বাংলাবাজার থেকে বাসায় ফিরব। কিন্তু দুপুরের খাবারটাও খাওয়া দরকার। পুরান ঢাকায় দাঁড়িয়ে যেদিকেই তাকাই কেবল বিরানি আর বিরানি। এই গরমে বিরানির কথা চিন্তা করতেই কেমন যেন শরীরটা গুলিয়ে উঠল। খেতে হবে তেল কম আছে এমন খাবার। ঝরঝরে সাদা ভাত সাথে একটু মুরগির গোশ, ঝোল থাকবে না, শুকনো শুকনো। মাথার ভেতর আসলে ঘুরছিল ঝুনুর পোলাওয়ের কথা। দেশি মোরগের ঝুনুর পোলাও।
রিকশায় ওঠার পরপরই মনে হলো, এক ঢিলে দুই পাখি মারার সুবর্ণ সুযোগ আমার সামনে। অনেকদিন যাবৎ বিনত বিবির মসজিদে যাবো যাবো করে যাওয়া হচ্ছে না। ঝুনুর পোলাও আর বিনত বিবির মসজিদ পাশাপাশি। দশ বারো গজ দূরত্ব মাঝখানে। বিনত বিবির মসজিদ হচ্ছে ঢাকার প্রথম মসজিদ…
ঢাকার অধিকাংশ প্রাচীন মসজিদ তৈরি মোগল আমলে। মোগলদের দৃষ্টিনন্দন নির্মাণশৈলী তেমনটাই সাক্ষী দেয়। ঢাকার সবথেকে প্রাচীন মসজিদের খোঁজে আমাদেরকে মোগল আমল ছাড়িয়ে সুলতানি আমলে যেতে হবে। সুবেদার ইসলাম খাঁ ঢাকাকে আনুষ্ঠানিক ভাবে রাজধানী ঘোষণা করেন ১৬১০ সালে। ইসলাম খানের আগমনের প্রায় ১৫০ বছর আগে মসজিদটি নির্মিত। এখন স্বভাবতই প্রশ্ন চলে আসে কে ছিল বিনত বিবি? আর কেনই বা তার নামে মসজিদ।
মসজিদে খোদিত শিলালিপি অনুসারে ৮৬১ হিজরি সালে, অর্থাৎ ১৪৫৭ সালে মসজিদটি নির্মিত। তখন সুলতান নাসিরুদ্দিন মাহমুদ শাহের শাসন চলছে। মসজিদটি নির্মাণ করেন মূলত বিনত বিবির বাবা আরকান আলী। সে সময় পারস্য উপসাগরের আশেপাশের লোকজন প্রায়ই জলপথে এ অঞ্চলে বাণিজ্যে আসতেন। পুরান ঢাকার এই এলাকা (নারিন্দা-ধোলাইখাল) দিয়ে তখন বয়ে যেত বুড়িগঙ্গার একটি শাখা যা বুড়িগঙ্গা হয়ে শীতলক্ষ্যায় গিয়ে মিশত। আরাকান আলি নামক এক সওদাগর সে সময় এ এলাকায় বাণিজ্যের জন্য আসেন এবং এখানে বসবাস শুরু করেন। তিনিই নামাজ পড়ার সুবিধার্থে এখানে মসজিদটি নির্মাণ করেছিলেন।
এখানে বসবাসকালীন আরাকান আলির মেয়ে বিনত বিবির আকস্মিক মৃত্যু হয়। এই মসজিদের পাশেই সমাধিস্থ করা হয় এবং পরবর্তীতে আরাকান আলীর মৃত্যু ঘটলে তাকেও এখানেই কবর দেয়া হয়। পরবর্তীতে বিনত বিবির নামে মসজিদটির নামকরণ করা হয়।

বিনত বিবির মসজিদ। ছবি : বণিক বার্তা
বারবার সংস্কার এবং পরবর্তী সময়ে সংযোজনের ফলে বর্তমানে মসজিদের বাইরের প্রকৃত অবয়ব একেবারেই পাল্টে গেছে। তবে মসজিদটির সংস্কার ও সম্প্রসারণ করা হলেও এতে প্রাক-মোঘল সালতানাতের বৈশিষ্ট্যসমূহ বেশ ভালোভাবেই লক্ষ করা যায়। বারবার পুরু আস্তরণের ফলে মসজিদের পোড়ামাটির অলংকরণ এখন আর দেখা যায় না। বাংলা ১৩৩৭ সালে এ মসজিদটির দ্বিতীয় সংস্করণ করা হয় এবং দ্বিতীয় গম্বুজটি স্থাপন করা হয়। প্রায় ২০০ বছর ধরে এলাকাবাসী একটি কমিটির মাধ্যমে এ মসজিদটির দেখাশোনা করে আসছেন। এলাকাবাসী ও মসজিদ পরিচালনা কমিটির উদ্যোগে বর্তমানে পুরোনো ভবন ঠিক রেখে নতুন সাত তলা মসজিদ ভবণ নির্মাণ করা হয়েছে।
মসজিদে জোহরের নামাজের পরে কিছুক্ষণ বসে থাকলাম মসজিদ সংশ্লিষ্ট কারো সাথে কথা বলা যায় কি না সেই লোভে। কিছু সময় পরেই পেয়ে গেলাম মসজিদের মুয়াজ্জিনকে। ভদ্রলোকের নাম আবদুল হাকিম। প্রায় নয় বছর যাবৎ তিনি আছেন এই ঐতিহাসিক মসজিদে। কথায় কথায় জিজ্ঞেস করলাম মসজিদটির ঐতিহাসিক গুরুত্ব সম্পর্কে তিনি ওয়াকিফহাল কি না। মুয়াজ্জিন সাহেব আমাকে থামিয়ে দিয়ে বললেন, কোনো ভিডিয়ো করার জন্য আসছে কি না। বুঝলাম ডকুমেন্টারি বা ব্যক্তিগত ভ্লগ করার জন্য অনেকেই আসে আজকাল। আমি মুচকি হেসে বললাম, নাহ… এমনি একটু কথা বলতে আসছি। কথায় কথায় অনেক কিছু জানলাম। সেসব কথা আরেকদিন হবে। খিদেয় পেট বিদ্রোহ শুরু করেছে । মুয়াজ্জিন সাহেবের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে পা চালালাম ঝুনুর পোলাওয়ের দিকে।
ঢাকার প্রথম মসজিদের খবর অনেকে না জানলেও ঝুনুর পোলাওয়ের খোঁজে একই রাস্তায় প্রতিদিন অসংখ্য মানুষ আসেন। কর্তৃপক্ষের সুনজর ও দায়িত্মশীলতার সুষ্ঠু প্রয়োগ হলে মসজিদটি হয়ে উঠতে পারে দর্শনীয় স্থান। সে আর হবে কবে!
পদচিহ্ন ধরে | বিবি মিরণের মসজিদ
চমৎকার লেখা
‘পদচিহ্ন ধরে’ নিয়মিত হোক, ইনাম ভাই!
মাশা-আল্লাহ। সুন্দর তথ্য।
আচ্ছা কেউ কেউ বলতে চাচ্ছেন এবং ইউকিপিডিয়ার আকসার তত্বও এমনই যে মসজিদটির মূল নির্মাতা বিনত বিবি এবং তিনি ছিলেন একজন বারবনিতা (পতিতা) বক্তব্যটি আমার কাছে মিথ্যা এবং উদ্দেশ্য প্রনোদিত বলে মনে হয়। ইউকিপিডিয়ায় সঠিক ইতিহাসটা তুলে ধরলে ভালো হতো।