসপাতালে কাটাই। শহিদ মনসুর আলি মেডিক্যাল কলেজ থেকে সেই চাচাকে বিদায় জানানোর সময় চিন্তা করতে পারিনি এই হাসপাতালে আমার আবার আসতে হবে।

অন্য সব দিনের মতো সব দেখেটেখে বিছানায় শরীরটা রাখলাম। সারাদিন নানান দিকে ব্যস্ত থাকার পর এই সময়টুকু একান্ত নিজের, একটু চিন্তাভাবনা, ডায়েরি লেখার মতো কাজগুলো এই সময়েই সারতে হয়। আর মাসখানেকের মধ্যেই চিল্লার সফর শেষ হয়ে আসছে, আগস্ট থেকে ডিসেম্বর, দীর্ঘ চার মাস বাড়ির বাইরে। সবকিছু কত পালটে গেছে, বাসায় একটা বিয়ের অনুষ্ঠান হয়েছে, আরেকটা হবে হবে করছে। জগতের সব আয়োজন থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে একটা নিরালা সফেদ যাত্রার শেষ পথটুক কেবল বাকি। এইসব নানা কথা ভাবতে ভাবতে কেউ একজন সজোরে মাথা নাড়িয়ে দিয়ে বলল, ‘আমির সাহেব, উঠেন একটু’।

লিভার সিরোসিসের চাচার বদলে সিরাজগঞ্জ থেকে আমাদের সঙ্গে যুক্ত হয়েছিলেন মোস্তফা ভাই। আসলে ভাই না বলে চাচা বলাই শ্রেয়, তার বড় ছেলের বয়স আমার চাইতে বেশি। হার্টের রোগী, ওপেন হার্ট সার্জারি হয়েছে বছর পেরিয়েছে বোধহয়, কিন্তু ডায়াবেটিসের সমস্যার কারণে শরীরটা ঠিক কাজ করে না। ভারী কোনো কাজ বা হাঁটাহাটি করা নিষেধ, কোথাও গেলে রিকশা-গাড়িই ভরসা। সেই মোস্তফা ভাই দেখলাম কাপড়চোপড় একটা ব্যাগে গুছিয়ে নিয়ে জামা পরছেন, কিন্তু আসলে নিজে থেকে করার মতো সাধ্য তখন তার নেই। প্রচণ্ড হাঁপাচ্ছেন, কপাল ঘর্মাক্ত। কোনোমতে বললেন, ‘আমাকে হাসপাতালে নিয়ে চলেন’। রাত বাজে বারোটা। কাকে ডাকব, আমি আর সালমান ভাই সজাগ, আরেকজনকে ডেকে মসজিদ আটকাতে বলে আমরা তিনজন বেরুলাম। রিকশা পাওয়া যাবে এখন? ৯৯৯ কল করে দেখব একটা? হাসপাতালটা শহরের অপর প্রান্তে, ছোট জেলা শহর সিরাজগঞ্জ, রিকশায় শহর পেরুতে মিনিট বিশেক লাগে। এই রাতে কেউ একজন ফিরলেন রিকশা করে, বিপদে খরকুটোও সই, রিকশা তো সে তুলনায় ঢের ভালো জিনিস।

যেকোনো পরিস্থিতিতেই এমন এমন ঘটনা ঘটে, মনে মনে কিংকর্তব্যবিমূঢ় হওয়া ছাড়া কোনো উপায় থাকে না। কেবল হৃদয়ের ডাকে সাড়া দিতে হয়। আমার মনে এক মুহূর্তের জন্য কী একটা জেগে ওঠায় মোস্তফা ভাইকে বললাম, ‘আপনার অবস্থা জানায় একটা ফোন করেন বাড়িতে। কাউরে আসতে বলেন।’ পাশ থেকে সালমান ভাই বললেন, ভাই, চিল্লায় থেকে স্ত্রীর সাথে দেখা করলে চিল্লাটা নষ্ট হয়ে যাবে না! আমি কোনো মতো নিজেকে সামলালাম, কী বলব।

পরের একটা ঘণ্টা কীসের বেগে কাটল আমার জানা নেই। সিসিইউ ইউনিটে সারিসারি রোগী, মোস্তফা ভাইকে কেবল প্রাইমারি কিছু ইনজেকশন দেয়া হয়েছে। একটা ওষুধ গ্যাসের সাথে নিতে বলা হয়েছে, সেটা মুখে ধরে আছি আমি। এর আগ পর্যন্ত কালিমা পড়ছিলেন, পরে থেকে থেকে কেবল হাত তুলে দোয়ার ভঙ্গিটা টের পাচ্ছিলাম। শরীর ঘামছে, হাত পা ঠান্ডা হয়ে আসছে। তার ভাই আসলেন, ছেলে আসলেন, স্ত্রী এসেই ছুটে চলে গেলেন বাবার বাড়ি। এত করে বোঝালাম, আপনি মানুষটার পাশে থাকেন, কে শোনে কার কথা। ডিসপ্লেতে অক্সিজেনের পার্সেন্টেজ উঠছে, হার্টবিটের ওঠানামা দেখতে দেখতে আমি সুরা ইয়াসিন পড়া শুরু করলাম। তার ভাই কানের কাছে মুখ নিয়ে কালিমা পড়ছেন, আমি এক মুবিন পেরিয়ে দ্বিতীয় মুবিনের দিকে এগুচ্ছি। হঠাৎ একটা চিৎকার, তার ছোট ভাই জোরে জোরে কালিমা পড়লেন দুবার। তার পর সব শেষ। এতক্ষণ উঁচু হয়ে থাকা ঘাড়টা নেমে এসেছে। পৃথিবীর সফর শেষ হয়ে গেল আরেকজন মানুষের।

ছেলেরা আসছে, স্ত্রী এসে পাশে বসে ডাকছেন ‘কী হইছে তোমার, আমারে শুনতে পাইতেছ?’ ইসিজি করা হচ্ছে, কেউ একজন একটা সাদাকাপড় দিয়ে ঢেকে দিচ্ছেন, এম্বুলেন্সের ড্রাইভার এসে দাঁড়িয়ে আছেন। এইসব টুকরা টুকরা দৃশ্য থেকে বিযুক্ত হয়ে আমি আর সালমান ভাই বসে আছে সিসিইউয়ের বাইরের একটা চেয়ারে। জানি না কী এক অবোধ্য অপরাধবোধ ছেয়ে ফেলল আমায়, কেবলি মনে হতে লাগল, আমার জিম্মাদারিতে আসা এই জামাতের সব কিছুর দায়ভার আমার। আমারই পাপের কারণে আমরা একের পর এক বিপদে আটকে পড়ছি।

অন্য হাসপাতালে নেয়ার জন্য এম্বুলেন্স তৈরিই ছিল, সেটাই এবার চলল তার বাড়ির দিকে। অল্প ক’দিনের পরিচয়—এক সপ্তাহ পেরিয়েছিল কেবল—কিন্তু মনে হতে লাগল কতদিনের পুরনো বন্ধুর চিরবিদায় ঘটে গেল আজকে। রাত আড়াইটার দিকে রিকশায় মসজিদের ফেরার রাস্তাটা আমার স্মৃতিতে এক অসীম শূন্যের পানে যাত্রার মতো দীর্ঘ হয়ে উঠল। পুরনো স্টেশন, সারি সারি রেললাইন, মিটমিটে সাদা স্ট্রীটলাইট, মনের তাৎক্ষণিক অবস্থা, সব মিলে সে এক অব্যক্ত অনুভূতি। এই মানুষের জীবন, দীর্ঘ পঞ্চাশ বছর সঙ্গে থাকা রুহ এই ভাবে দেহ ছেড়ে তার আলায়ে ইল্লিয়িনের পানে যাত্রা করে। যে জগতে সে ছিল, সেখানেই সে ফেরত যায়, মাঝের এই কটা সময়ে বেঁচে থাকবার জন্য যতো আয়োজন, লড়াই, আনন্দ, বেদনা।

মসজিদে ফিরে এসে দেখলাম একজন তাহাজ্জুদে দাঁড়িয়ে গেছে, শান্ত সমাহিত ভঙ্গিতে নামাজ পড়ছেন। তিনি জানেনও না সারাটা রাত আমরা কোথায় কাটিয়ে এলাম। খুব সম্ভাবনা আছে এই মুহূর্তে আমাদের বাইরে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে তিনি ভয়ানক চমকে উঠবেন। জানলা দিয়ে দেখা যাচ্ছে, মোস্তফা ভাইয়ের বিছানাটা পাতা।

আমার থেকে থেকে মনে পড়ে যায় মাওলানা রাহমাতুল বারীর শোনানো ইন্দোনেশিয় বৃদ্ধের কথা। আশেপাশের কোন এক কবরস্থানে শুয়ে থেকে যিনি স্বপ্নে দেখা দিয়েছিলেন পরিবারের সদস্যদের কাছে। আলোময় এক বাগানে হেঁটে বেড়ানোর দৃশ্য দেখে পরের বছর যিয়ারতে এসেছিল পরিবারের সদস্যরা। রাতের এইসব কারগুযারির সময়টায় চারপাশ যেন ঘন হয়ে ওঠে, এরপর একসময় দূর থেকে ভেসে আসে রাতের ট্রেনের হুইসেল। সময় হয়ে গেছে, দুয়ারে দাঁড়ায়ে গাড়ি, বেলা দ্বিপ্রহর…

যে যায়, সে যায়। মানুষ স্মৃতি আঁকড়ে ধরে বেঁচে থাকে বটে, কিন্তু যে পরিস্থিতির ভেতর দিয়ে সে যায়, সেটা আর কখনোই ফেরত আসে না। আজ ঠিক একবছর পরে এই লেখা যখন লিখছি, তখন সেই অভিজ্ঞতার ভেতর দিয়ে গেছি তার পুনরাবৃত্তি ঘটেনি, ঘটনাগুলো মনে পড়ছে কেবল। কিন্তু এই অভিজ্ঞতাটুকু, মনে পড়াটুকু ফেলনা নয়। আজ যখন গভীর কোন বেদনায় ছেয়ে যায় মন, লোভ, রাগ হতাশার মুহূর্তে নিজের সঙ্গে একা হলে পরে চোখে ভেসে ওঠে মোস্তফা ভাইয়ের সেই এলিয়ে থাকা মুখ, মানুষের গন্তব্য সেই পর্যন্ত। আজ হোক, কাল হোক সেই নীল, বরফের মত হিম মৃত্যুর পরশ সে পাবেই। কুল্লু নাফসিন যা-ইকাতিল মাউত।

বিজ্ঞাপন

Subscribe
Notify of
guest
3 Comments
Oldest
Newest Most Voted
Inline Feedbacks
View all comments
saad naseem
saad naseem
1 year ago

🙂

জুনাইদ বিন আজিজ
জুনাইদ বিন আজিজ
1 year ago

যেনো চোখের সামনে স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছিলাম প্রতিটা চিত্র। আমিও কিছুটা স্মৃতিকাতর হয়ে উঠলাম। শুকরিয়া।

সাদ আহমাদ
সাদ আহমাদ
1 year ago

marhaba

স্বত্ব © ২০২৩, যোগাযোগ | ই মেইল : jogajogbd.org@gmail.com

যোগাযোগ-এ প্রকাশিত কোনো লেখা, ছবি কিংবা শিল্পকর্ম লেখক অথবা কর্তৃপক্ষের অনুমতি ছাড়া কোথাও প্রকাশ করা অবৈধ৷