১.
হাতের বামে জানালা, তাকালেই পাশের ছাদের একাংশ চোখে পড়ে। সেখানে কিছু সবুজ গাছপালা আছে। আর একটি বড় লোহার খাঁচা—তাতে হয়তো মুরগি-টুরগি পালা হয়। মাঝেমধ্যেই দেখি সেই খাঁচার ভেতর একটা মানুশ উবু হয়ে বসে আছে। ছাদটির যতটুকু দেখা যায়, তাতে সেখানে একবার গিয়ে হেঁটে আসবার ইচ্ছে জাগে। এই ইচ্ছেটা সবচে বেশি হয় যখন দেখি কোনো বিকেলবেলার অবিরাম হাওয়ায় গাছগুলোর ডালপালা এলোমেলো দুলছে। তখন ইচ্ছে করে ওপাশের ছাদের মাঝখানে দুহাত ছড়িয়ে দাঁড়িয়ে থাকি।
একদিন দেখি, ওপাশের ছাদের লোহার খাঁচা হতে একটি সবুজ টিয়ে একদৃষ্টে আমার জানালার দিকে চেয়ে আছে।
২.
জানালার পাশেই আমার টেবিল। পড়ার জন্যে বসা হয় না কখনো। কেন যে আর টেবিলে বসলে পড়া হয় না। মন ঘাড় বাঁকা করে ঠায় দাঁড়িয়ে থাকে। আমি দেখতে পাই, আমি বসলেও আমার অবাধ্য মন আমার ঠিক পেছনেই দাঁড়িয়ে আছে, যাকে ঘাড়ের উপর দাঁড়িয়ে থাকা বলে। অগত্যা টেবিল থেকে উঠে বিছানার উপর উঠে বসতে হয়, বালিশের উপর বই রেখে। এবার মন আমার লক্ষ্মী মেয়ের মতো এসে পড়াশোনা শুরু করে। তবে আমি একটা কৌশল আবিষ্কার করেছি। স্টাডি ম্যাটেরিয়ালসগুলোর সব পিডিএফ করে নিয়েছি। এমনিতেও আমাদের ক্লাস লেকচার স্লাইড বেইজড হওয়ায় সেসব পিসি থেকে পড়া যায়। আগে এগুলো প্রিন্ট করে নিতাম দাগাদাগি করে পড়ার জন্যে, এখন আর করি না মনের খামখেয়ালি লক্ষ করে, এখন পাওয়ারপয়েন্টে স্লাইড এডিট করে নেই যা কিছু করার। এতে আমার মনের অবস্থা এখন—কী আর করা! কেমন ধীর পায়ে হেঁটে এসে পড়তে বসে। একমনে স্লাইডগুলো দেখতে থাকে, হাইলাইট করে, নোটস নেয় প্রয়োজন হলে। আমি এবার চেয়ারের পেছনে দাঁড়িয়ে দেখতে থাকি আমার মন-মেয়েকে। দেখতে দেখতে আমার মাথাটা জানালার গ্রিলে হেলে পড়ে। চোখে ধীরে ধীরে জল জমা হয়ে গড়িয়ে পড়ে। আমার বখে যাওয়া মন এখন সামান্য কৌশলেই বশ মানে। এই পনেরো-বিশ দিন আগেও সে ছিল ভীষণ বেয়ারা। হঠাৎ একদিন বাথরুমের বেসিনে এক থোকা রক্ত দেখে তার সবকিছু পাল্টে গেছে।
এখন একাডেমিক পড়াশোনা ছাড়াও সে খুব মনযোগ দিয়ে পাঠ করে কবিতা, গদ্য, গল্প। মাহমুদ মাসুদের ‘লাল পৃথিবীর নীল কদম’, হাসান এনামের ‘দোয়েল পাখির নোট’ পড়ে কিশোরী মেয়ের মতো চোখ ভরে ফেলে জলে। ফুল্লরার কবিতায় গলে গলে পরে ভিজিয়ে ফেলে প্রিন্টের শাড়ি। সন্দ্বীপের এক গ্রাম-গৃহস্থ সম্পর্কে কৌতূহলের ভেতর জমে থাকে, সন্ধ্যার আগে গৃহস্থবাড়ির আশপাশের আকাশে জমে থাকা পৌরাণিক ধোঁয়ার মতো। আমি অবাক হয়ে ভাবি, এতটা নরম হয়ে আসে সময় ফুরিয়ে আসা মানুশের মন!
আল মাহমুদের ‘গন্ধবণিক’ পাঠ করে সে এক বৃদ্ধের মতো প্রফুল্ল হয়ে ওঠে যে সময় চলে যাবার পর যৌবনের এক গোপন রসের কৌশল আবিষ্কার করতে সক্ষম হয়েছে। তার মনে হয়, জীবনে এমন গদ্য আরো অনেক পড়বার কথা ছিল। অথচ গদ্য পড়ে কাটাবার পর্যাপ্ত সময় নেই আর হাতে। যখন ছিল তখন সে বিমুগ্ধ হয়ে কাটিয়েছে জীবনের এক প্রগাঢ় অন্ধকারে। সে অন্ধকার তার সব কেড়ে নিয়েছে, দিয়েছে দুঃখের ডালি, হারাবার বেদনা।
৩.
গন্ধবণিকের ঘরের আসবাবপত্র, স্টেশানে কলিমের সিগারেট খাওয়া, বাসরের রাতে কুলসুমের গলায় আদর আর বুকে আতর মেখে দেওয়া, বুকে মধ্যরাতের জ্যোৎস্না আর কেয়াফুলের গন্ধের আশ্রয় নিয়ে কুলসুমের প্রেমের ইঙ্গিত দেওয়ার দৃশ্যগুলো গড়পড়তা এই জীবনে অনেক কিছু না পাওয়ার আক্ষেপে বুক ভার করে ফেলে। মনে হয় জীবনটা এমন ফিকশনাল হতে পারে না কেন? নাকি হয়, ক্বচিৎ এবং গদ্যে পাওয়া কলিমদের জীবনেই, না চাইতেই তাদের জীবন একেকটা সুখপাঠ্য গদ্য হয়ে ওঠে। নাকি প্রতিটা মানুশের জীবনই একেকটা গদ্য? কারোটা গন্ধবণিকের, কেউ কলিম, কেউ কামনায় নুয়ে পড়া কুলসুম। কারো জীবন সেইসব গদ্য পাঠ করে বুক ভার হয়ে আসা কোনো যুবকের—কিছু না পেয়েই যার ফুরিয়ে যায় জীবন, যে জীবন অনেক কিছুই পাবার স্বপ্নে বিভোর ছিল দিনরাত। তারপর হঠাৎ একদিন সে নিজের অস্তিত্বই বিলীন হয়ে যাওয়া দেখতে পেয়ে সেদিকেই তাকিয়ে থাকতে শুরু করেছে, সন্ধ্যার ক্রমশ অন্ধকারের ভেতর রহস্যময়ভাবে বিলীন হয়ে যাওয়া প্রতিটা বিকেলে। মধ্যরাতের এই শহরে প্রতিবেশী বাড়ির দেয়ালে দুলতে থাকা আলো-ছায়ায়। ভোররাতে হিফজখানা থেকে ভেসে আসা কুরআন পাঠের একটানা সুরে। ঘুম থেকে উঠলেই মনে পড়ে তার বুকটা তো ফাঁকা! মনে হয় কী যেন একটা তার থেকে খুব দূরে সরে যাচ্ছে। শুধু মনে হতে থাকে, তার বুকে প্রার্থনার মতো গভীর কিছু আটকে রয়েছে।
আল মাহমুদের এই স্বভাব কিছুটা অস্বস্তিকর। সুন্দর-অসুন্দর অবিচারে চলছে একটা জীবন, সুখে-অসুখে। হঠাৎ-ই তাতে একটি নেবুপাতার রস মেশানো পানির হুকোর জন্যে হাহাকার নিয়ে আসেন তিনি। চোখের সামনে চকচক করে ওঠে রুপো আর তামার তৈজসপত্রে সাজানো ঘর, লোবানে ধোয়া দিনরাত্রি। একাকিত্ব যেখানে মোহনীয় হয়ে ওঠে। আবার সেই সাথেই, প্রাচীনতম সুগন্ধি আতরের গন্ধ ব্যাপনের মতো জীবনে অনেক কিছু পাবার আকাঙ্ক্ষা জেগে ওঠে। সোনার অলংকারে আহ্লাদিত বউ—খুব গোপনে শরমে মাখামাখি করে যে আদর করে জান বলে ডাকে; রঙ্গনফুলের মতো একগুচ্ছ ছেলেমেয়ে, ঘরভর্তি মধ্যবিত্ত আলো—আল মাহমুদের রচনা জীবনে অনেক পোড় খেয়ে আসা একজন পুরুষের মনেও হঠাৎ একজন কুলসুমের জন্যে তৃষ্ণা জাগিয়ে তুলতে পারে। তখন বাস্তবতার জ্ঞান লোপ পেয়ে মনে হতে থাকে যেন পৃথিবীর আর সমস্ত আনন্দ ছাই, সব অর্জন নিরানন্দ নীরস।
পুরুষের সুখ বা আনন্দ পাবার ক্ষেত্র খুবই কম। সাধারণত তাদের আনন্দের ঘটনা বিশেষ কয়েকটি বিষয়কে কেন্দ্র করে সীমাবদ্ধ। কোনো পুরুষকে জিজ্ঞেস করা হলে বড়জোর দুইটি বিষয় পাওয়া যেতে পারে এমন। এর কিছু নজির দেখা যায় যখন শিক্ষক সেমিস্টারের শুরুতে শ্রেণিকক্ষে নতুন আসা সবার পরিচয় নেন এবং তাদের শখ সম্পর্কে জিজ্ঞেস করেন। ছাত্রদের ক্ষেত্রে সাধারণত এই পর্বটা সংক্ষিপ্ত হয়ে থাকে। তাদের হবি সাইক্লিং, হাইকিং এবং খুবই দুর্লভ ঘটনায় বাগান করা উঠে আসে। জেন-জি ছেলেরা হয়তো আরো ইউনিক কিছু বলতে পারে তবে সেটা সেই দুইয়েই সীমাবদ্ধ থাকবার প্রবণতা বেশি। তাদের পছন্দের তালিকা সাধারণত একটি বা দুইটি বিষয়ের বেশি হয় না। অন্যদিকে ছাত্রীদের জিজ্ঞেস করা হলে তারা এসব ক্রিয়াকর্মের ঝাঁপি খুলে বসেন।
পৃথিবীতে আসা পুরুষের কাছে তার স্ত্রী সবচে আনন্দের জায়গা, সবচে নিবিড় আশ্রয়। এই জায়গাটাতে তারা সর্বোচ্চ পর্যায়ের সংবেদনশীল হয়ে থাকেন। পুরুষ তাই যখন কোনো নারীর ভেতর এ সংশ্লিষ্ট কিছু দেখে চমৎকৃত হন, তখন নিজের জন্যেও তেমনটা পেতে চান। একান্ত অনুরত ও প্রেমনিষ্ঠ পুরুষের সবচে গোপন ঘটনা হচ্ছে এই আকাঙ্ক্ষাকে চেপে রাখা—তারাও তাকে চমৎকৃত করা বিষয়টি প্রিয়তমার ভেতর একবার কল্পনা করে দেখেন। পৃথিবীতে শতভাগ ‘লয়াল’ কোনো পুরুষ নেই। অতিমানব ও মহামানবদের কথা ভিন্ন। পুরুষের এই ন্যাচারটি যে নারী ধরতে পারেন এবং সে অনুযায়ী কৌশলী হয়ে ওঠেন, পুরুষের কাছে সে খুব সুন্দর আর সুখী হয়ে ওঠেন।
আল মাহমুদের গন্ধবণিক থেকে এরকম একটি চাওয়া মনের ভেতর উঠে আসে। আর কঠিন সত্যি কথাটি হচ্ছে, চাইলেই বাস্তবজীবনের কুলসুমকে পাওয়া যেতে পারে, কিন্তু ফিকশনাল কুলসুমকে? অলক্ষ্যে হয়তো কেউ পেয়ে গেলেও, তাকে চেয়ে কখনোই পাওয়া যায় না। অথচ ফিকশনের কুলসুম একজন পুরুষের ভেতর এতটা ভাস্বর হয়ে ওঠে যে তার রোশনীতে চোখ অন্ধ হয়ে যায়। এজন্যেই আল মাহমুদের ফিকশন অস্বস্তিকর, স্টিম্যুলেটিং। ফিকশনকে তার মতো জীবন ও বাস্তবঘনিষ্টভাবে বাংলায় আর কেউ লেখেননি। অতি-বাস্তবঘেষা টেক্সট ও কম্পোজিশনের কারণে আল মাহমুদের লেখা শুরুতে আনাড়ি লাগলেও, ধীরে ধীরে এই বিষয়টা আবিষ্কার হতে থাকে। ব্যাপারটা এমন যেন কোনো পুরুষ-চোখের সামনে অতি ধীরে একটি শ্যামলা মেয়ের বুক থেকে ওড়না নেমে যাচ্ছে।
৪.
একবার আমার বন্ধু তার জীবনের একটি মখমল ঘটনার কথা শুনিয়েছিল। কিশোরকালে তার সমবয়সী খালাতো বোনের সাথে খেলতে খেলতে হঠাৎ তার বুকে হাত লেগে গিয়েছিল। এবং তারপর—ছুঁয়ে দেখবার ইচ্ছেয় আরো একবার। তার নাকি মনে হয়েছিল পৃথিবীর সমস্ত মেঘ এসে তার হাতের মুঠোয় জমা হয়েছে। এই মেঘ নাকি তার ভেতরে নারীর প্রতি এক বিস্ময়, নিবিড় শ্রদ্ধা ও মমতা নিয়ে এসেছে।
নারীর বুক ছুঁয়ে দেখবার ইচ্ছে একজন পুরুষের মন অবশ করে রাখতে পারে। একটি নারীর কথা কথা মনে পড়লেই আমার সমুদ্রতীরে শুয়ে থাকবার অনুভূতি হয়। পীঠের তলে ভেজা বালির স্পর্শ আমাকে শান্ত করে রাখে। দুহাত ছড়িয়ে আমি আসমানের দিকে মুখ করে শুয়ে থাকি, কিছুক্ষণ পর পর ছোট ছোট ঢেউ এসে বুক পর্যন্ত ভিজিয়ে দেয়। সমুদ্রের উপর দিয়ে উড়ে আসা হু হু বাতাস আমার কানে মৃদু শিষ দিয়ে যায়। মনে হয় আমি সমুদ্রের ঢেউয়ের উপর শুয়ে আছি। আমার বুকের উপর একটা পাল বাতাসের টানে আমাকে ভাসিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। আমি ভাসছি। আমি ভেসে যাচ্ছি। ধীরে ধীরে নারীর কামনা স্তিমিত হয়ে নেমে আসে চোখে। ঘুমিয়ে পড়বার ঠিক আগ মুহূর্তে নিজেকে জাহাজের মাস্তুল থেকে ভেঙ্গে পড়া এক টুকরো ভাসমান কাঠের গুঁড়ি মনে হয়। ভাসতে ভাসতে কোনো এক অচেনা দ্বীপের বালিয়াড়িতে গিয়ে ভিড়বে—এই চিন্তার ভেতর ঘুম আসে। ঘুমের ভেতর দেখি আমি আমার প্রিয়তম নারীর বুকে জড়িয়ে আছি। আমাদের চারপাশে ফেনার মতো হাসনাহেনার সুবাস ভেসে উঠেছে। তার বুকের সমস্তটা আমাকে দলিল করে দিয়েছে সে—এমন এক অধিকারবোধে আমার সত্তা পূর্ণ ও নিশ্চিন্ত হয়ে আছে। আমি চেয়েছি, আমি পেয়েছি—এমন এক অসম্ভব কীভাবে যেন সম্ভব হয়েছে। আমি টের পাই, আমার বুকের ভেতরটা পরিপূর্ণ হয়ে গেছে প্রাপ্তি ও অর্জনের গৌরবে। যেন কৈশোরে দেখা আমার স্বপ্নগুলো সব হটাৎ করেই সত্যি হয়েছে।
আমি আমার প্রিয়তম নারীর বুকের সমস্তটা দুচোখ ভরে দেখি, হাত বুলিয়ে তাকে আরো কোমল করে তুলি। তৃষ্ণা মিটিয়ে চুমু খাই। সে চোখভরা প্রশান্ত আদর, অধিকার আর মমতা নিয়ে চেয়ে আছে আমার দিকে, মাথার চুলে হাত বুলিয়ে দিচ্ছে…
যেন সে মা মেরী, আমি কোলে শুয়ে থাকা যিশু—যেন আমি তার পরম স্নেহের শিশু।
৫.
আমাদের চারপাশে অসংখ্য ডেইজি ফুটেছে, তার উপরে রঙিন মথেরা উড়ছে। একটি মথ উড়তে উড়তে আমার দৃষ্টিকে উড়িয়ে নিয়ে যায় তার বুকের বাম দিগন্তে। সেখানে একটি শ্যামল তিল তার শরীর-সমুদ্রের মধ্যে একটি দ্বীপ হয়ে জেগে আছে। এই দ্বীপের মানচিত্র আমার আত্মস্থ, এই দ্বীপ আমি চিনি। অনেক বছর ধরে তিল তিল পরিচয়ে এখানে আমার আবাস গড়ে তুলেছি। এখানে পৌঁছবার জন্যেই আমি জীবন নামক জাহাজের মাস্তুল থেকে খসে পড়েছিলাম। অবধারিত এক বোধ বুকের ভেতর নিয়ে তীরের বালিয়াড়িতে হাঁটি, দূর সমুদ্রের দিকে চেয়ে বসে থাকি। আবার ভেসে আসবার অপেক্ষা করতে থাকি। একসময় আমার বুক ফুঁড়ে একটি স্নিগ্ধ আলো বের হয়ে সমুদ্রের হাওয়ায় দুলতে থাকে। তারপর আলো থেকে একটি হাস্যোজ্জল শিশুতে পরিণত হয়ে বীচের ভেজা বালিতে ছুটোছুটি করতে শুরু করে। হাঁটু গেড়ে বসে ঝিনুক কুড়ায়, উবু হয়ে কী যেন দেখে। আবার ছোটে। তীরে এসে ভেঙ্গে ভেঙ্গে পড়া ঢেউয়ের সাথে খেলায় নিমগ্ন এই শিশুটি কে? আমার অনাগত সন্তান? নাকি আমার ভেতরেই শৈশব থেকে লুকিয়ে যে শিশুটি থেকে গিয়েছিল, সে? আমি ঠাহর করতে পারি না। তখন হাওয়া এসে ভিজিয়ে দেয় সমস্ত গা, আমার চুল দাড়ি সব উড়তে থাকে। আরো ওড়ে সেই নারীটির শিফনের সাদা ওড়না, যেন শুভ্র মেঘে জড়াজড়ি করা এক টুকরো আকাশ সমুদ্রের তীরে নেমে এসে হাওয়ার কাছে বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে। নারীটিও অতি চঞ্চল এই শিশুটিকে একটুখানি পোষ মানাবার প্রচেষ্টায় পেছনে পেছনে ছুটছে। আমি মুগ্ধ হয়ে তাদেরকে দেখতে থাকি।
৬.
অপেক্ষা কি কখনো ফুরোয়? পাঁচ কি সাত বছর আগের কথা। বড় রাস্তার উপর আমি সাইকেল নিয়ে অপেক্ষা করতাম আমার বন্ধুর জন্যে। অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকবার পর একসময় মনে হতো আমি দূরের একদল হাওয়ার জন্যে অপেক্ষা করছি, যা আসার পথে আটকে গেছে কোনো বনে। একসময় আমি আমার বন্ধুর কথা ভুলে যেতাম এবং কী করবো বুঝে উঠতে পারতাম না। অপেক্ষা করব নাকি চলে যাব এমন এক দ্বিধাদ্বন্দ নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকতাম। কখনো এমন হতো যে আমি বাড়ি ফিরে যাওয়ার জন্যে রওনা করতাম এবং পথে মনে পড়ত আমি বন্ধুর জন্যে অপেক্ষা করছিলাম। আবার সেখানে ফিরে গিয়ে দেখতাম বন্ধু দাঁড়িয়ে আছে।
ছোটবেলায় আমি গাঁয়ের মক্তবে ভর্তি হয়েছিলাম দূরের মাদরাসায় যাবার আগে। মক্তবে যাবার পথে একটা পাকা পুল পড়ত। পুলের নিচ দিয়ে চলে যাওয়া ছোট্ট একটা খালে স্বচ্ছ টলমল হাঁটু জলে শাপলা ফুটত। ছোট ছোট শাদা পাপড়ির গায়ে ঈষৎ লাল সিঁদুরের আবহ থাকায় আমরা বলতাম হিন্দু-শাপলা। মাতাল করা একটা ঘ্রাণ লেগে থাকত এই শাপলায়। নাকের কাছে নিয়ে শুকলে মাথা ঘোরার মতো অনুভূতি হতো। সেই পুলের উপর আমি মিনিটের পর মিনিট দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করতাম রোজ। কী জন্যে? এখন মনে পড়ে না, তবে আমি প্রতিদিন দাঁড়িয়ে থাকতাম। আমার শিশুমন অকারণ কেন এই বিহ্যাভিয়ার করত, বড় হবার পর সেটা অনেক ভেবেছি। কীসের অপেক্ষা করতাম আমি? তবে অপেক্ষা করতাম, এটা ঠিক মনে পড়ে। পানিতে ছোট ছোট মাছ দেখা যেত। পুঁটিমাছের ঝাঁক খেলা করে বেড়াত, ছোট ছোট মাছগুলির রুপোলি পিঠ ঝিলিক দিয়ে উঠত যেন চোখের খুব কাছেই। আমার মক্তবে যেতে ইচ্ছে করত না। যারা দূর থেকে পড়তে আসত তারা মাদরাসায় থাকত। তাদের ভেতর কেউ কেউ চকের গুঁড়ো আর বৃষ্টির পানি দিয়ে ঘামাচির ওষুধ বানাত, ওরা ট্রাংক খুললেই তার গন্ধ এসে লাগত নাকে। আমার সেই গন্ধ ভালো লাগত না। মক্তব ঘরের পাশেই কাজীপেয়ারার ঝোঁপ গড়ে তুলেছিলেন বড় হুজুর। পেয়ারাগাছগুলোর চারা নাকি হুজুর সুদূর বরিশাল থেকে এনে লাগিয়েছিলেন। আমি বসে বসে অপরিপক্ব পেয়ারার কথা ভাবতাম। বতি হওয়া পেয়ারা গাছে থাকত না, ছিঁড়ে ফেলতেন। একবার বড় হুজুর রুমে ডেকে নিয়ে দুইটা ছোট সাইজের পেয়ারা দিয়েছিলেন। তার রুমে যেতে কেমন যেন ভয় লাগত। নানারকম তাবিজ-কবজের কাগজ ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকত বিছানা বালিশের পাশে। একবার ভয় পেলে আমাকে হুজুরের কাছে নিয়ে যাওয়া হলো। হুজুর পানিপড়া আর একটা তাবিজ দিলেন। সেই তাবিজ তখনো আমার গলায় ঝুলত। একটা পুরু রুপোর পাত, কালো তাবিজের সুতো দিয়ে বেধে দিয়েছিলেন গলায়।
বড় হবার পর আমি একটা সবুজ অরণ্যের অপেক্ষা করেছি। সেই অপেক্ষা ফুরিয়েছে। বাদবাকি সমস্ত অপেক্ষা দখল করে নিচ্ছে ধূসর ব্যাধির দিনেরা।
৭.
দিন বলতে আমার কাছে খুবই সংক্ষিপ্ত একটা কিছু মিন করে। সুবহে সাদিকে জেগে উঠি রোজ, পর্দা সরিয়ে ফ্লোরে শুয়ে থাকা ছাত্রদের ঘুম থেকে ডাকি—এই তালহা, ওঠো, ওঠো, সবাইকে ডেকে দেও… এই তালহা…
আমার কল্পনায় নিজের ভেতর ভোরের কোমল আলোয় ভিজতে শুরু করা একটি পাহাড়ি পথ দেখি, একাকিত্বে নিবিড় হয়ে আছে। সে পথ ধরে আমি হাঁটছি।
আমার অন্তরজুড়ে বিষাদ—ছড়িয়ে আছে, নরম হয়ে গলে পড়ছে সমস্ত উপত্যকায়। এই দেশে সূর্য ওঠে—আইসি সুগারের মতো মিহি আলো এসে পরে জানালায়। দিনের শুরু থেকে শেষ অবধি এই একটা ঘটনাই কেবল আমাকে প্রভাবিত করে। আমি আঙ্গুলে জড়িয়ে নেই, হাতের অপর পিঠে মুছে নেই আলো। ধুলোর নিহারিকা উড়তে থাকে—মনে হয় যেন কেমিস্ট্রি বই থেকে উঠে আসছে অজস্র আয়ন। দিন শুরু হয়, ঘুমিয়ে থাকা কলি থেকে আমার মনে ব্যথা ফোটে।