বঙ্গ-ভাষার উপর মুসলমানের প্রভাব

শ্রী দীনেশচন্দ্র সেন

যোগাযোগ ডেস্ক

দীনেশচন্দ্র সেন (১৮৬৬-১৯৩৯)। ১৮৬৬ সালের ৩ নভেম্বর ঢাকা জেলার বগজুরী গ্রামে জন্ম নেন দীনেশচন্দ্র সেন। ব্রাহ্ম-বিশ্বাস অনুসারী শিক্ষক-উকিল ঈশ্বরচন্দ্র সেন ও সনাতন ধর্মাবলম্বী রূপলতা দেবীর সন্তান ছিলেন তিনি। বাল্যকাল থেকে বাংলা ভাষা ওসাহিত্যের গবেষণায় তিনি সাধক হয়ে ওঠেন। ঢাকার বিভিন্ন স্কুল ও ঢাকা কলেজে অধ্যয়নের মাধ্যমে তিনি এন্ট্রান্স ও এফ. এ. (ইন্টারমিডিয়েট) পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। ১৮৮৯ সালে দীনেশচন্দ্র সেন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে প্রাইভেট ছাত্ররূপে ইংরেজী ভাষা ও সাহিত্যে দ্বিতীয় শ্রেণীতে অনার্সসহ বি.এ. পাশ করেন। তিনি হবিগজ্ঞ হাইস্কুল, কুমিল্লার শম্ভুনাথ ইনস্টিটিউশন ও ভিক্টোরিয়া স্কুলে প্রধানশিক্ষকের দায়িত্ব পালন করেন। ১৯০৯ সালে দীনেশচন্দ্র সেন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের রিডার নিযুক্ত হন এবং পরের বছরই তিনি সিনেট সদস্যপদ লাভ করেন। তিনি ১৯১৩ সালে বিশ্ববিদ্যালয়ের রামতনু লাহিড়ী রিসার্চ ফেলাে নিযুক্ত হন। ১৯২০ সালে এই বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা ভাষা ও সাহিত্য বিভাগের বিভাগীয় প্রধানের পদে অভিষিক্ত হন। পরের বছর তাঁকে ডি. লিট. (ডক্টর অব লিটারেচার) উপাধি দেয় কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় । সরকার তাকে ‘রায়বাহাদুর’ খেতাবে ভূষিত করে। বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের এই পণ্ডিত অসম্ভব নিষ্ঠাবান শিক্ষক ও দেশপ্রেমিক ছিলেন। তাঁর মতাে মানবপ্রেমী সমাজে দুর্লভ। বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের আরেক দিকপাল কবি জসীম উদ্‌দীনকে দীনেশচন্দ্র সেনের পিতৃতুল্য অভিভাবকত্বে প্রতিষ্ঠা লাভ করেছিলেন দীনেশচন্দ্র সেন। পূর্ব বাংলার প্রাচীন গীতিকবিতা (পুঁথি) সংগ্রহে বিশেষভাবে ময়মনসিংহ গীতিকা সংগ্রহে কবি জসীম। উদদীন কাজে লাগিয়েছিলেন। বাংলার প্রাচীন পুঁথিসাহিত্য সংগ্রহ ও সম্পাদনায় দীনেশচন্দ্র সেন বিশাল ভূমিকা রেখে গেছেন। বাংলা ও ইংরেজিতে কাব্যগ্রন্থ, ভাষা ও সাহিত্যের গবেষণাগ্রন্থ সব মিলিয়ে তাঁর সত্তরখানা অত্যন্ত মূল্যবান বই প্রকাশিত হয়েছে। তিনি ময়মনসিংহ গীতিকা ইংরেজী ও ফরাসী ভাষায় অনুবাদ করান এবং নিজে ইংরেজীতে ‘History of Bengali Language and Literature’ পুস্তক রচনা করেন; এই বইটি রবীন্দ্রনাথের নােবেল প্রাইজ পাওয়ার পথ সুগম করে। ৭৫ বছর বয়সে ১৯৩৯ সালে দীনেশচন্দ্র সেন ইহলােক ত্যাগ করেন।


মুসলমান আগমনের পূর্বে বঙ্গভাষা কোনো কৃষক রমণীর ন্যায় দীনহীন বেশে পল্লী কুটিরে বাস করিতেছিল। এই ভাষাকে এ্যান্ডারসন, স্ক্রাইন, কেরী প্রভৃতি সাহেবেরা। অতি উচ্চকণ্ঠে প্রশংসা করিয়াছেন। কেরী বলিয়াছেন, “এই ভাষার শব্দসম্পদ ও কথার গাঁথুনি এরূপ অপূর্ব যে, ইহা জগতের সর্বপ্রধান ভাষাগুলির পার্শ্বে দাঁড়াইতে পারে।” যখন কেরী এই মন্তব্য প্রকাশ করেন, তখন বঙ্গীয় গদ্য সাহিত্যের অপোগন্ডত্ব ঘোচে নাই: সে আজ ১২৫ বৎসর হইল। ইউরোপীয় পন্ডিতেরা বলিয়াছেন এমন কোন ভাব নাই, যাহা অতি সহজে, অতি সুন্দর ভঙ্গিতে বাঙ্গলা ভাষায় প্রকাশ না করা যায় এবং এই গুণেই ইহা জগতের সর্বশ্রেষ্ঠ ভাষাগুলির সমকক্ষ। ক্রাইন বলিয়াছেন, “ইটালী ভাষার কোমলতা এবং জার্মান ভাষার অদ্ভুত ভাব প্রকাশ করিবার শক্তি এই মধুরাক্ষরা এবং স্বছন্দগতি বাঙ্গলা ভাষায় দৃষ্ট হয়।”

এই সকল অপূর্ব গুণ লইয়া বাঙ্গলা ভাষা মুসলমান প্রভাবের পূর্বে অতীব অনাদর ও উপেক্ষায় বঙ্গীয় চাষার গানে কথঞ্চিত আত্মপ্রকাশ করিতেছিল। পন্ডিতেরা নস্যাধার হইতে নস্য গ্রহণ করিয়া শিখা দোলাইয়া সংস্কৃত শ্লোকের আবৃত্তি করিতেছিলেন এবং “তৈলাধার পাত্র” কিম্বা পাত্রাধার তৈল” এই লইয়া ঘোর বিচারে প্রবৃত্ত ছিলেন। তাঁহারা হর্ষচরিত হইতে ‘হারং দেহি মে হরিণি› প্রভৃতি অনুপ্রাসের দৃষ্টান্ত আবিষ্কার করিয়া আত্মপ্রসাদ লাভ করিতেছিলেন এবং কাদম্বরী, দশকুমারচরিত প্রভৃতি পদ্য-রসাত্মক গদ্যের অপূর্ব সমাসবদ্ধ পদের গৌরবে আত্মহারা হইতেছিলেন। রাজসভায় নর্তকী ও মন্দিরে দেবদাসীরা তখন হস্তের অদ্ভুত ভঙ্গী করিয়া এবং কঙ্কণ ঝঙ্কারে অলি গুঞ্জনের ভ্রম জন্মাইয়া প্রিয়ে, মূঞ্চময়ি মানমনিদানং” কিম্বা “মুখর মধীরম, ত্যজ মঞ্জীর” প্রভৃতি জয়দেবের গান গাহিয়া শ্রোতৃবর্গকে মুগ্ধ করিতেছিল। সেখানে বঙ্গভাষার স্থান কোথায়? ইতরের ভাষা বলিয়া বঙ্গভাষাকে পন্ডিতমন্ডলী ‘দূর দূর’ করিয়া তাড়াইয়া দিতেন, হাড়ি-ডোমের স্পর্শ হইতে ব্রাহ্মণেরা যেরূপ দূরে থাকেন বঙ্গভাষা তেমনই সুধী সমাজের অপাংক্তেয় ছিল-তেমনি ঘৃণা, অনাদর ও উপেক্ষার পাত্র ছিল।

হীরা কয়লার খনির মধ্যে থাকিয়া যেমন জহুরীর আগমনের প্রতীক্ষা করে, শুক্তির ভিতর মুক্তা লুকাইয়া থাকিয়া যেরূপ ডুবুরীর অপেক্ষা করিয়া থাকে, বঙ্গভাষা তেমনই কোন শুভদিন, শুভক্ষণের জন্য প্রতীক্ষা করিতেছিল। মুসলমান বিজয় বাঙ্গলা ভাষার সেই শুভদিন, শুভক্ষণের সুযোগ আনয়ন করিল। গৌড়দেশ মুসলমানগণের অধিকৃত হইয়া গেল। তাঁহারা ইরান-তুরান যে দেশ হইতেই আসুন না কেন, বঙ্গদেশ বিজয় করিয়া বাঙ্গালী সাজিলেন। আজ হিন্দুর নিকট বাঙ্গলাদেশ যেমন মাতৃভূমি, সেদিন হইতে মুসলমানের নিকট বাঙ্গলাদেশ তেমনই মাতৃভূমি হইল। তাঁহারা এদেশে আসিয়া দস্তুরমত এদেশবাসী হইয়া পড়িলেন। হিন্দুর নিকট বাঙ্গলা ভাষা যেমন আপনার, মুসলমানদের নিকট উহা তদপেক্ষা বেশী আপনার হইয়া পড়িল।

বঙ্গভাষা অবশ্য বহু পূর্ব হইতে এদেশে প্রচলিত ছিল, বুদ্ধদেবের সময়ও ইহা ছিল, আমরা ললিত বিস্তরে তাহার প্রমাণ পাইতেছি। কিন্তু বঙ্গ-সাহিত্যকে একরূপ মুসলমানের সৃষ্টি বলিলেও অত্যুক্তি হইবে না। তাহা আমরা পরে দেখাইব।

চারিদিকে হিন্দু প্রজা, চারিদিকে শঙ্খ ঘন্টার রোল, আরতির পঞ্চপ্রদীপ, ধূপ ধূনা, অগুরুর ধোঁয়া-চারিদিকে রামায়ণ মহাভারতের কথা, এবং ঐ সকল বিষয়ক গান। প্রজাবৎসল মুসলমান সম্রাট স্বভাবতই জানিতে চাহিলেন, “এগুলি কি?” পন্ডিত ডাকিলেন, তিনি তিলক পরিয়া, শিলা দোলাইয়া, নামাবলী গায়ে দিয়া হুজুরে হাজির হইয়া বলিলেন, “এগুলি কি জানিতে চাহিলে আমাদের ধর্মশাস্ত্র জানা চাই। দ্বাদশ বর্ষাকাল ব্যাকরণ পাঠ করিয়া ইহার মধ্যে প্রবেশাধিকার হইতে পারে।” এই ঝুনো নারিকেল না ভাঙ্গিয়া ভিতরের শাঁস খাইবার উপায় নাই। বাদশা ক্রুদ্ধ হইলেন, “আমি ব্যাকরণ বুঝি না, রাজ-কাজ ফেলিয়া আমি ব্যাকরণ শিখিতে যাইব, তাহাও বামুন আমাকে পড়াইবে না,-ও সকল হইবে না। দেশী ভাষায় এই রামায়ণ-মহাভারত রচনা কর।” গৌড়েশ্বর দেশী ভাষা শিখিয়াছিলেন, না হইলে প্রজা শাসন করিবেন কিরূপে? তিনি পুরোদস্তুর বাঙ্গালী সাজিয়াছিলেন-সে কথা পূর্বেই লিখিয়াছি। দেশী ভাষায় ধর্মগ্রন্থ রচনা করিতে হইবে, এই আদেশ শুনিয়া পন্ডিতের মুখ শুকাইয়া গেল, ইতরের ভাষায় পবিত্র দেব-ভাষা রচনা করিতে হইবে, চন্ডালকে ব্রাহ্মণের সঙ্গে এক পংক্তিতে স্থান দিতে হইবে। কিন্তু শত শত কল্লুক ভট্ট, রঘুনন্দন, শত শত স্মৃতি লিখিয়া শত শত বৎসরে যাহা না করিতে পারেন, শাহানশাহ বাদশাহের একদিনের হুকুমে তাহা হয়—রাজশক্তি এমনই অনিবার্য। অগত্যা প্রাণের দায়ে ব্রাহ্মণকে তাহাই করিতে হইল। পরাগলী মহাভারতে উল্লিখিত আছে, “শ্রীযুত নায়ক সে যে নসরত খান, রচাইল পাঞ্চালী সে গুণের নিধান।” এতদ্বারা প্রমাণিত হইতেছে, হুসেন শাহের পুত্র নসরত শাহ মহাভারতের বঙ্গানুবাদ করাইয়াছিলেন। পাঞ্চালী (পাঁচালী) অর্থ মহাভারত। নসরতের আদেশে রচিত মহাভারতের উল্লেখ আমরা পাইয়াছি, কিন্তু পুস্তকখানি এখনও আবিষ্কৃত হয় নাই। এই গ্রন্থ অনুমান ১৪১৮ খৃষ্টাব্দে রচিত হইয়াছিল। তখনও নসরত সম্রাট হন নাই-তাঁহাকে শুধু ‘নায়ক’ বলিয়া উল্লেখ করা হইয়াছে। হুসেন শাহের সেনাপতি পরাগল খাঁ চট্টগ্রাম বিজয়ের জন্য পূর্বাঞ্চলে প্রেরিত হন, তাঁহার বংশধরগণ ফেনী নদীর তীরস্থ পরাগলপুরে (নোয়াখালী জেলায়) এখনও বাস করিতেছেন, এখনও তাঁহারা তথাকার ভূম্যাধিকারী। এক সময়ে পরাগল খাঁ ও তৎপুত্র ছুটি খাঁর প্রতাপ এই প্রদেশে পরিব্যাপ্ত ছিল, ছুটি খাঁর সম্বন্ধে কবি শ্রী করণ নন্দী লিখিয়াছেন, “ত্রিপুরা নৃপতি যার ভয়ে এড়ে দেশ/পর্বত গহবরে গিয়া করিল প্রবেশ।” তখন ত্রিপুরার রাজা ছিলেন মহারাজ ধর্মমাণিক্য। তাঁহার মত এত বড় পরাক্রমশালী রাজা ত্রিপুরার ইতিহাসে আর দ্বিতীয়টি দেখা যায় না। তাঁহার প্রধানমন্ত্রী ছিলেন চাণক্যতুল্য রাজনীতি-বিশারদ রায়চান। এহেন সম্রাটও ছুটি খাঁর ভয়ে উদয়পুরের পার্বত্য দুর্গের নিভৃত কোণে আশ্রয় লইয়াছিলেন বলিয়া শ্রীকরণ নন্দী আমাদিগকে জানাইয়াছেন।

হুসেন শাহের সেনাপতি পরাগল খাঁ কবীন্দ্র পরমেশ্বর নামক জনৈক সুপন্ডিত কবিকে মহাভারতের অনুবাদ রচনা করিতে নিযুক্ত করেন। কবীন্দ্র পরমেশ্বর বহু স্থানে পরাগল খাঁর প্রশংসা করিয়াছেন, ‘শ্রীযুক্ত পরাগল খান পদ্মিনী ভাস্কর তিনি।’ ‘রস বোদ্ধা’, ‘গুণগ্রাহী’ ইত্যাদি বিশেষণ তাঁর প্রতি সর্বদা প্রযুক্ত হইয়াছে। কবীন্দ্র পরমেশ্বর ও শ্রী করণ নন্দী উভয়েই মহাভারত অনুবাদের একটা সংক্ষিপ্ত ইতিহাস দিয়াছেন। কবীন্দ্র লিখিয়াছেন, “নৃপতি হুসেন শাহ গৌড়ের ঈশ্বর/তান হক্ সেনাপতি হওন্ত লস্কর।। লস্কর পরাগল খান মহামতি/পঞ্চম গৌড়েতে যার পরম সুখ্যাতি।। সুবর্ণ বসন পাইল অশ্ব বায়ু গতি। লস্করী বিষয় পাই আইবন্ত চাহিয়া/চাটিগ্রামে চলি গেল হরষিত হৈয়া।। পুত্র পৌত্রে রাজ্য করে খান মহামতি/পুরাণন শুনস্ত নিত্য হরষিত মতি।।”

কবীন্দ্র পরমেশ্বর সংস্কৃতে বিশেষ ব্যুৎপন্ন ছিলেন এবং তিনি মহাভারতের স্ত্রী-পর্ব পর্যন্ত অনুবাদ রচনা করেন। পরাগলের বিজয়দৃপ্ত সুযোগ্য পুত্র ছুটি খাঁ শ্রী করণ নন্দীর দ্বারা মহাভারতের অশ্বমেধ পর্বের অনুবাদ সংকলন করাইয়াছিলেন।

শ্রী করণ নন্দী তাঁহার গ্রন্থের ভূমিকায় ঐতিহাসিক অনেক কথাই লিখিয়াছেন। পরাগল খাঁর আদেশে বিরচিত মহাভারতের এক জায়গায় কবীন্দ্র পরাগল-তনয় ছুটি খাঁর উল্লেখ করিয়াছেন, “তনয় ছুটি খাঁ পরগ উজ্জ্বল/কবীন্দ্র পরমেশ্বর রচিল সকল।”

সেই স্বভাবের নিভৃত পরম সুন্দর নিকেতন চন্দ্রশেখর পর্বতের ক্রোড়দেশে, শ্যামল বনস্পতি সচল মুক্তার পংক্তির ন্যায় নির্ঝরধরা অধ্যূষিত পরম রমণীয় রাজধানীতে বসিয়া প্রজারঞ্জক বা মহাবীর মুসলমান সেনাপতিরা হিন্দু পণ্ডিতের দ্বারা রামায়ণ ও মহাভারতের অনুবাদ করাইয়াছিলেন। তাঁহাদের কীর্তি জগতে সুপ্রতিষ্ঠিত হউক-এই ছিল হৃদয়ের আকাঙক্ষা। সে কামনা চরিতার্থ হইয়াছে। আজ ৪৫০ বৎসর পরে তাঁহাদের মাতৃভাষার গৌরবের সঙ্গে প্রজারঞ্জক এই রাজাদের কাহিনী দেশবিশ্রুত হইয়াছে। পরাগল খাঁর পিতা রাস্তি খানের সমাধি এখনও পরাগল পুরে বিরাজিত। ঐ পল্লীতে বিশাল পরাগলী দীঘি এখনও সেই মহামান্য লস্কর খানের স্মৃতি বহন করিয়া তরঙ্গায়িত হইতেছে।

হুসেন শাহ এবং অপরাপর মুসলমান সম্রাটেরা দেশীয় ভাষায় কতটা অনুরাগী ছিলেন, তাহার প্রমাণ প্রাচীন বঙ্গ-সাহিত্যের অনেক স্থানেই পাওয়া যায়। কবি বিদ্যাপতি লিখিয়াছেন, “সে যে নসিরা শাহজাদা যারে হানিল মদন্ বানে/চিরঞ্জীবী রহ প্রভু গৌড়েশ্বর; কবি বিদ্যাপতি ভনে।” অন্যত্র, “প্রভু গায়েশ উদ্দীন সুলতান।” পঞ্চদশ শতাব্দীতে যখন কবি বিজয় গুপ্ত তাঁহার মনসাদেবীর ভাষান গান রচনা করেন, তখন গৌড়ের তখতে হসেন শাহ সমাসীন ছিলেন। কবি অতি সশ্রদ্ধভাবে তাঁহার উল্লেখ করিয়াছেন, “সনাতন হসেন শাহ নৃপতি তিলক।” কবি যশোরজ খান হসেন শাহ সম্বন্ধে লিখিয়াছেন, “শাহ হুসেন, জগত ভূষণ, সেই রস জানে/গৌড়েশ্বর, ভোগ পুরন্দর যশোরাজ খানে।”

কৃত্তিবাস রামায়ণের আদি অনুবাদ সংকলন কর্তা। তিনিও কোনো গৌড়েশ্বরের আদেশে রামায়ণের বঙ্গানুবাদ রচনায় হস্তক্ষেপ করেন। দুঃখের বিষয়, কবি যদিও রাজসভার একটি আলেখ্য দিয়াছেন, অনেক সচিব ও মন্ত্রীর নাম করিয়াছেন, তথাপি গৌড়েশ্বরের নামটি দেন নাই। ইহা কিছু আশ্চর্যের কথা নহে। যেহেতু এখন কোন সভাসমিতি বা রাজকার্য উপলক্ষে উপস্থিত রাজপুরুষগণের নাম দেওয়া হয়, কিন্তু বড়লাট অথবা ছোটলাটকে কেবল ভাইসরয় কি গবর্ণর নামে উল্লেখ করিবার পদ্ধতি দৃষ্ট হইয়া থাকে। তখন যিনি সর্বজনপরিচিত ছিলেন, এখন তাঁহার পরিচয়ের দরকার হইয়াছে। সেই সভা মুসলমান প্রভাবান্বিত ছিল-কেদার খাঁ প্রভৃতি নামের পশ্চাতে খাঁ উপাধি দৃষ্টে তাহাই প্রমাণিত হইয়াছে। বঙ্গের ইতিহাসে সেই যুগে একমাত্র রাজা গণেশ ক্ষণেকের বিদ্যুৎচমেকের ন্যায় হিন্দুশক্তির স্ফূরণ দেখাইয়াছিলেন এবং তারপর মুসলমানগণের হস্তে পুনরায় রাজদন্ড আসিয়া পড়িয়াছিল। গণেশের পুত্র যদু জালালউদ্দিন নাম গ্রহণ করিয়া মুসলমান ধর্ম অবলম্বনপূর্বক হিন্দু সিংহাসনে তাঁহার দাবী রক্ষা করিয়াছিলেন। রাজা গণেশ স্বয়ং হিন্দু হইলেও তাঁহার উপর মুসলমান প্রভাব এত বেশী হইয়াছিল যে, তিনি মুসলমানদিগের বিশেষ সাহায্য পাইয়া রাজতখত অধিকার করিতে সমর্থ হইয়াছিলেন। সন-তারিখের সূক্ষ্ম আলোচনা করিলে মনে হয়, এই গণেশ রাজাই কৃত্তিবাসকে রামায়ণের অনুবাদ সংকলনের আদেশ প্রদান করিয়াছিলেন। তৎপূর্ববর্তী গৌড়ের মুসলমান সম্রাটগণ হয়ত হিন্দু পন্ডিত দ্বারা সংস্কৃত পুরাণের বঙ্গানুবাদ সংকলনের প্রথা প্রচলন করিয়াছিলেন মাত্র; তাহার একটি প্রমাণ এই যে, গৌড়ের শামসুদ্দিন ইউসুফ শাহ ১৩১৫ শকাব্দে (১৩৭৩ খৃ.) মালাধর বসুকে “শুণরাজ খাঁ” উপাধি দিয়া তাঁহার দ্বারা ভাগবতের দশম ও একাদশ স্কন্দের অনুবাদ করিয়াছিলেন। মালাধর বসু কুলীন গ্রামবাসী বিখ্যাত বসুবংশীয় এবং কৃত্তিবাসের প্রায় সমসাময়িক কবি। পর পর অনেক মুসলমান সম্রাটের সঙ্গে বঙ্গীয় পুরাণানুবাদকের নাম গ্রথিত দেখা যায়। সুতরাং আমাদের নিঃসন্দেহভাবে এই ধারণা বদ্ধমূল হইয়াছে যে, গৌড়েশ্বরগণের সহায়তা না পাইলে বঙ্গভাষা মাথা উঁচু করিয়া সুধী সমাজে দাঁড়াইতে পারিত না, মাথা হেঁট করিয়া পল্লীর এক কোণে চির উপেক্ষিতা হইয়া পড়িয়া থাকিত। এই সকল পুস্তক যে বাঙ্গলা ভাষায় বিরচিত হইতেছিল, ব্রাহ্মণগণ উহা কিরূপ চক্ষে দেখিতেন, তাহা তাঁহাদের রচিত কয়েকটি সংস্কৃত শ্লোক ও বাঙ্গলা প্রবাদ বাক্য হইতে পরিষ্কারভাবে জানা যায়। ‘অষ্টাদশ পুরাণমণি রামস্য চরিতানিচ। ভাষায়াং মানবং শুত্বা রৌরবং নরকং ব্রজে” অর্থাৎ অষ্টাদশ পুরাণ ও রামায়ণ যাহারা বাঙ্গলা ভাষায় শ্রবণ করিবে, তাহারা রৌরব নামক নরকে গমন করিবে। ব্যক্তিগতভাবে কৃত্তিবাস ও কালীদাস এই কুকার্য করিয়াছিলেন বলিয়া তাঁহারা ব্রাহ্মণের ক্রোধবহ্নি হইতে নিভৃতি পান নাই। আশ্চর্যের বিষয় এই যে, কায়স্থকুলোদ্ভব কাশীদাস তাঁহার মহাভারতের প্রতি পত্রে ব্রাহ্মণদের এত স্তব-স্তুতি করিয়াও তাঁহাদের অভিশাপ হইতে অব্যাহতি পান নাই। তিনি তো ভনিতায় “মস্তকে রাখিয়া ব্রাহ্মণের পদরাজ্যঃ” প্রতি পৃষ্ঠায় লিখিয়া তাঁহাদের মনস্তুষ্টি করিতে চেষ্টা পাইয়াছিলেন।

কিন্তু তথাপি ব্রাহ্মণ রচিত এই প্রবাদ বাক্য-“কৃত্তিবেশে কাশীদেশে আর বামুন ঘেঁষে এই তিন সর্বনেশে” (কৃত্তিবাস, কাশীদাস এবং যাহারা বামুনদের সঙ্গে ঘেঁষিয়া সমান হইতে চায়–এই তিন সর্বনেশে) এখনও স্মরণীয় হইয়া আছে। এহেন প্রতিকূল ব্রাহ্মণ সমাজ কি হিন্দু রাজত্ব থাকিলে বাঙ্গলা ভাষাকে রাজসভার সদর দরজায় ঢুকিতে দিতেন? সুতরাং এ কথা মুক্তকণ্ঠে বলা যাইতে পারে যে, মুসলমান সম্রাটেরা বাঙ্গলা ভাষাকে রাজ দরবারে স্থান দিয়া ইহাকে ভদ্র সাহিত্যের উপযোগী করিয়া নূতনভাবে সৃষ্টি করিয়াছিলেন।

আরাকান রাজের প্রধান সচিব মুসলমানধর্মী ছিলেন, কিন্তু তাঁহার নাম ছিল মাগন ঠাকুর। ১৬২৬-২৭ খৃঃ অব্দে মাগন ঠাকুর সৈয়দ আলওয়াল নামক কবিকে মালিক মোহম্মদ রচিত পদ্মাবৎ নামক হিন্দী কাব্যের বাঙ্গলা তরজমা করিতে নিযুক্ত করেন। বাঙ্গলা পদ্মাবৎ গ্রন্থের উল্লেখ আমরা পুনরায় করিব। দৌলত কাজী নামক এক কবি “লোর চন্দ্রানি” নামক কাব্য রাজানুগ্রহে রচনা করেন।

মুসলমান রাজ-রাজারা যে রীতি প্রবর্তন করেন, তাহা ব্রাহ্মণগণের নিষেধ-বিধি ও উপেক্ষা অগ্রাহ্য করিয়া প্রচলিত হইয়াছিল; শাহানশাহ বাদশাহগণ যাহা করিলেন, ছোট ছোট হিন্দু রাজন্যবর্গ তাহার অনুকরণ করিতে লাগিলেন। এইভাবে বঙ্গভাষা ক্ষুদ্র-বৃহৎ রাজসভায় প্রতিষ্ঠা পাইয়া বিজয়ী হইল। ব্রাহ্মণগণই স্বয়ং রৌরব নরকের ভয় অতিক্রম করিয়া শাস্ত্রগ্রন্থের বঙ্গানুবাদ প্রণয়নে তৎপর হইলেন। আমরা ষোড়শ শতাব্দীর কবি ষষ্ঠিবরকে জগদানন্দ নামক মুরুব্বীর আদেশে মহাভারতের অংশবিশেষের অনুবাদ করিতে দেখিতে পাই। এই ব্যক্তি সম্ভবতঃ কোন জমিদার বা প্রসিদ্ধ ব্যক্তি ছিলেন। মুসলমানগণ এইভাবে বঙ্গদেশে বাঙ্গলা ভাষাকে সুপ্রতিষ্ঠিত করিয়া আমাদের সাহিত্যে এক নূতন যুগ আনয়ন করিলেন। শুধু তাহাই নয়, তাঁহাদের প্রভাব আমাদের ভাষার বক্ষে আরবী-ফাসীর ভৃগু পদচিহ্ন অঙ্কিত করিয়া দিল। প্রাকৃত ভাষার উপর ঐ সকল বিদেশী ভাষার দুচ্ছেদ্য ছাপ পড়িয়া গেল। মুসলমানেরা রাজ-ততে বসিলেন। তাঁহারাই সর্ববিষয়ে দেশে প্রাধান্য লাভ করিলেন। বিলাসের আসবাব রাজদরবারে যাহা কিছু শাসন সংক্রান্ত সমস্ত উচ্চপদ তাঁহাদের অধিকৃত হইল। বাঙ্গলা ভাষার অভিধান বদলাইয়া গেল। ‘রাজস্ব’ শব্দ ‘খাজনায়’ পরিণত হইল, ‘প্রজা’রা ‘রায়ৎ’ হইয়া গেল। ‘মহাপাত্র’ ‘উজীর’ হইলেন, ‘নিশিপতি’ ‘কোটাল’ হইল, ‘ধর্মাধিকারী’, ‘কাজী’ হইলেন, ‘ভৃত্য’ ‘নফর’ হইল, ‘দোষী ব্যক্তি’ ‘আসামী হইল, অভিযোগ-কারী ‘ফরিয়াদী’ হইলেন। ‘বিচারালয়’ বা ‘রাজসভা’ ‘আদালত’ ও ‘দরবারে’ পরিণত হইল। ‘প্রভু’ হইলেন ‘হুজুর’, ‘দাস’ হইল ‘খেদমতগার’। এইরূপ অসংখা শব্দ আলোচনা করিলে দেখা যাইবে যে, জাতীয় জীবনের উচ্চত্তরের ভাষা অনেকটা পরিবর্তিত হইয়া গেল। যেখানে বিলাস, যেখানে আমোদ-প্রমোদ, সেখানেও বিজেতাদের ভাষা প্রভাব বিস্তার করিল। যাহা সামাজিক জীবনের অধঃস্তরের কথা, সেই শব্দগুলি শুধু প্রাকৃত ভাবাপন্ন রহিয়া গেল। কুটির বা কুঁড়ে কথার পরিবর্তন হইল না, মেটে তেলের দীপটি কুঁড়েঘরে ‘প্রদীপ’ বা ‘পিদিম’ হইয়া জ্বলিতে লাগিল, কিন্তু রাজপ্রাসাদে বা প্রাসাদোগম গৃহের আলো, ঝাড়, ফানুস, দেয়ালগিরি প্রভৃতি নাম বিদেশী কায়দা অবলম্বন করিল। শেষোক্ত শব্দটির শেষাংশ ফরাসীর অপভ্রংশ। ভাত, ডাইল, তেল, ঘি, ক্ষেতের শস্য প্রভৃতি নাম বদলাইল না। কিন্তু খাদ্য যেখানে উপাদেয় ও বিলাসীর যোগ্য, তখন তাহা ‘খানা’ হইয়া গেল। ক্ষেত যখন প্রভুত্বের নিদর্শন সেখানে তাহা ‘জমি’। ‘ভূস্বামী’ জমিদার হইয়া পড়িলেন। দেশের বাণিজ্য ধীরে ধীরে মুসলমানের হস্তগত হইল, তখন উহার নাম হইল ‘কারবার’, কারবারের সঙ্গে “আমদানী’ ‘রঙানী’ও বঙ্গভাষায় ঢুকিল। সৌখিন লোকদের সুগন্ধি-অগুরু ও চন্দনের স্থলে ‘আতর’ ‘খোশবো’ অধিকার করিয়া লইল। আকাশের বায়ু, তারা, চাঁদ, সূর্য এইগুলি অভিধানে রহিয়া গেল কিন্তু যেখানে বড় মানুষদের গৃহ কৃত্রিম আলোমালায় সুশোভিত হইল, সেখানে তাহা ‘রৌশনাই’ নাম ধারণ করিল। পূর্বে মাগধী ‘সূত’ ও ‘বন্দীরা’ শ্রুতিমধুর বন্দনাগীতি বাদ্যযন্ত্রের সঙ্গীতের সঙ্গে মিল রাখিয়া প্রত্যুষে গান করিত। সেই সঙ্গীতের মোহনীয় গুণে রাজাদের নিদ্রাভঙ্গ হইত, কিন্তু এখন তাহার স্থলে ‘রৌশনিচৌকী’ ‘নহবত’ ইত্যাদি শব্দ প্রবর্তিত হইল। ‘রাজসিংহাসন’ ‘তখত্-নামায়’ পরিণত হইল। তাহা ছাড়া বিচারালয়ের সমস্ত শব্দ, ‘মতরজ্জম’, ‘নাজির’, ‘দলিল’, ‘দপ্তরখানা’, ‘মোক্তার’ ‘আইন’ ‘মুসাবিদা’ ‘পেয়াদা’ ‘খাজাঞ্চিখানা’ ‘উকীল’ ‘আরজী’ প্রভৃতি শত শত শব্দ প্রাচীন ভাষার প্রাকৃত শব্দের স্থল কাড়িয়া লইয়া নিজেদের অধিকার বিস্তার করিল।

মুসলমানেরা এদেশ বিজয় করিয়া প্রভুত্ব করিয়াছিলেন এবং জীবনের ‘ক্ষীরসর নবনীত’ সমস্ত ভোগ করিতেছিলেন-তাহা কোন ইতিহাসে লেখা না থাকিলেও শুধু বাঙ্গলা ভাষা আলোচনা করিলেই স্পষ্টভাবে বুঝা যাইতে পারে। আমরা দেখিতে পাইলাম, বঙ্গভাষা মুসলমান সম্রাটদের কৃপায় দ্বিতীয়বার জন্মগ্রহণ করিয়া ‘দ্বিজের’ ন্যায় সম্মান লাভ করিল। বঙ্গভাষার উপর আরবী ও ফারসী তাহাদের সুস্পষ্ট ছাপ অঙ্কন করিয়া দিল। এইবার আমরা দেখাইব তাঁহারা শুধু বঙ্গভাষার উপর পূর্বোক্ত প্রভাব বিস্তার করিয়াই নিরস্ত হন নাই, তাঁহারা বঙ্গভাষাকে অপূর্ব কবিত্ব সম্পদে ভূষিত করিয়াছেন। তাঁহারা মুসলমানী কিতাব লিখিয়া বাঙ্গলাকে উর্দুর দিকে টানিয়া আনিয়াছেন সত্য, কিন্তু বিকৃত মুসলমানী বাঙ্গলায় আমরা বঙ্গভাষায় তাঁহাদের রচনার উৎকর্ষের বিশিষ্ট নিদর্শন পাই নাই।

অনুমান ১৫৭৮ খৃষ্টাব্দে ফতেয়াবাদ পরগণায় সৈয়দ আলওয়ালের জন্ম হয়। ইনি বাঙ্গলা ভাষায় এতটা সংস্কৃত শব্দ আমদানী করিয়াছেন যে, স্বয়ং ভারতচন্দ্রও ততটা করিয়াছেন কিনা সন্দেহ। ইনি সংস্কৃত ভাষার ব্যাকরণ, অলঙ্কার ও সাহিত্যে বিশেষ বৃৎপন্ন ছিলেন এবং স্বীয় পদ্মাবৎ গ্রন্থে অনেক সংস্কৃত শ্লোক নিজে রচনা করিয়া জুড়িয়া দিয়াছেন। আলওয়ালই তাঁহার আদি বার্তাবহ। তাঁহার কাব্য এখনও চাটগাঁয়ের মুসলমানেরা দল বাঁধিয়া গান করিয়া বেড়ায় এবং ইহা বড়ই আশ্চর্যের বিষয় যে, মুসলমান শ্রোতাগণ এরূপ সংস্কৃতাত্মক একখানি কাব্যের রস আস্বাদ করিয়া থাকে। চাটগাঁয়ের মুসলমানদের রীতি অনুসারে এই বাঙ্গলা পদ্মাবৎ গ্রন্থ ফারসী অক্ষরে লিখিত হইয়া থাকে। পুস্তকের রচনা হইতে একটি নিদর্শন দিতেছিঃ

‘বসন্তের নাগরবর নাগরী বিলাসে।

বরবালা দুই ইন্দু সবে যেন সুধা বিন্দু

মৃদুমন্দ অধরে ললিত মধু হাসে।

প্রফুল্লিত কুসুম, মধুব্রত ঝংকৃত

হুংকৃত, পরভূত কৃষ্ণে রতরাসে।

মলয় সমীর সুসৌরভ সুশীতল, 

বিলুলিত স্পতি অতিশয় রসভাসে

প্রফুল্লিত বনস্পতি; কুটিল তমাল ভ্রম,

মুকুলিত চ্যুতলতা কোরক জালে।

যুবজন হৃদয়, আনন্দে পরিপুরিত

বঙ্গ মল্লিকা মালতী মালো।

মধু সেনাপতি সঙ্গে মদন মেদিনী পতি বাহিনী 

কোরক নব পল্লব পূর্ণিত।

নবদণ্ড কেশর, চামর সৌরভ, 

ভুবন বিজয়ী চিত্ত যুবক শাসিত।

চৌদিকে যুবতিকূল, মাঝে শুনায় রব 

নৃত্যগীত অতিশয় আনন্দে বিভোরে। 

রোমাঞ্চিত শরীর, শ্রমিতা প্রেমভাসে অতিরসে। 

রমণী ললিত পতি উরে।।”

 

এই কবিতাটি পড়িতে পড়িতে–

মদন মহিপতে কনক দণ্ড

রুচি কেশর কুসুম বিকাশে, 

মিলিত শিলী মুখ পাটলি পটলকৃত 

স্মর তুণ বিকাশে।। 

উন্মাদ মদন মনোরথ পথিক, 

বধূজন জনিত বিলাপে। 

অসিকুল সঙ্কুল, কুসুম সমূহ 

নিরাকুল বকুল কলাপে।।”

প্রভৃতি জয়দেবের কবিতাগুলি স্বতঃই মনে পড়িবে। কিন্তু আলওয়ালের ছন্দসম্পদ ছিল অপূর্ব। নিরঙ্কর চাষাদের আবৃত্তিতে ও ফারসী অক্ষরের নোক্তার গোলযোগে সেই ছন্দগুসির অনেক বিভ্রাট হইয়াছে। এতবড় পণ্ডিতের রচনায় যদি ভুল পাওয়া যায়, তবে অবশ্যই স্বীকার করিতে হইবে, তাহা কখনই তাহার কৃত নহে, তাহা নিশ্চয়ই নকলের বিভ্রাটে। যিনি মগন, রগন প্রভৃতি অলঙ্কার শাস্ত্রের মূল সূত্র লইয়া এতটা সূক্ষ্ম বিচার করিয়াছেন ও স্বয়ং বহু সংস্কৃত শ্লোক রচনা করিয়াছেন, তাঁহার মূল রচনায় সে সকল দোষ কখনই ছিল না। বিশেষ বিশেষ ছন্দের জ্ঞান না থাকিলে আলওয়ালের সকল কবিতা আবৃত্তি করা সহজ হইবে না।

আলওয়াল জীবনে বহু কষ্ট সহ্য করিয়াছিলেন, যৌবনে এক জাহাজে চড়িয়া তাঁহার পিতা মজলিস কাজির সংগে বঙ্গোপসাগরে যাইতেছিলেন। পর্তুগীজ জলদস্যুরা তাঁহাদের জাহাজ আক্রমণ করে। সেই সমুদ্রবক্ষে জাহাজের উপর ছোটখাট একটি জলযুদ্ধ হয়। আলওয়ালের পিতা যুদ্ধে নিহত হন। কোন রকমে অব্যাহতি লাভ করিয়া আলওয়াল আরাকান যাইয়া তথাকার সচিব মাগন ঠাকুরের আশ্রয় লাভ করেন। মহামান্য মাগন ঠাকুর তাঁহার পান্ডিত্য ও কবিত্ব দেখিয়া মুগ্ধ হন এবং তাঁহারই আদেশে আলওয়াল ‘পদ্মাবৎ’ কাব্যের অনুবাদ করিতে প্রবৃত্ত হন। এই সময় সুজা বাদশাহ আরাকানে উপস্থিত হন এবং তাঁহার সহিত আরাকানরাজের মনোমালিন্য ঘটে। সুজা বাদশাহের গুপ্তচর বলিয়া আলওয়াল একটি মিথ্যাবাদী লোকের সাক্ষ্যে অভিযুক্ত হন এবং কারাগারে নিক্ষিপ্ত হইয়া সাত বৎসরকাল কারাযন্ত্রণা ভোগ করেন। তৎপরে উদ্ধার পাইয়া তিনি “ছয়ফল মুল্লুক ও বদিউজ্জামাল” নামক একখানি বাঙ্গলা কাব্য রচনা করেন। আলওয়ালের আরও অনেক কাব্য চট্টগ্রাম অঞ্চলে এখনও সাদরে পঠিত ও গীত হইয়া থাকে। তিনশত বৎসর পরেও যে কবির কাব্য জনসাধারণ হৃদয়ে গাঁথিয়া রাখিয়াছেন, তাঁহার কবিতার গুণাগুণ আর সমালোচনাসাপেক্ষ নহে। তিনশত বৎসর যাবৎ যে কাব্য লোকের হৃদয়ে আনন্দ দান করিয়াছে, তাহার সমালোচনার আর বাকী কী আছে?

বাঙ্গলার একটি প্রদেশের একখানি ক্ষুদ্র ইতিহাস আছে। ইহা এত ছোট যে, ইহাকে একখানি ইতিহাসিকা বলা চলে, ইহার প্রায় ৪০০ ছত্র কবিতা আছে। শমসের গাজি নামক এক দস্যু[1]আমাদের জাতীয় ইতিহাসের এক বিশিষ্ট ব্যক্তিত্ব শমসের গাজি সম্পর্কে … Continue reading কালক্রমে এমন প্রবল হইয়া উঠেন যে, তিনি ত্রিপুরেশ্বরকে সিংহাসনচ্যুত করিয়া তৎস্থলে নিজে অধিষ্ঠিত হন। শমসের আলীবর্দি খাঁর সমসাময়িক লোক ও প্রায় দুইশত বৎসর পূর্বে জীবিত ছিলেন। এখনও শমসের গাজির গান ত্রিপুরায় গীত হইয়া থাকে। অবশ্য ত্রিপুরার ‘রাজমালা’ গ্রন্থে-এই দস্যু প্রবরের বিবরণ সংক্ষেপে লিপিবদ্ধ আছে। শমসের গাজির বিবরণ সমস্তই ঐতিহাসিক। ইনি রাজপদ প্রাপ্ত হইয়া দেশে শিক্ষা প্রচলনের যে রীতি প্রবর্তিত করিয়াছিলেন, ধান-চাউল ও অপরাপর খাদ্যদ্রব্যের এবং সোনা-রূপার যে দর বাঁধিয়া দিয়াছিলেন, রাস্তাঘাট নির্মাণ করিয়া দেশের যে উন্নতি সাধন করিয়াছিলেন, তাহার একটি নিখুঁত ও খাঁটি চিত্র আমরা এই পুস্তকখানিতে পাইয়াছি। যখন শমসের দস্যু ছিলেন, তখনও রাজা হন নাই, সেই সময় তিনি সমস্ত দেশে লুন্ঠন করিয়া বেড়াইতেন। সেই লুন্ঠনপ্রাপ্ত অপর্যাপ্ত ধন তিনি উদয়পুরের পার্বত্য প্রদেশে অরণ্যবহুল গিরিকন্দরে লুকাইয়া রাখিতেন। তাহার লোকেরা জনৈক সূত্রধরকে নিবিড় জঙ্গলে ডাকিয়া আনিত। সেই সূত্রধরকে সঙ্গে করিয়া তিনি একা শালবনে ঢুকিতেন। শালতরুর কাণ্ডে গর্ত করিয়া তিনি তন্মধ্যে বহু অর্থ লুক্কায়িত করিয়া রাখিতেন, তদনন্তর সূত্রধর সেই গর্তের মুখ শালগাছের বাকল দিয়া এমন কৌশল বেমালুম ঢাকিয়া ফেলিত যে, বাহির হইতে সেই অর্থের কোন চিহ্নই পাওয়া যাইত না। তারপর সূত্রধরের পুরস্কারের পালা। শমসের মুক্ত কৃপাণ দ্বারা সূত্রধরের শিরচ্ছেদ করিয়া ফেলিতেন। তাহার মুখ এইভাবে চিরকালের জন্য বন্ধ হইয়া যাইত-কে আর সেই অর্থের সন্ধান বাহিরের লোককে দিবে? শুনিয়াছি, এখনও উদয়পুরের জঙ্গলে শালবৃক্ষ কর্তন করিতে যাইয়া কেহ কেহ অগাধ ঐশ্বর্য পাইয়া থাকে। নানারূপ ঐতিহাসিক তত্ত্বে এই পুস্তকখানি পূর্ণ। যদিও গ্রন্থকারের নাম নাই, তথাপি তিনি যে মুসলমান ও শমসের গাজির অন্তরঙ্গ ভক্ত ছিলেন বই পড়ার পর তাহাতে কোন সন্দেহ থাকিতে পারে না। এই বইখানি, রাজকৃষ্ণ বাবুর কথায় বলিতে গেলে একটি মুষ্টি ভিক্ষা, কিন্তু উহা সুবর্ণ মুষ্টি, যেহেতু প্রাচীন বাঙ্গলায় ঐতিহাসিক পুস্তক অতি অল্পই আছে। প্রায় ১২ বৎসর পূর্বে নোয়াখালির জজ আদালতের সেরেস্তাদার মৌলভী লুৎফুল কবীর সাহেব এই পুস্তকখানি প্রকাশিত করিয়া আমাকে একখন্ড উপহার পাঠাইয়াছিলেন। কিন্তু কবীর সাহেব তারপর কিভাবে কোথায় গেলেন এমন কি, তিনি জীবিত কি মৃত, তাহা আমরা বহু সন্ধান করিয়াও জানিতে পারি নাই। তাঁহার বাড়ী ছিল ত্রিপুরা জেলায়। ছোটলাটের প্রাইভেট সেক্রেটারী গুরলে সাহেব একখন্ড শমসের গাজির গানের বই খুঁজিয়াছিলেন, কিন্তু তিনি তাহা পান নাই। প্রসিদ্ধ ঐতিহাসিক স্বর্গীয় কৈলাশচন্দ্র সিংহ মহাশয় তাঁহার ‘রাজমালা’য় শমসের গাজির বিস্তৃত বিবরণ দিয়াছেন।

যদি মুসলমানগণ তাঁহাদের সমাজের উন্নত চরিত্রগুলি সুন্দর ও মহিমান্বিত বর্ণে চিত্রিত করিয়া বাঙ্গলা সাহিত্যে উপস্থিত করেন, তবে হিন্দু-মুসলমান একসঙ্গে তাহাদের দ্বারা প্রভাবান্বিত হইবে। উত্তর-পশ্চিমে অনেক হিন্দু মহররমের মর্মন্তুদ কাহিনী শুনিয়া অশ্রু বিসর্জন করে এবং উৎসবের দিনে তাজিয়া বাহির করে। নিদারুণ তৃষ্ণায় জলবিন্দুর জন্য কোমল কুসুমকোরকের মত সখিনা ও কাসেম শুকাইয়া মরিলেন-কারবালা ক্ষেত্রের সেই করুণ কাহিনী কি শুধু মুসলমানেরই জাতীয় সম্পত্তি, না সমস্ত বিশ্ববাসীর রস-সম্পদ? বঙ্গের যে পল্লীসঙ্গীত মুসলমান কৃষকের অতুলনীয় সম্পদ, যে গৌরব নভস্পর্শী অপূর্ব, আশ্চর্য, তাহার কথা আমি পরে লিখিতেছি। এখন এই সঙ্গীতের স্রোত মুসলমান সমাজে অবরুদ্ধ করিলে তাহাদের জাতীয় জীবন শুকাইয়া মরিবে। বাড়ীখানি গঙ্গার তীরে অবস্থিত, সেই সুর নদীকে বন্ধ করিলে জাতীয় জীবনের রসধারা কে সঞ্জীবিত রাখিবে? আমির খসরু সেতারের উদ্ভাবন করিয়াছিলেন, মিঞা তানসেন সঙ্গীত বিদ্যারূপ হিমাদ্রির কাঞ্চন জঙখায় অধিরোহণ করিয়াছিলেন। ইহারা কি ইসলামের শত্রু ছিলেন?

এ পর্যন্ত আমরা অনেক মুসলমান বাঙ্গলা কবির নাম করিয়াছি, কিন্তু তাহা অতি নগণ্য অংশ। পূর্ববঙ্গের নিরক্ষর মুসলমান চাষা ও মাঝিরা মুখে মুখে যে সকল গান বাঁধিয়া থাকে, তাহা অনেক সময় অতি সুন্দর কবিত্বময়। মুসলমান বাউলদের ‘মুরশিদা’ গান দেহতত্ত্ব বিষয়ক, তাহার ভাব-সম্পদ আধ্যাত্মিক, অনেক স্থলে তাহা এত সুন্দর যে আমাদের আশ্চর্য বোধ হয়, সামান্য ফকির ও বাউলেরা কি করিয়া ধর্মরাজ্যের সেই সকল সূক্ষ্ম তত্ত্ব আয়ত্ত করিয়াছে? শত শত মুরশিদা গান সেই সকল বাউল, মাঝি ও কৃষকের কন্ঠে ধ্বনিত লইয়া বাঙ্গলার পল্লীর আকাশ-বাতাস পূর্ণ করিয়া রাখিয়াছে। এই সকল পল্লীর আধ্যাত্মিক ঐশ্বর্য গর্ব করিবার সামগ্রী, আমরা কখনও করিয়াছি? এই বঙ্গদেশে কত মসজিদ, কত ইষ্টক ও শিলালিপি, কত কীর্তিস্তম্ভ মুসলমানদের বিজয়ের বার্তা ঘোষণা করিতেছে। বঙ্গদেশে এমন পল্লী নাই, যেখানে মুসলমানদের গৌরব ও পরাক্রান্ত অভিযানের কথা নাই, যেখানকার ধুলি পীর-দরবেশদের পদধূলি কিম্বা সমাধিতে পবিত্র হয় নাই। কতজন তাহার খবর রাখেন?

এ পর্যন্ত আমরা দেখাইয়াছি বাঙ্গলা সাহিত্যের উপর মুসলমানদের কতটা প্রভাব পড়িয়াছে। কিন্তু শুধু তাহাই নহে, বাঙ্গলা সাহিত্যে মুসলমান কবি রাজসিংহাসনের দাবী করিতেছেন, বাঙ্গলা সাহিত্যে এরূপ মুসলমান কবির আবির্ভাব হইয়াছে যাঁহারা কবিকুল চক্রবর্তী, যাঁহাদের যাশোভাদির নিকট আলওয়াল এমন কি ভারতচন্দ্রের খ্যাতিও পরিমান হইয়াছে।

সম্প্রতি কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয় তিন খন্ড পল্লীগীতিকা প্রকাশিত করিয়াছে। তাহাতে মুসলমান কবিদের যে কবিত্বের নিদর্শন আছে, তাহা অতুলনীয়। দুঃখের বিষয় এই সকল পল্লীগীতি সম্বন্ধে এদেশের লোক ততটা অবহিত নহেন। এই পল্লীগীতিকার প্রথম খন্ডে ‘দেওয়ানা মদীনা’ নামক একটি পালাগান প্রকাশিত হইয়াছে। তৎসম্বন্ধে ফরাসীদেশের বিখ্যাত লেখক মহাত্মা রোম্যা রোলাঁ লিখিয়াছেন, এরূপ অদ্ভুত কাব্য তিনি গ্রাম্য কৃষকের নিকট হইতে প্রত্যাশা করেন নাই। পল্লী কৃষককবি কিরূপে নিপুণ শিল্পীর ন্যায় এই আশ্চর্য কীর্তির মঠ রচনা করিয়াছেন, তাহা তাঁহার বিস্ময়ের সৃষ্টি করিয়াছে।

‘দেওয়ানা মদিনা’র প্রসিদ্ধ গায়ক ছিলেন ‘জালাল গাএন’। তিনি যখন ভাটিয়াল সুরে এই গানটি গাহিতেন, তখন বেদনায় শ্রোতাদের হৃদয় ভরিয়া উঠিত ও তাঁহারা আর্তনাদ করিয়া কাঁদিয়া উঠিতেন। উহা রয়াল আট পেজি ফর্মার ৩য় পৃষ্ঠায় সম্পূর্ণ। এত ক্ষুদ্র গণ্ডির মধ্যে এরূপ করুণ রসাত্মক কাব্য আমরা আর কোন সাহিত্যে পড়িয়াছি বলিয়া মনে হয় না। রোম্যা রোলাঁ সমালোচনা রাজ্যের সম্রাট, তিনি নির্ভয়ে মুক্তকণ্ঠে কবিকে তাঁহার প্রাপ্য প্রশংসা দিয়াছেন। আমরা অধীন জাতি, আমরা নিজেদের কবি সম্বন্ধে একটা বড় রকমের প্রশংসা দিতে ভয় পাই। বিদেশী কবিগণের পশ্চাতে তাঁহাদের সমালোচকেরা দুন্দুভি-নিনাদ করেন ও তাঁহাদের ডঙ্কা-নিনাদে বসুধা কম্পিত হয় এবং লোকেরা গরুড় পক্ষীর ন্যায় জোড়হস্ত হইয়া থাকে—কিন্তু আমাদের পল্লীর ক্ষেতে যদি অত্যুজ্জ্বল হীরকখন্ডও থাকে তাহা মাটির ডেলার মত উপেক্ষিত হয়। “কাঠুরে এক মানিক পেল, পাথর বলে ফেলে দিল, অভিমানে কাঁদছে মানিক মহাজনে টের পেল না”-আমাদের পরাধীন দেশের কাঞ্চন কাঁচ হইয়া যায়, জয়দৃপ্ত বিদেশীদের। কাঁচও কাঞ্চন মূল্যে বিকাইয়া থাকে।

জামাত উল্লা বয়াতির রচিত ‘মাণিক তারা’ বা ‘ডাকাতের পালা’ দ্বিতীয় খন্ড প্রকাশিত হইয়াছে। এই পালা গানটির কাব্য-ঐশ্বর্য অতুলনীয়। কৃষক-কবি চাষাবাদের জীবনের যে নিখুঁৎ ছবি আঁকিয়াছেন, বঙ্গ-সাহিত্যে তাহার সমকক্ষ কবিতা কতটি আছে জানি না। এই পালাটির কোন স্থানে নিপুণ শিল্পীর ন্যায় সিপিকুশলতা, কোথাও হাস্যরসোজ্জ্বল হৈমন্তিক রৌদ্রের ন্যায় সুখদ-পদবিন্যাস, কোথাও পূর্বরাগের রমণীয়তা-এ সমস্তই এমন দক্ষতার সহিত লিখিত হইয়াছে যে জামাত উল্লাকে সারস্বত কুজের প্রথম পংক্তিতে স্থান দিতে বোধ হয় কাহারও আপত্তি হইতে পারে না। গ্রাম্য কবির এই কাব্যখানি প্রত্যেক বাঙ্গালীর পাঠ করা উচিত। পাড়াগেঁয়ে ভাষা কোন স্থানে প্রাদেশিকতার বাহুল্যে দুর্বোধ্য কিন্তু ধূলিমাটি মলিন হীরকের জ্যোতি কি সেই সকল বাহিরের মলিনতা ফুটিয়া বাহির হয় না? মাণিক তারার কবিত্বভাতির গ্রাম্য ভাষার মধ্য হইতে সেই রূপ ফুটিয়া বাহির হইয়াছে।

তৃতীয় খন্ডেও অনেকগুলি পালাগান আছে, তন্মধ্যে “মজুর মার পালা”টি উৎকৃষ্ট। যদিও কবির নাম পাওয়া গেল না, তথাপি ইহা যে মুসলমান কবির লেখা-সে বিষয়ে কোন সন্দেহ থাকিতে পারে না। মনির নামক এক মুসলমান সাপুড়ের কথা লইয়া এই কাব্য রচিত।

তৃতীয় খন্ডের পল্লীগীতিকায় আর কয়েকটি উৎকৃষ্ট পালা আছে, তাহার একটি মনসুর ডাকাত বা কাফন চোরার পালা। এই মনসুর ডাকাতের জীবনের গতি কিভাবে ফিরিয়া গিয়াছিল, অতি জঘন্য নীচ ও নৃশংস-দস্যুবৃত্তি ছাড়িয়া সে কিরূপে একজন শ্রেষ্ঠ পীর ও সাধু হইয়াছিল, সেই মনস্তত্ত্বের আধ্যাত্মিক চিত্রপটখানি কবি এই পালা গানটিতে উদঘাটিত করিয়া দেখাইয়াছেন। ইহার মাঝে মাঝে এমন সুন্দর কবিত্বপূর্ণ চরণ আছে যাহা পড়িলে কবিকে পল্লী-কালিদাস বলিয়া প্রশংসা করিতে ইচ্ছা হয়। একটি নববিবাহিতা নারী পল্লীপথে প্রথম শ্বশুরবাড়ী যাত্রা করিয়াছেন। জ্যোৎস্না ধবধবে রাত্রি, আটজন পাল্কীবাহক তাহাকে লইয়া যাইতেছে-কবি সেই রাত্রি দুইটি ছত্রে বর্ণনা করিয়াছেন। কবি লিখিয়াছেন—জ্যোৎস্না রাত্রি, দোলা চলিয়া চাইতেছে–কেহ যেন মুষ্টি মুষ্টি বেলফুলের কলি দ্যুলোক হইতে ভুলোকে ছড়াইয়া ফেলিতেছে, এমনই সুন্দর জ্যোৎস্না।

এই জ্যোৎস্না রাত্রে মনসুর ডাকাত কুর্মাই খালের একটা বাঁকের কাছে, কেতকী ঝাড়ের আড়ালে লুকাইয়া পাল্কী খানির গতিবিধি লক্ষ্য করিতেছে।

দোলার গতি, জ্যোৎস্নার বর্ণনা কবিতাগুলিকে এমন একটা ছন্দ দিয়াছে যে, মনে হয় যেন আমরা বাহকদের পদশব্দ শুনিতে পাইতেছি ও মনসুর ডাকাতের ব্যাঘ্রমূর্তি চাক্ষুষ করিতেছি।

কিন্তু মনসুরের পরিবর্তনের কথাটি অতি অপূর্ব। সে প্রতিজ্ঞা করিয়াছিল, দিনে পাঁচবার নমাজ পড়িবে। এই দুর্দান্ত দস্যু যে রমণীকে প্রকৃতই ভালবাসিয়াছে, তাহার নিকট এই প্রতিজ্ঞা-সুতরাং তাহা দুর্লঙ্ঘ।

হাতীখেদার গানটি একশত বৎসর পূর্বের রচনা। এমন একটা বিষয় লইয়া যে কবিতা রচিত হইতে পারে, তাহা অনেকেরই ধারণার অগম্য। কিন্তু গ্রাম্য মুসলমান কবি ইহাতে অপর্যাপ্ত কাব্যরস ঢালিয়া দিয়াছেন। কবিতাগুলির বিদ্রূপছন্দ যেন শিকারীদের পদশব্দের সঙ্গে তাল রাখিয়া চলিয়াছে। কবিতাগুলি একবারে স্বভাবের সঙ্গে সম্পূর্ণভাবে সঙ্গতি রাখিয়া কোন স্থানে বন্দুকের আওয়াজ, অগ্নিদাহের চটপট শব্দ, কোথাও শিবিরে দর্শকদের কোলাহল ও মশালের আলোকমালার দীপালির শোভা–যেন পাঠককে প্রত্যক্ষ করাইয়া সেই অদ্ভুত বন্য-অভিযানের একেবারে কেন্দ্রস্থলে লইয়া গিয়াছে। হাতিগুলির ভীষণতা, বুদ্ধিহীনতা, অকারণ আশঙ্কা, দলবদ্ধ হওয়ার চেষ্টা–খেদার মধ্যে ঢুকিয়া তাহাদের আর্তনাদ ও না খাইয়া অস্থি-চর্মসার হইয়া যাওয়া–এই সমস্তই হয়ত নিতান্ত নিরস বিষয়–কিন্তু এগুলিকে যে কবি এরূপ রসাত্মক করিতে পারিয়াছেন–তাঁহার কবিত্ব ধন্যবাদার্হ-ইহা স্বীকার করিতে হইবে। ভাষা চাটগেয়ে, অনেক স্থলে বুঝিয়া উঠা কঠিন, কিন্তু নারিকেলের খোলাটা ভাঙ্গিয়া ফেলিলে যেরূপ ভিতরের সকলেই সুস্বাদু ও সরস, ভাষার বাধাটা অতিক্রম করিলে এই কবিতাও তেমনিই উপভোগ্য ও পরম উপাদেয় বোধ হইবে।

আমরা মুসলমান বিরচিত আরও অনেক পালাগানের উল্লেখ করিতে পারিলাম না–সেগুলিতে কবিত্বের অভাব নাই, কিন্তু আমাদের স্থান ও সময়াভাব।

মুসলমান সম্রাটগণ বর্তমান বঙ্গ-সাহিত্যের একরূপ জন্মদাতা বলিলেও অত্যুক্তি হয় না। তাঁহারা বহু ব্যয় করিয়া শাস্ত্রগুলির অনুবাদ করাইয়াছিলেন এবং সেগুলি আগ্রহ সহকারে শুনিয়া আনন্দিত হইতেন। আরব-দেশবাসীরা অনেক সংস্কৃত গ্রন্থের অনুবাদ করাইয়াছিলেন। ইসলাম ধর্মাবলম্বীরা শুধু ধনরত্ব আহরণের চেষ্টায় ভিন্ন দেশ জয় করিতেন না, সেই সকল দেশে যদি জ্ঞানের ভান্ডার থাকিত, তাহাও তাঁহারা লুটিয়া লইতেন। আবুল ফজলের ভ্রাতা ছদ্মবেশে কাশীতে যাইয়া সংস্কৃত শিক্ষা করিয়া আসিয়া শাস্ত্রগ্রন্থ অনুবাদ করিয়া সম্রাটকে সন্তুষ্ট করিয়াছিলেন, ইহাতে নূতন কথা কিছুই নাই। বঙ্গ-সাহিত্য মুসলমানদেরই সৃষ্ট, বঙ্গভাষা বাঙ্গালী মুসলমানের মাতৃভাষা। বহু পুস্তক বাঙ্গলা ভাষায় রচনা করিয়া মুসলমান কবিগণ কৃতিত্ব দেখাইয়াছেন,-পালাগানে তাঁহারা যে শক্তি ও কবিত্ব দেখাইয়াছেন, তাহাতে সাহিত্যিক আসরে তাঁহাদের স্থান প্রথম পংক্তিতে। কয়েকজন শিক্ষিত বাঙ্গালী হিন্দু এখন বঙ্গ-সাহিত্যের কান্ডারী হইয়াছেন সত্য, কিন্তু গোটা বঙ্গদেশের সাহিত্য এখনও মুসলমানের হাতে-এই কথার এক বর্ণও মিথ্যা নহে। ময়নামতীর গান হইতে আরম্ভ করিয়া গোরক্ষ-বিজয়, ভাসান গান ও পূর্বোক্ত শত শত পালা গান, মুরশিদা গান, বাউলের গান এ সমস্তই মুসলমানদের হাতে। তাঁহারাই অধিকাংশ স্থলে মূল গায়েন। তাঁহারাই তরজার গুরু। এই বঙ্গদেশ যে সুধামধুর কবিত্বরসে অভিষিক্ত, তাহার প্লাবন আনিয়াছে মুসলমান কৃষকরা। একবার ধান কাটার পর বঙ্গদেশ–বিশেষ করিয়া পূর্ববঙ্গ ঘুরিয়া আসুন, দেখিবেন, মুসলমান কৃষকেরা দল বাঁধিয়া কত প্রকার গান গাহিয়া এদেশকে আনন্দ বিতরণ করিতেছে। কত বাউলের দেহতত্ত্ব বিষয়ক গান, কত মাঝির ভাটিয়ালী গান, কত রূপকথা ও মনোহর কেচ্ছা ও গাজির গান তাহারা বাঙ্গলা দেশকে শুনাইয়া জনসাধারণের মধ্যে শিক্ষা বিস্তারে সহায়তা করিতেছে। হিন্দুরা এ বিষয়ে কোন ক্রমেই মুসলমানের সমকক্ষ নহে। দু’চারিজন শিক্ষিত লোক লইয়া এদেশ নহে। দু’চারিজন উপন্যাস পড়ুয়ার হাতে বঙ্গদেশটি নহে। বঙ্গদেশ বলিতে যে সপ্তকোটি লোক বুঝায় তাহার শতকরা ১০ জনেরও বেশী আধুনিক উচ্চশিক্ষার কোন ধার ধারে না। এই সুবৃহৎ জনসাধারণের শিক্ষা বড় সাধারণ নহে। যাহারা পদ্মাবতের ন্যায় এরূপ পান্ডিত্যপূর্ণ কাব্য বুঝিতে পারে, দেহতত্ত্ব বিষয়ক অতি সূক্ষ্ম আধ্যাত্মিক তত্ত্ব আয়ত্ত করিতে পারে, তাহারা কি ‘মূর্খ’ অভিধা পাইবার যোগ্য? এই বিপুল জনসাধারণের ভাষা বাঙ্গলা, মুসলমানগণ এখনও এই ভাষার উপর পল্লীগ্রামে আধিপত্য বিস্তার করিয়া আছেন।

যাঁহারা বাঙ্গলা ভাষার পরিবর্তে উর্দু ভাষা এদেশে প্রচলনের প্রয়াসী, তাঁহারা কখনই সে চেষ্টায় কৃতকার্য হইবেন না। লক্ষ লক্ষ মুসলমানের বাঙ্গলাই মাতৃভাষা, মায়ের মুখে তাহারা বাঙ্গলা ভাষা প্রথম শুনিয়াছে-সে ভাষা তাহাদিগকে ভুলাইয়া দেওয়ার চেষ্টা বাতুলতা মাত্র। ঘরের সামগ্রী তৈরী থাকিতে এরূপ চেষ্টা করিবার প্রয়োজন তো কিছুই দেখিতে পাই না। যদি বড় কিছু দিতে পার, তবে ছোট জিনিষটা ছাড়িয়া দাও। সূর্য্যের আলো আনিবার ব্যবস্থা করিয়া ঘরের প্রদীপটি নির্বাপণ কর, নতুবা যাহা আছে তাহা ছাড়িয়া দিয়া ঘর আঁধার করিবে মাত্র।

(রচনাটি মাসিক অগ্র পথিক মহান একুশে ফেব্রুয়ারী ১৯৮৮ ৩ বর্ষ ৬ সংখ্যা।। ৫ ফাল্গুন ১৩৯৪ ১৮ ফেব্রুয়ারী ১৯৮৮।। ২৯ জমাদিউস সানী ১৪০৮–এর সৌজন্যে পুনরায় পাবলিশ করা হলো।)

তথ্যসূত্র:

তথ্যসূত্র:
1 আমাদের জাতীয় ইতিহাসের এক বিশিষ্ট ব্যক্তিত্ব শমসের গাজি সম্পর্কে সাহিত্য-সাধক ডক্টর শ্রীদীনেশ চন্দ্র সেনের এবংবিধ বিশেষণ প্রয়োগ বিভ্রান্তিমূলক ও একদেশদর্শী। সঙ্গত কারণেই এ প্রসংগে আমরা ভিন্নমত পোষণ করি।—সম্পাদক

বিজ্ঞাপন

Subscribe
Notify of
guest
0 Comments
Oldest
Newest Most Voted
Inline Feedbacks
View all comments

স্বত্ব © ২০২৩, যোগাযোগ | ই মেইল : jogajogbd.org@gmail.com

যোগাযোগ-এ প্রকাশিত কোনো লেখা, ছবি কিংবা শিল্পকর্ম লেখক অথবা কর্তৃপক্ষের অনুমতি ছাড়া কোথাও প্রকাশ করা অবৈধ৷