আজকের সুশীল সমাজ ও আমরা

সাইফ সিরাজ

বাংলাদেশের প্রেক্ষিতে সুশীল সমাজ মূলত একটা ইউটোপিয়ান ধারণা। গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থায় যদিও সুশীল সমাজের ভূমিকা খুবই গুরুত্বপূর্ণ এবং তাৎপর্যময়; কিন্তু আমাদের এই অঞ্চলে ‘সুশীল সমাজ’ সবচেয়ে অকার্যকর এবং চরমভাবে হাস্য-রসের উপাদান। এই সিভিল সোসাইটি বা সুশীল সমাজের কর্মকাণ্ডে দেশের সাধারণ শিক্ষিত মানুষ এতোটাই বিরক্ত ও বিব্রত যে, তারা ‘সুশীল’র অর্থই করে নিয়েছে ‘সু-শীল’। রম্য-ব্যঙ্গ আর কৌতুকচ্ছলে তারা বলছেন, ‘স’ অর্থ ভালো আর ‘শীল’ অর্থ নাপিত। ফলে, সুশীল অর্থ ‘ভালো নাপিত’। আঞ্চলিক বাংলায় অকারণ পাণ্ডিত্য আর অতিচাটুকারদের আচরণকে বলে ‘নাইপতালি’ সেই থেকে ব্লগ যুগে এই সুশীল সমাজের আচরণ ও সক্রিয়তাকে ‘ভালো নাপিত’ বা ‘নাইপতালি’ বলে ট্রল করা হতো।

বাংলাদেশের নেটিজেনরা ব্লগ যুগ পেরিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের যুগে প্রবেশ করে ভার্চুয়াল নাগরিক হয়ে গেছে। কিন্তু সুশীল সমাজের তেমন কোন উন্নতি, সক্রিয়তা অথবা প্রভাব আমাদের দৃষ্টিগোচর হচ্ছে না। যদিও সুশীল সমাজের কাজ একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে একটি সাংবিধানিক সরকার প্রতিষ্ঠায় গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখা এবং সৎ ও যোগ্য প্রার্থী নির্বাচনে জনগণকে সহায়তা করা। জনগণের ভোটের অধিকার প্রতিষ্ঠায় স্বচ্ছ ও নিরপেক্ষ নির্বাচণের জন্য কাজ করা।

একটা যথার্থ সিভিল সোসাইটি রাষ্ট্রে আইনের শাসন, স্বাধীন বিচারব্যবস্থা, প্রশাসনিক জবাবদিহিতার সঙ্গে সঙ্গে জনগণ ও সরকারের মধ্যকার সম্পর্ককে সুন্দর, যৌক্তিক ও কল্যাণকর করে দেয়। সুশীল সমাজ নিজেরা জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল থেকে সরকারকে জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল থাকতে বাধ্য করে। রাষ্ট্রে অনাকাঙ্ক্ষিতভাবে তৈরি হওয়া জাতিগত, দলগত, পেশাগত এবং যেকোনো বিরোধ নিরসনে কাজ করে নিরপেক্ষভাবে। একটা উন্নয়নশীল দেশে নানাবিধ সংকট ও সমস্যা নিয়মিত চলতে থাকে সুশীল সমাজ সেইসব সংকট ও সমস্যার সামাধানের জন্য নিয়মিত ক্যাম্পেইন ও জনসচেতনতা তৈরিতে ভূমিকা রাখে।

একটা দেশের জন্য সবচেয়ে বড় অভিশাপ হলো দুর্নীতি। দুর্নীতির বেড়াজালে আটকালে সরকার, প্রশাসন ও আইন প্রয়োগকারী বিভিন্ন সংস্থা ক্রমশ অথর্ব ও পক্ষপাতদুষ্ট হয়ে দেশকে ফোকলা করে দেয়। ফলে এইসব দুর্নীতি তথা ঘুষ, টেন্ডারবাজিসহ রাষ্ট্রীয় সম্পদ আত্মসাৎ ও অপচয় রোধে সুশীল সমাজের ভূমিকা থাকে উজ্জ্বল। দুর্নীতিবাজ ক্ষমতাসীনদের জন্য এরা এক আতঙ্কের নাম হয়ে থাকার কথা। সেই সঙ্গে জনগণকে গণতান্ত্রিক ও সাম্যের চেতনায় উদ্বুদ্ধ করে একটি কার্যকর রাষ্ট্র ও সক্রিয় সরকার গঠণের নেপথ্যে থাকবে এই সুশীল সমাজ। সুশীল সমাজের মূলনীতি হবে দেশ ও জনগণের পক্ষপাত করা। দলনিরপেক্ষ সক্রিয়তায় তারা জনগণের আস্থাভাজন ও আপনজন হয়ে প্রভাবিত করবে জনগণের মতামতকে।

গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে এইযে সুশীল সমাজের এতো ব্যাপক কাজ সেই সুশীল সমাজ আসলে কারা? কোনো ব্যক্তি, সংগঠন, দল, সংস্থা নাকি সাধারণের মধ্যে অসাধারণ হয়ে উঠা কিছু মানুষ? তাহলে আরও বিস্তারিত বলার আগে চেষ্টা করি তাঁদেরকে একটু চিনে নিতে।

সিভিল সোসাইটি বা সুশীল সমাজ কারা?

উইকিপিডিয়ার মতে, Generally, civil society has been referred to as a political association governing social conflict through the imposition of rules that restrain citizens from harming one another. In the classical period, the concept was used as a synonym for the good society, and seen as indistinguishable from the state.

অর্থাৎ, “সাধারণত, সুশীল সমাজ বলতে বোঝায় একটি রাজনৈতিক সংঘকে। যা আইন প্রয়োগের মাধ্যমে নাগরিকদের পারস্পরিক ক্ষতি সাধন ও সামাজিক সংঘাত থেকে থেকে বিরত রাখে। প্রাচীন কালে এই ধারণাটি কল্যাণ সমাজের প্রতিশব্দ হিসাবে ব্যবহৃত হতো; যা রাষ্ট্রের অভিভাজ্য অংশ।”

অন্যভাবে বলা যায়, “সুশীল সমাজ হলো একটি সংগঠিত গোষ্ঠী, যার সদস্যরা সরকারের কাছ থেকে নাগরিক অধিকার অর্জনের জন্য স্বতঃস্ফূর্তভাবে একত্রিত হয়। সুশীল সমাজ ব্যক্তি ও সরকারের মধ্যে একটি মাধ্যম হিসেবে কাজ করে। সুশীল সমাজ কখনও কখনও সরকার ও জনগণের মধ্যকার দ্বান্দ্বিক সম্পর্ক নিরসনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।”

ওয়ার্লড ব্যাংকের মতে, Civil society … refers to a wide array of organizations: community groups, non-governmental organizations [NGOs], labour unions, indigenous groups, charitable organizations, faith-based organizations, professional associations, and foundations.

অর্থাৎ, “সিভিল সোসাইটি বলতে, নানাবিধ সংগঠন, সম্প্রদায়গত দল, বেসরকারি সংস্থা (এনজিও), শ্রমিক ইউনিয়ন, আদিবাসী গোষ্ঠী, দাতব্য সংস্থা, ধর্মভিত্তিক সংগঠন, পেশাদার সমিতি এবং বিভিন্ন ধরণের ফাউন্ডেশনকে বোঝায়।”

সুশীল সমাজের বৈশিষ্ট্য :

এরা রাষ্ট্রকে একটি স্বাধীন সার্বভৌম ভূখণ্ড হিসেবে টিকিয়ে রাখতে গণতান্ত্রিক সরকার, আইনের শাসন, বিচার বিভাগের নিরপেক্ষতা, জবাবদিহিতা ও নাগরিক অধিকার নিয়ে সক্রিয় থাকবে। চারটি মৌলিক উপাদান নিয়ে সুশীল সমাজের অস্তিত্ব : ১. বহুত্ববাদ বা বহুদলীয় গণতন্ত্র কিংবা উদার গণতন্ত্র, ২. জনমত প্রকাশের অবাধ স্বাধীনতা, ৩. রাষ্ট্রীয় গোপনীয়তা ও ৪. সর্বক্ষেত্রে বৈধতা নিশ্চিত করা।

এরা কখনোই সরকার, দল, রাষ্ট্রীয় ও রাজনৈতিক কোনো প্রতিষ্ঠানের অংশ হতে পারবে না। সরকার ও রাজনৈতিক দল থেকে কোনো সুবিধা নিতে পারবে না। নাগরিক ও সরকারের মধ্যকার সেতুবন্ধনের কাজ করবে। সরকারের ভুল, অপকর্ম, নিপীড়নমূলক আইন ও দমনমূলক কাজের বিরোধিতা এবং সরকারের ভুল ও অপরিণামদর্শী নীতির সমালোচনা করে সরকারকে গণতান্ত্রিক ও কল্যাণ রাষ্ট্র গঠনে সহায়তা করবে।

ইসলামী রাষ্ট্রব্যবস্থায় সুশীল সমাজ :

ইসলামী রাষ্ট্রব্যবস্থায় প্রতিজন সচেতন নাগরিকই সুশীল সমাজ। আলেম, চিন্তক ও দার্শনিকগণ সুশীল সমাজের প্রতিনিধি। সমাজের যে কোনো সাধারণ নাগরিক খলিফাকে পরামর্শ দিতে পারেন এবং জবাবদিহিতা চাইতে পারেন। খলিফা উমর রা. যখন বায়তুল মাল থেকে প্রাপ্ত কাপড়ের জামা পরে জুমার খুতবা দিচ্ছিলেন তখন একজন নাগরিক তাঁকে প্রশ্ন করেছিলেন যে, আমরা তো প্রাপ্ত কাপড় দিয়ে জামা বানাতে পারিনি। আপনি পারলেন কেমন করে! খলিফা তখন জবাব দিয়েছিলেন, ‘আমার সন্তানের কাপড়টি আমাকে দেওয়ায় আমার জামা হয়েছে।’ ফলে ইসলামী রাষ্ট্রের প্রতিজন নাগরিকই মৌলিকভাবে সিভিল সোসাইটি।

যদিও আরবিতে এই সুশীল সমাজকে জাম-ই-মাদীনা বা আলইজতিমাইয়্যাতুল মাদানিয়্যাহ বলা হয়ে থাকে। আরবিতে সুশীল সমাজের সংজ্ঞায় বলা হয় :

أن المجتمع المدني هو المجتمع الذي يقوم على  المؤسسات السياسية والاقتصادية والاجتماعية والثقافية التي تعمل في ميادينها المختلفة في استقلال نسبي عن سلطة الدولة لتحقيق أغراض متعددة

“নাগরিক সমাজ এমন একটি সমাজ যা রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সামাজিক এবং সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠানের উপর ভিত্তি করে গড়ে উঠে। যেগুলো নানাবিধ উদ্দেশ্য অর্জনের লক্ষ্যে রাষ্ট্রপক্ষের সঙ্গে স্বাধীনভাবে নাগরিক-অধিকার নিয়ে কাজ করে।”

সুতরাং সংজ্ঞা, বৈশিষ্ট্য ও কাজের ধরণ অনুযায়ী সুশীল সমাজ একটি সরকারের ভেতর আরেকটি অঘোষিত সরকার। যারা নাগরিক সুবিধা, বাক-স্বাধীনতা, সংখ্যালঘুর অধিকার, সামাজিক সদাচার, ধর্মীয় স্বাধীনতা, শিক্ষা ইত্যাদি নিয়ে সরকারের সঙ্গে স্বপ্রণোদিত হয়ে কাজ করে।

বাংলাদেশের সুশীল সমাজ :

লেখার শুরুতেই বাংলাদেশের সুশীল সমাজের প্রতি সাধারণ নাগরিকদের মনোভাব কী বলেছিলাম। আমরা দেখি এই দেশের সুশীল সমাজ স্থূলভাবে পক্ষপাতদোষে দুষ্ট। এরা দলীয় লেজুড়বৃত্তি করে। দলগত পরিচয় না থাকলেও নির্দিষ্ট দলের প্রতি কমিটেড থাকে। এদেশের সুশীল সমাজ ধর্মীয়, রাজনৈতিক, সামাজিক, শিক্ষা, কমিউনিটি এবং ইসলাম প্রশ্নে সবসময়ই নির্দিষ্ট এজেন্ডা অথবা পক্ষের হয়ে সরব থাকেন। কখনও কখনও তিলকে তাল বানিয়ে ‘হায় হায়’ ‘গেল গেল’ বলে সরব হয়ে উঠেন। আবার কখনও তালকে তিলটা না ভেবেও উট পাখির মতো বালিতে মাথা গুঁজে নিরব হয়ে যান।

২০০৯ সালের পঁচিশে ফেব্রুয়ারি পিলখানা হত্যাকাণ্ড, তেরো সালের পাঁচ মে শাপলা চত্বরের ম্যাসাকার, ২০২১ সালে মোদির আগমন-বিরোধী আন্দোলনে গুলি, বিচার বহির্ভূত হত্যা, বিরোধী দলীয় নেতাদের গুম, দুর্নীতি, ভোটহীন নির্বাচন, জামাতকে নিষিদ্ধ না করেও তাদের কর্মীদের সঙ্গে নিষিদ্ধ সংগঠনের মতো আচরণ ইত্যাদি নিয়ে বাংলাদেশের সুশীল সমাজের কোনো আলাপ-প্রতিবাদ নেই। বরং গণমাধ্যমের যেসব সুশীলদের নিজেদের স্বার্থেই কথা বলার দরকার ছিলো তারাও মাহমুদুর রহমান ও আদিলুর রহমান ইস্যুতে নীরব ভূমিকা পালন করেছে।

গত দেড় যুগে যতগুলো সংখ্যা লঘু নির্যাতন, মন্দির ও প্রতিমা ভাঙচুরের ঘটনা ঘটেছে প্রতিটিতে সুশীল সমাজ সোচ্চার ছিলো এই দেশের ধার্মিক মুসলিম ও আলেমদের বিরুদ্ধে। কিন্তু একটা ঘটনারও তদন্তপূর্বক রিপোর্ট প্রকাশের জন্য তারা মুখ খোলেনি। নাসীরনগর, রামু, কুমিল্লার নানুয়া দিঘীর ঘটনাসহ প্রতিটি ঘটনাই রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত ছিলো বলে গণমাধ্যমে অথবা নাগরিক সাংবাদিকতায় সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে খবর এসেছে। কিন্তু একটা অভিযোগও নিষ্পত্তি হয়নি। আমাদের সুশীল সমাজ এইসব নিয়ে নীরব ভূমিকা পালন করছেন।

বিশ্ববিদ্যালয়ে নারীর হিজাব নিয়ে, কলেজে ছাত্রীদের লম্বা হাতা কেটে দেওয়া নিয়ে আমাদের সুশীল সমাজ কোনো কথাই বলেননি। একদম চুপচাপ নীরবতা পালন করেছেন তারা। অবশ্য মাদরাসার ভেতরে কোথায় কী হয় তা নিয়ে সবসময়ই তারা সরব ছিলেন, থাকছেন।

৪ ডিসেম্বর ২০২০ সালের বিবিসি ‘বাংলাদেশের সুশীল সমাজ, এনজিও ও গণমাধ্যমের কন্ঠ এখন নমনীয় কেন’ শিরোনামে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করে। সেই প্রতিবেদনের ভূমিকায় লেখা হয়, “বাংলাদেশে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা, দুর্নীতি বিরোধী তৎপরতা এবং নারী অধিকারসহ গুরুত্বপূর্ণ নানা ইস্যুতে দীর্ঘকাল ধরেই সোচ্চার ছিলো সুশীল সমাজ, আর্থ সামাজিক খাতে কাজ করা বেসরকারি সংস্থা অর্থাৎ এনজিও এবং গণমাধ্যম। রাজনৈতিক দল এমনকি সরকারের ওপর চাপ তৈরি করতেও তাদের ভূমিকা আলোচনায় এসেছে নানা সময়ে। কিন্তু সিভিল সোসাইটি, এনজিও ও গণমাধ্যমের সেই ‘শক্তিশালী কন্ঠ’ ক্রমশ ম্রিয়মান হয়ে যাচ্ছে বলে মনে করছেন অনেকে।”

সেই প্রতিবেদনে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক শিক্ষার্থী এবং পেশায় উন্নয়ন কর্মী সানজিদা খানের অভিযোগ যে, গত প্রায় এক দশক ধরে সিভিল সোসাইটি, এনজিও কিংবা গণমাধ্যমের জোড়ালো ভূমিকা আর দেখা যায় না। তিনি বলেন, “আমাদের দেশে জাতীয় পর্যায়ের সুশীল সমাজ জাতীয় ইস্যুতে সোচ্চার থাকতেন। তারা যখন সোচ্চার হতেন সেটি আবার ঠিকভাবেই মিডিয়াতে প্রতিফলিত হতো। কিন্তু এখন সুশীল সমাজকে সেই ভূমিকায় দেখা যায়? তাদের সেই ভূমিকা এখন কোথায়? কেন তাদের কণ্ঠ আগের মতো নেই? আগে জাতীয় ইস্যুতে সুশীল সমাজ, এনজিও ও মিডিয়া একযোগে কথা বলতো। কেন এখন তাদের কণ্ঠ শোনা যায় না?”

বাংলাদেশের বর্তমান সুশীল সমাজ সম্পর্কে বিবিসি আরও লিখে, “বাংলাদেশে প্রবল রাজনৈতিক সহিংসতার জের ধরে ২০০৭ সালের জানুয়ারিতে সেনা সমর্থিত সরকার ক্ষমতায় আসার আগের কয়েক বছরে নির্বাচনে সৎ ও যোগ্য প্রার্থী আন্দোলনের ব্যানারে রাজনীতির দুর্বৃত্তায়ন বন্ধে বেশ সংঘবদ্ধ হয়ে উঠেছিলো সিভিল সোসাইটি বা সুশীল সমাজের একটি অংশ, যার সাথে ছিলো ঢাকার প্রভাবশালী দুটি সংবাদপত্র প্রথম আলো ও ডেইলি স্টার এবং একটি বেসরকারি সংস্থা সিপিডি আর টেলিভিশন চ্যানেল চ্যানেল আই।

তারও আগে বিশেষ করে আশি ও নব্বইয়ের দশকে দেশের পেশাভিত্তিক বুদ্ধিজীবীরা গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা বা ইস্যুতে যে দলবদ্ধ বক্তব্য বা বিবৃতি দিতেন তা আলোচনার ঝড় তুলতো।”

কিন্তু গত ক’বছরে আমাদের সুশীল সমাজ বলতে কেউ অথবা কিছু ছিলো তা আমরা আর অনুভবই করতে পারছি না। কেমন যেনো প্রতিটি পত্রিকা, টেলিভিশনসহ সবরকমের গণমাধ্যম এবং এনজিও, নাগরিক সংগঠনগুলো নীরব ও স্তব্ধ হয়ে আছে। যেনো তাদের কোথাও কিছুই আসছে যাচ্ছে না।

যেনো বা ঢাকার জ্যাম, নদীগুলোর হত্যা, শ্বেত হস্তি প্রকল্প, দেশের অর্থ পাচার, ব্যাংকগুলোর দেউলিয়াত্ব, ইসলামী ব্যাংক নামের একটি বৈশ্বিক সফল প্রতিষ্ঠানের মুমূর্ষাবস্থা, মেয়াদোত্তীর্ণের বহু আগেই ভেঙ্গে যাওয়া সড়ক, প্রতিনিয়ত সড়কে প্রাণহানি, রেলের বগিতে অন্য গাড়ির আঘাতে অগণিত প্রাণহানি এর কোনো কিছুই সুশীল সমাজকে ছুঁয়ে যাবে না। এরা কেউ এই সবের শিকার হবে না। এদের কেউ সাফার করছে না। মনে হচ্ছে সুশীল সমাজ ও গণমাধ্যমের জন্য রাষ্ট্রের ভেতরে কোনো নতুন ভেটিকান তৈরি করে দেওয়া হয়েছে। ফলে নিজেদের বাইরে কারো দুঃখ আর দুর্দশার কথা নিয়ে তাদের সরব হতে হবে না।

যেনো বা দ্রব্যমূল্য শুধু বিরোধী দলের জন্য বেড়েছে। শুধু মোল্লা মৌলভীদের জন্য বেড়েছে। ফলে আজকে নাগরিক সমাজের মানববন্ধন আর মিছিল দেখা যায় না। প্রফেসর আনু মোহাম্মদ স্যারকে এখন আর রাজপথে আমরা দেখি না। দেখি না কোনো সর্বহারাদের গণমানুষের অধিকার নিয়ে চিৎকার দিতে।

বাংলাদেশের সুশীল সমাজ আর আওয়ামীলীগ যেনো একাকার হয়ে গেছে। যেই প্রথম আলো দুর্নীতি আর হাওয়া ভবন নিয়ে এতো সরব ছিল; সেই প্রথম আলো তল্পীবহনের ফলাফল হিসেবে ভাত ও গোশতের অধিকার চাওয়ার প্রতিবেদনের প্রতিক্রিয়ায় পত্রিকা বন্ধের উপক্রম হয়েছিল। আমরা সেদিন দেখেছি দেশের সুশীল সমাজের চরিত্র। এই প্রথম আলো যাদেরকে সুশীল আর আইডল বানাতে ব্যস্ত আজীবন তারাই প্রথম আলো বন্ধের জন্য মাঠে নেমে এসেছে। যেখানে সুশীল সমাজের উচিত ছিলো নাগরিকদের হয়ে গণমাধ্যমের পক্ষে অবস্থান নেওয়ার সেখানে তারা রাজনৈতিক স্বার্থে অথবা ক্ষমতার ভয়ে সুশীল সমাজের ভূমিকা পালন না করে ‘কুশীল’ সমাজের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছিল।

সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে যে সব ইসলামপন্থী এক্টিভিস্ট তখন প্রথম আলোর পক্ষে লিখেছিলেন; মন্তব্যে তাদেরকে কেউ কেউ বলেছেন যে, “যতোই আপনি প্রথম আলো টিকে থাকুক চান; দিনশেষে প্রথম আলো কখনও আপনাদের পজেটিভিটি খুঁজে পাবে না।” দুঃসময় শেষে প্রথম আলো কিন্তু সুশীল সমাজের ভূভিকায় অবতীর্ণ হতে পারেনি।

বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে সুশীল সমাজ কোনোভাবেই দেশ-জনতার জন্য কল্যাণকর নয়। বরং এরা দলবাজি আর তেলবাজিতে সদা সক্রিয়। ফলে একটা উন্নয়নমুখী দেশ ক্রমশ দেউলিয়াত্বের দিকে যাচ্ছে। যেখানে প্রতি পণ্যের দাম কল্পনার বাইরে বৃদ্ধি পাচ্ছে। টাকার মান তাসের ঘরের মতো নেমে আসছে। ব্যাংকগুলো হাঁসফাস করছে। আর কথা বলার স্বাধীনতা তো নেই-ই। তবুও সুশীল সমাজ নীরব, জড়, প্রতিক্রিয়াহীন ও সুবিধাবাদী আচরণে নিমগ্ন।

জাতিসংঘ ও সুশীল সমাজ :

বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটে জাতিসংঘকে কেন্দ্র করে একটা বৈশ্বিক নাগরিক সমাজের কল্পনা যদি আমরা করি দেখব যে, তারাও বাংলাদেশী নাগরিক সমাজের মতোই আচরণ করছেন। তবে পার্থক্য হচ্ছে ক্ষমতাসীন দেশ আর ক্ষমতাহীন দেশ এবং মুসলিম দেশ ও অমুসলিম দেশ—এর প্রেক্ষিতে জাতিসংঘকেন্দ্রিক সুশীলেরা দ্বৈত আচরণ করে যাচ্ছে যুগের পর যুগ।

পূর্ব তিমুর যখন গণ ভোট চাইল জাতিসংঘের সুশীলেরা দ্রুত গণভোট দিয়ে পূর্ব তিমুরকে স্বাধীনতা এনে দিল। অপরদিকে আরাকান ও কাশ্মীর প্রশ্নে জাতিসংঘের সুসীলরা বধীর হয়ে থাকেন। যেনো বা তারা কিছুই দেখছেন না।

এরা ক্লাইমেট চেঞ্জ নিয়ে, পাখি নিয়ে, পশু নিয়ে গভীর আঁতেলের মতো ভারী ভারী বাণী ছাড়বে। কিন্তু মানুষের প্রশ্নে তারা বোবা হয়ে যাবে।

বৈশ্বিক সুশীলতা ও মুসলিম জনপদ :

সাম্প্রতিক হামাসের ইজরাইল আক্রমণের পর বৈশ্বিক সুশীল সমাজ আড়মোড়া ভেঙ্গে জেগে উঠলেন। বাণী দিলেন : ইজরাঈলের আত্মরক্ষার অধিকার আছে। এরপর গাজায় যা ঘটছে তা আইয়্যামে জাহেলিয়াকেও হার মানায়। অথচ পঁচাত্তর বছর ধরে একটা জাতিকে ক্রমান্বয়ে নিঃশেষ করে দিতে ইজরাইল এমন কোনো অন্যায় নেই যা করেনি। ভূমি দখল করেছে। মুসলমানদের উদ্বাস্তু করেছে। নারী-শিশুকে হত্যা করেছে। বাড়ি-ঘর বুলডোজার দিয়ে গুড়িয়ে দিয়েছে। প্রতিটা ঘরে শহীদের ইতিহাস লিখেছে। প্রতিজন মা শহীদের মা হয়েছেন। যুবকেরা বৃদ্ধ হওয়ার আগেই বুলেটের শিকার হয়েছেন। কিন্তু পৃথিবীর এইসব সুশীল মোড়লেরা কোনোদিন টু শব্দটি করেনি। বরং নানাভাবে ইজরাইলকে শক্তিশালী করেছে। আজকে যখন সর্বাহারারা জেগে উঠতে চাইছে তখনই বৈশ্বিক সুশীলেরা জেগে উঠেছে।

সুইজারল্যান্ডে যখন কুরআন পুড়ানো হয়, ফ্রান্সে যখন নবীজীকে অপমান করা হয়, হিজাব নিষিদ্ধ হয়, ভারতে যখন গরুর গোশত ব্যাগে আছে সন্দেহে মেরে ফেলা হয়, জয় শ্রীরাম না বললে গণপিটুনিতে খুন করা হয়, বাংলাদেশে যখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো (যা মুসলিমদের জমির উপর মুসলিমদের জন্য প্রতাষ্ঠিত) প্রতিষ্ঠানে হিজাবের বিরুদ্ধে শিক্ষকেরা আইন জারি করে; তখন কোনো দৈশিক সুশীল অথবা বৈশ্বিক সুশীল এইসব দেখতে ও শুনতে পায় না।

কিন্তু যখনই কোনো মুসলিম স্কলার অন্য ধর্মের অসাড়তা নিয়ে আলাপ করেন অথবা বক্তব্য দেন; সকল সুশীল একসঙ্গে জেগে উঠে। এই সুশীলেরা আযানের শব্দে, ওয়াজের শব্দে শব্দ দূষণ খুঁজে পায়। ট্রাকের হাইড্রোলিক হর্নে, কনসার্টের বক্সের সাউন্ডে, কিংবা পূজার টানা তিনদিনের সাউন্ডে কোনোরূপ শব্দদূষণ খুঁজে পায় না।

পুরো পৃথিবী জুড়েই ধার্মিক মুসলমানগণের জন্য কোনো সুশীল সমাজ সরব হয় না। ফলে কোথাও কোথাও নিজস্ব ইনসাফ থাকলেও ব্যাপকার্থে পৃথিবী একটা জুলুমের অভয়ারণ্য। এখানে ক্ষমতা ও ক্ষমতার তল্পীবাহকেরাই শেষ পর্যন্ত সুশীলতার অভিনয় করে।

বাংলাদেশ যদি একটা সত্যিকারের সফল রাষ্ট্র, সোনার দেশ, প্রভাশালী বৈশ্বিক মানচিত্র হতে চায় তাহলে এর সুশীল সমাজকে নিরপেক্ষ ও ইনসাফের পক্ষে সরব হতে হবে। দলীয় ও ব্যক্তিগত আদর্শের চেয়ে নাগরিক অধিকার ও ন্যায়-ইনসাফের পক্ষে সক্রিয় হতে হবে সিভিল সোসাইটিকে। আর সিলেক্টিভ এক্টিভিটি দিয়ে দেশ ও জনগণের ভাগ্যের পরিবর্তন সম্ভব হবে না। হতে পারে অল্পকিছু দলান্ধ অপবুদ্ধিজীবী ও সুশীল নামের কুশীলদের ব্যক্তিগত উন্নতি।

বাংলাদেশের সুশীল সমাজ সংজ্ঞার সুশীল সমাজ হয়ে উঠবে এই প্রত্যাশা।

বিজ্ঞাপন

Subscribe
Notify of
guest
6 Comments
Oldest
Newest Most Voted
Inline Feedbacks
View all comments
আবদুল্লাহ শাকের
আবদুল্লাহ শাকের
1 year ago

দারুণ লিখেছেন

Saif Siraj
Saif Siraj

ধন্যবাদ আপনাকে।

JuWeL RaNa
JuWeL RaNa
1 year ago

এই কথাগুলো আমি আমরা আমাদের সবার কথা৷ 💚

মু. আবিদুর রহমান
মু. আবিদুর রহমান
1 year ago

চমৎকার লিখেছেন।

মাহফুজ তাসনিম
মাহফুজ তাসনিম
1 year ago

আদ্যোপান্ত পড়েছি।
একদম রিয়েলিস্টিক।
আপনার মতো আমারও একই প্রত্যাশা।

Saifuddin Khalid
Saifuddin Khalid
10 months ago

কতকিছু অজানা ছিল
আরও কতকিছু অজানা
এমন লেখা আরও চাই
অশেষ কৃতজ্ঞতা আপনার প্রতি
جزاكم الله أحسن الجزاء

স্বত্ব © ২০২৩, যোগাযোগ | ই মেইল : jogajogbd.org@gmail.com

যোগাযোগ-এ প্রকাশিত কোনো লেখা, ছবি কিংবা শিল্পকর্ম লেখক অথবা কর্তৃপক্ষের অনুমতি ছাড়া কোথাও প্রকাশ করা অবৈধ৷