সৌদি আরবে দর্শনচর্চা : প্রশ্নের জাগরণ

মূল : সাদ মুহারিব

শেখ মুজাহিদুল ইসলাম

আরব ও মুসলিম স্মৃতিতে দর্শন একটা বিশাল স্থান দখল করে আছে এবং জমানার পর জমানা ধরে জারি থাকা একটা বিতর্ক হয়ে আছে। এর গোড়া ধরা যায় ইবনে রুশদ ও ইমাম গাজালির তাহাফুতুল ফাফালাসিফা তাহাফুতুত তাহাফুত-কে কেন্দ্র করে সামনে আসা বিখ্যাত বিতর্ককে। এই বিতর্ক, সাথে আরো নানান বিতর্ককে সঙ্গে নিয়ে, পরবর্তী শতাব্দীগুলাতে এই আলাপের কেন্দ্র হয়ে থাকবে যে, আমভাবে দর্শনের ফায়দা কী? খাস করে ইসলামের সাথেই এর সম্পর্ক কী? এইখান থেকে, বেশ কিছু আরব দেশসহ সৌদি আরবের দর্শনের প্রতি ঐতিহাসিক রক্ষণশীল দৃষ্টিভঙ্গিকে বুঝা যায়, এবং দর্শন যে কতক সামাজিক গোষ্ঠীর জন্য একপ্রকার চিন্তার অস্থিরতা বা ‘টেনশনে’র কারণ হয়েছিল তাও ব্যাখ্যা করা যায়।

ধীরে ধীরে শুরুয়াত

সৌদি আরবে শিক্ষাব্যবস্থা স্থিতিশীল হওয়ার পর, ষাট ও সত্তরের দশকে, যখন সরকারি অর্থায়নে উচ্চশিক্ষায় বিদেশে যাওয়ার জোয়ার বইতে থাকে, তখন দর্শনের উপস্থিতি নিয়ে সচেতনতা শুরু হয়; যদিও তা সরাসরি ‘দর্শন’ নামে না।

ফর এক্সাম্পল, যুক্তিশাস্ত্রের তয়তরিকা – আবেশন (ইনডাকশন), ন্যায়নির্মাণ (ডিডাকশন) ও উপমা (অ্যানালজি) গণিতশাস্ত্রে ও স্যোশাল সাইন্সে দেখা যেতে থাকে। একইভাবে ট্রাডিশনাল জ্ঞানশাস্ত্রে – ব্যাকরণ (নাহু) ও ইসলামি আইনেও

(উসুলুল ফিকহ) এই যুক্তিপদ্ধতির প্রয়োগে সচেতনতা বৃদ্ধি পায়। এ-ও স্পষ্ট হয় যে, সমাজবিজ্ঞান আর সাইন্টেফিক রিসার্চ-মেথডের মূল মূল তত্ত্বের অধিকাংশই দাঁড়ায়ে আছে দার্শনিক প্রাসঙ্গিকতার ওপর; ফলে, সেগুলার দার্শনিক প্রসঙ্গের প্রকৃতি বুঝতে না পারলে, তার তত্ত্বের যথাযথ উপলব্ধিও সম্ভব না। ফলত এইটা স্পষ্ট হয় যে, সাইন্স থেকে ফিলোসোফিকে বিচ্ছিন্ন করা কার্যত অসম্ভব; বরং, ফিলোসফির গ্রহণযোগ্য আর বাতিলযোগ্য দিক নির্ণয় করাই প্রধান চ্যালেঞ্জ।

ট্রাডিশনাল ও কালচারাল জাতীয় উৎসব প্ল্যাটফর্ম আল-জানাদিরিয়্যা (الجنادرية) আশির দশকের মাঝামাঝি সময়ে যখন তার কালচারাল প্রোগ্রাম চালু করে, তখন এইটা দর্শনসহ নানান বুদ্ধিবৃত্তিক বিষয়ে আলোচনার একটা গুরুত্বপূর্ণ মঞ্চ হয়ে ওঠে। এরপর, চলমান শতাব্দির প্রথম ভাগে ‘রিয়াদ বইমেলা’ আন্তর্জাতিক বইমেলায় পরিণত হলে, দর্শনবিষয়ক বইপত্র সৌদির পাঠাগারে প্রবেশ করতে শুরু করে। অথচ একসময় দর্শনের বই নিষিদ্ধ ছিল। এই দুইটা গুরুত্বপূর্ণ পর্বের মধ্য-সময়ে, সৌদির দর্শনচর্চার বিকাশে যুক্ত হইছে আরও উল্লেখযোগ্য বহু ঘটনা, পদক্ষেপ। 

রিয়াদ বইমেলা আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি পাওয়ার মাত্র দুই বছরের মাথায়, ২০০৮ সালে, রিয়াদ সাহিত্য ক্লাবের (نادي الرياض الأدبي) উদ্যোগে হরফ (حرف) নামে একটা দর্শনচর্চা সংগঠন প্রতিষ্ঠা পায়। এইটা সৌদির প্রথম স্থানীয় দর্শনচর্চার সংগঠন ছিল। একই সময়ে, হায়িল সাহিত্য ক্লাব (نادي حائل الأدبي) দর্শন বিষয়ক লেখালেখি আর লেকচার ইভেন্টে বেশ গুরুত্ব দেয় এবং দর্শনের উপর বিশেষ একটা সেমিনারের ব্যবস্থা করে।  

রিয়াদ সাহিত্য ক্লাব (النادي الأدبي بالرياض)

 

হায়িল সাহিত্য ক্লাব (النادي الأدبي بحائل)

এরপরে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে দর্শনচর্চার এরূপ উদ্যোগ ছড়ায়ে পড়তে থাকে। তখন উল্লেখযোগ্য যা কিছু উদ্যোগ নেওয়া হয় :  

—জেদ্দা সাহিত্য ক্লাবের (نادي جدة الأدبي) উদ্যোগে ইওয়ানুল ফালসাফা (إيوان الفلسفة) ফোরাম চালু হয়।  

—পূর্বাঞ্চলে ‘আল-হালাকাতুল মাঅ’রিফিয়্যা’ (الحلقة المعرفية) নামে জ্ঞানচক্র শুরু হয়। 

—নাজরান সাহিত্য ক্লাবের (نادي نجران الأدبي) আওতায় শুরু হয় ‘মুলতাকাস সালাম আল-ফালসাফি’ (ملتقى السلام الفلسفي) আয়োজন। 

—যাহরানের ‘কিং আব্দুল আজিজ সেন্টার ফর ওয়ার্ল্ড কার্লচার’ ইছরার (إثراء) উদ্যোগে দর্শন ও জ্ঞানচর্চার নানারকম প্রোগ্রাম, লেকচার ইভেন্টের আয়োজন হয়। 

জেদ্দা সাহিত্য ক্লাব (النادي الأدبي بجدة)

নাজরান সাহিত্য ক্ল্যাব (النادي الأدبي بنجران)

‘মুলতাকাস সালাম আল-ফালসাফি’ এর কোন এক আয়োজন

ইসরার (إثراء) ওয়েবসাইট।

এসবের ফলে, দর্শন নিয়ে আলোচনা শুধু আর ভার্সিটির ক্লাশরুমেই সীমাবদ্ধ রইল না, বরং সমাজের বুদ্ধিবৃত্তিক ও সংস্কৃতিমনা মহলের মধ্যে ক্রমশ আলোচনার বিষয় হয়ে উঠল।  

২০১৮ সালের শেষদিকে, সৌদি শিক্ষামন্ত্রণালয় এক ঐতিহাসিক সিদ্ধান্ত নিল—হাইস্কুলের সিলেবাসে দর্শন ও আইন অন্তর্ভুক্ত করা হবে। এইটা সৌদি সমাজের ও দর্শনের মাঝে সম্পর্কের এক ঐতিহাসিক পয়েন্ট। এর ফলে সাধারণ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলাতে দর্শনের প্রাথমিক পাঠ (مبادئ الفلاسفة) ও ক্রিটিকাল থিংকিং (التفكير النقدي) শেখানোর কার্যক্রম শুরু হল, যাতে শিক্ষার্থীরা কেবল মুখস্থবিদ্যায় আটকায়ে না থাকে, চিন্তা করা, প্রশ্ন তোলা ও উপসংহারে পৌঁছার দিকে ধাবিত হয়। এই পরিবর্তন কেবল শিক্ষাব্যবস্থায় সীমাবদ্ধ ছিল না, বরং এইটা মূলত ‘ভিশন ২০৩০’ পরিকল্পনার অংশ ছিল, যার আওতায় :

—নারীঅধিকার সম্প্রসারণ করা হয়,  

—বিচারব্যবস্থা ও আইনি কাঠামোর সংস্কার হয়,  

—ইকোনমিক পলিসির রিস্ট্রাকচার হয়,  

—সংস্কৃতি, ক্রীড়া, বিনোদন আর পর্যটন খাতে বেনজির কর্মসূচি চালু হয়।  

❝ এইটা স্পষ্ট যে, সাইন্স থেকে ফিলোসোফিকে বিচ্ছিন্ন করা কার্যত অসম্ভব; বরং, ফিলোসফির গ্রহণযোগ্য আর বাতিলযোগ্য দিক নির্ণয় করাই প্রধান চ্যালেঞ্জ। ❞

মাঅনা ও হিকমাহ

পরবর্তী বছরগুলাতে দর্শন নিয়ে লেখালেখির পরিসর ক্রমশ বিস্তৃত হইল। দর্শনের মশহুর কেতাবাদি, অগ্রগামী চিন্তকদের ভাবনা আর তত্ত্ব নিয়ে আলোচনা যেমন বাড়তে থাকল, তেমনই সংবাদপত্র, অনলাইন ফোরাম আর ব্লগগুলাতে দর্শন বিষয়ক লেখাপত্রের সংখ্যা বৃদ্ধি পাইতে থাকল উল্লেখযোগ্য হাড়ে। রিয়াদ আন্তর্জাতিক বইমেলায় দর্শনের বইপত্রের প্রতি তরুণ-তরুণীদের আগ্রহও বছরকে-বছর নতুন মাত্রায় পৌঁছাতে লাগল।

এই চিন্তাভাবনাগুলার প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দিতে সৌদিতে গড়ে উঠল দর্শনচর্চার দুইটা গুরুত্বপূর্ণ প্ল্যাটফর্ম—মাঅনা (معنى) ও হিকমাহ (حكمة)।

মাআনা একটা সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠান ও দর্শন-সংশ্লিষ্ট প্রকাশনা সংস্থা। ২০১৯ সালের মার্চ মাসে চলচ্চিত্র পরিচালক বদর আল-হামুদ ও সারা আর-রাজহি এইটা প্রতিষ্ঠা করেন, বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে এখানে উপদেষ্টা যুক্ত হন। একই বছরের শেষদিকে ‘মাআনা’ সৌদি যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমানের ‘মিস্ক’ (MiSK) ফাউন্ডেশনের একটা উদ্যোগ ‘মিস্ক আল-কুতুব’ (MiSK Books)-এর সঙ্গে পার্টনারশিপ গড়ে তোলে।

এই উদ্যোগের টার্গেট জ্ঞানের বিচিত্রশাখা থেকে ১০০টা জরুরি বই আরবি ভাষায় অনুবাদ করা। এবং বই অনুবাদেই সাথেসাথে, তারা দর্শন ও জ্ঞানচর্চার প্রচারে অসংখ্য সাক্ষাৎকার, গবেষণা-প্রবন্ধ আর নিবন্ধ প্রকাশ করে। পাশাপাশি, তারা ‘মাআনা পডকাস্ট’ চালু করে। এরই ধারাবাহিকতায় ২০২০ সালের মাঝামাঝি সময়ে ‘মাআনা’ সৌদি আরবে দর্শনচর্চাকে আরও প্রাতিষ্ঠানিক ভিত্তি দিতে প্রকাশ করে ‘দর্শন গবেষণা পত্রিকা সৌদি’ (المجلة السعودية للدراسات الفلسفية : SJPS)।  

‘মাঅনা’-র দর্শনচর্চা পত্রিকা المجلة السعودية للدراسات الفلسفية

১৬ অক্টোবর, ২০১৮, দুবাই ওয়ার্ল্ড ট্রেড সেন্টারে জিআইটিইএক্স ২০১৮-তে সৌদি প্যাভিলিয়নের (ভিশন ২০৩০) পাশে দাঁড়িয়ে আছেন সৌদি নারীরা।

বিশিষ্ট চিকিৎসক ও প্রকাশক ড. ইউসুফ আস-সুমাআন ‘হিকমাহ’ (حكمة) নামে দর্শন বিষয়ক ম্যাগাজিন বের করেন। এই ম্যাগাজিনের মোটো : বিশ্বখ্যাত দর্শন বিশ্বকোষ, গবেষণা সাময়িকী আর একাডেমিক রিসার্চপেপার থেকে জরুরি লেখাপত্র অনুবাদ করে আরবিতে নিয়ে আসা। হিকমাহর সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য কাজের মধ্যে ছিল, ‘স্ট্যানফোর্ড এনসাইক্লোপিডিয়া অব ফিলোসফি’ (Stanford Encyclopedia of Philosophy)-র সম্পূর্ণ অনুবাদ।  

ওয়েবজিন আকারে ‘হিকমাহ’

এছাড়াও ‘হিকমাহ’ বিচিত্র জ্ঞানশাখার বহু কেতাবাদি অনুবাদ ও পর্যালোচনা প্রকাশ করছে, এবং তা সাধারণ পাঠকের জন্য উন্মুক্ত করে দিছে। বইগুলা প্রকাশিত হয় দুইভাবে—  ১. ওয়েবসাইটে বিনামূল্যে ইলেকট্রনিক ভার্সনে, ২. বৈরুত অবস্থিত ‘দারু জাদাওয়িল’ (دار جداول) প্রকাশনা সংস্থার মাধ্যমে মুদ্রিত ভার্সনে। উল্লেখ্য, ড. ইউসুফ আস-সুমাআন গবেষক ও সাংবাদিক মুহাম্মদ আস-সাইফের সঙ্গে যৌথভাবে ‘দার জাদাউল’ প্রকাশনার মালিকানা ভাগাভাগি করে নেন।

‘মাআনা’ ও ‘হিকমাহ’ সৌদিসহ আরববিশ্বে দর্শনচর্চায় আগ্রহীদের জন্য এক জ্ঞানসেতু নির্মাণ করে; পাঠকরা এর ফলে ক্লাসিক ও আধুনিক দর্শনের গুরুত্বপূর্ণ রচনার সঙ্গে পরিচিত হওয়ার সুযোগ পায়; একইসঙ্গে, সৌদি আরবের অনুবাদক ও গবেষকদের জন্য দর্শনচর্চার জগতে অবদান রাখার নতুন দিগন্ত উন্মোচিত হয়। সৌদি আরবে দর্শন নিয়ে আলোচনা-গবেষণা শুধু আর ব্যক্তিগত প্রয়াসের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকে না; প্রাতিষ্ঠানিক রূপ পায়, যা কিনা দর্শনশাস্ত্রের ভবিষ্যৎ বিকাশের জন্য জরুরি মাইলফলক।

২০২১ সালের ডিসেম্বরে, ‘চিন্তার উৎসব’ স্লোগানের অধীনে লিটারেচার, পাবলিশিং এন্ড ট্রান্সলেশন কমিশন কর্তৃক আয়োজিত রিয়াদ দর্শন সম্মেলনের কার্যবিবরণী থেকে।

জামইয়্যাতুল ফালসাফা

২০২০ সালের নভেম্বর মাসে রিয়াদে সৌদির পয়লা বেসরকারি দর্শন সোসাইটি (جمعية الفلسفة) প্রতিষ্ঠার ঘোষণা হয়। সোসাইটির লক্ষ্য ছিল : 

—মানবিক ও নৈতিক চেতনার উন্নতি,  

—সংলাপের মধ্য দিয়ে সহনশীল ও সহাবস্থানমূলক মূল্যবোধের প্রসার,  

—নলেজ বিল্ডিং ও চিন্তাশক্তির বিকাশ।  

এর ওয়েবসাইট جمعية الفلسفة

সোসাইটির পরিচালনা পর্ষদের সভাপতি হন কিং সাউদ ইউনিভার্সিটির (جامعة الملك سعود) শিক্ষা-দর্শনের অধ্যাপক আব্দুল্লাহ আল-মুতাইরি। দর্শন সোসাইটি বিভিন্ন সেমিনার, কর্মশালা ও লেকচারের আয়োজন করে, দর্শনচর্চার প্রচারে এগুলি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। সোসাইটি তার প্রতিষ্ঠার পর থেকে বেশ কিছু উদ্যোগ গ্রহণ করে—  ১. রিয়াদের ‘হরফ’ (حرف) দর্শনচক্রকে আনুষ্ঠানিকভাবে এর অন্তর্ভুক্ত করে। ২. ‘মুকাবাসাত’ (مقابسات) নামে দর্শন রিলেটেড স্বতন্ত্র ম্যাগাজিন চালু করে। ৩. ‘ছোট দার্শনিক’ (الفيلسوف الصغير) নামে শিশু ও কিশোরদের জন্য দর্শন-শিক্ষা কর্মসূচি চালু করে। ৪. দর্শনের প্রতি গণচেতনা তৈরিতে আয়োজিত হয় ‘দার্শনিক পরিভাষা’ (مصطلحات فلسفية) প্রতিযোগিতা। 

দর্শন বিষয়ক পত্রিকা মুকাবাসাত : مجلة مقابسات

এই দর্শন সোসাইটি ছাড়াও সাম্প্রতিক বছরগুলাতে সৌদি আরবে দর্শনচর্চায় আগ্রহী আটখানা পাঠচক্র  সরকারিভাবে নিবন্ধিত হয়। এসব পাঠচক্র দর্শনের পাশাপাশি জ্ঞান ও শিল্পকলার অন্যান্য শাখা নিয়েও কাজ করছে এবং করতেছে। এছাড়াও نادي الكندي لفلسفة القيم নামে রিয়াদে মূল্যবোধ দর্শন (Philosophy of Values) বিষয়ের পাঠচক্র চালু হয়। বেসরকারি বা নাগরিক সংগঠন তৈরির ঝোঁক থেকে বুঝা যায় যে দর্শনচর্চায় মানে ও গুণে বিকাশ ঘটছে; কারণ এসবের ফলে আগ্রহীরা একত্রিত হইতে পারতেছিল, অভিজ্ঞতা বিনিময়ের ক্ষেত্র প্রসারিত হয় আর নতুন নতুন গবেষণা ও প্রকল্পের মাধ্যমে দর্শনের ভবিষ্যৎ বিকাশ ত্বরান্বিত হয়।

দর্শন সম্মেলন

২০২১ সালের শেষের দিকে সৌদির লিটারেচার, পাবলিশিং এন্ড ট্রান্সলেশন কমিশনের প্রতিনিধিত্বে কিং সংস্কৃতি মন্ত্রণালয় কিং ফাহাদ জাতীয় গ্রন্থাগারে দেশের প্রথম আন্তর্জাতিক দর্শন সম্মেলনের আয়োজন করে। তিন দিনব্যাপী এই সম্মেলনের থিম ছিল ‘চিন্তার উৎসব’। অয়োজনে উল্লেখযোগ্য প্রাতিষ্ঠানিক ও প্রাইভেট অংশগ্রহণ লক্ষ্য করা যায়। 

এই সম্মেলন প্রথমবারের মতো সৌদির স্থানীয় ও আন্তর্জাতিক দর্শন-সমাজের মধ্যে আনুষ্ঠানিক মিথস্ক্রিয়া ঘটায়। অংশ নেয় ইউনেস্কো, আন্তর্জাতিক দর্শন সম্মেলনের সভাপতি এবং মশহুর নানা ইউনিভার্সিটির ফিলোসোফি ডিপার্টমেন্টের নির্বাচিত অধ্যাপকগণ।

ঘোষণা মোতাবেক এই সম্মেলন সৌদি আরবে নিয়মিতভাবে অনুষ্ঠিত হবে। এর প্রথম অধিবেশনে আলোচনার থিম ছিল ‘الاتجاهات الفلسفة لغير المتوقع’ (Unexpected philosophical trends)। এছাড়া দর্শনের সাথে ইসলামের সম্পর্ক, আধুনিক বিশ্বে সাংস্কৃতিক স্বকীয়তা এবং শিশুদের দর্শনচর্চার প্রশিক্ষণ— গুরুত্বপূর্ণ এই তিন বিষয়কে কেন্দ্র করে অনুষ্ঠিত হয় ৩০টারও বেশি সেমিনার, বক্তৃতা ও কর্মশালা।

সৌদি আরবে দর্শনের উঁচু তবকীয় অবস্থানের তাৎপর্যকে ব্যাখ্যা করার ক্ষেত্রে এই সম্মেলন ছিল একটা প্রতীকী মূল্যায়ন, একইসাথে, ছিল ট্রাডিশনাল এপ্রোচের বাইরে গিয়ে দর্শনকে একটা আধুনিক সাংস্কৃতিক চর্চা হিসেবে উপস্থাপন করার ও দর্শনচর্চাকে একইসাথে বর্তমান ও ভবিষ্যতের সঙ্গে যুক্ত করার কোশেশ।

সৌদির দর্শনচর্চার সর্বশেষ অগ্রগতির মধ্যে উল্লেখযোগ্য উদ্যোগ— প্রথমবারের মতো দর্শনের ওপর গবেষণা ও নীতিশাস্ত্র অধ্যয়নের জন্য স্পেশাল রিসার্চ সেন্টারের অনুমোদন। ২০২৩ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় (المركز السعودي للفلسفة والأخلاقيات) Saudi Center for Philosophy and Ethics – SCOPE।

 المركز السعودي للفلسفة والأخلاقيات এর ওয়েবসাইট

এই সেন্টারের লক্ষ্য হচ্ছে জনসাধারণকে দর্শন সম্পর্কে অবহিত করা, সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলকে সমৃদ্ধ করা এবং দার্শনিক ও নীতিশাস্ত্রীয় চাহিদা পূরণে উপযুক্ত পরিবেশ তৈয়ার করা। এই সেন্টার কাজ করে তিনটা খাতে—গবেষণা ও পরামর্শ, প্রশিক্ষণ ও শিক্ষা এবং প্রকাশনা ও কালচারাল এক্টিভিটি।

উপসংহার

এতসবের পর, সৌদি আরব দর্শনের প্রসারে একটা ধীর, কিন্তু ধারাবাহিক, অগ্রগতি দেখতে পাচ্ছে, দর্শনচর্চার প্রতি বৃদ্ধি পাচ্ছে স্থানীয় ও আন্তর্জাতিক আগ্রহ। বর্তমানে সৌদি আরব আগের যেকোনো সময়ের চাইতে দর্শন বিষয়ক পাঠ ও পর্যালোচনার জন্য বেশি প্রস্তুত; যা কিনা ভবিষ্যতে দর্শন নিয়ে আরও গভীর সামাজিক মিথস্ক্রিয়ার সম্ভাবনা তৈরি করে, বিশেষ করে আধুনিক ও ভবিষ্যতের সাথে রিলেটেড যাবতীয় ব্যাপারের ক্ষেত্রে। একইসঙ্গে এসব সৃষ্টি করতেছে প্রশ্ন উত্থাপনের ক্ষেত্রে নয়া নয়া সুযোগ। 

যদিও সৌদি আরবে দর্শনের বিকাশে ঘটে যাওয়া ধারাবাহিক পরিবর্তন ও অবদানের সুনির্দিষ্ট পর্যালোচনা করা বেশ কঠিনই, বা একত্রে সেগুলাকে মূল্যায়ন করাটা অসম্ভবই, কারণ এই অভিজ্ঞতার যেকোনো মূল্যায়ন ও এর ভবিষ্যতের পূর্বাভাস দেওয়া— সবই মূলত আংশিক ধারণার ওপর ভিত্তি করে, এবং আদতে, যা নিজেই নির্ভরশীল নানান উৎস থেকে পাওয়া ভিন্ন মাত্রার জ্ঞানের উপর, দৃষ্টিভঙ্গি আর বিশ্লেষণের উপর— তবুও, এইখানে তিনটা গুরুত্বপূর্ণ উপসংহার টানা যায়—

. সৌদি আরবে দর্শনচর্চা তুলনামূলকভাবে এখনো বেশ নতুন; অনেক আরব দেশের পুরানা দর্শনচর্চার চেয়ে নবীন, আর ওয়েস্টার্ন ফিলোসফির ঐতিহ্যের তুলনায় তো একেবারেই প্রাথমিক। বিশেষ করে, শতাব্দির চলে আসা আরব দর্শনচর্চার সাথে তার পষ্ট বিচ্ছিন্নতার ব্যাপারটা প্রকাশিতই। ফলে, এই উপসংহার থেকে বোঝা যায় যে, স্থানীয় পরিসরে দর্শনকে পরিচয় করায়ে দেওয়াই এখন সৌদি আরবের মূল কাজ— বিশেষ করে দর্শনের ক্ষেত্র, দর্শনের ট্রাডিশনাল ও মর্ডান স্কুল অফ থটগুলার ক্ষেত্রে। অর্থাৎ, এখানে আলোচনা বেশি হচ্ছে এখন দর্শন নিয়েই, ‘দর্শনচর্চা’ আর ডিপ বিশ্লেষণের দিকে মনোযোগদান এখনও তুলনামূলকভাবে কম।

. ২০১৮ সালে মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে দর্শন ও আইন অন্তর্ভুক্ত করা ছিল যুগান্তকারী পরিবর্তন। এর মাধ্যমে সরকার দর্শনচর্চার প্রতি গভীর আগ্রহ আর সমর্থন দেখাইছে। তারা না শুধুই আগ্রহী নাগরিকদের জন্য সুযোগ সৃষ্টি করছে, বরং দুনিয়ার নানান প্রান্তর থেকে দর্শন বিশেষজ্ঞদের জড়ো করতে পারছে। এই সহায়তার ফলে সৌদি আরব দর্শনচর্চার প্রাথমিক ধাপগুলা দ্রুত অতিক্রম করছে। অর্থাৎ, এইটা শুধুমাত্র কিছু আগ্রহীর ব্যক্তিগত প্রচেষ্টার ওপর নির্ভরশীল থাকতেছে না, বরং একটা সুসংগঠিত ও শক্তিশালী কাঠামোর মধ্যে থেকে পরিচালিত হইতেছে, যা কিমা দর্শনচর্চার শুরুওয়াতকে করে তুলতেছে আরও বিস্তৃত, আরও প্রভাবশালী ও আরও গভীর।

আখেরে এইটা স্বীকার করা জরুরিই যে, এই পরিবর্তন যদিও শক্তিশালী কাঠামো, আপাত উচ্চাকাঙ্ক্ষা আর সক্রিয় সামাজিক সম্পৃক্ততার মাধ্যমে পরিচালিত হইতেছে, এসব সত্ত্বেও, সৌদি দর্শনচর্চাকে বেশ কিছু চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হইতে হবে, এবং তাদের এজন্য প্রয়োজন হবে—১. দর্শনের হিস্টোরিকাল ও জিয়োগ্রাফিকাল এরিয়া নিয়ে ভালো বোঝাপড়া তৈরি করা; ২. সৌদি সংস্কৃতির সমৃদ্ধ উপাদান থেকে নিজস্ব দার্শনিক ভাবনা ও ব্যাখ্যা গড়ে তোলা; ৩. অতীত, বর্তমান ও অপেক্ষমান স্টেপগুলাকে অতিক্রম করে, আধুনিক দার্শনিক প্রশ্ন ও জিজ্ঞাসার মোকাবেলা করা, যার জন্য কিনা প্রয়োজন অদম্য বৈজ্ঞানিক সৎসাহসিকতার ও জ্ঞানিতাত্ত্বিক গভীরতার; যেই প্রশ্ন ও জিজ্ঞাসা দাঁড় করায়ে দেয় নৃতাত্ত্বিক আইডেন্টিটি আর নৈতিক কাঠামোর মুখোমুখি, একইসঙ্গে চোখা নজর রাখে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে দ্রুত পরিবর্তনশীল প্রযুক্তিক অগ্রগতির দিকে ও তার সামাজিক প্রভাব-প্রবণতার দিকে। অতএব, এইসব প্রশ্নাধীন ক্ষেত্রে সৌদি দর্শনকে হইতে হবে আরও কানেক্টেড, আরও কার্যকর। 

বিজ্ঞাপন

Subscribe
Notify of
guest
1 Comment
Oldest
Newest Most Voted
Inline Feedbacks
View all comments
ওমর ফারুক
ওমর ফারুক
30 days ago

দারুণ একটা অনুবাদ পড়লাম।
মনে হইলো এটা যেন একটা মৌলিক লেখা পড়লাম।

স্বত্ব © ২০২৩, যোগাযোগ | ই মেইল : jogajogbd.org@gmail.com

যোগাযোগ-এ প্রকাশিত কোনো লেখা, ছবি কিংবা শিল্পকর্ম লেখক অথবা কর্তৃপক্ষের অনুমতি ছাড়া কোথাও প্রকাশ করা অবৈধ৷