প্রুফরিডার

অস্ট্রিক আর্যু

‘সমস্ত পৃথিবীতে একভাষা ও একরূপ কথা ছিল। পরে লোকেরা পূর্ব্বদিকে ভ্রমণ করিতে করিতে শিনিয়র দেশে এক সমস্থলী পাইয়া সে স্থানে বসতি করিল; আর পরস্পর কহিল, আইস, আমরা ইস্টক নির্মাণ করিয়া অগ্নিতে দগ্ধ করি; তাহাতে ইস্টক তাহাদের প্রস্তর মেটিয়া তৈল চূর্ণ হইল। পরে তাহারা কহিল, আইস, আমরা আমাদের নিমিত্তে এক নগর ও গগণস্পর্শী এক উচ্চগৃহ নির্মাণ করিয়া আপনাদের নাম বিখ্যাত করি, পাছে সমস্ত ভূমণ্ডলে ছিন্নভিন্ন হই। পরে মনুষ্যসন্তানেরা যে নগর ও উচ্চগৃহ নির্মাণ করিতেছিল, তাহা দেখিতে সদাপ্রভু নামিয়া আসিলেন। আর সদাপ্রভু কহিলেন, দেখ, তাহারা সকলে একজাতি ও এক ভাষাবাদী; এখন এই কর্মে প্রবৃত্ত হইল; ইহার পরে যে কিছু করিতে সংকল্প করিবে, তাহা হইতে নিবারিত হইবে না। আইস, আমরা নিচে গিয়া, সেই স্থানে তাহাদের ভাষার ভেদ জন্মাই, যেন তাহারা একজন অন্যের ভাষা বুঝিতে না পারে। আর সদাপ্রভু তথা হইতে সমস্ত ভূমণ্ডলে তাহাদিগকে ছিন্নভিন্ন করিলেন, এবং তাহারা নগর পত্তন হইতে নিবৃত্ত হইল। এই জন্য সেই নগরের নাম বাবিল [ভেদ] থাকিল; কেননা সেই স্থানে সদাপ্রভু সমস্ত পৃথিবীর ভাষার ভেদ জন্মাইয়াছিলেন, এবং তথা হইতে সদাপ্রভু তাহাদিগকে সমস্ত ভূমণ্ডলে ছিন্নভিন্ন করিয়াছিলেন।’

কালিদাস বাক্যের সহিত অর্থের সম্পর্ক হরগৌরীর সম্পর্কের মতো নিত্য জানিয়া বাগর্থপ্রপত্তির জন্য হরগৌরীকে বন্দনাপূর্ব্বক মহাকাব্য আরম্ভ করিয়াছিলেন; কিন্তু ঐ সম্পর্ক কিরূপে আসিল, তাহা পণ্ডিতেরা অদ্যাপি মাথা খুঁড়িয়াও নিরূপণ করিতে পারেন নাই—তবে পূর্ববাঙলার মেঘনাপারের ধীবরসন্তান খবিরুদ্দিন যিনি নদী থেকে জাল ওঠানোর অবসরে বাগর্থসহযোগে স্ববিরচিত সঙ্গীত গাইতেন আপন মহিমায়, তারই কী যেন এক গোপনবহতা বইছে প্রপৌত্র আবদুল মুজতবা সেলিমের রক্তে; যখন এদিক-ওদিক দুচারটি কবিতা প্রকাশ হচ্ছিল তার, সে সময়টায় আরেকটু নিবিষ্টভাবে কাব্যচর্চা করতে গিয়ে কয়েকজন তরুণ কবির সাথে কাব্যভাবনার নিয়ামক নিয়ে তার সখ্য গড়ে ওঠে। সে সময়টায় পূর্বপরিচিত এক জ্যেষ্ঠ কবির বাসায় সে প্রথমবারের মতো প্রুফশিট দেখে। ঐ কবির তৃতীয় কাব্যগ্রন্থটি তখন প্রকাশের দোরগোড়ায়। কবির একজন প্রতিবেশী প্রুফরিডার তখন তাকে শেখাচ্ছিলেন কী করে প্রুফ কাটতে হয়। ঐ বিকেলে সরকারি চাকরিজীবী কবির বাসায় সেলিমের সাথে আরো একজন সেখানে গিয়ে ওঠে। একজন জ্যেষ্ঠ কবির প্রচ্ছন্ন প্রশ্রয় তাদের মতো উঠতিরা সব যুগেই হয়তো পেয়ে থাকে; উনিও দেন, অথবা সব কবিরই দুয়েকজন স্তুতিবাদকের প্রয়োজন হয়।

প্রুফশিটগুলোর দিকে সেলিম চেয়ে থাকে আর দেখে নেয় শেষ মুহূর্তে এসেও ঐ কবি কবিতায় কতটা সংশোধনের সুযোগ নিচ্ছেন। একদিন তার বইও এইভাবে বেরুবে; এভাবেই প্রুফ দেখতে হবে তাকে। এই ভাবনায় সেলিম পুলকিত বোধ করে আর তার চোখের সামনে ভেসে ওঠে শিল্পশোভন এক সুদৃশ্য কবিতার বই। সেখানে তার নিজের নামটি মুজতবা আবদেল যেন পবিত্র পাথরে খোদাই করা প্রাচীন বর্ণমালার মতো সমীহ জাগায়। তার নামের তিনটি অংশ থেকে একটিকে বাদ দিতে বলেছিল কেউ কেউ। কবিদের নাম নাকি হতে হয় পদ্যের মতো। পিতৃপ্রদত্ত নাম সংস্কার করেই নাকি কবিদের প্রথম বিদ্রোহ ঘটাতে হয়।

কবি বন্ধুদের প্ররোচনায় আর নিজের সাথে নিজের অজানা বিদ্রোহে তার নামের আবদুলের জায়গায় আবদেল করে নিয়েছে সে নিজ থেকেই। আত্মীয় আর ছেলেবেলার বন্ধুরা অবশ্য এখনো তাকে সেলিম নামেই ডাকে। শখের বশে সেদিনই সেই ভদ্রলোকের কাছ থেকে সাথে সাথে শিখে নেয় কিছু প্রুফসাইন—কিন্তু শিক্ষানবিশ কবি মুজতবা আবদেল তখনও কি জানতেন—একদিন এই প্রুফরিডিংটাই তার নিয়তিনির্ভর পেশা হয়ে দাঁড়াবে? আজ মুজতবা আবদেল একজন পুরোদস্তুর প্রুফরিডার—তার বর্ষপঞ্জিতে কোনো শুক্রবার নেই।

প্রেমপত্রে ভুল ধরতে নেই জেনেও অভ্যাসবশে সেলিম ওরফে মুজতবা আবদেল তবুও ধরেছিল। কিছু একটা করি অথবা করি না—এমতাবস্থায় দুটি জিনিস তার মিলে গেল—একটি প্রুফরিডিংয়ের কাজ; অপরটি আলেয়া। বয়সের চেয়ে একটু আগেভাগেই বিয়েটা সেরেছিল সে; রুটিরুজির উৎস খুঁজতে গিয়ে দিশেহারার একপর্যায়ে এই প্রুফরিডিংটাকেই অবলম্বন করে দাঁড়াতে শেখে; যদিও প্রকৃত দাঁড়ানো কাকে বলে তা সে জানে না।

পয়লা পয়লা কেমন একটা ঘোর আর ভালোলাগা ছিলো প্রুফরিডিং আর আলেয়ার চোখে। আহামরি কোনো চোখ নয় তার—গোল, ঈষৎ ধূসর। আলেয়ার চোখের ভাষার কোনো প্রুফরিডিং করার সুযোগ মেলেনি সেলিমের—নির্ভুল বানানের এক গোটা উপন্যাস দেখেছে সে আলেয়ার চোখে। সেবার জ্বরের চতুর্থ দিনে যেদিন সেলিম ওকে রিকশায় চেপে ফার্মেসিতে নিয়ে গিয়েছিল সেদিন আলেয়ার করতল ছুঁয়ে দেখেছিল জ্বরটা তাকেও কতখানি টেনে নিয়েছিল দৃশ্যের গভীরে। জ্বরটা সেরে গেলে সমুদ্র দেখাতে নিয়ে যাবে—এমনটা প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল তাকে—আজও আলেয়ার সমুদ্র দেখা হলো না। যেখানে সমুদ্রের শুরু—যেখানে কেউ কেউ ফেলে আসে পাৎলুন; শরীরের নুন; সেমত স্থানে যাওয়ার জন্য সেলিমের মনও উচাটন হয়। ভাবে, একদিন ঠিক ঠিক নিয়ে যাবে ওকে। দিন যায়। আর এদিকে একে একে দুই কন্যা সন্তানের মাতা হয়ে ওঠে সে—ইত্যবসরে বিজ্ঞাপনের সৈকতটাকেই সে বুকের ভেতর আপন করে নেয়। 

ষোলো পৃষ্ঠায় এক ফর্মা; সারাদিনে পাঁচ-সাত ফর্মার বেশি প্রুফ দেখে উঠতে পারে না সে। বইমেলা ঘনিয়ে এলে চাপে পড়ে দশ-বারো ফর্মাও সে দেখে রোজ। রাত জেগে প্রুফ দেখতে হয়; উপায় নেই, তাড়া থাকে লেখকের, প্রকাশকের। তখন শরীরের ওপর দিয়ে বেশ ধকল যায় তার। কত জনপ্রিয় আর বিখ্যাত বইয়ের প্রথম পাঠক সে, অথচ এই অনুভূতি তাকে সুখী করে না। টাইপ পয়েন্ট-রংফন্ট-রেগুলার-বোল্ড-ইটালিক-জাস্টিফাই-প্যারা-ইনডেন্ট ইত্যাদি ভাবতে ভাবতেই তার কলম এগিয়ে চলে। ব্যক্তিগতভাবে সে সবুজ রঙের জেলপেন দিয়ে প্রুফ কাটতে পছন্দ করে। কখনো কখনো, তাকে ট্রেসিং পেপারে পর্যন্ত প্রুফ দেখতে হয়। নির্ভুল রাখার তাগিদ; কিন্তু প্রেসলাইনে ছাপার ভূত বলতে একটা কথা আছে। মুদ্রণপ্রমাদ তবু থেকেই যায়। ঐ শব্দভূত ঘাড় থেকে নামে না সহজে।

বইয়ের শুরুর দিকে—যে অংশে শিরোনাম-লেখক-প্রকাশকের নামধাম ভূমিকা-সূচি-উৎসর্গ ইত্যাদি থাকে সে অংশের ডাক নাম ইনার। অনেক বদবখত প্রকাশক এই ইনারের জন্য পুরো ফর্মাটাকে হাফ ফর্মা ধরে বিল করেন। কেননা তাদের যুক্তি এই যে এতে লেখা কম তাই শ্রম কম। কেউ কেউ আবার পৃষ্ঠা ধরে হিসেব করেন; মেকআপের পর যখন বইটি আয়তনে বেড়ে গিয়ে প্রকাশ হয়, সেই হিসাবটি আর প্রকাশক ধর্তব্যে আনেন না। শোষণের এই বালসুলভ চাতুর্য দেখে প্রকাশকদের করুণা করতে ইচ্ছে করে তার। বিষয়ভেদে প্রুফের রেটও ভিন্ন; সবচেয়ে কম রেট কবিতায়; কম হলেও কবিতার প্রুফ দেখতে তার বরাবরই ভালো লাগে। কাজটার ভেতর তখন কেমন এক আনন্দ খুঁজে পায় সে। কেন? সে নিজে কবি বলেই কি? আবার অপাঠ্য রচনার প্রুফ দেখতে গিয়ে তার মাথা বিগড়ে যায়। ছিঁড়ে ফেলতে ইচ্ছে করে শিটগুলো; কিন্তু পারে না; রুজির উৎসের প্রতি বিনম্র থাকতে হয়। এদিকে কারেকশন হয়ে যাওয়ার পর কাটা প্রুফশিটগুলো কখনো সে চেয়ে নিয়ে আসে উল্টোপিঠে মেয়েদের অঙ্কটঙ্ক করার জন্য। কাগজের দাম বাড়াতে অনেকেই আজকাল উল্টোপিঠেও প্রুফ দিচ্ছে; তাই সেটাও সহজে মেলে না।

দৈনিক পত্রিকাতেও সেলিম টানা তিন বছর এক শিফট করে চাকরি করেছে। ওয়েজ-বোর্ড সহজে মিলবে না জেনেই সে চলে এসেছে; কথাটির ভেতর পুরো সত্যি নেই; তাদের সম্পাদক যখন অন্য একটি পত্রিকায় চলে যাচ্ছিলেন তখন তাকেও বলেছিলেন সঙ্গী হতে; সে কী মনে করে-নতুন পত্রিকা-স্যালারি-সার্কুলেশন-এইসব দ্বিধা; তাছাড়া এখানে যে তাকে চাকরি দিয়েছিল তার প্রতি কৃতজ্ঞতাবোধ—সবমিলিয়ে তার আর নতুন জায়গায় যাওয়া হয়ে ওঠেনি; এখন মনে হয় তার যাওয়াটাই উত্তম ছিল। পরে ঐ পত্রিকায় নতুন ও আনাড়ি লোকদের নিয়োগের ভিড়ে তার আর থাকা হয়নি। সম্মান অবশিষ্ট রেখেই ফিরে এসেছে সেই পুরোনো চৌহদ্দি-বইবাড়ি-বাংলাবাজারে।

ছোটখাটো এনজিওর টুকটাক কাজও সে দেখে ফাঁকেজোকে। কোনো বইয়ের নাতিদীর্ঘ ভূমিকা কিংবা প্রচ্ছদের ফ্ল্যাপ দেখিয়ে নিয়েছে বিনে পয়সায় কত কেউ—হিসেব রাখেনি তার; সব কাজের সবটুকুই কি আর হিসেবের মধ্যে পড়ে। সেলিমের মনে হয়, আমি কি তেমন কেউ যারা তার পেশার ক্রীতদাস হতে চায়নি। অবজ্ঞা আর উপহাস সয়ে সয়ে একদিন যারা কবি হয়ে ওঠে—তারা কি শুরু থেকেই কবি। আচ্ছা, সুরুজ্জামান ভাইও আমার মতো কবি হতে চেয়ে অবশেষে একজন প্রুফরিডার হয়ে ওঠেননি তো? নতুন কিংবা শৌখিন কত লেখকের পাণ্ডুলিপিতে সে হাত বসিয়েছে অকাতরে। চাই কি প্যারার পর প্যারা ফেলে অথবা লিখে দিতে হয়েছে তাকে নিজে। সবই প্রকাশকের আজ্ঞায়। উনি চাচ্ছেন জিনিসটাকে মানুষ করতে। টাকা নিয়েছেন লেখকের কাছ থেকে; ছাপতে তো হবেই। কিছুটা ঘষামাজা না করলে যে প্রকাশনীর ইজ্জত থাকে না। তার এত বড় প্রকাশনী, বইমেলাতে এত বই বের করে সে, অনেককিছুই ভাবতে হয় একজন প্রকাশককে। আবার নিজের সম্পাদনাগিরি ফলাও করতে গিয়ে একবার এক প্রকাশনীর জরিমানার নয় হাজার টাকাও তাকে ঐ প্রকাশনীর কাজ করেই শোধ করতে হয়েছে। কেননা বইটি ছাপা হয়ে গিয়েছিল—বইতে কেন হাত দেওয়া হলো, কেন মাতবরি করা হলো এবং কেনই বা তার দেওয়া বানান রাখা হলো না—তা নিয়ে জোর আপত্তি করে এবং পুনরায় বইটি ছাপাতে প্রকাশককে বাধ্য করেন লেখক। অতএব জরিমানা প্রদানে প্রুফরিডারকে বাধ্য করেন প্রকাশক।

আজকাল একটানা প্রুফ দেখতে গেলে চোখ ব্যথা করে তার। পানি পড়ে। বাসায় একটিমাত্র টেবিল। পড়ার জন্যে মেয়েদেরকে ছেড়ে দিতে হয় সেটি। প্রায়শ তাকে তাই বিছানায় উপুড় হয়ে প্রুফ দেখতে হয়। এভাবে প্রুফ দেখতে গিয়ে তার বাম দিকের বাহুর উপর অংশে কেমন যেন ব্যথা করে ওঠে হঠাৎ হঠাৎ। ডাক্তার বলেছেন কাৎ হয়ে প্রুফ দেখতে গিয়ে এপাশের হাড় কিছুটা বেড়ে গেছে। ঐভাবে প্রুফ দেখতে বারণ করেছেন তিনি। কিন্তু রুটিরোজগারের বেলায় যে সব বারণ মানা যায় না।

সেলিমের কোনো ছেলেসন্তান নেই। যদি থাকত—ছেলেকে কী বানাত সে? কবি বানাত? কবি কি বানানো যায়? সেলিম ভাবে, দুর্ঘটনায় যদি তার চোখ চিরতরে অন্ধ হয়ে যায়—তখন সে হয়তো আর প্রুফ দেখতে পারবে না, তবে কবিতা সে ঠিকই লিখতে পারবে—এই ভাবতে গিয়ে তার মনে পড়ে অন্ধকবি হোমারের কথা। সত্যিই যদি তার চোখ চলে যায় কোনোদিন। নিজেকে কিছুক্ষণের জন্যে অন্ধ মনে হয় তার। যে অন্ধকবি খুঁজে ফেরে তার মার্বেল হারানো শৈশব আর সদ্যসমাপ্ত কবিতার মতো সতেজতা নিয়ে অভিজাত ভঙ্গিতে কলেজে ছুটে চলা পাশের বাড়ির প্রিসিলা আপা। তার জীবন তো ব্যর্থ এক কবির প্রুফরিডার হবার গল্প মাত্র—তার স্ত্রী যদি একটি বেসরকারি বিদ্যালয়ে শিক্ষকতা না করতেন; এবং সেই সুবাদে দু-চারটি বাচ্চাকে বাসায় কোচিং না করাতেন তবে কীভাবে চলত তাদের সংসার; নিদানের কালে স্ত্রীর সঞ্চয়ই তার ভরসা। শুধু প্রুফ দেখে জীবন চালানো যায় না। এদেশে সফল প্রুফরিডার বলতে কিছু নেই।

দুই মেয়েকে নিয়ে কদাচিৎ গল্পে মাতে সে। নেফারতিতি, রাপুনজেল কিংবা সুচরাজপুত্রের গল্প শোনায় তাদের। গল্পের ফাঁকে মেয়েদের স্কুলের নোটবুক দেখে ক্লাসটিচারের বানানের ভুল ধরে। এ এক বাজে স্বভাব হয়েছে তার—যখন-তখন যেকোনো কিছুতেই প্রুফ দেখা। ঘটনাগুলো অবচেতনেই ঘটে। এ যেন সেই গল্পের মতো—একদিন এক অনুষ্ঠানে কোনো এক যুবক নিরাপদ দূর থেকে অনেকক্ষণ তাকিয়ে থাকে কোনো এক সুন্দরীর দিকে—ব্যাপারটা লক্ষ করে সুন্দরী এগিয়ে আসে—যুবককে কিছু একটা জিজ্ঞেস করে—তার মতো এহেন ডাকসাইটে সুন্দরীর আচমকা প্রশ্নে কেমন একটা ভ্যাবাচেকা খেয়ে যুবকটি কোনোমতে একটিমাত্র শব্দসংখ্যা বলে ওঠে—সাত। যুবকটি ছিল শহরের একটি সু স্টোরের সেলসম্যান আর ও যা বলেছিল তা ছিল ঐ সুন্দরীটির জুতোর মাপমাত্র। 

দেশের এক প্রধান কবির কবিতার প্রুফ সে বরাবরই দেখে আসছে। ঐ স্বনামখ্যাত কবিও তাকে বিশেষ পছন্দ করেন। কাজের সূত্রেই তার সাথে পরিচয়। তার প্রুফ যেন সেলিমই দেখেন এমনটা তিনি প্রকাশকদের বলে রেখেছেন। বিষয়টা তার ভালো লাগে। কবি হওয়ার ব্যর্থতার গ্লানি তাকে কিছুক্ষণের জন্য হলেও দূর করে। কোনো কোনো প্রকাশনী প্রিন্টার্স লাইনে আজকাল তার নামটি কদাচিৎ ব্যবহার করেন; যদিও এর রেওয়াজ নেই বললেই চলে। তবে বইয়ের ভূমিকায় অনেকেই তার নাম কৃতজ্ঞতার সাথে স্মরণ করেন; তাতেই সে খুশি। স্বীকৃতি না দিলেই বা কী—কাজ করেছে, পয়সা নিয়েছে। দেশের কোন কবি মৌলবাদী হয়ে উঠল আর কোন ব্যর্থ কবি রুপালি বাক্সের অভিনেতা হয়ে উঠল—এসব খবরে কী যায় আসে তার।

প্রবাসী এক সধবা নারী-লেখক প্রতি বছর বইমেলার শুরুর দিকে পাণ্ডুলিপি নিয়ে দেশে আসেন। একটি করে বই প্রকাশ করেন আর ফেরেন পছন্দের একাধিক বই সঙ্গী করে। সেখানে তিনি কী করেন সেলিম তা জানে না। মেলায় পরিচয় কাজের সূত্রেই। বাংলার ছাত্রী ছিলেন তিনি—মুড ভালো ছিল বলেই কিছুটা স্মৃতিচারণ করেন। বানান বিষয়ে তার সীমাহীন অজ্ঞতা হেসে হেসে অকপটে প্রকাশ করেন—আর তার বইয়ের প্রুফ দেখে দেওয়ায় ধন্যবাদ জানাতে ভোলেন না সেলিমকে। ষাট ছুঁইছুঁই লাবণ্যসচেতন সেই মহিলার নির্মল হাসি সেলিমকে উচাটন করে। এই হাসির সাথে চকিতে সে রিমির হাসির মিল খুঁজে পায়। মেলায় আগত সকল উজ্জ্বল তরুণীর মুখে তখন সে তার প্রাক্তন প্রেমিকার মুখের আদল দেখে। এ কী, এমন লাগছে কেন তার? কেমন একটা চাপা অস্বস্তি তাকে ঘিরে আছে। আরেকটু সময় সে কাটাতে চেয়েছিল মেলায়; কিন্তু কেন জানি বেরিয়ে যেতে ইচ্ছে করল তার। এক প্রকাশনী তাকে প্রুফ বিলের কিছু টাকা দেবে তাইতো দীর্ঘ লাইন ভেঙে ভিড় ঠেলে এই শুক্রবারেও তার বইমেলাতে আসা—অথচ সেই প্রকাশকের সাথে দেখা না করেই প্রস্থানমুখী সারিবদ্ধ মানুষের ভিড়ে ঢুকে পড়ে সে।

চোরে চোরে মাসতুতো ভাইয়ের মতো প্রুফরিডারদের মধ্যেও আলাপ জমে ওঠে কখনো। আটপৌঢ়ে সাংসারিক কথার বাইরেও কথা ওঠে পেশার; কথা হয় প্রুফরিডিংয়ের মান আর রেনুমেশনের পরিমাণ নিয়ে। একবার কে যেন প্রস্তাব দিয়েছিল প্রুফরিডারদের সমিতীকরণ প্রসঙ্গে। কিন্তু ঐ পর্যন্তই। হার্নিয়া অপারেশনের পর তরুণদা যেদিন টিশার্ট পড়ে প্রথম বাংলাবাজারে আসেন তখন এই ষাটোর্ধ্ব প্রুফরিডারকে তার নামের মতোই বেশ তরুণ দেখায়। ততদিনে তার লম্বা জামা পরার ব্যাপারটা সেলিমের কাছে খোলাসা হয়। এই তরুণদাকে বেশ পছন্দ করে সে। বানান বিষয়ে টুকিটাকি টিপস সে প্রায়শ নিয়ে থাকে তার কাছ থেকে। তার মুখে শোনে সে গতদিনের কথা—কমপিউটার আসার আগে সে আমাদের প্রেসপাড়ার কাহিনি শোনায়। তার নিজেরও একটি প্রেস ছিল যৌথ ব্যবসায়। প্রেস চালাতে গিয়েই তার প্রুফরিডিং শেখা। লেটারপ্রেস যুগে কবিসাহিত্যিকরা সঙ্গীসহচর নিয়ে প্রেসে চলে আসতেন প্রুফ দেখতে। সে কী উদ্দীপনা। মেশিনের ঘটঘট শব্দ আর কালির চিটচিট গন্ধ নিয়েই টালখাওয়া বেঞ্চিতে বসে সস্তা চায়ের সাথে পাতার পর পাতা প্রুফ দেখে নিতেন। এখনকার মতো একসাথে গোটা বইয়ের প্রুফ তখন মিলত না। অত টাইপ একসাথে জোগাড় হতো না। তখন ছিল ফাউন্ড্রি টাইপ। প্রতিটি বর্ণ আলাদা আলাদা। ধরেন, ‘স’ বা ‘শ’ টান পড়ে গেল। বড় কোনো বইটই হলে এমনটা হয়—তখন অন্য কোনো প্রেস থেকে টাইপ ভাড়া করে নিয়ে আসতে হতো। আবার এইসব টানাটানির ক্ষেত্রে এক ফর্মা এক ফর্মা করে ছেপে তারপর পুরো বই হতো। অনেক কথাই হয় তাদের মাঝে। ছেঁড়া ছেঁড়া—প্রসঙ্গে বিসঙ্গে। কত কী যে উঠে আসে সেই আড্ডায়—ইংরেজির সুবিধাটি কী—ইংরেজিতে কেন বানান ভুলের আশঙ্কা নেই। তাদের আছে নানা রকমের সফটওয়ার। আমাদের এখানে সর্বমান কোনো বানানরীতি অনুসরণ করা হয় না। বানান নিয়ে আছে নানাবিধ সমস্যা; বাংলা একাডেমি প্রণীত প্রমিত বানান রীতিও সবক্ষেত্রে মানছে না কেউ—অন্যদিকে দেশের প্রকাশনা সংস্থাগুলোও কোনো নির্দিষ্ট নিয়মরীতি অনুসরণ করছে না; যখন যে পাণ্ডুলিপি যে প্রুফরিডারের কাছে যাচ্ছে সে তার মতো করেই দেখছে। যে বাংলা দেখছে সেই আবার ইংরেজি দেখছে, চাই কি চাইনিজও দেখে দেবে। নিজেকে এই প্রফেশনে অবাঞ্ছিত মনে করে সেলিম।

ভাষা এক হলেও কলিকাতা আর ঢাকার বানান নিয়ে আছে নানা ক্যাঁচাল। এখানেও কি কম! একপক্ষ তো বলেন, ‘বাঙালী’-কে ‘বাঙালি’ করলে নাকি উচ্চতায় খাটো লাগে।

কালিদাস প্রুফরিডিং জানতেন কি না জানি না, তারা যা-ই লিখতেন তাই শাশ্বত; মুদ্রণযন্ত্রের আবিষ্কার আর প্রুফরিডিং দুইয়ের যাত্রা সমান্তরাল; তবে মাইরি বলছি রবিবাবু তা খুব ভালো জানতেন; যদিও তার নিজের প্রুফের দরকার পড়েনি কোনোদিন—তার মতো ভালো বাংলা আর বাংলা বানান কয়জন আর জানতেন। ‘বাবিলস্তম্ভ নির্মাণ করিবার সময় মানবজাতির উপর যে শাপ নিপতিত হয়, তাহা অদ্যাপি আমাদের উপর প্রভুত্ব করিতেছে’—এই বলিয়া সেদিনের ন্যায় আড্ডা ভঙ্গের ঘোষণা দিয়ে উঠে দাঁড়ালেন সময়ের বয়োজ্যেষ্ঠ মান্যবর প্রুফরিডার তরুণ কুমার মহলানবিশ।

যে বইটির প্রুফ সে দেখেছে সেটির একটি কপি কি চাইলে প্রুফরিডার সৌজন্য হিসেবে পেতে পারে না?—কখনো নিজের বা স্ত্রীর বা মেয়েদের জন্য দুয়েকটা বই চাইতে ইচ্ছে করে—কিন্তু বলা হয়ে ওঠে না কী এক সম্ভ্রমে। দুয়েকটা প্রকাশনীর পক্ষে প্রস্তাব এসেছে বাচ্চাদের কিছু বই লিখে দেওয়ার। সেলিম ভেবেছে কয়েকবার। প্রথমে আমল না দিলেও সম্প্রতি সে দুটি বইয়ের কাজে হাত দিয়েছে। বাচ্চাদের জন্য বিষয়ভিত্তিক বই। এই বইমেলাতেই বের হওয়ার কথা। দেখা যাক। সেলিম ভাবে, যদি কিছু টাকা তার কাছে হঠাৎ করে চলে আসত তবে সে নিজের মতো করে কিছু বই প্রকাশ করত। আজকাল একটা প্রকাশনা দেবার ইচ্ছে মনের গহনে গোপনে গোপনে লালন করে সে। কাউকে বলে না। আচ্ছা তখন সে-ও কি প্রুফরিডারদের সাথে অমন আচরণ করবে—এখন যেমনটা করে অন্য প্রকাশকরা তার সাথে?

প্রুফ দেখতে গিয়ে কত রকমের হাতের লেখা যে তাকে পড়তে হয়েছে এই জীবনে। সেলিম ভাবে, বাংলা ক্যালিগ্রাফি নিয়ে কাজই নেই আসলে। শিল্পীরা কেন যে এদিকটায় পা মাড়ান না কে জানে। কম্পিউটারের আধিক্যের ফলে আজকাল অনেকেই সফট কপি হিসেবে সিডিতে করে পাণ্ডুলিপি দেন; এতে আগে থেকেই মোটামুটি গুছানো থাকে। কয়েক কেজি কাগজের পাণ্ডুলিপির স্থলে এখন একটি পাতলা সিডিই কাফি। বিশ্বায়নের এই প্রবাহে তার মনে প্রশ্ন জাগে, কম্পিউটারাইজেশনের ফলে স্পেলচেকার আর প্রুফরিডারদের মধ্যে দ্বন্দ্ব কী তবে শুরু হয়ে গেল।

আমাদের উন্নয়নশীল নদী যদিও সমুদ্রগামী তবুও সেলিম-আলেয়া দম্পতির সমুদ্র দেখা হয়ে ওঠে না। যে বর্ণসমুদ্র সেলিমকে প্রতিদিন হাতছানি দিয়ে ডাকে তাকে ফেরাবে সে কীসে—কোন জাদুবাস্তবতায়? জীবনের প্রুফরিডিং কী করে হয় নিজেকেই প্রশ্ন করে সেলিম। বয়োজ্যেষ্ঠ রিডার তরুণদা কি পেরেছে জানতে—কিংবা রিডার-বন্ধু আফসার। জীবনটা যে কাটিয়ে দিলেন দাঁড়ি-কমা দেখে দেখে কিন্তু জীবনের দাঁড়ি-কমা কোথায় সুরুজ্জামান ভাই? সুরুজ্জামান সাহেবের সাথে তার সখ্য একই মার্কেটে তারা দুজনই প্রুফ দেখতে বসেন বলে। সেলিম এখানে নিয়মিত না দেখলেও সুরুজ্জামান সাহেবকে প্রতিদিনই দেখতে হয়—কেননা তিনি একটি প্রকাশনীতে হিসাবরক্ষকের চাকরির পাশাপাশি প্রুফও দেখেন। সেলিমের এই প্রশ্নে নিজের শুভ্রশ্মশ্রুর দিকে ইঙ্গিত করে বলেন—‘দাঁড়ি আছে ভাই, কমা নাই।’ তারপর বলেন, ‘জীবনে দাঁড়িটাই বড়। কমা-কোলন-প্রশ্ন-বিস্ময় দিয়ে কী হবে সেলিম ভাই। দাঁড়িতেই শেষ—আবার দাঁড়ির পড়েই প্রকৃত শুরু। আমরা কী সঠিক জানি জীবনে যতিচিহ্নের ব্যবহার? জীবনের কোন ধাপে এসে কমা হবে–কোন ধাপে এসে কোলন–জানি না। কিচ্ছু জানি না। জানে সব আল্লাপাক। আল্লাই জীবনের শ্রেষ্ঠ প্রুফরিডার—বুঝলেন ভাই।’

জীবনে তাকে কত বাক্য মেলাতে হয়েছে নির্ভুল–রাখতে হয়েছে বানানের সমতা–অথচ আজ এই ছেষট্টিতে এসে নিজের জীবনগল্পে কত অসংগতি সুরুজ্জামানের চোখে ধরা পড়ে। নিজের নামের বানানই বদলে ফেলতে ইচ্ছে করে তখন তখন। মুহূর্তে মনে হয় আজ থেকে তার নাম হবে ভুলুজ্জামান। এই জামানায় যে ভুল করে তার নাম তো ঐ হওয়াই জায়েজ। তখন তখন তার মনে হয়—আমরা কি তবে সবাই ভুল বানানের মানুষ?

আজ তার মনে হয় সংসারেও অনেক প্রুফরিডিং আছে; স্পেস- ক্লোজ-রানঅন-ডিলিট রয়েছে সেখানেও। সি-কপি বা ছাড় গেলে সেখানেও কাহিনির ছন্দপতন ঘটে। সেরকমই কি কোনো ছাড় রয়ে গেছে একজন সুরুজ্জামানের জীবনে? মান্নান মার্কেটের দোতলায় কোনার দিকের জানলাবিহীন ছোট্ট গুদাম ঘরটিতে উবু হয়ে প্রুফ দেখতে দেখতে সিরাজগঞ্জে বাড়ির পাশ দিয়ে বয়ে যাওয়া নদীটির কথা চকিতে মনে পড়ে তার। পলকের জন্যে সে আনমনা হয়। গ্রামের শেষমাথার বাড়িটিতে তার ছেলেবেলার বন্ধু হামিদ যেদিন পড়ন্ত দুপুরে কয়েকপাক খিঁচুনি দিয়ে হঠাৎ করেই মারা যায় সেদিন সে দুই ক্রোশ দূরে ফুপুর বাড়িতে। খবর পেয়ে পরদিন ভোরবেলা ফিরে এসে যখন সে সরাসরি মৃতের বাড়ি গিয়ে ওঠে তখন তার সাথে মুখোমুখি হয় হামিদের পিঠোপিঠি তেরো বছর বয়েসি ছোট বোনের সাথে। এই দেখা প্রথম নয়, বহুবার দেখা হয়েছে তাদের। কিন্তু এই দেখা যেন একেবারে আলাদা। ভাইয়ের বন্ধুকে দেখে একটু যেন নড়ে ওঠে সে। সারারাতের কান্নাভেজা চোখ নিয়ে সুরুজ্জামানকে কি যেন বলতে চেয়ে কিয়ৎক্ষণ তাকিয়ে থাকে মাকসুদা। বাড়ির পেছন দিকে হঠাৎ করে তখন কুকুর ডেকে ওঠে। মৃতের বাড়িতে স্বল্পপরিচিতরাও আসেন। তেমন কেউ হয়তো এসেছে। কুকুরের ডাকে ভাবনার রেশ কাটে ওর। মাকসুদার আর কিছু বলা হয়ে ওঠে না। আজ এতদিন পর প্রুফের পৃষ্ঠায় বিভ্রমের মতো সুরুজ্জামান সাহেব যেন দেখতে পেলেন সেদিনের সেই কিশোরী মুখচ্ছবিটা। তখনই মনে পড়ে সদ্য নবম শ্রেণিতে ওঠা তার কনিষ্ঠ মেয়েটি আজ তাকে কীজন্য যেন আগেভাগে বাসায় ফিরতে বলেছিল। পরক্ষণেই তার এই মেয়েটির চোখের সাথে সেই কিশোরী মাকসুদার চোখের কোনো মিল আছে কি না তা খুঁজতে গিয়ে থমকে যান। সিঁড়িতে কারো পদশব্দ শুনে সংবিৎ ফিরে পেয়ে পুনরায় চোখ বুলান সামনে রাখা পৃষ্ঠার দিকে। ভাবেন হয়তো, কে চায় জলের অন্তরে বিস্তীর্ণ বালির বিষাদ।

প্রুফ দেখতে গিয়ে কোনোদিন রাত গড়িয়ে যায়; চোখ ধরে আসে; তখন উঠে গিয়ে চোখেমুখে পানির ঝাপটা মারেন; গ্রীবায় জলের প্রলেপ তাকে প্রশান্ত করে। সরু সিঁড়ি বেয়ে পুরোনো এই বাড়ির একতলার ছাদে গিয়ে ওঠেন কোনো রাত্রে। আশেপাশের কোনো বাড়িই তিনতলার নিচে নয়। তাদের বাড়িটাই কেবল অংশীদারি জটিলতায় এখনো পূর্বের অবস্থায় আছে। আকাশের দিকে তাকিয়ে পায়চারি করেন। এভাবে কতক্ষণ পার হলো মনে নেই—মনে কি পড়ে তার জীবনানন্দ—‘নক্ষত্র জেনেছে কবে এই অর্থ শৃঙ্খলার ভাষা।’ ফিরে এসে দেখে বিছানায় দুই মেয়েকে সাথে নিয়ে কুণ্ডলী পাকিয়ে শুয়ে আছে তার স্ত্রী। মেয়ে দুটোকে ভালো করে তাকিয়ে দেখা হয়ে ওঠে না। অনেকদিন থেকে মেয়েদুটো বেড়াতে যাওয়ার বায়না করে আসছে; সেলিম ভাবছে, এই ফেব্রুয়ারিটা পার হলেই এবার সে কমপক্ষে এক সপ্তাহের জন্য সপরিবারে বেড়িয়ে আসবে দূরে কোথাও। কোনো আত্মীয়ের বাসায় নয়। হঠাৎ স্মৃতি জাগে তার। বিয়ের পর স্ত্রী আলেয়া—যাকে সে ভালোবেসে ‘আলো’ বলে ডাকে—কথা ছিল, তাকে সমুদ্র দেখাতে নিয়ে যাবে। বিয়ের একযুগ পার হয়ে গেল—তবুও সেই প্রতিশ্রুতি মিলল না বলে কোনোদিন স্বামীকে সে অভিযোগ করেনি। আসলে আলোর মতো মেয়েরা অভিযোগ করতে জানে না। সেলিম মনে মনে প্রস্তুতি নেয়—এই দুই মাসে সে কম করে হলেও একশ ফর্মা বাড়তি প্রুফ দেখবে। কষ্ট হয় হোক। টাকাটা তার চাই। ব্যর্থতা তাকে কেমন যেন রুক্ষ করে তুলেছে। এই শহর ছেড়ে তার কোথাও যেতে ইচ্ছে করে না। কেন করে না? স্ত্রী আর দুই মেয়েকে সাথে নিয়ে এবার সে সমুদ্র দেখার সিদ্ধান্তকে চূড়ান্ত করে। অভিনন্দনের মতো ক্ষণস্থায়ী একটু মুক্তি তার এবার চাই-ই চাই।

বৃহস্পতিবার একটু আগেভাগেই বাসায় ফেরে সেলিম। সেদিন বইয়ের দোকানগুলোও বন্ধ হয়ে আসে তাড়াতাড়ি। সেদিন–রাতে শুতে গিয়ে–স্বামী-স্ত্রীর আটপৌরে কথার মাঝে প্রসঙ্গান্তরে উঠে আসে কাদের যেন বিয়েবার্ষিকীতে তাদের যাবার কথা পরশু শনিবারে;—আর এই কথার জের ধরে মনে আসে—আসছে জানুয়ারির এগারোতে তাদের বিয়েরও তেরো বছর পূর্ণ হবে। জলপাই রঙের মশারির ভেতর আলোআঁধারির খাঁজকাটা নকশায় দুজন আজ নিজেদের আবিষ্কার করে লালিত এষণায়। আলেয়ার নিকট এই তেরো বছর যেন মীন ও মেষের, জল ও জোৎস্নার নির্ভুল বিভ্রম। সেলিমের পায়ের কাছে পড়ে আছে সে এক প্রলুব্ধ গহন, আর সেলিম যেন আলেয়ার শাড়ির ইয়ানে গাঁথা হিমমাছ, সেফটিপিন।

আলেয়ার কি মনে পড়ে—বিয়ের আগে তাকে কেউ একজন—উহ্যই থাক তার নাম আজ—দীর্ঘ চিঠিতে জানিয়েছিল ভালোলাগার সাতকাহন। সাত পাতার সেই চিঠি সে যেন সাত লক্ষ বার পড়েছিল। নিজের অজান্তেই আজ আলেয়া বলে ওঠে—কোথায় আছ কেমন আছ পত্রপ্রেরক তুমি আমার। পাশ ফিরে শুয়ে থাকা সেলিমের মনে পড়ে—সেবার বন্ধুর নিমন্ত্রণে নওগাঁয় গিয়েছিল সে। দুইদিন থাকবে বলে ভেবেছিল, শেষমেশ নয় দিনের দিন তার ফেরা। মহাদেবপুরে আদিবাসী আলফ্রেড সরেন হত্যাকাণ্ডে নীরব শহরটি হঠাৎ সরব হয়ে ওঠে তখন। এই হত্যাকাণ্ডে দেশব্যাপী নিন্দার ঝড় ওঠে। সেলিম নিজেকে আলাদা করে রাখতে পারে না। আদিবাসীদের সাথে সেও মিছিলে অংশ নেয়। বিচার দাবি করে। সেলিম জানত না—এত আদিবাসী এখনো ছড়িয়ে আছে ওখানে। ভুল বানানের মতো চেহারা নিয়ে শত শত আদিবাসীর মাঝে নিজেকে তখন ভিন গ্রহের কেউ মনে হয় সেলিমের।

সেবারই একরাত্রে বন্ধু সহযোগে সে দেখে অলীক জোৎস্নায় চারদিক প্লাবিত—স্থানীয় এক স্বেচ্ছাসেবীর বিদ্যাঘর, বাগান, মাঠ পেরিয়ে নদীঘেঁষা ঐ দূরের বাবলাগাছের সারি—ক্ষীণকায়া তুলসীগঙ্গার রূপাজলে দুই বন্ধু নিজেদেরকে একসময় আবিষ্কার করে নগ্নআদিম। গলাঅব্দি জলে নেমে সরবে সমস্বরে তারা বলে ওঠে— ‘চাঁদ খুঁজে পাবে জলমগ্ন রাত, নদী খুঁজে পাবে তোমার নগ্ন পা, আমি কি আর পাই পাতাটার নিঃশ্বাস, রক্তে গোধূলি মিশে গেছে বুঝি নিদারুণ কোলাহলে।’

আজ তার আরো মনে পড়ে— আলেয়াকে যে বছর সে বিয়ে করে ঠিক ঐ বছরেই চারুকলায় এক নিদাঘ দুপুরে হাঁটতে গিয়ে শুকনো পুকুর ধারে ঈষৎ বেগুনি রঙের যে ফুলটি মাটি থেকে তুলে নিয়ে তার প্রাক্তন প্রেমিকা রিমিকে সে দিয়েছিল—সেই ফুলটির নাম কী ছিল? আজ এতদিন পর কিছুতেই ফুলটির নাম সেলিমের মনে পড়ে না। মনে করার জোর চেষ্টা করে। কিন্তু পারছে না। যতই সে মনে করার চেষ্টা করছে ততই তার চোখ ভারী হয়ে আসছে। ফুলটির নাম কি রডেড্রডেন নাকি রডোড্রেনড্রন? কী জানি! ফুলের সৌন্দর্যের কথা ভুলে গিয়ে সে তখন তখন ফুলের বানান নিয়ে ভাবতে থাকে।  

জোর করে ঘুম আনার চেষ্টা করতে গিয়ে ঘুম উল্টে ছুটে পালায়। এখন মনে হচ্ছে ঘরে যেন তার নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে আসছে। তার একটু মুক্ত বাতাসে শ্বাস নেওয়া দরকার। দুই মেয়েকে নিয়ে খাটে গভীর ঘুমে শুয়ে আছে তার স্ত্রী। স্থান সংকুলান না হওয়ার কারণে বরাবরই তার বিছানা করা হয় মেঝেতে। সে একাকী চুপিচুপি দরজা ভেজিয়ে ছাদে ওঠার জন্য সিঁড়ির দিকে এগিয়ে আসে। পুরোনো বাড়ির একতলা ছাদ। সিঁড়ির অর্ধেক না পেরুতেই সহসা বিদ্যুৎ চলে গেল। অন্ধকারে দেয়াল হাতড়ে ছাদে উঠে এলো সে। আহা! কতদিন পরে তার ছাদে ওঠা। ছাদে উঠেই প্রাণভরে শ্বাস নিল সে। তারপর তার অবাক হওয়ার পালা। কী অপরূপ জোৎস্না আজ। কী অনন্য জোৎস্না আজ। কী গৃহত্যাগী জোৎস্না আজ। এমনই জোৎস্না সে দেখেছিল একবার নওগাঁর বরেন্দ্র অঞ্চলে। সেখানে যতদূর চোখ যায়—ছিল বিস্তীর্ণ ধানক্ষেত—আর আজ এই নগরে যতদূর চোখ যায় আছে বিকীর্ণ কংক্রিট—কিন্তু জোৎস্নাটা যেন ঠিক একই রকম। সেলিমের তখন তখন মনে হয়—এটা শুধু অপরূপ জোৎস্না নয়—এটা শুধু অনন্য জোৎস্না নয়— এটা শুধু গৃহত্যাগী জোৎস্না নয়। এটা এক অলীক জোৎস্না—এই জোৎস্নায় অনায়াসে প্রুফ দেখা যায়। এই জোৎস্নার নাম কি তবে প্রুফ-দেখা জোৎস্না?

বিজ্ঞাপন

Subscribe
Notify of
guest
3 Comments
Oldest
Newest Most Voted
Inline Feedbacks
View all comments
numan prodhan
numan prodhan
1 month ago

হাহা। ভালো লাগল

তা মি ম
তা মি ম
1 month ago

উফ্, শব্দের এত দারুণ বুনট! প্রুফরিডার বলেই কি না!

তা মি ম
তা মি ম
1 month ago

এক গল্পতেই সব লিখে ফেললেন!
আর আমার কমেন্টের প্রুপ দেখে দেন তো।

স্বত্ব © ২০২৩, যোগাযোগ | ই মেইল : jogajogbd.org@gmail.com

যোগাযোগ-এ প্রকাশিত কোনো লেখা, ছবি কিংবা শিল্পকর্ম লেখক অথবা কর্তৃপক্ষের অনুমতি ছাড়া কোথাও প্রকাশ করা অবৈধ৷