ছোট বেলা থেকেই টুকটাক বইটই পড়লেও উর্দু জামাতের বছর থেকেই তা যেন এক নতুন জীবন পায়। আমার এত অতিরিক্ত বই পড়া দেখে তাইসির জামায়াতের এক বড় ভাই একদিন আমাকে বললেন, “তোকে একটা উপন্যাস দেই, পড়ে দেখ, আশা করি অনেক ভালো লাগবে ।” আমি বললাম “আচ্ছা ঠিক আছে, দিয়েন।” তখনই তিনি এসে পাঁচটি বই দিয়ে গেলেন।
বইয়ের নাম ‘আধার রাতের বন্দিনী’। মোট ৫ খণ্ড। বইগুলো দিয়ে যাওয়ার পর পরই পড়া শুরু করে দিলাম। ঐ সময় আমার বয়স মাত্র ১২ বছর। বাংলাদেশের সাধারণ পাঠকশ্রেণির মতো আমারও ইসলামী ঐতিহাসিক উপন্যাসের ব্যাপারে অনেক বেশি আগ্রহ ও পজেটিভ ধারণা ছিল।
আমি ভাবতাম, ঐতিহাসিক উপন্যাসে ইতিহাস ঠিক রেখে গল্পের প্রয়োজনে কিছু বিষয় বাড়ানো হয়ে থাকে। তবে কিছুটা শিক্ষিত হওয়ার পর এখন বুঝতে পারছি যে, আমার চিন্তাভাবনা কতটা গলত ছিল। মাদ্রাসার ছাত্রদের কাছে তুমুল জনপ্রিয়, সেইসাথে অনেকের কাছেই সঠিক ইতিহাসের বই হিসেবে সমাদৃত, আঁধার রাতের বন্দিনী বইয়ে থাকা কিছু মারাত্মক ভুল নিয়ে কথা বলব।
লেখক বলেছেন : কামাল পাশা ছিলেন বিখ্যাত আলেম আনোয়ার পাশার ডান হাত। তৎকালীন অধিকাংশ আলেম কমিউনিজম গ্রহণ করে নেওয়ার পর, আনোয়ার পাশাই একমাত্র আলেম যিনি অস্ত্র হাতে তুলে নিয়েছিলেন। কিন্তু পরবর্তী সময়ে কামাল পাশাও কমিউনিজম গ্রহণ করে আনোয়ার পাশার সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করে বসে। আর বিনিময়ে লেনিন সরকার কামাল পাশাকে তুরস্ক দেশটি উপহার হিসেবে দেয়।
বর্তমান সময়ে এ কথাগুলো মনে হলেই আমার হাসি পায় । কামাল পাশার ব্যাপারে প্রায় সবারই কিছুটা হলেও ধারণা আছে। কিন্তু লেখকের ভাষ্যমতে তার ‘উস্তাদ’ আনোয়ার পাশার ব্যাপারে একটু জেনে নেওয়া যাক।
আনোয়ার পাশা ছিলেন প্যান তুর্কিজমের প্রবক্তা, উসমানীয় সাম্রাজ্যের পতনের পিছনে দায়ী শক্তিশালী তিন পাশার একজন। সেইসাথে তিনি ছিলেন উসমানীয় রাজপরিবারের জামাই। সুলতান আবদুল হামিদ খানের ভাই শাহজাদা সেলিম সুলাইমানের কন্যা নাজিমে সুলতানা ছিলেন তার স্ত্রী। চিন্তাধারায় তিনি ছিলেন কট্টর তুর্কি জাতীয়তাবাদী, সেক্যুলার ইসলামিস্ট।
এই মানুষটার জেদের কারণেই উসমানীয় সাম্রাজ্য বিশ্বযুদ্ধে অংশগ্রহণ করে এবং শেষমেষ নিজের সর্বস্ব হারিয়ে নিঃস্ব হওয়ার প্রাক্কালে উসমানী সাম্রাজ্য ১৯১৮ সালের অক্টোবরে লজ্জাজনক মুদ্রোস চুক্তিতে সাইন করে । ১৯১৮ সালের ৪ নভেম্বর আনোয়ার পাশা সাবমেরিন দিয়ে জার্মানিতে পালিয়ে যান। তার পলায়নের পর উসমানীয় পার্লামেন্ট আনুষ্ঠানিকভাবে তার বিরুদ্ধে তদন্ত শুরু করে।
আর এদিকে তিনি জার্মানির বার্লিনে বসে নতুন একটি প্যান-তুর্কি বিপ্লবের ব্যাপারে ভাবতে থাকেন। বলকান ও মধ্য এশিয়ার মুসলিমদের নিয়ে একটি বৃহৎ তুর্কি রাষ্ট্রের স্বপ্ন দেখতে থাকেন। ১৯১৯ সালের শুরুর দিকে বার্লিন থেকেই এনভার পাশা জার্মান ও বলশেভিক বিপ্লবীদের সঙ্গে যোগাযোগ করেন। তিনি গোপনে তুর্কিস্তান (বর্তমান উজবেকিস্তান/তাজিকিস্তান) অঞ্চলে সোভিয়েত বিরোধী মুসলিম বিদ্রোহীদের সমর্থন দিতে শুরু করেন।
১৯১৯ সালে আনোয়ার পাশা সোভিয়েত রাশিয়ার সঙ্গে যোগাযোগ বাড়িয়ে দেন, কারণ তিনি চাইছিলেন বলশেভিকদের সঙ্গে আপস করে তুর্কিস্তানে প্রবেশ করতে। তিনি নিজেকে বলশেভিক-সমর্থক হিসেবেও প্রচার করেন। তিনি সোভিয়েত গোয়েন্দা সংস্থাকে (চেকা) বোঝানোর চেষ্টা করেন যে, তার তুর্কিস্তান মিশন মূলত বৃটিশ উপনিবেশবাদবিরোধী। কিন্তু তিনি তখনো পুরোপুরি বলশেভিকদের আস্থা অর্জন করতে পারেননি।
১৯১৯ সালের শেষদিকে আনোয়ার পাশা মধ্য এশিয়ায় প্রবেশের প্রস্তুতি নিতে থাকেন। এসময় তিনি নিজের ‘ইসলামী বিপ্লব’ ও ‘প্যান-তুর্কি’ স্বপ্ন বাস্তবায়নের লক্ষ্যে পরিকল্পনা সাজাতে থাকেন। ১৯২০ সালের শুরুতে প্রথমে তিনি আনাতোলিয়ায় ব্রিটিশবিরোধী যুদ্ধরত তুর্কি জাতীয়তাবাদী (মুস্তাফা কামাল যাদের নেতৃত্বে ছিলেন) ও জার্মান বিপ্লবীদের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করেন। কিন্তু কামাল পাশা ছিলেন ধর্ম ও খেলাফতের চেয়ে আধুনিক, ধর্মনিরপেক্ষ জাতীয়তাবাদে বিশ্বাসী। সুতরাং উভয়ের দৃষ্টিভঙ্গি ভিন্ন হওয়ার কারণে তার উদ্দেশ্য সফল হয়নি। ফলে তিনি ইউরোপ ছেড়ে রাশিয়ার বলশেভিক (কমিউনিস্ট) সরকারের সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপন করেন।
তিনি মুসলিম বিশ্বজুড়ে সাম্রাজ্যবাদবিরোধী বিদ্রোহের পরিকল্পনা করেছিলেন এবং তুর্কিস্তানকে (উজবেকিস্তান, তাজিকিস্তান, ইত্যাদি) এর মূল কেন্দ্র হিসেবে গড়ে তোলার প্ল্যান করেন। আনোয়ার পাশার প্ল্যান ছিল, বলশেভিকদের সঙ্গে সমঝোতা করে মধ্য এশিয়ার মুসলিমদের একত্রিত করে একটি স্বাধীন ইসলামী প্যান-তুর্কি সাম্রাজ্য গড়ে তোলা।
১৯২০ সালের মার্চ মাসে মিত্রবাহিনী সম্পূর্ণভাবে ইস্তাম্বুল দখল করে নেয়। এর ফলে কামাল পাশার নেতৃত্বে তুরস্কে জাতীয়তাবাদী আন্দোলন আরও তীব্র থেকে তীব্রতর হয়ে উঠে । ঐদিকে আনোয়ার পাশা বার্লিন থেকে সোভিয়েত রাশিয়ার সঙ্গে যোগাযোগ চালিয়ে যেতে থাকেন। বলশেভিকদের সমর্থন পেতে তিনি নিজেকে ‘সাম্রাজ্যবাদবিরোধী’ হিসেবে উপস্থাপন করতে থাকেন।
১৯২০ সালের মে মাসে আনোয়ার পাশা মস্কো পৌঁছে লেনিন, ট্রটস্কি ও চিচেরিন প্রমুখ বলশেভিক নেতাদের সঙ্গে গোপন বৈঠক শুরু করেন। তিনি সোভিয়েত কমিউনিস্টদের বোঝাতে চেষ্টা করেন যে, মুসলিমদের বিপ্লবী শক্তি ব্যবহার করে ব্রিটিশ ও ইউরোপীয় উপনিবেশবাদীদের বিরুদ্ধে যৌথ ফ্রন্ট গঠন করা সম্ভব।
এসময়ে আনোয়ার পাশা নতুন একটি মুসলিম লিগ গঠনের পরিকল্পনা করেন, যেখানে ভারত, ইরান, আফগানিস্তান, তুর্কিস্তান, এবং আরব অঞ্চলের মুসলমানগণ একত্রে ব্রিটিশ ও ফরাসি উপনিবেশবাদের বিরুদ্ধে জোটবদ্ধ হবে।
এর কিছুদিন পরেই আনোয়ার পাশা সোভিয়েত প্রতিনিধিদের কাছ থেকে মধ্য এশিয়ায় প্রবেশের অনুমতি চেয়ে বসেন। তিনি “বাকু কংগ্রেস অব দ্য পিপলস অফ দ্য ইস্ট” (সেপ্টেম্বরে অনুষ্ঠিতব্য) উপলক্ষ্যে সোভিয়েত সহায়তায় মুসলিম নেতাদের একত্র করতে চাইছিলেন।
১৯২০ সালের ১-৮ সেপ্টেম্বর বাকুতে অনুষ্ঠিত Congress of the Peoples of the East-এ আনোয়ার পাশা প্রধান অতিথি হিসেবে থাকলেও, শেষপর্যন্ত স্বশরীরে উপস্থিত হতে পারেননি। তবে সম্মেলনে তার যথেষ্ট প্রভাব লক্ষ করা গিয়েছিল।
উল্লেখ্য, এটি ছিল বলশেভিকদের উদ্যোগে আয়োজিত একটি বিশ্বব্যাপী উপনিবেশবিরোধী সম্মেলন, যেখানে মুসলিম, এশিয়ান, ও আফ্রিকান প্রতিনিধিরা যোগ দেয়। আনোয়ার পাশার নামও সেখানে উচ্চারিত হয়, তবে তখনো তিনি নিজে সম্পূর্ণরূপে বলশেভিকদের আস্থাভাজন হয়ে উঠতে পারেননি।
আনোয়ার পাশা বলশেভিকদের ধোঁকা দিয়ে তুর্কিস্থানে নতুন সাম্রাজ্য গড়ে তোলার পরিকল্পনা করলেও, বলশেভিকদের পরিকল্পনা ছিল, আনোয়ার পাশাকে ব্যবহার করে মধ্য এশিয়া থেকে ব্রিটিশ প্রভাব দূর করা। অর্থাৎ এ ক্ষেত্রে আনোয়ার পাশাকে একটি মোহরভুক্ত হাতিয়ার হিসেবে ইউজ করা।
আনোয়ার পাশা বলশেভিকদের প্রস্তাব দেন যে, তিনি মুসলিমবিশ্বের নেতৃত্ব নিতে পারেন যদি সোভিয়েত সরকার সামরিক ও আর্থিক সহায়তা দেয়। কিন্তু স্পাই নেটওয়ার্কের মাধ্যমে বলশেভিক সরকার আনোয়ার পাশার গোপন চালের ব্যাপারে জেনে যায়। তাই বলশেভিক নেতৃবৃন্দ আনোয়ার পাশাকে উপেক্ষা করে কামাল পাশার সাথে সখ্যতা স্থাপন করে।
১৯২১ সালের জুন-জুলাইয়ের দিকে বলশেভিকরা কামাল পাশাকে অর্থ ও সামরিক সাহায্য পাঠায়। যার মধ্যে ছিল, প্রায় ১০ লাখ রুবল নগদ অর্থ, বিপুল পরিমাণ রাইফেল, মেশিনগান, আর্টিলারি, গুলাবারুদ ও সীমান্তের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে কূটনৈতিক সহযোগিতা।
এইসব সহায়তা কামাল পাশার জন্য ছিল গেম-চেঞ্জার। যা যুদ্ধের মোড় ঘুরিয়ে দেওয়ার পাশাপাশি তাকে একটি সুসংগঠিত প্রতিরোধ গড়ে তোলার সুযোগ এনে দেয়।
বলশেভিক নেতৃবৃন্দের কাছ থেকে প্রত্যাখ্যাত হয়ে কিছুদিন আনোয়ার পাশা মস্কোতেই অবস্থান করেন এবং মুসলিমবিশ্বের জন্য একটি বিপ্লবী প্ল্যাটফর্ম তৈরি করার চেষ্টা চালিয়ে যেতে থাকেন। তিনি ‘ইস্টার্ন পলিসি’ নিয়েও আলোচনা চালান, যেখানে রাশিয়ার মুসলিমরাও অংশ নিয়েছিল। ১৯২০ সালের আগস্ট মাসে আনোয়ার পাশা প্রথমবারের মতো বাসমাচি আন্দোলনের নেতা করিম বেক ও অন্যান্য বিদ্রোহী নেতাদের সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপন করেন। তার উদ্দেশ্য ছিল, ব্রিটিশ ও সোভিয়েত উভয় শক্তির বিরুদ্ধে তুর্কিস্তানে একটি ইসলামি বিদ্রোহ সংগঠিত করা।
এ উদ্দেশ্যে তিনি নিজের নাম পরিবর্তন করে ‘হাজি বেগ’ ছদ্মনামে কাজ শুরু করেন এবং দ্রুত বিদ্রোহীদের মধ্যে গ্রহণযোগ্যতা অর্জন করে নিতে সক্ষম হন।
তবে বলশেভিকরা তাঁকে থামাতে দৃঢ় প্রতিজ্ঞ ছিল। কারণ তারা বুঝতে পেরেছিল, আনোয়ার পাশা মুসলিম দুনিয়ার জন্য আবারও একটি বিপ্লবী হুমকি হয়ে উঠতে পারেন। অবশেষে ১৯২২ সালের ৪ আগস্ট, তাজিকিস্তানের বালজুয়ান অঞ্চলে একটি রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ চলার সময় লাল সেনা (Red Army) আনোয়ার পাশাকে ঘিরে ফেলে।
অস্ত্র সমর্পণ না করে, তিনি বরং সাহসিকতার সাথে লড়াই করেন, কিন্তু শেষ পর্যায়ে একটি গুলি তার হৃদয়ে বিদ্ধ হয় এবং তিনি শহিদ হন। তখন তাঁর বয়স ছিল মাত্র ৪০ বছর। এইভাবেই শেষ হয়ে যায়, এই পাগলাটে বিপ্লবী, সাহসী, কিন্তু বিতর্কিত এক নেতার ঘটনাবহুল সংক্ষিপ্ত রাজনৈতিক জীবন।
তবে শ্রদ্ধেয় মাজলুম লেখক আঁধার রাতের বন্দিনী বইয়ে বুঝিয়েছেন যে, সোভিয়েত ইউনিয়নের অধিকাংশ আলেম কমিউনিস্ট সরকারের আনুগত্য করলেও, আনোয়ার পাশাই ছিলেন একমাত্র আলেম যিনি গুটিকয়েক যোদ্ধাদের নিয়ে অস্ত্র হাতে তুলে নিয়েছিলেন। ব্যাপারটা এমনভাবে উপস্থাপন করা হয়েছে যেন তিনি ছিলেন ইমাম শামিলের উত্তরসূরি! মানে আমি হাসব নাকি কাঁদব? আনোয়ার পাশা নাকি আলেম ছিলেন! সত্যি বলতে মাজলুম লেখক আমীরুল ইসলাম এনায়েতুল্লাহ আলতামাশের চাইতেও অনেক বেশি ইতিহাস বিকৃতি করেছেন বললেও হয়তো অত্যুক্তি হবে না।
আর কামাল পাশার কথা বলতে গেলে, তিনি ছিলেন তিন পাশার অন্যতম, তালাত পাশার মতোই কট্টর তুর্কি জাতীয়তাবাদী, পশ্চিমা সাম্রাজ্যবাদবিরোধী, ধর্মনিরপেক্ষতাবাদী একজন তুর্কি জেনারেল। তবে মজার ব্যাপার হচ্ছে, এই লোকটা চুরি করার পর ডাকাতির মামলায় ফেঁসে গেছে।
এই কথা বলার কারণ হলো—কামাল আতাতুর্ক তার রাজনৈতিক জীবনের শুরু থেকেই ছিলেন কট্টর তুর্কি জাতীয়তাবাদী। তিনি ইত্তিহাদ ও তারাক্কি বা কমিটি অব ইউনিয়ন এন্ড প্রোগ্রেস এর একজন সক্রিয় কর্মী ছিলেন। তার কাছে ধর্ম তেমন ম্যাটার করত না বরং জাতীয়তাবাদই ছিল মুখ্য। নিজের চিন্তাধারা ও মতবাদ প্রচার করতে গিয়ে বিজয়ী হওয়ার পর, তিনি মুমূর্ষু খেলাফতের পতন ঘটিয়েছিলেন। কিন্তু আবেগী বাঙালিরা কোনো ধরনের দলিল-প্রমাণ ডকুমেন্ট ছাড়াই তাকে ব্রিটিশ গুপ্তচর ট্যাগ দিয়ে গালিগালাজ করতে থাকে।
আমার কথা হলো—তাঁর কার্যকলাপ, মতবাদ ও আদর্শের কারণে তাকে গালিগালাজ করুন। তাঁর নাস্তিকতা, খেলাফতবিরোধী অবস্থান, পাশ্চাত্য অনুকরণের কারণে আরো বেশি বদদোয়া করুন, অভিশাপ দিন। কিন্তু যেকোনো কিছু করলেই অটোমেটিকভাবে তাকে আমেরিকা, ব্রিটিশ ও ইহুদিদের গুপ্তচর বানিয়ে দেওয়া মূর্খতাপূর্ণ আবেগী দৃষ্টিভঙ্গি ছাড়া আর কিছুই নয় !
জেনারেল হিসেবে কামাল পাশা ছিল এক অনন্য বীর। বিভিন্ন ফ্রন্টে যুদ্ধ করে বেশ সুনাম কুড়িয়েছিলেন। বিশেষ করে চানাক্কালের যুদ্ধে তৎকালীন বিশ্বের নাম্বার ওয়ান ব্রিটিশ নেভিকে লজ্জাজনক পরাজয়ের স্বাদ আস্বাদন করানোর পর পাশা উপাধিতে ভূষিত হন।
মুদ্রোস যুদ্ধবিরতি চুক্তি সাক্ষরিত হওয়ার পর, যখন জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের নেতারা উসমানীয়দের উপর আস্থা হারিয়ে বিদ্রোহ করে বসলেন, তখন সুলতান ষষ্ঠ মেহমেদ বিদ্রোহীদের শায়েস্তা করার জন্য কামাল পাশাকে সামসুনে পাঠান। কিন্তু এরপর পরই গ্রিস পশ্চিম আনাতোলিয়া দখল করে নেওয়ার পর পরিস্থিতি বদলে যায়।
উসমানীয় সাম্রাজ্যের তরুণদের একটা বড় অংশ, প্রায় ৫০ বছর ধরে সংবিধান ও সংসদের জন্য লড়াই করে আসছিল। সেইসাথে গতিশীল ইউরোপের রেসে পিছিয়ে পড়া তুর্কি জাতীয়তাবদীরা আর হয়তো পারেনি উসমানীয়দের মুমূর্ষু সাম্রাজ্যের বোঝা নিয়ে চলতে। ইবনে খালদুনের ‘আসাবিয়া’ তত্ত্ব অনুযায়ী, একবার কোনো শক্তির পতনের ধারা শুরু হলে তা রোধ করা দুরূহ। তাই অনেক জাতীয়তাবাদী নেতাই মনে করলেন, উসমানীয়দের পতন অনিবার্য। এই রুগ্ণ মুমূর্ষু সাম্রাজ্যকে বাঁচানোর চেষ্টা নিছক সময়ের অপচয়। কেননা সবকিছুরই একটা শেষ রয়েছে। উসমানীয়দের সমাপ্তিও নিকটবর্তী।
এরপর কামাল পাশাও খলিফার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে বসে। তারা একটি সাধারণ পরিষদের মাধ্যমে আংকারাকে রাজধানী করে আনাতোলিয়ায় একটি নতুন সরকার গঠন করে এবং প্রেসিডেন্ট হিসেবে কামাল পাশাকে দায়িত্ব দেওয়া হয়। তার অপমানজনক সেভ্রেস চুক্তিকে সম্পূর্ণভাবে প্রত্যাখ্যান করে তুর্কি জাতীয়তাবাদী আংকারা সরকার দখলদার মিত্রশক্তির বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে। তাদের চূড়ান্ত লক্ষ্য ছিল, আনাতোলিয়া, ইস্তাম্বুল ও পূর্ব থ্রেসকে শত্রুমুক্ত করে একটি স্বাধীন রাষ্ট্র গঠন করা, যার ভিত্তি হবে তুর্কি জাতীয়তাবাদ, ধর্মনিরপেক্ষতা ও পশ্চিমা ধাঁচের আধুনিকতা।
এই সময়টায় কামাল পাশা পুরো তুর্কি দখল করে ফেলা মিত্রশক্তির সাহায্যপুষ্ট গ্রিক সৈন্যবাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে একেরপর এক এলাকা দখল মুক্ত করতে থাকেন। এর কিছুদিনের মধ্যেই আংকারার জাতীয়তাবাদী সরকার ব্রিটিশদের হাতের পুতুল হয়ে থাকা পাপেট খলিফার সরকারকে অস্বীকার করে।
যদিও বিভিন্ন ভক্তিমূলক মুসলিম ঐতিহাসিক এইসব বিষয়ে বিস্তর তাবিল করেছেন কিন্তু তাদের বর্ণনা ও ব্যাখ্যার সাথে বাস্তবতার অনেক অসঙ্গতি বিদ্যমান। তাই এগুলো মেনে নেওয়া একটু কঠিনই বটে। তার চেয়ে সহজ বিষয় হলো যে, কামাল পাশা শুরু থেকেই কট্টর তুর্কি জাতীয়তাবাদী ছিল। সে কখনো নিজেকে আল্লামা রুপে হাইলাইট করেনি। আর সে নিজের মতবাদ ও আদর্শের প্রচারের জন্যই কাজ করে গেছে।
যাই হোক শ্রদ্ধেয় মাজলুম লেখক বইয়ে আরো লিখেছেন যে, সমাজতান্ত্রিক সোভিয়েত ইউনিয়নে নাকি বিয়ে বাতিল করে ‘যৌন ক্যাম্প’ বানানো হয়েছিল, যেখানে সবসময় শুধু নারীরা থাকত, আর পুরুষরা যৌন চাহিদা মিটানোর জন্য সেখানে গিয়ে কাজ শেষ করে চলে আসত। তিনি এমনও লিখেছেন যে, মাঝে মাঝে নাকি এমনও ঘটতে দেখা যেত, ছেলের কাছে মাকে ও ভাইয়ের কাছে বোনকে পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে! আর মা আর বোনেরা তখন তাদের কাপুরুষ সন্তান ও ভাইদের তিরষ্কার করত এই বলে—কেন তোমরা কমিউনিস্টদের বিরুদ্ধে অস্ত্র তুলে না নিয়ে এমন লজ্জাজনক জিন্দেগি যাপন করছো?
কী আর বলব!
যাই হোক, এগুলো যদিও তখন অনেক জোশ নিয়ে পড়তাম, কিন্তু এখন ভাবি কতটা বোকা ছিলাম ছোটবেলায়!
তবে এটা ঠিক যে, লেনিন ও অন্যান্য বেশকিছু বলশেভিক নেতাদের পরিবারবিরোধী মনোভাব ছিল, কারণ তারা পরিবারকে বুর্জোয়া নিপীড়নের কেন্দ্র মনে করতেন। তবে লেখকের বর্ণনার মতো চরম বা বিকৃত অবস্থা প্রতিষ্ঠা করা হয়নি, বরং তালাক প্রক্রিয়া সহজ করে দেওয়া হয়েছিল, বিবাহপূর্ব যৌন সম্পর্ক বৈধ করে দেওয়া হয়েছিল—যেটা এখন প্রায় সব সেক্যুলার দেশেই বৈধ। সুতরাং এ ব্যাপারে লেখকের বর্ণনা ছিল রীতিমতো অসার এবং কল্পনানির্ভর।
সবশেষ বলব, ইতিহাসবিকৃতি, যতই আবেগময় ভঙ্গিতে উপস্থাপন করা হোক না কেন, শেষ পর্যন্ত মানুষকে তা বিভ্রান্ত করে, বুদ্ধিবৃত্তিক অন্ধকারের দিকে ঠেলে দেয়। তাই মনে রাখা দরকার যে, ইতিহাসচর্চা মানে শুধু ভক্তিমূলক মহান চরিত্র খুঁজে বেড়ানো নয়, বরং ইতিহাসের জটিলতা, দ্বৈততা এবং ভুলগুলোকে শনাক্ত করে তা থেকে শিক্ষা গ্রহণ করে পথচলা।
“যে জাতি নিজের ইতিহাস বিকৃত করে ফেলে, সেই জাতি ভবিষ্যত হারিয়ে ফেলে।”