উনিশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধে মুসলিমজাতি অধঃপতনের যে ধারালো ডগায় পৌঁছেছিল, ইতিহাসের কিছু টুকরো টুকরো গল্প থেকে তা মোটেও আন্দাজ করা সম্ভব নয়। হাজার বছরের বেশি সময় যারা দোর্দণ্ড প্রতাপে পৃথিবী শাসন করেছে, একে একে তারা নিজেদের মাথা গোঁজার ঠাঁইও হারাতে থাকে, মাতৃভূমিতেই তারা হয়ে পড়ে পরাধীন। ইসলামের রুহানি আছর দিল থেকে উজাড় হয়ে গিয়েছিল, শীতের পাতা ঝরার মতো মুসলিম সমাজ থেকে একে একে ঝরে পড়ে তার মৌলিক বিশ্বাস। রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা, ভোগবিলাস, অজ্ঞতা, ধর্মহীনতা, নিরাশা, অন্ধ-তাকলিদ, অর্থনৈতিক বিপর্যয় ইত্যাদি মুসলমানদের থেকে মুছে ফেলেছিল মুসলমানিত্বের আলামত। ফলাফল যা হবার তা-ই হলো, গোলামির জিঞ্জির পায়েও মুসলমানদের চোখে-মুখে দেখা গেল খুশির চিহ্ন—যেন আখেরাত নয়, দুনিয়াই মুখ্য।
খেলাফতে ওসমানি, যাকে তখনও মুসলিমবিশ্বের কেন্দ্র ভাবা হতো, নিজ অঞ্চলেই গ্রহণযোগ্যতা হারিয়ে ফেলে; ধনশালী ভারতবর্ষ ডাকু ইংরেজদের কব্জায়, উত্তর আফ্রিকা নির্মম-নিষ্ঠুর ফরাসিদের কালো থাবায়, রাশিয়ার করালগ্রাসে ককেশীয় ও উজবেকীয় অঞ্চল, ডাচ জলদস্যুরা নোঙর ফেলে ইন্দোনেশিয়ায়, আর আরববিশ্ব জাতীয়তাবাদের আফিমে বেসামাল—চীনের সীমান্ত থেকে অতলান্তিক পর্যন্ত মুসলিম অধ্যুষিত যত ভূমি ছিল, সবই তখন প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে কোনো না কোনো ঔপনিবেশিক শক্তির দখলে। এমন সময় সব দুর্বল মুসলমানের ভীড় ঠেলে সামনে এগিয়ে এলেন ‘প্যান ইসলামের’ নিশান হাতে এক মর্দে মুমিন, যিনি ধারণ করতেন নিকট অতীতের শাহ ওলিউল্লাহ দেহলবি (রহ) থেকে শুরু করে সমস্ত সালাফের তাজদিদি উত্তরাধিকার—তিনি আর কেউ নন, সাইয়িদ জামালুদ্দিন আল হুসাইনি আল আফগানি (রহ)।
তিনি ছিলেন আঁধার রাতের মশালবাহী, উম্মতকে তিনি দরদভরা কণ্ঠে এই আশা দিয়েছিলেন—
عالمے در سینۂ ما گم ہنوز
عالمے در انتظارِ قُم ہنوز
عالمے بے امیتازِ خون و رنگ
شامِ او روشن تر از صبحِ فرنگ
عالمے پاک از سلاطین و عبید
چوں دلِ مومن کرانش ناپدید
عالمے پاک از سلاطین و عبید
چوں دلِ مومن کرانش ناپدید
ندرونِ تست آں عالم نگر
می دہم از محکماتِ او خبر
এক পৃথিবী এখনও লুকিয়ে আমাদের সিনায়,
অপেক্ষায় আছে ‘কুম’ শব্দের মোজেজার—
যেখানে নেই জাতপাতের কোনো বিভাজন
যার সন্ধ্যা য়োরোপের ঊষার চেয়ে উজ্জ্বলতর
নেই সেখানে রাজা-প্রজার ফারাক
মুমিনের দিলের মতোই সব পাক-সাফ।
যার নেই সারসত্তার কোনো পরিবর্তন
বাহিরে বদলায় কেবল উন্নতির ধরন।
খুঁজে দেখো, সেই পৃথিবী আছে তোমারই মাঝে
দিয়ে যাই তোমাদের সেই মুহকামাতের খবর।
(আল্লামা ইকবাল/জাভিদনামা)
জন্ম ও জন্মস্থান বিতর্ক
সাইয়িদ জামালুদ্দিন আফগানি (রহ)-এর জন্ম ১২৫৪ হিজরির শাবান মাস মোতাবেক পহেলা অক্টোবর ১৮৩৮ কিংবা ১৮৩৯ খ্রিষ্টাব্দে। তার পিতার নাম সফদর আলি, আর মায়ের নাম সাকিনা বেগম। তার ঊর্ধ্বতন নবম পুরুষ ছিলেন সাইয়িদ আলি তিরমিজি, যিনি সেই সময়ের অনেক বড় আলেম ও বুজুর্গ ছিলেন। তিনি কুনার অঞ্চলের আসাদাবাদ গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। এই সূত্র ধরে তাকে জামালুদ্দিন আসাদাবাদিও বলা হয়। তবে এই আসাদাবাদ কোথায়, আফগানিস্তানে না ইরানে; আর তার পরিবার সুন্নি ছিল না শিয়া—এই নিয়ে দুটো মত প্রসিদ্ধ আছে।
কার্ল ব্রকেলমান-সহ অধিকাংশ প্রাচ্যবাদী দাবি করেন সাইয়িদ আফগানি ইরানি ও শিয়া ছিলেন। বিখ্যাত প্রাচ্যবাদী লেখিকা নিকি আর. কেডি এ ব্যাপারে খুব জোর দেন। তিনি লিখেন :
There is now abundant evidence that Afghani was not, as he usually claimed, born and brought up in Sunni Afghanistan, but rather in Shi’i Iran.
জামালুদ্দিন আফগানি যে সুন্নি বা আফগানিস্তানের অধিবাসী ছিলেন না, যেমনটা তিনি দাবি করতেন, এর উপর অসংখ্য প্রমাণ আছে। বরং তিনি ছিলেন একজন ইরানি শিয়া।
সাইয়িদ আফগানির চিন্তাদর্শন অনুসরণ করে গড়ে ওঠা রাজনৈতিক দলগুলোর বিরোধিতা করতে গিয়ে অনেক মুসলমানও খুব জোরালোভাবে এই কথা প্রচার করে। এর পেছনের কারণটা খুবই স্পষ্ট—তার গ্রহণযোগ্যতা নষ্ট করা। এমনকি তার জীবদ্দশাতেও এই গুজব ছড়ানো হয়েছিল। কিন্তু তিনি তার প্রাণপ্রিয় শাগরেদ ও অনুরাগীদের কাছে এর জওয়াব দেন, তিনি নিজেকে আফগানিস্তানি ও সুন্নি বলেন। তবু প্রাচ্যবাদীরা বলে বেড়ান—এটা ছিল তার রাজনৈতিক চাল। খুবই আশ্চর্য হতে হয়, সাইয়িদ আফগানি জীবনের প্রায় পুরোটাই বিভিন্ন সুন্নি রাষ্ট্রে কাটান, অথচ যেসব প্রশ্নে শিয়া-সুন্নি মৌলিকভাবে আলাদা—ইমামত কিংবা রাজত্বের হকদার একমাত্র আহলে বাইত—এসব বিষয় নিয়ে তিনি কোনো আলাপই উঠাননি। তর্কের খাতিরে যদি ধরেও নিই তিনি শিয়া ছিলেন, তবে তিনি কেমনতর শিয়া—যিনি ইরানে গিয়ে শিয়া শাসকের বিরুদ্ধে জনতাকে উস্কে দেন, কিন্তু তুর্কিতে গিয়ে সুন্নি শাসককে পরামর্শ দেন গোটা মুসলিমবিশ্বকে এক সুতোয় গাঁথার!
জনাব মুজিবুর রহমান তার পিএইচডি থিসিসে মুহাম্মদ আবদুহ, রাশিদ রিদা, জুরজি যায়দান প্রমুখের সূত্রে প্রমাণ করেন—সাইয়িদ আফগানির জন্ম আফগানিস্তানে হওয়ার মতই অধিক নির্ভরযোগ্য। এবং ড. মুহাম্মদ ইমারা তার ‘জামালুদ্দিন আফগানি : আল মুফতারা আলাইহি’ বইতে প্রতিপক্ষের সব ধরনের যুক্তি খণ্ডন করে লিখেন :
فكما لم يكن جمال الدين ، إيرانيا … كذلك لم يكن و شيعيا .. وهو أيضا لم يكن بابيا – كما زعم الزاعمون بغير دليل .. وإنما كان الرجل : مسلما .. مجتهدا .. مجددا … يسعى إلى تجديد دنيا ، المسلمين بواسطة تجديد و دينهم ، وذلك بتأسيس تمدنهم على أساس متين وأصيل من الإسلام …
তিনি না ইরানি, না শিয়া, আর না বাবি কিছু ছিলেন। অভিযোগকারীদের অভিযোগ নিতান্তই ভিত্তিহীন। বরং তিনি ছিলেন একজন মুসলিম, মুজাতাহিদ ও মুজাদ্দিদ। তিনি মুসলমানদের দীনের (সমঝদারিতে) সংস্কারসাধনের মাধ্যমে মুসলিমজাহানকে নতুন করে সাজাতে সচেষ্ট ছিলেন। আর তা চেয়েছিলেন ইসলামের অবিমিশ্রিত ও মূল ভিত্তির উপর মুসলমানদের তাহযিব-তমদ্দুন প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে।
শৈশব ও প্রাথমিক শিক্ষা
সাইয়িদ আফগানির শৈশব কাটে কুনারে, তার পড়াশোনায় হাতেখড়ি বাবা সফদর আলির কাছেই। তার কাছ থেকে তিনি বিভিন্ন শাস্ত্রের প্রাথমিক জ্ঞান হাসিল করেন।
দীর্ঘ সময় ধরেই আফগানিস্তানের রাজনীতি ছিল অস্থিতিশীল। গোটা আফগানিস্তান ছিল আহমদ শাহ আবদালির উত্তরপুরুষ আমির দোস্তে মুহাম্মদ খানের অধীনে, তার রাজধানী ছিল কাবুল। হঠাৎ কমন্দল খান কান্দাহার দখল করে আলাদা রাজত্ব গড়ে তোলে। এরপর দুজনের মধ্যে শুরু হয় গৃহযুদ্ধ। এই সুযোগটাই কাজে লাগিয়ে ১৮৩৮ সালে ইংরেজরা আফগানিস্তানের কান্দাহার দখল করে নেয়।
সাইয়িদ আফগানির বাবা সফদর আলি ছিলেন রাজনীতিতে সক্রিয়, কুনার অঞ্চলে তার ভালো প্রভাব ছিল। আমির দোস্তে মুহাম্মদ খান আশঙ্কা করেন সফদর আলি বিদ্রোহ করতে পারে। তাই তার সমস্ত জায়-জায়েদাদ জব্দ করে তাকে কাবুলে থাকার নির্দেশ দেন, এবং সেখানে সরকারের নজরবন্দিতে পরিবারসমেত থাকার ব্যবস্থা করেন। এই ঘটনা ঘটে ১৮৪৬ সালে, সাইয়িদ আফগানির বয়স তখন আট। এরপর প্রায় দশ বৎসর তারা কাবুলেই বসবাস করেন।
উচ্চশিক্ষা
তৎকালে আফগানিস্তানে পড়াশোনার কোনো পরিবেশ ছিল না, কিন্তু এমন জায়গায় থেকে কীভাবে তিনি উন্নতচিন্তার সাথে পরিচিত হলেন—সে এক আশ্চর্য। মওলানা আবুল কালাম আজাদ লিখেন :
‘তার জন্মভূমির মতো প্রাথমিক জীবনও আন্দাজ-অনুমানের পর্দায় ঘেরা। তবু, তালিম ও তরবিয়তের জন্য তিনি যে কোনো উন্নত, নিদেনপক্ষে উল্লেখযোগ্য পরিবেশ পাননি—এ কথা খুব নিশ্চয়তার সাথেই বলা যায়। উনিশ শতকের সেই পতনোন্মুখ সময়ে আফগান ও পাঞ্জাবি আলেমগণ নিজেদের ঘরে কিংবা মসজিদে ছাত্রদের বড়জোর কলম ধরিয়ে দিতেন, উচ্চশিক্ষার সাথে পরিচিত করা তাদের জন্য সম্ভব ছিল না। নিজেরা যা পারতেন, ছাত্রদের তা-ই শেখাতেন। আর তাদের মধ্যে এমন কোনো আলেমও ছিল না—যাকে গোনায় ধরা যায়।’
তবে, ইতিহাসে পাওয়া যায় তিনি পেশোয়ারে দুজন শিক্ষকের কাছে পড়তে গিয়েছিলেন। তাদের নাম হাফেজ দারাজ পেশোয়ারি ও মওলানা মুহাম্মদ ওয়াসিম। তাদের ব্যাপারে বেশি কিছু জানা না গেলেও সাইয়িদ আফগানি যে তাদের শ্রেষ্ঠতম ছাত্র ছিল, এ ব্যাপারে সন্দেহ নাই।
তিনি ছিলেন অস্বাভাবিক মেধার অধিকারী। মাত্র ১৮ বছর বয়সে তিনি আরবি সাহিত্য, ব্যাকরণ, অলংকারশাস্ত্র, ইতিহাস, ফিকহ, তফসির, হাদিস, তাসাওউফ, যুক্তিবিদ্যা, কালামশাস্ত্র, দর্শনশাস্ত্র, গণিতশাস্ত্র, প্রকৃতিবিদ্যা, জ্যোতির্বিজ্ঞান ও চিকিৎসাবিদ্যায় ব্যুৎপত্তি অর্জন করেন। এরপর তিনি বিজ্ঞান ও অন্যান্য শাস্ত্র নিয়ে পড়াশোনা করেন, এবং উচ্চশিক্ষার জন্য বিভিন্ন অঞ্চল সফর করেন।
ফারসি ও আরবি ভাষায় তিনি পারদর্শিতা অর্জন করেছিলেন, সাধারণত এই দুই ভাষাতেই লেখালেখি ও বক্তৃতা দিতেন। তুর্কি ও উর্দুতে তিনি মাতৃভাষার মতো কথা বলতে পারতেন। এছাড়াও তিনি ইংরেজি, ফরাসি ও রুশ ভাষা জানতেন।
পিতার ইন্তেকাল ও হিন্দুস্তান সফর
১৮৫৬ সালে আমির দোস্তে মুহাম্মদ খান সফদর আলি সাহেবের সমস্ত সম্পত্তি ফিরিয়ে দেন। সাইয়িদ আফগানি সপরিবারে কুনারে ফেরত যান, কিন্তু কয়েকদিন পরেই তার শ্রদ্ধেয় পিতা ইন্তেকাল করেন।
পিতার ইন্তেকালের পর সাইয়িদ আফগানির জীবনের নতুন অধ্যায় শুরু হয়। এর কিছুদিন পর হজে যাওয়ার উদ্দেশ্যে তিনি হিন্দুস্তান পৌঁছেন। হিন্দুস্তানে তখন মোগল সালতানাত তার শেষ প্রহর গুনছে, অন্যদিকে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি গোটা অঞ্চল তাদের নিয়ন্ত্রণে নিয়ে নিয়েছে। এই সময় সিপাহি বিপ্লব শুরু হয়। সাইয়িদ আফগানি ইউরোপীয় জ্ঞান-বিজ্ঞানের শক্তি, বিপরীতে মুসলমানদের বিচ্ছিন্নতা ও জ্ঞানবিমুখতার পরিণতি স্বচক্ষে দেখেন। তার ভেতরে তখন বুদ্ধিবৃত্তিক বিপ্লবের আগুন জ্বলে উঠে। তিনি প্রায় পাঁচ বছর হিন্দুস্তানে থাকেন, এখানে কোথায় কীভাবে ছিলেন তা জানা যায় না, তবে এই সময় যে তিনি শাহ ওলিউল্লাহ দেহলবি (রহ)-এর অনুসারীদের দ্বারা প্রভাবিত হন—তার জীবন থেকে এর প্রমাণ পাওয়া যায়। ইংরেজি ভাষা ও আধুনিক জ্ঞান-বিজ্ঞানের সাথে তার পরিচয় এ সময়কালেই হয়। ১৮৬১ সালে তিনি আফগানিস্তান ফিরে যান।
আফগান রাজনীতিতে অংশগ্রহণ
তার ফিরে আসার সংবাদ পেয়ে আমির দোস্তে মুহাম্মদ তাকে দরবারে ডেকে পাঠান, এবং তার বড় ছেলে মুহাম্মদ আজম খানের তালিম ও তরবিয়তের দায়িত্ব তাকে সোপর্দ করেন। আমির তার বুদ্ধিমত্তা ও রাজনৈতিক দূরদর্শিতা দেখে মুগ্ধ হন, বেশির ভাগ সময় তার সাথে পরামর্শ করতেন।
আফগানিস্তানে সাইয়িদ আফগানি প্রথমে উপদেষ্টা, পরবর্তীতে মন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেন। তার পরামর্শে আমির আফগানিস্তানের সংস্কার ও আধুনিকায়নের কর্মসূচি নেন। তিনি ব্রিটিশদের মোকাবেলায় রাশিয়ার সাথে মিত্রতা স্থাপনের পরামর্শ দেন বলেও গোয়েন্দা প্রতিবেদন থেকে ধারণা পাওয়া যায়। তিনি পর পর তিন আমির—দোস্তে মুহাম্মদ খান, শের আলি খান ও মুহাম্মদ আজম খানের আমলে উক্ত পদে বহাল ছিলেন।
আমির দোস্তে মুহাম্মদের ইন্তেকালের পর ১৮৬৪ সালে আফগানিস্তানে গৃহযুদ্ধ শুরু হয়। একদিকে ছিল শের আলি খান, অপরদিকে মুহাম্মদ আজম খান। তিনি পক্ষপাত এড়াতে হিন্দুস্তানের দিকে চলে যান। ব্রিটিশ সরকার তার সম্মান বুঝে থাকার অনুমতি দেয়, কিন্তু কিছু শর্তসাপেক্ষে। তিনি হিন্দুস্তানে প্রায় চার মাস ছিলেন। যতদিন ছিলেন, বেশ চুপচাপ ছিলেন।
১৮৬৫ সালে তিনি হজের উদ্দেশে রওয়ানা দেন। হজ আদায়ের পর এক বছর সিরিয়া, বাইতুল মুকাদ্দাস, ইরাক ও পারস্যের কিছু অঞ্চল সফর করে তিনি মুসলমানদের সামাজিক ও রাজনৈতিক অবস্থা পর্যবেক্ষণ করেন। এরপর যখন সংবাদ পান কাবুল এখন মুহাম্মদ আজম খানের নিয়ন্ত্রণে, শের আলি খান পরাজিত হয়ে পালিয়েছে, তিনি বালুচিস্তান ও হিন্দুস্তানের পথ ধরে আফগানিস্তান ফিরে আসেন। তার প্রত্যাগমনের পর আমির মুহাম্মদ আজম খান তাকে সসম্মানে স্বাগত জানান, এবং প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব অর্পণ করেন। এই ঘটনা খুব সম্ভব ১৮৬৬ সালের শেষদিকের।
১৮৬৮ সালে আমির শের আলি খান আবার কাবুল দখল করে নেন। সাইয়িদ আফগানি তার জান নিয়ে খতরায় পড়েন, কারণ মুহাম্মদ আজম খানের সাথে তার সম্পর্ক ছিল খুবই ভালো। কিন্তু শের আলি খান তার বিরুদ্ধে কোনো পদক্ষেপ নেননি, বরং নিরাপত্তা দেন। এই সময় শের আলি খান ব্রিটিশদের সাথে আঁতাত করেন। তিনি মানুষের মাঝে সচেতনতা বৃদ্ধির জন্য ‘শামসুন নাহার’ নামে একটি পত্রিকা প্রকাশ করেন। অন্যদিকে নতুন প্রজন্মের মধ্যে পরিবর্তন আনতে ও অজ্ঞতা দূর করতে বেশ কয়েকটি নতুন ধারার মাদরাসা প্রতিষ্ঠা করেন। কিন্তু এক পর্যায়ে বুঝতে পারলেন মাতৃভূমি তার কাজের জন্য অনুকূল নয়। তিনি তখন আমিরের কাছে হজের উদ্দেশে হেজাজ গমনের অনুমতি প্রার্থনা করেন। আমির তাকে ইরান অথবা বুখারার পথ ধরে না যাওয়ার শর্তে অনুমতি দেন, যেন এই দুই অঞ্চলে লুকিয়ে থাকা মুহাম্মদ আজম খান ও আবদুর রহমান খানের সাথে তিনি সাক্ষাৎ করতে না পারেন। কিন্তু সাইয়িদ আফগানির নিজেদের মধ্যকার এই লড়াইয়ে কোনো আগ্রহ ছিল না, তিনি এটাও বুঝেন—ঐক্য প্রতিষ্ঠা না করে ক্ষমতা দখল করলেও কার্যকরী কিছু করা সম্ভব নয়।
প্যান-ইসলাম আন্দোলন
প্যান ইসলাম হলো মুসলিমদের ঐক্যকেন্দ্রিক একটি রাজনৈতিক আন্দোলন। আরবিতে বলা হয় ‘আল ওয়াহদাতুল ইসলামিয়া’, আর উর্দুতে ‘ইত্তেহাদে ইসলামিইয়াত’। সাইয়িদ আফগানি যখন দেখলেন দুনিয়াজুড়ে মুসলমানরা শুধু পরাজিত হচ্ছে, কোনোভাবেই তাদের অধঃপতন রোখা যাচ্ছে না, তখন তিনি তিনটি মূলনীতি সামনে রেখে কাজ শুরু করেন :
এক. মুসলমানদের একই সাথে আধুনিক ও পরম্পরাভিত্তিক ধর্মীয় জ্ঞান (তুরাস) হাসিল করতে হবে। আধুনিকতাকে পুরোপুরি গ্রহণ করতে হবে, তবে সেই ক্ষেত্রে নয় যেখানে তা ধর্মের সাথে সাংঘর্ষিক। ইউরোপে ধর্ম বনাম বিজ্ঞানের সংঘাতে খ্রিষ্টধর্ম গির্জায় কোণঠাসা হয়ে পড়ে, এর কারণ তারা ধর্মের নামে বিজ্ঞানের এমন সব বিষয়ও বাদ দিয়েছিল—যার সাথে ধর্মের দূরতম কোনো সম্পর্ক নাই। তাই দুটো জিনিসকে আলাদা করা, এবং বিজ্ঞানের যতটুকু অংশ স্পষ্ট ধর্মবিরুদ্ধ, ততটুকুই বাদ দেওয়া। পাশাপাশি এ বিষয়টিও মাথায় রাখতে হবে—অতীতের (তুরাস) সাথে সব সম্পর্ক ত্যাগ করা যাবে না। এ প্রসঙ্গে আল্লামা ইকবাল তার ‘ইসলামে ধর্মীয় চিন্তার পুনর্গঠন’ গ্রন্থে বলেন :
‘সম্ভবত শাহ ওলিউল্লাহ দেহলবিই সর্বপ্রথম নবপ্রেরণা-উদ্বুদ্ধ অন্তর নিয়ে এ পথে অগ্রসর হয়েছিলেন। কিন্তু যিনি এ কার্যের পূর্ণ গুরুত্ব ও বিশালত্ব হৃদয়ঙ্গম করেছিলেন, মুসলিম চিন্তা ও জীবন-ইতিহাসের নিগূঢ় তাৎপর্যের প্রতি যার গভীর অন্তর্দৃষ্টি মানুষ ও তার রীতিনীতি সম্পর্কে ব্যাপক অভিজ্ঞতার ফলে গড়ে ওঠা প্রশস্ত দৃষ্টিভঙ্গির সঙ্গে যুক্ত হয়ে অতীত ও ভবিষ্যতের মিলনসেতু রচনা করেছিল, তিনি হলেন জামালুদ্দিন আফগানি। তার ক্লান্তিহীন অথচ বহুধাবিভক্ত কর্মস্পৃহা যদি মানবীয় বিশ্বাস ও রীতিনীতির কেন্দ্র হিসেবে ইসলামের প্রতি পুরোপুরিভাবে প্রযুক্ত হতে পারত, তবে আজকের মুসলিম জগৎ চিন্তাক্ষেত্রে নিজেকে আরও অনেকখানি আত্মপ্রতিষ্ঠিত দেখতে পেত। এখন আমাদের সামনে একমাত্র যে পথ খোলা রয়েছে, তা হলো আধুনিক জ্ঞানরাজির প্রতি সশ্রদ্ধ অথচ বিমুক্ত দৃষ্টিতে অবলোকন করে সেই জ্ঞানেরই আলোকে ইসলামি শিক্ষাকে নতুন করে অন্তরে গ্রহণের চেষ্টা করা। এতে পূর্ববর্তীদের সঙ্গে আমাদের মতবিরোধ হলেও উপায় নেই।’
দুই. মুসলমানদের আখলাকি উন্নয়ন ঘটানো। তিনি হিন্দুস্তান, আফগানিস্তান, ইরান ও আরব—যেখানেই গিয়েছেন, মুসলমানদের চূড়ান্ত নৈতিক স্খলন দেখেছেন। আখলাকি পরিবর্তন ছাড়া মুসলমানদের সামগ্রিক পরিবর্তনের আশা দুরাশা ছাড়া আর কিছুই নয়। আল্লাহর রসুল (স) এরশাদ করেন, ‘আমি উত্তম চরিত্রের পূর্ণতা দিতেই প্রেরিত হয়েছি।’ (মুয়াত্তা মালেক, হাদিস নং ১৬৪৩) এর মানে চারিত্রিক বিকাশে কাজ করা সরাসরি নবুওয়তি কাজ। এই জায়গাটা দুর্বল রেখে অন্যক্ষেত্রে সবল হলেও লাভ নেই।
তিন. মুসলমানদের রাজনৈতিক ক্ষমতা লাভ করতে হবে। অর্থনৈতিক ও কূটনৈতিক ক্ষেত্রে শক্তিশালী হতে হবে। ঔপনিবেশিক শক্তির সাথে আঁতাত করা যাবে না। নিজের সার্বভৌমত্ব রক্ষা করতে হবে।
এই তিন মূলনীতিকে বাস্তবায়নের জন্য ‘প্যান ইসলামের’ ধারণাকে সামনে আনেন। এর মূলকথা হলো—মুসলিম অধ্যুষিত পৃথিবীর প্রতিটি রাষ্ট্র একটি নির্দিষ্ট ব্যবস্থার অধীনে থাকবে। অনেকটা বর্তমান সময়ের ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের মতো। রাষ্ট্র অনেকগুলোই থাকবে, প্রত্যেকে নিজ অবস্থানে স্বাধীন থাকবে, কিন্তু তাদের সবার সম্মিলিত একটি স্বেচ্ছাসেবী ইসলামি যোদ্ধাদল থাকবে, যেন তারা পৃথিবীর যেকোনো জায়গায় মুসলিমদের প্রয়োজনে লড়াইয়ে যোগ দিতে পারে।
রাজনৈতিক ঐক্যের ক্ষেত্রে তিনি ঈমান-আকিদা ও অন্যান্য বিষয়ের উপরে শুধুমাত্র রাজনৈতিক স্বার্থটাকেই প্রাধান্য দেন। কারণ এই মুহূর্তে মতাদর্শিক দ্বন্দ্বের চেয়ে নিজেদের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখা বেশি জরুরি। তা ছাড়া, তিনি দেখতে পেয়েছিলেন ইউরোপীয় ঔপনিবেশিকদের মূল স্লোগান ছিল—ডিভাইড অ্যান্ড রুল, ভাগ করো আর শাসন করো। তারা সফলভাবে এই কাজটা করতে পেরেছে। তাদের বিরুদ্ধে প্রধান অস্ত্র এটাই হতে পারে—তাদের ভাগ করতে না দেওয়া।
সাইয়িদ আফগানি এই মতবাদের প্রচারে একে একে বিভিন্ন দেশে সফর করেন, এবং সেখানে চিন্তাশীল মানুষের মাঝে বিপ্লবের অগ্নিস্ফুলিঙ্গ ছড়িয়ে দিতে থাকেন।
মিশরে ৪০ দিন
১৮৭০ সালে সাইয়িদ আফগানি মিশর সফর করেন। ওই সময় তার বয়স সবে ৩২। তিনি একা একাই কায়রোতে যান। ওসমানি সালতানাতের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো তখন মিশরে। সেই সুদূর প্রাচ্য থেকে আসা এক ব্যক্তি সেখানে মাত্র ৪০ দিন অবস্থান করে সকলের দৃষ্টি তার দিকে নিবদ্ধ করতে বাধ্য করেন। এমনকি তার এই ‘নতুন ধারার ইলমি যোগ্যতার’ সংবাদ ইস্তাম্বুল পর্যন্ত পৌঁছে যায়। তার বিপ্লবী চিন্তা তরুণ ছাত্রদের মাঝে খুব প্রভাব বিস্তার করে।
মুহাম্মদ আবদুহ, এক তরুণ মিশরীয়, যার বয়স তখন মাত্র ২০, তিনি এই সময় সাইয়িদ আফগানির দ্বারা খুব বেশি প্রভাবিত হন। এই তরুণই তার পরবর্তীতে বৈপ্লবিক অগ্রযাত্রায় হাল ধরেছিলেন।
তুর্কি সফর
মিশর থেকে তিনি হেজাজে যাচ্ছিলেন, কিন্তু পথে এরাদা পরিবর্তন করে ওসমানি সালতানাতের কেন্দ্রভূমি তুর্কির উদ্দেশে রওয়ানা দেন। ১৮৭১ সালে রাজধানী কুস্তুনতুনিয়া (বর্তমান ইস্তাম্বুল) গিয়ে পৌঁছেন। তুর্কি প্রধানমন্ত্রী মুহাম্মদ আমিন আলী পাশা তাকে যথাসম্মানের বরণ করেন। তুর্কির আলেমগণও তাকে সংবর্ধনা জানান। তাকে তুর্কির ‘আঞ্জুমানে দানিশ’-এর সদস্যপদ দেওয়া হয়। এছাড়াও আয়া সুফিয়া ও সুলতান আহমদের মসজিদে খুতবা দেওয়ার দায়িত্বও তার উপর বর্তায়। মানুষ তার কথা মন্ত্রমুগ্ধের মতো শুনত, এই কারণে তুর্কিরা তার খেতাব দেন ‘সিহরুল কুলুব’ (মনের জাদুকর)। তার এলেম ও হেকমতের কথা চারদিকে ছড়িয়ে পড়ে, সিরিয়া ইরাক ও হেজাজেও মানুষ তাকে নিয়ে আলোচনা করতে থাকে।
কিন্তু, তুর্কির প্রাচীনপন্থি আলেমগণ তার নতুন ধারার চিন্তার সাথে একমত হতে পারেননি। কয়েকজন গুরুত্বপূর্ণ আলেম তার বিরোধিতা করতে শুরু করেন, বিশেষ করে শায়খুল ইসলাম হাসান আফেন্দি। এর মধ্যে সাইয়িদ আফগানি ওসমানিয়া ইউনিভার্সিটিতে একটি বক্তব্য দেন, সেই বক্তব্যের কয়েকটি শব্দের উপর হাসান আফেন্দি ঘোর আপত্তি জানান, এমনকি কুফরির ফতোয়াও দেন। ওসমানি সালতানাতে হাসান আফেন্দির মর্তবা ছিল খুবই উপরে, জনগণ তাকে সুলতানের মতো মান্য করত। তিনি যখন বিরোধিতা করছেন, সুলতান আবদুল হামিদ সানি তখন বিষয়টিকে খুব গুরুত্ব দেন, এবং ‘প্রশাসনিক শৃঙ্খলার স্বার্থে’ সাইয়িদ আফগানিকে তাৎক্ষণিক দেশত্যাগের নির্দেশ করেন।
বিয়ের প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান
সাইয়িদ আফগানির বিপ্লবী চিন্তা ঠান্ডা করতে সুলতান আবদুল হামিদ ভাবলেন তাকে বিয়ে করাবেন। বিবি-বাচ্চা হলে পুরুষের পিছুটান তৈরি হয়, তখন আর মাথায় সারাক্ষণ বিপ্লবের চিন্তা ঘুরঘুর করে না। তিনি রাজপ্রাসাদের এক লাস্যময়ী মনোহারী সুন্দরীকে বিয়ের জন্য প্রস্তাব করলেন। সাইয়িদ আফগানি প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করে বললেন, ‘যেখানে আমি এই মনোহারী দুনিয়াকেই বিয়ে করিনি, সেখানে নারীকে বিয়ে করি!’
মিশরে প্রত্যাবর্তন ও বিপ্লবের ডাক
তুর্কি থেকে তিনি মিশরে ফিরে যান। যুবসমাজ, আলেম এবং স্বাধীনতার চেতনায় উদ্বুদ্ধ জনগণ তাকে সাদর অভ্যর্থনা জানায়। এরপর একটানা নয় বছর তিনি মিশরে থাকেন। মিশরের খাদেবি শাসক ইসমাইল তার বৃত্তি মঞ্জুর করেন, এবং শিক্ষা সংস্কার ও শিক্ষা বিস্তারের দায়িত্বে নিয়োজিত করেন।
তিনি কখনও নিজ বাসভবনে, কখনও জামিয়া আজহারে ক্লাস নিতেন। আজহারে ফিকহ, হাদিস, ফালসাফা ও তাসাওউফ নিয়ে পড়াতেন। ছাত্ররা খুব মনোযোগের সাথে তার ক্লাসে অংশ নিত, তার জন্য সবাই পাগল ছিল। অবশ্য প্রাচীনপন্থি শিক্ষকগণ তাকে ভালো চোখে দেখতেন না। তিনি ভূগোল ক্লাসে ছাত্রদের বোঝানোর সুবিধার্থে একটি গ্লোব তৈরি করেছিলেন, কিন্তু নিবর্তনবাদী আলেমগণ একে বেদআতি কাজকর্ম বলে অভিহিত করেন। এর পেছনে যুক্তি দেন—গ্লোব একটা ‘নতুন জিনিস’, আর প্রত্যেক নতুন জিনসই বেদআত! কিন্তু তার ব্যক্তিত্ব ও জনপ্রিয়তার কারণে এ নিয়ে খুব উচ্চবাচ্য করেননি।
সাইয়িদ আফগানি শিক্ষা, সেবা ও সাংস্কৃতিক ধারায় ‘আল হিজবুল ওয়াতানি’ নামে একটি সংগঠন কায়েম করেন। এর সদস্য সংখ্যা তিনশোর বেশি ছিল। এ সংগঠনের ছায়াতলে সমবেত যুবজনতাকে তিনি ‘প্যান ইসলামি’ চেতনায় উজ্জীবিত ও স্বাধীনতার প্রেরণায় উদ্দীপ্ত করে তোলেন। এ সংগঠনের মাধ্যমে তিনি দীনি শিক্ষা বিস্তার, খ্রিষ্টান মিশনারির সাথে বাহাস, চিকিৎসা ও অন্যান্য জনসেবামূলক কার্যক্রমও জোরদার করেন।
খাদেবি শাসক ইসমাইল পাশা ছিলেন খুবই আরামপ্রিয় ও বেখেয়ালি। তিনি রাষ্ট্রীয় কাজের জন্য এতবেশি ঋণ নিয়েছিলেন যে তা শোধ করা কোনোভাবেই সম্ভব হচ্ছিল না। মিশরের মতো প্রাচীন ও সমৃদ্ধ একটি দেশ দেউলিয়া হওয়ার দ্বারপ্রান্তে উপনীত হয়। আর এরই সুযোগ নিয়ে ব্রিটেন ও ফ্রান্স সাহায্যকারী পরম বন্ধুর বেশ ধরে তার সামনে হাজির হয়। তিনি রাষ্ট্রের বিভিন্ন দায়িত্ব তাদের হাতে দিয়ে দেন, এমনকি সুয়েজ খালের মালিকানা বিক্রি করে দেন। সাইয়িদ আফগানি তার এসব কাজ মিশরের সার্বভৌমত্বের জন্য হুমকি মনে করেন, কারণ তিনি হিন্দুস্তানে স্বচক্ষে ব্রিটিশদের কর্মকৌশল দেখে গেছেন।
এই সময় সাম্রাজ্যবাদীদের ষড়যন্ত্রের বিরুদ্ধে মিশরবাসীদের জাগিয়ে তুলতে তিনি স্লোগান দেন, ‘আল মাসর লিল মাসরিইয়িন’ (মিশর শুধুমাত্র মিশরবাসীর)। এই স্লোগান আগুনের মতো পুরো মিশরে ছড়িয়ে পড়ে। তার অনুপ্রেরণায় মিশরের প্রখ্যাত সাহিত্যিক ইসহাক ‘আল মাসর’ নামে একটি পত্রিকা শুরু করেন। তার এক ইহুদি শাগরেদ, যার নাম ছিল জুমাইজ, তিনি ‘আবু নাজারা’ নামে আরেকটি পত্রিকা সম্পাদনা করতেন। দুটো পত্রিকা থেকেই জোরেশোরে সাম্রাজ্যবাদবিরোধী স্লোগান প্রচার করা হতো।
তিনি ইসলামী দর্শন, রাজনীতি, বিজ্ঞান ও সাংবাদিকতা বিষয়ে স্বাধীনভাবে শিক্ষাদান করেন এবং শিক্ষিতদেরকে সাহিত্যসাধনায় উদ্বুদ্ধ করেন। তার শিক্ষা ও প্রেরণার প্রভাবে আরব তরুণদের দৃষ্টি ও চিন্তাধারা প্রসারিত হতে থাকে। তার ব্যক্তিত্বের প্রভাবে দলে দলে লোক তাকে কেন্দ্র করে ঐক্যবদ্ধ হতে থাকে। তার এই কার্যক্রম ফরাসি ও ব্রিটিশরা মিশরে তাদের অস্তিত্বের জন্য হুমকি বিবেচনা করে। তারা সাইয়িদ আফগানিকে মিশর থেকে বের করার জন্য খাদেবি শাসককে চাপ দিতে থাকে।
কিন্তু ঘটনা হয় উলটো, জনতার চাপে খোদ ইসমাইল পাশার পতন হয়। মিশরের মসনদে বসেন তওফিক পাশা। কিন্তু, তিনি ছিলেন আরও বড় জালেম। তিনি সাইয়িদ আফগানির সাথে সম্পর্ক রাখার কারণে প্রধানমন্ত্রী শরিফ পাশাকে পদচ্যুত করেন। এরপর দমন-পীড়ন শুরু করেন। একদিন রাতে হঠাৎ এক সৈন্য সাইয়িদ আফগানিকে জাগিয়ে তোলে, এবং রাতারাতি সুয়েজ খাল অতিক্রম করতে বাধ্য করে। ১৮৭৯ সালে তিনি মিশর থেকে হিন্দুস্তানের উদ্দেশ্যে রওয়ানা দেন।