বই : অটুট পাথর (অনূদিত)
মূল : আহমদ ফালুদ্দিন
অনুবাদ : সাবের চৌধুরী
প্রকাশক : রাহনুমা প্রকাশনী
গায়ের দাম : ৩৬০৳
আফগান। আমার স্বপ্নের দেশ। অনুভূতি আর আবেগের বেশ বড় একটা জায়গা দখল করে আছে এই নামটি। এক আকাশভরতি ফানুস ওড়ানোর মতোই আমার আজন্ম সাধ হিন্দুকুশ পর্বতমালার গাম্ভীর্যপূর্ণ রূপসুধা পান করার। কেবল মনে হয় কাবুলের বাতাসে ভেসে বেড়ানো আফগানি সিংহশাবকদের কলধ্বনি আর পাথুরে জমিনে ফেলে যাওয়া তালেবান বীরসেনাদের পদচিহ্ন, কাঞ্চনজঙ্ঘার চূড়ায় সূর্যোদয় দেখার চাইতেও বেশি হৃদয়কাড়া।
আমার জন্মের বছর থেকে আফগান-মার্কিন যুদ্ধ শুরু। পারিবারিক মজলিসে আফগান, তালেবান, কাবুল, কান্দাহার শব্দগুলো শুনতে শুনতে বড় হই। হৃদয়ে গেঁথে যায় এইসব নাম। আমার প্রথম যুদ্ধ বুঝতে শেখা তখন থেকে। নানুবাড়িতে থরে থরে সাজানো বইয়ের সারি থেকে একদিন হাতে উঠে আসে আফগানিস্তানে আমি আল্লাহকে দেখেছি বইটি। আমার বয়েস তখন কত হবে! ৪র্থ শ্রেণিতে পড়ি হয়তো। মনে পড়ে আমি বইখানা পড়ে অঝোরে কান্না করছিলাম। কখনো দুঃখে কখনো আনন্দে। শহিদের মায়ের ধৈর্য, ত্যাগ আর যুদ্ধের ময়দানে খোদায়ি নুসরত এইসব পড়তে পড়তে কান্না করেছি। এরপরে যতবার সেই বই পড়েছি প্রতিবারই অশ্রুসিক্ত হয়েছে চক্ষুদ্বয়। তারপর থেকে আফগান, তালেবান শব্দদুটি নিয়ে দিনে দিনে আমার জানার আগ্রহ বাড়তে থাকে। খুঁজে খুঁজে পড়তে থাকি এ সম্পর্কিত বইগুলো। মিযানের বছর বোধহয় মল্লিক আহমদ সরওয়ারের মরণজয়ী মুজাহিদ বইখানা পড়েছিলাম। বইটি আমার মনে কেটে দিয়েছিল পাহাড়ি যোদ্ধা তালেবান সেনাদের প্রতি গভীর ভালোবাসার এক নতুন আঁচড়। মাসিক রহমত তখন বাসায় আসত নিয়মিত। তাতে খুঁজে খুঁজে তালেবানবিষয়ক লেখাগুলো পড়তাম। অতশত অবশ্য তখন বুঝি না। শুধু মনে হতো আমি ভালোবাসি সেই পাথুরে ভূমিকে। ভালোবাসি পাহাড়ের লড়াকু সন্তানদের। দিন, বছর গড়াতে থাকে যুগের দিকে। এতগুলো বছরে আফগানকে জানতে কী করিনি! নাহবেমির শেষ করে মাদরাসার দীর্ঘ বন্ধে বিনিদ্র রাতে তালেবানের মেয়ে পড়ে চোখের পাতায় এঁকেছি কান্দাহার, মোল্লা ওমর, ডুমুর আর আখরোট বাগানের জলছাপ! গল্প আর ভাষার মান যেমনই হোক কেবল আফগানকে নিয়ে লেখা বলে উপন্যাসখানা আজও আমার প্রিয়। কতবার পড়েছি! ঠিক হিসাব নেই। তারপর একে একে সংগ্রহ করতে থাকি আফগানভিত্তিক বইগুলো। লেখক যেই হোক! গোগ্রাসে গিলেছি।
ইসলামি লেখক বা সেক্যুলার! কার বই পড়িনি! দ্য কাইট রানার বই পড়ে জেনেছি তালেবানবিদ্বেষী আফগানিদের জীবনযাপন, মনোভাব। ভ্রমণকাহিনিগুলোও তো খুঁজে খুঁজে পড়েছি। মঈনুস সুলতানের রোড টু কান্দাহার, কাবুলের ক্যারাভান সরাই। পান্থজনের কাবুলের পথে পথে। তবুও যেন আমার আকণ্ঠ তৃষ্ণা। মুজতবা আলীর দেশে বিদেশে আমার তৃষ্ণা বাড়িয়ে তুলে দ্বিগুণ বহুগুণ।
নিজেকে প্রশ্ন করি কেবল কি আফগান মুলুকের সৌন্দর্যই আমার ভালোবাসার কারণ? মনের ভেতর থেকে প্রশ্ন আসে—না। আমার আশৈশব প্রেম তো কোনো ভূমির প্রতি না। আমার প্রেম সেই জাতির প্রতি যাদের রক্তে পরাজয়, পরাধীনতা বলে কোনো পদার্থ নেই। যারা অকুতোভয়, স্বাধীনচেতা।
সেই জাতির যোদ্ধাদের আমি ভালোবাসি। তাদেরকে জানতে চাই। নাইন ইলেভেনের পর থেকে তারা সমগ্র বিশ্বে নিষিদ্ধ হয়ে পড়ে। যেন বিধ্বংসী কোনো বোমা। আমি দিন গুণতে থাকি তাদের বিজয়ের, স্বাধীনতার। আমার সতত প্রার্থনায় থাকে এই কামনাও—যেভাবে রুশ পরাশক্তিকে চূর্ণবিচূর্ণ করে দিয়েছিল ঠিক সেভাবেই যেন তালেবান মার্কিনি অপশক্তিকে ধুলোয় মিশিয়ে দিতে সক্ষম হয়। অবশেষে আসে সেই কাঙ্ক্ষিত দিন। ফাতহুম মুবিন। সেজদায় লুটিয়ে পড়ে অঝোরে কান্না করার দিন।
এখন সময় সমকালীন আফগানকে জানার, চেনার। শৈশবের ভালোবাসার সেই তালেবান যারা আত্মপ্রকাশ করেছে এবার নতুন রূপে। নতুন নাম “আল ইমারাতুল ইসলামিয়্যাহ”।

লেখক আহমদ ফালুদ্দিন
আফগান ও তালেবান নিয়ে পাঠের ধারাবাহিকতায় হাতে আসে অটুট পাথর বইখানা। লেখক আহমাদ ফালুদ্দিন আল-জাজিরার সাংবাদিক হয়ে তালেবান কর্তৃক বিজিত আফগানে সফর করেছেন। সেই সফরের সফরনামা এই বই। সমকালীন আফগানকে চেনার জার্নি শুরু করলাম বইটি থেকেই। সেই আফগান—যে ভূমির প্রতি আমার আশৈশব প্রেম তা এখন আমার স্বপ্নের রূপে। স্বাধীন এক ভূমি। যেখানে নেই কোনো দখলদার পরাশক্তির হিংস্রতা। লিল্লাহিয়্যাতের রাহে চলা একদল শান্তির পতাকাবাহীর হাতে এখন দেশটির ক্ষমতার লাগাম। বর্তমান আফগানের অবস্থা কেমন তা দিয়েই বইটির আলোচনা ধীরে ধীরে এগিয়ে যায়। আহমাদ ফালুদ্দিন আফগানিস্তানে রুশ আগ্রাসন থেকে শুরু করে, ব্রিটিশ ও সর্বশেষ আমেরিকার একটি নিরর্থক, অমানবিক, ব্যর্থ ফলাফলের যুদ্ধে জড়ানো নিয়ে বেশ ভালো রকমের বিশ্লেষণ করেছেন। যা কিছুটা সংক্ষিপ্ত হলেও মর্মবহুল। লেখকের আলোচনায় উঠে এসেছে যুদ্ধের দীর্ঘ সময়ে তালেবানদের টিকে থাকা, প্রতিহত করা ও উড়ে এসে জুড়ে বসতে চাওয়া এক দাম্ভিক পরাশক্তিকে ঝেঁটিয়ে দেশের ভূমি থেকে বিদায় করার ইতিহাস। আমেরিকার পরাজয় হবে এবং এই কথাটা কেন অবশ্যম্ভাবী, কোন সে শক্তিতে বলিয়ান হয়ে দেখতে চাষাভুষোর মতো একদল লোক বিশ্বের অন্যতম পরাশক্তি আমেরিকাকে আফগানের পাথুরে ভূমিতে গড়াগড়ি খাওয়াতে সক্ষম হলো, কোন সে ভয়ে আমেরিকান সৈন্যগুলো হিন্দুকুশ পর্বতমালার দেশকে ছাড়তে মরিয়া হয়ে উঠেছিল লেখক সে সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করেছেন। লেখকের চমৎকার বর্ণনাভঙ্গি এইসব গুরুগম্ভীর আলাপকেও আকর্ষণীয় করে তুলেছিল। তার অভিনব উপস্থাপনা পাঠককে ধরে রাখে চুম্বকের মতো। আমেরিকার পরাজয় ঘটেছে আমু দরিয়ার তীরঘেঁষা এক কাঠখোট্টা পাথুরে ভূমিতে। সকলের চোখের সামনে ঘটে যাওয়া বাস্তবতা এইটুকুই। কিন্তু এই প্রায় অসম্ভব ব্যাপার সংঘটিত হওয়ার ঘটনাপ্রবাহ আড়ালেই পড়েছিল। লেখক আহমাদ ফালুদ্দিন কাতারভিত্তিক সংবাদ মাধ্যম আল জাজিরার সাংবাদিক হওয়ায় ও উভয় পক্ষের মধ্যস্থতায় কাতারের পূর্ণাঙ্গ সহযোগিতা থাকায় আড়ালে থাকা অনেক ঘটনাপ্রবাহই লেখকের কলমে উঠে আসে। জানা যায়, তালেবান-আমেরিকার আলোচনার টেবিলে আমেরিকার ব্যর্থতা, তালেবান নেতাদের দ্ব্যর্থহীন কণ্ঠে সিদ্ধান্ত জানিয়ে তার উপর অটল থাকার মতো চমৎকার ব্যাপারটি। এই জায়গাটা পড়তে গিয়ে বলা যায় ঘেমে উঠছিলাম। কী দুর্দান্ত তালেবান! কৌশল ও সাহসিকতার অনন্য নজির! শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে কেন আফগান ভূমির প্রতি দখলদারদের লোলুপ দৃষ্টি, আফগান ভূমির অপরূপ সৌন্দর্য, পূর্বকাল থেকে আজতক তার ভৌগোলিক গুরুত্বের কথাও লেখক মোটাদাগে তুলে এনেছেন।
তালেবান—আমার আশৈশব ভালোবাসা ও হৃদয়ের সকল আবেগ নিবেদিত যে দলটির জন্য, সেই তালেবানের সূচনাকাল, সংগঠিত হওয়ার প্রেক্ষাপট, তাদের লক্ষ্য-উদ্দেশ্য ও আজকের ইমারাতে ইসলামিয়্যাহ হয়ে ওঠার ইতিহাস বর্ণনা করেছেন লেখক তার নির্মোহ, সাবলীল গদ্যের মাধ্যমে। বইখানা পড়তে পড়তে বারবার গায়ে কাঁটা দিচ্ছিল। চোখের পানি আটকে রাখা কঠিন। আনন্দের কান্না ও বিস্ময় মিলে একাকার হয়ে যাচ্ছিল। কখনো এমন হয়েছে বই বন্ধ করে কান্না করছি। দোপাট্টা ভিজে যাচ্ছিল বারবার। অথচ লেখক এমন এক প্রফেশনের যে তার বইয়ে অযথা থ্রিল বা ইমোশন দিয়ে লেখা চমকপ্রদ করার প্রশ্নই আসে না। তালেবান এমন এক দল যাদের ইতিহাস ও ঐতিহ্যের পুরোটাই আজন্ম থেকে আমাদের আবেগ, অনুভূতি দখল করে আছে আর আফগানিস্তানের প্রতিটি ধূলিকণায় মিশে আছে থ্রিল। নাইন ইলেভেনের হামলা যখন হয় তখন আমেরিকার পাগলামি, দাম্ভিকতা ও মুসলমানদের অযথা হয়রানি করা থেকে নিয়ে শেষতক সেই দাম্ভিকতার পরিণতি পড়া পর্যন্ত পাঠক সম্মোহিত হয়ে থাকতে বাধ্য। যতটা আত্মম্ভরিতার সাথে আমেরিকা আফগানিস্তানে প্রবেশ করেছিল ঠিক ততটাই অপমান, অপদস্থতাভরতি ঝুলি নিয়ে শেষ মার্কিন সৈন্যটি আফগান ভূমি পরিত্যাগ করেছে। ফাতহুম মুবিনের দিনের বর্ণনা পড়তে গিয়ে কান্না আটকানোর চেষ্টা ব্যর্থ হয়ে চোখ ভিজে যায়। আমেরিকার এই শোচনীয় পরাজয়ের কারণ লেখক খুব সুন্দরভাবে বিশ্লেষণ করেছেন। তালেবানের প্রতিষ্ঠাতা মোল্লা ওমরের বিস্ময়কর জীবনযাপন, ধৈর্য, সাহসিকতা, দ্বীনের উপর তার ইস্তেকামাত, আমিরুল মুমিনিন হওয়ার ঘটনাসহ তার সম্পর্কে লেখক এমনসব চমৎকার তথ্য তুলে এনেছেন, যা আর কোনো কিতাবে হয়তো বর্ণিত হয়নি। এটা সম্ভব হয়েছে লেখক মোল্লা ওমরের ব্যক্তিগত দেহরক্ষীর সাক্ষাৎ পাওয়ায়। যিনি মোল্লা ওমরকে বছরের পর বছর খুবই কাছ থেকে অবলোকন করেছিলেন।

মূল আরবি বইয়ের প্রচ্ছদ
মুহাম্মদ আজম নামে বর্তমান তালেবানের যে যুবক যোদ্ধার সঙ্গে লেখক আলাপ করেছেন, জানতে চেয়েছেন তাদের সাহসিকতার রহস্য, স্বজন হারানোর বেদনা, দীর্ঘ সময় ধরে দিতে থাকা ধৈর্য আর ত্যাগের পরীক্ষার কথা সে অংশটুকু পড়তে গিয়ে কান্না ধরে রাখা কঠিন। মনে হচ্ছিল হাউমাউ করে কান্না করি। কাবুল বিজয়ের পরে কাবুলের জমিনে শোকর আদায়ের সিজদার কথা যখন লেখক বলছিলেন, মনে পড়ে যাচ্ছিল আমার নিজের সেদিনের অনুভূতির কথা।
১৯৯৭ সালের তালেবান ও বর্তমান তালেবানের দৃষ্টিভঙ্গি, রীতিনীতিতে কীরকম পরিবর্তন এসেছে লেখক তার সংক্ষিপ্ত আলোচনা করেছেন। যেখানে তিনি সমকালীন বৈশ্বিক কূটনীতির সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলতে গিয়ে তালেবান পদে পদে যে প্রজ্ঞার ছাপ রাখছে তার কথাও উল্লেখ করেছেন। নারীনীতি নিয়ে তালেবান সম্পর্কে সাধারণ আফগানি ও বহির্বিশ্বের যে অমূলক ভয় ভীতি এবং নারীদের জন্য সমকালীন তালেবান কী কী করছে সেসব কথাও তুলে এনেছেন। এতে করে আন্তর্জাতিক কুচক্রী মহলের মুখে কুলুপ এঁটে দেওয়ার মতোন একটা পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে।
একটা অনুবাদকৃত বইয়ের সঙ্গে পাঠকের জার্নি কখন সুখকর হয়? যখন পাঠক পড়তে গিয়ে একথা অনুভব করে যে, সে কোনো বই পড়ছে না বরং সবকিছু লেখকের চোখে দেখছে। অটুট পাথর বইটিতে অনুবাদক সাবের চৌধুরী গদ্য ও শব্দচয়নে এমনই মুন্সিয়ানা দেখিয়েছেন, পড়তে গিয়ে মনে হচ্ছিল ঘটনাপ্রবাহ সব আমার চোখের সামনেই ঘটছে। চমৎকার, সাবলীল তার বর্ণনাভঙ্গি। অনন্য তার শব্দচয়ন, বাক্যবিন্যাস। বহুদিন পর কোনো অনুবাদ পড়ে চোখ ও মনের শান্তি হলো। মনে হচ্ছিলো এই বইয়ের অনুবাদ এমন না হলে বরং মানানসই হতো না। অনুবাদকের সার্থকতা তো এখানেই। আল্লাহ লেখক ও অনুবাদক উভয়কেই জাযায়ে খাইর দান করুন।

প্রচ্ছদ : অটুট পাথর
হাজরুল আরদের আরেকটা প্রচ্ছদ আছে__সেটা সুন্দর।