বই : কারফিউড নাইট
লেখক : বাশারাত পীর
অনুবাদক : আনোয়ার হোসেইন মঞ্জু
প্রকাশক : প্রচ্ছদ প্রকাশন
প্রকাশকাল : ডিসেম্বর, ২০১৯
‘কী বলতে পারি আমি? কারো মা বাবা যখন প্রায় মৃতদের মধ্যে শামিল হতে যাচ্ছিলো, তখন তার কী বলার থাকতে পারে? আমি কোনো কিছু বলিনি।’
কারফিউড নাইট বইটি দ্বিতীয়বার যখন আমি পড়লাম তখন ঠিক প্রথমবারের মতোই ৮৬ নম্বর পৃষ্ঠার এই লাইনগুলোতে এসে থমকে গেলাম। গলার ভেতর কিছু একটা আটকে থাকার মতো অনুভূতি হলো। কী সেটা? কান্না, ক্ষোভ, বেদনা না অন্যকিছু? আমি ঠিক ধরতে পারছি না। শুধু টের পেলাম চোখের কোণ ভিজে যাচ্ছে। আমি কি কান্না করছি? জানি না।
বাশারাত পীরের মা-বাবা এক মাইন বিস্ফোরণের শিকার হলে তার ভাষ্যে তখনকার অনুভূতি পড়ার পর আমার নিজেকে তার জায়গায় দেখতে ইচ্ছে করে না। অনিচ্ছাসত্ত্বেও দেখে ফেলি কাশ্মীরের জনপদে আমিও মিশে গেছি।
দিঘির নিটোল জলের মতো আমার শান্ত চারপাশ আচমকাই বারুদের গন্ধে ভরে উঠেছে। এ যেন অন্যরকম সকাল, যাপিত জীবনের অন্য এক রূপ। আমি কেমন অস্থির হয়ে পড়ি। বিদ্রোহী হয়ে উঠে আমার সত্ত্বা। আমার বুকে বাজতে থাকে সেই অমোঘ আকর্ষণের নিনাদ—স্বাধীনতার জন্য শাহাদাত বরণের আকাঙ্ক্ষা কিশোরীর ঠোঁটে প্রথম চুম্বনের আকাঙ্ক্ষার মতো।
কাশ্মীর। পৃথিবীর স্বর্গ খ্যাত এই দেশটির প্রতি আমার আশৈশব প্রেম। কাশ্মীরীদের জীবনযাপন, ইতিহাস, ঐতিহ্য বরাবরই আমাকে টানে। জীবনের অসংখ্য ছোট স্বপ্নগুলো থেকে একটি কাশ্মীরের মাটিতে পা রাখা। সেই কাশ্মীরের সৌন্দর্যের চমৎকার বিবরণ দিয়ে লেখক বইখানা শুরু করেছেন। তার ভাষ্য এমন—
এক শীতকালে কাশ্মীরে আমার জন্ম। আমার গ্রাম পর্বতের পাদদেশে দক্ষিণাঞ্চলীয় অনন্তনাগ জেলায়। যেখানে মাটি ও ইটের তৈরি গুচ্ছ বাড়িঘরের চারপাশ ঘিরে গ্রীষ্মের শুরুর সবুজ ধানক্ষেতগুলো শরতে সোনালি রং ধারণ করে। শীতকালে আমাদের ছাদ থেকে সশব্দে তুষার গড়িয়ে পড়ে বাগানে। ছোট ভাই ওয়াজহাত ও আমি মিলে তুষারমানব তৈরি করি এবং কয়লার টুকরা বসিয়ে দিই তুষারমানবের চোখে।
নিঃসন্দেহে তুষারপাত পৃথিবীর সবচেয়ে সুন্দর দৃশ্যগুলোর একটি। গ্রীষ্মকালীন কাশ্মীরের সবুজাভ উপত্যকা আর শীতকালীন তুষারপাতের বিবরণ পড়ে পাঠকমন মাত্রই সৌন্দর্যের হাওয়ায় আন্দোলিত হবে। কিন্তু সেই সবুজকে গ্রেনেড আর বুলেটের আঘাতে ধূসর রং ধারণ করতে দেখা কিংবা তুষারের সাদা বুক রক্তের রঙে লাল হতে দেখা কোনো সুখকর দৃশ্য নয়। লেখক এইসব করুণ দৃশ্যের দিকেই পাঠককে ধীরে ধীরে টেনে নিয়ে যান। বিষাদের দিকে যাওয়ার জন্য কেউ অমন আগ্রহ সৃষ্টি করতে পারে তা আমার জানা ছিলো না। কয়েকপাতা সৌন্দর্যের ঘোরে কাটানোর পর ধীরে ধীরে শুরু হয় স্বর্গের মতো একটা দেশকে কী করে ধ্বংসের দিকে ঠেলে দেওয়া যায় লেখকের চোখে পাঠককে তা দেখানো। বইয়ের গভীরে যেতে যেতে পাঠক দেখবেন, ভূস্বর্গ খ্যাত কাশ্মীর বছরের পর বছর ধরে কী করে জ্বলেপুড়ে খাক হয়ে যাচ্ছে ভারতীয় হানাদারদের জ্বালানো আগুনে। একটা প্রজন্মের প্রথম যুদ্ধের শুরু থেকে শেষ দেখার অনুভূতি পড়তে পড়তে চোখ ভিজে যায়। পাতায় পাতায় মন স্থবির হয়ে পড়ে থাকে। আশেপাশের মানুষজন যারা যাপিত জীবনের নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিসের মতোই সারাক্ষণ চোখের সামনে থাকে কিংবা ক্লাসরুম থেকে সহপাঠীদের হঠাৎ করেই হারিয়ে যেতে দেখাটা কি আসলেই বলে বুঝানোর মতো? নিজেকে সেই জায়গায় দাঁড় করালে তার কিছুটা হয়তো অনুভব করা যায়। স্বদেশকে অন্যের হতে দেখার দুঃখটাও তো ব্যক্ত করার ভাষা কারোর জানা থাকে না। এ এমন এক ব্যথা যা বর্ণনার ভাষা নেই, সহ্য করার ক্ষমতা নেই।

লেখক বাশারাত পীর এবং অনুবাদক আনোয়ার হোসেইন মঞ্জু
অন্যান্য কাশ্মীরীদের মতো লেখক বাশারাত পীরকে নিয়েও তার পরিবারের আজন্ম ইচ্ছা ছিলো তিনি ‘ইন্ডিয়ান অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ সার্ভিস’-এ যোগ দেবেন। কিন্তু যখন যুদ্ধ শুরু হলো লেখক দেখলেন তিনি যেন এক ঝটকায় তার লক্ষ্য থেকে সরে গেছেন। তার ভাষ্যমতে সেদিনটা ছিল এমন—
বেকার গ্রাজুয়েট, যিনি গ্রামের ক্রিকেট ম্যাচের জন্য নিজেকে ইংরেজি ধারাভাষ্যকার হিসেবে নিয়োগ দিয়েছেন: সালাফি পুনর্জাগরণবাদী, যিনি প্লাস্টিকের জিনিসপত্র বিক্রয় করেন; স্টালিনের মতো গোঁফধারী ঝুড়ি নির্মাতা কমিউনিস্ট—সবাই মিছিলে যোগ দিয়ে স্বাধীনতার স্লোগান দিচ্ছে। জনতার ভিড় একাকার হয়ে গেছে, গায়ে গায়ে লাগছে, পরস্পরের হাত ধরে আছে, তাদের চোখে মুখে নিশ্চিত দৃঢ়তা, হাজারো কণ্ঠে ধ্বনি উচ্চারিত হচ্ছে।
আমার যে লাজুকতা ছিল তা আর নেই, পড়ুয়া যে ছেলের ওপর পরিবারের আকাঙ্ক্ষা তাও বোধহয় শেষ হয়ে গেছে। বকুনি খাওয়ার ভয় আমার মাঝে নেই। আমি নিজেকে বড়ো কিছুর অংশ বলে অনুভব করছি, আমার অজান্তেই ‘আমি’ থেকে ‘আমরা’র পথে যাত্রা শুরু করেছি। আমি নিজেকে ভাসিয়ে দিয়েছি, জনতার সাথে উড়ে চলেছি। ‘আজাদি!’ পুরো শীতকাল জুড়ে প্রায় প্রতিটি কাশ্মীরি এক একজন ফরহাদে পরিণত হয়েছে। শিরিনের সাথে মিলিত হওয়ার জন্য প্রত্যেকে পর্বত খুঁড়ে দুধের নহর তৈরি করতে প্রস্তুত।
সেদিন থেকেই হয়তো তার জীবনের লক্ষ্য পাল্টে গিয়েছিল। একজন সিভিল সার্ভিস হওয়ার জার্নি থেকে সরে গিয়ে তিনি কাশ্মীরের জন্য জান উৎসর্গ করতে প্রস্তুত হচ্ছিলেন। গেরিলাদের দলে যোগ দেওয়ার ইচ্ছা থাকলেও দাদা, মায়ের চোখের অশ্রু এবং বাবার উৎকণ্ঠা তাকে সে পথ বেছে নিতে বাধা দেয়। কিন্তু কাশ্মীরের জন্য তার আত্মার টান তাকে কিছু একটা করতে হবে এই অনুভূতি এনে দেয়। সেই তাড়না থেকেই তিনি পরিবারের কথায় সিভিল সার্ভিসে ভর্তি হলেও পাশাপাশি সাংবাদিকতার প্রস্তুতি নিতে থাকেন। পরবর্তীতে তিনি কাশ্মীরের করুণ উপাখ্যান বিশ্ববাসীকে জানানোর তাড়না থেকে কাশ্মীরে সাংবাদিক হয়ে ফিরে আসেন। ততদিনে কাশ্মীরের চেহারা বদলে গেছে। সবুজাভ উপত্যকাগুলো পরিণত হয়েছে ধূসর শূন্য মাঠে। যুদ্ধে শত শত তরুণ শহিদ হয়েছে। কাশ্মীরের অলিগলিতে ভারতীয় সৈন্য কর্তৃক ধর্ষিতা, নির্যাতিতা নারীদের সংখ্যা অগণিত হয়ে উঠেছে। বিয়ের যাত্রা থেকে কনে মুবিনা গনিকে তুলে নিয়ে দলবদ্ধভাবে ধর্ষণ করার সেই নির্মমতার কাহিনি লেখক বারবার লিখতে যেয়েও ব্যর্থ হচ্ছিলেন। কাশ্মীরি কবি ফারুক নাজাকির কবিতা বলে তখনকার পরিস্থিতি ছিল এমন—
মায়েরা ঝর্ণার তীরে বরদের রক্তমাখা
জামাকাপড় ধুয়ে দেন,
বিয়ের পোশাক পুড়ে ছাই হয়
কনের সঙ্গিনীরা কাঁদে, এবং
ঝিলাম নদীর পানি বয়ে চলে।
পরবর্তীতে মুবিনা গনির জীবন কীরকম দুর্বিষহ হয়ে উঠেছিল তা ভাষায় প্রকাশ করার মতো না। সে গল্প বহুকষ্টে লেখক লিখে শেষ করেছিলেন বটে। কিন্তু সে গল্প পড়তে গেলে অক্ষরে অক্ষরে কেবলই অশ্রু ঝরে।
এইসব অশ্রুসিক্ত উপাখ্যান কেবল এক দুটো নয়—কাশ্মীরের উপত্যকাগুলোতে এত সংখ্যক গাছও নেই যত সংখ্যক লোক ভারতীয় বাহিনীর নৃশংসতার শিকার হয়েছে। বিরাট এক কবরস্থান যেখানকার অধিকাংশ ফলকে লেখা ছিল মৃতের বয়স ১৬-২৪। যে ফলকগুলো এ কথা প্রমাণ করে যায় যে, একটা প্রজন্মকে পুরো খোঁড়া করে দেওয়ায় ভারতীয় বাহিনীর অবদান অপরিসীম। আমরা বাইরে থেকে সৌন্দর্যের লীলাভূমি, ভূস্বর্গ কাশ্মীর দেখে মুগ্ধ হই, বিমোহিত হয়ে থাকি কিন্তু সেসব সৌন্দর্য নিয়ে দুইদেশের রাজনীতির খেলার গুটি হয়ে—জীবনমৃত্যুর অনিশ্চয়তায় দিন গুজরান করতে থাকা একটা পুরো জাতির হৃদয়ের আর্তনাদ কখনোই শুনিনি। শুনতে চাইনি পর্যন্ত। অথচ বিগত সত্তুরটি বছর ধরে সেসব মানুষ কীসব দিন পার করছে। সকালের সূর্য কিংবা রাতের আঁধার তাদের জন্য না জানি কীরকম ভয়াবহতা বয়ে আনছে সে আশঙ্কায় তাদের দিন শেষ হয় রাত পোহায়। সেসব যন্ত্রণা উপলব্ধি করার সাধ্য আসলে আমাদের নেই। লেখক বাশারাত পীর কাশ্মীরীদের নিত্য যাতনার সমস্তটুকুর রস নিংড়ে তার সামান্যই তুলে ধরেছেন কারফিউড নাইট বইটিতে। একটা জালিম জাতির সত্তুর বছরের নির্মমতার সম্পূর্ণ ইতিহাস লিখতে গেলে তিন যুগেও তা শেষ হবার কথা নয়। মূলত তিনযুগ ধরে বলার মতো কাহিনির সারকথা বইটিতে তুলে আনা হয়েছে। বইটি পড়তে গিয়ে পাঠকের কান্না আটকে রাখার ব্যাপারটা সত্যিই বেশ কঠিন। সবকিছুর পরেও বইটি পাঠককে ধরে রাখে কারণ তাতে কান্না, বেদনার পাশাপাশি বলা হয়েছে কাশ্মীরীদের হাসি, আনন্দের গল্পও। লেখকের মনকাড়া বলার ভঙ্গি পাঠককে নিয়ে যায় কাশ্মীরী জনপদে। মনোরম আপেল বাগান আর ঝর্ণার পাড়ে। অপরূপ সৌন্দর্যের সম্মুখে দাঁড় করিয়ে লেখক পাঠকের চোখে ধরিয়ে দেন এই মনকাড়া দৃশ্যগুলোর ফাঁকে ফাঁকে লুকিয়ে থাকা নির্মমতার দুঃসহ স্মৃতিগুলোকে। আমি হয়তো কাশ্মীর দেখতে যাবো একদিন, ঝিলাম নদীর পানিতে আঁজলা তুলে অজু করতে করতে, উপত্যকাগুলোর মনোরম সবুজের সৌন্দর্যে হারিয়ে যেতে যেতে কিংবা তুষারপাত দেখতে দেখতে—আমার চোখে যেন সেদিন সবকিছু ছাপিয়ে বিমূর্ত হয়ে উঠে ভারতীয় বাহিনির নৃশংসতার দৃশ্যগুলো। সৌন্দর্য দেখে কেবলই উল্লাস নয়; আমার চোখের পানিতেও যেন সিক্ত হয় কাশ্মীরী জনতার রক্তস্নাত সেই ভূমি।

মূল ইংরেজি বইয়ের প্রচ্ছদ
বইটা হাতের কাছে থাকা সত্বেও বই সম্পর্কে তেমন কিছু জানি না বলে পড়া হচ্ছিল না এতোদিন। আলোচনাটা সুন্দর ছিল। বইটা পড়ার আগ্রহ জন্মেছে।