জায়নবাদ : ইতিহাস ও মতাদর্শ (প্রথম পর্ব)

সারোয়ার তুষার

[1]হিব্রু বাইবেলে এরেৎজ ইজরায়েল (Land of Israel) এবং জেরুজালেম— দুই অর্থেই ‘জায়ন’ … Continue readingLike all nationalisms, Zionism is founded on a binary of self and others for its identitarian project. What is noteworthy in this regard is how it is the anti-Semite, not the Jew, who constitutes the self for Zionism, with the Jew being the other against whom the new self must be based. In internalising anti-semitic subjectivity, Zionism adopts its epistemology lock, stock and barrel, thus seeing the Jew as everything the new Zionist identity is not.

— Joseph Massad[2]Joseph Massad, The Persistence of the Palestinian Question, p.177

 

 

ধর্মতাত্ত্বিক প্রেক্ষাপট 

ইহুদি আখেরিতত্ত্ব মোতাবেক মানব ইতিহাস শুভ ও অশুভর কুরুক্ষেত্র। মসিহার আগমনের মধ্য দিয়ে এই যুদ্ধের চূড়ান্ত অবসান ঘটবে। মসিহার আগমন ইতিহাসেরও পরিসমাপ্তি ঘটাবে। একজন সাচ্চা ঈমানদার ইহুদির কর্তব্য হচ্ছে মসিহার আগমনের প্রতীক্ষায় দিন গুজরান করা। এই আখেরিতত্ত্ব মোতাবেক সামাজিক ও রাজনৈতিক সংকট নিরসনে সক্রিয় হওয়ার সুযোগ ইহুদিদের নাই। যে ধরনের রাজনৈতিক বন্দোবস্তের অধীনেই তারা থাকুক না কেন, নির্বিকার থাকাই সংখ্যালঘু ও ধর্মপ্রাণ ইহুদিদের জন্য বেহতর। ইহজাগতিক প্রশ্নে চূড়ান্ত নির্লিপ্তি ইহুদি ধর্মতত্ত্বের কেন্দ্রীয় বিষয়। সংখ্যাগরিষ্ঠ খ্রিস্টান সমাজের জুলুম নির্যাতনের প্রতিক্রিয়ায় মসিহা আগমনের নিষ্ক্রিয় প্রতীক্ষা ও প্রার্থনাই ছিল রেওয়াজ।[3]Benjamin Beit-Hallahmi, Original Sins: Reflections on the History of Zionism and Israel, London: Pluto Press, 1992

সকল কালের সকল সমাজেই ভিনদেশী অপরের প্রতি ঘৃণা-বিদ্বেষ কমবেশি লক্ষ করা যায়। কিন্তু ইউরোপের ‘ইহুদি সমস্যা’ তথা ইহুদি ঘৃণার গোড়া খুঁজতে গেলে বেশ তাজ্জব হতে হয়। কারণ ইউরোপে ইহুদিরা সেই অর্থে ভিনদেশি কিংবা অচেনা সম্প্রদায় ছিল না। রোমান সাম্রাজ্যের সময় থেকেই ইহুদিরা ইউরোপীয় সমাজের অবিচ্ছেদ্য অংশ। মধ্যযুগের মধ্য ও পশ্চিম ইউরোপের প্রায় সর্বত্র ইহুদিদের বিচরণ ছিল। তথাপি, পশ্চিমা সমাজে ইহুদিরা ছিল অপরের প্রতিরূপ (figure of the other)। সকল ধরনের অপরের প্রতি ঘৃণা ও অবজ্ঞার বহিঃপ্রকাশ ইহুদি প্রতিরূপের মাধ্যমে ঘটত।[4]Ivan Marcus, “Jews and Christians Imagining the Other in Medieval Europe.” Prooftexts 15, no. 3 (1995): 209–26. http://www.jstor.org/stable/20689425.

ইহুদি ও খ্রিস্টান ধর্মের সম্পর্ক বেশ অম্লমধুর। খ্রিস্টান ধর্ম নিজেকে একইসাথে ইহুদি ধর্মের ধারাবাহিকতা এবং শ্রেষ্ঠতর জ্ঞান করে এসেছে। খ্রিস্ট ধর্মতত্ত্ব মোতাবেক খ্রিস্টানরা খোদার সাথে সম্বন্ধ নির্ণয়ের ক্ষেত্রে পুরানা চুক্তি পেরিয়ে এসেছে। চার্চের মাধ্যমে খ্রিস্টানদের সাথে খোদার নতুন ধরনের সম্বন্ধ স্থাপিত হয়েছে।[5]Benjamin Beit-Hallahmi, Original Sins যিশুখ্রিস্টকে প্রত্যাখ্যানের মাধ্যমে ইহুদিরা তাদের জন্মগত বিশেষাধিকার খুইয়েছে, কাজেই খ্রিস্টানরাই খোদায়ি মনোনয়নের প্রকৃত উত্তরাধিকার।[6]প্রাগুক্ত গসপেলের বাণীকে অবজ্ঞা করে এবং যিশুখ্রিস্টকে শূলে চড়ানোর মাধ্যমে ইহুদিরা গর্হিত পাপাচারে লিপ্ত।[7]ইহুদিরাই যীশু খ্রিস্টের হত্যাকারী—এর সপক্ষে কোনো শক্ত প্রমাণ নাই; বরং … Continue reading তাদেরকে পৃথিবীতে টিকে থাকতে দেয়ার একমাত্র কারণ হচ্ছে ক্ষণে ক্ষণে তাদের প্রাপ্য শাস্তির কথা স্মরণ করিয়ে দেয়া। খ্রিস্টান ধর্ম গ্রহণ করার আগ পর্যন্ত যিশুর বাণী প্রত্যাখ্যানকারীদের অনন্ত ঘৃণা, অবজ্ঞা ও শাস্তির মধ্যেই দিনাতিপাত করতে হবে।[8] Benjamin Beit-Hallahmi, Original Sins

পশ্চিমা চৈতন্যে ‘ইহুদি প্রশ্নের’ অস্তিত্ব খ্রিস্টীয় ধর্মতাত্ত্বিক দীক্ষার সমসাময়িক। এমনকি বাস্তব জীবনে ইহুদি হাজিরার পূর্বেই চৈতন্যগত ‘ইহুদি’ পশ্চিমা মানসে বরাবর জাগরূক থেকেছে। নিউ টেস্টামেন্টে ইহুদিদের সত্য ও নাজাতের দুশমন হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। ফলে বাস্তবের ইহুদিদের মন্দের প্রতিরূপ সাব্যস্ত করাটা খ্রিস্টান সমাজে আহামরি কোনো ব্যাপার ছিল না। নিউ টেস্টামেন্টে বর্ণিত যিশুর জন্ম ও মৃত্যুর উপাখ্যান মধ্যযুগ থেকে আধুনিকতার ঊষালগ্নে ইউরোপ ও আমেরিকার নাটক, গান, গল্পে বারবার পুনরুৎপাদিত হয়েছে। ইহুদিরা খ্রিস্টধর্মের বাণীকে প্রত্যাখান করার মাধ্যমে নিজেদের ভাগ্যে দুর্ভোগ লিখিয়ে নিয়েছে। ইহুদিদের প্রতি খ্রিস্টান সমাজের এই মনোভাব এতটাই স্বাভাবিক ও ন্যায্য ধরে নেয়া হয়েছে যে এমনকি জেমস জয়েসের উপন্যাসের চরিত্রকেও বলতে শোনা যায় : “They sinned against the light… and you can see the darkness in their eyes. And that is why they are wanderers on the earth to this day.”[9]James Joyce, Ulysses, New York, Random House, 2002

নিজ কর্মদোষেই যেন ইহুদিদের করুণ পরিণতি। এই ধারণা থেকে এমনকি খ্রিস্টান সমাজের উদার অংশও পুরোপুরি মুক্ত ছিল না। জার্মান পুরোহিত মার্টিন নিম্যোলারের হিটলার বিরোধিতা পৃথিবীব্যাপী সুবিদিত। তিনি পর্যন্ত মনে করতেন যিশুখ্রিস্টকে ক্রুশবিদ্ধ করার পাপের বোঝা ইহুদিরা তাদের রক্তে বংশ পরম্পরায় বহন করে চলেছে : “… as a fearsome burden the unforgiven blood-guilt of their fathers.”[10]উদ্ধৃত, J.S. Conway, “Protestant Missions to the Jews 1810-1980: Ecclesiastical imperialism or theological aberration?”, Holocaust and Genocide Studies 1(1):127–146. … Continue reading

আদি-আধুনিক পর্বের ইহুদি বিদ্বেষ ও নিধন

১৩৪৮ সালের ব্ল্যাক ডেথ মহামারির পরে ইহুদিরা রাইন উপত্যাকা থেকে পূর্ব ইউরোপে (বিশেষত পোল্যান্ড ও ইউক্রেন) হিজরত করে। এই মহামারিতে ইউরোপের এক-তৃতীয়াংশ জনগোষ্ঠী নিহত হয়।[11]Black Death Pandemic, Encyclopedia Britannica, https://www.britannica.com/event/Black-Death মহামারি ও ব্যাপক প্রাণহানীর জন্য ইহুদিদের দায়ী করা হয়। ইউরোপের আধুনিক জমানায় রূপান্তর নতুন করে ইহুদি ঘৃণার জন্ম দেয়। ১৪৯২ সাল একদিকে ছিল ইউরোপের নতুন যুগের যাত্রাবিন্দু; অন্যদিকে, ইহুদিদের সামষ্টিক জীবনে, এই সাল নতুন বিপর্যয় ডেকে আনে। সে বছরের ৩১ মার্চ স্পেন থেকে আড়াই লক্ষ ইহুদি বিতাড়িত হয়।[12]ক্রিস্টোফার কলম্বাস তার ডায়েরিতে লিখেছেন: “In the same month in which their Majesties [Ferdinand and Isabella] issued the … Continue reading বিতাড়নের পূর্বে স্পেনে ইহুদিদের অন্তত এক হাজার বছরের ইতিহাস ও ঐতিহ্য ছিল। হয় খ্রিস্টধর্মে ধর্মান্তরিত হতে হবে, অথবা স্পেন ছাড়তে হবে—এমন পরিস্থিতিতে ইহুদিরা স্পেন ত্যাগই বেছে নেয়। ১৫১৬ থেকে ১৫৭১ সালের মধ্যে ভেনিস, রোম ও ফ্লোরেন্সে আনুষ্ঠানিকভাবে ইহুদি ঘেটো নির্মিত হয়।[13]Joel J. Levy/ Center For Jewish History, “What Life Was Like in the World’s First Ghetto”, Time Magazine, NOVEMBER 2, 2016, https://time.com/4551523/venice-ghetto-history/

মধ্য ও আধুনিক যুগের শুরুতে ইউরোপে ইহুদিদের অত্যন্ত প্রতিকূল পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে যেতে হয়েছে। এ সময়ে তারা কায়মনোবাক্যে রুহানি মুক্তির উপায় সন্ধান করেছে। প্রাত্যহিক প্রার্থনায় জেরুজালেমে ফিরে যাওয়ার মনোবাঞ্ছা প্রকাশ করেছে। পরের বছর যেন একে অপরের সাথে জেরুজালেমে কাটাতে পারে সেই প্রার্থনা করেছে।[14]সে সময় ইহুদিরা প্রার্থনা করার সময় একে অপরের প্রতি বলতেন, “Next year in Jerusalem!”। তবে … Continue reading

 কিন্তু এই প্রার্থনা কখনোই কোনো বাস্তব কর্মসূচিতে পরিণত হয়নি। রুহানি প্রার্থনা হিসেবেই বিরাজমান থেকেছে। ১৫২৪ সালে ডেভিড হ্যারিউভেনি (David Hareuveni) নামি একজন রহস্যময় ব্যক্তি সপ্তম ক্যাথলিক চার্চের প্রধান পোপ ক্লিমেন্টের দ্বারস্থ হন এবং অটোমানদের উৎখাতপূর্বক পবিত্র ভূমি দখল করার প্রস্তাব পেশ করেন। পোপের কাছে এই উদ্ভট প্রস্তাবের তেমন একটা আবেদন ছিল না। হ্যারিউভেনি সলোমন মলখো (Solomon Molcho) নাম্নী আরেক পর্তুগিজ রহস্যবাদীর যোগসাজশে রোমান সম্রাট পঞ্চম চার্লসের কাছে একই প্রস্তাব পেশ করেন। সম্রাট দুজনকেই গ্রেফতার করেন। মলখোকে পুড়িয়ে মেরে ফেলা হয় এবং এক পর্যায়ে হ্যারিউভেনির আর কোনো হদিস পাওয়া যায়নি।[15]Moti Benmelech, “History, Politics, and Messianism: David Ha-Reuveni’s Origin and Mission.” AJS Review 35, no. 1 (2011): 35–60. http://www.jstor.org/stable/41310648.

ইহুদিদের মধ্যে কে বা কোনো গোষ্ঠী সর্বপ্রথম ফিলিস্তিনে স্বতন্ত্র ইহুদি আবাসভূমির কথা তুলেছিল এ নিয়ে বেশ কিছু মতামত চালু আছে। তবে ধারণা করা হয় প্রাগের অর্থডক্স রাব্বি লিভা (১৫২৫-১৬০৯) প্রথম ফিলিস্তিনে ইহুদি পুনর্বাসনের দাবি তোলেন। তখনো ‘ইহুদি রাষ্ট্র’ ধারণার জন্ম হয়নি। তবে এ কথা ঠিক যে, স্বতন্ত্র জনগোষ্ঠী হিসেবে পূর্ণতা লাভের অংশ হিসেবেই রাব্বি লিভা ফিলিস্তিনের কথা ভেবেছিলেন।[16]Alan R. Taylor, “Vision and Intent in Zionist Thought”, in Transformation of Palestine, edited by Ibrahim Abu-Lughod, pp.9-26 ১৬৪৮ সালে ইহুদি ইতিহাসের সবচাইতে বড় বিদ্রোহ সংঘটিত হয়। ইউক্রেনে হলোকাস্টের শিকার ইহুদিরা বোহদান জাইনোভি মাইখাইলোভিচ খমেলনিৎস্কির নেতৃত্বে পোলিশ জমিদারদের বিরুদ্ধে (ইউক্রেন তখন পোল্যান্ডের অন্তর্গত) বিদ্রোহ ঘোষণা করে। এই বিদ্রোহে প্রায় এক লক্ষ ইহুদিকে হত্যা করা হয়।[17]Zenon Kohut, “The Khmelnytsky Uprising, the Image of Jews, and the Shaping of Ukrainian Historical Memory.” Jewish History 17, no. 2 (2003): 141–63. http://www.jstor.org/stable/20101495. সমগ্র পূর্ব ইউরোপের ইহুদি জনগোষ্ঠী ৩০ শতাংশে নেমে আসে।[18]Benjamin Beit-Hallahmi, Original Sins

এমন সময়ে সাব্বাতাই জেভি নাম্নী একজন রহস্যবাদী ইহুদি নিজেকে মসিহা ঘোষণা করে ইহুদি সমাজে চাঞ্চল্য সৃষ্টি করেন। তিনি ঘোষণা করেন যে, ১৬৬৬ সাল নাগাদ ইহুদিদের পরিপূর্ণ নাজাতপ্রাপ্তি ঘটবে। এই ঘোষণার ফলে ইহুদিরা স্পেন ও ইউক্রেনে সংঘটিত দুই ভয়াবহ গণহত্যাকে নাজাতপ্রাপ্তির আবশ্যিক আগমনী ধাপ সাব্যস্ত করেন। মসিহার আগমনের মধ্য দিয়ে নিষ্ঠুর দুনিয়ার পরিসমাপ্তি ঘটতে যাচ্ছে বিশ্বাস করে ইহুদিরা তাদের সমস্ত স্থাবর-অস্থাবর সম্পত্তি বিক্রি করতে শুরু করে। কিন্তু দুনিয়ার পরিসমাপ্তি ঘটেনি। উপরন্তু ইহুদিদের মধ্যে মসিহা আগমনের স্বপ্ন বুনে দেয়া সাব্বাতাই জেভি নিজে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেন।[19]প্রাগুক্ত এই ঘটনা ইহুদিদের স্তব্ধ ও বিমূঢ় করে দেয়। খোদা তাদের সাথে কোনো নিষ্ঠুর তামাশায় লিপ্ত কি না, নাকি তাদের কপালেরই দোষ—তারা ঠিক ঠাহর করে উঠতে পারছিল না। প্রকৃত মসিহাই কেবল এই নিষ্ঠুর তামাশা বন্ধ করতে পারেন বলে তারা পুনরায় বিশ্বাসে বুক বাঁধে। 

জাতিরাষ্ট্রের যুগে ইউরোপ

খ্রিস্টানদের ইহুদি-ঘৃণার ধর্মতাত্ত্বিক প্রেক্ষাপট তো ছিলই। তা ছাড়াও নতুন যুগে পদার্পণের ফলে ইউরোপে আর্থ-সামাজিক-সাংস্কৃতিক যে পরিবর্তন ঘটছিল, সেটাও ইহুদি-ঘৃণার নতুন বাতাবারণ সৃষ্টি করেছিল। খ্রিস্টানদের আন্তঃধর্মীয় (intrafaith) বিবাদে সে সময়ের ইউরোপ টালমাটাল ছিল। ক্যাথলিক ও প্রটেস্টান্টদের প্রারস্পরিক বিদ্বেষ ও হানাহানি রীতিমতো যুদ্ধের রূপ লাভ করে। ত্রিশ বছরের এই ধর্মযুদ্ধের মধ্য দিয়ে সাব্যস্ত হয় যে, রাজার ধর্মই হবে প্রজার ধর্ম। অবশ্য চতুর্দশ শতকের স্পেনকে মুসলমানদের হাত থেকে ক্যাথলিকরা পুনরুদ্ধারের পর থেকে এটাই ছিল রেওয়াজ।[20]সুদীপ্ত কবিরাজ, “জাতীয়তা/অজাতীয়তা”, রাষ্ট্রচিন্তা: একটি রাষ্ট্রনৈতিক … Continue reading হয় খ্রিস্টান ধর্ম গ্রহণ করতে হবে, নতুবা ভিটামাটি ছেড়ে যেখানে খুশি চলে যেতে হবে। অবশেষে ত্রিশ বছরব্যাপী ধর্মযুদ্ধের মধ্য দিয়ে এই দফারফা হলো যে ক্যাথলিক রাজত্বে সকল প্রজার ধর্ম হবে ক্যাথলিক; আর প্রটেস্টান্টদের রাজত্বে সকল প্রজার ধর্মমত হবে প্রটেস্টান্ট। এ সাম্প্রদায়িক নীতিকেই “রাজার ধর্মই হবে প্রজার ধর্ম” আপ্তবাক্যে হাজির করা হলো।[21]ইতিহাসবিদ সুদীপ্ত কবিরাজ মন্তব্য করেছেন, “পরশুরামের কায়দায় পৃথিবীকে … Continue reading ক্যাথলিক ও প্রটেস্টান্টদের এই দফারফা ইতিহাসে “ওয়েস্টফালিয়ার সন্ধি” হিসেবে পরিচিত।[22]Derek Croxton, “The Peace of Westphalia of 1648 and the Origins of Sovereignty.” The International History Review 21, no. 3 (1999). http://www.jstor.org/stable/40109077. এর ফলে ধর্মের দিক থেকে রাজত্বগুলো একবাদী হয়ে উঠেছিল। ধর্মযুদ্ধে বিধর্মীনাশের মাধ্যমে ইউরোপে এক অদ্ভুত সাম্প্রদায়িক ‘শুদ্ধতা’ অর্জিত হয়েছিল। আশ্চর্য নয় যে, পরবর্তী কালের ইউরোপে বিভিন্ন সম্প্রদায়ের মানুষের মধ্যে স্বাধীকার চেতনা যত বৃদ্ধি পেয়েছে, ইউরোপের এই একবাদী জাতীয়তাবাদের সাথে বহুত্ববাদী ধ্যানধারণার তীব্র সংঘাত লেগেই থেকেছে। এক অর্থে, আধুনিক ইউরোপের ইতিহাস “এক জাতি এক ধর্ম এক ভাষা এক রক্ত” কিসিমের বর্ণবাদী ধারণার সাথে বহুত্ববাদী গণতান্ত্রিক চেতনার সংগ্রামেরই ইতিহাস। ইতিহাসবিদ সুদীপ্ত কবিরাজ মন্তব্য করেছেন : “আমরা ইয়োরোপের যে ইতিহাস পড়ি এবং মুখস্থ করে পরীক্ষা পার হই তাতে দেখানো হয় যে ইয়োরোপীয় মানব ক্রমশই একটা থেকে আরেকটা মুক্তির দিকে লম্ফ দিয়ে বাকি পৃথিবীকে পথ দেখাচ্ছে। একটু খতিয়ে দেখলেই দেখা যায় সেই ইতিহাস যে কেবল শ্রেণিবিদ্বেষের এবং শোষণের ওপরে প্রতিষ্ঠিত তাই নয়, নিজের অস্মিতা (identity) ছাড়া সে অন্য সব অস্মিতাকেই অবমাননা এবং হিংসা করে এসেছে। এবং তাই পাশ্চাত্যের আধুনিক ইতিহাস মানবিক ভ্রাতৃত্বের ইতিবৃত্ত নয়, প্রত্যেক জাতির অন্য জাতির বিরুদ্ধে হিংসার ও যুদ্ধের রক্তাক্ত ইতিহাস।”[23]সুদীপ্ত কবিরাজ, “জাতীয়তা/অজাতীয়তা”

সাধারণ কাণ্ডজ্ঞান মোতাবেক ‘জাতি’ ধারণা আবিষ্কারের মধ্য দিয়ে ইউরোপ তার ধর্ম প্রশ্নের মীমাংসা করেছে বলে মনে করা হয়। কিন্তু সত্য হচ্ছে, ইউরোপের “জাতি ধারণা”র সাথে (খ্রিস্ট) ধর্মের যোগাযোগ ও আঁতাত গভীর।[24]Michael Allen Gillespie, The Theological Origins of Modernity, Chicago: The University of Chicago Press, 2008 কারা এক ও অভিন্ন ‘জাতি’?—এই প্রশ্নের মীমাংসা করতে গিয়ে আধুনিক ইউরোপ সাব্যস্ত করেছে যে, যারা ভাষা, ধর্ম ও রক্তের দিক থেকে ‘এক ও অভিন্ন’, তারাই একীভূত জাতি। অর্থাৎ, ইউরোপের জাতি ধারণা ‘মধ্যযুগীয়’ ধর্মের প্রতিবিধান তো নয়ই; বরং, ধর্ম, ভাষা ও তথাকথিত অমিশ্রিত রক্তই ইউরোপের আধুনিক জাতিবাদী ধ্যানধারণার গাঠনিক উপাদান হিসেবে রয়ে গেছে। একই রক্তের অধিকারী অভিন্ন ভাষিক ও ধর্মীয় গোষ্ঠী নির্দিষ্ট ভূমিতে ‘জাতিরাষ্ট্র’ কায়েম করবে—এমন ধ্যানধারণা ইউরোপ তো বটেই, উপনিবেশবিরোধী সংগ্রামের মধ্য দিয়ে সারা পৃথিবীর কাছে অমোঘ ও স্বাভাবিক মডেল হিসেবে গ্রহণযোগ্য হয়েছে। এই কাণ্ডজ্ঞান অনুযায়ী রাষ্ট্র মানেই জাতিরাষ্ট্র।[25]প্রাগুক্ত বলা বাহুল্য, বিজ্ঞানের মোড়কে হাজির করা হলেও, সাম্প্রদায়িক ও বর্ণবাদী এই (জাতি) রাষ্ট্রতত্ত্ব আধুনিক জমানার সকল সংকটের মূলে। আধুনিক জাতিবাদের সঙ্গে সাম্রাজ্যবাদের সম্পর্কও অত্যন্ত গভীর।[26]Uday Singh Mehta, Liberalism and Empire: A Study in Nineteenth-Century British Liberal Thought

‘জাতি’ ধারণার বলেই ইউরোপ সাম্রাজ্যবাদী শক্তি হিসেবে আবির্ভূত হয়েছিল। অভিন্ন ধর্ম-ভাষা-রক্তের বলে বলীয়ান কোনো ‘জাতি’  তথা সংগঠিত ইউরোপীয় লোকশক্তি পরদেশ আক্রমণ ও দখল করেছে। উপনিবেশিত অঞ্চল আকারে এবং জনসংখ্যার দিক থেকে অনেকক্ষেত্রেই ইউরোপীয় সাম্রাজ্যবাদী শক্তির তুলনায় বড় হলেও, তারা শুরুর দিকে উপনিবেশের যৌক্তিক বিরোধিতা করতে পারে নাই জাতি/জনগণ ধারণার অভাবে। উপনিবেশের শুরুর জমানায় উপনিবেশিত অঞ্চলের বুদ্ধিজীবীরা ঠিক এ কারণেই উপনিবেশের পক্ষাবলম্বন করেছিলেন। এমন নয় যে তারা স্বাধীনতাবিরোধী ছিলেন। কিন্তু কেন স্বাধীনতা? কার জন্য স্বাধীনতা? আমরা কি স্বাধীনতার লায়েক হয়ে উঠেছি তথা আমরা কি ‘জাতি/জনগণ’ হয়ে উঠতে পেরেছি?—এটাই ছিল প্রধান তর্ক।[27]নাজমুল সুলতান, “স্বাধীনতা কারে কয়? বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় ও ঔপনিবেশিক … Continue reading তার মানে দাঁড়াচ্ছে, কেবল স্বাধীনতা চাইলেই হবে না, তা চাওয়ার আগে ‘জাতি/জনগণ’ হয়ে উঠতে হবে। এই অর্থে ঔপনিবেশিক শাসন কেবল সামরিক শক্তির জোরে নয়, জাতি ধারণার বয়ানের জোরে তামাম দুনিয়া শাসন করেছে।[28]সুদীপ্ত কবিরাজ, “জাতীয়তা/অজাতীয়তা” আবার, ঔপনিবেশিক শাসনের সাথে “সাংঘর্ষিক মোলাকাতের”[29]নাজমুল সুলতান, “স্বাধীনতা কারে কয়? বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় ও ঔপনিবেশিক … Continue reading মধ্য দিয়েই উপনিবেশিত অঞ্চলে স্বশাসনের বাসনা বিকশিত হয়েছে। ইউরোপীয় জাতিবাদী-সাম্রাজ্যবাদী শক্তির পদানত এ সকল অঞ্চলে ক্রমশ জাতীয় মুক্তির চেতনা তৈরি হওয়াতে তারা উপনিবেশের বিরুদ্ধে সংগ্রামে লিপ্ত হয়েছে। আবারও সুদীপ্ত কবিরাজকে দোহাই মানতে হয় :

… আধুনিক জাতীয়তাবাদের উত্থানের মধ্য দিয়ে যে রাজনৈতিক পৃথিবীটা তৈরি হয়ে উঠেছে, সেটা স্ববিরোধী—তার মধ্যে দুটো বিরোধী স্রোত। একটা হলো প্রত্যেক জাতি-জনের স্বাধীনতার স্পৃহা এবং নিজের assertion—স্বশক্তির আস্বাদনের অনুভব—এবং স্বশক্তির আস্বাদনের সব থেকে বড় উপায় অন্যকে নিজের শক্তির অধীন করে রাখতে পারা। ইয়োরোপের নেপোলিয়নীয় যুদ্ধের ইতিহাসে এর দুটো দিকই স্পষ্টভাবে চোখে পড়ে। ফ্রান্স নিজের স্বাতন্ত্র‍্যের বিস্তারে অন্য সমস্ত ইউরোপীয় জনগণকে যুদ্ধে পরাজিত করে অধীন করেছে একদিক দিয়ে, আবার তারই জন্যে অন্যদিক দিয়ে পরাজিত জনগণেরা স্বাধীনতার সংগ্রামে নেমে পড়েছে।[30]সুদীপ্ত কবিরাজ, “জাতীয়তা/অজাতীয়তা”

উপনিবেশিত অঞ্চলের ক্ষেত্রেও একই কথা প্রযোজ্য। যে যুক্তিতে তারা বিশ্বের বিভিন্ন অঞ্চলকে (আমরা ইতিহাসের অগ্রসর স্তর তথা সংগঠিত লোকশক্তি জাতিবাদের স্তরে আছি) নিজেদের দখলে নিয়েছে, সেই একই যুক্তিতে উপনিবেশিত অঞ্চলের মানুষজন বিংশ শতাব্দীতে উপনিবেশের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করেছে তথা নিজেদেরকে জাতি/জনগণ ঘোষণা করেছে।[31]Nazmul Sultan, Waiting for the People: The Idea of Democracy in Indian Anticolonial Thought, Cambridge: Harvard University Press, 2023

আধুনিক কালের ইহুদি ইতিহাস

জায়নবাদের ইতিহাস ও মতাদর্শের আলোচনা করতে গেলে উল্লিখিত মধ্যযুগ ও আধুনিক যুগের আলোচনা না করে উপায় থাকে না। কারণ, আমরা পরে দেখব, জায়নবাদের ইতিহাস মূলত আধুনিক উপনিবেশ ও জাতিবাদেরই ইতিহাস। ওয়েস্টফালিয়ার সন্ধির মাধ্যমে ক্যাথলিক ও প্রটেস্টান্টরা নিজেদের মধ্যে যে বিভাজন সৃষ্টি করেছিল, তার ফলে ইহুদিরা নতুনভাবে অপরায়নের শিকার হতে শুরু করে। খ্রিস্টীয় ধর্মতত্ত্বের পাশাপাশি এ পর্যায়ে আধুনিক জাতিবাদী যুক্তির কোপানলে পড়ে তারা। “রাজার ধর্মই প্রজার ধর্ম” এহেন সাম্প্রদায়িক নীতি সংখ্যাগরিষ্ঠ খ্রিস্টান সমাজের দোর্দণ্ড প্রতাপে ইতিমধ্যেই ব্যাপকভাবে প্রান্তিক ইহুদি সম্প্রদায়কে পুনরায় কোণঠাসা করে। আঠারো-উনিশ শতকের নতুন ইউরোপীয় বাস্তবতায় ইহুদি সম্প্রদায়কে নিজেদের বর্তমান ও ভবিষ্যত প্রশ্নে নতুন করে বিচলিত হতে হয়। নতুন এই যুগে ‘ইহুদি প্রশ্ন’ ইউরোপের নামজাদা বুদ্ধিজীবী ও দার্শনিকদের বেচইন রাখে : Emancipation brought the Jews into the world, but at the same time it created the Jewish question.[32]Benjamin Beit-Hallahmi, Original Sins

ঠিক এমন পরিস্থিতিতেই জায়নবাদের উদ্ভব ও বিকাশ। জাতিবাদ, উপনিবেশবাদ, সাম্রাজ্যবাদের সংস্পর্শে ‘ইহুদি প্রশ্ন’[33]কোনো একটা বিষয় কখন ‘প্রশ্ন’ হয়ে ওঠে সে ব্যাপারে এডওয়ার্ড সাঈদ … Continue reading নতুন পর্যায়ে প্রবেশ করে। আঠারো শতকের ইহুদিদের মধ্যে ঐতিহাসিক ধৈর্যচ্যুতি লক্ষ করা যায়। মসিহা আগমনের নিষ্ক্রিয় নিস্ফলা গালগল্পে তাদের আর আস্থা ছিল না। ইতিমধ্যেই গত দুইশ বছরে ইহুদি সম্প্রদায়ের মধ্যে ব্যাপক পরিবর্তন সংঘটিত হয়েছে। আধুনিকায়নের সংস্পর্শে অন্যান্য যেকোনো সম্প্রদায়ের মতো তারাও মানব ইতিহাসের প্রায় সকল যজ্ঞের সমান অংশীদার ছিলেন। বিজ্ঞানী, বুদ্ধিজীবী, ব্যবসায়ী, শিল্পী-সাহিত্যিক, রাজনীতিবিদ থেকে শুরু করে সকল শ্রেণিপেশায় তাদের সরব উপস্থিতি ছিল। তবু, জাতিধর্মবাদী ইউরোপে দৈনন্দিন বর্ণবাদের শিকার হওয়া থেকে তাদের রেহাই মেলেনি।  

আলোকায়নের স্বপ্ন

জায়নবাদের আগে নব প্রজন্মের ইহুদি সম্প্রদায়ের মধ্যে আলোকায়ন এবং ইউরোপীয় সমাজে আত্মীকৃত হবার উদ্যোগ লক্ষ করা যায়। আধুনিক ইউরোপের নানান গালভরা প্রতিশ্রুতি নতুন প্রজন্মের ইহুদিদের মধ্যে আরও একবার স্বপ্ন বুনে দিয়েছিল। আঠারো শতকের অন্তিম পর্যায়ে ইহুদি বুদ্ধিজীবী ও দার্শনিকরা “ইহুদি আলোকায়ন” প্রকল্পের প্রতি মনোযোগী হন। আধুনিক মূল্যবোধের সাথে সাযুজ্যপূর্ণ ইহুদি সত্তার প্রস্তাব রাখেন মোসেস মেন্ডেলসোহন (Moses Mendelssohn:1729-86)। জার্মান এই ইহুদি দার্শনিক ও ধর্মতাত্ত্বিক প্রথম ইহুদি আলোকায়নের রূপকল্প পেশ করেন। তিনি নিজে ছিলেন একজন আত্মীকৃত ইহুদি। ইউরোপীয় সংস্কৃতিতে সংঘটিত গভীর পরিবর্তনের তিনি কেবল পর্যবেক্ষকই ছিলেন না, সক্রিয় অংশীদারও ছিলেন। পরবর্তীকালে গুরুত্ব হারালেও, আঠারো শতকের ইউরোপীয় বুদ্ধিবৃত্তিক পরিসরে তিনি ছিলেন একজন পরিচিত মুখ।[34]Ben Halpern, The Idea of the Jewish State

তবে পশ্চিম ইউরোপ নয়; পূর্ব ইউরোপ হয়ে ওঠে নতুন ইহুদি আলোকায়নের তীর্থভূমি। হাসকালাহ (Haskalah) তথা ইহুদি আলোকায়নের ফলে পূর্ব ইউরোপের বিভিন্ন দেশে—বিশেষত পোল্যান্ড, ইউক্রেন, রোমানিয়া, লিথুনিয়া ও রাশিয়া—ইহুদি বুদ্ধিজীবীদের মধ্যে নতুন সাংস্কৃতিক জাগরণ লক্ষ করা যায়। ইহুদি আলোকায়নের দুটি লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়।

  • অভ্যন্তরীণ : তথা নিজ সম্প্রদায়ের পুরানা সেকেলে ধ্যানধারণার জিঞ্জির ভেঙ্গে সাংস্কৃতিক নবজাগরণ। 
  • বাহ্যিক : ইউরোপীয় মূলধারার সমাজে আত্মীকৃত হওয়ার ন্যায্য বাসনা।[35]Yakov M. Rabkin, A Threat From Within: A Century of Jewish Opposition to Zionism, translated by Fred A. Reed, London: Zed Books, 2006

হাসকালাহ আন্দোলনের সদস্যদের বলা হতো মাসকিলিম (maskilim)। মাসকিলিমদের হাতে সর্বপ্রথম ইহুদি সাংস্কৃতিক জাতীয়তাবাদের বিকাশ ঘটে। এই সাংস্কৃতিক জাতীয়তাবাদই সমসাময়িক জায়নবাদী সাংস্কৃতিক পুনর্জাগরণ এবং ইজরায়েলি সংস্কৃতির ভিত্তি গড়ে দেয়। এর ফলে নতুন ‘ইহুদি সত্তা’র সাথে ধর্মীয় জুডাইজমের যোগাযোগ ক্ষীণ থেকে ক্ষীণতর হতে থাকে। ‘ইহুদি’ বর্গটি স্রেফ ঐতিহাসিক-সাংস্কৃতিক বর্গে পরিণত হয়। ইহুদি ধর্ম ও সংস্কৃতি পুনর্গঠনের সমস্ত তোড়জোড়ের প্রধান লক্ষ্য ছিল ইহুদিদেরকে ইউরোপীয় সমাজে ‘গ্রহণযোগ্য’ করে তোলা। ইহুদি ধর্মের এমন সংস্কারের উদ্যোগ নেয়া হয়েছিল যেন খোদ ইউরোপীয় সমাজ (পড়ুন খ্রিস্টান সমাজ) তাদের খুশিমনে গ্রহণ করে : 

…they wanted to reinterpret Judaism in their own image : to make it modern, acceptable or even attractive to Europeans. This necessitated rejecting most of it in practice, and presenting to the world a sanitised, Europeanized version of ‘rational’, ‘humanistic’ Judaism.[36]Benjamin Beit-Hallahmi, Original Sins, p.22

মধ্য উনিশ শতকের জায়নবাদ অন্তিম-আঠারো শতকি হাসকালাহ আন্দোলনের দ্বারা নানাভাবে পরিপুষ্ট হয়েছে। মূলত জায়নবাদী সংস্কৃতি হাসকালাহ সাংস্কৃতিক জাতীয়তাবাদেরই পরিমার্জিত রূপ।[37]Alan R. Taylor, “Vision and Intent in Zionist Thought” হাসকালাহ আন্দোলনের মাধ্যমেই জায়নবাদের ভাষ্য ও বয়ান সৃষ্টি হয়েছে। তবে একদিক থেকে জায়নবাদ ইহুদি আলোকায়ন ও আত্মীকরণ রূপকল্পকে ছাপিয়ে গেছে। ইহুদি আলোকায়ন ও আত্মীকরণ প্রকল্প ছিল ইউরোপীয় সমাজেই “ইহুদি প্রশ্ন” সমাধানের চেষ্টা। অন্যদিকে, “ইহুদিদের স্বতন্ত্র আবাসভূমি” তথা ইহুদি-রাষ্ট্রের ধারণা উনিশ ও বিশ শতকী জায়নবাদের কেন্দ্রীয় বিষয় ছিল। ইউরোপে থেকে ইহুদি সমস্যার কোনো সমাধান হবে—জায়নবাদীরা তা মনে করেনি। তাই বলে তারা তাদের ইউরোপীয়তা বিসর্জন দিতে চায়নি। “ইউরোপের এশীয়” (Asians in Europe) ইহুদিদেরকে জায়নবাদ “এশিয়ার ইউরোপীয়” (Europeans in Asia) সত্তায় রূপান্তরের প্রকল্প গ্রহণ করে।[38]Joseph Massad, The Persistence of the Palestinian Question, p.178

রূপকল্পগত পার্থক্য সত্ত্বেও হাসকালাহ ও জায়নবাদের মধ্যে ব্যাপক সাংস্কৃতিক ঐক্য লক্ষ করা যায়। বিশেষত ঐতিহ্যিক ইহুদি সত্তার প্রতি দুর্নিবার ঘৃণা উল্লেখিত দুই আন্দোলনেরই সাধারণ প্রবণতা হিসেবে থেকে গেছে। সাহিত্যিক ও বুদ্ধিবৃত্তিক লেখালেখিতে হাজার বছরের ইউরোপীয় ইহুদি অধিবাসীরা ‘অভিবাসী’ ও ‘ভিনদেশী’ হিসেবে চিহ্নিত হতে শুরু করে।[39]ফিলিস্তিনি কবি, বুদ্ধিজীবী ও তাত্ত্বিক গাসসান কানাফানির মতে, জায়নবাদী … Continue reading প্রবলভাবে ধর্মকর্ম আঁকড়ে থাকা নিজস্ব ভূখণ্ডহীন ইউরোপীয় ইহুদিদের ‘পরাশ্রিত’, ‘পরজীবী’, ‘পশ্চাদপদ’ অভিহিত করা হয়।

আত্মীকরণের প্রচেষ্টা

আলোকায়ন প্রকল্পের অংশ হিসেবেই আত্মীকরণের (assimilation) উদ্যোগ নেয়া হয়। আত্মীকরণ প্রকল্প ইহুদিদের স্ব স্ব দেশের মূলধারায় মিশে যেতে উদ্বুদ্ধ করে। ঘেটো জীবন থেকে পরিত্রাণ পেতে হলে মূলধারার সমাজের লায়েক হয়ে উঠতে হবে তথা সংখ্যাগরিষ্ঠ সমাজের বিরক্তি উদ্রেক করে এমন আচার-অনুষ্ঠান পরিত্যাগ করতে হবে—এমন প্রচারণা চলতে থাকে।[40]Walter Laqueur, A History of Zionism: From the French Revolution to the Establishment of the State of Israel, New York: MJF Books, 1972 এমনকি, প্রয়োজনে, খ্রিস্টান ধর্ম গ্রহণ করে জাতীয় সংস্কৃতিতে জায়গা করে নেয়ার ফরমায়েশও করা হয়। এ সময়ে অনেক ইহুদি আনুষ্ঠানিকভাবে খ্রিস্টান ধর্ম গ্রহণ করেন। তারা ইহুদি সংস্কৃতি পুরোপুরি পরিত্যাগ করেননি। যেমন কার্ল মার্কসের পুরো পরিবার খ্রিস্টান ধর্মে ধর্মান্তরিত হয়েছিল।[41]David McLellan, Karl Marx: A Biography, Palgrave Macmillan; (4th edition), 2006 মার্কসের জন্য অবশ্য এই ধর্মান্তরণ আনুষ্ঠানিকতার বেশি কিছু ছিল না। উনিশ শতকে সমগ্র বিশ্বের মোট ইহুদি জনগোষ্ঠীর শতকরা ৫ ভাগ (সাড়ে সাত লক্ষ) খ্রিস্টান ধর্মে ধর্মান্তরিত হয়।[42]Benjamin Beit-Hallahmi, Original Sins ধর্মান্তরিত অনেকেই অ-ইহুদি নাম গ্রহণ করলেও, সামাজিক-সাংস্কৃতিক বিবেচনায় তাদের ইহুদিত্ব সম্পূর্ণরূপে বিলীন হয়নি।

আলোকায়ন ও আত্মীকরণের পর্ব পেরিয়ে জায়নবাদী ইতিহাস

আধুনিক ইউরোপের ইতিহাসকে এড়িয়ে জায়নবাদের ইতিহাস যথাযথভাবে নিরূপণ করা সম্ভব নয়। জায়নবাদ আধুনিক ইউরোপীয় ইতিহাসেরই অংশ।[43] Walter Laqueur, A History of Zionism জাতিবাদের পরস্পরবিরোধী প্রবণতা জায়নবাদকে পুষ্টি জুগিয়েছে। “রাজার ধর্মই প্রজার ধর্ম”—ধর্মযুদ্ধ পরবর্তী এই সাম্প্রদায়িক নীতি ইউরোপীয় ইহুদিদের আরেকপ্রস্থ ‘অপর’ করে। এর প্রতিক্রিয়ায় ক্রমশ বিকশিত জায়নবাদে এক অদ্ভুত প্রবণতা লক্ষ করা যায়। ঔপনিবেশিক-জাতিবাদী শ্রেষ্ঠত্ববাদের মুখোমুখি হয়ে পৃথিবীর বিভিন্ন অঞ্চলের মানুষ একদিকে ঔপনিবেশিকতার বিরোধিতা করেছে; অন্যদিকে, ইউরোপীয় জাতিবাদের মুক্তিদায়ী প্রতিশ্রুতি থেকে অনুপ্রেরণা ও যুক্তি সঞ্চয় করেছে। অর্থাৎ ইউরোপীয় যুক্তিতেই ইউরোপীয় উপনিবেশকে ধরাশায়ী করেছে। কিন্তু ইউরোপীয় জাতিবাদী বর্ণবাদ ও সাম্প্রদায়িকতার শিকার জায়নবাদ অপরাপর উপনিবেশ-বিরোধী সংগ্রামের মতো করে ইউরোপীয় জাতিবাদের বিরোধিতা করেনি; বরং, নিজেরা এক ঔপনিবেশিক শক্তি হয়ে উঠেছে।[44]Richard P. Stevens, “Zionism as a phase of  Western Imperialism”, in Transformation of Palestine ইহুদিঘৃণাসহ (খ্রিস্টান সমাজের ‘অপর’ ঘৃণা জায়নবাদে এসে পরিণত হয়েছে আত্মস্থ ঘৃণায়) ইউরোপীয় বর্ণবাদী মতাদর্শের সকল যুক্তির রস নিংড়ে নিয়ে জায়নবাদ আবির্ভূত হয়েছে এক সেটলার ঔপনিবেশিক-জাতিবাদী শক্তিরূপে।[45]Jeff Halper, Decolonizing Israel, Liberating Palestine: Zionism, Settler Colonialism, and the Case for One Democratic State, London: Pluto Press, 2021 জায়নবাদের এই ইতিহাস স্মরণে রাখলে ইজরায়েলকে ইন্ডিয়া, আলজেরিয়াসহ অপরাপর জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের সাথে গুলিয়ে ফেলার মতো বিভ্রান্তি আমাদের পেয়ে বসবে না।[46]পোলিশ মার্কসবাদী সাংবাদিক ও চিন্তক আইজ্যাক ডয়েচার (Isaac Deutscher) এই ফাঁদে পা … Continue reading

রাজনৈতিক-সেক্যুলার জায়নবাদ উনিশ শতকি মতবাদ হলেও আঠারো শতকি হাসিদিক (Hasidic) আন্দোলনের মধ্যে এর ভাবাদর্শিক ভ্রূণ জন্ম নিয়েছিল।[47]Alan R. Taylor, “Vision and Intent in Zionist Thought”, in Transformation of Palestine ইসরায়েল বেন এলিজার (১৭০০-১৭৬০) ওরফে বাল শেম টভ (Baal Shem Tov) হাসিদিক আন্দোলনের প্রতিষ্ঠাতা। হাসিদিক আন্দোলন সনাতনী জুডাইজমের নানা আচার-রীতির প্রকাশ্য বিরোধিতা করে। তালমুদিক ঐতিহ্যের কঠোর ও অলঙ্ঘনীয় বিধিবিধানকে হাসিদিকরা প্রত্যাখ্যান করে। আধুনিক জাতীয়তাবাদের সাথে তাল মিলিয়ে ঐতিহ্যিক ইহুদিতন্ত্রের হালনাগাদ করার দিকে এই আন্দোলন মনোনিবেশ করে। ইহুদিদের তরফে সংঘবদ্ধভাবে “স্বদেশ প্রত্যাবর্তন” এর ধারণা সর্বপ্রথম হাসিদিকরাই পেশ করে।[48]প্রাগুক্ত ফরাসি বিপ্লবের অব্যাবহিতকাল পূর্বে হাসিদিকদের হাতেই আদি-জায়নবাদের ভিত রচিত হয়েছিল। তবে আঠারো শতকের শেষ এবং উনিশ শতকের মাঝামাঝি সময় পর্যন্ত ইহুদি আলোকায়ন, আত্মীকরণ ও সেক্যুলারায়ন প্রকল্পের প্রবল প্রতাপে হাসিদিক মতবাদ খুব একটা সুবিধা করে উঠতে পারেনি।

জায়নবাদ : ইতিহাস ও মতাদর্শ (দ্বিতীয় পর্ব)

তথ্যসূত্র:

তথ্যসূত্র:
1 হিব্রু বাইবেলে এরেৎজ ইজরায়েল (Land of Israel) এবং জেরুজালেম— দুই অর্থেই ‘জায়ন’ শব্দের ব্যবহার আছে। ঐতিহাসিক অর্থে ‘জায়ন’ শব্দের দ্বারা জেরুজালেমের একটি পাহাড় এবং খোদ জেরুজালেম শহরকে নির্দেশ করা হয়। খ্রিস্টান ধর্মের বিভিন্ন ফেরকা এর অর্থ ‘ইউটোপিয়া’ বুঝে থাকে। ‘জায়ন’ শব্দের আরেক অর্থ ‘পবিত্র স্থান’। আধুনিককালে ‘জায়নবাদ’ দ্বারা একটি বসতিস্থাপনকারী ঔপনিবেশিক-জাতিবাদী মতাদর্শ ও রাজনীতিকে নির্দেশ করে যা পুরানা বাইবেলের একটি বিশেষ ব্যাখ্যার ওপর দাঁড়িয়ে আছে। এর সার কথা হচ্ছে, আল্লাহ ইহুদিদের সঙ্গে  চুক্তি করেছেন যে, জেরুজালেম তথা অখণ্ড ফিলিস্তিন ভূখণ্ড একমাত্র ইহুদিদের। এই চুক্তি যাবতীয় ঐতিহাসিকতা ও নৈতিকতার ঊর্ধে। জায়নভূমির সঙ্গে ইহুদিদের এই সম্বন্ধ চিরন্তন, অলঙ্ঘনীয়, প্রাগৈতিহাসিক ও পরম। দেখুন: Avi Shlaim, The Iron Wall এবং ফরহাদ মজহার, সাম্রাজ্যবাদ, পৃ: ১০৩;
2 Joseph Massad, The Persistence of the Palestinian Question, p.177
3 Benjamin Beit-Hallahmi, Original Sins: Reflections on the History of Zionism and Israel, London: Pluto Press, 1992
4 Ivan Marcus, “Jews and Christians Imagining the Other in Medieval Europe.” Prooftexts 15, no. 3 (1995): 209–26. http://www.jstor.org/stable/20689425.
5, 18, 32, 42 Benjamin Beit-Hallahmi, Original Sins
6, 19, 25, 48 প্রাগুক্ত
7

ইহুদিরাই যীশু খ্রিস্টের হত্যাকারী—এর সপক্ষে কোনো শক্ত প্রমাণ নাই; বরং হালের গবেষণা এই দাবি নাকচ করে দেয়। দেখুন: Samuel Griswold, “No Pope? What if Rome had become Jewish?”, The Times of Israel Blog, Sep 25, 2015, https://blogs.timesofisrael.com/no-pope-what-if-rome-had-become-jewish/

 তাছাড়া নিউ টেস্টামেন্টে বর্ণিত ক্রুশবিদ্ধ যীশুর কাহিনি সম্পর্কে পবিত্র কোরআনের বর্ণনা ভিন্ন। এ বর্ণনা অনুযায়ী ঈসা (আঃ) কে হত্যা করার পূর্বেই মহান আল্লাহর নির্দেশে তাঁকে আসমানে উঠিয়ে নেয়া হয়েছে এবং ঈসা (আঃ)-এর একজন অনুসারীকে তাঁর আকৃতি প্রদান করা হয়েছিল। ঈসা (আঃ)-এর বাহ্যিক রূপ ধারণকারী সেই অনুসারীকেই ক্রুশবিদ্ধ করা হয়। দেখুন, সূরা আন-নিসা, আয়াত ১৫৭-১৫৮, পবিত্র আল কোরআন

8  Benjamin Beit-Hallahmi, Original Sins
9 James Joyce, Ulysses, New York, Random House, 2002
10 উদ্ধৃত, J.S. Conway, “Protestant Missions to the Jews 1810-1980: Ecclesiastical imperialism or theological aberration?”, Holocaust and Genocide Studies 1(1):127–146. doi:10.1093/hgs/1.1.127
11 Black Death Pandemic, Encyclopedia Britannica, https://www.britannica.com/event/Black-Death
12 ক্রিস্টোফার কলম্বাস তার ডায়েরিতে লিখেছেন: “In the same month in which their Majesties [Ferdinand and Isabella] issued the edict that all Jews should be driven out of the kingdom and its territories, in the same month they gave me the order to undertake with sufficient men my expedition of discovery to the Indies.” দেখুন: “Modern Jewish History: The Spanish Expulsion (1492)” Jewish Virtual Library 

https://www.jewishvirtuallibrary.org/the-spanish-expulsion-1492

13 Joel J. Levy/ Center For Jewish History, “What Life Was Like in the World’s First Ghetto”, Time Magazine, NOVEMBER 2, 2016, https://time.com/4551523/venice-ghetto-history/
14 সে সময় ইহুদিরা প্রার্থনা করার সময় একে অপরের প্রতি বলতেন, “Next year in Jerusalem!”। তবে এটা কেবল রুহানি প্রার্থনার অংশই ছিল, কোনো বাস্তব কর্মসূচির অংশ ছিল না। প্রার্থনার এই ‘জেরুসালেম’ সকল সময়ে ভৌত স্থানকে নির্দেশ করত না। ‘জেরুসালেম’ ছিল আদর্শ, বাসনা ও সম্ভাবনার প্রতীক। দেখুন: Dasee Berkowitz, “What Does ‘Next Year in Jerusalem’ Really Mean?”, Reform Judaism, APRIL 6, 2020

https://reformjudaism.org/blog/what-does-next-year-jerusalem-really-mean

15 Moti Benmelech, “History, Politics, and Messianism: David Ha-Reuveni’s Origin and Mission.” AJS Review 35, no. 1 (2011): 35–60. http://www.jstor.org/stable/41310648.
16 Alan R. Taylor, “Vision and Intent in Zionist Thought”, in Transformation of Palestine, edited by Ibrahim Abu-Lughod, pp.9-26
17 Zenon Kohut, “The Khmelnytsky Uprising, the Image of Jews, and the Shaping of Ukrainian Historical Memory.” Jewish History 17, no. 2 (2003): 141–63. http://www.jstor.org/stable/20101495.
20 সুদীপ্ত কবিরাজ, “জাতীয়তা/অজাতীয়তা”, রাষ্ট্রচিন্তা: একটি রাষ্ট্রনৈতিক জার্নাল, ত্রয়োদশ সংখ্যা (বর্ষ ৮, সংখ্যা ২), জানুয়ারি, ২০২৪, সম্পাদক: আর রাজী
21 ইতিহাসবিদ সুদীপ্ত কবিরাজ মন্তব্য করেছেন, “পরশুরামের কায়দায় পৃথিবীকে নিঃক্ষত্রীয় করতে না পারলেও এই রাজারা নিজেদের দেশ নিষ্প্রটেস্টান্ট এবং নিষ্ক্যাথলিক করতে পেরেছিলেন। ইয়োরোপের লোকেরা করলেও একে একটা শুভবুদ্ধির পরাকাষ্ঠা বলা যায় না। ধর্মীয় অসহিষ্ণুতার একেবারে চরমপন্থার উপরে তাঁরা সামাজিক শান্তিকে প্রতিষ্ঠিত করতে চেয়েছিলেন।” দেখুন: প্রাগুক্ত।
22 Derek Croxton, “The Peace of Westphalia of 1648 and the Origins of Sovereignty.” The International History Review 21, no. 3 (1999). http://www.jstor.org/stable/40109077.
23, 28, 30 সুদীপ্ত কবিরাজ, “জাতীয়তা/অজাতীয়তা”
24 Michael Allen Gillespie, The Theological Origins of Modernity, Chicago: The University of Chicago Press, 2008
26 Uday Singh Mehta, Liberalism and Empire: A Study in Nineteenth-Century British Liberal Thought
27 নাজমুল সুলতান, “স্বাধীনতা কারে কয়? বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় ও ঔপনিবেশিক আমলের বুদ্ধিবৃত্তিক ইতিহাস পাঠের সমস্যা”, সময়ের কুয়াশায়: দীপেশ চক্রবর্তীর সম্মানে প্রবন্ধগুচ্ছ, সম্পাদনা: আহমেদ কামাল ও অন্যান্য, ইউনিভার্সিটি প্রেস লিমিটেড, ঢাকা, ২০২৩
29 নাজমুল সুলতান, “স্বাধীনতা কারে কয়? বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় ও ঔপনিবেশিক আমলের বুদ্ধিবৃত্তিক ইতিহাস পাঠের সমস্যা”
31 Nazmul Sultan, Waiting for the People: The Idea of Democracy in Indian Anticolonial Thought, Cambridge: Harvard University Press, 2023
33 কোনো একটা বিষয় কখন ‘প্রশ্ন’ হয়ে ওঠে সে ব্যাপারে এডওয়ার্ড সাঈদ তাৎপর্যপূর্ণ ব্যাখ্যা হাজির করেছেন। কোনো একটা বিষয় যখন অন্য সকল বিষয় থেকে আলাদা রূপ ধারণ করে এবং আলাদা মনোযোগ দাবি করে, তখন তা ‘প্রশ্ন’। এজন্যই ‘ইহুদি প্রশ্ন’, ‘ফিলিস্তিন প্রশ্ন’। এছাড়াও কোনো বিষয় যদি দীর্ঘকাল অমীমাংসিত অবস্থায় থাকে, তাহলেও সেটা ‘প্রশ্ন’ হিসেবে হাজির হয়। এমন ‘প্রশ্ন’ যা বারবার ফিরে ফিরে আসছে অথচ যার সঠিক চিহ্নায়ন হচ্ছে না। উপরন্তু কোনো বিষয়ের অস্তিত্ব থাকা সত্ত্বেও তা যদি অবজ্ঞার শিকার হয় তথা অনেকের চৈতন্যে হাজির না থাকে, তখনো সেটা ‘প্রশ্ন’। ইউরোপে দীর্ঘকাল ধরে ‘ইহুদি প্রশ্ন’ জারি আছে। জায়নবাদ এই ‘প্রশ্ন’ সমাধানের নামে নতুন করে ‘ফিলিস্তিন প্রশ্ন’ সৃষ্টি করেছে। দেখুন, ফরহাদ মজহার, সাম্রাজ্যবাদ, পৃ: ১১০-১১২; আরও দেখুন Edward Said, The Question of Palestine
34 Ben Halpern, The Idea of the Jewish State
35 Yakov M. Rabkin, A Threat From Within: A Century of Jewish Opposition to Zionism, translated by Fred A. Reed, London: Zed Books, 2006
36 Benjamin Beit-Hallahmi, Original Sins, p.22
37 Alan R. Taylor, “Vision and Intent in Zionist Thought”
38 Joseph Massad, The Persistence of the Palestinian Question, p.178
39 ফিলিস্তিনি কবি, বুদ্ধিজীবী ও তাত্ত্বিক গাসসান কানাফানির মতে, জায়নবাদী সাহিত্য রাজনৈতিক জায়নবাদের জন্ম দিয়েছে। বিপুল সংখ্যক জায়নবাদী সাহিত্য বিশ্লেষণ করে কানাফানি দেখিয়েছেন জায়নবাদী আন্দোলন সাহিত্যকে রাজনৈতিক ও সামরিক অভিযানের মতাদর্শিক হাতিয়ার রূপে ব্যবহার করেছে। রাজনৈতিক জায়নবাদের শ্রেষ্ঠত্ববাদ ও বর্ণবাদ মূলত সাহিত্যিক জায়নবাদেরই ধারাবাহিকতা। দেখুন: Ghassan Kanafani, On Zionist Literature, translated by Mahmoud Najib, Oxford: Ebb Books, 2022 [1967]
40 Walter Laqueur, A History of Zionism: From the French Revolution to the Establishment of the State of Israel, New York: MJF Books, 1972
41 David McLellan, Karl Marx: A Biography, Palgrave Macmillan; (4th edition), 2006
43  Walter Laqueur, A History of Zionism
44 Richard P. Stevens, “Zionism as a phase of  Western Imperialism”, in Transformation of Palestine
45 Jeff Halper, Decolonizing Israel, Liberating Palestine: Zionism, Settler Colonialism, and the Case for One Democratic State, London: Pluto Press, 2021
46 পোলিশ মার্কসবাদী সাংবাদিক ও চিন্তক আইজ্যাক ডয়েচার (Isaac Deutscher) এই ফাঁদে পা দিয়েছেন। তিনি ইজরায়েলের অন্ধভক্ত নন, ইজরায়েলের ব্যাপারে বেশ কিছু সমালোচনাও তাঁর আছে। কিন্তু দুঃখজনকভাবে তিনি ইজরায়েলকে শেতাঙ্গ শাসিত দক্ষিণ আফ্রিকা, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, রোদেশিয়া ও অস্ট্রেলিয়ার মতো সেটলার ঔপনিবেশিক রাষ্ট্রগুলোর সাথে তুলনা না করে তুলনা করেছেন ইন্ডিয়া, বার্মা, ঘানা, আলজেরিয়াসহ উপনিবেশের বিরুদ্ধে সংগ্রামের মধ্য দিয়ে জন্ম লাভ করা রাষ্ট্রগুলোর সাথে। তিনি ইজরায়েলের সমালোচনা করছেন ঠিকই কিন্তু অপরাপর জাতিরাষ্ট্রের সাধারণ প্রগতিশীল চরিত্রের অবক্ষয়ের অংশ হিসেবেই ইজরায়েলের অবক্ষয়কে দেখছেন: “Even those young nation-states that have come into being as the result of a necessary and progressive struggle waged by colonial and semi-colonial peoples for emancipation— India, Burma, Ghana, Algeria, and others— cannot preserve their progressive character for long….. In our epoch any nation-state, soon after its constitution, begins to be affected by the general decline of this form of political organization; and this is already showing itself in the short experience of India, Ghana, and Israel.” দেখুন: “The Non-Jewish Jew”, in The Non-Jewish Jew, p.40-41

উপনিবেশ-বিরোধী সংগ্রামের মধ্য দিয়ে উঠে আসা রাষ্ট্রগুলোর সাথে ইজরায়েলকে একই পাল্লায় মাপার এই প্রবণতা বিভ্রান্তিকর। আমরা এ প্রবন্ধে দেখিয়েছি, ইন্ডিয়াসহ একদা উপনিবেশিত অঞ্চলগুলো আধুনিক জাতিবাদের কাছ থেকে অনুপ্রেরণা নিয়েছে ঠিকই, তবে তা আধুনিক জাতিবাদের মুক্তিদায়ী প্রতিশ্রুতি থেকে নিংড়ানো অনুপ্রেরণা যা দিয়ে এসব অঞ্চল খোদ জাতিবাদের ঔপনিবেশিক প্রবণতার তীব্র বিরোধিতায় লিপ্ত হয়েছে এবং কালক্রমে স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে। অন্যদিকে, জায়নবাদ, আধুনিক ইউরোপীয় জাতিবাদের ঔপনিবেশিক চরিত্র অনুকরণ ও আত্মস্থ করার মধ্য দিয়ে ঔপনিবেশিক শক্তি রূপে হাজির হয়েছে। এই পার্থক্য চিহ্নিত না করলে ইজরায়েলকে এক প্রকার দায়মুক্তি দেয়া হয়। 

১৯৬৭ সালের যুদ্ধের পর আইজ্যাক ডয়েচার অবশ্য তাঁর অবস্থান কিছুটা পরিবর্তন করেছেন। এ পর্বে এসে তিনি লিখছেন: “The nationalism of the people in semi-colonial or colonial countries, fighting for their independence, must not be put on at the same moral-political level as the nationalism of conquerors and oppressors.  The former has its historic  justification and progressive aspect which the latter has not. Clearly Arab nationalism, unlike the Israeli, still belongs to the former category.” দেখুন: Isaac Deutscher, “The Israel-Arab War, June 1967”, in The Non-Jewish Jew, p.138

ডয়েচারের এই বিশ্লেষণ আগের বিশ্লেষণের তুলনায় অধিকতর সঠিক হলেও পুরোপুরি সন্তোষজনক নয়। এর মধ্য দিয়ে তিনি বলার চেষ্টা করছেন যে, ইজরায়েল এক সময় উপনিবেশ-বিরোধী জাতীয়তাবাদের বৈশিষ্ট্য ধারণ করলেও কালক্রমে (সাতষট্টির যুদ্ধের মাধ্যমে) তা হারাচ্ছে। ইজরায়েল যে ঔপনিবেশিক জায়নবাদের আবশ্যিক পরিণতি—যা একসময় খোদ এই আন্দোলনের রূপকাররা অস্বীকার করেননি—ডয়েচারের বিশ্লেষণে সেই সত্য আড়াল হয়। 

তবে ডয়েচারের বইটির গুরুত্ব অন্যখানে। তিনি আধুনিক ইহুদি ঐতিহ্যে সর্বজনীন চিন্তায় সক্ষম দার্শনিকদের (স্পিনোজা, মার্কস, ফ্রয়েড, হাইনরিশ হাইনে, রোজা লুক্সেমবার্গ, ট্রটস্কি প্রমুখ) তাৎপর্য তুলে ধরেছেন যারা ইহুদি হয়েও ইহুদিত্বের বৃত্তে নিজেদের সীমাবদ্ধ রাখেননি। দেখুন: Issac Deutscher, The Non-Jewish Jew and other Essays, New York: Hill and Wang, 1968 

রাজনৈতিক ধারণা হিসেবে ‘পাকিস্তান’কে ‘মুসলিম জায়ন’ অভিহিত করে আরেকদিক থেকে ইতিহাসবিদ ফায়সাল দেভজিও (Faisal Devji) একই ভুল করেছেন। তিনি পাকিস্তান আন্দোলনের উপনিবেশ-বিরোধী চরিত্র এবং ইজরায়েলের ঔপনিবেশিক চরিত্রকে আমলে নেননি। পাকিস্তান আন্দোলন যদি মুসলমানদের স্বতন্ত্র আবাসভূমি হিসেবে মক্কা কিংবা আরবের কোনো অঞ্চলকে বেছে নিত তাহলে দেভজির এই অদ্ভুত তুলনার কিছুটা প্রাসঙ্গিকতা থাকত। দেখুন: Faisal Devji, Muslim Zion: Pakistan as a Political Idea, Cambridge: Harvard University Press, 2013

47 Alan R. Taylor, “Vision and Intent in Zionist Thought”, in Transformation of Palestine

বিজ্ঞাপন

Subscribe
Notify of
guest
0 Comments
Oldest
Newest Most Voted
Inline Feedbacks
View all comments

স্বত্ব © ২০২৩, যোগাযোগ | ই মেইল : jogajogbd.org@gmail.com

যোগাযোগ-এ প্রকাশিত কোনো লেখা, ছবি কিংবা শিল্পকর্ম লেখক অথবা কর্তৃপক্ষের অনুমতি ছাড়া কোথাও প্রকাশ করা অবৈধ৷