ইতিহাস অস্বীকারের প্রবণতা : নেপথ্যের কারণ ও প্রতিক্রিয়া

মূল : মুহাম্মাদ ইসমাইল রেহান

হুসাইন আহমাদ খান

বর্তমান সময়ে আত্মচর্চা ও মুক্তচিন্তার নামে নিজেদের সীমিত অধ্যয়ন এবং ব্যক্তিগত ধারণার ওপর অন্ধবিশ্বাসের প্রবণতা বাড়ছে। এর ফলে জ্ঞান ও বুদ্ধিবৃত্তির ক্ষেত্রে নানা ধরনের বিভ্রান্তি ও পথভ্রষ্টতার সুযোগ তৈরি হচ্ছে। এসব বিভ্রান্তির মধ্যে সবচেয়ে বিপজ্জনক একটি প্রবণতা হলো ইতিহাস অস্বীকার করার প্রবণতা। যদিও সাধারণত ইসলাম এবং ইসলামের পবিত্র ব্যক্তিত্বদের সুরক্ষার উদ্দেশ্যে এ ধরনের প্রচেষ্টা প্রশংসনীয়, তবুও যখন তা পূর্বসূরিদের প্রজ্ঞাপূর্ণ জ্ঞানপদ্ধতি থেকে বিচ্যুত হয়, তখন তা সহজেই বিভ্রান্তিতে পরিণত হতে পারে।

ইতিহাস অস্বীকারের এই ফেতনায় জড়িতরা আকিদা রক্ষার আবেগে এমন কিছু ইসলামী উৎসকে প্রশ্নবিদ্ধ বা উপেক্ষা করছেন, যা আসলে দ্বীন ও ধর্মের ভিত্তি রচনা করেছে। ফলস্বরূপ, তাদের এই ভালো উদ্দেশ্যও দীর্ঘমেয়াদে ইসলামের মূল শিক্ষার প্রতি হুমকি হয়ে উঠতে পারে।

ইতিহাসকে অস্বীকার করার প্রবণতার কোনো বৈজ্ঞানিক ভিত্তি নেই। বরং এটি একধরনের চরমপন্থি চিন্তার প্রতিক্রিয়ায় উদ্ভূত। সেই চিন্তা হলো—ইতিহাসের বর্ণনার মান ও প্রামাণিকতা যাচাই না করে অন্ধভাবে সেগুলোকে গ্রহণ করা এবং ভুল ব্যাখ্যার মাধ্যমে ইতিহাসকে বিকৃতভাবে উপস্থাপন করা।

গত দুই-তিন শতাব্দী ধরে প্রাচ্যবিদরা ইসলামী ইতিহাসের উৎসগ্রন্থগুলো থেকে বিভিন্ন ঘটনা ভুলভাবে তুলে ধরেছে। যঈফ কিংবা মাওযূ (দুর্বল ও জাল) বর্ণনার ওপর ভিত্তি করে তারা ইসলামের পবিত্র ব্যক্তিত্বদের আক্রমণ করাকেও অভ্যাসে পরিণত করেছে। তাদের এই প্রবণতার প্রভাব এমনকি কিছু মুসলিম পণ্ডিতের মাঝেও দেখা গেছে। তারা ইতিহাসের প্রতিটি বর্ণনাকে নির্দ্বিধায় গ্রহণ করতে শুরু করেন এবং অতীতের ব্যক্তিবর্গ ও ঘটনাবলি সম্পর্কে অবিবেচনাপ্রসূত মন্তব্য করতে থাকেন। এমনকি তাদের এই মনোভাব সাহাবায়ে কেরামের পবিত্র জামাতকেও প্রশ্নবিদ্ধ করেছে।

এই বিভ্রান্তিকর প্রবণতার জবাব দিতে গিয়ে কিছু ব্যক্তি সাহাবায়ে কেরামসহ ইসলামের পবিত্র ব্যক্তিত্বদের রক্ষায় চরম আরেকটি অবস্থানে চলে গেছেন। তারা ইতিহাসের পুরো শাস্ত্রকেই বাতিল করে দিয়ে, সমস্ত ঐতিহাসিককে গোমরাহ, সাবায়ি দালাল, কিংবা ইসলামের শত্রু বলে আখ্যা দিচ্ছেন। তাদের দাবি হলো, “আমাদের জন্য কুরআন ও হাদিসই যথেষ্ট; ঐতিহাসিক বর্ণনাগুলো গ্রহণ করার কোনো প্রয়োজন নেই।”

এই দৃষ্টিভঙ্গি আপাতদৃষ্টিতে সরল মনে হলেও বাস্তবে এটি অত্যন্ত জটিল একটি বিষয়। কেউ যদি এ ধরনের ধারণাকে একটি নিবন্ধ, বক্তৃতা, বা বিবৃতির মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখেন, তবে তিনি হয়তো নিজেই বুঝতে পারবেন না, কত বড় একটি দাবি তিনি করে বসেছেন।

ইতিহাসকে অস্বীকার করার দাবির প্রকৃত সত্য তখনই উন্মোচিত হয়, যখন সেই দাবির জ্ঞানগত ভিত্তি খতিয়ে দেখা হয় এবং সেসব প্রশ্নের জবাব দেওয়া হয়, যা এই দাবির প্রতি স্বাভাবিকভাবেই ওঠে। কিন্তু অনেক সময়, এই প্রশ্নের মুখোমুখি হয়ে নিজের অবস্থান রক্ষার জন্য ব্যক্তি ইতিহাসকে পুরোপুরি প্রত্যাখ্যান করার পথ বেছে নেয় এবং শেষ পর্যন্ত পৌঁছে যায় হাদিস অস্বীকারের চরম পর্যায়ে। এটি কোনো কল্পিত আশঙ্কা নয়; বরং বাস্তব ঘটনা। আমি ব্যক্তিগতভাবে এমন লোকদের চিনি, যারা একসময় সম্পূর্ণ ইসলামি ইতিহাসকে মিথ্যা বলে দাবি করত, আর আজ তারা হাদিসের প্রতি আস্থা হারিয়ে শুধু কুরআনের আলোতে নিজেদের পথ খুঁজতে চেষ্টা করছে। কারণ, হাদিসের ভান্ডারও তাদের দাবি বা দৃষ্টিভঙ্গিকে সমর্থন করে না।

এই মানসিকতার একটি বাস্তব উদাহরণ হলো এক সাংবাদিক বন্ধু, যিনি ইয়াজিদ বিন মুয়াবিয়ার প্রশংসা করতে গিয়ে ইমাম বুখারীর বর্ণিত কনস্টান্টিনোপলের হাদিস উল্লেখ করছিলেন। (উল্লেখিত হাদিসটি সহিহ, এবং এটি প্রমাণিত যে ইয়াজিদ এই জিহাদের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন।) তবে আলোচনা অন্যদিকে প্রবাহিত করতে আমি বললাম, বুখারীতে তো এমনটাও উল্লেখ আছে যে ইয়াজিদের শাসনামলে মক্কায় কাবার ওপর আক্রমণ করা হয়েছিল। এমনকি সাহাবি আবু শুরাইহ (রা.) ইয়াজিদের গভর্নর আমর বিন সাঈদকে নিষেধ করেছিলেন, আর তিনি উত্তরে তাকে কঠোর কথা শুনিয়েছিলেন। [1]বুখারী: ৫৯২৪

আমার কথা শোনামাত্র ওই সাংবাদিক বন্ধু উত্তেজিত হয়ে বললেন, “কুরআনের বিরোধী এমন হাদিস আমরা বিশ্বাস করি না। ইমাম বুখারী তো অনেক শিয়াদের বর্ণনাও লিপিবদ্ধ করেছেন। এ ধরনের হাদিস আমরা গ্রহণ করি না।”

এই মানসিকতা বর্তমানে ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়েছে। বাস্তবে, ইনকারে তারিখ (ইতিহাস অস্বীকার) থেকে শুরু হওয়া এই প্রবণতা শেষ পর্যন্ত ইনকারে হাদিসে (হাদিস অস্বীকার) গিয়ে পৌঁছায়।

প্রকৃতপক্ষে, প্রতিটি যুগের ইতিহাস আমাদের দ্বীন বা ইসলামের সাথে সরাসরি সম্পর্কিত নয়। সময়ের বিবর্তনের সঙ্গে বিশ্ব পরিস্থিতি বদলেছে, ঘটেছে নানা ঘটনা, যার মূল্যায়ন একেক দৃষ্টিকোণ থেকে একেকরকম। একটি ঘটনাকে কেউ সত্য মনে করতে পারে, আবার অন্য কেউ তা মিথ্যা হিসেবে গ্রহণ করতে পারে। কোনো শাসক একদলের কাছে প্রশংসিত, অন্যের কাছে নিন্দিত।

তবে সমস্যা হলো, যেসব ইতিহাসকে আজ পুরোপুরি প্রত্যাখ্যান করা হচ্ছে, সেগুলোর মধ্যে রয়েছে হিজরি প্রথম থেকে তৃতীয় শতাব্দীর বর্ণনাগুলো। আর এই সময়ের ইতিহাসেই রয়েছে নবিজির ﷺ সিরাত, সাহাবায়ে কেরামের জীবনচরিত, এবং তাবেয়ি ও তাবে-তাবেয়িদের কর্মকাণ্ডের বিবরণ।

এই সময়ের ইতিহাসকে সম্পূর্ণরূপে বাতিল করার পর একজন ব্যক্তি হাদিস অস্বীকার থেকে বেঁচে থাকতে পারে না। কারণ, বহু বর্ণনাকারীকে আমরা প্রাথমিক ঐতিহাসিক উৎসগ্রন্থ যেমন তারিখে তাবারি, তাবাকাতে ইবনে সাদ, এবং আনসাবুল আশরাফ-এ পাই। একই ব্যক্তিদের আমরা সহিহ বুখারী, মুসলিম, মুয়াত্তা মালেক, আবু দাউদ, তিরমিজি, নাসায়ী এবং তাহাবী শরিফের মতো হাদিসের প্রসিদ্ধ গ্রন্থগুলোতেও পাই।

এ ছাড়া, কুরআনের তাফসিরের প্রাথমিক উৎসগুলোতেও এসব বর্ণনাকারীদের উল্লেখ বারবার এসেছে। সুতরাং, যদি প্রথম শতাব্দীর ইতিহাসকে সম্পূর্ণরূপে বাতিল ঘোষণা করা হয়, তবে ঐ বর্ণনাকারীদেরও অগ্রহণযোগ্য গণ্য করতে হবে। এটি স্পষ্ট যে, যাদেরকে ঐতিহাসিক বিষয়গুলোতে অবিশ্বস্ত মনে করা হয়, তাদেরকে হাদিস এবং কুরআনের তাফসিরের মতো আরও সংবেদনশীল ক্ষেত্রে নির্ভরযোগ্য বলে গণ্য করা অসম্ভব।

তাই ইতিহাস অস্বীকার করার এই প্রবণতা একবার শুরু হলে তা কেবল ইতিহাসে সীমাবদ্ধ থাকে না; বরং হাদিস এবং তাফসিরের মতো দ্বীনের মূল ভিত্তির ওপরেও আঘাত হানে। এই প্রবণতা শেষ পর্যন্ত ব্যক্তিকে এমন এক অন্ধকার গহ্বরে নিয়ে যায়, যেখানে সে নিজের বিশ্বাসের মূলে আঘাত করতে থাকে।

আকিদা-বিশ্বাস, ইবাদত-বন্দেগি এবং হালাল-হারামের যাবতীয় বিধিবিধানের মূল ভিত্তি তাফসির ও হাদিসের উপর দাঁড়িয়ে আছে। যদি কেউ ইতিহাসকে পুরোপুরি মিথ্যা বলে দাবি করে, তাহলে ঐতিহাসিক বর্ণনায় উল্লেখিত অনেক বর্ণনাকারীর দ্বারা বর্ণিত শত শত হাদিসও প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে যাবে। অথচ এইসব হাদিসই ইমাম বুখারী, ইমাম মুসলিম, ইমাম আহমাদ প্রমুখ মুহাদ্দিসগণ পূর্ণ আস্থার সাথে গ্রহণ করেছেন। এমনকি এই অবস্থান থেকে মুহাদ্দিসীন ও ফকিহগণকেও দ্বীনের মূলনীতি এবং রেওয়ায়েত-দেরায়াতের জ্ঞান সম্পর্কে অজ্ঞ ও সন্দেহজনক বলে অভিহিত করতে হবে। এর ফলে, বাকি যে বর্ণনাগুলো থাকবে, সেগুলোও জাল বা বানোয়াট হওয়ার আশঙ্কা থেকে মুক্ত থাকবে না।

এমনকি এমনও হতে পারে যে, কেউ এক ধাপ এগিয়ে এসব ইমামদেরকেই গোমরাহ, সাবায়ি ষড়যন্ত্রকারী বা ইসলামের নামেই বিভ্রান্তি ছড়ানো ব্যক্তিত্ব বলে দাবি করবে। ফলে, ইসলামী আকিদা ও বিধানের আর কোন উৎস অবশিষ্ট থাকবে, যার ওপর আমরা আস্থা রাখতে পারি?

উদাহরণস্বরূপ, হজরত হুসাইন ইবনে আলী রা.-এর শাহাদাতের ঘটনা। এটি তারিখে তাবারীতে এমন কিছু বর্ণনাকারীর মাধ্যমে বর্ণিত হয়েছে, যাদের অনেকেই দুর্বল বর্ণনাকারী হিসেবে পরিচিত। যেমন, আবু মিখনাফ ও হিশাম কালবী। এই কারণ দেখিয়ে কিছু লোক কারবালার ঘটনাকে পুরোপুরি কাল্পনিক বলে দাবি করছে এবং সেইসঙ্গে এই ট্র্যাজেডিতে তৎকালীন শাসকদের অত্যাচার ও বাড়াবাড়ি মেনে নিতে অস্বীকৃতি জানাচ্ছে। তাদের যুক্তি হলো, এসব ঘটনা কুরআনে বা হাদিসে বর্ণিত নয়; সুতরাং সেগুলো ঐতিহাসিক রচনার অংশমাত্র। তাদের মতে, খায়রুল কুরুনের (সর্বশ্রেষ্ঠ যুগের) লোকেরা এমন বর্বরতা করতে পারে না।

অন্যদিকে, ইমাম তাবারী এই ঘটনাটি এমন নির্ভরযোগ্য মুহাদ্দিস এবং বর্ণনাকারীদের মাধ্যমেও বর্ণনা করেছেন, যাঁরা সিকাহ বা প্রমাণযোগ্য হিসেবে পরিচিত। তাঁদের মধ্যে রয়েছেন হুসাইন বিন আবদুর রহমান, আবু আওয়ানা, সাঈদ বিন সুলাইমান আনফাসি আল-ওয়াস্তি ও ইবাদ বিন আওয়াম। এই বর্ণনাকারীদের হাদিস গ্রহণ করেছেন ইমাম বুখারী, ইমাম মুসলিম, ইমাম আবু দাউদ, ইমাম তিরমিজি এবং ইমাম নাসায়ী। এমনকি হাফেয ইবনে হাজার ও হাফেয যাহাবীর মতো সমালোচকরাও তাঁদেরকে সিকাহ বলে স্বীকৃতি দিয়েছেন। [2]দেখুন : তাকরীবুত তাহজীব, তারিখে বাগদাদ, সিয়ারু আলামিন নুবালা

যদি কারবালার ঘটনাকে পুরোপুরি কাল্পনিক হিসেবে ধরে নেওয়া হয়, তাহলে শুধু এই ঘটনাই বাতিল হবে না; বরং এই বর্ণনাকারীদের সমস্ত বর্ণনাও পরিত্যক্ত করতে হবে। এতে সীহাহ সিত্তার মধ্যে এমন বহু রেওয়ায়েতও অগ্রহণযোগ্য হয়ে যাবে, যা এই বর্ণনাকারীদের থেকে এসেছে। এ ধরনের মানসিকতা শুধু কারবালার ঘটনাতেই সীমাবদ্ধ নয়; বরং তারিখে তাবারীতে আরও বহু ঘটনা বর্ণিত হয়েছে, যা সীহাহ সিত্তার মুহাদ্দিসীনে কেরামের শায়খদের মাধ্যমে এসেছে। তাহলে কি সীহাহ সিত্তার সেই সমস্ত রেওয়ায়েতও প্রত্যাখ্যান করা উচিত নয়?

কথা শুধু তাবারী বা সীহাহ সিত্তার মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়। ইতিহাস ও জীবনী সম্পর্কিত যে সমস্ত গ্রন্থ তৎকালীন যুগে রচিত হয়েছে, সেগুলোও সন্দেহের মধ্যে পড়বে। উদাহরণস্বরূপ, সিরাতে ইবনে ইসহাক, সিরাতে ইবনে হিশাম, ফুতুহুল বুলদান, তাবাকাতে ইবনে সাদ, আনসাবুল আশরাফ, তারিখে খলিফা ইবনে খাইয়াত এবং তারিখুল মদীনা লি-ইবনে শায়বা

এই সমস্ত গ্রন্থে বর্ণিত বর্ণনাগুলোর বর্ণনাকারীদেরকে যদি হাদিস ও তাফসিরের কিতাবে অনুসন্ধান করা হয়, তাহলে শত শত রেওয়ায়েত পাওয়া যাবে, যেগুলো ইসলামের মৌলিক শিক্ষা—যেমন আকিদা, ইবাদত এবং শারীয়তের বিধানে ব্যবহৃত হয়েছে। সুতরাং, আজ যদি এইসব ঐতিহাসিক বর্ণনাকারীদের মিথ্যাবাদী বা কল্পকাহিনিকার হিসেবে সাব্যস্ত করা হয়, তবে এর ফলাফল হবে হাদিস ও তাফসিরের প্রতি আস্থা হারিয়ে ফেলা।

ইনকারে তারিখে’র পণ্ডিতদের প্রকৃত সমস্যা হলো, তাঁরা নিজেদেরকে সাহাবিদের একমাত্র রক্ষক বলে মনে করেন। তাঁদের এই প্রবণতা এতটাই বাড়াবাড়িতে রূপ নিয়েছে যে, তাঁরা নিজেদের যুক্তি, যা অধিকাংশ ক্ষেত্রে জ্ঞান ও প্রমাণশূন্য, সেটাকেই চূড়ান্ত বলে ধরে নেন। তাঁরা নিজেদের মতামতের বিপরীতে অবস্থানকারী অধিকাংশ আলেম ও অনুসারীদেরকে সাবায়ি ষড়যন্ত্রের শিকার বলে আখ্যা দিতে কুণ্ঠাবোধ করেন না।

তাঁদের এক প্রবক্তা তো এমন পর্যন্ত বলে বসেছেন (যা তাঁদের অনুসারীরা গর্বের সাথে প্রচার করেন) যে, “সাহাবিদের রক্ষা করার জন্য দরকার হলে আকাবিরের (প্রবীণ আলেমদের) মাথা নত করে দিন এবং পূর্বসূরিদের পাগড়ি খুলে ফেলুন।”

এই মনোভাব শুধু ইতিহাস অস্বীকার নয়; বরং এক চরমপন্থি মানসিকতার প্রতিফলন, যা ইসলামের ঐতিহ্যবাহী শিক্ষাকে ধ্বংস করার দিকে নিয়ে যাচ্ছে।

আমরা বলি, আকাবির ও পূর্বসূরিদের মাধ্যমেই আমরা সাহাবায়ে কেরামের মর্যাদা ও সঠিক পরিচয় পেয়েছি। তাদের শিক্ষা থেকেই আমরা সাহাবিদের সম্মান রক্ষা করতে শিখেছি। কিন্তু যদি উসূল ও মূলনীতি মেনে, পাণ্ডিত্যপূর্ণ ও গভীর আলোচনা করা হয়, তাহলে সাহাবিদের সম্মান রক্ষার জন্য আমাদের পূর্বসূরিদের সাবায়ি ষড়যন্ত্রের শিকার বলার কোনো প্রয়োজন হয় না। বরং এমন ভিত্তিহীন নীতির চর্চা করা হচ্ছে, যেখানে সাহাবিদের সম্মান রক্ষার নামে হাদিস ও কুরআনের সঠিক ব্যাখ্যাও ঝুঁকির মুখে পড়ে।

কিছু লোক সাহাবিদের সম্মান রক্ষার নামে এমন একটি নীতি অবলম্বন করেছে, যেখানে সাহাবিদের বিরুদ্ধে যেকোনো বর্ণনা বা ঘটনাকে সরাসরি প্রত্যাখ্যান করা হয়। তা সে আকাবির বা ইমামদের অভিমত হোক, ঐতিহাসিক বর্ণনা হোক, কিংবা সহীহ বা যঈফ হাদিস—সবকিছুকেই অবজ্ঞা করা হয়। অথচ তারা কখনো স্পষ্ট করে না যে, কোন বিষয়গুলো সাহাবিদের বৈশিষ্ট্যের অন্তর্ভুক্ত আর কোনটি মানবিক দুর্বলতা বা নিরুপায়তার ফল।

এ ধরনের প্রবণতা যদি বিশ্লেষণ করা হয়, তাহলে কেবল জঙ্গে জামাল ও সিফফীনের মতো ঘটনা নয়, বরং শত শত সঠিক রেওয়ায়েতও এই অদ্ভুত নীতির আওতায় প্রত্যাখ্যাত হবে। এমনকি কুরআনের যেসব আয়াতে সাহাবিদের নির্দিষ্ট ভুলগুলো তুলে ধরা হয়েছে, সেগুলোও এই নীতির আলোকে প্রশ্নবিদ্ধ হবে। যেমন, উহুদের যুদ্ধ থেকে কিছু সাহাবির পলায়ন, বদরের বন্দিদের বিষয়ে রাসুলুল্লাহ ﷺ-কে সতর্ক করা, ইত্যাদি।

যারা ইলমে অজ্ঞ, তারা এসব রেওয়ায়েতকে বানোয়াট বলে দাবি করতে থাকবে। তারা বিশ্বাস করবে না যে, হাতিব ইবনে আবি বালতার মাধ্যমে মক্কাবাসীদের কাছে গোপন তথ্য ফাঁসের চেষ্টা বা হজরত ওমর রা.-এর দ্বারা আবু হুরায়রাকে মাটিতে ঠেলে দেওয়ার মতো ঘটনাগুলো সত্য হতে পারে। সাহাবিদের জ্ঞানগত মতানৈক্যের বিষয়েও তারা সন্দেহ পোষণ করবে। উদাহরণস্বরূপ, হজরত আবু হুরায়রা রা.-এর ফতোয়া যে আগুনে রান্না করা খাবার খেলে অজু ভেঙে যায়, কিংবা হজরত আয়েশা রা.-এর মতে, বয়ঃসন্ধির পর স্তন্যপানের মাধ্যমে সম্পর্ক হারাম হয়ে যায়—এসব মতামতকে তারা সাহাবিদের মর্যাদার বিপরীত বলে মনে করবে।

এইভাবে তারা কুরআনের ঐ আয়াত— “তারা সঠিক পথপ্রাপ্ত”— এবং “তারা পরস্পর সহানুভূতিশীল”—এর বিপরীত ধারণা তৈরি করবে।

সবচেয়ে বড় কথা, মানুষকে ব্যাপকভাবে ইতিহাস অস্বীকার করা শেখানো যতটা সহজ, তাদের এই ফিতনার থেকে নিরাপদ রাখা ততটাই কঠিন। কারণ, এই নীতি ইতিহাসের ঘটনাগুলোকে শুধু নয়, বরং হাদিসের সত্যতার প্রশ্নও সামনে নিয়ে আসবে।

আমাদের আকাবির ও মুহাদ্দিসীন কখনো বলেননি যে, ইতিহাসের সমস্ত রেওয়ায়েতই গ্রহণযোগ্য। তারা পরিষ্কারভাবে বলেছেন, ইতিহাসের বর্ণনাগুলোতে সহীহ, দুর্বল, এমনকি মাওযূ রেওয়ায়েতও রয়েছে। তবে যেহেতু এগুলো সনদসহ সংরক্ষিত হয়েছে, সেজন্য মুহাদ্দিস ও আলেমগণ সত্য-মিথ্যা যাচাই করতে সক্ষম। এ কারণেই ইতিহাসের অনেক রেওয়ায়েতকে ইমামগণ নির্ভরযোগ্য বলে চিহ্নিত করেছেন।

ইতিহাস ও রিজালের গ্রন্থাবলির গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে আলোচনার সময় একটি বিষয় স্পষ্টভাবে বুঝে নেওয়া প্রয়োজন—এই গ্রন্থগুলোর সব রেওয়ায়েতই সর্বত্র দলিল হিসেবে গ্রহণযোগ্য নয়। আলেমগণ একমত যে, ঐতিহাসিক গ্রন্থগুলোতে সহীহ, যঈফ এবং কখনো কখনো মাওযূ রেওয়ায়েতও স্থান পেয়েছে। তবে ঐতিহাসিকরা সাধারণত মুহাদ্দিসদের নিয়ম অনুযায়ী সনদসহ বর্ণনাগুলো পেশ করেছেন, যাতে আলেমগণ সেগুলোর সহীহ বা দুর্বল হওয়ার ব্যাপারটি যাচাই-বাছাই করতে পারেন। এ কারণেই এসব গ্রন্থের অধিকাংশ বিষয়বস্তুকে জরাহ-তাদিলের ইমামগণ নির্ভরযোগ্য হিসেবে বিবেচনা করেছেন।

যদি কোনো আলেম দুর্বল রেওয়ায়েত সংগ্রহ করে থাকেন, সেটাও নিশ্চয়ই কোনো নির্দিষ্ট চিন্তা বা প্রয়োজন থেকেই করেছেন। অবশ্যই আকিদা, আহকাম ও সুনানের ক্ষেত্রে দুর্বল রেওয়ায়েত গ্রহণযোগ্য নয়। একইভাবে এমন সব দুর্বল বর্ণনা, যা ইসলামি আকিদার বিরোধিতা করে, বেদআতের সমর্থনে ব্যবহৃত হয় কিংবা পবিত্র ব্যক্তিত্বদের মর্যাদাহানিকর, সেগুলোও অগ্রহণযোগ্য।

তবে এর মানে এই নয় যে দুর্বল রেওয়ায়েত সবক্ষেত্রে অগ্রহণযোগ্য। ফাজায়েল ও মানাকিবের বর্ণনায় যঈফ হাদিস গ্রহণ করা যেমন মুহাদ্দিসদের মতে গ্রহণযোগ্য, তেমনি ঐতিহাসিক আলোচনায় প্রাসঙ্গিক দুর্বল রেওয়ায়েতও অনেকে গ্রহণযোগ্য বিবেচনা করেছেন। এই কারণে হাফিজ ইবনে কাসির, হাফিজ যাহাবী, ইবনে হাজার আসকালানী, ইবনে তাইমিয়া এবং ইবনে কাইয়্যিমের মতো প্রথিতযশা আলেমরাও এসব রেওয়ায়েতের ব্যবহার করেছেন।

যদি কেউ আহলে সুন্নাহ ওয়াল জামাআতের পথ অনুসরণ করতে চান, তাহলে ইতিহাসের গ্রন্থগুলোকে সেই সম্মান ও গুরুত্ব দিতে হবে, যা পূর্ববর্তী উলামারা দিয়েছেন। অন্যথায়, তার জন্য তার দাবির ভিত্তি রক্ষা করা কঠিন হয়ে পড়বে। এভাবে সন্দেহ থেকে শুরু করে অবশেষে হাদিস অস্বীকার পর্যন্ত গিয়ে পৌঁছানোর সম্ভাবনা তৈরি হবে।

এখানে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, হাদিস ছাড়া কুরআনের সঠিক ব্যাখ্যা দেওয়া সম্ভব নয়। আর হাদিসের ধারাবাহিকতা পুরোপুরি ইলমে রিজালের উপর নির্ভরশীল। রিজালের শাস্ত্রের ভিত্তি যদি দুর্বল হয়ে যায়, তাহলে কোনো হাদিসকেই সঠিকভাবে প্রমাণ করা সম্ভব নয়। এ কারণেই যারা ইলমে রিজালের প্রাথমিক গ্রন্থগুলো সংকলন করেছেন, তারা সেগুলোর নাম দিয়েছেন “তারিখ”। যেমন, ইমাম বুখারি তাঁর সংকলনগুলোর নাম দিয়েছেন আত-তারিখুল কাবির, আত-তারিখুল আওসাত, এবং আত-তারিখুস সগীর

তদ্রূপ, সাহাবায়ে কেরামের জীবনী এবং অবস্থান জানার জন্য যেসব গ্রন্থ রচিত হয়েছে, সেগুলোও রিজাল ও ইতিহাসের সমন্বিত প্রয়াস। যেমন, আল্লামা ইবনে আবদিল বার-এর আল-ইসতিয়াব, ইবনে আছির-এর উসদুল-গাবা, এবং হাফিজ ইবনে হাজার-এর আল-ইসাবা। এ সমস্ত গ্রন্থ ছাড়া সাহাবায়ে কেরামের অবস্থান এবং কর্ম সম্পর্কে আমাদের জ্ঞান অসম্পূর্ণ থেকে যাবে।

তবে ইতিহাস ও রিজালের বর্ণনাগুলোকে ওহির মতো চূড়ান্ত সত্য বলে গ্রহণ করা যেমন ভুল, তেমনি এগুলোকে সম্পূর্ণভাবে প্রত্যাখ্যান করাও চরম বাড়াবাড়ি। মধ্যপন্থা অবলম্বন করাই এখানে একমাত্র গ্রহণযোগ্য পথ। আলেমগণ এই রেওয়ায়েতগুলোর সহীহ-যঈফ বিচার করে যথাযথ গুরুত্ব দিয়েছেন। কিন্তু যারা এগুলোকে সরাসরি মিথ্যার সমষ্টি বলে দাবি করেন বা নির্বিচারে ইতিহাসবিদদের গালি দিয়ে সাবাঈ ষড়যন্ত্রকারী আখ্যা দেন, তারা প্রকৃতপক্ষে নিজেদের অজ্ঞতারই পরিচয় দেন।

তাই ইতিহাস ও রিজাল শাস্ত্র নিয়ে আলোচনা বা সমালোচনা করতে হলে আমাদের পূর্বসূরি ইমামগণের নির্ধারিত উসুল এবং পদ্ধতি অনুযায়ী এগোতে হবে। এ বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনার জন্য তাদরিবুর রাবি এবং আল-কিফায়া ফি ইলমির রিওয়ায়া-র মতো প্রামাণ্য গ্রন্থের সাহায্য নেওয়া যেতে পারে।

(মাহনামা শাহরাহে ইলম, জানুয়ারি-ফেব্রুয়ারি, ২০২০)

তথ্যসূত্র:

তথ্যসূত্র:
1 বুখারী: ৫৯২৪
2 দেখুন : তাকরীবুত তাহজীব, তারিখে বাগদাদ, সিয়ারু আলামিন নুবালা

বিজ্ঞাপন

Subscribe
Notify of
guest
0 Comments
Oldest
Newest Most Voted
Inline Feedbacks
View all comments

স্বত্ব © ২০২৩, যোগাযোগ | ই মেইল : jogajogbd.org@gmail.com

যোগাযোগ-এ প্রকাশিত কোনো লেখা, ছবি কিংবা শিল্পকর্ম লেখক অথবা কর্তৃপক্ষের অনুমতি ছাড়া কোথাও প্রকাশ করা অবৈধ৷