আধুনিকতাবাদের অগ্রদূত : সাইয়িদ জামালুদ্দিন আফগানি (দ্বিতীয় পর্ব)

মওলবি আশরাফ

আধুনিকতাবাদের অগ্রদূত : সাইয়িদ জামালুদ্দিন আফগানি (প্রথম পর্ব)

আবার হিন্দুস্তান

১৮৮০ সালে তিনি প্রথমে হায়দরাবাদে নিজামের দরবারে আসেন। এখানকার সামরিক প্রধান সাইয়িদ হাসান বলগ্রামি ও ধর্মমন্ত্রী রসুল ইয়ার খান মহিউদ্দৌলার সাথে তার খুব ভালো সম্পর্ক ছিল। এখানে প্রায় দুই বছর অবস্থান করেন। এই সময় তিনি স্যার সৈয়দের আপসনীতি ও কোরআনের বিজ্ঞানবাদী ব্যাখ্যার সমালোচনা করেন। আলিগড়পন্থীদের চিন্তাভাবনা রদ করে তিনি ‘মুয়াল্লিম’ পত্রিকায় ধারাবাহিক লিখতে থাকেন, যা পরবর্তীতে ‘রদ্দে ন্যাচারিয়াত’ নামে বই আকারে প্রকাশ পায়। একই সাথে পশ্চিমাদের বস্তুবাদী চিন্তার বিরুদ্ধে কলম ধরেন, এবং ইসলামের শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণ করেন। তিনি হিন্দুস্তানের মুসলমানদেরকে গোলামির শিকল ভেঙে আজাদ হওয়ার অনুপ্রেরণা দিতে থাকেন। ব্রিটিশ সরকার তার এই কর্মতৎপরতাকে ‘বিদ্রোহ’ বিবেচনা করে। 

ওদিকে সাইয়িদ আফগানি মিশরে বিপ্লবের যে বীজ বুনে এসেছিলেন, তা বৃক্ষ হয়ে ফল দিতে শুরু করে। আরাবি পাশা ছিলেন সাধারণ একজন সিপাহি, তিনি সাইয়িদ আফগানির চিন্তায় উজ্জীবিত হয়ে নিজেকে উন্নত অবস্থানে নিয়ে যান। এক পর্যায়ে কর্নেল হন। ১৮৮২ সালে তিনি বিদ্রোহ করেন, এবং তার নেতৃত্বে সেখানে ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে সশস্ত্র প্রতিরোধ সংগ্রাম শুরু হয়। এ অবস্থায় ব্রিটিশরা সাইয়িদ আফগানিকে হিন্দুস্তান ত্যাগের অনুমতি দেওয়া বিপজ্জনক মনে করে, আবার তার হায়দরাবাদ অবস্থানকেও সন্দেহের চোখে দেখে। হায়দরাবাদ থেকে মিশরে যেন কোনো সাহায্য পাঠাতে না পারে, তা নিশ্চিত করার জন্য তাকে ব্রিটিশ ভারতের রাজধানী কলকাতায় নজরবন্দি করে রাখা হয়।

কিন্তু কলকাতায় গিয়ে তিনি চুপ হয়ে বসে থাকেননি। তিনি সেখানকার শিক্ষিত মুসলমানদের সচেতন ও জাগ্রত করতে চেষ্টা করেন। তিনি ভারতের মুসলমানদের সামনে ইসলামের আলোকে মুক্তির নতুন দিগন্ত উন্মোচিত করেন। তার চিন্তাধারা এ সময় হিন্দুস্তানের বিরাটসংখ্যক মুসলমানকে বিপ্লবের সাহস জোগায়। 

ফ্রান্স অবস্থান ও আল উরওয়াতুল উসকা

আরাবি পাশা আলেকজান্দ্রিয়া ও তেল আল কবিরের যুদ্ধে পরাজিত ও বন্দি হয়ে সিংহলে নির্বাসিত হন। এরপর সাইয়িদ আফগানিকে হিন্দুস্তান ত্যাগ করার অনুমতি দেওয়া হয়। তিনি প্রথমে কাবুলে যান। আমির আবদুর রহমান তাকে স্বাগত জানান। সাইয়িদ আফগানি দেশকে আসন্ন সংকট থেকে উদ্ধার করার জন্য কিছু পরামর্শ দেন। আমির তাকে বিভিন্নভাবে সম্মান জানালেও তার কথা শুনতে আগ্রহী ছিলেন। তিনি যখন বুঝতে পারলেন এখানে সময় ব্যয় করা মোটেও ফলদায়ক না, তখন হিন্দুস্তানের পথ ধরে লন্ডনের উদ্দেশ্যে রওয়ানা দেন। সেখান থেকে ১৮৮৩ সালের শেষদিকে তিনি ফ্রান্সের রাজধানী প্যারিসে গিয়ে পৌঁছান। 

প্যারিস ছিল তখন পৃথিবীর নানান দেশের সব রাজনৈতিক নির্যাতনে শিকার ব্যক্তিদের আশ্রয়কেন্দ্র। ওদিকে মিশর থেকে সাইয়িদ আফগানির খাস শাগরেদ মুহাম্মদ আবদুহ নির্বাসিত হন। দুজনে প্যারিসে মিলিত হন। তারা সেখানে ‘আল উরওয়াতুল উসকা’ নামে একটি সংগঠন তৈরি করেন। তুর্কি, মিশর, সিরিয়া, তিউনিসিয়া, আলজেরিয়া, মরক্কো, ইরান ও হিন্দুস্তানের বৈপ্লবিক চেতনার লোকজন এর সদস্য হন। এবং এর জন্য হায়দরাবাদ, মিশর ও তিউনিসিয়া থেকে আর্থিক সহায়তা আসত। 

সাইয়িদ আফগানি সব সময় বিশ্বাস করতেন পত্রপত্রিকা সাধারণ মানুষের চিন্তাভাবনাকে প্রভাবিত করতে বড় ধরনের ভূমিকা রাখে। এই ভাবনা থেকেই তাদের বিপ্লবী আন্দোলনের মুখপত্র হিসেবে সংগঠনের নামেই একটি আরবি সাপ্তাহিকী প্রকাশ করতে থাকেন। ১৩ মার্চ ১৮৮৪ সালে এই ম্যাগাজিনের প্রথম সংখ্যা প্রকাশিত হয়। এর একদিকে ‘মুদিরুস সিয়াসাহ’ (রাজনৈতিক সম্পাদক) হিসেবে সাইয়িদ আফগানির নাম, আরেকদিকে ‘মুদিরুত তাহরির’ (ভাষা সম্পাদক) হিসেবে মুহাম্মদ আবদুহর নাম থাকত। 

‘আল উরওয়াতুল উসকা’ ম্যাগাজিন খুব অল্প সময়ের মধ্যে এশিয়া ও আফ্রিকার দেশে দেশে মুসলিম সমাজে আলোড়ন সৃষ্টি করে এবং স্বাধীনতাকামী মানুষের বলিষ্ঠ কণ্ঠস্বরে পরিণত হয়। তাতে ইংরেজরা আতংকিত হয়। তারা মিশর ও হিন্দুস্তানে পত্রিকাটির প্রবেশ নিষিদ্ধ করে। তারপরও বন্ধ লেফাফায় ডাকযোগে এ পত্রিকাটি হিন্দুস্তানে বেশ কিছু গ্রাহকের হাতে পৌঁছত। নানা বাধার মধ্যে সাত মাসে ১৮ সংখ্যা প্রকাশিত হওয়ার পর ১ অক্টোবর পত্রিকাটি বন্ধ হয়ে যায়। কিন্তু ইংরেজবিরোধী স্বাধীনতা আন্দোলনে এ স্বল্পস্থায়ী পত্রিকা বিপুল প্রভাব ফেলে। 

সাইয়িদ আফগানি ফ্রান্সে প্রায় ৩ বছর ছিলেন। এ সময় তার সাহিত্য, সাংবাদিকতা ও রাজনৈতিক কর্মতৎপরতা নিয়োজিত ছিল ‘আল উরওয়াতুল উসকা’ কেন্দ্র করে। তার এসব কাজ যে অনর্থক হচ্ছে না, তা তিনি চোখের সামনেই দেখতে পাচ্ছিলেন। 

রাশিয়ায় প্রথম সফর 

ব্রিটিশদের সাম্রাজ্যবাদী নীতি পর্যবেক্ষণ করে সাইয়িদ আফগানি বুঝতে পেরেছিলেন মুসলিম অধ্যুষিত অঞ্চলগুলোকে তারা কখনোই একতাবদ্ধ হতে দেবে না। তাদের মূল তদ্বিরই হলো ভাগ করা ও শাসন করা। এক্ষেত্রে কাঁটা দিয়ে কাঁটা তুলতে হবে, অর্থাৎ ব্রিটিশদের দমন করতে তাদের সমপর্যায়ের শক্তি লাগবে। এরই সূত্র ধরে তিনি ১৮৮৫ সালে রাশিয়ার রাজধানী সেন্ট পিটার্সবুর্গে যান।

রাশিয়া মুসলমানদের মিত্র ছিল না। তারা ক্রমশ মুসলিম এলাকাগুলো গ্রাস করেছিল। ১৮৫৯ থেকে ১৮৬৪ সালের মধ্যে ককেশাস এবং ১৮৮৬ সালের মধ্যে উজবেকিস্তান রুশ পদানত হওয়ার ফলে রুশদের থাবা আফগান ও ইরান ভূখণ্ডের প্রান্তসীমা স্পর্শ করেছিল। এমন পরিস্থিতিতে সাইয়িদ আফগানির রাশিয়া সফর ছিল খুবই সাহসী ঘটনা। 

সাইয়িদ আফগানি রাশিয়ায় মাত্র কয়েক মাস ছিলেন, কিন্তু তিনি যে উদ্দেশ্য নিয়ে গেছিলেন তা সফল হয়নি। তিনি আবার প্যারিসে ফিরে যান।

ইরান শাহের দাওয়াত

১৮৮৬ সালে ইরানের শাহ নাসিরুদ্দিন কাজার তারযোগে সাইয়িদ আফগানিকে তেহরান যাওয়ার দাওয়াত দেন। বছরের শেষদিকে তিনি তেহরান গিয়ে পৌঁছান। শাহ তাকে রাজকীয় সংবর্ধনা জানান। এরপর তার কাছে ইরানের উন্নয়নের জন্য একটি কর্মপরিকল্পনা তৈরি করতে বলেন।

সাইয়িদ আফগানির অধঃপতিত ইরানের জন্য প্রশাসন ও বিচারব্যবস্থার সংস্কারের লক্ষ্যে নীতি ও কাঠামো প্রণয়ন করেন। ব্রিটিশ তোষণ ও তাদের অন্যায় সুযোগ-সুবিধা প্রদানের বিপক্ষে কথা বলেন। শাহ তার এই স্পষ্টবাদিতা পছন্দ করেননি। এমনকি তার কর্মপরিকল্পনা গ্রহণ করার জন্যও প্রস্তুত ছিলেন না। ইতোমধ্যে দরবারের কিছু লোক শাহকে এই কানপড়া দেয়—এই লোক তার জাদুময় বক্তৃতা দিয়ে জনগণকে আপনার বিরুদ্ধে উস্কে দিচ্ছে, তার মূল উদ্দেশ্য আপনাকে কুরসি থেকে নামানো। এর সাথে মিশরে তার ইসমাইল পাশার বিরুদ্ধে জনতাকে ক্ষেপিয়ে দেওয়ার গল্প বলে। শাহ তাদের কথায় প্রভাবিত হয়ে তাকে ইরান ত্যাগ করতে বলেন। 

রাশিয়ায় দ্বিতীয় সফর 

১৮৮৭ সালে তিনি ইরান থেকে রাশিয়ার মস্কোর উদ্দেশে যাত্রা করেন। সেখানে প্রসিদ্ধ এক পত্রিকার সম্পাদকের সাথে সাক্ষাৎ করেন, যার নাম কাতিকফ। তিনি তার সাথে ইংরেজদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ও মুসলিম দেশগুলোর সাথে সম্পর্ক তৈরির লাভ নিয়ে আলোচনা করেন, এবং এই বিষয়ে জারের সাথে আলাপ করতে অনুপ্রেরিত করেন। কিন্তু দুঃখজনক বিষয় হলো সেই সম্পাদক আচমকা মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েন। তাই এ বিষয়ে এই দফাও তিনি ব্যর্থ হন। এরপর তিনি সেন্ট পিটার্সবুর্গ চলে যান। সেখানে দীর্ঘদিন অবস্থান করেন।

তবে একটা কাজের কাজ হয়, আর তা হলো—তার অনুরোধেই জার নিকোলাস মুসলমানদেরকে ধর্ম পালনে স্বাধীনতা দান করেন। এর আগে রাশিয়ার মুসলমানদের জন্য কোরআন শরিফ ও অন্যান্য ইসলামি বইপত্র প্রকাশ করা ছিল বেআইনি। সাইয়িদ আফগানি এ ব্যাপারেও রুশ সরকারের কাছ থেকে অনুমতি আদায় করতে সমর্থ হন।

জার্মান সফর 

১৮৮৯ সালে তিনি জার্মানের মিউনিখে যান। এখানে ইরানের শাহের সাথে তার আবার দেখা হয়। শাহ তাকে ইরান যাওয়ার আমন্ত্রণ করেন এবং তাকে প্রধানমন্ত্রিত্বের পদ দেওয়ার আশ্বাস দেন। সাইয়িদ আফগানি প্রথমে এই প্রস্তাবে একদম রাজি ছিলেন না, কিন্তু কিছু ভালোদিক বিবেচনা করে রাজি হয়ে যান। 

শাহ তাকে ইরানের সাথে রাশিয়ার মৈত্রী সম্পর্ক স্থাপনে কাজ করতে বলেন। তিনি তখন জার্মান থেকে রাশিয়ার দিকে রওয়ানা দেন।

রাশিয়ায় তৃতীয় সফর 

এই দফা তিনি ইরানের প্রতিনিধি হয়ে রাশিয়ার মন্ত্রী পর্যায়ের বেশ কয়েকজনের সাথে বৈঠক করেন। তিনি ইরান-রুশ সম্পর্কে নতুন মাত্রা তৈরিতে ভূমিকা রাখেন, এবং এই আশ্বাস দেন—ইরান তাদের প্রাচ্যের বন্ধু। 

ইরানে অবস্থান ও ইনকিলাব

তিনি তার উদ্দেশ্যে সফলকাম হওয়ার পর ইরান যান। কিন্তু বহুদিন অপেক্ষা করার পরও শাহের সাথে দেখা করতে পারছিলেন না। তিনি শাহকে একটি চিঠি পাঠিয়ে তার সফলতার কথা বলেন। ফিরতি চিঠিতে শাহ তাকে শুধুমাত্র ‘শুকরিয়া’ জানান। অথচ কথা ছিল তাকে প্রধানমন্ত্রীর পদ দেওয়া হবে। তিনি বুঝতে পারেন আবারও দরবারি ষড়যন্ত্রে শিকার হয়েছেন। ইত্যবসরে শাহের সাথে সাক্ষাৎ হলে তিনি তাকে তেহরান ছেড়ে ‘কুম’ চলে যাওয়ার জন্য বলেন। কিন্তু তিনি কুম না গিয়ে তেহরান থেকে ১০ মাইল দূরে একটি খানকা—দরগাহে শাহ আবদুল আজিমে আশ্রয় নেন। এখানে প্রায় সাত মাস অবস্থান করেন, এবং সংস্কারের গুরুত্ব সম্পর্কে জনগণকে উদ্বুদ্ধ করতে থাকেন। 

তার বক্তব্যের প্রভাবে সেখানকার সংস্কারকামী দলগুলো একত্রিত হয়ে প্রকাশ্যে আন্দোলন চালাতে থাকে। তিনি তার এক বক্তব্যে বলেন :

‘জালেম ও মজলুম—দুই শ্রেণিই আমার দুশমন। জালেম দুশমন এই কারণে যে, সে জুলুম করে। আর মজলুম এই কারণে দুশমন—তারা জুলুম সহ্য করে জালেমের হাতকে শক্তিশালী করে তোলে।’ 

এই ধরনের বক্তব্যের প্রভাবে যা হওয়ার তা-ই হয়। মানুষের মনে বিক্ষোভের আগুন ছড়িয়ে পড়ে।

১৮৯০ সালে ইরান সরকার ইংরেজদেরকে তামাক ব্যবসায়ের একচেটিয়া সুযোগ দিয়েছিল। দেশের সম্পদ ইসলামের শত্রুদের হাতে তুলে দেওয়ার বিরুদ্ধে জনতা প্রতিবাদ জানায়। সরকারের অপশাসন ও নিষ্ঠুরতা এবং ইংরেজ তোষণের বিরুদ্ধে প্রবল আন্দোলন ও প্রতিরোধ গড়ে ওঠে। এ প্রতিরোধের ফলে সরকার ইংরেজদের সাথে তামাক চুক্তি বাতিল করতে বাধ্য হয়। এরপর ইরানের সংস্কার আন্দোলন বিশেষ শক্তিশালী হয়ে ওঠে এবং দেশের ধর্মীয় নেতারা এ আন্দোলনের সাথে একাত্ম হন।

নাসিরুদ্দিন শাহ কাজার যে ভয়ে ছিলেন, দিনশেষে তা-ই হয়। তিনি এর জন্য পুরোপুরি সাইয়িদ আফগানিকে দায়ী করেন। ১৮৯১ সালের শুরুর দিকে তাকে অসুস্থ অবস্থায় গ্রেফতার করা হয়, এবং শৃঙ্খলিত অবস্থায় ইরান-তুর্কি সীমান্তবর্তী শহর ‘খানিকিন’-এ পাঠিয়ে দেওয়া হয়। 

বাগদাদ ও বসরায় অবস্থান

খানিকিন থেকে তিনি বাগদাদ, এরপর বাগদাদ থেকে বসরায় চলে যান। এই সময় তিনি পত্রযোগে ইরানের বিপ্লবীদের উৎসাহ-উদ্দীপনা জোগাতে থাকেন। এর মধ্যে তুর্কি থেকে সুলতান তাকে দাওয়াতনামা পাঠান, কিন্তু তিনি এই মুহূর্তে তুর্কি যাওয়া নিজের জন্য সমীচীন মনে করেননি। ফিরতি চিঠিতে নিজের অপারগতা জানিয়ে তিনি লন্ডনের উদ্দেশে রওয়ানা দেন।

তিনি লন্ডনে গিয়ে পত্রপত্রিকায় লেখালেখির মাধ্যমে ইরানের বিপ্লবী গোষ্ঠীকে সমর্থন জুগিয়ে যাচ্ছিলেন। এরই প্রভাবে ১৮৯৬ সালে জালেম শাসক নাসিরুদ্দিন শাহকে বিপ্লবীরা হত্যা করে। 

সুলতানের ফাঁদ 

১৮৯২ সালে, সাইয়িদ আফগানি তখন ইংল্যান্ডে, সেখানে নিয়োজিত তুর্কি রাষ্ট্রদূত রুস্তম পাশার তরফ থেকে একটি শাহি ফরমান হাতে পান। এই ফরমান পাঠিয়েছেন সুলতান আবদুল হামিদ সানি। সুলতানের দিলের তামান্না, তিনি সাইয়িদ আফগানির সাথে একবার মোলাকাত করবেন। কিন্তু সাইয়িদ আফগানি ওজর পেশ করে চিঠি পাঠান। সুলতান আবার চিঠি পাঠিয়ে তাকে দ্রুত আসবার তাড়া দেন। তিনি এবার ফিরতি চিঠিতে বলেন, আমি যেতে পারি, কিন্তু দ্রুতই ফিরে আসব। 

তিনি যখন ইস্তাম্বুল পৌঁছান, সুলতান আগের চেয়ে জাঁকজমকপূর্ণভাবে তাকে অভ্যর্থনা জানান। তুর্কি ওলামায়ে কেরামও তাকে অনেক খাতিরদারি করেন। তার জন্য আলিশান অট্টালিকা, এবং মাসিক ৭৫ লিরা (বর্তমান প্রায় ৫০ লক্ষ টাকা) বরাদ্দ করা হয়। তিনি যখন এই অবস্থা দেখেন, তুর্কিতে থেকে যাবার মনস্থির করেন। কিন্তু এই সবই ছিল ফাঁদ। সুলতান মূলত তাকে নজরবন্দি করে রাখার জন্যই এভাবে ডেকে পাঠিয়েছিলেন। 

ইন্তেকাল

এই সময় তার চোয়ালে ক্যান্সার ধরা পড়ে। সুলতান তার চিকিৎসার ব্যবস্থা করেন। চিকিৎসক জামিল পাশা তার ছয়টি দাঁত তুলে ফেলেন। তবু তার অবস্থার কোনো উন্নত হলো না। তিনি উন্নত চিকিৎসার জন্য দেশত্যাগের অনুমতি চান, কিন্তু সুলতান অস্বীকৃতি জানান। পাঁচ বছর বন্দিজীবন কাটানোর পর, ১৮৯৭ সালের ৯ মার্চ তিনি ইন্তেকাল করেন। ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি র-জিউন। নিশানতাশের কবরস্তানে এ মর্দে মুমিনের লাশ দাফন করা হয়।

দার্শনিক চিন্তাধারা

মাওলানা আবুল হাসান আলি নদবি তার ‘মুসলিম মামালিক মেঁ ইসলামিইয়াত অওর মাগরিবিইয়াত কি কাশমাকাশ’ গ্রন্থে লিখেন : 

আল্লামা ইকবাল তার ব্যাপারে অনেক উচ্চধারণা রাখতেন। তিনি মনে করতেন, পশ্চিমা সভ্যতা-সংস্কৃতির বিবর্তন মুসলিমমানসে যে বিভ্রান্তি ও বিশৃঙ্খলা উস্কে দিয়েছিল, তা নিয়ন্ত্রণে সাইয়িদ আফগানির যথেষ্ট ভূমিকা ছিল। তিনি একদিকে মুসলমানদের প্রাচীন বিশ্বাস, চিন্তাদর্শন ও আখলাকি ব্যবস্থা, অন্যদিকে আধুনিক মতবাদের ভিত্তিতে গড়ে ওঠা বিভিন্ন কাঠামোর মাঝে যে বিশাল দূরত্ব ছিল, তা কমিয়ে এনেছিলেন। 

ড. আমিনুল ইসলাম তার ‘ইসলাম ধর্ম ও মুসলিম দর্শন’ গ্রন্থে লিখেন :

‘আফগানির দার্শনিক ও ধর্মতাত্ত্বিক মতাবলি বিশিষ্ট জার্মান দার্শনিক হেগেলের (১৭৭০-১৮৩১) কথা স্মরণ করিয়ে দেয়। আফগানির জন্ম হেগেলের মৃত্যুর ৮ বছর পর। সময়ের দিক থেকে কাছাকাছি বলেই হয়তো হেগেলের দর্শনের মূলে যে ধর্মতত্ত্ব ও ইতিহাস চেতনা খুঁজে পাওয়া যায়, ঠিক অনুরূপ চেতনা লক্ষ্য করা যায় আফগানির চিন্তার অন্তরালে। ঈশ্বরপিতা, ঈশ্বরপুত্র ও পবিত্রাত্মার সমবায়ে গঠিত খ্রিষ্টীয় ত্রিত্ববাদকে হেগেল যেমন ব্যাখ্যা করেছেন নয়-প্রতিনয়-সমন্বয় (thesis-antithesis-synthesis) ত্রয়ী বিকাশের ধারায়, ঠিক তেমনি আফগানি যথার্থ ইসলামের মর্মবাণীকে তুলে ধরার চেষ্টা করেছেন অবক্ষয়ের সম্মুখীন আধুনিক মুসলমানদের একমাত্র অনুকরণীয় আদর্শ হিসেবে। হেগেল ও আফগানি উভয়েই তাদের ধর্মকে ব্যবহার করেছেন দার্শনিক মতবাদের সমর্থনে এবং দুজনেই নিজস্ব দার্শনিক মতকে যুক্তিযুক্ত করতে চেয়েছেন ধর্মের বাস্তব, প্রগতিশীল ও কল্যাণকর দিকটির আলোকে। এজন্যই তাদের উভয়ের দর্শনেই অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িয়ে আছে ধর্মীয় মূল্যবোধ ও ইতিহাস চেতনা।

আফগানির মতে, ধর্মের যথার্থ শিক্ষা এবং ঐতিহাসিক বিবর্তনের আলোকে রচিত জীবনদর্শনই সত্যিকার প্রগতির সোপান। সভ্যতা ও প্রগতির স্বাভাবিক অগ্রযাত্রার পক্ষে ধর্মের ভূমিকা শুধু গুরুত্বপূর্ণ নয়, অপরিহার্যও বটে। ধর্ম ও ইতিহাস সম্পর্কে এ মতবাদ তিনি রচনা করেছেন জড়বাদীদের খণ্ডন নামক ফারসি ভাষায় রচিত তার দার্শনিক গ্রন্থে। এ গ্রন্থে তিনি প্রাচীনকাল থেকে শুরু করে তাঁর সমসাময়িক পাশ্চাত্য ও প্রাচ্যের বেশকিছু বস্তুবাদী ও প্রকৃতিবাদী দার্শনিকের মতের সমালোচনা করেন, বিশেষত তাদের নিরীশ্বরবাদী দৃষ্টিভঙ্গির কারণে। আফগানির মতে, ধর্মই মানুষের প্রকৃত স্থায়ী কল্যাণের উৎস। বড় বড় অট্টালিকা ও শহর নির্মাণ কিংবা ধ্বংসের কাজে ব্যবহার্য অস্ত্র নির্মাণের ওপর নয়, জ্ঞান-বিজ্ঞানের স্বাধীন চর্চা এবং নৈতিকতা ও ধর্মানুশীলনের ভিত্তিতেই রচিত মানুষের সংস্কৃতি ও সভ্যতা।

ধর্ম সম্পর্কে আফগানির ধারণা ছিল প্রচলিত ধারণার চেয়ে স্বতন্ত্র এবং যথার্থই প্রগতিশীল। রক্ষণশীল দার্শনিকদের ন্যায় ধর্মকে তিনি কোন অতিপ্রাকৃত বস্তুর সমবায়ে গঠিত নিছক একটি বিশ্বাসের ব্যাপার বলে মনে করেননি, বরং দেখেছেন বিচারশীল বিশ্বাসের একটি যুক্তিযুক্ত সিস্টেম হিসেবে। তার মতে, যথার্থ ধর্মবিশ্বাসকে অবশ্যই বৈধ যুক্তি-প্রমাণের উপর প্রতিষ্ঠিত হতে হবে। শুধু তাই নয়, যেকোনো শাস্ত্রীয় বিধানই যৌক্তিক ব্যাখ্যার অপেক্ষা রাখে। খোদ ইসলাম ধর্মও বিচারশীল ব্যাখ্যার ঊর্ধ্বে নয়। ইসলামের উৎকৃষ্টতা এখানে যে, তা মুসলমানদের কোনকিছুকেই খেয়ালখুশির বশবর্তী হয়ে গ্রহণ না করে পরীক্ষা-নিরীক্ষা ও প্রমাণ-প্রতিপাদনের ভিত্তিতে গ্রহণের পরামর্শ দেয়। …

ধর্ম মানুষকে যেসব মূল্যবান বিষয় শিক্ষা দিয়েছে সেগুলোর মধ্যে তিনটি বিশেষভাবে প্রণিধানযোগ্য। 

এক. ধর্মের কাছ থেকেই মানুষ শিখেছে যে, সে উচ্চতর আধ্যাত্মিক গুণাবলির অধিকারী, এবং এ কারণেই সৃষ্টির সেরা। এ শিক্ষার কল্যাণেই মানুষ লাভ করেছে পাশবিক শক্তি ও রিপুর ঊর্ধ্বে উত্তরণের এবং অন্যান্য মানুষের সঙ্গে শান্তির পরিবেশে বসবাসের ক্ষমতা। আফগানির মতে, যেসব জাতি এ সত্য যতবেশি অনুসরণ করতে পেরেছে, তারাই পেরেছে তাদের ভাগ্যের ততবেশি উন্নয়ন ঘটাতে, জ্ঞান ও সত্যের অনুসন্ধানকে জোরদার করতে এবং সভ্যতার জন্য প্রয়োজনীয় সব কলাকৌশল আয়ত্ত করতে। 

দুই. ধর্ম মানুষকে এ শিক্ষা দিয়েছে যে, তার নিজের সম্প্রদায় অন্যান্য সম্প্রদায়ের চেয়ে শ্রেষ্ঠ। এ ধর্মীয় বিশ্বাস মানুষের মনে সৃষ্টি করেছে ন্যায়, প্রেম ও শান্তির পরিবেশে অপরাপর মানুষের সঙ্গে বসবাসের প্রেরণা ও সংকল্প। 

তিন. ধর্ম মানুষকে শিখিয়েছে বিনয়, সততা ও সত্যবাদিতা। বিনয় মানুষকে বিরত রাখে অশুভ কর্মানুষ্ঠান থেকে, বিনয় মানুষকে শেখায় অশুভ অন্যায় কর্মের জন্য অনুশোচনা করতে। সততা মানুষকে উদ্বুদ্ধ করে সুস্থ ও শান্তিপূর্ণ সামাজিক জীবনে। আর সত্যবাদিতা এমন একটি গুণ যাকে বাদ দিয়ে মানুষে মানুষে পারস্পরিক আদান-প্রদান প্রায় অসম্ভব।

পৃথিবীর অনেক বড় বড় জাতির উন্নতি ও অগ্রগতির পেছনে বিনয়, সততা ও সত্যবাদিতার সুস্পষ্ট ভূমিকা লক্ষণীয়। দৃষ্টান্তস্বরূপ, এসব গুণের চর্চা ও অনুশীলনের ফলেই একটি অপেক্ষাকৃত ক্ষুদ্র জাতি হওয়া সত্ত্বেও গ্রিকরা সক্ষম হয়েছিল পারস্য সাম্রাজ্যকে রুখতে এবং শেষ পর্যন্ত সেই সাম্রাজ্যকে পদানত করতে। এরপর গ্রিক সমাজে যে অবক্ষয় এবং গ্রিক জাতির ওপর রোমানদের যে আধিপত্য সূচিত হয়েছিল, তা ছিল (আফগানির দৃষ্টিতে) মূলত এপিকিউরাস প্রবর্তিত বস্তুবাদী ও সুখবাদী দৃষ্টিভঙ্গির অনিবার্য ফল। অনুরূপ কারণেই আবার অবক্ষয় ও পতন শুরু হয় পারসিকদের ন্যায় একটি প্রাচীন জাতির, এবং আরবদের কাছে তাদের নতি স্বীকার করতে হয় মাজদাবাদ (mazdaism)-এর উদ্ভব ও প্রসারের কারণে। খোদ মুসলিম সাম্রাজ্যের উত্থান ও বিস্তারের মূলেও ছিল উল্লিখিত নৈতিক ও ধর্মীয় গুণাবলির অনুশীলন। দশ শতকের মধ্যে মিসর ও পারস্যে ইসমাইলি (বাতেনি) প্রচারণার ছদ্মাবরণে যে বস্তুবাদের আবির্ভাব ঘটে, তা বহুলাংশে ক্ষুণ্ণ করে মুসলমানদের মনোবল ও ধর্মবিশ্বাসকে এবং তাদের মনে বপন করে সংশয়ের বীজ। বাতেনিরা তাদের অনুসারীদের ধর্মীয় ও নৈতিক দায়িত্ব সম্পর্কে উদাসীন করে তোলে এ বিভ্রান্তি সৃষ্টির মাধ্যমে যে, এসব দায়িত্ব তাদের (অনুসারীদের) বেলায় নয়, বরং শুধু অদীক্ষিতদের বেলায়ই প্রযোজ্য। এ ধরনের ভ্রান্ত শিক্ষার প্রভাবে মুসলমানরা যতই হারাল তাদের নৈতিক প্রেরণা, ততই হয়ে পড়ল দুর্বল, এবং মূলত এজন্যই তাদের দুশো বছর ধরে থাকতে হল মুষ্টিমেয় ক্রুসেডারের প্রভাবে। বিশাল সাম্রাজ্য ও গৌরবোজ্জ্বল ঐতিহ্যের অধিকারী মুসলমানদের শেষ পর্যন্ত পদানত করলো চেঙ্গিস খানের দলবল। ধ্বংস করা হল নগর ও জনপদ, সংঘটিত করা হল গণহত্যা এবং গ্রাস করা হল সমগ্র মুসলিম জাহানকে।

ইতিহাসের বিবর্তনধারায় এই নীতি আফগানি আবার প্রয়োগ করেন উনিশ শতকে নেতিবাদ (nihilism), সমাজতন্ত্র ও কমিউনিজমের সমর্থকদের ওপর। শোষিত বঞ্চিত বিত্তহীন মানুষের কল্যাণে তারা ব্যক্তিগত সুযোগ-সুবিধা ও বিষয়-বৈভব যৌথিকরণের (communization) যে পরিকল্পনা গ্রহণ করেন আফগানি সেটিকে চিহ্নিত করেন সামাজিক অশান্তি ও রক্তক্ষয়ী বিদ্রোহের আকর বলে। তাদের নিরীশ্বরবাদ ও ধর্মবিরোধী মতকে তিনি দেখেছেন মানবজাতির শান্তি তথা অস্তিত্বের পক্ষে এক মস্তবড় হুমকি হিসেবে, এবং এজন্যই তিনি মুসলমানদের পরামর্শ দেন এ থেকে নিজেদের দূরে সরিয়ে রাখার।

আফগানি সমাজতন্ত্রের বিরোধী ছিলেন না। আসলে তিনি বিরোধিতা করেছেন বস্তুবাদী কমিউনিজমের, সমাজতন্ত্রের নয়। তিনি সার্থক সমাজতন্ত্র খুঁজে পেয়েছেন ইসলাম ধর্মে এবং এজন্যই তিনি পার্থক্য দেখিয়েছেন বস্তুবাদী কমিউনিজম ও ইসলামি সমাজতন্ত্রের। তার মতে, ইসলামি সমাজতন্ত্র যেখানে প্রতিষ্ঠিত প্রেম, প্রজ্ঞা ও সুনীতির ওপর, সেখানে বস্তুবাদী কমিউনিজম প্রতিষ্ঠিত হিংসা, দ্বেষ, স্বার্থপরতা ও শোষণের ওপর।

আগেই বলা হয়েছে আফগানি ছিলেন বৈচিত্র্যপূর্ণ ও গতিশীল ব্যক্তিত্বের অধিকারী একজন রাজনৈতিক ও সাংবিধানিক চিন্তাবিদ, আধুনিক ধর্মসংস্কারক ও মানবতাবাদী দার্শনিক। ইসলাম ধর্মের প্রকৃত অর্থ স্পষ্টায়নের এবং মুসলমানদের জন্য একটা বিশ্বজোড়া কল্যাণরাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার তার আজন্ম স্বপ্ন বাস্তবায়িত হয়নি ঠিক; কিন্তু ঔপনিবেশিক শক্তির মুসলিম দেশসমূহ দখলের অবসান, প্রগতিবিরোধী মুসলিম শাসকদের বিরুদ্ধে আপোসহীন সংগ্রাম এবং পাশ্চাত্যের জড়বাদী শক্তিসমূহকে চ্যালেঞ্জ করতে গিয়ে তিনি যে দার্শনিক যুক্তি ও প্রগাঢ় নীতিবোধের পরিচয় দিয়েছেন, তা কোনোমতেই উপেক্ষণীয় নয়। আল্লামা ইকবালের মতে, আফগানি যদি তার মেধা ও শক্তিকে এত বিচিত্র বিষয়ে ব্যয় না করে শুধু একটি বিষয়ে সর্বতোভাবে প্রয়োগ করতেন, তাহলে মুসলিম সমাজে পাশ্চাত্য সৃষ্ট বিভ্রান্তি দূরীকরণে এবং ইসলামের বৌদ্ধিক ও আধ্যাত্মিক মূল্যবোধ ও পাশ্চাত্যের উগ্র জড়বাদী দৃষ্টিভঙ্গির মধ্যে কার্যকর সমন্বয়বিধানে তিনি অন্য যেকোনো আধুনিক মুসলিম চিন্তাবিদদের চেয়ে অনেক বেশি সফল হতেন। কারণ, তার মেধা ও শক্তি ছিল এ কাজের জন্য চমৎকারভাবে উপযোগী।’

উত্তরাধিকার

সাইয়িদ আফগানিকে বলা হয় প্রথম ‘আধুনিকতাবাদী চিন্তাশীল’। তার ‘প্যান ইসলাম’ আন্দোলন ঔপনিবেশিক আমলে চিন্তাশীলদের মাঝে গভীর প্রভাব বিস্তার করে। তার এই আন্দোলন থেকে হিন্দুস্তানে আল্লামা শিবলি নোমানি, আল্লামা ইকবাল, মওলানা ওবায়দুল্লাহ সিন্ধি, মওলানা আবুল আলা মওদুদি ও মওলানা আবুল কালাম আজাদসহ অসংখ্য গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিত্ব প্রভাব গ্রহণ করেন। আরববিশ্বেও নতুন ধারার চিন্তাচর্চায় তার ভূমিকা ব্যাপক, বিশেষ করে তাকে ইখওয়ানুল মুসলিমিন ধারার গুরু ভাবা হয়। 

ঔপনিবেশিক শাসন থেকে মুসলিম রাষ্ট্রগুলো আজাদ হওয়ার পর সবাই মিলে ‘অর্গানাইজেশন অফ ইসলামিক কোঅপারেশন’ বা ওআইসি প্রতিষ্ঠা করে, যা ছিল সাইয়িদ আফগানির আন্দোলনের ফল। 

সাম্প্রতিককালের প্যান ইসলামিজমের অন্যতম পৃষ্ঠপোষক ছিলেন তুরস্কের প্রধানমন্ত্রী ও মিল্লি গুরুশ আন্দোলনের প্রতিষ্ঠাতা নাজিমউদ্দিন এরবাকান। তিনি আফগানির কথার সূত্র ধরেই প্যান ইসলামিক ইউনিয়নের ধারণার প্রতি মুসলিমদের উৎসাহিত করেন। তার সরকার তুরস্ক, মিশর, ইরান, পাকিস্তান, ইন্দোনেশিয়া , মালয়েশিয়া , নাইজেরিয়া ও বাংলাদেশ নিয়ে উন্নয়নশীল ৮টি দেশ বা ডি-৮ গঠন করেছে। লক্ষ্য ছিল ইউরোপীয় ইউনিয়নের মতো একক মুদ্রা (ইসলাম দিনারি), যৌথ বৈমানিক ও প্রতিরক্ষা কার্যকলাপ, পেট্রোকেমিকেল প্রযুক্তি উন্নয়ন, আঞ্চলিক বেসামরিক বিমান নেটওয়ার্ক এসবের মাধ্যমে অর্থনৈতিক ও প্রযুক্তিগত সহযোগিতায় মুসলিম জাতিগুলোর মধ্যে ধারাবাহিকভাবে ঐক্য সৃষ্টি করা। এর মাধ্যমে প্রমাণিত হয়েছে, আফগানির ধারণা সঠিক ছিল এবং এভাবে একটা ইউনিয়নের মতো করে পৃথিবীর মুসলিমদের রাষ্ট্রীয়ভাবে ঐক্যবদ্ধ করা সম্ভব । সুতরাং সময়ের সাথে সাথে সাইয়িদ আফগানি আমাদের মধ্যে আরও বেশি জীবন্ত হয়ে উঠছেন—একথা নির্দ্বধায় বলা যায়।

মূল্যায়ন

ইতিহাস পর্যালোচনায় যতটা সরলরৈখিক সিদ্ধান্তে আমরা উপনীত হই, ইতিহাস ততটা সরল নয়। আল বেরুনি তার ভারততত্ত্বের প্রথমে যা বলেছেন, ইবনে খালদুন তার আল মুকাদ্দিমায় এরই বিশ্লেষণ করেছেন—কালবৈষম্য এড়িয়ে এবং ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক নিরপেক্ষ থেকে ইতিহাসকে পর্যালোচনা করা। কিন্তু এ এমন এক কঠিন প্রক্রিয়া, ব্যক্তিকে যেখানে অভিজ্ঞতানিরপেক্ষ হওয়ার চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করতে হয়।

সাইয়িদ আফগানির কর্মপ্রচেষ্টাকে আমরা যেভাবেই বিশ্লেষণ করি না কেন, সেখানে কালের ফাঁকফোকর থাকবে। যেমন তার ‘প্যান ইসলাম’ চিন্তায় শাসকের পরিবর্তন ছিল খুব গুরুত্বপূর্ণ। তিনি জনতাকে জালেম শাসকের বিরুদ্ধে উস্কে দিয়েছেন, মিশর ও ইরানে তার প্রচেষ্টা সফলও হয়। এর কারণ ছিল তিনি মনে করতেন পরিবর্তন আসে উপর থেকে, পরবর্তীতে তার অনুসারীদের অনেকেই এই নীতি অবলম্বন করতে গিয়ে রাষ্ট্রকে আরও বিশৃঙ্খলার দিকে ঠেলে দেন। 

মোটাদাগে সমাজ পরিবর্তনের দুটো নীতি আছে :

১. ইনকিলাবে ফার্দ (ব্যক্তিমানসের পরিবর্তন) 

২. ইনকিলাবে নিজাম (রাষ্ট্রব্যবস্থার পরিবর্তন)

সাইয়িদ আফগানি ও তার অনুসারীদের অধিকাংশই দ্বিতীয় নীতি গ্রহণ করেছেন। অথচ মূলধারার আলেমগণ প্রথম নীতির অনুসারী। 

কিন্তু, আজ থেকে দেড়শো বছর আগে, যখন মুসলমানরা সবদিক থেকেই পিছিয়ে, তখন প্রথম নীতি কতটা ফলপ্রসূ হতো তা প্রশ্নসাপেক্ষ। সাধারণত জনতার মাঝে খুব সহজেই রাষ্ট্রবিরোধী মনোভাব জাগিয়ে তোলা যায়, জালেম শাসকের পরিবর্তনে কার্যকর উস্কানি দেওয়া যায়, কিন্তু আখলাক বা ব্যক্তিমানসের পরিবর্তন করা এতটা সহজ নয়। তাই ঔপনিবেশিক আমলে দ্বিতীয় নীতি যে আসলেই প্রয়োজনীয় ছিল, ইতিহাস পর্যালোচনায় বারবার এটাই সত্য প্রমাণিত হয়। 

এক্ষণে যদিও আমরা নীচ থেকে, অর্থাৎ ব্যক্তিমানসের পরিবর্তনকে প্রাধান্য দিই, তবু সাইয়িদ আফগানির কর্মতৎপরতা সামনে রাখা জরুরি। কারণ ‘নীতি’ কখনও একমাত্রিক নয়, প্রয়োজনসাপেক্ষে নীতির পরিবর্তন সাপ দেখামাত্র লাঠি হাতে নেওয়ার মতো অত্যাবশ্যক হয়ে যায়।

 

সহায়ক সূত্র

  1. কবিতা : ফালাক আতারিদ : যিয়ারতে আরওয়াহে জামালুদ্দিন আফগানি ও সায়িদ হালিম পাশা। কাব্যগ্রন্থ : জাভিদনামা। কবি : আল্লামা মুহাম্মদ ইকবাল।
  2. Keddie, Nikki R (1983). An Islamic response to imperialism: political and religious writings of Sayyid Jamāl ad-Dīn “al-Afghānī”. United States: University of California Press. page 05. ISBN 978-0-520-04774-7.
  3. সাইয়িদ জামালুদ্দিন আফগানি আওর মওলানা ওবায়দুল্লাহ সিন্ধি কে তাসাওউরে ইনকিলাব কা তাকাবুলি জায়েযা। লেখক : মুজিবুর রহমান। প্রকাশ : শু’বায়ে ইসলামিয়া, বাহাউদ্দিন যাকারিয়া ইউনিভার্সিটি মুলতান।
  4. জামালুদ্দিন আল আফগানি : আল মুফতারা আলাইহি। লেখক : ড. মুহাম্মদ ইমারা। পৃষ্ঠা ১৫৮। প্রকাশ : দারুশ শুরুক।
  5. সাইয়িদ জামালুদ্দিন আফগানি। লেখক : সাইয়িদ জাকির ইজাজ। প্রকাশ : ইসলামিক বুক ফাউন্ডেশন, নয়াদিল্লি।
  6. ইসলামে ধর্মীয় চিন্তার পুনর্গঠন। লেখক : আল্লামা ইকবাল। পৃষ্ঠা ১০৩। প্রকাশ : প্রথমা প্রকাশন।
  7. মাকামে জামালুদ্দিন আফগানি। প্রকাশ : হায়দরাবাদ বুক ডিপো।
  8. জামালুদ্দিন আল আফগানি : মুকিয আশ শারক ও ফাইলাসুফ আল ইসলাম। লেখক : ড. মুহাম্মদ ইমারা। পৃষ্ঠা ৮৫। প্রকাশ : দারুশ শুরুক। 
  9. আসারে জামালুদ্দিন আফগানি। লেখক : কাজি মুহাম্মদ আবদুল গাফফার। প্রকাশ : আঞ্জুমান তারাক্কিয়ে উর্দু, দিল্লি।
  10. শাহ ওয়ালিউল্লাহ দেহলভী ও জামালউদ্দীন আফগানী। লেখক : মোহাম্মদ আবদুল মান্নান। প্রকাশ : কামিয়াব প্রকাশন লিমিটেড।
  11. সাইয়িদ জামালুদ্দিন আফগানি। লেখক : এস এম হামিদ। প্রকাশ : হালি প্রেস পানিপত। 
  12. জামাল উদ্দীন আফগানীর চিন্তাধারার বিশ্লেষণ। লেখক : মোঃ তৌহিদুল ইসলাম। 
  13. তার মুসলিম মামালিক মেঁ ইসলামিইয়াত অওর মাগরিবিইয়াত কি কাশমাকাশ। লেখক : মাওলানা আবুল হাসান আলি নদবি। পৃষ্ঠা ১৩৫। প্রকাশ : মজলিসে তাহকিকাতে ও নাশরিয়াতে ইসলাম, নদওয়াতুল উলামা লখনৌ। 
  14. ইসলাম ধর্ম ও মুসলিম দর্শন। লেখক : ড. আমিনুল ইসলাম। পৃষ্ঠা ২৩২-২৩৫। প্রকাশ : উত্তরণ। 
  15. জামালউদ্দিন আফগানি ও তাঁর প্যান ইসলামিজম চিন্তা। লেখক : মনযূরুল হক। 

বিজ্ঞাপন

Subscribe
Notify of
guest
0 Comments
Oldest
Newest Most Voted
Inline Feedbacks
View all comments

স্বত্ব © ২০২৩, যোগাযোগ | ই মেইল : jogajogbd.org@gmail.com

যোগাযোগ-এ প্রকাশিত কোনো লেখা, ছবি কিংবা শিল্পকর্ম লেখক অথবা কর্তৃপক্ষের অনুমতি ছাড়া কোথাও প্রকাশ করা অবৈধ৷