আল্লামা শিবলী নোমানী। ইমাম আজম আবু হানীফা, নোমান ইবনে ছাবিত রহিমাহুল্লাহর মতাবলম্বী হওয়ার কারণে তার সাথেসম্বন্ধযুক্ত করে নোমানী উপাধি ধারণ করেছিলেন। প্রাথমিক রচনাসমূহে তিনি মুহাম্মাদ শিবলী এবং পরবর্তীতে শিবলী নোমানী লিখতেন (সায়্যিদ সুলায়মান নদবী, হায়াতে শিবলী, পৃ : ৬৮)। জন্ম বিনদওয়াল (আজমগড়) ১৮৫৭ খ্রিস্টাব্দে। পিতা শায়খ হাবীবুল্লাহ ছিলেন একজন ধনী ব্যবসায়ী, স্বচ্ছল জমিদার ও সফল উকীল। তার বংশধারা একজন নওমুসলিম রাজপুত শায়খ সিরাজুদ্দীন (পূর্বনাম শূরাজ সিং) পর্যন্ত পৌঁছে। শিবলী ছিলেন তার সকল ভাইদের (মাহদী হাসান, মুহাম্মাদ ইসহাক’ ও জুনায়দ) মধ্যে জ্যেষ্ঠ। প্রাচীন পদ্ধতিতেই শিক্ষা সম্পন্ন করেন। শিক্ষকগণের মধ্যে মাওলানা মুহাম্মাদ ফারুক চিড়িয়াকূটি (মানতিক তথা যুক্তিবিদ্যা ও ন্যায়শাস্ত্রের উসতাদ) ও মাওলানা ফয়যুল হাসান সাহারানপুরী (আরবী সাহিত্যের উসতাদ)-এ দু’জনের দ্বারা তিনি সর্বাধিক প্রভাবিত হন।
শিক্ষা, জ্ঞান-বিজ্ঞান ও সাহিত্যের পেশা গ্রহণের পূর্বে শিবলী যথাক্রমে নকলনবিশী, খাদ্য গুদামের রক্ষণাবেক্ষণ, নীল উৎপাদনের ব্যবসায় এবং ওকালতির প্রতি মনোনিবেশ করেন। কিন্তু উক্ত পেশাসমূহের প্রতি তার মন বসে না। অবশেষে ১৮৮৩ খ্রিস্টাব্দে (১ ফেব্রুয়ারি) আলীগড় কলেজে আরবীর সহকারী অধ্যাপক নিযুক্ত হন এবং এই সূত্রে তিনি স্যার সায়্যিদ আহমাদ-এর ঘনিষ্ঠ সান্নিধ্যে এসে এমন একটি পেশায় নিয়োজিত হন যা ছিল তার প্রকৃতি ও যোগ্যতার যথার্থ অনুকূলে।
শিবলীর অবশিষ্ট জীবনের গুরুত্বপূর্ণ ঘটনাবলি হলো : আজামগড়-এ একটি ন্যাশনাল স্কুলের প্রতিষ্ঠা (১৮৮৩ খ্রিস্টাব্দ); নাদওয়াতুল উলামাার আন্দোলন ও উন্নতি বিধান, হায়দ্রাবাদে অবস্থান (১৯০১-১৯০৫ খ্রিস্টাব্দ) এবং জ্ঞান-বিজ্ঞান চর্চা ও আনজুমানে তারাক্কীয়ে উর্দুর পরিচালনা (জানুয়ারী ১৯০৩ খ্রিস্টাব্দ)।
দারুল উলুম নাদওয়ার সেক্রেটারি (১৯০৫-১৯৯৩ খ্রিস্টাব্দ), আন-নাদওয়া অর্থাৎ নাদওয়াতুল উলামার বই-পত্রের সম্পাদনা (১৯০৪-১৯১২ খ্রিস্টাব্দ), তামগা-ই মাজীদী লাভ, পায়ে আঘাত লাগার ঘটনা (১৭ মে, ১৯০৭ খ্রিস্টাব্দ), সন্তানদের প্রতি ওয়াকফ করার আইন প্রণয়ন এবং আরো অনেক শিক্ষা ও রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড ছাড়াও দারুল-মুসানিফীন-এর পরিচালনা। এর অধিকাংশ উদ্যোগ সম্পন্ন হতেই ১৮ নভেম্বর, ১৯১৪ খ্রিস্টাব্দে তিনি ইনতিকাল করেন (দেখুন : হায়াতে শিবলী, পৃ : ৬৯৯)।
শিবলীর অধিকাংশ রচনাই কালামশাস্ত্র, সাহিত্যের ইতিহাস ও ইতিহাস সম্পর্কিত। মাদ্রাসাতুল উলুম আলীগড়ে আগমনের পূর্বে তার লেখনীর ঝোঁক ছিল মাযহাবী আলোচনা ও বিতর্কের প্রতি। কিন্তু পরবর্তীতে স্যার সায়্যিদ আহমাদ খাানের তত্ত্বাবধানে খাঁটি ইলমী রচনার প্রতি মনোনিবেশ করেন। তিনি ১৮৮৩ থেকে ১৮৯৮ সাল পর্যন্ত মাদরাসাতুল উলুম-এর শিক্ষক ছিলেন। সেই সময়কার স্মরণীয় গ্রন্থ হলো : একটি মাছনবী; যার নাম সুবহে উমীদ (১৮৮৪ খ্রিস্টাব্দ), একটি ছোটো পুস্তিকা : মুসলমানু কী ওযাশতাহ্ তা’লীম (১৮৮৭ খ্রিস্টাব্দ), আল-মামুন : মামুনুর রশীদের জীবন ও কর্ম (১৮৮৭ খ্রিস্টাব্দ), যার দ্বিতীয় সংস্করণে স্যার সায়্যিদ আহমাদ ভূমিকা লিখে দিয়েছিলেন। এই গ্রন্থের আয় কলেজ তহবিলে জমা হতো, আল-জিজয়া ও কুতুবখানায়ে ইসকানদারিয়া (১৮৯৮ খ্রিস্টাব্দে শিবলী রচনাবলীতে প্রকাশিত এবং পৃথকভাবেও তা প্রকাশিত হয়েছে)। ১৮৯২ খ্রিস্টাব্দে শিবলী শাম (সিরিয়া), মিসর ও তুরস্ক ভ্রমণ করেন এবং সফরনামায়ে শাম ওয়া রুম নামে নিজের সফরের অভিজ্ঞতা বিবৃত করে একটি গ্রন্থ প্রকাশ করেন। ১৮৯৩ খ্রিস্টাব্দে সীরাতুন নো’মান নামে ইমাম আবু হানীফা (র)-এর জীবনী রচনা করেন। এরপর নিজের গুরুত্বপূর্ণ ইলমী অবদানস্বরূপ রচনা করেন আল-ফারূক : হযরত উমর (র)-এর জীবনীগ্রন্থ; ১৮৯৯ খ্রিস্টাব্দে যার রচনাকর্ম সমাপ্ত হয়।
হায়দ্রাবাদ অবস্থানকালে (১৯০১-১৯০৫ খ্রিস্টাব্দ) শিবলী কালাম শাস্ত্রের নতুন রূপ দানের প্রতি মনোনিবেশ করেন। আল-গাযালী (১৯০২ খ্রিস্টাব্দ), ইলমুলকালাম (১৯০৩ খ্রিস্টাব্দ), আল-কালামি (১৯০৪খ্রিস্টাব্দ) এবং সাওয়াানিহে মাওলানা রুমী (র.)—এই সময়েরই রচনা। এগুলো ব্যতীতও মুওয়াযানায়ে আনীস ওয়া দাবীর নামের একটি সাহিত্য সমালোচনামূলক গ্রন্থও হায়দ্রাবাদেই লিখিত।
১৯০৪ খ্রিস্টাব্দ ও ১৯১৪ খ্রিস্টাব্দ-এর মধ্যবর্তী সময়টি ছিল শিবলীর জন্য মানসিক পেরেশানির সময়। এই সময়ে রাজনৈতিক চিন্তা-ধারার প্রসার ও দরবারি পদসমূহের দায়িত্বে থাকার কারণে তার মানসিক অস্থিরতা বৃদ্ধি পায়। কিন্তু গ্রন্থ রচনার দিক থেকে এই সময় কালটিও অন্যান্য সময়ের তুলনায় কোনও অংশে কম ফলবর্তী ছিল না। বেশ কিছু প্রবন্ধ-নিবন্ধ ছাড়াও এই সময়ে তিনি শে’রুল আজম নামে পাঁচ খণ্ডে ফারসী কাব্যের এক বিশাল ইতিহাস রচনা করেন (প্রথম খণ্ড ১৯০৮ খ্রিস্টাব্দে প্রকাশিত হয়)। চার খণ্ড তার জীবদ্দশায় এবং পঞ্চম খণ্ডটি তার ইন্তিকালের পর প্রকাশিত হয়। গ্রন্থাদির মধ্যে ‘আওরঙ্গযেব আলমগীর পর এক নাজার’ও এই সময়ের (১৯০৮ খ্রিস্টাব্দ) অবদান। নাদওয়াতুল-উলামা থেকে পৃথক হয়ে যাওয়ার পর তিনি ১৯১৩ খ্রিস্টাব্দে তার জীবনের সর্বশ্রেষ্ঠ ও গুরুত্বপূর্ণ রচনা ‘সীরাতুন নাবী’র (সা.) সংকলন ও গ্রন্থনার প্রতি মনোনিবেশ করেন। কিন্তু কেবল প্রথম খণ্ড লেখা শেষ হতেই তার ইন্তেকাল হয়ে যায়। [সীরাতু’ন-নাবী (সা) পূর্ণ ছয় খণ্ডে সমাপ্ত। প্রথম খণ্ড ছাড়া বাকি সকল কাজ তার যোগ্য উত্তরসুরি সায়্যিদ সুলায়মান নাদাবী সম্পাদন করেন, যার পূর্ণতা সাধনে মাওলানা আবদুল-বারী নাদাবী ও মাওলানা হামীদুদ্দীনও কিছুটা সহায়তা করেছিলেন।]
শিবলী একজন অনুভূতিপ্রবণ লোক ছিলেন। যার কারণে তার চিন্তাধারায় বিভিন্ন সময়ে অদ্ভুত ধরনের পরিবর্তন লক্ষ করা যায় (প্রথমে ওয়াহাবী হানাফী বিবাদ; যার ফলশ্রুতি ছিল ইসকাতুল মু’তাদী নামের একটি পুস্তক। কবিতায় তার ‘দাগ’ পদ্ধতির অনুসরণ এবং ‘পয়াম যার’ গ্রন্থে তাসনীম ছদ্মনামে কাব্য চর্চা করা, অতঃপর ড. লাইম-এর ‘সিনীনা ইসলায়’ দেখে আধুনিক ইতিহাস চর্চার প্রতি মনোনিবেশ করা। এর পর স্যার সায়্যিদ আহমাদ দ্বারা প্রভাবিত হওয়া, অতঃপর অন্যান্য কারণে তার মতামতের প্রতি অসন্তুষ্টি প্রকাশ করা, মোটকথা তার জীবনে বিভিন্ন ধরনের প্রস্তাব ও পরিবর্তন দেখা যায়)। কিন্তু তার উপর সর্বাধিক গভীর ও তুলনামূলকভাবে অবিচল প্রভাব পড়ে মাওলানা মুহাম্মাদ ফারুক চিরয়া কুটী ছাড়াও স্যার সায়্যিদ আহমাদ খান-এরই; যার বন্ধুত্ব শিবলীর জন্য খুবই লাভজনক ছিল। শিবলী স্যার সায়্যিদ আহমাদ-এর গ্রন্থাগার থেকেও সবিশেষ উপকৃত হন। এ ছাড়াও তিনি কলেজের যোগ্য ইংরেজ শিক্ষক টি. ডব্লিউ আরনল্ড থেকে (যার নিকট তিনি ফরাসী ভাষা শিক্ষা করেছিলেন) সম্পাদনার পাশ্চাত্য পদ্ধতি শিক্ষা লাভ করেছিলেন। মোটকথা শিবলীর উপর আলীগড় ও স্যার সায়্যিদ-এর প্রভাব এতই সুস্পষ্ট যে, তা অস্বীকার করা ঐতিহাসিক ঘটনাকে অস্বীকার করারই নামান্তর। এ কথা ঠিক যে, পরবর্তীতে শিবলী ও স্যার সায়্যিদ-এর দৃষ্টিভঙ্গি ও চিন্তাধারায় কিছুটা পার্থক্য পরিলক্ষিত হয়। কিন্তু এই মতপার্থক্য কোনোরূপ ব্যক্তিগত ছিল না, বরং তা ছিল নীতিগত। প্রকৃতপক্ষে তার ও স্যার সায়্যিদ-এর মতবিরোধ ছিল দু’টি ভিন্নতর দৃষ্টিভঙ্গির মতভেদ, দুই ব্যক্তির বিবাদ ও বিরোধ ছিল না।
মোটকথা শিবলী আলীগড় আন্দোলনের একজন বিশিষ্ট পথিকৃৎ ছিলেন। ইলমের দিক দিয়ে তিনি স্যার সায়্যিদ ও আলীগড় আন্দোলন থেকে লাভবান হন। স্যার সায়্যিদ-এর তত্ত্বাবধানে তিনি যুক্তিবাদীদেরকে মধ্যমপন্থি বানানোর মোক্ষম সুযোগ পান। স্যার সায়্যিদ-এর প্রভাবে শিবলীও বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গির প্রতি আকৃষ্ট হয়ে পড়েন। এ কারণেই তার ও স্যার সায়্যিদ-এর দৃষ্টিভঙ্গিতে বহু বিষয়ে মিল পরিলক্ষিত হয়। যদিও পরবর্তীতে শিবলী স্যার সায়্যিদ-এর দৃষ্টিভঙ্গি হতে পিছু সরে যান, কিন্তু প্রকৃতপক্ষে এই পিছুটান ছিল স্যার সায়্যিদ আহমাদ-এর সীমাহীন রাজনৈতিক আপসকামিতা, মধ্যমপন্থা হতে বিচ্যুতি ও ‘প্রকৃতি নির্ভরতা’র কারণে, নতুবা মৌলিক দিক হতে শিবলী ও স্যার সায়্যিদ পরস্পর থেকে কখনও পৃথক হন নাই। উভয়ের মধ্যে পার্থক্য ছিল এই যে, শিবলী আধুনিক চিন্তাধারার অধিকারী হওয়া সত্ত্বেও কোনও অবস্থাতেই অতীতের রিওয়ায়াত থেকে বিচ্যুত হতে চাইতেন না, কিন্তু স্যার সায়্যিদ বেশীর ভাগ ক্ষেত্রে পুরাতন রিওয়ায়াতের বিরোধী ছিলেন। তার ইজতিহাদী চিন্তাধারাও ছিল একেবারে নিজের খেয়ালখুশি মতো। শিবলী ও স্যার সায়্যিদ-এর শিক্ষা বিষয়ক ও রাজনৈতিক চিন্তাধারাতেও এই ধরনের মতবিরোধ ছিল; যা স্যার সায়্যিদের জীবদ্দশায় অবশ্য সুপ্ত ছিল, কিন্তু পরবর্তীতে একেবারে প্রকাশিত হয়ে পড়ে, এমনকি শিবলীর বন্ধু মাওলানা আবুল কালাম আযাদ, সায়্যিদ সুলায়মান নাদাবী প্রমুখের মাধ্যমে তা একটি স্বতন্ত্র আন্দেলনের রূপ পরিগ্রহ করে।
লেখক হিসাবে শিবলীর সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ দিক হলো ঐতিহাসিক দিক। আল-মামুন, আল-ফারুক, তা’রীখী মাকামাত ওয়া মাজামীন এবং একদিক দিয়ে সীরাতুন-নাবী তার ঐতিহাসিক কর্মসমূহের বিরাট কীর্তি। তার ইতিহাস রচনার একটি বৈশিষ্ট্য এই যে, তিনি ইতিহাসকে সামাজিক দর্পণ হিসাবে দেখেন এবং ইতিহাসকে মানব চরিত্র গঠনের উপযোগী করে উপস্থাপন করেন। এটা ঠিক যে, তিনি কারলাইলের ন্যায় খ্যাতিমান ও বীরপুরুষদের (Heroes) জীবনীকে মানবেতিহাসের সমপর্যায়ভুক্ত বলেই মনে করতেন। কিন্তু তিনি ইতিহাসের সামাজিক দিককে উপেক্ষা করেন নাই।
শিবলী বাকলে (Buckle)-এর ন্যায় মানব ইতিহাসের উপর প্রাকৃতিক ও ভৌগোলিক প্রভাবের অনুসন্ধান করেছেন, যদিও তিনি এই ব্যাপারে ইবনে খালদুন থেকেও অবশ্যই উপকৃত হয়ে থাকবেন। তা ছাড়াও তান (Taine), কতেঁ (Comte), হেগেল (Hegel)—যাদের রচনা হতে তিনি সম্ভবত আরবী অনুবাদের মাধ্যমে অথবা স্বীয় ইংরেজি বিশেষজ্ঞ বন্ধুদের মাধ্যমে জ্ঞান লাভ করে থাকবেন—প্রমুখেরও প্রভাব ও ভাবধারা তার রচনায় দেখা যায়। শিবলী ইতিহাস সমালোচনায় জ্ঞান-বিজ্ঞানের মৌলনীতি ও যাচাই-বাছাইয়ের বিষয়টি প্রবর্তিত করেছেন। তিনি যেখানে মুসলমানদের ইতিহাস রচনার কিছু কিছু দোষত্রুটি তুলে ধরেছেন, সেখানে ইউরোপীয় ঐতিহাসিক, বিশেষত ইসলামের উপর লেখনী ধারণকারী ঐতিহাসিকগণের ত্রুটিবিচ্যুতিও নির্দেশ করেছেন। কিন্তু তিনি ইউরোপীয় পণ্ডিতবর্গের ও পাশ্চাত্যের জ্ঞানীগুণীদের জ্ঞান পদ্ধতির কথাও স্বীকার করতেন, স্বীয় রচনাবলীর বিভিন্ন স্থানে যার প্রকাশ লক্ষ করা যায়।
ঐতিহাসিক হিসাবে শিবলীর রচনাবলীকে উত্তর প্রদানমূলক ও কৈফিয়ত মিশ্রিত বলে উল্লেখ করা হইয়াছে (দেখুন : ‘আবদুল লতীফ, Influence of English Literature on Urdu Literature, পৃ : ১২১)। কোনও কোনও লেখকের মতে তার ইতিহাস কেবল দীন ও মাযহাবের খিদমতের জন্য উৎসর্গীকৃত ছিল (তানহা, সিয়ারুল মুসাননিফীন, ২খ., ২১৭)। এমনিভাবে এটাও বলা হয়েছে যে, তার উদ্দিষ্ট ব্যক্তিবর্গ ছিল কেবল আধুনিক শিক্ষায় শিক্ষিত ব্যক্তিবর্গ (আন-নাাজির এর ইনআমী প্রবন্ধ, দার তানহা, সিয়ারুল মুসকাননিফীন, পৃ. ৪২৫)। কিন্তু তার মধ্যে অধিকাংশ প্রশ্নই জোরদার বলে মনে হয় না। কারণ স্যার সায়্যিদ-এর বন্ধুবান্ধবদের মধ্যে সম্ভবত শিবলীই ছিলেন এমন একজন লেখক যার দৃষ্টিভঙ্গি অন্যান্যদের তুলনায় অধিক ইতিবাচক ছিল। এতদ্সত্ত্বেও এই কথা মানতেই হয় যে, শিবলী ইতিহাস রচনায় কখনও কখনও অতিরঞ্জনের আশ্রয় গ্রহণ করেছেন এবং এমন বর্ণনারীতি গ্রহণ করেছিলেন যার কারণে বাস্তব বিষয় ও ঘটনাবলির আসল রূপ ও সম্পর্ক পরিবর্তিত হয়ে গিয়েছে। শিবলীর ইতিহাস রচনা তার নিজের পক্ষ হতে টীকা সংযোজনের কারণেও ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, যা তার মূল বক্তব্যের বিভিন্ন স্থানে অনুপ্রবেশ করেছে এবং বর্ণনার ধারাবাহিকতা বাধাগ্রস্ত করা ছাড়াও ব্যক্তিগত দৃষ্টিভঙ্গির সম্পর্কহীন অথবা উত্তেজনাপূর্ণ পক্ষপাতের রূপ পরিগ্রহ করেছে। শিবলীর মূলনীতি (উসুল) ইতিহাসের ক্ষেত্রে আল-মামুন ও আল-ফারূক-এর ভূমিকা এবং ঐতিহাসিক প্রবন্ধ সমূহের কোনও কোনও অংশ অত্যন্ত কার্যকর তথ্য প্রদান করেছে। তা সত্ত্বেও সীরাতুন নাবীর ভূমিকা, ইতিহাস ও সীরাতে রাসূল (সা)-এর মূলনীতিসমূহ সম্পর্কে একটি গুরুত্বপূর্ণ দলীল-দস্তাবেজের পর্যায়ভুক্ত।
উর্দুতে শিবলীর জীবন-চরিত রচনার অবদানও সর্বজনস্বীকৃত। কিন্তু তার জীবন-চরিত রচনা স্বতন্ত্র ও উদ্দেশ্যমূলক নয়। তার লিখিত জীবন-চরিত জীবনী রচনার উদ্দেশ্যে নয়, বরং অন্য কোনও উদ্দেশ্যে তা প্রণীত হয়েছে। তাই আল-মামুন ও আল-ফারূক গ্রন্থদ্বয়ে জীবনীর তুলনায় ইতিহাসই বেশি। সীরাতুন নো’মান, আল-গাযালী, সাওয়াানিহে মাওলানা রুমী গ্রন্থে ইমাম আ’জম (আবু হানীফা), ইমাম গাযালী (র) .ও মাওলানা রুমী (র.)-এর জীবন-চরিত হতে অতিরিক্ত, তারা যেই সকল জ্ঞান ও শাস্ত্রের রূপকার ও পুরোধা ছিলেন তার ইতিহাস তুলে ধরা হয়েছে।
শিবলী উর্দু সাহিত্যের খুব উঁচু মানের সমালোচক ছিলেন। তার মুওয়াযানায়ে আনীস ওয়া দাবীর ও শে’রুল আজম গ্রন্থে কার্যকর সমালোচনার উত্তম নমুনা বিদ্যমান। মুওয়াযানায়ে আনীস ওয়া দাবীর গ্রন্থে বাক্যের নমুনা খুবই উৎকৃষ্ট। কিন্তু সমালোচনার মূলনীতি জটিল ও অস্পষ্ট (দেখুন : আহসান ফারুকী, মুওয়াাযানায়ে আনীস ওয়া দাবীর, রিসালায়ে সাকীতে, এপ্রিল ১৯৫৪ খ্রিস্টাব্দ)। শে’রুল আজম গ্রন্থে কবিতা ও কাব্য চর্চায় জযবা ও খেয়ালের বুনিয়াদি গুরুত্বের স্বীকৃতি বিদ্যমান, কিন্তু প্রত্যেক কবির কাব্য চর্চার বাছ-বিচার কোনও কোনও সময় এমনভাবে একই ধরনের হয়ে যায় যে, বিভিন্ন কবিদের মধ্যে পার্থক্য করা দুষ্কর হয়ে পড়ে। বহু ক্ষেত্রে শে’রুল আজম গ্রন্থে বাক্য চয়ন ও কবিতার ব্যাখ্যা খুব চমৎকার, কিন্তু তাতে ঘটনার মধ্যে বহু বিভ্রান্তি রয়েছে; যার ফলে গ্রন্থের গবেষণামূলক মর্যাদার যথেষ্ট ক্ষতি হয়েছে (দেখুন : শীরানী, তানকীদু শে’রিল আজম)।
শিবলীর সমালোচনার মূলনীতি (উসুল) তার সাহিত্যিক ও সমালোচনামূলক প্রবন্ধসমূহের বিভিন্ন স্থানে বিক্ষিপ্ত অবস্থায় পাওয়া যায়। যার দ্বারা তার সমালোচকসুলভ মন-মানসিকতা ও মূলনীতির প্রবণতা সম্পর্কে অবহিত হওয়া যায়। তিনি প্রবন্ধ-সমূহের বিভক্তিকরণের মাধ্যমে বিষয়গত অধ্যয়নের বড় বড় মূলনীতি তৈরি করেছেন। তাই তার প্রবন্ধসমূহে ইতিহাস, জীবনচরিত, আত্মজীবনী, সাহিত্য, অলংকারশাস্ত্র প্রভৃতি অধ্যয়নের গুরুত্বপূর্ণ মূলনীতি (উসুল) পাওয়া যায়।
শিবলীর প্রবন্ধরাজি, যা মোট ৮টি খণ্ডে প্রকাশিত হয়েছে, ইলমী আলোচনায় পরিপূর্ণ। তা সংক্ষিপ্ততা ও বর্ণনা মাধুর্যের কারণে খুবই জনপ্রিয়। কিন্তু তাতে Essay এর ন্যায় আনন্দঘন অবস্থা পাওয়া যায় না। তার প্রতিটি প্রবন্ধই কোনও না কোনও জ্ঞানগত প্রয়োজন পূরণ করে। কোনওটি কোনও গ্রন্থের সমালোচনা, কোনওটি কোনও ঐতিহাসিক ভুলের অপনোদন অথবা জ্ঞানজাগতিক কোনও প্রশ্নের জবাব।
শিবলী একজন উত্তম পত্রলেখকও ছিলেন। তার পত্রাবলি সাধারণত সংক্ষিপ্ত হতো; কিন্তু একইসাথে আনন্দদায়ক ও চিত্তাকর্ষকও ছিল বটে।
উর্দু গদ্যে শিবলীর অত্যন্ত উঁচু অবস্থান ছিল। তার গদ্যে স্যার সায়্যিদ-এর প্রতিষ্ঠানের গদ্যের অধিকাংশ বৈশিষ্ট্য পাওয়া যেত। যেমন সরলতা, অনাড়ম্বরতা, দ্বিধাহীনতা, প্রমাণ পেশ করা, যুক্তি প্রদর্শন প্রভৃতি। কিন্তু তার গদ্যরীতির গুরুত্ব প্রকৃতপক্ষে তার কয়েকটি ব্যক্তিগত বৈশিষ্ট্যের কারণেই। তার লেখনীতে অত্যন্ত আত্মবিশ্বাস ও আত্মনির্ভরশীলতা এবং আত্মপ্রত্যয় পাওয়া যায়। সংক্ষিপ্তকরণ তার গদ্যের বিশেষ গুণ, কিন্তু তার লেখার ইলমী মর্যাদা ও জ্ঞানীসুলভ আড়ম্বর দ্বারা পাঠকগণ খুবই প্রভাবিত হয়। শিবলীর বর্ণনায় আবেগও পাওয়া যায়। তার গদ্যে আবেগের কয়েকটি রূপ বিদ্যমান। তন্মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ হল রূপকের (ইসতি’আরা) ব্যবহার, যার দ্বারা তার বর্ণনায় মুবালাগা (অতিরঞ্জন)-এর রং সৃষ্টি হয়। এ কথা ঠিক যে, এর কারণে বাস্তব অবস্থার (হাকাইক) বর্ণনা অধিকাংশই দুর্বল হয়ে পড়ে, কিন্তু তার গদ্যের শক্তি ও গুণাশ্রিত হওয়ার রহস্যও অধিকাংশ ক্ষেত্রে এই রূপকের মধ্যেই সুপ্ত রয়েছে। তার রূপক বাক্যসমূহ ফারসী কবিতার রঙ্গীন শব্দভাণ্ডার থেকে সংগৃহীত হয়েছে। শিবলীর বর্ণনারীতিতে উল্লিখিত গুণাবলির সঙ্গে ইশারা-ইঙ্গিতের এক সুকোমল ও উত্তম ধারা পাওয়া যায়। তার মধ্যে চমৎকারিত্ব, অনাড়ম্বরতা ও ভাবপ্রবণতার উপকরণ একই সময়ে বিদ্যমান থাকে। ইশারা-ইঙ্গিতের এই বিষয় তার নিজস্ব এবং এ ক্ষেত্রে স্যার সায়্যিদ-এর সঙ্গীদের মধ্যে কেউই তার সমকক্ষ নন। অবশ্য তার বন্ধুবান্ধব ও অনুসারীবৃন্দ এই ব্যাপারে তার বিশেষ প্রভাব গ্রহণ করেছেন। শিবলী উর্দু সাহিত্যের বড় নির্মাতাদের অন্যতম ছিলেন। তিনি একজন দীনী চিন্তাবিদ, উর্দু ও ফারসীর উত্তম কবি, রাজনীতিবিদ, শিক্ষাবিদ, সাংবাদিক, প্রবন্ধকার এবং সর্বোপরি একজন উঁচু পর্যায়ের জীবনীকার ও ঐতিহাসিক ছিলেন। স্যার সায়্যিদ-এর সাথে তার সাদৃশ্য ছিল এই যে, তারা উভয়েই গ্রন্থ রচনা করেছেন। কিন্তু শিবলীর স্বাতন্ত্র্য ও বৈশিষ্ট্য হলো, বন্ধু-বান্ধব ও অনুসারীদের এমন একটি দলও তিনি সৃষ্টি করে গেছেন, যা শিবলী একাডেমী অথবা দারুল মুসাননিফীন (আজমগড়) নামে আজো রচনা ও বিভিন্ন সংকলনের কাজে নিয়োজিত রয়েছে। একটি ইলমী পত্রিকা (মা’আরিফ)-এর প্রচার ছাড়াও প্রতি বৎসর সুনির্ধারিত গ্রন্থ রচনা করে উর্দু সাহিত্যের ভান্ডারকে সমৃদ্ধ করে গেছেন। এই সাফল্য ও অর্জন শিবলীর একক। যা তাকে অনন্য উচ্চতায় সমাসীন করেছে।
আল্লামা শিবলী নোমানী উর্দু ভাষা ও সাহিত্যের এক আশ্চর্য জাদুকর। যার জাদুর প্রভাব আরও বহুকাল পাঠকদের আবিষ্ট করে রাখবে নিঃসন্দেহে।
গ্রন্থপঞ্জি :
১. সায়্যিদ সুলায়মান নাদাবী, হায়াতে শিবলী।
২. শায়খ মুহাম্মাদ ইকরামি, শিবলী নামাহ।
৩. শায়খ মুহাম্মাদ ইকরামি, মাওজ-ই কাওছার।
৪. মুহাম্মাদ আমীন যুবায়রী, যি’করে শিবলী।
৫. মুহাম্মাদ য়াহ’য়া তানহা, সিয়ারু’ল- মুসাননিফীন, ২য় খণ্ড।
৬. রামবাবু সাকসেনা, তা’রীখে আদাবে উরদু (মুহাম্মাদ ‘আসকারী অনূদিত)।
৭. রিসালা : আল-বাসীর (ইসলামিয়া কলেজ, চিনিউট, পানজাব, পাাকিস্তানি) শিবলী সংখ্যা।
পড়া হলো