একটি সন্ধ্যা আর আমাদের সুনসান নদীতীর

গালিব মুহাম্মাদ

সন্ধ্যা মানে তো অন্ধকারই। সন্ধ্যার মূল অনুষঙ্গই অন্ধকার। চলাফেরায় মন-খারাপের মতো একটা অবস্থা বিরাজ করতে শুরু করে। নিতান্ত ভাবলেশহীন অথবা নিত্যদিনের সন্তুষ্ট মানুশ হলে সেটা নিছকই দিনের শেষ, মাগরিবের ওয়াক্ত, গোয়ালে ঠায় দাঁড়িয়ে থাকা গাভিটাকে ঘরে তোলবার সময়। অথচ এমন সন্ধ্যাবেলায় শান্তি নাই। পরিবেশটা মিশ্র এক আমেজের ভেতর ঢুকে যায়।  বাইরে রিকশার হর্ন, অটোগুলো চলে গেলে তার মোটরের আওয়াজটা মনে হয় যেন পেছনে পেছনে দৌড়ে যাচ্ছে। এদের কোনোটারই হেডলাইটে আলোর প্রাচুর্য নেই, আর এজন্যে সন্ধ্যাটা আরো ম্লান, আরো মৌন হয়ে ওঠে। এরা তেমন আলোকিত করে না ক্ষয়ে চলা পথ, দুইপাশের অন্ধকার। ঝলক দেখা যায় বড় কোনো গাড়ি গড়গড় করে চলে গেলে। 

আমি দেখতে পাই না আসলে—শব্দ শুনে ঠিক করি যে এটা ট্রাক, তিনরাস্তার মোড়ে যে বাড়িগুলো তৈরি হচ্ছে, তার মাল নিয়ে এসেছে৷ শুয়ে শুয়ে রুমের অন্ধকার সিলিংয়ের দিকে তাকিয়ে কল্পনা করি কতটুকু পথ আলোকিত হলো, গলির মুখের আলিশান প্যালেসের জানালায় কতটুকু আলো আটকে গেল কাঁচের এপাড়ে। ভেতরে লাইটের আলোয় একটা মেয়ে পড়ছে। ভালো ছাত্রী। হাইয়ার সেকেন্ডারিতে ভালো রেজাল্ট করবে। পাবলিক ইউনিভার্সিটিতে চান্স পেয়ে ভালো সাবজেক্ট নিয়ে পড়বে। হাইয়ার স্টাডির জন্যে বিদেশ যাবে। কী লাইফটাই না গড়ে উঠছে নির্বিঘ্নে, হবার মতো নিয়ম করেই হচ্ছে সব। এইসব ভাবতে ভাবতে নিজের পড়াশোনার কথা মনে পরলে পীড়া বোধ হয়।

অথচ আমি আদৌ জানি না এই বিশাল প্রাসাদে কোনো মেয়ে আছে কিনা, যার মেধা খুব ভালো, যার পড়াশোনা নিয়ম মতোই হচ্ছে আর যার সম্পর্কে এটাও নিশ্চিত হওয়া যায় যে তার চেহারাটা সুন্দর, কমনীয়—গায়ের ত্বক খুব কোমল। তার জামাগুলো নারী-দেহের সুগন্ধিযুক্ত, মসৃণ আরাম জড়ানো—মুঠোয় নিয়ে গালে জড়ালে জড়িয়েই রাখতে ইচ্ছে করে। যাকে দেখলে হেঁটে হেঁটে অনেক দূরে চলে যেতে চায় মন। যাকে পাওয়া যাবে না ভাবলে শেষ হয়ে যায় ঘরে ফেরবার তাড়া। বুকের ভেতর জাগে গোপন বিরহ, কাতর অস্থিরতা। কখনো বৃষ্টি হবে না এমন সংবাদ জানে যে কৃষক—তার আশার মতো আবেশে নুয়ে থেকে তবু যাওয়া হয় না কোথাও। নাকি কোথাও যাবার থাকে না। পেট-পোড়া পীঠ-পোড়া কৃষকের জমির আলের ভেতরই যেমন আয়তাকার বন্দী জীবন।

এমন সময় হঠাৎ করে ফোন বেজে উঠলে একরকম অনীহা জাগে কল রিসিভ করতে। আবির। এই সন্ধ্যাবেলায় কী? ‘বের হবা?’—রিসিভ করতেই জিগ্যেস করবে, জানি। কল পিক করে আমিই প্রশ্ন করি—‘কোথায়? রুমে আসো।’ বলি—‘আচ্ছা দাঁড়াও তাইলে, বের হইতেছি। মাছরাঙার সামনে দাঁড়াও।’ 

আবিরকে আমি বুঝে উঠতে পারি না। হাবভাব যেন একজন আত্মমগ্ন কবি, কিন্তু পাকা কবিতা ও লেখে না। ওর চিন্তাধারা কাব্যিক, তাতে একজন শিল্পী বাস করে। মাঝেমধ্যে মনে হয় সে একজন মুখোশপরা মানুষ, জগতের সব বুঝে, তবু তার শিশুর মতো আচরণ। আবির নিজে আমাকে পাগল বলে। কেন বলে সেটা ও ভালো বলতে পারবে, অথবা কোনো কারনই নেই। আমার বড় চুল, অপরিপাট্য পরিধেয়, সুগন্ধিহীন জীবন দেখে আমাকে পাগল মনে হতে পারে। একটা কারণ ও বলে— দেখা হলেই পড়াশোনার আলাপ করি শুধু। অথচ প্রতিবার এই আলাপটা সেই তুলে দেয়। কেন দেয়, তাও জানি। যার যাতে দুঃখ, তার সাথে আমরা সেই বিষয়েই কথা বলতে আরাম পাই। পুরুষমানুশ পরস্পরের মধ্যে সুখ নিয়ে আলাপ করে না সাধারণত। আবির জানে কোথায় আমার দুঃখ, আলাপ করবার জন্যে উপাদেয় আর সহজ বলেই সে পড়াশোনা নিয়ে টান দেয়। এই এক গণ্ডিবদ্ধ বিষয় জীবনের সব মনোহারি আনন্দ আটকে দিল। শৈশব, কৈশোরের নিশ্চিন্তে ভালো থাকবার সময়টুকু শুষে নিল। কঠিন অসুস্থতার ভেতর আমাদেরকে নামিয়ে দিয়েছে এই সমাজ-সিস্টেম, এই দেশ, এই বিশ্ব।

আবিরকে কখনো বাস্তব জগতের একজন গড়পরতা মানুশই মনে হয় কেবল যার আসলে কোনোকিছু হারিয়ে গিয়েছে পথে, তাই মন খারাপ। যার আসলে অনেক কিছুই হারিয়ে গিয়েছে—আর কিছু হারানোর ব্যাপারে তাই অসচেতন।    

 ‘কই যাবা?’—জিগ্যেস করি। ‘নদীর দিকে চলো।’ 

আমি বাইক স্টার্ট করে নদীর দিকে নিয়ে যেতে থাকি। এই এক নদী আমাদের বন্ধু। আমাদের খুব ক্লোজলি মিউচুয়াল। কোথাও যাবার না থাকলে পদ্মার এই শাখাটার কাছে আমাদের সবসময় যাবার থাকে। এই পথে আমরা নির্দ্বিধায় চলতে শুরু করি। এর কাছে বসবার থাকে, জলের কাছাকাছি—চলে অনির্দিষ্ট কথাবার্তা, গান— প্রাচীন নদীতীরের এক নীরবতায় শুধু ঢেউয়ের শব্দে ভাসতে থাকি আমরা। পানীয়, ধূমপান— ধীরে ধীরে এইসব উপলক্ষ হয়ে ওঠে বসে থাকবার—

যেন এছাড়া আর কিছু নেই আমাদের কাছে।

যেন আমাদের ভেতরটা খুব ফাঁকা—

কিছুই ভাববার নেই,

বলবার নেই কোনো বন্ধু বন্ধু জোক।

শুধু স্রোতের মতো চলতে থাকা এক শূন্যতার ভেতর ভাসতে থাকি আমরা। ঢেউয়ের শব্দে৷ শূন্যতার নৈঃশব্দে।

‘মেরীর খবর বলো’—হঠাৎ বলে উঠবে ও। এই একটা কথা সমস্ত নীরবতা ছাপিয়ে ওঠে প্রতিবার। চুপচাপ বসে থাকতে থাকতে যখন দম আটকে আসে, নিয়ম করে ও তখন মেরীকে নিয়ে আসে। বিগত তিন বছর ধরে চলছে এই নিয়ম। আমাদের সমস্ত কথা ফুরিয়ে যাবার পর মেরীর কথা উঠে আসে দীর্ঘ নীরবতার ভেতর থেকে, যেন এখানেই  আমাদের নিস্তব্ধতার ভেতর কথার বীজ হয়ে ঘুমিয়ে ছিল। আমাদের কথা ফুরিয়ে গেলে, নতুন বসন্ত ফুটিয়ে তুলতে অংকুরিত হয় মেরী। তাকে নিয়ে কয়েক মুহূর্ত কথা হয়। মেরীর গল্প চারা থেকে পরিণত গাছ হয়, ফুল ফোটে, বীজ হয়ে আবার আমাদের নিবিড় নিস্তব্ধতার ভেতর আত্মগোপন করে। আমাদের আবার দম আটকে আসে। হাঁটু ভাঁজ করে তার উপর মাথা রেখে বসে থাকি। নীরবতা কী অসহ্য ব্যাপার। তবু এইটুকু সন্ধ্যার জন্যে আবির ছুটে আসে রোজ।  

নদীতে কথার আওয়াজ পাওয়া যায়। আবছা অন্ধকারে, আমাদের খুব কাছেই কখন চুপিসারে একটি নৌকা ভিড়েছে, খেয়াল করিনি কেউ। তা থেকে একটা লোক সাইকেল নামাবার কসরত করছে। সাথে কালো বোরকা পরিহিতা একজন নারী, চারপাশে আরো অন্ধকার জড়িয়ে দাঁড়িয়ে আছে একটি বাচ্চার কাঁধে হাত রেখে। নিবিড় মনোযোগ দিয়ে লোকটির সাইকেল নামানো দেখছে। লোকটি যে তার আপনজন, প্রাণের মানুষ, তার তাকিয়ে থাকায় সেই পরিচয় ফুটে উঠছে। যেন তার এই সাইকেল নামানোর দৃশ্যটাও নারীটির অধিকারের। পাঞ্জাবি পরা লোকটা এরপর বাচ্চাটিকে নামায়। স্ত্রীকে নামতে সাহায্য করে। বাচ্চাটি পা টিপে টিপে নদীর ঢালু পার বেয়ে উঠে আসে। লোকটি বউ-বাচ্চা সাইকেলে তুলে উত্তরের বড় রাস্তার দিকে চলে যায়, সন্ধ্যাকালীন হাওয়ায় উড়ে উড়ে। নৌকাটি  ফিরে যায় অন্য পাড়ে। নদীপাড় আবার ফাঁকা হয়ে যায়। মাঝখান থেকে কয়েক মিনিটের এই দৃশ্যটুকু আটকে রাখে মন। নারীটি একমনে পর্যবেক্ষণ করছে লোকটির সাইকেল নামানো, বাচ্চা মেয়েটি খুব সাহসী ভঙ্গিতে পাড় বেয়ে উঠছে—এইসব সিনারিও ভেসে উঠছে বারবার। নৌকাটির তীরে ভেড়া এবং চলে যাওয়ার ভেতরের সমস্ত ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র ঘটনা নিয়ে কেমন এক স্যুরিয়েলিস্টিক আখ্যান রচনা হয়ে গিয়েছে। নৌকাটি চলে যাওয়ার পরপরই সেটি খুব দ্রুত অতীতে চলে যেতে থাকে, যেন সুপ্রাচীন কোনো ঘটনা প্রতি মুহূর্তে প্রাচীনতর হয়ে মনে জায়গা করে নিচ্ছে।

আমি জানি কিছুক্ষণের মধ্যেই এই ঘটনা ভুলে যাব। আমার ভেতরে হারিয়ে যাবে এইসব দৃশ্য। তারপর একদিন আধোঘুমের ভেতর আমার কল্পনা একটি দ্রতগামী টানেলের ভেতর দিয়ে ছুটতে শুরু করবে। তখন সহস্র স্মৃতির ভেতর এই ঘটনাটাও আমি আবার দেখতে পাব। ক্ষুদ্রতর সময়ের জন্যে এই ঘটনাটা আমার মস্তিষ্কের ভেতর দিয়ে ছুটে যাবে। তারপর এটা আমি চিরতরে ভুলে যাব। এই নৌকা, মধ্যবয়সী লোকটার সাইকেল, বাচ্চা মেয়েটি— সবকিছু চিরতরে কোথাও হারিয়ে যাবে। মানুশের ভুলে যাওয়া স্মৃতিগুলি কোথায় যায়? 

আবির নড়েচড়ে ওঠে। মনে হয় যেন দীর্ঘ শীতকাল ঘুমিয়ে থাকা একটি রেপ্টাইল হঠাৎ জেগে উঠলো পাশেই। প্যাকেট হতে সিগারেট বের করে, পকেট হাতরে লাইটার খোঁজে। এতক্ষণ চুপচাপ বসে থাকবার পর হঠাৎ এই তৎপরতা একটু অস্বাভাবিক লাগে, যেন দীর্ঘসময় ধরে জমে ওঠা শান্তি ভঙ্গ করতে ও চঞ্চল হয়ে উঠেছে। ওর সঙ্গ দিয়ে হঠাৎ হালকা বাতাস বইতে শুরু করে—তাতে মৃদু হিম মিশে আছে। চাঁদ নেই, আকাশে অনেক তারা। তাদের দু-একটি আমাদের আঙ্গুলের ফাঁকে জ্বলে জ্বলে ক্ষয়ে যাচ্ছে। ছাইগুলো কেমন চিরতরে শেষ হয়ে যাবার দুঃখ নিয়ে ঝরে পড়ছে, যে দুঃখের কোনো মূল্য নেই৷ আমাদের ভেতর এমনি কতকিছু ছাই হয়ে আছে৷ আমাদের মায়েরা কি জানে? আমাদের বোন, আমাদের প্রেমিকারা? বাহুর ভেতরে শুয়ে থাকা বউ আমাদের খবর রাখে? আবির আবার আলাপ শুরু করে—

কখনো শেষরাতে হঠাৎ হঠাৎ ঘুম ভেঙ্গে যায়। শুয়ে শুয়ে কত কী ভাবতে থাকি। জীবনের কথা মনে পড়লে মনে হয় তা যেন একটি ক্ষুদ্র অ্যালপেনলিবে ক্যান্ডি, যা মুখের ভেতর গলে গলে ছড়িয়ে পরবার আগেই অনাকাঙ্ক্ষিতভাবে গলা দিয়ে নেমে গিয়েছে। এমন জীবন নিয়ে কী করব ভেবে পাইনা। প্রচণ্ড ভয় হতে থাকে সকালের কথা ভেবে। মনে হয়, ধুতরা ফুলের মতো একেকটা সকাল ফুটে উঠছে জীবনে, একেরপর এক—আমি চাইলেও আটকে রাখতে পারছি না, পারছি না হাতের মুঠোয় বিগত রাতটিকে ধরে রাখতে। চাইলেও সকালগুলো স্বাভাবিক হচ্ছে না। আমার বিশেষ কোনো দুঃখ নেই। টাকা-পয়সার টানাটানি নেই। একটি নারীর প্রয়োজন অনুভব করি কখনো কখনো, কিন্তু সেটা অভাববোধ হবার মতো তীব্র নয়। তাহলে কেন আমি নিজেকে একজন সুখী মানুষ ভাবতে পারি না?

রাতটুকু বড় আরামদায়ক লাগে। ভেতরে যা কিছুই চলতে থাকুক, অন্তত নিজের কামরায় একা থাকতে পারি। জগতের আর কোনোকিছুর সাথে নিজেকে মানিয়ে চলতে হয় না। বিছানায় শুয়ে চোখ বুঝলেই চোখের কোঠরে ঝলক দিয়ে যায় কসমিক রে। এভাবে চলতে থাকে ঠিক কতক্ষণ, জানি না। তবে আমি এক মহাশূন্যে ভাসতে থাকি। আমার চারপাশে চমক দিতে থাকে অজস্র আলো। কোনোটার তীব্রতা অর্গাজমের মতো পুড়িয়ে দেয় সবকিছু। অন্ধকারের ভেতর আমি আরো প্রগাঢ় অন্ধ হয়ে থাকি। কোনো আলো আমার থেকে দূরে বহুদূরে সরে যেতে যেতে আমাকে আহ্বান করে। দূরগামী সেই আলোর দিকে চেয়ে চেয়ে সময়জ্ঞান যতটা সময় ভুলে থাকা যায়, জগতের আর সমস্ত বিষয়বস্তু থেকে বিচ্ছিন্ন থাকি। সময়ই আসলে সবকিছুর সাথে সূত্রতা তৈরি করে রাখে। টালমাটাল সংসারে বাবার অনুপস্থিতি, দোকানদারের সাথে মূল্য নিয়ে বোঝাপরা করতে না পারা অথবা শিশুর মতো সুন্দর যে মেয়েটিকে পছন্দ করতাম, তার মরে যাবার দিনটা­— ’ 

আবির চতুর্থ সিগারেটটা প্যাকেট হতে বের করলে ওর হাত থেকে সেটি নিয়ে আমি জ্বালি। নিজের ফুসফুসের কথা ভাবলে কান্না পায়। এক হাজারবার প্রতিজ্ঞা করেও দ্রুত মরে যাবার নিয়ামকগুলো ছাড়তে পারিনি। নদীতে অন্ধকার, আবির এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে সেদিকে। ‘তোমাকে ভাবে ধরল নাকি?’—তিরস্কার করলাম। ও হেসে আমার হাত থেকে সিগারেট নিয়ে বললো— 

‘চলো থানা রোডে গিয়ে পাকোড়া খাই। তারপর রাজেন্দ্র-র সামনে থেকে ভাজা কালোজিরা দেওয়া লেবু-চা। মনকে আনন্দ দেওয়া দরকার। মনকে প্রচুর আনন্দ দেওয়া দরকার।’

যেতে যেতে আমি আবিরকে উদ্দেশ্য করে বলি, ‘আমাকে শে জিজ্ঞেস করেছিলো, “আমাদের ভেতর এত দুঃখ কেন?” আমার তখন খুব বলতে ইচ্ছে করছিল, কেন এত দুঃখ? জানো তুমি? কখনো এইসব দুঃখ চাইনি আমি। কখনো চাইনি।’  

আমার মতো আমি বিড়বিড় করতে থাকি। আবির ভালোমতো শুনতে না পাওয়ায় তা নিয়ে মাথা ঘামায় না। মাঝে মাঝে পেছনের দিকে ঝুকে শোনার চেষ্টা করে কী বলছি, কিছু বলছি কিনা, কিন্তু শোনার জন্যে খুবেকটা উৎসুক না। মন দিয়ে ড্রাইভ করছে। আর গাইছে কী যেন। ওর গলায় সুর নেই, মুখে জড়তা। কিন্তু বুকভরা গান। পাখি হতে চেয়ে একেকটি অস্ট্রিচ হয়ে জন্মেছি আমরা কেউ কেউ।

দুইপাশের বাউন্ডারির ভেতর থেকে উৎসুক কিশোরীর মতো এক ঝাড় বাগানবিলাস ঝুঁকে আছে রাস্তার উপর—যেন বাউন্ডারি দিয়েও আটকে রাখতে পারছে না তাকে। এমন দুরন্ত মেয়ে নিয়ে কী যে বিপদ! হালিমা গার্লসের পাশ দিয়ে যেতে যেতে আমি ভাবি বাগানবিলাসের কথা। আজিমপুর কলোনীর সামনে দিয়ে যাওয়া-আসার সময় রোজ কলোনীর ভেতরের একটি বিল্ডিংয়ের নয়তলার বেলকনির দিকে তাকিয়ে থাকতাম, বাগানবিলাস দেখতে। তখন ফার্মগেটে ভর্তি কোচিং করতাম, মনখারাপ থাকত। তখন বেদনার দিন ছিল। নীলক্ষেত থেকে রোজ ফার্মগেটের লেগুনায় উঠবার ঘটনা এতটা করুণ ছিল যে কান্না পেয়ে যেত। ফিরবার সময় নীলক্ষেত থেকে ইডেনের সামনে দিয়ে হেঁটে হেঁটে আসতাম। কলোনীর সামনে এসে অটোতে উঠবার আগে একটু থামতাম। গাঢ় লাল ও গোলাপি রঙ মেশালে যে থোকা থোকা গভীর ক্রিমসন লাল ও হালকা লালের মিশেল রঙ পাওয়া যায়, ওরকম এক থোকা বাগানবিলাস ঝুলে থাকত বেলকনির গ্রীল থেকে। আমি শিশুর মতো তাকিয়ে থাকতাম উপরদিকে মুখ করে। নয়তলার উপরে এক বেলকনির বাগানবিলাস এতটা মোহনীয় হয়ে উঠেছিল আমার কাছে।

আবির ডাক দিলো—নামবা না? সম্বিৎ ফিরে পেয়ে বাইক থেকে নামি। আবির চায়ের অর্ডার করতে যায়। আমি দুইটা চেয়ার টেনে সারি সারি তালিপাম গাছের সমান্তরালে বসি। বাতাস ছেড়েছে, দলে দলে মেঘেরা এলাকা ছেড়ে চলে যাচ্ছে দূরে।

বিজ্ঞাপন

Subscribe
Notify of
guest
3 Comments
Oldest
Newest Most Voted
Inline Feedbacks
View all comments
Imrul Bro
Imrul Bro
1 year ago

মা শা আল্লাহ,হাজারো তরুণের জীবনের সাথে প্রাসঙ্গিক গদ্য।

মাহফুজ তাসনিম
মাহফুজ তাসনিম
1 year ago

লেখাটা পড়ে কোথায় যে হারিয়ে গিয়েছিলাম —ঠিক জানা নেই!
কবে যে চোখের কোণে কয়েক ফোঁটা নোনাজল জমে মুখতক গড়িয়ে পড়েছে —তা-ও ঠিক বলতে পারিনি।

হাসনাত
হাসনাত
9 months ago

আপনার লেখা আরও চাই

স্বত্ব © ২০২৩, যোগাযোগ | ই মেইল : jogajogbd.org@gmail.com

যোগাযোগ-এ প্রকাশিত কোনো লেখা, ছবি কিংবা শিল্পকর্ম লেখক অথবা কর্তৃপক্ষের অনুমতি ছাড়া কোথাও প্রকাশ করা অবৈধ৷