আরবি ভাষা বিশ্বের সবচেয়ে ব্যাপকভাবে ব্যবহৃত এবং গুরুত্বপূর্ণ ভাষাগুলির একটি। এটি পবিত্র কুরআনের ভাষা, নবিজি (সা.) এর ভাষা এবং হাদিস অনুসারে জান্নাতিদের ভাষা। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আরবিভাষার সবচে বিশুদ্ধভাষী বলে নিজে গর্বিত হয়েছেন, তিনি বলেছেন : “আমি আরবদের মধ্যে সবচে’ বিশুদ্ধভাষী”।[1]القسطلاني، أحمد بن محمد، المواهب اللدنية بالمنح المحمدية الجزء 2 ص. 238 ط. المكتب الإسلامي 1425هـ ; অন্যত্র, বলেছেন : “যারা আরবিতে কথা বলে আমি তাদের মধ্যে সবচে বিশুদ্ধভাষী।”
সাহাবিদের দাওয়াতি সফরের ফলে এবং মুসলমানদের আরবির সাথে ঘনিষ্ঠ সম্পর্কের কারণে আরবিভাষা দ্রুত বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে ছড়িয়ে পড়ে। ভারতের দক্ষিণে অবস্থিত কেরালা হচ্ছে এমনই একটি প্রদেশ যেখানে এই ভাষা খুব তাড়াতাড়ি ছড়িয়ে পড়ে। এই সংক্ষিপ্ত প্রবন্ধে আমি কেরালা রাজ্যে আরবিভাষার শিক্ষা ও প্রসারের সাথে সম্পর্কিত কিছু গুরুত্বপূর্ণ দিক তুলে ধরব।
যদিও আয়তনের দিক থেকে কেরালা ভারতের অন্যান্য বড় রাজ্যগুলির তুলনায় ছোট, কিন্তু আরব দেশগুলোর নিকট কেরালা তার খ্যাতি ও মান-মর্যাদার দিক দিয়ে সুপরিচিত। কেরালা ভারতের দক্ষিণতম প্রান্তে অবস্থিত। দক্ষিণে কন্যাকুমারী, পূর্বে তামিলনাড়ু, উত্তরে কর্ণাটক এবং পশ্চিমে আরব সাগর। এর মোট আয়তন ৩৮,৮৬৩ বর্গ কিলোমিটার।
ইসলামের আগমন
কতক ইতিহাসবিদের মতে, নবি মুহাম্মদ (সা.) এর জীবদ্দশাতেই কেরালায় ইসলাম প্রবেশ করে। আর এই মতামতটিই সবচেয়ে যুক্তিসঙ্গত, কারণ আরবরা মুহাম্মদ (সা.) এর নবুওয়তের বছর শতেক পূর্ব হতেই এ অঞ্চলে বাণিজ্য করত। অতঃপর নবীজির (সা.) ইসলাম প্রচারের পর, আরবরা ইসলাম কবুল করে নিলে পরের মৌসুমে ব্যবসায়ীরা মুসলিম বেশে কেরালায় আগমন করল। তবে কবে এবং কীভাবে কেরালায় ইসলামের প্রচার শুরু হয়েছিল—এই বিষয়টি নিয়ে ইতিহাসবিদদের মধ্যে মতপার্থক্য রয়েছে। জয়নুদ্দীন মখদুম ছগির তার তাহফাতুল মুজাহিদীন গ্রন্থে লিখেন যে : “কেরালায় ইসলামের প্রচার নবুওয়াতের দ্বিতীয় শতাব্দীতে শুরু হয়েছিল বলে ধারণা করা হয়।”[2]زين الدين المخدوم الصغير، تحفة المجاهدين في أخبار البرتغاليين، ص. 29 ط. مكتبة الهدى كاليكوت 1996.
নবিজির জীবদ্দশায়ই যে ইসলাম কেরালায় প্রবেশ করেছিল সে ব্যাপারে আরও একটি প্রমাণ হচ্ছে, ইমাম হাকিমের আল-মুস্তাদরাক গ্রন্থে উল্লিখিত একটি হাদিস। এই হাদিসে আবু সাঈদ খুদরি (রা.) বর্ণনা করেন যে : “ভারতের রাজা রাসুলুল্লাহর (সা.) জন্য আদার আচার হাদিয়া পাঠালেন। রাসুলুল্লাহ (সা.) তা থেকে সাহাবিদের একটু একটু করে খাওয়ালেন এবং আমাকেও কিছুটা খেতে দিলেন।”[3]الحاكم، محمد بن عبدالله النيسابوري، المستدرك على الصحيحين رقم: 7190.
ইতিহাসের সাক্ষ্য অনুযায়ী, কেরালা ও আরবদের মধ্যে দীর্ঘদিন ধরে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ছিল। বাণিজ্যিক ও সাংস্কৃতিক আদান-প্রদান এবং ধর্মীয় প্রভাবের মাধ্যমে দুই অঞ্চলের মানুষদের মধ্যে গভীর বন্ধন স্থাপিত হয়। তাই স্থানীয়রা বাণিজ্য ও যোগাযোগের প্রয়োজনে আনুষ্ঠানিক-অনানুষ্ঠানিক সব উপায়ে এ আরবি ভাষা শিখতে শুরু করে। কেরালায় আরবি ভাষার প্রসারে ভুমিকায় ছিল নানা শ্রেণির মানুষজন। যেমন : কালিকটের কাজীগণ, মাখদুম পরিবার ও সামাস্থা জমিয়তে উলামায়ে কেরালা—কেরালায় আরবি ভাষার প্রসার-প্রতিষ্ঠায় তাঁদের ছিল বেশ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা।
মালেক বিন দীনার রহ. ও তাঁর সঙ্গীরা যখন ইসলাম প্রচারের উদ্দেশ্যে এই অঞ্চলে আসেন, কেরালায় তখন তারা অনেক মসজিদ নির্মাণ করেছিলেন। এর মধ্যে রয়েছে কাসারগড়, মাদাই, শালিম, কান্দালোর এবং কোল্লামের মসজিদ। এই মসজিদগুলো ছাড়াও আরও অনেক মসজিদ আরবি ভাষার সমৃদ্ধি, প্রসার এবং শিক্ষার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে গেছে।
যে-সকল প্রাচীনতম মসজিদে পাঠদান হতো
- তোতুংকুলি মসজিদ[4]Thottungal Mosque
: ফনান শহরে অবস্থিত এই মসজিদটি ওইসকল প্রাচীনতম মসজিদগুলোর মধ্যে একটি, যেখানে আরবিশিক্ষার দরস বসত। শেখ কুতুব ফরিদউদ্দিন, যিনি ৬৬৬ হিজরিতে মৃত্যুবরণ করেন[5] الأستاذ كي وي عبد الرحمن، نبذة من تاريخ مسلمي مليبار، ص. 23، ط. جماعة خدمة المسلمين في فنان 1998م. , তার পিতা শেখ ইজ্জুদ্দিন আজুধানি হিন্দির দ্বারা নির্মিত এই মসজিদটি কেরালায় আরবি শিক্ষার কেন্দ্র হিসেবে বেশ সুখ্যাতি অর্জন করেছিল। - সাহিল বারাকাহ আল-কুবরা মসজিদ[6]Valiya Kulangara Mosque
: তানুর শহরে অবস্থিত এই মসজিদকে বলা যায় শত শত পুরানো বইয়ের পাণ্ডুলিপিগার। এর মধ্যে সবচেয়ে পুরনো পাণ্ডুলিপি যেটা, সেটা হচ্ছে, শায়েখ আবু ইসহাক ইবরাহিম বিন আলি বিন ইউসুফ ফিরুজাবাদি সিরাজি রচিত “التنبيه في الفقه الشافعي”। পাণ্ডুলিপির মুখপৃষ্টায় লেখা : “এই বহি ৬৭৫ হিজরিতে ওয়াকফ করা হইয়াছিল, ওয়াকফকারী ছিলেন মুহাম্মদ বিন আবদুল্লাহ হাযরিমি, যিনি শাফি মাজহাবের ও কাদিরিয়া ধারার অনুসারী ছিলেন এবং আল-আযহার হইতে পড়াশোনা সম্পন্ন করিয়াছিলেন।” তারই নিচে লেখা : “তানুরের সাহিল আল-বারাকাহ আল-কুবরা মসজিদে মুদাররিস ও মুফতি পদে দায়িত্ব পালনকালে ফকির মুহাম্মদ বিন আবদুল্লাহ আল-হাযরিমি এই ওয়াকফনামা লেখেন।” - অন্যান্য মসজিদ : শালিম মসজিদ, মুচুন্ডি মসজিদ এবং কালিকট শহরের কুটি শেরা মসজিদেও নিয়মিত দরস অনুষ্ঠিত হতো। পরবর্তীতে, এই দরস ও পাঠদান কেরালা রাজ্যের আরও অনেক মসজিদে চালু হয়।
সেই মসজিদগুলিতে শত শত শিক্ষার্থী জ্ঞান অর্জনের জন্য আসত এবং নিযুক্ত উস্তাদদের কাছ থেকে শিক্ষা গ্রহণ করত। শিক্ষার্থীরা মসজিদেই অবস্থান করত এবং তাদের খানাপিনার এন্তেজাম মসজিদ-এলাকার বাসিন্দাদের বাড়ি থেকে করা হতো। পাঠ্যক্রমে ফিকহ, তফসির, হাদিস এবং আরবি ভাষাবিজ্ঞান তথা : নাহু-ছরফ বালাগাতসহ আরো অন্যান্য বিষয়ও অন্তর্ভুক্ত থাকত। ভাষা শিক্ষার ক্ষেত্রে নিম্নলিখিত বইগুলি পাঠ্যক্রমে অন্তর্ভুক্ত ছিল :
- ميزان
- الأجناس الصغرى
- الأجناس الكبرى
- التفسير العززى
- تقوية اللسان
- العوامل
- التحفة الوردية
- قطر الندى
ও এইরকম করে ألفية ابن مالك পর্যন্ত সব কেতাবই পড়ান হতো।[7]دائرة المعارف الإسلامية (مليالم)، دار النشر الإسلامي ج.1 ص. 534
উপরোক্ত তালিকা থেকে বোঝা যায় যে, নাহু-সরফ-বালাগাত ও ভাষা-সাহিত্যের বইগুলি এই পাঠ্যক্রমে কতটা গুরুত্ববহ অবস্থান রাখত।
কালিকটের কাজী সম্প্রদায়
কেরালায় ইসলাম আবির্ভাবের পর থেকে কালিকট অঞ্চলে কাজীদেরই ছিল সর্বোচ্চ ক্ষমতা। তাদের সিদ্ধান্তই চূড়ান্ত এবং সকলের জন্য মান্য মনে করা হতো।
পূর্ববর্তী কাজীদের মধ্যে প্রাচীনদের ইতিহাস আমরা তেমন কিছু জানতে পারি না। তবে, ফখরুদ্দিন উসমানের সময় থেকে কিছু কাজীদের ব্যাপারে আমরা তথ্য পাই । [8]محمد كويا، تاريخ مسلمي كاليكوت (مليالم)، ص. 143، ط. منشورات فوكس كاليكوت 2012م
মশহুর কাজীগণ :
- কাজী রমজান শালিয়াটি।
- কাজী ফখরুদ্দিন আবু বকর কালিকুটি, তিনি ছিলেন শেখ জয়নুদ্দিন মখদুম কাবিরের শিক্ষক; ছিলেন বিখ্যাত লেখক।
- কাজী মুহাম্মদ ইবনে আবদুল আজিজ, বিখ্যাত “মহিউদ্দিন মালা” কাসিদার রচয়িতা ।[9] শাইখ আব্দুর কাদের জিলানির উপর লেখা বিখ্যাত কাসিদা। (منظومة في مناقب الشيخ عبد القادر … Continue reading
- কাজী আবু বকর ছগির, তিনি “কাজী আবু বকর কুন্জ”[10] কুঞ্জ একটি মালায়েম শব্দ, যার অর্থ : ছোট। নামে পরিচিত।
- কাজী ফখরুদ্দিন আবু বকর, তিনি মসজিদশিক্ষার একটি বিশেষ শিক্ষাব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। এই ব্যবস্থাকে ‘সিলসিলায়ে ফখরিয়্যা’ নামে ডাকা হতো। সিলসিলায়ে ফখরিয়্যা কেরালায় আরবি ভাষা এবং ইসলামি উলুমের প্রসারে বিশেষ ভূমিকা পালন করেছিল।
কাজী মুহাম্মদ ইবনে আবদুল আজিজ আউওয়াল, তিনি নতুন প্রজন্মের জন্য আরবি ভাষা ও ব্যাকরণশিক্ষা বিষয়ক বেশকিছু বইয়ের উপর কাজ করেন। তার উল্লেখযোগ্য রচনার মধ্যে রয়েছে :
- نظم قطر الندى
- نظم الاجناس (‘আজনাস’ শেখ মুহাম্মদ লাব্বা ইবনে সাদাকা আল-কাহিরী রচিত একটি বিখ্যাত সরফ বিষয়ক কিতাব। মৃত্যু : ১১৩০ হিজরি)
- نظم العوامل (‘আওয়ামিল’ ইমাম আবদুল কাহের আল-জুরজানী রচিত গ্রন্থ। মৃত্যু : ৪৭১ হিজরি)।[11]محمد كويا، تاريخ مسلمي كاليكوت (مليالم)، ص. 146، ط. منشورات فوكس كاليكوت 2012م
কালিকট শহরের কুটি শেরা মসজিদকে কালিকট কাজীদের কেন্দ্র বলা হয়।
মাখদুম পরিবার
কেরালায় ইসলামের প্রচার-প্রসার, আরবী ভাষাশিক্ষা ও ইসলামী উলুমের চর্চায় যাদের সবচে প্রধান অবদান, তারা হলেন ঐতিহ্যবাহী মাখদুম পরিবার। এই পরিবারের পূর্বপুরুষ ছিলেন শাইখ আহমদ মা’আবরি আল-মাখদুম; তামিলনাড়ুর মাদুরাইয়ের দক্ষিণে অবস্থিত মা’বার বন্দর পাড়ি দিয়ে তিনি কেরালার কোচিন এলাকায় এসেছিলেন।
শায়েখ যাইনুদ্দিন আহমদের ছেলে ছিল শায়েখ আলী, আর পৌত্র ছিল যাইনুদ্দিন মাখদুম কাবির। এককালে যাইনুদ্দিন মাখদুম কাবির ফনান শহরে চলে যান ।[12]النليكوتي، محمد علي بن عبيد الله، أعيان مليالم (مليالم)، ص. 11،12 ط. مكتبة الإرشاد 1997م.
তখন থেকে ফনান শহর জ্ঞান-বিজ্ঞান ও শিল্প-সংস্কৃতির কেন্দ্রে পরিণত হয়, বিশেষ করে আরবি ভাষা ও সাহিত্যের জন্য। এবং ফানানকে ‘মক্কা-ই-মালবার’ বা ‘মালবারের মক্কা’ নামে ডাকা হতো, এবং ফলে দূর-দূরান্ত থেকে জ্ঞানাগ্রহীরা এখানে জ্ঞানের খোঁজে আসতে শুরু করে।
মাখদুম পরিবার অনেক অনেক পণ্ডিত ও জ্ঞানী মানুষের জন্ম দিয়েছে, যারা জ্ঞানের নানান শাখাপ্রশাখায় জ্ঞানের প্রসার ঘটিয়েছেন, একইভাবে আরবি ভাষাচর্চার খেদমতেও তারা সমুজ্জ্বল ইলমী কাজ আঞ্জাম দিয়েছেন।
মাখদুম পরিবারের উল্লেখযোগ্য কিছু কারনামা :
- যাইনুদ্দিন মাখদুম কাবির : তিনি আরবি ব্যাকরণ তথা নাহুশাস্ত্রে বেশ কিছু বইয়ের শরাহ ও ব্যাখ্যাগ্রন্থ রচনা করেন : ইবনে হাজিবের ‘কাফিয়া’র শরাহ লেখেন; উমর ইবনে আল-ওয়ারদির ‘তুহফাহ’ গ্রন্থের উপর লেখেন; এবং ইবনে মালিকের ‘আলফিয়া’রও তিনি শরাহ রচনা করেন (আলফিয়ার কাজ উনি সম্পূর্ণ করে যাওয়ার তৌফিক পাননি। পরে আব্দুল আজিজ মা’বারী তা পূর্ণ করেন)।[13] دائرة المعارف الإسلامية (مليالم)، دار النشر الإسلامي، ج.1 ص. 537.
- শায়েখ উসমান ইবনে জামালুদ্দিন (শাইখ যাইনুদ্দিন ইবনে আলীর শ্বশুর) : তিনি ইবনে হিশামের ‘কত্বরুন্নিদা’র শরাহ রচনা করেন।[14]পূর্বোক্ত
- শায়েখ আবদুল আজিজ মাখদুম আল-মা’বারী (মৃত্যু : ১৩২২) : তিনি সরফশাস্ত্রে ‘তাসরিফে আযযি’র উপর عمدة التعريف নামে পদ্য রচনা করেন এবং বালাগাত শাস্ত্রে البهجة السنية নামে বই লেখেন।[15]পূর্বোক্ত
- শায়েখ মুহাম্মদ ইবনে আলি আত-তুন্নামি (মৃত্যু : ১৩৪৩) : ‘শরহে তুহফাতু ইবনিল ওয়ারদি’র উপর একটি বিখ্যাত হাশিয়া লেখেন উনি, ১৩২২ হিজরিতে, এবং তা ১৩২৪ হি. সনে প্রকাশ পায় ফানান শহরের প্রাচীন منبع الهداية প্রকাশনী থেকে।[16] النليكوتي، محمد علي بن عبيد الله، أعيان مليالم (مليالم)، ص. 19، ط. مكتبة الإرشاد 1997م.
উপরের তথ্যগুলো মাখদুম পরিবারের আরবি ভাষাশিক্ষার প্রসার ও প্রতিষ্ঠায় তাদের অবদানের একটি ঝলক মাত্র। তাছাড়া ‘আলফিয়াতু ইবনে মালেক’, ‘তুহফাতু ইবনিল ওয়ারদি’ এসকল গ্রন্থের উপর তারা যে-সকল শরাহ ও ব্যাখ্যাগ্রন্থ রচনা করেছেন, সেগুলো কেরালার মসজিদে মসজিদে নিয়মিত দরসে পঠিত হতো এবং আজ অবদি সেগুলো পাঠ্যক্রমভুক্ত। কেরালায় ছাত্রছাত্রীদের আরবি ভাষাশিক্ষা ও কায়দাকানুন আত্মস্থ করতে এই বইগুলো বিরাট সহযোগী ভূমিকা পালন করে আসছে।
শালিয়াতি-পরবর্তী সময়
প্রাচীনকাল থেকেই কেরালার প্রতিটি মসজিদ ও ঘরে-ঘরে শিক্ষার উপস্থিতি ছিল। পরবর্তীতে, এ ঘরোয়া শিক্ষাব্যবস্থা বিশেষ নির্দিষ্ট ভবনে আর কিছুটা সংস্কার ও উন্নয়নে ‘মাদরাসা-ইশকুল’ ও ‘জামিয়া, কলেজ-ভার্সিটি’ নামে পরিচালিত হতে শুরু করে। এই নতুন পদ্ধতির প্রবর্তক ছিলেন শেখ আহমদ হাজি শালিয়াতি (মৃত্যু : ১৩৩৮ হি./১৯১৯ ঈ.)। তিনি শালিয়াত কুনজ আহমদ আল-হাজ্জ নামে মশহুর ছিলেন (মালায়ালাম ভাষায় কুনজ বলে ছোট বোঝানো হয়।) ঐতিহাসিকরা তখনকার দ্বীনি শিক্ষাব্যবস্থাকে দুই ভাগে ভাগ করেন : একটি হল শালিয়াতি-পূর্ব শিক্ষাধারা; আরেক হল শালিয়াতি-পরবর্তী শিক্ষাধারা। উনার শিক্ষা-সংস্কারমূলক খেদমতের ফলে পঠন-পাঠনের সিলসিলায় পরিবর্তন আসে এবং শিক্ষাখাতে নতুন সিস্টেম গ্রহণ করেও তিনি পূর্ববর্তী শিক্ষাপদ্ধতির মূল্যবোধ পাশাপাশি ধরে রাখেন। নতুন কারিকুলামে তিনি নাহু-সরফ-বালাগাত ও ভাষা সাহিত্যের অনেক কিতাব নেসাবভুক্ত করেন এবং নিজেও নাহু, সরফ ও আরবী ভাষাশিক্ষার উপর বই রচনা করেন।[17]النليكوتي، ص. 112
সামস্থ কেরালা জমিয়তে উলামা
কেরালার জনমুসলিম উলামা সমিতি, যা ‘সামস্থ কেরালা জমিয়তে উলামা’ নামে পরিচিত, ১৯২৬ সনের ২৬ জুন প্রতিষ্ঠিত হয়। সাইয়েদ আব্দুর রহমান বালাভী কোয়া তুঙ্গুলের রহ. হাতে এ সমিতি প্রতিষ্ঠা পায়। শেখ আহমদ মুসলিয়ার বানকি (মৃত্যু : ১৩৬৫ হিজরি) ও শেখ আবুল হক মুহাম্মদ আব্দুল বারি আল-ওয়ালক্কুলমি (মৃত্যু : ১৩৮৫ হিজরি) ছিলেন তাদের অন্তর্ভুক্ত, যারা এই সংগঠন প্রতিষ্ঠায় গুরুত্বপূর্ণ অংশীদার ছিলেন। ‘জমিয়তে উলামা’ কেরালার মুসলিম শিক্ষা-সংস্কৃতির উন্নতি ও অগ্রগতিতে বিরাট অবদান রেখেছে তখন, এবং এখনও নিয়ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে যাচ্ছে এ উলামা সংগঠন।[18]http://samastha.info/samstha/samastha.html
শায়েখ আহমদ মিসলিয়ার বানকি খুতুবাত ও তাসনিফাত উভয় সুরতে এ সংগঠনের জন্য দিনরাত নিরলস কাজ করেছেন। তিনি আল-বায়ান নামে একটি ইলমী ম্যাগাজিনও বের করেন, যা কয়েক বছর নিয়মিত জমিয়তে উলামার অধীনে প্রকাশিত হয়। কিন্তু মরহুমের ওয়াফাতের মধ্য দিয়ে ‘আল বায়ানে’র সমাপ্তি ঘটে। শায়েখ বানকি রচিত গ্রন্থের সংখ্যা প্রায় পঁচিশ। তাঁর বেশ কিছু ভাষা বিষয়ক বইও পাওয়া যায়, যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল :
- البيان الشافي في علم العروض والقوافي.
- نظم علاقة المجاز المرسل.
- إبراز المهمل شرح علاقة المرسل ইত্যাদি।[19]النليكوتي، ص.137-142
১৯৫১ সালে, জমিয়তে উলামায়ে কেরালার তত্ত্বাবধানে ‘‘সামস্থ কেরালা ইসলামী শিক্ষা কমিটি’’ (لجنة تعليم الدين الإسلامي لعموم كيرلا) নামে একটি বিশেষ শিক্ষা কমিটি গঠন করা হয়।[20]http://samastha.info/samstha/samastha.html আজও এ কমিটির অধীনে কেরালার ভেতরে ও বাহিরে হাজারো মাদরাসা পরিচালিত হচ্ছে। শিশুদের জন্য উপযোগী করে ফিকহ, আকিদা, নীতিশাস্ত্র, ইসলামী ইতিহাস ও আরবি ভাষাশিক্ষার একটি পরিশিলিত পাঠ্যক্রম তৈরি করা হয়। আরবি ভাষার উপর বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া হয় এবং প্রাথমিক থেকে উচ্চস্তর পর্যন্ত সমস্ত বিভাগে আরবি ভাষায় পাঠ্যপুস্তক প্রণয়ন করা হয়। এমনকি আরবী ভাষা শেখানোর জন্য লিসানুল কুরআন নামে ছাত্রদের জন্য স্বতন্ত্র সিরিজ রয়েছে, যা আরবি ভাষা শেখার, আরবি উসলুব ও তা’বির হৃদয়ঙ্গম করার ও তা সঠিকভাবে ব্যবহার করার মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের উত্তরোত্তর উন্নতি সাধনে সহায়তা করে। আর বলার বাকি থাকে না যে, এরূপ সুচারু পদ্ধতি শিক্ষার্থীদের আরবি ভাষার কাঠামো বুঝার ক্ষেত্রে কীরূপ ইতিবাচক ফলাফল দিয়ে থাকবে।
কুল্লিয়া ও জামিআ
কেরালায় শতাধিক ইসলামী ও সরকারী কলেজ রয়েছে যেখানে আরবি ভাষাচর্চার প্রসার ও উন্নতির জন্য প্রসংশনীয় উদ্যোগ গ্ৰহণ করা হয়। সরকারি কলেজগুলোতে আগ্রহী শিক্ষার্থীদের জন্য সকল স্তরে, প্রাথমিক থেকে উচ্চমাধ্যমিক পর্যন্ত, আরবি ভাষা অন্তর্ভুক্ত রয়েছে। অনেক কলেজ উচ্চশিক্ষা স্তরেও তাদের পাঠ্যক্রমে স্নাতক এবং মাস্টার্স ডিগ্রি পর্যায়ে আরবি ভাষা অন্তর্ভুক্ত করেছে। কিছু উল্লেখযোগ্য কলেজের নাম হচ্ছে :
- কাসারকোট সরকারি কলেজ
- ফারুক কলেজ, ফারুকনগর
- এমআইএস কলেজ, মানফাদ
- মহারাজা কলেজ, এনার্কুলাম
- ইউনিভার্সিটি কলেজ, ত্রিবান্দ্রম ইত্যাদি।[21] دائرة المعارف الإسلامية، دار النشر الإسلامي ج.1 ص. 535
১৯৭৪ সাল থেকে নিয়ে এ পর্যন্ত কালিকট বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অনেক গবেষক আরবি ভাষার উপর ডক্টরেট ডিগ্রি অর্জন করেছেন।[22]পূর্বোক্ত
অনেক ইসলামী কলেজ রয়েছে যেখানে প্রাথমিক স্তর থেকেই পুরোদমে আরবি ভাষা শেখানো হয়। যেমন উল্লেখযোগ্য কিছু ইসলামী কলেজ :
- নূরুল ইসলাম কলেজ
- আলওয়াফি কলেজ চেইন, ওলঞ্জেরি
- রহমানিয়া কলেজ, কদম্বুর
- দারুস সালাম, নেন্দি
তবে, সকল কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান ও কেন্দ্রে অবস্থান যার সেটা হলো, দারুল হিদায়া ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়।
দারুল হিদায়া ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়
দারুল হিদায়া ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় ১৯৮৬ সালে (১৪০৬ হিজরি) একটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয় এবং ২০০৯ সালের মে মাসে একটি বেসরকারি ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ে রূপান্তরিত হয়। বিশ্ববিদ্যালয়ের লক্ষ্য এমন ইসলামী পণ্ডিত ব্যক্তিত্ব তৈরি করা, যারা গত শতাব্দীর প্রতিভাবান আলেমদের রেখে যাওয়া বিশাল ইলমী তুরাস থেকে জ্ঞান অর্জন করতে সক্ষম হবে। এইখানের পাঠ্যক্রমে আরবি ভাষার প্রতি বিশেষ গুরুত্বারোপ করা হয় এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিটি স্তরে : মাধ্যমিক, উচ্চমাধ্যমিক, স্নাতোক, স্নাতকোত্তর—প্রতিটি স্তরে আরবিকে স্ববিশেষ গুরুত্বের সাথে চর্চা করা হয়। পাঠ্যক্রমে নাহু, ছরফ, বালাগাত, আরুজ, কাওয়াফি, ইনশা, তরজমা, তা’রিব, ‘আরবি সাহিত্যের ইতিহাস : জাহেলি যুগ থেকে রেনেসাঁ’ এবং সাহিত্য সমালোচনাসহ নানাবিধ আরবিশাস্ত্র সিলেবাসে অন্তর্ভুক্ত রয়েছে। সিলেবাসভুক্ত অধিকাংশ বই-ই আরবি ভাষায় রচিত, তাই ১২ বছরের দীর্ঘমেয়াদী অধ্যয়নকালে শিক্ষার্থীরা প্রাথমিক থেকে উচ্চমাধ্যমিক স্তরে যে সমস্ত বইপত্র অধ্যয়ন করে থাকে, সেগুলো যেমন :
- النحو الواضح
- القراءة الراشدة
- قصص النبيين
- القراءة الرشيدة
- البلاغة الواضحة
- الخلاصة الألفية ابن مالك (শরাশুরহত সহকারে) مختصر المعاني ও ইত্যাদি কেতাবসমূহ।
শিক্ষার্থীদের আরবিতে অধিক উন্নতির জন্য রয়েছে “ইনশা ও তরজমা” (Translation and Composition) সাবজেক্ট, যা আরবি ভাষায় অধিকতর উন্নতি ও অগ্রগতি সাধনকারী বেশ কতক গুরুত্ববহ শাখায় শিক্ষার্থীদের দক্ষতা হাছিলে মদদ করে, যথা : বাক্যগঠন ও তার অনুবাদ, ছোট গল্প ও প্রবন্ধের অনুবাদ, শিশুতোষ গল্প লেখা, প্রবন্ধ-নিবন্ধ রচনা করতে পারা, মুল টেক্সট পড়ে তার অর্থ ও মর্মোদ্ধার করতে পারা, আরবিতে কথা বলতে পারা, চিঠিপত্র ও পত্রিকা-ম্যাগাজিনের ভাষা আয়ত্ত করা ও তার অনুবাদ করতে সমর্থ হওয়া, আরবিতে অ্যাড দেয়া ও অ্যাডের অনুবাদ, সিভি তৈরি, মিডিয়া সাক্ষাৎকার ও প্রতিবেদন করতে পারা ইত্যাদি ইত্যাদি নানাবিধ অনুশীলন শিক্ষার্থীদের করানো হয়ে থাকে এই “ইনশা ও তরজমা” সাব্জেক্টের অধীনে। সিলেবাসে বেশ কিছু আরবি বই শিক্ষার্থীদের একান্ত মুতালাআ’র জন্য নির্ধারিত থাকে, সেগুলি শিক্ষার্থীরা শিক্ষকদের সাহায্য নিয়ে পড়ে থাকে এবং এ পাঠের উপর আবার পরিক্ষাও নেয়া হয়। একান্ত মুতালাআ’র কিছু বই, যেমন :
- ما لا عين رأت : মুহাম্মদ বিন আ’লাওয়ি আল-মালিকি আল-হাসানি।
- صور من حياة الصحابة : আব্দুর রহমান পাশা।
- الأجنحة المتكسرة : খলিল জাবরান।
- أميرة الجبل : নাজিব কিলানি।
- سلوى في مهب الريح : মাহমুদ তাইমুর।
- ماذا خسر العالم بانحطاط المسلمين : সাইয়িদ আবুল হাসান আলি নদবি৷
- ইত্যাদি।
আজহারীদের ভূমিকা
কেরালার অনেক আলেম-উলামা পড়াশোনার সুবাদে জামিআ আজহারে যান, সেখানে আরব সংস্কৃতির সাথে গভীরভাবে পরিচিত হন এবং অধ্যবসায় সহকারে ধ্রুপদি আরবি সাহিত্যের অনুশীলন করেন, অতঃপর তারা দেশে আরবিচর্চার ময়দানে বিপুল পরিমাণ খেদমত আঞ্জাম দেন। ফারুকনগরে “রওযাতুল উলুম আল-আ’রাবিয়্যা কলেজে”র প্রতিষ্ঠাতা আবু সাবাহ আহমদ মৌলভী, সাইয়িদ আব্দুর রহমান আইদ্রুসি ও ডক্টর মুহিউদ্দিন আলওয়াই—এনারা হলেন কেরালার উল্লেখযোগ্য আলোচিত আজহারী ব্যক্তিত্ব।
ডক্টর মুহিউদ্দিন আলওয়াই “القضايا الإنسانية” ও أدب الهند المعاصر (হিন্দের আধুনিক সাহিত্য), “الدعوة الإسلامية وتطورها في شبه القارة الهندية” (ভারতীয় উপমহাদেশে ইসলামী দাওয়াহ এবং তার ক্রমবিকাশ) সহ বেশ কতক গ্রন্থ রচনা করেছেন। সাইয়িদ আব্দুর রহমান আইদ্রুসি, তিনি লিবিয়া এবং সৌদি আরবে অধ্যাপনা করেছেন, লিখেছেন “العرب والعربية” ও “تاريخ النحو و تطورها” (নাহুশাস্ত্রের ইতিহাস ও তার বিকাশ) ছাড়াও মূল্যবান মূল্যবান গ্রন্থ।[23] دائرة المعارف الإسلامية، ج.1 ص. 539
পত্রিকা-ম্যাগাজিনের ভূমিকা
বিশ্ববিদ্যালয় ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠান থেকে প্রকাশিত আরবি ম্যাগাজিনগুলি আরবি ভাষা শেখা ও তার প্রসারে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। এই ম্যাগাজিনগুলি শিক্ষার্থীদেরকে তাদের আরবি ভাষাদক্ষতা বাড়াতে এবং আরব সংস্কৃতি সম্পর্কে জ্ঞান অর্জন করতে সহযোগিতা করে। পর্যবেক্ষণ থেকে জান যায় যে, এসকল পত্রিকা-ম্যাগাজিন কেরালার আরবি বিশ্ববিদ্যালয়গুলো থেকে প্রকাশিত প্রবন্ধ-নিবন্ধের সংকলন হতো। আল-হিদায়া দারুল হিদায়া ইসলামিয়্যার শিক্ষার্থীদের দ্বারা প্রকাশিত তেমনই একটি মাসিক পত্রিকা, যার উদ্দেশ্য লেখালেখির ময়দানে শিক্ষার্থীদের হাতকে দক্ষ, মজবুত ও পরিপক্ব করে তোলা। কেরালায় আরবি পত্রিকার ইতিহাস বিংশ শতাব্দীর মধ্যভাগ থেকে শুরু হয়। কেরালায় সর্বপ্রথম যে আরবি পত্রিকা প্রকাশ পায় তার নাম “বুশরা”, ১৯৬৩ সালে এটা প্রকাশ করেন মওলবি মুহাম্মদ। কিন্তু আফসোসের বিষয়, ‘বুশরা’ মাত্র এক বছর প্রকাশিত হয় এবং পরের বছর ১৯৬৪ সালে বন্ধ হয়ে যায়। তবে মজার বিষয় হলো, তিন বছর পর ১৯৬৭ সালে, কেরালার শিক্ষক কমিটির উদ্যোগে ‘বুশরা’ আরবি পত্রিকাটি আবারো বের হওয়া শুরু হয়। কেরালা আরবি প্রবন্ধকার পর্ষদ কর্তৃক ১৯৭২ সালে ‘‘আল-হুদা” নামে আরেকটি আরবি পত্রিকা প্রকাশ পায়। প্রাচীন আরবি পত্রিকার মধ্যে ১৯৯৬ সালের অক্টোবর প্রকাশিত “আস-সাকাফাহ”, ২০০৪ সালে “আর-রাইহান’’ ও ২০০৫ সালে প্রকাশিত “আস-সালাহ” অন্যতম কিছু আরবি পত্রিকা।[24]পূর্বোক্ত তারপর ২০০৬ সালে আরো চমৎকার কিছু আরবি পত্রিকা বের হয় : শান্তাপুর জামিয়া ইসলামিয়া থেকে প্রকাশ পায় “আল-জামিআ” পত্রিকা; পারপুরের “সাবিলুল হিদায়া” কলেজের ছাত্রসংগঠন ‘আল হিদায়া স্টুডেন্টস অ্যাসোসিয়েশন’ কর্তৃক পত্রিকা প্রকাশ পায় “আন-নাহদা”; ৭ বছর পূর্তির পর ২০১৩ সালের ৯ নবেম্বর আনা-নাহদা ISSN নম্বর ISSN2319-8060 অর্জন করে। ‘আন-নাহদা’ পত্রিকা তার ইসলামী সংস্কৃতি ও ঈমানী দাওয়াতের চর্চার ফলে খুবই অল্প সময়ে গুণিজনদের মনোযোগ ও সুদৃষ্টি লাভ করতে সমর্থ হয়। কোরআন, হাদিস, ফিকহ, ইতহাস, সাক্ষাৎকার, সমালোচনা, চিন্তাপ্রস্তাব ও পর্যালোচনা, সংবাদ প্রতিবেদন—প্রতিটি বিষয়ের জন্য আন-নাহদায় আলাদা ও স্বতন্ত্র পাতা বরাদ্দ থাকে এবং বাচ্চাদের জন্য শিশুপাতায় থাকে উপদেশমূলক গল্প, রহস্যধাঁধা, প্রবাদ-উক্তি ও আরবী সাহিত্যছটা। আন-নাহদা ছিল পাঠকদের চক্ষুশীতলকারী পত্রিকা, পাঠক আন-নাহদা হাতে নিলে পাতার পর পাতা পড়ে যেতে বাধ্য হতো। এত সব বৈশিষ্ট্য ও গুণাগুণ আন-নাহদাকে অন্যান্য দেশি-বিদেশি খ্যাতিমান প্রতিষ্ঠিত পত্রিকাগুলোর মধ্যে বিশেষ পরিচিতি ও অবস্থান দান করেছিল। ২০১২ ঈ. ১৯ নভেম্বর সাইয়্যিদ মুনাওয়ার আলি শিহাব ‘আন-নাহদা’র সাধারণ সম্পাক হিসাবে দায়িত্ব গ্রহণ করেন। (বর্তমানে নাহদা স্বতন্ত্র আকারে শিশুতোষ আরবি ম্যাগাজিন বের করা শুরু করেছে النهضة الصغيرة للأطفال নামে।)
কেরালার প্রসিদ্ধ আরবি পত্রিকার কাতারে আরো আছে। যেমন, কালিকট বিশ্ববিদ্যালয়ের আরবি ভাষা বিভাগ কর্তৃক প্রকাশিত মাজাল্লাতু কালিকুত (কালিকট পত্রিকা), ত্রিবান্দ্রমের কেরালা বিশ্ববিদ্যালয়ের কলেজ অফ আর্টস অ্যান্ড সায়েন্সের আরবি বিভাগ কর্তৃক প্রকাশিত মাজাল্লাতুল আ’সিমা এবং কান্নুর জেলার কান্নাদি ফারমবায় অবস্থিত দারুল হাসানাত কর্তৃক আল-মাদাদ। আল-আ’সিমা পত্রিকা ১৪৩০ হি. জিলকদ/ ২০০৯ ঈ. নভেম্বরে তার যাত্রা শুরু করে; এর প্রধান সম্পাদক হচ্ছেন উস্তাদ যাইনুদ্দিন আর এটি একটি বার্ষিক আরবি সাহিত্যিক গবেষণা ম্যাগাজিন, যা আরবি ভাষা, সাহিত্য-সমালোচনা ও তার চর্চার প্রসার-প্রসারণা সম্পর্কে মূল্যবান আর্টিকেল প্রকাশ করে থাকে। এই পত্রিকা-ম্যাগাজিনগুলি আরবি ভাষা ও সাহিত্যের ক্ষেত্রে গবেষণাকে উৎসাহিত করে, মুসলমানদের মধ্যে ইসলামী মূল্যবোধ টিকিয়ে রাখতে সহায়তা করে এবং ইংরেজির বিশ্বব্যাপী প্রসারের প্রেক্ষাপটে, এই পত্রিকা-ম্যাগাজিনগুলি আগামী প্রজন্মের কাছে আরবি ভাষা সংরক্ষণ ও ছড়িয়ে দেওয়ার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।

কেরালার সাম্প্রতিক সক্রিয়তম আধুনিক আরবি পত্রিকা— النهضة

কেরালার সাম্প্রতিক সক্রিয়তম আধুনিক আরবি পত্রিকা— النهضة

‘নাহদা’র কালারপ্রিন্ট শিশুতোষ কাগজ— النهضة الصغيرة للأطفال

কেরালা ইউনিভার্সিটির ডিপার্টমেন্ট অফ এরাবিক থেকে প্রকাশিত একটি মাসিক একাডেমিক রিসার্চ জার্নাল—مجلة كيرالا । এটি তার মে মাসের সংখ্যা।

একটি বার্ষিক পিয়ার-রিভিউড গবেষণা জার্নাল—مجلة العاصمة

ইউনিভার্সিটি কলেজ অফ কালিকটের অফিশিয়াল ম্যাগাজিন—مجلة كاليكوت, এটিও একটি বার্ষিক পিয়ার-রিভিউড গবেষণা জার্নাল
কবিদের ভূমিকা
কেরালার অনেক সাহিত্যিক পণ্ডিত তাদের কাব্যিক রুচি দিয়ে আরবি ভাষার সেবা করেছেন। তারা মাহাত্ম্য, স্তুতিগাথা, শোকবহতা ও জন্মদিবসের উপর অনেক কাব্য রচনা করেছেন। তাদের মধ্যে সবচেয়ে বিখ্যাত হচ্ছেন, প্রথম এবং দ্বিতীয় মখদুমের পর : কাজী মুহাম্মদ ইবনে আব্দুল আজিজ, কাজী ওমর বালানকুটি, কাজী মুহিউদ্দিন কালিকটি, শায়েখ আব্দুল কাদের ফাদফারী, শায়েখ মুহাম্মদ আবুল কামাল কাদিরী, শেখ আহমদ আশ-শারানী, মুহাম্মদ ফালাকি আল-জামালী, আবু লাইলা মুহাম্মদ ইবনে মিরান এবং শায়েখ আব্দুর রহমান আল-আরিকলি (আল্লাহ তাদের প্রতি দয়া করুন।) এবং সমসাময়িক কবিদের মাঝে আরবি কবিতায় উল্লেখযোগ্যদের মধ্যে রয়েছেন, শেখ আনোয়ার আব্দুল্লাহ ফাদফারী এবং ফাযিল আলোয়ী কুটি আল-কুতুরী ইত্যাদি কবি গুণিজন। কেরালার কবিদের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ এবং বিখ্যাত রচনাগুলির কাব্যশিল্পে রয়েছে, শেখ আব্দুল কাদের ইবনে ইউসুফ ফাদফারীর “جواهر الأشعار” কাব্যগ্রন্থ, যাতে তিনি অসাধারণ ও উপভোগ্য সকল কবিতার সংকলন করেছেন। বিখ্যাত কাসিদার মধ্যে রয়েছে, “هداية الأذكياء” এবং تحريض أهل الإيمان على جهاد عبدة الصلبان—উভয় কেতাব শায়েখ যাইনুদ্দিন মাখদুম প্রথমের রচিত, রয়েছে “صلة الإله” ও “نفائس الدرر“—কাজী ওমর বালানকুটির রচিত কাব্যগ্রন্থ এবং আরো রয়েছে ”الفتح المبين“ কাজী মুহাম্মদ ইবনে আব্দুল আজিজ কালিকুটি রচিত বিখ্যাত কাব্যগ্রন্থ।[25] محمد ضياء الدين الفيضي، خدمات علماء كيرلا لنشر اللغة العربية، مجلة المداد، فبراير 2013م. ص. 45
শিক্ষাখাতে প্রযুক্তির ব্যবহার
আমাদের বর্তমান যুগ শিক্ষাক্ষেত্রে এক অভাবনীয় পরিবর্তনের সাক্ষী হচ্ছে। ইন্টারনেট এখন জ্ঞান-বিজ্ঞানের একটি অবিচ্ছেদ্য উৎস, যা তালিম-তাআল্লুমের জগতে নতুন সম্ভাবনার দ্বার উন্মোচন করেছে। বিজ্ঞানের অভাবনীয় অগ্রগতির ফলে, একটি ছোট্ট ডিস্কেও হাজার হাজার বইপত্র মজুদ রাখা সম্ভব হচ্ছে এবং অতি সহজেই আমরা তথ্যানুসন্ধান ও রিসার্চ করতে পারছি; একজন শিক্ষক সল্প সময়ের ভেতর তার সাব্জেক্টের নানাবিষয়ে জানতে পারছেন। তাছাড়া ইন্টারনেটে এমন শতশত সাইট রয়েছে, যেখানে হাজার হাজার পিডিএফ বই বিদ্যমান।
- المكتبة الوقفية للكتب المصورة
- مكتبة المصطفى الالكترونية
- شبكة مشكاة الإسلامية ইত্যাদি।
শুধু তাই নয়, একজন শিক্ষার্থী চাইলে ভিডিয়ো কনফারেন্সিং প্রযুক্তির মাধ্যমে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের বিখ্যাত পণ্ডিতদের সাথে সরাসরি ভিডিয়োতে যুক্তও হতে পারে।
শিক্ষাক্ষেত্রে প্রযুক্তির গুরুত্ব উপলব্ধি করে কেরালার বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়, যার মধ্যে রয়েছে পূর্বোল্লিখিত দারুল হুদা আল-ইসলামিয়া, ডিজিটাল লাইব্রেরি (Digital library) প্রতিষ্ঠা করেছে। এই ডিজিটাল লাইব্রেরিগুলি একজন আদর্শ শিক্ষার্থী তৈরিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে, যার ফলে শিক্ষার্থী জ্ঞানের নতুন দিগন্ত অন্বেষণ করতে পারে।
এই ডিজিটাল লাইব্রেরিগুলি শিক্ষার্থীদের তাদের ভাষাদক্ষতা উন্নত করতেও সহায়তা করে। এর সাহায্যে তারা ইলেকট্রনিক ম্যাগাজিন পড়তে পারে ও বিশ্বের বিখ্যাত গুণিজনদের সাথে কানেক্ট হতে পারে, দৈনন্দিন বিশ্বের পরিস্থিতির খবরাখবর জানতে পারে ও নিয়মিত দৈনিক পত্রিকা পড়তে পারে। আর এসবের মধ্য দিয়ে সে নিজের ভাষা-দক্ষতাকে আরো মজবুত ও শক্তিশালী করতে সক্ষম হয়, তার আরবি ভাষাচর্চার পথ দৃঢ়তার সাথে অগ্রসর হয়।
উপসংহার
অনেক জমানা পূর্ব থেকেই ভারতের এই সমুদ্রউপকূলীয় রাজ্য ও অঞ্চলগুলোতে আরবদের যাতায়াত ও মিশ্রণের ফলে আরবী জ্ঞানচর্চার দুয়ার খুব দ্রুত গতিতে বিকাশ লাভ করেছিল। তাই কেরালা, মালবার, কালিকট, বিহার এসকল স্থানে আরবি ভাষা কালেকালে চর্চার ভেতর দিয়ে বর্তমান সময়ে এসে একটা মোটামুটি ভালোরকমের পরিশিলিত ও কাঠামোবদ্ধ প্রাতিষ্ঠানিক রূপে দাঁড়িয়েছে। ছেলে-মেয়ে উভয়ের মাঝে আরবি ভাষার চর্চাও এখানে সমানধারায় বহিত ও সমানমাত্রায় ব্যবস্থাপিত দেখা যায়। প্রাচীন আরবি ও আধুনিক আরবি উভয়ের মাঝে চর্চাগত সিস্টেমিক যোগসূত্র তৈরিতে কেরালার বিশ্ববিদ্যালয় ও শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের সম্মিলিত প্রসংশাযোগ্য মেহনত ও উদ্যোগ কেরালায় আরবি ভাষাচর্চার পরিবেশে আরো উন্নতি ও অগ্রগতি আনবে এবং কেরালার জ্ঞানচর্চার ইতিহাসকে আরো সমৃদ্ধ ও উজ্জ্বল করবে বলে আশা করি। ইনশাআল্লাহ।
তথ্যসূত্র:
↑1 | القسطلاني، أحمد بن محمد، المواهب اللدنية بالمنح المحمدية الجزء 2 ص. 238 ط. المكتب الإسلامي 1425هـ |
---|---|
↑2 | زين الدين المخدوم الصغير، تحفة المجاهدين في أخبار البرتغاليين، ص. 29 ط. مكتبة الهدى كاليكوت 1996. |
↑3 | الحاكم، محمد بن عبدالله النيسابوري، المستدرك على الصحيحين رقم: 7190. |
↑4 | Thottungal Mosque |
↑5 | الأستاذ كي وي عبد الرحمن، نبذة من تاريخ مسلمي مليبار، ص. 23، ط. جماعة خدمة المسلمين في فنان 1998م. |
↑6 | Valiya Kulangara Mosque |
↑7 | دائرة المعارف الإسلامية (مليالم)، دار النشر الإسلامي ج.1 ص. 534 |
↑8 | محمد كويا، تاريخ مسلمي كاليكوت (مليالم)، ص. 143، ط. منشورات فوكس كاليكوت 2012م |
↑9 | শাইখ আব্দুর কাদের জিলানির উপর লেখা বিখ্যাত কাসিদা। (منظومة في مناقب الشيخ عبد القادر الجيلاني في لغة عربي مليالم) |
↑10 | কুঞ্জ একটি মালায়েম শব্দ, যার অর্থ : ছোট। |
↑11 | محمد كويا، تاريخ مسلمي كاليكوت (مليالم)، ص. 146، ط. منشورات فوكس كاليكوت 2012م |
↑12 | النليكوتي، محمد علي بن عبيد الله، أعيان مليالم (مليالم)، ص. 11،12 ط. مكتبة الإرشاد 1997م. |
↑13 | دائرة المعارف الإسلامية (مليالم)، دار النشر الإسلامي، ج.1 ص. 537. |
↑14, ↑15, ↑22, ↑24 | পূর্বোক্ত |
↑16 | النليكوتي، محمد علي بن عبيد الله، أعيان مليالم (مليالم)، ص. 19، ط. مكتبة الإرشاد 1997م. |
↑17 | النليكوتي، ص. 112 |
↑18, ↑20 | http://samastha.info/samstha/samastha.html |
↑19 | النليكوتي، ص.137-142 |
↑21 | دائرة المعارف الإسلامية، دار النشر الإسلامي ج.1 ص. 535 |
↑23 | دائرة المعارف الإسلامية، ج.1 ص. 539 |
↑25 | محمد ضياء الدين الفيضي، خدمات علماء كيرلا لنشر اللغة العربية، مجلة المداد، فبراير 2013م. ص. 45 |