আবারও ফিরব বলে

বদরুদ্দীন রাব্বানী

ফেরার তাড়না মানুষের ভেতর প্রবল৷ সবাই ফিরতে চায় বিভিন্ন টানে, বিভিন্নভাবে৷ কেউ সমস্ত অভিমান ভুলে প্রিয়তম হৃদয়ের কাছে, কেউ বিবিধ যাতনায় তাড়িত হয়ে মায়ের কোমল আঁচলে, কেউ অবোধ শৈশবে, কেউ বা ফেলে আসা কোনো স্মৃতির গহীনে৷ 

আমার ভেতর কখনো ফেরার তাড়না ছিল না, আমি কেবল ছুটেছি, পথে–প্রান্তরে আর নতুন নতুন স্মৃতিতে৷ জীবনের এই পর্যায়ে এসে মনে হলো আমারও ফেরা দরকার৷ কোথায়? মায়ের আঁচলে নাকি ফেলে আসা কোনো স্মৃতির গহীনে? শৈশবে সারাদিন খেলাধুলা করে ক্লান্ত হলেই ঘরে ফিরতাম চুপিসারে, লুকিয়ে লুকিয়ে৷ জীবনের নিঠুর জার্নিতে ক্লান্ত, শুধু মনে হয় ফেরা দরকার৷ বেলা তো কম হলো না, সেই কবে বাড়ি ছেড়েছিলাম৷ তখন সকাল৷ সবুজ পাতার উপর ঠিকরে পড়ছে সূর্যের সোনালি আলো৷ কাঁধে ব্যাগ ঝুলিয়ে ধানক্ষেত ধরে আমি হাঁটছি৷ পেছনে পড়ে আছে বাড়ি, একটি নিস্তরঙ্গ পুকুর আর আম্মার বিষাদমাখা–মুখ৷ আমার কি দুখ জেগেছিল হৃদয়ের কোথাও? আর কখনো সেভাবে বাড়ি ফিরতে না পারার বেদনায় আমি কি বিবশ হয়েছিলাম? জানি না৷ শুধু মনে আছে একটি নতুন জগতের উন্মাদনা পরাস্ত করে রেখেছিল বাড়ি–ছাড়ার বেদনা৷ শুধু তৈরি হয়েছিল বিবিধ শূন্যতা, মনে হয়েছিল আমি হারিয়ে ফেলব কুয়াশা–মোড়ানো সকাল, বাঁশঝাড়ে ছুটোছুটি করতে থাকা চড়ুইয়ের দল, সন্ধ্যায় ক্লান্ত হয়ে মায়ের কোলে ফিরতে পারব না বলে কেঁদে উঠেছিল হৃদয়ের গহন কোণ৷ 

আমার ভেতর ফেরার তাড়না না থাকলেও একটা সুপ্ত আশা ছিল, নিশ্চয়ই একদিন আমি ফিরব৷ কখন, কীভাবে? জানা ছিল না৷ শুধু মনে হতো আমার ফেরাকে কেন্দ্র করে জেগে উঠবে আমাদের বাড়ি৷ একদিন আমার ভেতরের সুপ্ত সেই আশাটাও নেই হয়ে গিয়েছিল৷ জীবনের প্রথম রক্তদান করি, মুমূর্ষু এক রোগীকে৷ রক্তদানের পর আমার কিছুই হয়নি, এটা প্রমাণ করতে হাঁটাহাঁটি, দুষ্টুমি শুরু করি৷ হঠাৎ মনে হলো চরম বিরক্ত কোনো বিড়াল আমার মাথা খামচে ধরেছে৷ আমার চোখ ধীরে ধীরে বুজে আসছে৷ রেড ক্রিসেন্টের আলোকিত বারান্দা মনে হলো ডুবে যাচ্ছে প্রাচীন কোনো অন্ধকারে৷ আমি কি মরে যাব? এত ছোট বয়সেই? আমার দেখা হলো না কতকিছু৷ জীবনে একবার সমুদ্র দেখার ইচ্ছে হয়েছিল, শেষমেশ প্ল্যান ভেস্তে যায়, আর কখনো সমুদ্র–দর্শন কেন্দ্র করে প্ল্যান সাজানো হবে না৷ সেই বয়সেই ষোড়শী কোনো রমণীকে নিজের করে পাওয়ার স্বপ্ন দারুণভাবে আমাকে আলোড়িত করত, আধো–অন্ধকারে তুমুল গল্পে তার ভেতর হারিয়ে যাওয়ার স্বপ্ন তাহলে অধরাই থেকে যাবে? আমি আর কখনো আম্মার মুখ দেখতে পারব না! আমাদের নিস্তরঙ্গ পুকুর আর অ–পঠিত সমস্ত বই তেমনই থেকে যাবে? এতসব ভেবে তখন, সেই কঠিন সময়ে আমি মনখারাপ করে ফেলি!

এক সহপাঠী বলেছিল, জীবনে আমার নাকি কোনো পিছুটান নেই, কিসের যেন তাড়া৷ পিছুটান কী, আমি হয়ত পুরোপুরি বুঝে উঠতে পারি না বা বুঝে উঠলেও সময় লাগে৷ কিন্তু অদ্ভুতভাবে লক্ষ্য করি, দীর্ঘ বাস জার্নিতে জানালার পাশে প্রতিবারই আমি বজ্রাহতের মতো বসে থাকি৷ তারা–ভরা আকাশ, বিস্তৃত দিগন্তে ঝুলে থাকা নিশ্ছিদ্র নীরবতা কিম্বা দূরের আবছা আলো আমাকে তৃপ্তি দেয় না৷ একটা জায়গায় এসে গোপন প্রতিজ্ঞাগুলো স্ব–শব্দে  জেগে ওঠে হৃদয়ের কোথাও, এদিকেই আমার ফেরার কথা, তবু ছুটে চলেছি কোথায়, কোন অজানায়? আমার ফেরা হয় না বলে কি কেঁদে ওঠে কোনো ঘর? স্বপ্নের পাখি? আমার হাহাকার লাগে৷ মনে হয় তীব্র হচ্ছে ফেরার তাড়না, আর আমার প্রতিজ্ঞাগুলো স্ব–শব্দে জেগে উঠছে অদ্ভুত এক নৈঃশব্দের ভেতর, আমি ফিরব বলে…

পড়াশোনা করে অনেক বড় হবো বলে বাড়ি ছেড়েছি আজ পনেরো বছর হলো৷ জীবন থেকে হারিয়ে গেছে কতকিছু৷ বাড়ি থেকে কিছুটা দূরে একটি নীরব নিঃশব্দ জমিনে চিরদিনের জন্য আব্বা শুয়ে আছেন, তার পাশে শুয়ে আছে ফুটফুটে ছোট্ট শিশু—আমার ভাতিজি, যাকে আমার দেখা হয়নি কোনোদিন; জন্মের কিছুদিনের ভেতরই সে চলে যায় চিরস্থায়ী ঠিকানায়৷ আমাদের চিরচেনা সেই বাড়িটাও আর নেই, নদীর বাঁধ ভেঙে ছোটখাটো বন্যা হলেই যে বাড়ি ডুবে যেত৷ উঠোনের ফুলগাছ কিম্বা পুকুরপাড়ের লেবু–ঝাড়, বিরান হয়ে গেছে৷ বাড়ির কথা ভাবলেই আমার ভেতর হাহাকার করে৷ একটা সুখী পরিবারের সদস্যরা জীবনের নিদারুণ চক্রে বিক্ষিপ্ত হচ্ছে দিগ্বিদিক, এটা আমি ভাবতে পারি না৷ আমার ভাবনায় শুধু ভেসে ওঠে একটা সুন্দর সকাল, আম্মা বাড়ির পেছনের পর্দাঘেরা চুলায় বসে রান্না করছেন আর মক্তবপালানো আমি গুলাইল নিয়ে সন্তর্পণে বেড়িয়ে যাচ্ছি পাখির পেছনে, হঠাৎ পকেটে থাকা মার্বেল ঝনঝন করে ওঠে, আম্মা আমাকে দেখে ফেলেন কিন্তু কিছু না বলেই চুলায় খড় গুঁজে দিতে থাকেন৷

বিজ্ঞাপন

Subscribe
Notify of
guest
7 Comments
Oldest
Newest Most Voted
Inline Feedbacks
View all comments
টির্ধম
টির্ধম
6 months ago

আহ কী গদ্য রে—

মুহাম্মদ উমর ফারুক
মুহাম্মদ উমর ফারুক
6 months ago

আপনার লেখাটিই প্রথম পড়লাম। পঁচিশের প্রথম সংখ্যা আসছে, আপনার পোস্ট থেকেই জানতে পেরেছি।

Alizah Mohammad Samaneen
Alizah Mohammad Samaneen
6 months ago

চমৎকারভাবে অনুভূতি ব্যক্ত করেছেন।

Alizah Mohammad Samaneen
Alizah Mohammad Samaneen
6 months ago

চমৎকারভাবে অনুভূতি ব্যক্ত করেছেন।

ASHRAFUJJAMAN ZAKARIA
ASHRAFUJJAMAN ZAKARIA
1 month ago

জীবন ঘনিষ্ঠ গদ্য!

মুস্তাফিজ তামীম
মুস্তাফিজ তামীম
1 month ago

বেশি করে লিখতে পারেন না? 😔

তা মি ম
তা মি ম
1 month ago

কোথাও হারিয়ে যাচ্ছি গদ্যের ঢেউয়ে…

স্বত্ব © ২০২৩, যোগাযোগ | ই মেইল : jogajogbd.org@gmail.com

যোগাযোগ-এ প্রকাশিত কোনো লেখা, ছবি কিংবা শিল্পকর্ম লেখক অথবা কর্তৃপক্ষের অনুমতি ছাড়া কোথাও প্রকাশ করা অবৈধ৷