ইসলামি ঐতিহ্যে মানতেকশাস্ত্র : ত্বাহা আবদুর রহমানের মূল্যায়ন

খালিদ মুহাম্মাদ সাইফুল্লাহ

ত্বাহার নাম মানতেক চর্চার সঙ্গে বিশেষভাবে সংযুক্ত হবার পেছনে কিছু অনুঘটক আছে। সোরবোঁ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পড়াশোনা শেষে তিনি দেশে ফেরেন এবং রিবাত বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনার দায়িত্ব গ্রহণ করেন। ১৯৭০ সালে, উস্তাজ নাজিব বালাদির মৃত্যুর পর যুক্তিবিদ্যা পড়ানোর দায়িত্বভার ত্বাহার উপর অর্পিত হয়। তিনি তখন প্রাচীন মানতেকের পরিবর্তে আধুনিক যুক্তিবিদ্যায় জোর দেন; যা গাণিতিক সংকেতের মাধ্যমে চর্চিত হয়। সেইসাথে, মানতেক যেহুতু নেসাবভুক্ত, তাই এর পেছনে উল্লেখযোগ্য একটি সময় তিনি ব্যয় করেন, যাতে পাঠদানে ঘাটতি না থাকে। কাজেই, যুক্তিবিদ্যার মেথডোলজি, ইতিহাস ও যুক্তিবিদ্যার দর্শনের উপর তিনি ধারাবাহিক অধ্যাবসায় জারি রাখেন। এক পর্যায়ে বিষয়টি কেবল দর্শনের আওতাভুক্ত থাকেনি, আরবি ভাষা ও সাহিত্যের দিকেও মোড় নিয়েছিল। আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ অনুঘটক হচ্ছে, ত্বাহার গবেষণা, অনুসন্ধান ও লেখালেখি পরবর্তীতে মানতেককে কেন্দ্র করে গড়ে উঠে। এমনকি তার ডক্টরেট থিসিসের বিষয় হিসেবে তিনি বেছে নেন ‘ভাষার উপরিকাঠামোতে আধুনিক যুক্তিবিদ্যার ব্যবহার’। ক্রমান্বয়ে এ বিষয়ে হাজির করেন উল্লেখযোগ্য কিছু রচনা, যেমন, আল মানতেক ওয়ান নাহউস সুরী, উসুলল হিওয়ার ওয়া তাজদিদু ইলমিল কালাম ইত্যাদি।

ইসলামি ঐতিহ্যে মানতেক (Logic) শাস্ত্রের দুটি ঐতিহাসিক বাস্তবতা আছে—প্রথমত, যুক্তিবিদ্যার সাথে নিবিড়ভাবে সংযুক্ত ছিলেন, এমন আলেমের সংখ্যা মোটেও স্বল্প নয়। বরং যুগে যুগে বৃদ্ধি পেয়েছে। স্পেন, মরোক্কো, ইরাক ও পারস্য সহ নানা অঞ্চলে তাদের উপস্থিতি ছিল লক্ষ্যণীয়। তাদের নির্মাণ ও সৃষ্টি একই ছাঁচের নয়, বরং বহুরূপী; সৃজনশীল রচনা, টীকা, অনুবাদ, সার-সংক্ষেপ, মতন ও ব্যাখ্যাগ্রন্থের মতো বিবিধ প্রকাশনা মানতেক শাস্ত্রকে ঘিরে গড়ে উঠেছিল। আরো তাজ্জবের ব্যাপার হচ্ছে, মানতেক শাস্ত্রজ্ঞদের বিশ্বাস ও ভাবাদর্শ অভিন্ন ছিল না, বরং বিচিত্র ঘরনার লোক এতে শামিল ছিলেন। মুসলিমদের পাশাপাশি দেখা যায় ঈসায়ী, ইহুদী এবং সাবিয়ান সম্প্রদায়কে।[1]সাবিয়ান সম্প্রদায় মুলত আব্রাহামিক ধর্মের একটি। যারা আদম, নূহ এবং শীষ আ. এর … Continue reading তারা নির্দিষ্ট কোনো শাস্ত্রের পন্ডিত নন, বরং এক্ষেত্রেও রয়েছে বিপুল বৈচিত্র; আছেন ফকিহ, উসুলবিদ, মুতাকাল্লিম, সুফি, দার্শনিক, চিকিৎসক, জ্যোতির্বিজ্ঞানী এবং রাসায়নবিদ প্রমুখ। মনে রাখতে হবে, তারা কিন্তু শিক্ষানবিশ কিংবা তালবে এলেম নন, বরং আলেম হিসেবে তাদের ছিল শুহরত ও প্রসিদ্ধি।

দ্বিতীয়ত, শাস্ত্র হিসেবে মানতেকের প্রতি উষ্ণ অভ্যর্থনা যেমন ছিল, তুমুল প্রতিরোধের মুখেও পড়তে হয়েছে তাকে। ত্বাহা আব্দুর রহমান দেখাচ্ছেন যে, তীব্রতা ও পদ্ধতিগত দিক থেকেও প্রতিরোধ ছিল নানারূপ; অনর্থক, অর্থহীন প্যাঁচাল, আন্দাজে ঢিল মনে করেছে অনেকে, কেউ আবার ঠাহর করেছে সত্যপথ-বিরুদ্ধ প্রবনতা হিসেবে; যাকে ঘিরে রেখেছে ভ্রান্তি, সংশয় ও দ্বন্দ্বের বেড়াজাল। এমনকি আজ অবধি মানতেক শাস্ত্রজ্ঞ ব্যক্তিগন অপবাদ, প্রতিঘাত, প্রসিদ্ধি ও পতন সবকিছুর সম্মুখীন হয়েছেন সমান্তরালে।

ত্বাহা আব্দুর রহমান বলেন, আমরা প্রতিরোধ কিংবা অভ্যর্থনা, কোনো ক্ষেত্রেই ত্বরিত-সিদ্ধান্ত নিব না। বুদ্ধিবৃত্তিকভাবে স্থবির থাকা যেমন ভালো কাজ না, তদ্রুপ, ইসলামি ঐতিহ্যের একটি বিশেষ অংশকে খারিজ করে দেয়ার প্রকল্পে সাক্ষর করতেও রাজি নই আমরা। তুরাসকে পুর্ণাঙ্গরূপে ধারণ করতে ব্যর্থ হলে আমাদের সমৃদ্ধি মুখ থুবড়ে পড়বে। খুব সচেতনভাবে নজর দিতে হবে, কেন ও কিভাবে ইসলামি ঐতিহ্যে মানতেক (যুক্তিবিদ্যা) সম্পর্কে দ্বিমূখী বাস্তবতা গড়ে উঠেছে।

ইসলামি ঐতিহ্যে জ্ঞানতাত্ত্বিক (ইলমি) মিথস্ক্রিয়া: কয়েকটি মৌলিক প্রস্তাব

ইলম ও জ্ঞানতাতত্ত্বিক যেকোনো প্রকল্পের ক্ষেত্রে শুদ্ধা-শুদ্ধি যাচাইয়ের মানদন্ড হিসেবে থাকবে কিছু নীতিমালা ও উসুল। মজার ব্যাপার হচ্ছে, মানতেক-শাস্ত্রও এর বাইরে নয়। সুতরাং শরিয়াসম্মত কিংবা শুদ্ধ বলার পূর্বে অবশ্যই মানতেককে মুলনীতি অনুযায়ী বিচার-বিশ্লেষণ করতে হবে। এখন প্রশ্ন হচ্ছে, জ্ঞানতাত্ত্বিক মিথস্ক্রিয়ার মূলনীতি বলতে কী বুঝি আমরা?

মোটাদাগে বলতে গেলে, যেসব উসুল ও মৌলনীতির সাহায্যে কোনো শাস্ত্র, জ্ঞান ও চর্চাকে আমরা ইসলামি অথবা অনৈসলামি বলে থাকি, ত্বাহা সেগুলোকেই জ্ঞানতাত্ত্বিক মিথস্ক্রিয়ার মূলনীতি হিসেবে চিহিৃত করেছেন। তিনি এক্ষেত্রে বিশ্বাস, ভাষা এবং বুদ্ধিবৃত্তির সাথে সংশ্লিষ্ট কিছু মুলনীতি প্রস্তাব করেছেন—

ক. আল্লাহর একত্ব স্বীকার করে নেয়া; তাকে ইবাদত ও মর্যাদার এমন উপযুক্ত স্থানে অবস্থান দেয়া, যাতে অন্য কারো শরিকানা চলে না।

খ. আল্লাহ ব্যতীত অন্য যা কিছু আছে, তা কেবল আল্লাহর ইচ্ছা, দয়া এবং সৃষ্টির মাধ্যমেই সম্ভব হয়েছে, সেটি মেনে নেয়া।

গ. ভাব-প্রকাশের ক্ষেত্রে বাক্য সংক্ষেপ করে উপস্থাপন করা, এটি মুসলিম সাহিত্যের একটি গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য।

ঘ. দ্বীন সংশ্লিষ্ট বুদ্ধিবৃত্তিক কোনো প্রসঙ্গে কথা বলার ক্ষেত্রে অবশ্যই তার ব্যবহারিক (আমলি) গুরুত্বের প্রতি খেয়াল রাখতে হবে। এবং তাতে কল্যাণ আছে কি না, বিবেচনা করতে হবে।

ঙ. এবং গায়েবের ব্যাপারে উপলব্ধি যেনো বুদ্ধি নির্ভর না হয়, বরং শরিয়তের মুলনীতির ভিত্তিতেই হয়, সে ব্যাপারে হুশিয়ার থাকতে হবে।

জালালুদ্দীন সুয়ুতী রাহ. বলেন,

ليس في جميع الأمم، أمة أوتيت من استقامة العقيدة وبلاغة اللسان وسلامة العقل مثلما أوتيته العرب، تفضيلا من الله

এমন কোনো জাতি নেই, যাদেরকে আরবদের মতো সঠিক বিশ্বাস, ভাষার শুদ্ধতা এবং বুদ্ধির সুস্থতা দিয়ে সম্মানিত করা হয়েছে, এটি আল্লাহর অনুগ্রহ।[2]সওনুল মানতিক ওয়াল কালাম আন ফান্নিল মানতিক ওয়াল কালাম, সুয়ুতী। পৃষ্ঠা- ২৩ ত্বাহা আব্দুর রহমান মৌলিক কিছু শর্ত প্রস্তাবের পাশাপাশি বিরোধীদের সমালোচনা ও আপত্তি নিয়ে কথা বলেছেন। তিনি দেখিয়েছেন, ঠিক কী ধরণের সমস্যার কারণে মুসলিম ওলামাগন মানতেককে গ্রহণের ব্যাপারে সম্মত হননি।

মানতেক শাস্ত্রকে ঘিরে সৃষ্ট অনাস্থা ও সংশয়: উৎসের সন্ধানে

যুক্তিশাস্ত্রের বিপরীতে আপত্তিগুলো জন্ম নিয়েছে প্রথমত আকিদার প্রশ্নে। ইলমে কালাম এবং ম্যাটাফিজিক্সের সাথে মানতেকের একটা গভীর নিমজ্জন ছিল। এ কারণে দেখা যায়, আকিদার মুলনীতি উপেক্ষা করে মানতেক একটি অধিবিদ্যাগত রাস্তা বেছে নিয়েছিল। যেমন, উকুলে আশারা ও জগতের অবিনশ্বরতায় বিশ্বাস, পরকাল এবং দৈহিক পুনরুত্থানের প্রতি অস্বীকৃতির মতো অনুসঙ্গ যুক্তিবিদ্যার সাথে সংযুক্ত হয়ে গেছে। এসবের দায় থেকে মানতেককে নিষ্কলুষ রাখা যাচ্ছে না।

এরসাথে যুক্ত হয়েছে ইলমে কালাম প্রসঙ্গ। অধিবিদ্যার মতো ইলমে কালামের সঙ্গেও যুক্তিবিদ্যার রিশতা ছিল নিবিড়। ফলে ইলমে কালামের অসঙ্গতি থেকে মানতেক দায় এড়াতে পারেনি। আকিদার অনুসঙ্গকে ইলমে কালাম যেভাবে সমাধা করতে চেয়েছে, সেটি কুরআন-সুন্নাহর পদ্ধতি নয়। সালাফদের চর্চাতেও এই পদ্ধতির উপস্থিতি নেই। ব্যাপকভাবে সিফাত ও মুতাশাবিহাত সংশ্লিষ্ট বিষয়ে মুতাকাল্লিমদের লিপ্ততা দেখা যায়; যেখানে উচিত ছিল দাসত্ব বা উবুদিয়াতের গুণাবলী নিয়ে চর্চা করা, সেটা না করে মানুষ লিপ্ত হলো আল্লাহর সিফাত সংক্রান্ত আলোচনায়, যার উপলব্ধি বুদ্ধির মাধ্যমে সম্ভব নয়, ভাষার সীমাবদ্ধ কাঠামোতে ব্যক্ত করা যায় না। ফলে জ্ঞানতাত্ত্বিক মিথস্ক্রিয়ার জন্য যেসব মৌলিক শর্ত ত্বাহা আব্দুর রহমান নির্ধারণ করেছেন, সেগুলো যথাযথভাবে অনুসৃত হয়নি। জ্ঞানতাত্ত্বিক মিথস্ক্রিয়ার শর্ত অনুসৃত হলে মানতেক চর্চায় সংকট দেখেন না ত্বাহা। কাজেই, একসময় ইলমে কালামের ব্যাপারেও হারাম ফতোয়া এসেছিল।

দ্বিতীয়ত, কিছু সংশয় সৃষ্টি হয়েছে ভাষা ও প্রকাশভঙ্গির কারণে। ত্বাহা দাবি করেছেন, ভাব-প্রকাশের ক্ষেত্রে সংক্ষিপ্ত বাক্যে উপস্থাপন মুসলিম সাহিত্যের একটি গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য; এজন্য নবিজীর সা. কথামালাকে জাওয়ামিউল কালিম বলা হয়। এছাড়াও সাহাবী, তাবেঈন এবং সালাফদের বক্তব্য ছিল অত্যন্ত সংক্ষিপ্ত, অর্থবহ ও সুস্পষ্ট। কিন্তু যুক্তিবিদ্যার বইপত্র ও রচনাসমূহে দেখা যায়, অর্থপূর্ণ ছোট বাক্যকে অযথা দীর্ঘায়িত করা হচ্ছে। আরবি ভাষার প্রকাশরীতি অনুসৃত হচ্ছে না। ঠিক কী কারণে যুক্তিবিদ্যা এমন অনর্থক পন্থা বেছে নিল, সেটি বুঝতে নজর দিতে হবে মানতেকের কাঠামোতে। মুলত এই শাস্ত্র মনের ভাব ভাষায় প্রকাশের ক্ষেত্রে একটি নির্দিষ্ট কাঠামো অনুসরণ করে থাকে। সুগরা, কুবরা এবং নতিজার (Premise-1, Premise-2, Conclusion) সমন্বয়ে একটি অর্থপূর্ণ বাক্য তৈরি করা হয় যুক্তিশাস্ত্রে। এই শাস্ত্রের দাবি অনুযায়ী কোনো একটি অংশের অনুপস্থিতিতে বাক্য যুক্তিপূর্ণ ও অর্থবহ হয়ে ওঠে না। মুসলিম শরীফে বর্ণিত একটি হাদিসে নবিজী বলেন, كل مسكر خمر وكل خمر حرام অর্থ:  প্রতিটি মাদকদ্রব্যই মদ এবং প্রতিটি মদ হারাম। নবিজীর সা. উল্লিখিত বক্তব্যে কোনো ধরণের অস্পষ্টতা নেই। কিন্তু যুক্তিশাস্ত্রের কাঠামো অনুসারে এটি অপূর্ণ বাক্য এবং পূর্ণাঙ্গ যৌক্তিক দেখায় না। কেননা মানতেক শাস্ত্রে ধারণা করা হয়, একটি অর্থপূর্ণ ও যৌক্তিক বাক্যের তিনটি অংশ থাকতে হবে। এখানে একটি অংশ অনুপস্থিত। কাজেই, যুক্তিবিদ্যার দাবি অনুসারে হাদিসটিকে বিন্যাস্ত করতে হলে আরো একটি অংশ বৃদ্ধি করতে হচ্ছে। যেমন, মানতেকের কাঠামো অনুসারে হাদিসের শব্দ ও মর্ম সাজালে পুরো বাক্যটি দাঁড়াচ্ছে এমন, كل مسكر خمر وكل خمر حرام، فإذن كل مسكر حرام অর্থ: প্রতিটি মাদকদ্রব্যই মদ এবং প্রতিটি মদ হারাম। সুতরাং, প্রতিটি মাদকদ্রব্য হারাম।  এভাবেই যুক্তিবিদ্যার বইপত্র ও রচনাসমূহে দেখা যায়, অর্থপূর্ণ ছোট বাক্যকে অযথা দীর্ঘায়িত করা হচ্ছে।

তৃতীয়ত, ত্বাহা আব্দুর রহমান যুক্তিবিদ্যার আরো কিছু মুসিবতের দিকে ইশারা করেছেন। এরমধ্যে গুরুত্বপূর্ণ একটি মুসিবত মানুষের আমল বা ব্যবহারিক জীবনের সাথে সম্পৃক্ত। সাধারণত দার্শনিকরা দু‘ধরনের চিন্তার কথা বলেন: তত্ত্বীয় চিন্তা এবং ব্যবহারিক চিন্তা। লক্ষণীয় বিষয় হচ্ছে, মানতেক যেসব কানুন, তুলাদন্ড এবং সীমারেখা নির্ধারণ করে থাকে, সেগুলো মোটাদাগে তত্ত্বচিন্তার সঙ্গে সম্পৃক্ত; আমলকে শামিল করে না। অথচ ইসলামি চিন্তার প্রধান মনোযোগ থাকে ব্যবহারিকতায় (আমল)। যে জ্ঞান ও চিন্তার সাথে আমলের যোগাযোগ নেই, সেটি উপকারী চিন্তা হিসেবে মুল্যায়িত হয়না। সে চিন্তা বিশেষ মনোযোগ তো দূরে থাক, ক্ষেত্রবিশেষে নিন্দিত হয়। কিন্তু তত্ত্বচিন্তার প্রতি যুক্তিশাস্ত্রবিদদের বাড়তি মনোযোগ দেখা যায়, সেই তুলনায় ব্যবহারিক চিন্তা ছিল অবহেলিত। ফলে উপকার ও প্রভাবের তুলনায় বিশৃঙ্খলা তৈরি হয়েছে মানতেক শাস্ত্রকে ঘিরে। ফলে অনেক ফকিহ ও হাদিসবেত্তাগণ মানতেককে ইতিবাচক হিসেবে বিবেচনা করেননি। ব্যবহারিক গুরুত্ব নিশ্চিত করে মানতেক চর্চার প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন ত্বাহা আব্দুর রহমান।

চতুর্থত, বর্তমানেও ব্যাপকভাবে মানতেকের বিরোধিতা দেখা যায়। আরবের অনেক বিশ্ববিদ্যালয়ে রীতিমতো মানতেক পাঠকে হারাম গণ্য করা হয়। মানুষের মধ্যে একটি উক্তি ছড়িয়ে গেছে, যে মানতেক চর্চা করে সে জিন্দিক হয়ে যায়। এসব নেতিবাচকতা ছড়িয়েছে, কারণ, প্রাচীন মানতেক দর্শনের নামে চর্চিত হতো। ফলে দর্শনের দায় মানতেকের উপর এসে পড়েছে। আদিতে গ্রীক দর্শনের কারণে মুসলিমদের মনে সংশয় ও সন্দেহের দানা বাঁধতো।

আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার হচ্ছে, যুক্তিশাস্ত্রের পন্ডিতগণ সকল বিষয়কে বুদ্ধির উপর নির্ভরশীল করে রাখেন। বুদ্ধির বিচার ব্যতীত ভিন্ন কোনো বিচারিক মানদন্ড তাদের কাছে নেই। অথচ ইসলামের যে অধ্যায়গুলো গায়েবের সাথে সম্পৃক্ত, তাতে বুদ্ধির বিচার চলে না। শুধু যে বিচার চলে না, তাই না, বরং বুদ্ধির গায়েবের সীমানায় হাজির হওয়ার ক্ষমতাই রাখে না। কখনও বুদ্ধির বিচার সরাসরি গায়েবের বিরুদ্ধে অবস্থান গ্রহণ করে। সেসব ক্ষেত্রে মুসলিম হিসেবে আমরা নির্লিপ্তে মেনে নিই এবং আত্মসমর্পণ করি। এবং প্রত্যাশা রাখি, আল্লাহ ইহজগতে অথবা পরকালে গায়েবের বিষয়গুলো উন্মোচিত করবেন। তিনি কুদরত ও ইলমের মাধ্যমে গোটা জগতকে পরিবেষ্টিত করে রেখেছেন, কারো ক্ষমতা নেই আল্লাহর সীমা অতিক্রম করার। যুক্তিশাস্ত্রজ্ঞদের একটি মুসিবত হচ্ছে, সবকিছুর বুনিয়াদে তারা বুদ্ধিকে স্থান দেন। ফলে, মাঝে মাঝে এমন অনেক বিষয়কে জ্ঞান ও সত্য হিসেবে তারা বিচার করে যা নিছকই কৃত্রিমভাব; বাস্তবের সাথে ঘুণাক্ষরেও তার রিশতা নেই। কাজেই ত্বাহা আব্দুর রহমান বলেন, সর্বশেষ আলোচনার ভিত্তিতে বোঝা গেল, জ্ঞানতাত্ত্বিক মিথস্ক্রিয়ার শেষোক্ত যে শর্তসমূহ ছিল (ব্যবহারিক গুরুত্ব, কল্যাণ বিবেচনা এবং গায়েবের ব্যাপারে বুদ্ধি নির্ভর না হওয়া), সেগুলোও মূল্যায়িত হয়নি, যুক্তিশাস্ত্রের চর্চা ও অনুশীলনে।

দ্বীন এমন একটি ব্যবস্থাপনা, যা কি না সম্পূর্ণ ব্যবহারিক উপায়ে ব্যক্তি ও সমাজের পরিশুদ্ধির কথা বলে। অথচ দুঃখজনকভাবে, যুক্তিশাস্ত্রের পন্ডিতগণ দ্বীনকে তার আমলি তাৎপর্য থেকে সরিয়ে ফেলেছে। এবং নিরেট তাত্ত্বিক কাঠামোর উপর দাঁড় করিয়েছে। এটি স্রষ্টার আকাঙ্খা ও অভিপ্রায়ের ভিন্নতা অবশ্যই, সেইসাথে ফিকহের নীতি-বিরুদ্ধ আচরণ। ত্বাহা বলেন, মানতেককে পরিশীলিত ভঙ্গিতে উপস্থাপন করতে হবে। এক্ষেত্রে শরিয়ার টেক্সট এবং আত্মশুদ্ধির সঙ্গে রিশতা তৈরির কাজটি প্রাথমিক এবং জরুরী, যুক্তিশাস্ত্রের পন্ডিতদের জন্য। টেক্সটকে মুল আর বুদ্ধিকে বিবেচনা করতে হবে অনুগামী হিসেবে।

উপরোক্ত বিবরণ থেকে পষ্ট হলো, ঠিক কী কারণে ফকিহ, মুহাদ্দিস, উসুলবিদ, মুতাকাল্লিম এবং ভাষাবিদগণ সম্মিলিতভাবে যুক্তিবিদ্যার বিরোধীতা করেছে। একজন কিংবা দুজন নন, বরং বড় একটি শ্রেণী বিপরীতে অবস্থান নিয়েছেন। তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিলেন ইমাম শাফেঈ, আবু সাইদ সাইরাফি, বাকিল্লানী, কাজী আব্দুল জাব্বার, আবু আলী জুব্বাঈ, আবু মাআলী, আবুল কাসেম আনসারী, ইবনুস সালাহ, ইবনু তাইমিয়া, ইবনুল কাইয়্যিম জাওযিইয়্যাহ, সুয়ুতী প্রমুখ ইমামগন।

যুক্তিশাস্ত্রের বিরোধীতা আর সমালোচনা শুধু হয়েছে, প্রভাব ও তাৎপর্যের স্বীকৃতি কি দেয়নি কেউ, ইসলামি ঐতিহ্যে? এটি অত্যন্ত জরুরি জিজ্ঞাসা। এই জিজ্ঞাসা জরুরি, কেননা, বহু লোকজন আছেন, এমনকি আলেম শ্রেণীও ইসলামি ঐতিহ্যে ইলমে মানতেকের স্বত্ব স্বীকার করতে রাজি নন। আমরা খুব সচেতনভাবে এ জিজ্ঞাসার সদুত্তর তালাশ করবো সামনের আলোচনায়। এবং ইলমে মানতেকের গুণগ্রাহী ব্যক্তিত্বদের চিন্তা-ভাবনা ত্বাহা আব্দুর রহমানের ভাষায় পর্যালোচনা করব ইনশাআল্লাহ।

ইলমুল মানতেক : জরুরত এবং প্রাসঙ্গিকতা

ইসলামের জ্ঞানতত্ত্বিক ঐতিহ্যের শেষযুগেও মানতেক চর্চা সচল ছিল। শুধু মৌলিক লেখালেখিতে নয়, বরং অধ্যায় ও কায়দা-কানুন বিশ্লেষিত হয়েছে বিস্তৃত পরিসরে। আবার এই চর্চা দর্শনের পরিমন্ডল পেরিয়ে প্রভাব বিস্তার করেছে ইসলামের অন্যান্য জ্ঞানশাখায়। সহায়ক বিদ্যা হিসেবে পরিচিত যে জনরা রয়েছে, ইলমুল উসুল, কালামশাস্ত্র এবং নাহু-সরফ ইত্যাদি শাস্ত্রে মানতেকের বিচরণ ছিল পরিষ্কার। ইসলামি জ্ঞানচর্চার ইতিহাস আমাদের সামনে খোলা আছে, আপনি নজর রাখলেই বুঝবেন, আলেমগণ ব্যাপকভাবে মানতেক চর্চায় অংশ নিয়েছেন। ইতিবাচক ভুমিকা পালন করেছেন। ফকিহ এবং উসুলবিদ ছিলেন সামনের সারিতে। শক্ত ও যথোপযুক্ত প্রমাণের ভিত্তিতে যুক্তিবিদ্যার প্রাসঙ্গিকতা তারা তুলে ধরেছেন।

মোটাদাগে, তিনটি বিশেষ পরিক্রমার ভেতর দিয়ে ফকিহ-ইমামগণ মানতেক চর্চার ইতিবাচক-পরিসর নির্মাণ করেন। সে ব্যাপারে শীঘ্রই সবিস্তারে বয়ান করব আমরা। তার আগে, মুসলিমদের জ্ঞানচর্চার বিশেষ একটি বৈশিষ্ট্যের খবর দিই। ফকিহগণ মিথস্ক্রিয়ার যে পরিমন্ডল তৈরি করেন, অন্যান্য জ্ঞানশাখাকে আত্মীকরণ করতে, ত্বাহার ভাষায় সেটি তাদাউল। তুরাসে তাদাউলের বিশেষ কিছু নীতিমালা রয়েছে, ফকিহগন মুলত সেসব নীতিমালা হাজির করেছেন নানাসময়ে। যাইহোক, এবার আমরা মুল আলাপে আসি। যে তিনটি বিশেষ পরিক্রমার ভেতর দিয়ে রচিত হয়েছে মানতেক চর্চার অনুকুল পরিবেশ, সেগুলো ত্বাহার ভাষায় বিশ্লেষিত হয়েছে–-

এক. বয়ানী (তাবয়ীন) পরিক্রমা; প্রখ্যাত ফকিহ ইবনে হাজম তার ‘আত-তাকরীব লি হাদ্দিল মানতিক’ বইয়ে একটি পরিক্রমা অবলম্বন করেছেন; সেখানে জরুরি কিছু শর্ত পূরণের নিমিত্তে মানতেক চর্চাকে তিনি দরকারি হিসেবে বিবেচনা করেন। প্রথম শর্ত হচ্ছে, যুক্তিশাস্ত্রীয় আলাপ-আলোচনা যখন অনুবাদ করবেন কেউ, তখন নিজস্ব ভাষা-সংষ্কৃতির প্রতি যত্নশীল হবেন। সেইসাথে জনসমাজে প্রচলিত ও চর্চিত শব্দবাক্যের প্রতি নজর রেখে অনুবাদ করবেন। যেন নিজস্ব ভাষাভাষী লোকদের নিকট সহজবোধ্য হয়। যবান ও ফিকিরের রিশতা তৈরির ক্ষেত্রেও এটি কার্যকর ভুমিকা রাখবে। দ্বিতীয় শর্ত হচ্ছে, শাস্ত্রে কিছু বিষয় থাকে, যা ল্যাটিন, গ্রীক কিংবা অন্যান্য ভাষায় যুতসই মনে হলেও, মাতৃভাষায় জটিল ও দুর্বোধ্য হতে পারে। কেননা, ক্ষেত্রবিশেষে ভাষার গঠনের সাথে ভাবের যোগ থাকে। সেসব বিষয় খোলাখুলি উপস্থাপন করতে হবে। ত্বাহা আব্দুর রহমান এই পরিক্রমায় ইমাম গাযালীকেও বিশেষ গুরুত্বের সাথে স্মরণ করেছেন। একটি বা দুটি নয়, গাযালী কয়েকটি বইয়ে মানতেক শাস্ত্রের বৃহৎ পরিমন্ডল নির্মাণে সক্রিয় ছিলেন। সেসব বইয়ের মধ্যে রয়েছে কিতাবুল মুস্তাসফা, শিফাউল গালীল, মিহকুন নজর, আল-কিস্তাসুল মুস্তাকিম এবং মুনকিয মিনাদ্দলাল ইত্যাদি। গাযালী মানতেকের পুনঃসংজ্ঞায়ন করছেন; যার মর্মশাঁস তুলনামুলক পরিব্যাপ্ত, যেখানে ফিকহ এবং বুদ্ধির কলাকৌশল শামিল থাকে।

দুই. তাবরিয়া শব্দের সাহায্যে ত্বাহা আরেকটি পরিক্রমা নির্দেশ করেন, যার মুলকথা হচ্ছে, সহায়ক-বিদ্যা হিসেবে মানতেককে ভ্রান্তি থেকে দায়মুক্ত করতে হবে। কেননা মৌলিকত্বের বিবেচনায় মানতেকের নিজস্ব কোনো আদর্শ নেই। ধর্মের কোনো সিদ্ধান্তে স্বয়ং যুক্তিবিদ্যা কোনো রকম বাগড়া দেয়না; চাই তা ইতিবাচক হোক কিংবা নেতিবাচক। তাহলে ধর্মে যুক্তিবিদ্যার কাজ কী আসলে? ত্বাহার মতে, সহায়ক বিদ্যা হিসেবে দলিল, প্রমাণ ও বুদ্ধির বিন্যাস রচনাই কেবল মানতেকের কাজ। সিদ্ধান্ত কিংবা ভাবাদর্শ লালন ও পালন এ শাস্ত্রের কাজ নয়। কাজেই, কারো ভুল ও ভ্রান্তিপূর্ণ সিদ্ধান্ত একান্তই সে ব্যক্তির, যুক্তিবিদ্যার যথাযথ প্রয়োগে সে ব্যর্থ হয়েছে। সুতরাং, ধর্মতত্ত্বে দার্শনিকরা যেসব ভুল-ভ্রান্তি করেছে, ধর্মবিরোধী সিদ্ধান্ত দিয়েছে, তা থেকে মানতেক দায়মুক্ত। দার্শনিকদের ভ্রম হয়েছিল, যে, তারা পরমসত্য আবিষ্কার করেছে, অথচ সেটি ছিল ভ্রান্তি।

তিন. ফিকহী পরিক্রমা। এক্ষেত্রে দুটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা ঘটে গেছে জ্ঞানগত ঐতিহ্যে; মানতেক উসুলুল ফিকহের অধ্যায়ে ঢুকে গেছে। আর ফিকহী দৃষ্টিভঙ্গি প্রবেশ করেছে চিন্তাগত লেখাপত্রে। উভয় ঘটনার স্বাক্ষর ইমাম গাযালীর বইপত্রে রয়েছে, তিনি যুগান্তকারী উদাহরণ সৃষ্টি করেছেন বলা যায়। প্রথম যে ঘটনার কথা উল্লেখ করেছি আমরা, সেক্ষেত্রে গাযালী যে নমুনা রেখেছেন, তার কিছু নিদর্শন আল-মুসতাসফা ফি ইলমিল উসুল কিতাবে রয়েছে। ক্বিয়াসে শরতিয়ার অন্তর্ভুক্ত – ইকতিরানি এবং ইসতেসনাঈ- উভয় প্রকারকে ফিকহি আলোচনায় এনেছেন। এমনকি যুক্তিবিদ্যা সম্পর্কে ধারণা নেই, এমন লোকের জ্ঞানে ভরসা রাখেন নি ইমাম গাযালী। আর দ্বিতীয়টির ছাপ রয়েছে মাকাসিদুল ফালাসিফা, আল-কিস্তাসুল মুস্তাকিম, মিহুকন নাজর এবং মিয়ারুল ইলম ইত্যাদি বইয়ে; এতে তিনি ক্রমে ক্রমে ফিকহ থেকে গৃহীত নানা উদাহরণ উপস্থাপন করেছেন। তাআদুল, তালাযুম এবং তাআনুদের[3]তাআদুল (تعادل): ‘সমতা’ বা ‘ভারসাম্য।’ যখন দুটি প্রমাণ বা যুক্তি একে অপরের সমান … Continue reading মতো ফিকহি মুলনীতিগুলো তিনি চিন্তাগত বইপত্রে এনেছেন।

মোদ্দাকথা, মানতেকের বিরুদ্ধে ইতিহাসে একমুখী কিংবা সম্মিলিত (ইজমা) কোনো সিদ্ধান্ত আসেনি। গাযালী ও ইবনে হাজমের মতো বহু আলেম পক্ষ নিয়েছেন। সমালোচনার জবাব দিয়েছেন, নিজেদের বইপত্রে মানতেকের কাঠামোগত অবস্থান বিন্যস্ত করেছেন ভাষা, বিশ্বাস ও ফিকহের অধ্যায়গুলোতে, সমান্তরালে।

পরিশেষে কিছু জরুরি নোক্তা দিই— প্রথমত, মানতেক চর্চা কোনো ঐচ্ছিক ইস্যু নয়, ইচ্ছে হলে চর্চা করবেন নতুবা না, এটি বরং সকল ‍বুদ্ধিসম্পন্ন মানুষের জন্য জরুরি। যুক্তিবিদ্যা ছাড়া বুদ্ধি সুসংহত হয়না। কেউ বিপরীত দাবি করলে হয়তো তার বুদ্ধি নেই, অথবা বুদ্ধি থাকলেও তা কার্যকর নয়। দ্বিতীয়ত, মানতেকের কোনো সীমিত ক্ষেত্র নেই যে, কেবল দর্শনেই যুক্তি চলবে, অন্য কোথাও চলবে না। ফিকহ ও রাজনীতির মতো ক্ষেত্রগুলো মানতেকের উপযোগিতার বাইরে নয়। এমনকি ত্বাহা আব্দুর রহমান দেখিয়েছেন, আইনজীবিদের জন্যও যুক্তিবিদ্যা চর্চা অত্যন্ত দরকারি।

তৃতীয়ত, যুক্তিবিদ্যা সরল এবং আশ্চর্য সুন্দর গদ্য তৈরির মেশিন নয় যে, এই সামান্য নান্দনিকতা বাদ দিলেও ক্ষতি নেই। কেননা বিবেক-বুদ্ধি যেমন মানুষের নান্দনিক বিষয় নয় বরং জরুরি, প্রত্যেকের জন্য, তেমনি যুক্তিবিদ্যাও জরুরি। এই শাস্ত্রের সাহায্যে আপনার বুদ্ধি ও চিন্তাফিকিরকে আপনি সুসংহত করবেন, একটি পদ্ধতি অনুসরণ করে। কাজেই, যারা বুদ্ধির প্রশংসা করে আবার যুক্তিবিদ্যার প্রতি নিন্দা জ্ঞাপন করে, তারা প্রকৃতঅর্থেই দ্বিচারিতা করে। মানতেক চর্চা জীবনভর করতে হবে, বয়সের সাথে এটি নির্দিষ্ট নয়।

অনেকে ‘আর রাদ্দু আলাল মানতিকিয়্যিন’ বইয়ের সুত্র ধরে ইবনে তাইমিয়াকে মানতেক বিরোধী হিসেবে দেখানোর চেষ্টা করেন। অথচ তিনি মানতেক শুধু চর্চাই করেন নি, বরং বড় রকম সংষ্কার ঘটে গেছে তাঁর হাতে। ইবনে তাইমিয়ার সংষ্কারকে ফলপ্রসু করার ব্যাপারে সালাফি, নন-সালাফি কারো মধ্যেই তেমন চৈতন্য দেখা যায় না। ইবনে তাইমিয়া এরিষ্টটলের অনেক স্বীকৃত মূলনীতির সমালোচনা করেছেন, মানতেকের নয়া রূপ হাজির করেছেন। এবং নয়া মানতেকের জন্য উসুল নির্মাণ করেছেন, যা এরিষ্টটলের মুলনীতি থেকে ভিন্ন। সালাফিরা শুধু ইবনে তাইমিয়ার শক্ত সিদ্ধান্তগুলোই গ্রহণ করে, তার মানতেকি উত্তরাধিকারের খোঁজ রাখে না। বাস্তব ব্যাপার হচ্ছে, এরিষ্টটলের যুক্তিবিদ্যা অনড়, অন্যদিকে ইবনে তাইমিয়ার মানতেক সচল, ব্যবহারিক এবং জীবন্ত।

সুত্র: সুআলুল মানহাজ এবং হিওয়ারাত মিন আজলিল মুস্তাকবাল।

তথ্যসূত্র:

তথ্যসূত্র:
1 সাবিয়ান সম্প্রদায় মুলত আব্রাহামিক ধর্মের একটি। যারা আদম, নূহ এবং শীষ আ. এর অনুসারী বলে বিশ্বাস করে।
2 সওনুল মানতিক ওয়াল কালাম আন ফান্নিল মানতিক ওয়াল কালাম, সুয়ুতী। পৃষ্ঠা- ২৩
3 তাআদুল (تعادل): ‘সমতা’ বা ‘ভারসাম্য।’ যখন দুটি প্রমাণ বা যুক্তি একে অপরের সমান শক্তিশালী হয় এবং উভয়ই গ্রহণযোগ্য হয়, তখন এ অবস্থাকে তাআদুল বলা হয়। এর সাহায্যে ফকিহগণ একটি ভারসাম্যপূর্ণ সিদ্ধান্তে আসার চেষ্টা করেন। তালাযুম (تلازم): ‘পারস্পরিক নির্ভরশীলতা।’ এটি তখন ব্যবহৃত হয় যখন দুটি বিষয় বা যুক্তি পরস্পরের সাথে সম্পর্কযুক্ত হয় এবং একটি অন্যটির উপর নির্ভরশীল। একটির সত্যতা বা ভ্রান্তি অন্যটির উপর নির্ভর করে। তাআনুদ (تعاند): ‘বিরোধ’ বা ‘দ্বন্দ্ব।’ এটি ব্যবহৃত হয় যখন দুটি প্রমাণ বা যুক্তি একে অপরের বিপরীত এবং পরস্পরকে বিরোধ করে। এখানে উভয় যুক্তি একসাথে সঠিক হতে পারে না এবং বিচারককে একটি বেছে নিতে হয়।

এই পরিভাষাগুলো মূলত ফিকহের সমস্যাগুলোর সমাধানের প্রক্রিয়ায় ব্যবহৃত হয়, যেখানে ইসলামী আইনের ভিত্তিতে বিচারক বা মুফতিরা সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন।

বিজ্ঞাপন

Subscribe
Notify of
guest
3 Comments
Oldest
Newest Most Voted
Inline Feedbacks
View all comments
Abrar Khan
Abrar Khan
6 months ago

অসাধারণ উপস্থাপনা৷ গুরুত্বপূর্ণ বিষয়৷ জাযাকাল্লাহ৷ এমন লেখা আরও চাই৷

মুহাম্মদ আসাদ
মুহাম্মদ আসাদ
Reply to  Abrar Khan
1 month ago

দারুণ

তা মি ম
তা মি ম
1 month ago

আলোচনার পয়েন্টগুলো চমৎকার ছিলো। শুকরিয়া।

স্বত্ব © ২০২৩, যোগাযোগ | ই মেইল : jogajogbd.org@gmail.com

যোগাযোগ-এ প্রকাশিত কোনো লেখা, ছবি কিংবা শিল্পকর্ম লেখক অথবা কর্তৃপক্ষের অনুমতি ছাড়া কোথাও প্রকাশ করা অবৈধ৷