ইসলামি শিল্পকলা বা ইসলামিক আর্ট এক বিশেষ শৈল্পিক ধারা। এই ধারা মূলত ইসলামি সংস্কৃতি ও ধর্মীয় বিশ্বাসকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছে। ইসলামে যেহেতু প্রাণীর ছবি আঁকাকে নিরুৎসাহিত করা হয়েছে তাই এই শিল্পকলার অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য হলো এর বিমূর্ততা, জ্যামিতিক নকশা, আরবি ক্যালিগ্রাফি এবং প্রাকৃতিক অনুপ্রেরণায় গঠিত নকশা। পোশাকে ইসলামি শিল্পকলার ব্যবহার মূলত এইসব উপাদানের ভিত্তিতেই গড়ে ওঠে। ইসলামি শিল্পকলা কেবল মসজিদ, কোরআন বা স্থাপত্যে সীমাবদ্ধ নয়; পোশাকেও এর একটি দারুণ সৌন্দর্যমণ্ডিত প্রয়োগ রয়েছে। ঐতিহ্য ও ধর্মীয় ভাবধারাকে ধারণ করে আধুনিক যুগেও ইসলামি পোশাক শিল্প বৈশ্বিক ফ্যাশনে একটি গুরুত্বপূর্ণ স্থান দখল করে আছে।
ইসলামি পোশাক শুধুমাত্র বাহ্যিক সৌন্দর্য প্রকাশ করে না, বরং তা একজন মুসলিমের শালীনতা, আধ্যাত্মিকতা এবং বিশ্বাসের প্রতিফলন ঘটায়। ইসলামি শিল্প ব্যবহার করে তৈরি পোশাক মানুষকে স্মরণ করিয়ে দেয় তার ধর্মীয় পরিচয় ও নৈতিক মূল্যবোধ। পোশাকে ইসলামি শিল্পকলার ব্যবহার কেবল নান্দনিকতার জন্য নয়, বরং তা একটি আধ্যাত্মিক, সাংস্কৃতিক এবং ধর্মীয় প্রকাশ। এই নকশাগুলোর মাধ্যমে একজন ব্যক্তি নিজের বিশ্বাস, শালীনতা এবং ঐতিহ্য বহন করেন।
ইসলামি শিল্পকলার ইতিহাস খুবই সমৃদ্ধ এবং বৈচিত্র্যময় এবং এটি পোশাক শিল্পে এক গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব ফেলেছে। ইসলামি শিল্পের সূচনা সপ্তম শতাব্দীতে ইসলামের উত্থানের সঙ্গে সঙ্গে। এই শিল্পধারাটি মূলত ধর্মীয় আদর্শ, যেমন অনারূপ চিত্র বা ফিগারাল ইমাজিনারি এড়িয়ে চলা এবং বিমূর্ত নকশা ব্যবহারে অনুপ্রাণিত। ইসলামি পোশাক শুধুমাত্র ধর্মীয় অনুশাসনের অনুগামী নয়, বরং শিল্পকলার এক অভিজাত মাধ্যমও বটে।
পোশাকে ইসলামি শিল্পকলার একটি প্রধান বৈশিষ্ট্য জ্যামিতিক নকশা। যেকোনো একটা ফর্ম একই ফরমেটে বারবার ব্যবহার করা হয়; যেমন গোল একটা ফর্ম বা ত্রিভুজ একটা ফর্ম বা গোল আর ত্রিভুজ মিলে একটা ফর্ম। এখন এই ফর্ম একইভাবে বারবার ব্যবহার করা হয়; অর্থাৎ নকশাগুলো প্রধানত পুনরাবৃত্তি। এই পুনরাবৃত্তিকে অনন্তের প্রতীক হিসেবে দেখা হয়; অর্থাৎ এর কোনো শেষ নেই। এই নকশা একই সাথে স্রষ্টার নিখুঁত সৃষ্টি ও সুষমতার প্রতীক হিসেবে ধরা হয়। পোশাকে এই নকশাগুলো প্রিন্ট, অ্যামব্রয়ডারি কিংবা বুননের মাধ্যমে ব্যবহার হয়। জুব্বা, আবায়া, কুর্তি, স্কার্ফ ইত্যাদিতে জ্যামিতিক মোটিফ দেখা যায়।
পোশাকে ইসলামি শিল্পকলার আরেকটি প্রধান বৈশিষ্ট্য আরবি ক্যালিগ্রাফি। পবিত্র কুরআনের আয়াত, ধর্মীয় শব্দ বা দোয়া আরবি ক্যালিগ্রাফির মাধ্যমে পোশাকে অলংকরণ হিসেবে ব্যবহার হয়। কোরআনের আয়াত, বিসমিল্লাহ, আল্লাহর ৯৯ নাম প্রভৃতি আরবি লিপিতে সুদৃশ্যভাবে লেখা হয়। সাধারণত কমন কিছু শব্দ বা বাক্য অধিক ব্যবহার হয়। ব্যতিক্রমও হতে পারে। অধিক ব্যবহৃত শব্দগুলো এমন : মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ( محمد ﷺ), আল্লাহ (الله), আলহামদুলিল্লাহ (الحمد لله), বিসমিল্লাহ (بِسْمِ اللَّهِ)।
এই ক্যালিগ্রাফি প্রধানত জামার বুকের অংশে, হাতার প্রান্তে বা স্কার্ফে ডিজাইন হিসেবে ব্যবহার হয়। পোশাকের নিচের অংশে ব্যবহার করা হয় না, হওয়াটা সমীচীন না।
পোশাকে ইসলামি শিল্পকলার আরেকটি প্রধান বৈশিষ্ট্য হলো আরবেস্ক নকশা বা আরবেস্ক প্যাটার্ন। এই নকশা মূলত গুল্ম, ফুলপাতা ও প্রাকৃতিক উপাদানের বিমূর্ত রূপ। এই নকশাগুলোর মধ্যে একটা ধারাবাহিকতা থাকে আবার ব্যতিক্রমও হয়। নকশাগুলো এক ধরনের আধ্যাত্মিক সৌন্দর্য উপস্থাপন করে। পোশাকে এই নকশাগুলো ব্যবহারের ফলে নান্দনিকতা ও পরিশীলিত ধর্মীয় বার্তা প্রকাশ পায়।
আধুনিক ফিউশন একটি নতুন ধারা। আজকের ইসলামি ফ্যাশনে ঐতিহ্যবাহী ইসলামি মোটিফগুলোকে আধুনিক ডিজাইন ও ট্রেন্ডের সঙ্গে মিশিয়ে নতুন ধারার সৃষ্টি হচ্ছে। হিজাব বা অ্যাবায়াতে মিনিমালিস্ট ক্যালিগ্রাফি ডিজাইন। সিল্ক, কটন, লিনেন প্রভৃতি কাপড়ে ব্যবহার হচ্ছে।
ইসলামি শিল্পকলার আরেকটি বৈশিষ্ট্য পোশাকে ব্যবহার হয় সেটি হলো আর্কিটেকচার মোটিফ অর্থাৎ গম্বুজ, মিনার, মেহরাব ইত্যাদি। মুসলিম সমাজে পুরুষদের টুপি আর স্কার্ফ একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। বিভিন্ন রকমের টুপিতে এবং স্কার্ফে ইসলামি শিল্পকলার বিভিন্ন মোটিফের ব্যবহার দেখা যায়।
পোশাকে ইসলামি শিল্পকলার ব্যবহার একটি গভীর সাংস্কৃতিক ও নান্দনিক ধারা। এটি ইতিহাস, ধর্মীয় মূল্যবোধ এবং সৃজনশীলতার এক সংমিশ্রণ, যা পোশাকে নকশা, অলংকরণ ও উপস্থাপনার মাধ্যমে ফুটে ওঠে।
ইসলামি শিল্পকলা বা ইসলামিক আর্টের প্রভাব বিভিন্ন দেশের পোশাকশিল্পে দৃশ্যমান, বিশেষ করে যেসব দেশে ইসলাম ধর্ম ও সংস্কৃতি গভীরভাবে প্রোথিত। পোশাকে ইসলামি শিল্পকলার ব্যবহার বেশি দেখা যায় ইরান, তুরস্ক, মরক্কো, সৌদি আরব, ইন্দোনেশিয়া, মালয়েশিয়া এবং পাকিস্তানে। ভারতও এই তালিকায় আছে কেননা ভারতে রয়েছে এক বিশাল মুসলিম জনগোষ্ঠী।
ইরানিরা প্রাচীন পারসিয়ান ও ইসলামি মোটিফ যেমন আরাবেস্ক, জ্যামিতিক নকশা, ক্যালিগ্রাফি ইত্যাদি পোশাকে ব্যাপকভাবে ব্যবহার করে। তাদের ঐতিহ্যবাহী চাদর, আবায়া, এবং হিজাবে ইসলামি অলঙ্করণ থাকে। তুরস্কে বা তুর্কি পোশাকে ওসমানীয় বা অটোমান আমলের প্রভাব লক্ষণীয়। তাদের পোশাকে ইসলামি ক্যালিগ্রাফি, টালি নকশা, এবং ফুলেল মোটিফ ব্যবহৃত হয়। মরক্কোর ঐতিহ্যবাহী পোশাক জাবাদোর, কাফতানে ইসলামি জ্যামিতিক ও জারদৌসি কাজ দেখা যায়। পোশাকে অনেক সময় মসজিদের ডিজাইন অনুপ্রাণিত অলঙ্করণ থাকে। সৌদি আরবে আবায়া এবং থোব জাতীয় পোশাকে কালিগ্রাফি ও মসজিদের মিনার অনুপ্রাণিত ডিজাইন থাকে। সৌদিতে সাম্প্রতিক সময়ে ফ্যাশনবিষয়ক পরিবর্তনের সঙ্গে ইসলামি মোটিফ যুক্ত করে আধুনিক ও ঐতিহ্যের সমন্বয় দেখা যায়। ইন্দোনেশিয়া ও মালয়েশিয়াতে বাটিক এবং সিল্কের কাপড়ে ইসলামি মোটিফ, যেমন জ্যামিতিক প্যাটার্ন, ফুলের ডিজাইন এবং আরবি ক্যালিগ্রাফির সংমিশ্রণ করা হয়। এই দুই দেশের হিজাব ও আবায়ায় ইসলামি অলঙ্করণ খুবই জনপ্রিয়। পাকিস্তান ও ভারতের মুসলিম জনগোষ্ঠীর মধ্যে কুর্তা, শালওয়ার কামিজ ও দোপাট্টায় ইসলামি মোটিফ যেমন মুঘল স্থাপত্য থেকে অনুপ্রাণিত ডিজাইন ব্যবহার হয়। এছাড়া তাদের পোশাকে আরবি ও উর্দু ক্যালিগ্রাফি অলঙ্করণ হিসেবে ব্যবহার হয়।
মুঘল ভারতে ইসলামি পোশাকে আরবি-ফারসি লেখার ক্যালিগ্রাফিক প্যাটার্ন, জরি-কাঁথা, এবং মিনিয়েচার শিল্পের প্রতিফলন দেখা যায়। ইসলামী সভ্যতায় সূচিকর্ম ও টেক্সটাইল শিল্প বিশেষ মাত্রায় পৌঁছায়। ব্রোকেড, জরিপাড়, ইকাত, সিল্ক বুনন বিশেষ খ্যাতি অর্জন করে। সিরিয়া, মিশর, ইরান ও তুরস্ক এই সূচিকর্ম পোশাক রফতানিতে অগ্রণী ছিল।
আধুনিক ইসলামি ফ্যাশনে ঐতিহ্যের প্রতিফলন দেখা যায়। আজকের ইসলামি ফ্যাশন ডিজাইনাররা ঐতিহ্যগত শিল্পকলা, বিশেষ করে: মোরোক্কান কাফতান, তুর্কিশ হিজাব নকশা, ইরানিয়ান চাদর, ইন্দোনেশিয়ান বাটিক এইগুলোতে ঐতিহ্যগত জ্যামিতিক ও ক্যালিগ্রাফিক প্যাটার্ন পুনরুজ্জীবিত করছেন।
তুরস্কের ঐতিহ্যবাহী পোশাক হলো কাফতান, সিল্ক জুব্বা; এখানে মূলত ব্যবহার হয় টাইল আর্ট, জ্যামিতিক ডিজাইন। পারস্যর ঐতিহ্যবাহী পোশাক হলো চোগা, সিল্ক স্কার্ফ; এখানে মূলত ব্যবহার হয় মিনিয়েচার ও অ্যারাবেস্ক। মরক্কোর ঐতিহ্যবাহী পোশাক হলো জেলাবা ও কাফতান। এখানে মূলত ব্যবহার হয় আরবি ক্যালিগ্রাফি ও হাতে করা অ্যামব্রয়ডারি। ভারতের ঐতিহ্যবাহী পোশাক শেরওয়ানি ও দোপাট্টা। এখানে মূলত ব্যবহার হয় মুঘল মোটিফ ও জরির কাজ। পারস্য বা ইরানি অ্যামব্রয়ডারি বিখ্যাত। ইরানে প্রচলিত পাতেহ বা পারসিয়ান অ্যামব্রয়ডারি পোশাকে সূক্ষ্ম সিল্ক থ্রেড ও স্বর্ণের সূচিকর্ম থাকে।
বাংলাদেশের পোশাকেও আমরা ইসলামি শিল্পকলার ব্যবহার দেখি। ঈদ, জুমা বা ধর্মীয় অনুষ্ঠান উপলক্ষে পুরুষদের পাঞ্জাবি ও জুব্বায় আরবি ক্যালিগ্রাফি এবং জ্যামিতিক নকশা ব্যবহার করা হয়। গলার কাছের অংশ, হাতার প্রান্ত ও বুকের অংশে সূচিকর্মে ইসলামি মোটিফ ব্যবহৃত হয়। মহিলাদের আবায়া ও হিজাবে সূক্ষ্ম আরবেস্ক নকশা বা ক্যালিগ্রাফি দেখা যায়, বিশেষত কালো, ধূসর বা গাঢ় রঙে। হিজাবে আল্লাহর নাম বা কোরআনিক আয়াত ক্যালিগ্রাফির মাধ্যমে অলংকরণ করা হয়। কিছু শাড়ি বা কামিজে একটা নির্দিষ্ট সীমার মধ্যে ইসলামি মোটিফ ও জ্যামিতিক নকশা প্রয়োগ করা হয়, বিশেষত পাড় ও আঁচলে। রেশমি বা খাদি কাপড়েও হাতে আঁকা বা ব্লক প্রিন্টে ইসলামি শিল্পকলার প্রভাব দেখা যায়। জামদানি, নকশিকাঁথা এবং ব্লক প্রিন্ট কাপড়েও ইসলামি মোটিফ ঢুকে পড়েছে। এছাড়া বিভিন্ন হস্তনির্মিত বস্ত্রপণ্যে ধর্মীয় নান্দনিকতা ফুটিয়ে তোলা হয়।
বাংলাদেশে আজকাল অনেক ফ্যাশন ব্র্যান্ড তাদের কালেকশনে ইসলামি মোটিফ সংযুক্ত করছে। তরুণ প্রজন্মের মধ্যে ইসলামি ক্যালিগ্রাফি প্রিন্ট করা পাঞ্জাবি, টি-শার্ট, কুর্তা ও স্কার্ফ জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে। বাংলাদেশের পোশাকে ইসলামি শিল্পকলার ব্যবহার একটি ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক পরিচয়ের বহিঃপ্রকাশ। এটি কেবল আধ্যাত্মিকতার প্রতিফলনই নয়, বরং বাঙালি মুসলিম সমাজের রুচি, ঐতিহ্য এবং সৃজনশীলতাকে একত্রে উপস্থাপন করে।
ইসলামি শিল্পকলা ব্যবহার পোশাককে শুধু নান্দনিক করে তোলে না, বরং তা পরিধানকারীর ধর্মীয় মূল্যবোধকেও তুলে ধরে। বিশেষত ইসলামী অনুষ্ঠানে এমন পোশাক সমাজে সম্মান ও আত্মপরিচয়ের একটি চিহ্ন হয়ে ওঠে।