পোশাকের ধারণা আবর্তিত হয় সাধারণত স্টাইল, ফ্যাশন আর ঐতিহ্য এই তিন বিষয়কে ঘিরে। স্টাইল সাধারণত ব্যক্তি ও ব্যক্তিত্বের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকে। ঐতিহ্য সাধারণত গোষ্ঠী, আদর্শ এবং জাতীয় চৈতন্যের ভেতর দিয়েই প্রতিষ্ঠিত হয়। আর ফ্যাশন মানুষের দৈনন্দিন চাহিদার সঙ্গে মিলিয়ে প্রতিনিয়ত বদলাতে থাকে। ঐতিহ্য ও স্টাইলে ডেভেলপমেন্ট হলেও আহামরি বদল সাধারণত আসে না। কিন্তু ফ্যাশন কখনও কখনও পোশাকের পুরো ধারণাকেই বদলে দিতে পারে। আমাদের আজকের আলোচনা মূলত এই বিষয়কে কেন্দ্র করে নয়। ফলে এখানে বেশি শব্দ ব্যয় না করে মূল বিষয়ে প্রবেশ করতে চাইছি।
পৃথিবীর আদিমতম ব্যবস্যায়ের মধ্যে এবং দীর্ঘ সময় ধরে বলা যায় সভ্যতার সমান বয়স পর্যন্ত টিকে থাকবে যেই ব্যবসায় সেটা কাপড় ও পোশাকের বাণিজ্য। পৃথিবীতে মানুষ যতো বেড়েছে পাল্লা দিয়ে পোশাকের ব্যবসায় ফুলেফেঁপে উঠেছে। পৃথিবীর বহু দেশ এখন নিজেদের রাষ্ট্রীয় অর্থব্যবস্থাকে পোশাকশিল্পের উপর ভিত্তি করে পরিচালিত করছে। তৈরি পোশাক বাংলাদেশের অন্যতম প্রধান বৈদেশিক মূদ্রা আয়কারী খাত।
কাপড় ও পোশাকের ব্যবসায় বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে মানুষের রুচি ও চৈতন্যবোধকেও বদলে দেওয়া হয়েছে। ব্যক্তির দৈনন্দিন পোশাকের সঙ্গে আনুষ্ঠানিক ও ঘরোয়া পোশাকের ধারণাও তৈরি হয়েছে ব্যাপকভাবে। বণিকেরা নিজেদের ব্যবসায়কে বিস্তৃত করার জন্য মানুষকে নানাবিধ পোশাকে অভ্যস্ত করে তুলছে। অফিসের পোশাক, বাজারের পোশাক, বেড়ানোর পোশাক, ঘরের পোশাক এবং ঘুমানোর পোশাক অনেকেরই এক না। আলাদা আলাদা। ধর্মীয়, ভৌগোলিক এবং আরামগত কারণেও পোশাকের ভিন্নতা তৈরি হচ্ছে নানাভাবেই।
এইসব রকমারি পোশাকের ভেতর দিয়ে বিরাট এক বাজার তৈরি হয়েছে উৎসবকেন্দ্রিক পোশাকের। বিভিন্ন দিবস ও উৎসবকে কেন্দ্র করে পোশাকের ডিজাইন করা হচ্ছে। এমনও হচ্ছে যে, একটা পোশাকের উপযোগ শুধু এক দিনের জন্যই। মানুষ সেই পোশাকও খরিদ করছে। আবার পুরো বছরে একদিন পরেই সেই পোশাককে বাতিল করে দিচ্ছে। কেউ কেউ হয়তো পরের বছরের নির্দিষ্ট দিনটির জন্য রেখে দিচ্ছেন। কিন্তু দেখা যায় পরের বছর দীর্ঘ ব্যবহারহীনতাজনিত অথবা থিম বদলজনিত কারণে সেই পোশাক বাতিল করে নতুন পোশাক কিনতে হচ্ছে। বাজার অর্থনীতি এভাবেই আমাদেরকে রুচি ও চাহিদার চক্রে বন্দি করে দিচ্ছে। দখল করে নিচ্ছে আমাদের মনোজগত।
উৎসবকেন্দ্রিক পোশাক আবার কখনও কখনও সাংস্কৃতিক লড়াইয়ের অংশ হয়ে উঠে। ব্যবসা-বাণিজ্যের বাইরে সেই পোশাক আমাদের নিজস্ব সংস্কৃতির পথ প্রদর্শন করে। আবার কখনও কখনও বিদেশি সংস্কৃতির ওকালতি করে। আমাদের দেশে পোশাকের ক্ষেত্রে এই দেশি-বিদেশি ও জাতীয়-বিজাতীয় কালচারাল পোশাকের চোরা দ্বন্দ্বে বৈশ্বিকভাবে এখনও নিজেদের জাতীয় পোশাকের উপস্থাপনা করতে পারিনি। আবার ধর্মীয় জাতিবোধের যেই পোশাক তা নিয়েও আমাদের বিতর্কের শেষ নেই, কালচারাল বিতর্কের পাশাপাশি ধর্মীয় বিতর্ক তো আছেই। আছে আবার ব্যক্তি ও তার অনুসারীদের পোশাকচিন্তার বিতর্ক।
এহেন হযরবল পরিস্থিতিতে আমাদের এখানে পোশাকের বিভিন্ন ব্র্যান্ড নিজেদের মতো করে ফ্যাশন উপস্থাপন করছে। ফ্যাশনেবল পোশাকের বিরাট এক বাজার তৈরি হলেও ঐতিহ্য ও স্টাইলিশ পোশাকের ক্ষেত্রে আমাদের ওয়্যারহাউজগুলো বরাবরের মতোই পিছিয়ে। সারা বছর আমাদের ওয়্যারহাউজগুলো একটা কমন এজকে কেন্দ্র করে নিজেদের প্রমোশন করে যায়।
এই অঞ্চলের মানুষের ঐতিহ্য ও ধর্মগত রুচিবোধকে প্রাধান্য দিয়ে সাধারণত কোনো পোশাক কোম্পানির মার্কেটিং ক্যাম্পেইন তৈরি হয় না বললেই চলে। দেশীয় ফ্যাশনহাউজগুলোর প্রতি নকলের অভিযোগ তো আছেই। আবার পণ্যের দামের ক্ষেত্রেও থাকে বিরাট অভিযোগ। কেসস্টাডি হিসেবে যদি আড়ং ও ইল্লিয়্যিনকে আমরা সামনে আনি দেখব যে এদের পোশাক সাধারণের সামর্থ্যের চেয়ে বহুগুণ ঊর্ধ্বে।
এতে করে সাধারণ জনতার পোশাক বাজার ইন্ডিয়ান ও পাকিস্তানি কর্পোরেটরা দখল করে নিচ্ছে। নারীদের পোশাক ও পাঞ্জাবীর ক্ষেত্রে দেখা যায় পাকিস্তানি ও ইন্ডিয়ান প্রোডাক্টের জয়জয়কার। ফলে নিজস্ব ঐতিহ্য বলি বা গণমানুষের প্রচলন বলি কোনোটাই আমাদের নেই। ফলে আমাদের পোশাকের দৈশিক সীমানার বাইরে বৈশ্বিক পরিচয় কালচারাললি নাই বললেই চলে।
অপরদিকে আমাদের এই অঞ্চলে পুজোর জন্য স্পেশাল পোশাক ও স্পেশাল ডিজাইন তৈরি হয়। সেইসব পোশাক সেই ধর্মের মানুষের গায়ে দেখা যায়। তাদের ধুতিসহ পোশাকের সেন্স থেকেই আপনি তার ধর্মগত পরিচয় ও তার উৎসবের সময়টাকে ধরতে পারবেন।
পহেলা বৈশাখকে কেন্দ্র করেও আলাদা পোশাক, আলাদা ডিজাইন ও আলাদা থিমের পোশাক আমরা দেখি। বসন্ত উৎসবের জন্যও আলাদা পোশাক। গায়ে হলুদের জন্য আলাদা ড্রেস। তেমনিভাবে জাতীয় দিবস যেমন, স্বাধীনতা দিবস, বিজয় দিবস, শহীদ দিবস, শোক দিবস ইত্যাদির জন্যও আলাদা আলাদা পোশাকের ডিজাইন আমাদের ফ্যাশনহাউজগুলো করে থাকে।
এইসব এই অঞ্চলের মানুষের সাংস্কৃতিক সক্রিয়তার প্রমাণ। তাদের নিজস্ব কালচারাল রিপ্রেজেন্ট করার একটা প্রেরণা এইসব উৎসব ও দিবসের দিনগুলোতে দেখা যায়।
কিন্তু মুসলমানদের ঈদ উৎসবকে কেন্দ্র করে বিশেষ কোনো থিম বা বিশেষ পোশাকের ডিজাইন আমাদের ডিজাইনাররা করেন না। যেইটে করেন সেইটে কেবলই পোশাকের ডিজাইন। বিশেষ কিছু না। ফলে দেখা যায় প্রতি বছরেই বাজারে পপুলার হয় ইন্ডিয়ান কোনো পোশাক। অথবা কোনো সিনেমা ও সিরিয়ালের পোশাক। আমাদের ঈদে অনেক তরুণের গায়ে আবার দেখা যায় ইন্ডিয়ান পার্টি ড্রেস। পাজামা ও পাঞ্জাবির শৈলীতে মুসলিম ঐতিহ্যের প্রকাশের চেয়ে ভারতীয় পার্টি কালচারের প্রভাব তীব্রভাবে ফুটে উঠে। ফলে পোশাকের সঙ্গে সঙ্গে মননগতভাবেও তাদের মধ্যে ধর্মীয় উৎসবের ভাবগাম্ভীর্যের অনুপস্থিতি দেখা যায়।
আর এইসব ঐতিহ্য ও ধর্মীয় আধ্যাত্মিক চৈতন্যহীন পোশাকের সঙ্গে সঙ্গে এদের মনোজগতেও তৈরি হয় এক বিশাল শূন্যতা। যেখানে পরকালহীন এক ভোগবাদী জান্তার বসবাস। আমরা দেখি ঈদের দিন রাতে তরুণেরা জুয়া ও নেশার আসরে উপস্থিত হচ্ছে। পিকআপ ভ্যানে ডিজে পার্টি নিয়ে মানুষের জীবন ও রাস্তার পরিবেশকে বিপজ্জনক করে তুলছে। সেই সঙ্গে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে নিজেরাও।
গত রোজার ঈদে শুধু আমাদের কেন্দুয়াতে বাইক একসিডেন্টে পাঁচজন তরুণ ইন্তেকাল করেছে। অনেকেই বলবেন, পোশাকের আলাপে এইসব মৃত্যুর আলাপ কেন? হ্যাঁ, মনোজাগতিক পরিবর্তনটা আসলে বাইরে থেকেই শুরু করতে হয়। অথবা বলা যায় বাইরের পোশাকের রুচি চৈতন্যেই ভেতরগত বোধ তৈরি হয়। আমাদের পোশাকের যে সেন্স এটাতে এই কথা তো স্পষ্ট যে এখানে ধর্মীয় উৎসব ইবাদাহকেন্দ্রিক ভাবগাম্ভীর্য তা নেই কর্পোরেট ওয়্যারহাউজগুলোর। ফলে চেতনাগত বোধ তৈরির চেষ্টাও তাদের থাকে না। যার কারণ আমাদের আপাদমস্তক চৈতন্যই ফাঁপা।
এই বছর আমানত শাহ লুঙ্গির ডিজাইনে দেখলাম ঈদের একটা থিম তারা তৈরি করেছে। যদিও ঈদের পোশাক হিসেবে এখন আর লুঙ্গি চলছে না। প্রশ্ন হলো, আমাদের ঈদের পোশাকে ঈদ, ইসলাম ও ইসলামের আধ্যাত্মিক চৈতন্য কি থিমেটিকভাবে আনা উচিত? আনলে কি ভালো হবে? ব্যাপারটা কি দৃষ্টিগ্রাহ্য ও শোভন-স্বাভাবিক লাগবে?
এই প্রশ্নের উত্তরে আমার পার্সোনাল অবজার্বেশন হলো, ইসলাম কোনো পোশাকি কিংবা উৎসবনির্ভর জীবনব্যবস্থাই না। ফলে এখানে এইসব পোশাক ও পোশাকের থিম-কালচার বিশেষ কোনো ভূমিকাতেই থাকে না। বরং ইসলামের যে পোশাক সেন্স তা চিরায়ত। ফলে যে কোনো ধরনের বিশেষ আর্টিস্টিক থিম ছাড়াও ইসলামি পোশাক তার নিজস্ব অবয়বেই উৎসবের পোশাক হয়ে উঠতে পারে। আর তার এই শক্তির কারণেই আলাদা থিমের ঈদ পোশাকের প্রয়োজন মুসলিমদের হয় না।
কিন্তু প্রশ্ন যখন সাংস্কৃতিক অগ্রাসন, জাতীয় অর্থনীতি, নিজস্ব ঐতিহ্য, নিজেদের কালচার তখন এই ভাবনাটা জরুর ভাবা উচিত। যারা নিতান্তই ধর্মীয় আবহ, পরিবেশ, আমল, ইবাদাত, ইলম ইত্যাকার কারণে এই অঞ্চলের প্রচলিত ইসলামি কালচারাল পোশাকে ঈদ উৎসব উদ্যাপন করবেন; তারা তো ঐতিহ্য ও স্টাইলগতভাবেই নিজস্বতা ও মুসলিম কালচারে অভ্যস্ত হয়ে গেলেন। কিন্তু যারা কখনও নিজেদের আত্মপরিচয় নিয়ে কনসার্ন না; তাদের জন্য ঈদ উৎসবের থিমেটিক পোশাকের ভাবনা গুরুত্বপূর্ণ মনে করি।
কালচারাল লুকোচুরি দিয়ে কিংবা এদিক সেদিক থেকে ধার করা ফ্যাশন সেন্স দিয়ে আমাদের অন্তর্গত স্খলন রুখে দেওয়া সম্ভব না। ব্যক্তির জীবনে, ব্যবহারে, রুচিতে, আচরণে, স্বভাবে পোশাক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। ফলে, আমাদের উৎসবে আমাদের তারুণ্যের পোশাক, ফ্যাশন ও স্টাইল হোক একান্তই আমাদের। একান্তই মুসলমানদের।
অসাধারণ