১৮৩০ সালে জার্মান বহুবিদ্যাবিশারদ লেখক য়োহান উলফগং গ্যেতে (১৭৪৯–১৮৩২) তার the world Literature প্রবন্ধে বলেন– ‘অন্য ভাষা-সাহিত্যের সঙ্গে সম্পর্ক ব্যতীত কোনো দেশের সাহিত্যই সম্পূর্ণ হয় না।’ গ্যেতের একথা মনে রেখে আমরা যদি আমাদের বাংলা ভাষা এবং সাহিত্যের দিকে তাকাই, তাহলে এর বাস্তবতা দেখতে পাই। বাংলা ভাষাকে সমৃদ্ধ করে রাখা বিপুল পরিমাণে বিদেশি শব্দ, বিশেষত আরবি এবং ফারসি শব্দ আমাদের এ কথা জানান দেয়—বাংলা ভাষা দীর্ঘ সময় আরবি এবং ফারসির সংস্পর্শ লাভ করেছে। আর একটি ভাষা অপর আরেকটি ভাষার সংস্পর্শে থেকে সমৃদ্ধি লাভ করবার সুপ্রাচীন প্রক্রিয়া অর্থাৎ সমৃদ্ধিপ্রত্যাশী ভাষাটি বিভাষী মানুষদের মাধ্যমে চর্চিত হওয়ার বিষয়টি একজন সচেতন মানুষমাত্রই বুঝবার কথা।
ডঃ মুহাম্মদ হারুন রশিদ ‘বাংলা ভাষায় ব্যবহৃত বিদেশি শব্দের অভিধান’ নামে একটি অভিধান রচনা করেছেন–যাতে সন্নিবেশ ঘটিয়েছেন বিদেশি ভাষার প্রায় ১৬ হাজার শব্দ। এর মধ্যে সর্বাধিক ছয় হাজার আরবি শব্দ এবং সাড়ে চার হাজার ফারসি শব্দ এরপর প্রায় তিন হাজার ইংরেজি শব্দের উল্লেখ করেছেন। ১৬ হাজার বিদেশি শব্দের মাঝে সাড়ে দশ হাজার আরবি এবং ফারসি শব্দ এ কথাই প্রমাণ করে যে, বাংলা ভাষা দীর্ঘ সময় চর্চিত হয়েছে খাঁটি আরবি-ফারসিভাষী কিংবা এ দুই ভাষার অনুরাগীদের দ্বারা । আর ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়, বঙ্গে আরবি-ফারসিভাষী যারাই ছিলেন তারা সকলেই ছিলেন একত্ববাদী মুসলমান । ইতিহাস এ-ও সাক্ষ্য দেয়, এসব আরব-পারসিক মুসলমানদের বদান্যতায়ই অপাঙ্ক্তেয় বাংলা ভাষা রাজভাষায় পরিণত হয়েছিল।
কিন্তু হাল জামানায় বাংলা ভাষাকে সমৃদ্ধকারী আরবি-ফারসি শব্দ এবং এসব শব্দের অভিজাত ব্যবহার রামরাজ্যের প্রসাদ খাওয়া কতিপয় প্রগতিশীল বুদ্ধিজীবীর গাত্রদাহের কারণ হয়ে দেখা দিয়েছে। তাদের ভাবখানা এমন–ও ভগবান! রক্ষে রক্ষে! সাধের বাংলা যবন আরবি-ফারসির দাপটে আমাদের হাতছাড়া হয়ে গেল যে!
কথিত এসব প্রগতিশীলের এই ‘গেল গেল’ ধ্বনি নতুন কিছু নয় বরং আরবি-ফারসিকে অস্বীকারের মাধ্যমে বাংলা ভাষা-সাহিত্যে মুসলমানদের অবদান অস্বীকারের উত্তরাধিকার তারা তাদের পূর্বসূরি দাদাবাবুদের কাছ থেকে পেয়েছে।
১৮০০ সালে কলকাতায় ফোর্ট উইলিয়াম কলেজ প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে বাংলা ভাষা সাহিত্যের আধুনিক যুগের সূচনা হয়। বাংলা সাহিত্যের আধুনিক যুগের আধুনিক লেখকেরা আরবি-ফারসিকে বাংলা থেকে ছেঁটে ফেলবার সর্বাত্মক চেষ্টা চালিয়েছেন। ভুত খেদানোর মতো করে অনবরত যপে গেছেন সংস্কৃত তন্ত্র-মন্ত্র। এক্ষেত্রে তাদের সহায়ক হয়েছে তৎকালের ইংরেজ সরকার। ১৮৩৫ সালে ইংরেজ সরকার নিম্নবর্গের হিন্দু এবং সমগ্র মুসলিম জনগোষ্ঠীকে শিক্ষা থেকে বঞ্চিত করে সামগ্রিকভাবে কোণঠাসা করে ফেলবার উদ্দেশ্যে ফারসির বদলে ইংরেজিকে রাষ্ট্রভাষা ঘোষণা করে। পাশাপাশি মার্শম্যান এবং উইলিয়াম কেরি সকল আরবি-ফারসি শব্দকে বাংলা ভাষা থেকে বিদায় দেওয়ার মিশনে অবতীর্ণ হয়। যার উন্মুক্ত ঘোষণা উইলিয়াম কেরি তার বাংলা ভাষার অভিধান A Dictionary of Bengali Language দিয়েছিলেন।[1]বাংলা সাহিত্যে মুসলিম ঐতিহ্য– সৈয়দ আলী আশরাফ পৃ.৪৮
এজন্যে গীতা রামায়ণ মহাভারত ইত্যাদি কতক ধর্মীয় গ্রন্থাশ্রিত সাহিত্যকর্মের সাহায্যে হিন্দু জাতীয়তাবাদ উসকে দেওয়ার মানসে সাহিত্যকর্ম করে যাওয়া দাদাবাবুদের কাছ থেকে ইংরেজ বড়সড়-ফুলেল নমস্কার পেতেই পারে।
ইংরেজের ছত্রছায়ায় এসময়ে হিন্দু সাহিত্যিকগণ আরবি-ফারসির পরিবর্তে বাংলায় সংস্কৃত শব্দের বাহুল্য ঘটাতে থাকেন। এ থেকেই মূলত বাংলার সভ্যতা সংস্কৃতি এবং ভাষা-সাহিত্যে মুসলিম অবদান অস্বীকারের একটি চাতুর্যময় বয়ানের ঐচ্ছিক সূত্রপাত ঘটে। বর্ণবাদী ব্রাহ্মণের আধুনিক উত্তরসূরিরা এ কথার মন্ত্র যপতে শুরু করে—বাংলা ব্রাহ্মণের সংস্কৃত থেকে উদ্ভুত একটি ভাষা।
কিন্তু এই বয়ান ঐতিহাসিক এবং ভাষাতাত্ত্বিক উভয় বিবেচনাতেই মিথ্যা প্রমাণিত। ঐতিহাসিক দিকটি আমরা পরে আলোচনা করব, তার আগে ভাষাতাত্ত্বিক বিবেচনায় এই দাবির অসাড়তার দিকে নজর দেয়া যাক। এক্ষেত্রে আমরা সাহায্য নিব ভাষাবিদ ডঃ মুহম্মদ শহীদুল্লাহ কর্তৃক প্রণীত ‘বাঙ্গালা ভাষার ইতিবৃত্ত’ গ্রন্থটির।
ডঃ শহীদুল্লাহ বলেন, বাঙ্গালা ভাষার উৎপত্তি সম্বন্ধে নানা মতভেদ আছে। সংস্কৃতজ্ঞ পণ্ডিতদের মতে বাঙ্গালা সংস্কৃতের দুহিতা। স্যার জর্জ গ্রিয়ারসন বাঙ্গালাকে মাগধী প্রাকৃত হইতে উৎপন্ন বলিয়াছেন। ডক্টর সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায় এই মত সমর্থন করিয়াছেন। আমরা এক্ষণে এই দুই মতের সমালোচনা করিব।[2]বাঙ্গালা ভাষার ইতিবৃত্ত–ড.মুহম্মদ শহীদুল্লাহ
বাঙ্গালা যে সংস্কৃতের দুহিতা নয়, কয়েকটি সাধারণ প্রচিলত শব্দের দ্বারা ইহার উদাহরণ দিব। বাপ, মা, বোন, গরু, নাক, হাত, পা, গাছ, দেখে, শুনে–এই বাঙ্গালা শব্দগুলি সংস্কৃত পিতা, মাতা, ভগিনী, গো, নাসিকা, হস্ত, পদ, বৃক্ষ, পশ্যতি, শূণোতি শব্দ হইতে সাক্ষাৎভাবে ব্যুৎপন্ন হইতে পারে না। ইহাদের প্রাকৃতরূপ যথাক্রমে বপ্, মাআ, বহিণী, গোরূঅ, নক্ক, হথ, পাঅ, গচ্ছ, দেখখই, সুণই। স্পষ্টই দেখা যাইতেছে যে এই প্রাকৃত শব্দগুলির বিকারে বা ক্রমশঃ পরিবর্তনে আমরা বাঙ্গালা শব্দগুলি পাইয়াছি। বাস্তবিক প্রাকৃত হইতে অপভ্রংশের মাধ্যমে আমরা তাহা পাইয়াছি। একটি সাধারণ বাঙ্গালা বাক্য হইতে আমরা দেখাইব যে সংস্কৃত হইতে কোন ক্রমেই সাক্ষাৎভাবে বাঙ্গালা উৎপন্ন নহে।
বাঙ্গালা-‘তুমি আছ’; সংস্কৃতে যূয়ং স্থ; কিন্তু প্রাচীন প্রাকৃতে (পালি) তুমহে অচ্ছথ; মধ্য প্রাকৃতে ও অপভ্রংশে তুমহে অচ্ছহ; প্রাচীন বাংলায় তুমহে আছহ; মধ্য বাংলায় তোহ্মে বা তুহ্মি আছহ আধুনিক বাংলায় ‘তুমি আছ’।[3]বাঙ্গালা ভাষার ইতিবৃত্ত–ড.মুহম্মদ শহীদুল্লাহ
ঐতিহাসিকভাবেও বিষয়টি প্রমাণিত যে বাংলা সংস্কৃতের উপভাষা নয়। ডঃ মুহাম্মদ শহীদুল্লাহর ভাষায়—আমরা প্রথমে বাঙ্গলা সংস্কৃতের দুহিতা কি না-এই মত পরীক্ষা করিব। জননী হইতে যেমন কন্যা জন্মগ্রহণ করে, সেইরূপ সংস্কৃত হইতে বাঙ্গালা জন্মিয়াছে এইরূপ মত কেহই পোষণ করিতে পারেন না, কারণ ভাষাপ্রবাহের মধ্যে আমরা বাঙ্গালার পূর্বে অপভ্রংশ, তাহার পূর্বে প্রাকৃত যুগ দেখি। সংস্কৃত প্রাকৃত যুগের সমসাময়িক একটি সাহিত্যিক ভাষা। পতঞ্জলির কথিত শিষ্ট বা ব্রাহ্মণ্য সমাজে ইহার প্রচার থাকিলেও ব্রাত্য বা জনসাধারণের মধ্যে যে ইহার ব্যবহার ছিল না, তাহার যথেষ্ট প্রমাণ পাওয়া যায়। সুতরাং সংস্কৃত যুগ বলিয়া আমরা একটি পৃথক যুগ কল্পনা করিতে পারি না। প্রাকৃতের পূর্বে প্রাচীন প্রাকৃতের যুগ, যাহার সাহিত্যিক রূপ আমরা পালি ভাষায় দেখি। প্রাচীন প্রাকৃতের পূর্বে প্রাচীন ভারতীয় আর্য ভাষার যুগ। এই কালের ব্রাহ্মণ্য সমাজের বহির্ভূত জনসাধারণের কথ্য ভাষাকে আদিম প্রাকৃত বলা হইয়াছে। সুতরাং দেখা যাইতেছে সংস্কৃতের সহিত বাঙ্গালার কোনও সাক্ষাৎ সম্পর্ক নাই।[4]বাঙ্গালা ভাষার ইতিবৃত্ত–ড.মুহম্মদ শহীদুল্লাহ
ডঃ মুহম্মদ শহীদুল্লাহর গবেষণা থেকে স্পষ্ট হয়, সংস্কৃত মূলত প্রাকৃত যুগের অর্থাৎ খ্রিস্টপূর্ব ৮০০ থেকে ৫০০ সমসাময়িক এবং একমাত্র গোঁড়া ব্রাহ্মণ সমাজের একটি সাহিত্যভাষা—যার সঙ্গে সমাজের অন্যান্য মানুষদের ভাষার কোনো সম্পর্ক নেই। এ সময় ব্রাহ্মণের চোখে ব্রাত্যদের ভাষা ছিল আদিম প্রাকৃত (খ্রি.পূ. ৮০০–৫০০) যার পরবর্তী সংস্করণ প্রাচীন প্রাচ্যপ্রাকৃত (খ্রি.পূ. ৫০০–২০০ খ্রি.) এরপর গৌর প্রাকৃত খ্রি. ২০০–৪৫০) এরপর গৌড় অপভ্রংশ (খ্রি. ৪৫০–৬৫০) এরপর ৬৫০ থেকে বাংলা ভাষায় আনুষ্ঠানিক ইতিহাসের সূচনা।
সূচনাকাল থেকে অদ্যাবধি বাংলা ভাষার ইতিহাসকে গবেষকগণ মূলত চার ভাগে ভাগ করেছেন।
১. নবযুগ : ১৮০০ খ্রি. থেকে চলমান।
২. মধ্যযুগ : ১৩৫০ থেকে ১৮০০ খ্রি.
৩. সন্ধিযুগ : ১২০০ থেকে ১৩৫০ খ্রি.
৪. প্রাচীনযুগ : ৬৫০ থেকে ১২০০ খ্রি.
ইতিহাস বলছে—৬৫০ খ্রি. থেকে ১২০০ খ্রি. পর্যন্ত সময়কালে বাংলা ভাষা প্রতিনিয়ত তার রূপ বদলে একটি আধুনিক ভাষা হিসেবে আত্মপ্রকাশ করবার দ্বারপ্রান্তে পৌঁছে গেলেও সংস্কৃত ব্রাহ্মণ সমাজের গণ্ডিতেই সীমাবদ্ধ ছিল। নিম্নবর্গের হিন্দুদের এ ভাষার উপর কিঞ্চিত অধিকার ছিল না। সুতরাং প্রমাণিত হলো—বাংলা আদিম প্রাকৃত থেকে যুগে যুগে রূপান্তরিত একটি স্বতন্ত্র ভাষা। সংস্কৃতির সঙ্গে ঐতিহাসিকভাবে এর কোনো যোগসূত্র নেই। বাংলা এবং সংস্কৃতের যে যোগসূত্র তৈরি করা হয়েছে তা মূলত বাংলা ভাষার সন্ধিযুগ অর্থাৎ ১২০০ খ্রিস্টাব্দ থেকে চলমান আধুনিক যুগ পর্যন্ত মুসলমানের উত্থান রোধ এবং সভ্যতা নির্মাণে মুসলমানের অবদান অস্বীকারের মানসে হিন্দু উচ্চশ্রেণির পণ্ডিতবর্গের লেখালেখির মাধ্যমে হয়েছে।
জনাকয়েক হিন্দু জ্ঞানতাপস অসাম্প্রদায়িক মানসিকতা নিয়ে সাহিত্য চর্চা করলেও অধিকাংশ হিন্দু সাহিত্যিকের গীতা মহাভারত রামায়ণ নির্ভর সাহিত্যের একমাত্র উদ্দেশ্য ছিল—হিন্দু জাতীয়তাবাদকে উসকে দেওয়া। রচনায় ধর্মীয় দেব-দেবীদের আমদানি করে বিজিত হিন্দুদের মনে তাদের দেব-দেবীদের ক্ষমতা সম্পর্কে আস্থা পুনর্জীবিত করা।[5]বাংলা সাহিত্যে মুসলিম ঐতিহ্য–সৈয়দ আলী আশরাফ পৃ. ১৬
সংখ্যাগুরু হিন্দু পণ্ডিতদের সাহিত্যসাধনার পেছনের এই নেপথ্য আরও স্পষ্ট হয়ে উঠবে বাংলা ভাষার চতুর্যুগের ঐতিহাসিক বিশ্লেষণের মাধ্যমে। পাশাপাশি ইতিসাহের দর্পণে সংক্ষিপ্ত প্রবন্ধের জন্যে উপযুক্ত দৃষ্টিপাতে এবিষয়গুলোও আমাদের সামনে খোলাসা হয়ে যাবে—
১. বাংলা ভাষায় আরবি-ফারসি অলংকারের অনস্বীকার্য হওয়ার যৌক্তিকতা এবং এসব অলংকার অস্বীকারের অসাড়তা ও নেপথ্য।
২. বাংলা ভাষা-সাহিত্যে মুসলমানের হক সাব্যস্ত হওয়ার ঐতিহাসিক ভিত্তি।
প্রাচীন যুগ ৬৫০–১২০০ খ্রিস্টাব্দ
ডঃ মুহম্মদ শহীদুল্লাহ এই যুগকে দুই ভাগে ভাগ করেন—
ক. বৌদ্ধকাল ৬৫০–১১০০ খ্রিস্টাব্দ।
খ. হিন্দুকাল ১১০০– ১২০০ খ্রিস্টাব্দ।
৬৫০ থেকে ১২০০ মোট ৫৫০ বছরের মধ্যে বাংলায় বৌদ্ধ পাল রাজাদের শাসন ছিল ৩০০ বছর। এতদ্সত্বেও পুরো ৫৫০ বছরের সময়কালকে বৌদ্ধকাল বলবার কারণ ইতিহাস থেকে যতটুকু বোধগম্য হয়—হিন্দুদের সুপ্রিম গোষ্ঠী ব্রাহ্মণ কর্তৃক অন্যান্য তিন শ্রেণি অর্থাৎ ক্ষত্রিয় বৈষ্য এবং শুদ্রদের উপর আধিপত্য ধরে রাখবার একটি অন্যতম কৌশল ছিল শিক্ষাকে ব্রাহ্মণ সমাজে সীমাবদ্ধ করে ফেলা। এজন্যে ব্রাহ্মণদের শিক্ষাব্যবস্থা ছিল শ্রুতিনির্ভর। ব্রাহ্মণ ঋষিরা মুখস্থ বেদ আবৃত্তি করতেন শিষ্যরা শুনে শুনে তা কণ্ঠস্থ করত।
মুসাফির আল বেরুনী লিখছেন, ব্রাহ্মণরা বেদ আবৃত্তি করেন না বুঝেই এবং তা কণ্ঠস্থ করেন লোকপরম্পরায় শুনে শুনে। ঋষিদের মধ্যে এমন লোক অল্পই রয়েছেন যারা বেদের ব্যাখ্যা করতে পারেন। ব্রাহ্মণরা ক্ষত্রিয়দের বেদ শিক্ষা দেন। ক্ষত্রিয়রা বেদ শিক্ষা নিতে পারেন কিন্তু শিক্ষা দেওয়ার অধিকার তাদের নেই। বেদ শিক্ষা দেওয়ার একমাত্র অধিকার সংরক্ষণ করেন ব্রাহ্মণরা।[6]আল বেরুনীর ভারততত্ত্ব পৃ. ৪৪-৪৫
শিক্ষায় ক্ষত্রিয়দের অংশগ্রহণের সামান্য সুযোগ থাকলেও সমাজব্যবস্থার যাবতীয় ক্ষেত্রে একচ্ছত্র আধিপত্য ছিল ব্রাহ্মণের। এমনকি ধর্মীয় রীতি অনুসারে রাষ্ট্রপরিচালনার ক্ষমতা ক্ষত্রিয়কে দেওয়া হলেও অন্দরের কলকাঠি নাড়ত ব্রাহ্মণরাই। ক্ষত্রিয় সমাজ ব্রাহ্মণের এই অনৈতিক যথেচ্ছাচারী আধিপত্য মেনে নেয়নি। ফলশ্রুতিতে মহাবীরের নেতৃত্বে জৈনধর্ম এবং সিদ্ধার্থের হাতে বৌদ্ধধর্মের আত্মপ্রকাশ ঘটে। ভারতে বৌদ্ধ ধর্মের প্রচারের ফলে বৈষ্য এবং শূদ্রদেরও শিক্ষায় অংশগ্রহণের পথ সুগম হয়।[7]ভারতীয় শিক্ষার ইতিহাস– বেবি দত্ত, মধুমালা, দেবিকাগুহ পৃ. ৪৪৫
বৌদ্ধদের বাংলা শাসনকালে শিক্ষাব্যবস্থায় বাংলা ভাষা শিক্ষার মাধ্যম হিসেবে গৃহীত না হলেও বাংলাভাষীদের অবস্থান শিক্ষাঙ্গনে বেশ ভালো অবস্থানে ছিল। যেমনটা আমরা চীনা পর্যটক হিউয়েন সাঙের বর্ণনায় দেখতে পাই। সপ্তম শতাব্দীতে ভারতে আসা হিউয়েন সাঙ চার বর্ণের লোক এবং ব্রাহ্মণের প্রাধান্যের কথা বলেছেন। হিউয়েন সাঙ নালন্দা প্রভৃতি উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানের বিবরণও দিয়েছেন। তার ভ্রমণবিত্তান্ত থেকে একথাও জানা যায় যে, একজন বাঙালি তখন নালন্দার বিশ্ববিশ্রুত বিহারের অধ্যক্ষের পদ অলংকৃত করেছিলেন…[8]বাঙ্গালা ভাষার ইতিবৃত্ত – ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ পৃ. ১৬
এভাবে বৌদ্ধের কৃপায় শিক্ষায় অংশগ্রহণ এবং গুপ্ত শাসনামলে কর্মে স্বাধীনতার ফলে নিম্নবর্গের হিন্দুরা সামাজিকভাবে প্রতিষ্ঠিত হয়ে পড়ে। পাশাপাশি ব্রাহ্মণ্য সমাজ যাবতীয় ক্ষেত্রে তাদের উপর নির্ভরশীল হওয়ার কারণে ব্রাহ্মণদের অমানবিক বর্ণপ্রথাতেও কিছুটা শিথিলতা প্রবেশ করে। এ কারণেই বাংলা ভাষার প্রাচীন যুগের দ্বিতীয় কাল তথা হিন্দুকালে (১১০০–১২০০) হিন্দু রাজের বর্ণ প্রথার খড়গ কিছুটা ভোতা হয়ে গিয়েছিল।
সুতরাং আমরা দেখলাম–বাংলা ভাষার প্রাচীন যুগে হিন্দু পণ্ডিতেরা শূদ্রের ভাষা বাংলা হবার অপরাধে বাংলাকে অচ্ছুৎ গণ্য করেছেন। যেমনটা ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ তার বইয়ে উল্লেখ করেছেন—সেন রাজাগণ সংস্কৃতের উৎসাহ দাতা ছিলেন ব্রাহ্মণ্যেতর ধর্মের সহিত সংশ্লিষ্ট বলিয়া সম্ভবত তাহারা বাঙ্গলা ভাষার প্রতি বিদ্বিষ্ট ছিলেন।[9]বাংলা সাহিত্যে সূফী প্রভাব– মনির উদ্দীন ইউসুফ পৃ. ১১
কিন্তু বৌদ্ধ ধর্মের উত্থানের ফলে নিম্নবর্গের বাংলাভাষী সংখ্যাগরিষ্ঠ হিন্দুরা সামাজিকভাবে প্রতিষ্ঠিত হয়ে গেলে একরকম ঠেলায় পড়ে তাদের প্রতি নমনীয় হতে বাধ্য হয়েছে। তখনও পর্যন্ত বাংলা শিক্ষার মাধ্যম হিসেবে প্রতিষ্ঠিত না হওয়ায় এ সময়ের কোনও রচনা পাওয়া যায় না।
সন্ধিযুগ ১২০০ থেকে ১৩৫০ খ্রিস্টাব্দ
১২০১ সালে ইখতিয়ার উদ্দিন মোহাম্মদ বিন বখতিয়ার খিলজী বাংলার তদানীন্তন রাজধানী নবদ্বীপ (পরবর্তীতে নদীয়া জেলা) বিজয় করেন। ইখতিয়ার খিলজীর ঘোড়া যেন এ দেশের সাধারণ মানুষ এবং শাসকশ্রেণির ধর্মীয় জাতপ্রথায় অনলদগ্ধ প্রজাবর্গের জন্যে স্বস্তি এবং সমৃদ্ধি বয়ে এনেছিল। অবশ্য ইসলামের আলো বঙ্গে আগেই প্রদীপ্ত হয়েছিল। নবম শতকের শেষ ভাগে বিখ্যাত সুফি দরবেশ বায়েজিদ বোস্তামী চট্টগ্রামের সন্নিকটে খানকা স্থাপন করে আশপাশের অঞ্চলে ইসলাম প্রচার করেছিলেন।
একাদশ শতকে সুলতান রুমী নামক আরেকজন সুফির সন্ধান পাওয়া যায়, যিনি ময়মনসিংহ জেলার উত্তরাঞ্চলে জনৈক কোচ রাজার রাজ্যে খানকা স্থাপন করে ইসলাম প্রচার শুরু করেন। তাঁর আধ্যাত্মিক ও অলৌকিক ক্ষমতার (কারামতের) প্রভাবে দলে দলে মানুষ ইসলাম গ্রহণ করতে থাকে। কোচ রাজা সংবাদ পেয়ে ভীত হয়ে দরবেশকে তার দরবারে তলব করেন। রাজদরবারেও তাঁর বিভিন্ন কারামত প্রকাশ পায়, ফলে রাজা তাকে মদনপুর গ্রামে বসবাস এবং নির্বিঘ্নে ধর্ম প্রচারের অনুমতি দেন।[10]বাংলা সাহিত্যে সূফী প্রভাব– মনির উদ্দীন ইউসুফ পৃ. ১১
এ দুজনেরও পূর্বের আরেকজন সূফী সাধকের কথা জানা যায়। যিনি তৎকালীন বাংলার রাজধানী গৌড়ের নিকটস্থ পাণ্ডুরায় একটি মসজিদ, একটি উদ্যান এবং খানকা নির্মাণ করেছিলেন। তাঁর খানকায় প্রত্যহ সর্বশ্রেণির দরিদ্র দুঃস্থ এবং মুসাফিরের আহার জুটত। তাঁর নাম ছিল শেখ জালাল উদ্দিন তিবরিজী। তাঁর হাতে কীভাবে শত শত মানুষ ইসলাম ধর্মে দীক্ষিত হয়েছিল তার বিভিন্ন কাহিনী ‘শেখ শুভদয়’ নামক একটি সংস্কৃত পুস্তকে লিপিবদ্ধ রয়েছে–যার লিপিকার গৌড়ের শেষ হিন্দু রাজা লক্ষণ সেনের সভাকবি হালায়ুধ মিশ্রকে মনে করা হয়।[11]মুসলিম বাংলা সাহিত্য–ড.এনামুল হক পৃ. ২০-২১
কিন্তু বিস্ময়ের বিষয় হলো, শেখ শুভোদয় সংস্কৃত ভাষায় লেখা হলেও পণ্ডিতগণ এর উপর বাংলা ভাষার প্রভাব লক্ষ করেছেন। সংস্কৃতির উপর বাংলার এই প্রভাবের কারণ আমরা অনুসন্ধানে খুঁজে না পেলেও অনুমান করতে পারি—সাধারণ মানুষের সঙ্গে সুফি সাধকের আলাপন হয়তো বাংলায় হতো। এ কারণে ইতিহাস লিপিবদ্ধ করবার সময় রচয়িতা বাংলাকে উপেক্ষা করতে পারেননি। সুতরাং ইতিহাসের এই চমৎকার তথ্যটি থেকে আবিষ্কৃত হলো—বাংলা ভাষার সেই প্রাচীন যুগেই মুসলমানগণ বাংলা ভাষাকে আপন করে নিয়েছিলেন। অন্যদিকে হিন্দু শিক্ষিত সমাজের কোল আলো (?) করে রেখেছিল সংস্কৃত ভাষা।
বাংলায় মুসলমানদের সেনাভিজানের পূর্ব থেকে এখানে অবস্থানকারী এসব সুফিসাধকদের কল্যাণে পরবর্তীতে বাংলায় সুলতানি শাসন প্রতিষ্ঠা সহজ এবং টেকসই হয়েছিল। উত্তম চরিত্রবলে সুফিগন এ অঞ্চলের মানুষের মন জয় করে রেখেছিলেন, এরপর সুলতানরা বর্ণবাদী সেন রাজাদের হটিয়ে শাসনযন্ত্রও জয় করে নিয়েছিলেন।
বাংলায় সুলতানি শাসনামলে লাঞ্ছিত-বঞ্চিত বাংলা ভাষার উপযুক্ত লালন পালন শুরু হয়। প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ছাত্রদের আরবি-ফারসির পাশাপাশি বাংলা শিক্ষার প্রচলন শুরু করা হয়। বাংলা বহু মুসলমানের মাতৃভাষা ছিল বলে মুসলিমরা বাংলাকে অবহেলা করত না। অভিবাসী মুসলিমরাও বাংলা ভাষা এবং এ দেশকে নিজেদের দেশ হিসেবে গ্রহণ করে নিয়েছিলেন।[12]ব্রিটিশ আমলে বাংলার মুসলিম শিক্ষা: সমস্যা ও প্রসার– মোহাম্মদ আবদুল্লাহ আল … Continue reading
মুসলিম আগমনের আগে বাংলার শিক্ষাব্যবস্থা প্রধানত ব্রাহ্মণদের হাতে কুক্ষিগত ছিল। মুসলিম শাসকেরা সুবিধাভোগী হিন্দু শ্রেণীর কবল থেকে নিম্নবর্গের হিন্দুদের সুবিধা লাভের সুযোগ করে দেন, ফলে নিম্নবর্গের হিন্দুদের বুদ্ধিবৃত্তিক বিকাশের পথ উন্মুক্ত হয়।[13]বাংলার দেশজ শিক্ষাধারা– পরমেশ আচার্য
বাংলায় মুসলমানের আগমনের কারণেই যে বাংলা আজ পৃথিবীর প্রতিষ্ঠিত একটি সভ্য ভাষা এই সত্যের অকাট্যতা আমরা ইতিহাস থেকে লাভ করলাম এবং সামনেও লাভ করব।
মধ্যযুগ ১৩৫০ থেকে ১৮০০ খ্রিস্টাব্দ
সন্ধিযুগে বাংলার লালন পালন শুরু হলেও এর যৌবন প্রকাশিত হয় বাংলা ভাষার মধ্যযুগে।
১২০১ সালে বাংলায় মুসলিম শাসনের গোড়াপত্তন হলেও সমগ্র বাংলা মুসলমানের অধিকারী আসে ১৩৫২ সালে। এ সময় শামসুদ্দিন ইলিয়াস শাহ সমগ্র বাংলার অধিপতি হন। সমগ্র বাংলায় মুসলিম শাসনের ফলে বাংলা ভাষার মধ্যযুগকে ডঃ মুহম্মদ শহীদুল্লাহ সহ অনেক গবেষক ‘মুসলিম যুগ’ বলেও অবহিত করেছেন। তারা ‘মুসলিম যুগ’ উপাধি দিয়ে কোনো অত্যুক্তি করেননি, কারণ এ সময়ে বাংলা একটি সভ্য এবং অভিজাত ভাষায় পরিণত হয়েছিল। পাশাপাশি সাহিত্যের সমঝদার সুলতানদের দরবারে হিন্দু পণ্ডিতদের আনাগোনার ফলে পারসিক সাহিত্যের বিভিন্ন ধারার সঙ্গে বাংলা সাহিত্যের পরিচয় ঘটে এবং সাহিত্যে নতুন নতুন ধারা সৃষ্টি হয়। অবশ্য সুলতানদের সাহিত্য–মজলিসে হিন্দুদের উপস্থিতির কারণ ছিল মুসলমানেরই মানবতাবাদ। মানুষকে মানুষ হিসেবে মূল্যায়ন এবং তার প্রাপ্য অধিকার নিশ্চিত করবার ফলে ব্রাহ্মণদের সৃষ্ট বিভিন্ন অনুশাসনের আজ্ঞাবহ লাঞ্চিত এবং উৎপীড়িত ব্রাত্য হিন্দু সমাজ অবহেলা থেকে মুক্তি পায়। ফলত হিন্দুদের ইসলাম গ্রহণের ধারা আরও বেগবান হয় এবং সাহিত্যে নতুন জনরা সৃষ্টি হয়। মুসলিম সুলতানগণ যেহেতু শিক্ষা এবং সাহিত্যের অনুরাগী ছিলেন, সেহেতু তাঁরা এক্ষেত্রে হিন্দু-মুসলিমের ভেদ করতেন না।
যেমন, ইতিহাসে আমরা দেখতে পাই—গৌড়ের সুলতান গিয়াস উদ্দিন আজম শাহ (১৩৮৯–১৪১০) তাঁর দরবারে পারস্যের মহাকবি হাফিজকে আমন্ত্রণ করে নিয়ে এসেছিলেন। পাশাপাশি তিনি তাঁর দরবারে মিথিলার কবি বিদ্যাপতিকেও আমন্ত্রণ করেছিলেন। গৌড়ের আরেক সুলতান শামসুদ্দিন আহমদ শাহ ( ১৪৩১–১৪৪২) তাঁর দরবারে মধ্যযুগের কবি চণ্ডীদাসকে আমন্ত্রণ করেছিলেন। কবি সুলতানের দরবারে নিজের লেখা কবিতাও পাঠ করেছিলেন বলে জানা যায়।
এ থেকে বোঝা যায়, বাংলার কবি-সাহিত্যিকগণ সুলতানদের দরবারে পারস্যের মহাকবিদের অর্থাৎ রুমি সাদী হাফিজের কবিতার সঙ্গে পরিচিত হয়েছিলেন এবং প্রভাবিত হয়েছিলেন, যার কারণে বাংলা সাহিত্যে প্রেম, মানবতার রূপকল্প এবং ভাবাবেগের এক নতুন মাত্রা যুক্ত হয়েছে, যা ইতিপূর্বে সদ্য বয়ঃসন্ধিতে উপনীত হওয়া বাংলা ভাষায় অনুপস্থিত ছিল। ‘ইসলামি বাংলা সাহিত্য’ গ্রন্থে এস কে সেন একথা স্বীকার করে বলেছেন—মুসলমানরাই এ ধরনের রোমান্টিক গল্পের পথিকৃত এবং একচ্ছত্র অধিপতি ছিলেন।[14]বাংলা সাহিত্যে মুসলমান– আবদুল মান্নান সৈয়দ পৃ. ৬১
মুসলমানের সমাজে হিন্দুর অবাধ প্রবেশ এবং সুলতানদের সাহিত্য মজলিসে হিন্দু সাহিত্যিকদের উপস্থিতির ফলে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ যে দুটি ঘটনা সংঘটিত হয়। সেগুলো হলো—
১. হিন্দুদের মধ্যে গোঁড়া রক্ষণশীল এবং উদারপন্থি দুটি গ্রুপ তৈরি হয়।
২. হিন্দুদের পারস্পরিক উক্ত মেরুকরণের ফলে এ বিষয়টি স্পষ্ট হয়ে ওঠে যে, গোঁড়া হিন্দুরা নিজেদের ধর্ম, উঁচু জাত এবং হিন্দুত্ববাদ রক্ষার্থে বাধ্য হয়েই সাহিত্যের পথে হেঁটে ছিলেন।
ডঃ মুহাম্মদ এনামুল হকের ভাষায়—অতঃপর সেই চাঞ্চল্য সমাজ ছাড়াইয়া ধর্মের ক্ষেত্রেও ফুটিয়া উঠিতে লাগিল। হিন্দুর মনে প্রশ্ন জাগিতে লাগিল, তবে কি বেদ-বেদান্ত, স্মৃতি-পুরাণ প্রভৃতি শাস্ত্র, ব্রহ্মা-বিষ্ণু-মহেশ্বর আদি দেবতা এবং আচার-বিচার, ক্রিয়া ইত্যাদি অনুষ্ঠান–সমস্তই ভুল? আর ইসলাম, ভ্রাতৃত্ব, মানবতা প্রভৃতিই সত্য? ধর্ম মানুষের জন্য, না মানুষ ধর্মের জন্য? এই যুগের খ্যাতনামা হিন্দু কবি চণ্ডীদাস ঘোষণা করিলেন—
‘শুন হে মানুষ ভাই!
সবার উপরে মানুষ সত্য, তাহার উপরে নাই।’
ইহাতে গোঁড়া হিন্দুদিগের রক্ষণশীলতার আসন টলটলায়মান হইল। রক্ষণশীল দলে রব উঠিল, রক্ষা কর, রক্ষা কর। এই রব দেশের এক প্রান্ত হইতে অন্য প্রান্তে বায়ুর পাখায় ভর করিয়া উড়িয়া চলিল।
হুসেন শাহী বংশের রাজত্বকালে বাংলার সংস্কৃত ধারার প্রধানতম কেন্দ্র নবদ্বীপের পণ্ডিত সমাজ হইতে পণ্ডিত রঘুনন্দন এবং নৈয়ায়িক রঘুনাথ শিরোমণি রক্ষণশীল হিন্দুদের নেতৃত্ব গ্রহণ করিলেন। অতঃপর সংহিতার ব্যবস্থায় ও ন্যায়ের ধুম্রজালে হিন্দু সমাজকে আচ্ছন্ন করিয়া দিবার চেষ্টা চলিল।
এই চেষ্টাও ব্যর্থতায় পর্যবসিত হইল। ১৫৪০ খৃষ্টাব্দের কাছাকাছি সময়ে নুলো পঞ্চানন তাঁহার ‘গোষ্ঠী কথা’ নামক গ্রন্থে ‘মেলবন্ধন’ করিলেন। তিনি রঘুনন্দনের স্মৃতির ব্যবস্থা, রঘুনাথের নৈয়ায়িক বিচার কিছুরই প্রশংসা করিলেন না। তিনি লিখিলেন–
‘এই কালে রাড়ে বঙ্গে পড়ে গেল ধূম।
বড় বড় ঘর যত হইল নিধুম-‘
রঘুনাথ রঘুনন্দনের ন্যায় হাতি-ঘোড়া যেখানে তলাইয়া গেল, সেখানে নুলো পঞ্চাননের মতো ফড়িং কত জল জিজ্ঞাসা করিয়াও বিশেষ কিছু যে করিতে পাড়ে নাই, তাহা বলাই বাহুল্য। ফলতঃ জীবনের সহিত সংশ্লিষ্ট হিন্দুর ধর্ম, সমাজ, সহায় ও সংস্কৃতি প্রভৃতি এমন কোন জিনিষ রহিল না, যাহাতে এই সময়ে ইসলামের মুখ্য বা গৌণ প্রভাব পড়িল না। ‘প্রেম বিলাসের’ কথায় এই বিক্ষোভ এইভাবে প্রচার পাইয়াছে–
‘কলিকালে লোক সব বড় দুরাচার,
প্রধান কারণ তার যবন অধিকার।
হিন্দু সমাজের এই বিক্ষোভের সময়ই চৈতন্য দেবের (১৪৮৫-১৫৩৩) আবির্ভাব। ১৫০৬ খৃষ্টাব্দে তিনি নদীয়ায়-‘গৌড়ীয় বৈষ্ণব মত’ প্রচার করিতে থাকেন। তাঁহার এই মত ঘটক ও কারিকাকারদের এবং রক্ষণশীল পণ্ডিতদের হিন্দু ধর্মীয় মতবাদের প্রতিক্রিয়া মাত্র। এই মতবাদ ইসলামকে মানিয়া লইয়া প্রগতিশীল হইয়া উঠায়, দেশ স্থায়ী ও বিস্তৃত হইতে সমর্থ হয়।
‘নামে রুচি, জীবে দয়া’ ইহাই গৌড়ীয় বৈষ্ণব মতের মূলমন্ত্র।,,,
‘জীবে দয়া’ সাম্য ভ্রাতৃত্ববোধে রূপান্তরিত হইয়া হিন্দুদের জাতিভেদ প্রথা লোপ করিয়া দিবার চেষ্টা করে। বলা বাহুল্য, গৌড়ীয় বৈষ্ণবদের এই ‘নামে রুচি জীবে দয়া’ মুসলিম সাধকদের ‘জিকর’ ও ‘খিদমৎ’ নীতির নামান্তর,,,।
ডক্টর এনামুল হকের বর্ণিত ইতিহাস থেকে আমরা মৌলিকভাবে দুটো জিনিস বুঝতে পারলাম—
এক. হিন্দু পণ্ডিতেরা বাংলা ভাষাকে নিছক একটি ভাষা এবং এর মাধ্যমে ব্রাত্যদের সঙ্গে তাদের দূরত্ব কমানোর মাধ্যম হিসেবে গ্রহণ করেনি। তারা এটিকে শিক্ষার মাধ্যম হিসেবে মূল্যায়ন করেনি এবং ভাষায় সমৃদ্ধি আনবার লক্ষ্যেও তারা সাহিত্যচর্চা করেনি বরং তারা বাংলা ভাষাকে হিন্দু জাতীয়তাবাদের প্রচার মাধ্যম হিসেবে গ্রহণ করেছিল। তৎকালের মডারেট বা উদার হিন্দুদের বিরোধিতা করার জন্যে তারা সাহিত্যের ময়দানে পা রেখেছিল।
দুই. বাংলাকে আপন করে নিয়ে এর মাধ্যমে ইসলামের মানবতাবাদ প্রচার এবং এর ব্যাপক জনপ্রিয়তা লাভের প্রতিক্রিয়ায় হিন্দুদের ধর্মে-কর্মে সংস্কার ঘটে। যেমনটা আমরা চৈতন্যদেবের ইসলাম থেকে ধার করা মানবতাবাদ প্রচারের মাধ্যমে দেখতে পাই। শ্রীচৈতন্য ধার করে বৈষ্ণব ধর্ম গড়ে তুলেছিলেন তার অনেক প্রমাণ থাকলেও সবচে বড় প্রমাণ বোধ হয় এটাই যে, চৈতন্যের দুই প্রধান অনুগামী ছিলেন রুপা গোস্বামী এবং সনাতন গোস্বামী। তারা প্রথমে হোসেন শাহের মন্ত্রী ছিলেন, তখন তাদের নাম ছিল শাকের মল্লিক এবং দাবির খান। তারা ফারসি ভাষার পণ্ডিত ছিলেন। ইসলামের বিভিন্ন শাস্ত্রেও তাদের বেশ পারদর্শিতা ছিল। জ্ঞানগত ইসলামে পাণ্ডিত্য হাসিল করা এই দুই শিষ্যের সাহায্যে শ্রীচৈতন্য গড়ে তুলেছিল তার বৈষ্ণব ধর্ম।
অপরদিকে মুসলমান বাংলা ভাষাকে কোনো ধর্মীয় এবং রাজনৈতিক উদ্দেশ্য ছাড়াই আপন করে নিয়েছিল। (যদিও এ কারণে পরবর্তীতে মুসলমানের জন্যে উভয় উদ্দেশ্যেই সাধিত হয়েছিল) এর স্বীকৃতি আমরা পাই পণ্ডিত রাহুল সাংকৃত্যায়নের কাছ থেকে। তিনি তার বই ইসলামের রূপরেখাতে উল্লেখ করেন, ইসলাম সর্বত্র স্থানীয়তাকে স্বীকার করে নিয়েছে বলে বিশ্বব্যাপী বিস্তৃত হয়েছে। মধ্যযুগের সুলতানদের পৃষ্ঠপোষকতায় বাঙালি হিন্দু-মুসলমান সাহিত্য যে প্রবাহ সৃষ্টি করে তাতে বিদেশ ও স্থানীয়তার অপরুপ মিলন ঘটে।[15]বাংলা সাহিত্যে মুসলিম ঐতিহ্য– সৈয়দ আলী আশরাফ পৃ. ৪৮
এমনকি আরবি-ফারসির পাশাপাশি বাংলাকেও যেন সমান গুরুত্বে চর্চা করা হয় সেদিকে মুসলমানরাই সবচেয়ে বেশি তাগাদা দিয়েছেন। উধাহরণত আমরা মধ্যযুগীয় বিখ্যাত বাঙালি কবি আব্দুল হাকিমের (১৬২০-১৬৯০) কথা উল্লেখ করতে পারি। তিনি তাঁর কাব্যগ্রন্থ ‘শিহাবুদ্দিননামা’য় বাংলা প্রচারে যারা বাধা দেয় তাদের নিন্দা করেন। পক্ষান্তরে তিনি বলেন, আরবি এবং ফারসির পর ইসলামী ভাষার মধ্যে বাংলার স্থান। যারা আরবি এবং ফারসি জানে না তাদের উচিত বাংলার মাধ্যমে ইসলামী সাহিত্য পড়া। তা না হলে তাদের ‘ঈমান’ থাকবে না; তারা অন্ধকারে থেকে যাবে।[16]বাংলা সাহিত্যে সূফী প্রভাব– মনির উদ্দীন ইউসুফ– পৃ. ২৯
এই মধ্যযুগেই মূলত আরবি-ফারসিভাষীদের বাংলা চর্চা এবং বাংলাভাষীদের আরবি-ফারসি বিভিন্ন উৎস থেকে উপাদান গ্রহণ করে বাংলা চর্চা করবার ফলে বাংলা প্রচুর পরিমাণ আরবি-ফারসি শব্দ অধিগ্রহণ করে সভ্য-সমৃদ্ধ হয়ে ওঠে। এ কথার স্বীকৃতি দিয়ে দীনেশচন্দ্র সেন(১৮৬৬–১৯২৯) বলেন—ব্রাহ্মণগণ প্রথমত ভাষা-গ্রন্থ প্রচারের বিরোধী ছিলেন। কৃত্তিবাস ও কাশীদাসকে ইহারা ‘সর্বনেশে’ উপাধি প্রদান করিয়াছিলেন এবং অষ্টাদশ পুরাণ অনুবাদকগণের জন্য ইহারা ‘রৌরব’ নামক নরকে স্থান নির্ধারিত করিয়াছিলেন। আমার বিশ্বাস, মুসলমান কর্তৃক বঙ্গবিজয়ই বঙ্গভাষার এই সৌভাগ্যের কারণ হইয়া দাঁড়াইয়াছিল। মুসলমানগণ ইরান, তুরান প্রভৃতি যে স্থান হইতেই আসুন না কেন, এদেশে আসিয়া সম্পূর্ণরূপে বাঙালি হইয়া পড়িলেন।[17]বাংলা সাহিত্যে মুসলমান – আবদুল মান্নান সৈয়দ পৃ. ৬২
মুসলমান কর্তৃক দীনহীনা বাংলা ভাষা একটি অভিজাত এবং সমৃদ্ধ ভাষা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হওয়ার ফলে বাংলার উপর আমাদের মুসলমানদের অধিকার প্রতিষ্ঠিত হয়ে গিয়েছিল সুলতানি আমলেই। আরবি-ফারসি অলংকারে অলংকৃত বিশ্বের প্রায় ত্রিশ কোটি মানুষের এই ভাষার আভিজাত্য মুসলমানের দান—এ দাবি করবার হক আমাদের জন্যে সাব্যস্ত হয়ে গিয়েছিল সেই মধ্যযুগে। সুতরাং একবিংশ শতাব্দীতে এসে যদি কোনো পামর বাংলার অলংকার আরবি-ফারসি শব্দসমূহকে অস্বীকার করতে চায় এবং এসব শব্দে তাদের নরক যন্ত্রনা শুরু হয়, তাহলে তাদের যন্ত্রণা-কাতর ধ্বনি আমরা প্রাণ ভরে উপভোগ করি। আমাদের পূর্বপুরুষদের সাফল্য এবং তাদের দাদাবাবুদের ব্যর্থতার কথা স্মরণ করে দিল খোশ করি।
আধুনিকযুগ ১৮০০ খ্রি. থেকে চলমান
বাংলা ভাষা-সাহিত্যের আধুনিক যুগ শুরু হয় মূলত ১৮০০ সালে কলকাতায় ফোর্ট উইলিয়াম কলেজ প্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়ে। এই কলেজ প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে মুসলমানের উপর ইংরেজ কর্তৃক সার্বিক আগ্রাসন নতুন মাত্রা লাভ করে। শিক্ষার মাধ্যমকে ইংরেজিতে রূপান্তরিত করবার ফলে মুসলমানকে শিক্ষা থেকে বঞ্চিত করবার ষোলো আনা পূর্ণ হয় তখন। অপরদিকে ইংরেজি মাধ্যমের এই শিক্ষা উচ্চবর্গীয় হিন্দুদের জন্যে সহজলভ্য করে দেয়ায় শিক্ষায় অংশগ্রহণ এবং ইংরেজের আমদানিকৃত বিদেশি সাহিত্যের রূপ-রসে উচ্চবর্গের হিন্দুরা বাংলা সাহিত্যে বিভিন্ন নতুন ধরন সৃষ্টি করে বাংলার নয়া জমিদার হয়ে ওঠে। হিন্দুদের জমিদারির একালেই বাংলা ভাষায় ইংরেজি ফরাসি রুশ লেটিন ইত্যাদি বিদেশি শব্দ প্রবেশ করে। এ সময় সদ্য সাম্রাজ্যহারা মুসলমানগণ আত্মগ্লানিতে জর্জরিত হয়ে এবং আত্মাভিমানের প্ররোচনায় আধুনিক বাংলা সাহিত্য চর্চা থেকে নিজেদের সরিয়ে রাখেন। মধ্যযুগীয় কাব্যিক পুঁথিসাহিত্যে বুঁদ হয়েই নিজেদের দুঃখ ভুলবার ব্যর্থ কোশেশ করতে থাকেন।
ভারত আগমনের পর মানুষকে মানুষ গণ্য করা এবং তাদের প্রাপ্য সম্মানে বুঝিয়ে দেওয়ার দরুন অভিজাত মানুষে পরিণত হওয়া মুসলমানের জন্যে ইংরেজ এবং ইংরেজের ফুট সোলজার সুবিধাভোগী বাবুদের থেকে অমানুষের আচরণ পাওয়ার ফলে এ ধরনের আত্মাভিমানী গোস্বা অযৌক্তিক কিছু ছিল না।
কিন্তু অর্থনৈতিক সামাজিক এবং হিন্দু জাতীয়তাবাদী কবি সাহিত্যিক দ্বারা সৃষ্ট সাংস্কৃতিক আগ্রাসনের ফলে মুসলমান এই গোস্বা বেশিদিন ধরে রাখতে পারিনি।
ভারতবর্ষের স্বাধীনতা সংগ্রামে অগ্রণী হয়ে মুসলমানের ইংরেজ আগ্রাসনের মোকাবেলার ইতিহাস তো সকেলেরই জানা। রাজনৈতিক আগ্রাসন মোকাবেলার পাশাপাশি সাংস্কৃতিক আগ্রাসন মোকাবেলা করে উপমহাদেশের সভ্যতা সংস্কৃতিতে মুসলমানের অবদানকে অনস্বীকার্য হিসেবে প্রতিষ্ঠার লড়াইয়েও তাঁরা অবতীর্ণ হয়েছিলেন সমান আগ্রহে। আদর্শের দাবি থেকে।
‘বাংলা ভাষা মুসলমানের দান’ এই সত্য চিরউন্নত রাখবার জন্যে আমাদের পূর্বসূরিগণের চেষ্টা মেহনতের নমুনা আমরা আমাদের মুসলিম রেনেসাঁর তিন কবি—কায়কোবাদ, নজরুল ইসলাম এবং ফররুখ আহমদের মেহনতের ভেতর দিয়ে আবিষ্কার করবার চেষ্টা করব। তার আগে পূর্বসূরিদের সাংস্কৃতিক লড়াইয়ে অবতীর্ণ হওয়ার প্রেক্ষাপটের দিকে এক দৃষ্টি দেওয়া যাক।
ইতিহাস থেকে আমরা আগেই প্রমাণ পেয়েছি মধ্যযুগে হিন্দু পণ্ডিতদের সাহিত্যে হাতে খড়ি হয়েছিল মূলত মুসলিম জাগরণ প্রতিহত করা হিন্দু জাতীয়তাবাদের বিষবাষ্প ছড়িয়ে দেওয়া এবং সাধারণ হিন্দুদের মনে তাদের দেব-দেবীদের সম্পর্কে আস্থা ফিরিয়ে আনবার উদ্দেশ্যে। তাদের এই সাম্প্রদায়িক প্রয়াসেরই একটি হলো মঙ্গলকাব্য—এতে অনুমিতভাবেই হিন্দুদের মনে মুসলমানদের একটি বর্বর জাতি হিসেবে প্রতিষ্ঠা এবং মুসলিম সভ্যতা সংস্কৃতির প্রতি ঘৃণা তৈরির প্রয়াস চালানো হয়েছে। এই ধারাবাহিকতারই আরেকটি সংযোজন হেমচন্দ্রের কাব্য—এতে মৌলিক বিষয় হিসেবে ঠাঁই পেয়েছে রামরাজ্যের স্তুতি। সঙ্গে সঙ্গে মুসলিম সুলতানদের যাচ্ছেতাইভাবে হেয় করা হয়েছে এসব গ্রন্থে । বিষাক্ত এমন সাহিত্যকর্মের ফিরিস্তি বেশ দীর্ঘ। ঐতিহাসিক ভোলানাথ ঘোষ তার ‘সাহিত্য পরিক্রমা’ গ্রন্থে উল্লেখ করেন–সিপাহী বিদ্রোহের পর থেকে যে সমস্ত সাহিত্য রচিত হয়েছে তাতে হিন্দু জাতীয়তাবাদকেই গৌরবান্বিত করে দেখান হয়েছে। (বাংলা সাহিত্য পরিক্রমা-ভোলানাথ ঘোষ, কলিকাতা, ১৯৫৮, পৃষ্ঠা ৩২৩)।
ভোলানাথের এই উক্তির সমর্থন পাওয়া যায় হেমচন্দ্রের ‘ভারত সঙ্গীত’ কবিতায় (১৮৭০), নবীনচন্দ্র সেনের কাব্যত্রয়ীতে–’রৈবতক’ (১৮৮৬), ‘কুরুক্ষেত্র’ (১৮৯৩) এবং ‘প্রভাস’ (১৮৯৬)। এর মধ্যে ‘ভারত সঙ্গীত’ পশ্চিমবঙ্গের শিক্ষা গেজেটে অন্তর্ভুক্তির সময়ে সম্পাদক ভূদেব চন্দ্র লেখেন–এটি একটি ঐতিহাসিক কবিতা এবং সপ্তদশ শতকে মুগলদের বিরুদ্ধে হিন্দু মনোভাব জাগ্রত করার জন্যই কবিতাটি রচিত হয়। ভারত সঙ্গীতের মতো স্পষ্ট মুসলিমবিরোধী মনোভাব পরিলক্ষিত হয় মুসলমানের টাকায় নেয়ে-খেয়ে জাতে উঠা বঙ্কিমচন্দ্রের আনন্দমঠে (১৮৮২) এবং তাঁর ঐতিহাসিক উপন্যাস রাজসিংহ (১৮৮২) ও সীতারামে (১৮৮৭)। বিশেষত আনন্দমঠ তো হিন্দু জাতীয়তাবাদীদের আদর্শ গ্রন্থ হয়ে উঠেছিল। এর বিষয়বস্তু ছিল মুসলিম আধিপত্য থেকে বাঙলি হিন্দুর মুক্তি।[18]মুসলিম বাংলা সাহিত্য– ড. এনামুল হক পৃ. ৯
ইতিহাস দর্পণে সামান্য দৃষ্টিপাতেই অনুধাবন করা যায়—আধুনিক যুগে হিন্দু সাহিত্যিকগণ মূলত তাদের মধ্যযুগীয় উত্তরসূরিদেরই অনুসরণ করেছেন এবং বর্ণপ্রথার এক আধুনিক রূপ বঙ্গবাসীর সামনে হাজির করেছেন। মধ্যযুগে তাদের পূর্বপুরুষ রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা না থাকার কারণে মিশনে তেমন সফল না হলেও দখলদার ইংরেজের ছত্রছায়ায় ব্রাহ্মণদের আধুনিক প্রজন্ম পূর্বপুরুষের অপূর্ণ মিশনে ভালো সফলতা লাভ করেছিল। সাম্রাজ্যবাদীদের যোগসাজশে ঊনবিংশ শতাব্দীর সূচনাকালে মুসলমানকে সাংস্কৃতিকভাবে দাবিয়ে রাখতে সমর্থ হয়েছিল তারা।
কিন্তু মুসলমান অবদমিত হয়ে থাকবার পাত্র নয়। অনুভূতিশীল মুসলমানের অভিজাত রক্তের গতি সর্বদাই ঊর্ধ্বমুখী। আর উর্ধ্বগতির লহুর প্রভাবে বাংলা সাহিত্যাসমানে এক নক্ষত্রের আবির্ভাব ঘটে। যে নক্ষত্রের শ্রেষ্ঠত্ব বিনা ভেধে স্বীকার করতে বাধ্য হয়েছিল মুসলিম-হিন্দু সকলে। আমাদের সেই নক্ষত্রের নাম—কায়কোবাদ।
ভীনদেশি কবিদের মধ্যে কায়কোবাদের আদর্শ ছিলেন হাফিজ সাদী ফেরদৌসীদের মতো মহাকবিগণ। আর বাঙালি কবিদের মধ্যে তাঁর পছন্দের তালিকায় সবার উপরে ছিলেন অসাম্প্রদায়িক কবি হিসেবে যার খ্যাতি—মাইকেল মধুসূদন দত্ত এবং চির সাম্প্রদায়িক দুই কবি হেমচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায় এবং নবীনচন্দ্র সেন—যাদের সাম্প্রদায়িকতার ইতিহাস আমরা পূর্বে আলোচনা করেছি। কায়কোবাদ এই কবিদের সম্পর্কে বলেছেন, আজ সেরূপ কবি নাই-কবিতা নাই-কবিতা লিখিবার শক্তিও আমাদের নাই, সে হাফেজ নাই—সে সাদী নাই—সে ফেরদৌসী নাই, তাহারা আর ফিরিয়া আসিবে না; সে কালিদাস-সে বায়রন-সে হেম নবীন মধু সাহিত্যের কুসুমকানন আর কলকল কণ্ঠে মুখরিত করিয়া তুলিবে না; সে কানন এখন নীরব-নিস্তব্ধ-নিঝুম, সে দোয়েল পাপিয়া কোকিল ঘুঘু চিরকালের জন্যই বিদায় লইয়াছে।
–ভূমিকা, অমিয়-ধারা[19]বাংলা সাহিত্যে মুসলমান–আবদুল মান্নান সৈয়দ পৃ. ৬১
সাহিত্যের পাণ্ডিত্য স্বীকার করে হেমচন্দ্র নবীনচন্দ্রদের প্রতি ইনসাফ করেছেন আমাদের কবি। কিন্তু আদর্শের প্রশ্নে ছাড় দেননি একচুল। মুসলিমবিদ্বেষী সাম্প্রদায়িক বাবুদের সম্প্রদায়িকতার কথা নির্দ্বিধ কন্ঠে বলেছেন। সঙ্গে স্পষ্ট করেছেন নিজের আদর্শের জায়গা। কবি বলছেন—
নবীন সেনের আশীর্বাদ-লিপি শিরে ধারণ করিয়া কবিতা লেখা আরম্ভ করিয়াছিলাম। তাঁহার প্রশংসা আমাকে প্রভৃত উৎসাহ দিয়াছিল কিন্তু তাই বলিয়া তাঁহার অনুকরণে হিন্দু ইতিহাস হইতে উপাদান সংগ্রহ করি নাই। আমি মুসলমানদের মনের কথা মুসলমানকে শুনাইতে চাহিয়াছি। ইহাই আমি আমার প্রধান কর্তব্য বলিয়া ধরিয়া লইয়াছিলাম।’
মহাশ্মশান মহাকাব্যের ভূমিকায় লেখেন–
আমার এই কাব্যে কোনো সম্প্রদায়ের লোককেই আক্রমণ করি নাই, হিন্দু লেখকগণ যেমন মুসলমানদিগকে অযথা আক্রমণ করিয়া পিয়ন চাপরাশি কুলি মজুর রূপে রঙ্গমঞ্চে আনয়ন করিয়া বাহবা লইয়াছেন। ভুরু চাচা নেড়ে মামা ইত্যাদি মধুর সম্ভাষণে আপ্যায়িত করিয়া মনের ক্ষোভ মিটাইয়াছেন। আমি হিন্দুদিগের প্রতি তেমন ব্যবহার করি নাই, তবে যুদ্ধপ্রার্থী হিন্দু-মুসলমান পরস্পর গালাগালি করিয়া ‘কাফের কুকুর নরাধম পাষণ্ড বর্বর’ ইত্যাদি মধুর সম্ভাষণ আখ্যায়িত করিয়া শেষে হৃদয়ের উষ্ণ শোণিতে প্রাণের জ্বালা মিটাইয়াছেন, যেস্থানে যেটুকু হওয়া দরকার এবং যাহা না হইলে কাব্যের অঙ্গহানি হইত, আমি কেবল তাহাই চিত্রিত করিয়া উহার প্রকৃত বর্ণনা ফুটাইয়া দিয়াছি। আমি এই চিত্র নিরপেক্ষভাবেই অঙ্কিত করিয়াছি।[20]বাংলা সাহিত্যে মুসলিম ঐতিহ্য সৈয়দ আলী আশরাফ পৃ. ৪৭
নিজের মুসলমানিত্বের নিঃসংকোচ প্রকাশ এবং মুসলমানের প্রতি হিন্দুর হীন বর্ণবাদের সমালোচনা করতে গিয়ে তিনি কখনও প্রতিক্রিয়াশীল সমালোচনার ভয় করেননি। মুসলিম রেনেসাঁর পটভূমি নির্মাণে তার হস্ত কম্পিত হয়নি একটি বারের জন্যেও।
১৯৩৮ খ্রিস্টাব্দে কলকাতার ইসলামিয়া কলেজের এক সংবর্ধনা সভায় কায়কোবাদ বলেন, হিন্দু লেখকগণ তাচ্ছিল্যভাবে বলেন—মুসলমানগণ বাঙ্গালা লিখতে জানেন না। তাহাদের মধ্যে প্রভাত-চিন্তা, নিশীথ-চিন্তা, ছায়া-দর্শন প্রভৃতি গ্রন্থলেখক, ‘বান্ধব’ সম্পাদক ও সমালোচক কালীপ্রসন্ন ঘোষ বিদ্যাসাগর বাহাদুর C. I. E. ছিলেন অগ্রণী। মুসলমানের বাঙ্গালা ভাষায় দখল আছে কিনা, মুসলমান বিশুদ্ধ বাঙ্গালা ভাষা লিখতে জানে কিনা তাহা দেখাবার জন্যই আমি বিশুদ্ধ বাঙ্গালা ভাষায় কাব্য লিখতে আরম্ভ করি।
–ইসলামিয়া কলেজ ম্যাগাজিন’, এপ্রিল ১১৩৮।[21]বাংলা সাহিত্যে মুসলিম ঐতিহ্য সৈয়দ আলী আশরাফ পৃ. ৪৭
আত্মমর্যাদাশীল মুসলমানের যবান কখনও মাটিতে গড়ায় না—হিন্দু বাবুদের বিষয়টি ষোলো আনাই বুঝিয়ে দিয়েছিলেন কায়কোবাদ। অন্যথায় গেরুয়া সাহিত্যিকেরা কায়কোবাদের পাণ্ডিত্যকে কেনই বা স্বীকৃতি দিবে! দলিল হিসেবে এখানে দুজনের স্বীকৃতির কথা উল্লেখ করাই যথেষ্ট। প্রথমজন–নবীনচন্দ্র সেন, কায়কোবাদে মুগ্ধ হয়ে বলেন–মুসলমান যে বাঙ্গালা ভাষায় এমন সুন্দর কবিতা লিখিতে পারে, আমি আপনার উপহার না পাইলে বিশ্বাস করিতাম না; অল্প সুশিক্ষিত হিন্দুরই বাঙ্গালা কবিতার উপর এরূপ অধিকার আছে। [কবি নবীনচন্দ্র সেনের পত্র, ২রা এপ্রিল ১৮১৬]
দ্বিতীয়জন—মুসলমানকে তাচ্ছিল্যকারী কালীপ্রসন্ন ঘোষ। নিজের জামাতার কাছে লেখা এক চিঠিতে কালীপ্রসন্ন বলেছেন, কবি সাহেবকে জানাইয়া দিও যে তাঁহার লেখা বড়ই মাদকতাপূর্ণ, আমি তাঁহার মহাশশ্মাশান পাঠ করিয়া এরূপ তৃপ্তি লাভ করিয়াছি যে তাঁহার অনুমতির অপেক্ষা না করিয়া আমি উহার কিয়দংশ আমার পুস্তকে উদ্ধৃত করিয়াছি।
এত ছিল নিঃশর্ত স্বীকৃতি। কিন্তু হিন্দু সাহিত্যিকদের অনেকেই কায়কোবাদকে স্বীকৃতি দেওয়ার সময় এটা প্রমাণ করতে চেয়েছেন–কায়কোবাদ বাঙালি হতে গিয়ে প্রাচীন মুসলিম ঐতিহ্য থেকে সরে এসেছেন। ফলে তার সাহিত্যে আরবি-ফারসির পরিবর্তে সংস্কৃত প্রাধান্য লাভ করেছে। কিন্তু হিন্দু বাবুদের এমন দাবি যে কেবলই অপবাদ সেটা বুঝতে হলে খুব ইতিহাস ঘাটতে হবে না। বরং কায়কোবাদের খানা দুয়েক কবিতা পাঠই এর জন্যে যথেষ্ট। আর কেউ যদি নিয়মতান্ত্রিক কাব্যের পাঠক হয়ে থাকেন, তাহলে তার কাছে এ ব্যাপারটি স্পষ্ট থাকবে—নজরুল কাব্যে আরবি-ফারসি শব্দের ঐতিহাসিক ব্যবহার এবং ঈদ, শবে বরাত, আযান ইত্যাদি একান্ত মুসলমানের জীবনঘনিষ্ঠ বিষয়ে কাব্য রচনার মূল পাটাতন কবিগুরু কায়কোবাদই।
কায়কোবাদের সঙ্গে প্রাসঙ্গিকভাবে যার নামটি উচ্চারণ না করলেই নয়—বাংলা ভাষার সুবিখ্যাত ঐতিহাসিক উপন্যাস ‘বিষাদ সিন্ধু’র লেখক মীর মোশাররফ হোসেন। প্রখ্যাত উপন্যাসিক নাট্যকার এবং গবেষক আব্দুল মান্নান সৈয়দের ভাষায় উনবিংশ শতাব্দীতে সারা বাংলা সাহিত্যে বঙ্কিমচন্দ্র এবং রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে বাদ দিলে মীর মোশাররফ হোসেনের তুল্য বড় লেখক আর ছিল না।[22]বংলা সাহিত্যে মুসলমান– আবদুল মান্নান সৈয়দ পৃ. ১০১
কায়কোবাদের পর আমাদের রেনেসাঁর কবি হিসেবে কাজী নজরুল ইসলামকে পাই। বাংলা সাহিত্যাঙ্গনে নজরুলের পদধূলি পড়ে ১৯১৯ সালে। সে থেকেই নজরুল আমাদের দ্রোহের কবি। বিশ্বাসের কবি। আধুনিক বাংলা সাহিত্যে কায়কোবাদের হাতে সূচিত মুসলিম বৈশিষ্ট্যে মণ্ডিত স্বতন্ত্র সাহিত্যধারার উপরেই স্থাপিত হয়েছিল নজরুলের সাহিত্যের ভিত, যার প্রমাণ তাঁর প্রথম দু-একটি সাহিত্যকর্মে নজর দিলেই স্পষ্ট হয়। সাহিত্যে পদার্পণের বছরই নজরুল ‘তুর্কি মহিলার ঘোমটা খোলা’ নামে একটি প্রবন্ধ রচনা করেন । মূলত এটি ছিল তুরস্কের রমণীদের কটাক্ষ করে রচিত সাহিত্যিক হেমেন্দ্র কুমারের রায়ের (১৮৮৮–১৯৬৩) রচনার তীব্র জবাব।
প্রাথমিক সময়ে নজরুল গল্পকার হিসেবে শুরু করলেও কবি নজরুলের কবিসত্তাও ইসলামী ভাবাবেগ থেকে খালি ছিল না। ১৯২০ সালে প্রকাশিত হয় নজরুলের ‘খেয়াপারের তরণি’ শিরোনামের কবিতাটি। নজরুল কাব্যে সেখানেই প্রথম মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম উল্লেখ পাওয়া যায়। এরপর নবিচরিত সম্পর্কে নজরুলের বিখ্যাত মরু ভাস্কর এবং ফাতেহা ই দোয়াজদমের কথা বাংলা ভাষায় নিজেদের হক দাবি করতে পারা সকল মুসলমানেরই জানা।
নজরুল কাব্যে আমরা আমাদের বিশ্বাসের সুবাস পাই। আমাদের বিদ্রোহী কবির ভাষণেও যখন আমরা ইমানের খোশবু পাই, তখন কবি আল মাহমুদের সঙ্গে সমকণ্ঠে উচ্চারিত আমাদের স্লোগান–‘আমার ধর্মবিশ্বাস আমার আত্মবিশ্বাস’ আরও দীপ্ত এবং নিষ্কম্প হয়ে ওঠে।
১৯৪০ সালে ডিসেম্বর মাসে কলকাতার মুসলিম ইনস্টিটিউট হলে একটি ভাষণ দেন কবি। যেখানে তিনি বলেন, যে দিন আল্লাহ তাঁর এই বান্দার অন্তর-বাহিরের সর্বসত্তাকে তাঁর বলে গ্রহণ করবেন—আমার বলে কিছুই থাকবে না, যেদিন আমার পরম স্বামী পরম প্রভুর দরবার থেকে পাবো ফরমান, সেই দিন আমি তাঁরই ইঙ্গিতে কর্মে নামবো; তার আগে নয়। আল্লাহ আমায় সর্ব প্রলোভন হতে রক্ষা করুন। শুদ্ধজ্ঞান ও শুদ্ধপ্রেমের মিলনে তখন সে কর্ম হবে তাঁর কর্ম। এ বান্দার নয়–শুদ্ধ কর্ম। আজ আমার বলতে দ্বিধা নেই আল্লাহর রহমত আমি পেয়েছি। আমার পরম প্রিয় ‘আল গফুরুল ওদুদ’ তিনি আমায় নাজাত দিয়েছেন। কিন্তু অন্যকে মুক্ত করার শক্তি তিনি আমায় দেননি। [এই ভাষণটি দৈনিক ‘কৃষক’ পত্রিকার ৮ই পৌষ ১৩৪৭ সংখ্যায় প্রকাশিত হয়েছিল।]
নজরুল বাঙালি মুসলমানকে ঋণী করে গেছেন বাংলা ভাষার মুসলমানী চেহারা সমুন্নত করবার মাধ্যম। বাংলা ভাষাকে মুসলমানী চেহারা দানের ক্ষেত্রে নজরুলের সবচেয়ে বড় অবদান–বাংলা কাব্যে আরবি-ফারসির নান্দনিক ব্যবহার। নজরুলের পূর্বসূরি মুসলিম সাহিত্যিকগণ আরবি-ফারসি শব্দের ব্যবহার করেছেন ঠিক কিন্তু তা ছিল সমাজে প্রচলিত আরবি-ফারসি শব্দটির বিকৃত রূপ অর্থাৎ বাংলা রূপ। কিন্তু নজরুল ছিলেন এক্ষেত্রে অনন্য। তিনি আরবি-ফারসি শব্দটির প্রচলিত রূপ ব্যবহার না করে মূলরূপ ব্যবহার করেছেন। তবে কোথাও গ্রামীণ চিত্র-চরিত্র নির্মাণের স্বার্থে গ্রামীন বিকৃত রূপও ব্যবহার করেছেন।
এক্ষেত্রে নজরুলের আরেকটি অনন্য সাংস্কৃতিক কারনামা হলো, তিনি এমন অনেক জায়গায় আরবি-ফারসি শব্দ ব্যবহার করেছেন যেখানে তার মূল সংস্কৃত, যেমন–‘রক্ত’ শব্দের পরিবর্তে তিনি ব্যবহার করেছেন ‘খুন’ শব্দ। এরূপ ব্যবহারে রবীন্দ্রনাথ আপত্তি জানাতেন। তার মতে এতে খামোখা খুন শব্দের অর্থ জটিল হয়। কিন্তু নজরুল তা ব্যবহার করেছেন এই যুক্তিতে–মুসলমানের কাছে উভয় অর্থই জ্ঞাত।[23]বংলা সাহিত্যে মুসলমান– আবদুল মান্নান সৈয়দ পৃ. ১০১
নজরুল এসব মুসলমানি শব্দকে বাংলার অলংকার খেতাব দিয়েছেন। বলেছেন–আমি মনে করি, বিশ্ব-কাব্যলক্ষ্মীর একটা মুসলমানি ঢং আছে। ও সাজে তাঁর শ্রীর হানি হয়েছে বলেও আমার জানা নেই। বাংলা কাব্য-লক্ষ্মীকে দুটো ইরানী ‘জেওর’ পরালে তাঁর জাত যায় না, বরং তাঁকে আরও খুবসুরতই দেখায়।
বাংলা ভাষা ও সাহিত্যকে মুসলমানী সাজ-সজ্জায় অলংকৃত করবার মিশনে নজরুলের ভাবধারাকে সামনে বয়ে নিয়ে গেছেন ফররুখ আহমদ। নজরুলের মতো তিনিও মূল আকৃতিতে আরবি-ফারসি শব্দের ব্যবহার করেছেন। এক্ষেত্রে উভয়েরই অনুপ্রেরণা ছিল–মুসলিম ইনকেলাবের চেতনা। কারণ উভয়ই মুসলমানের অবদানের ধারক-বাহক এসব শব্দের প্রতি তাচ্ছিল্য দেখতে পেয়েছিলেন। রামপন্থিদের সামগ্রিক আগ্রাসনের মুখে দাঁড়িয়ে তাঁরা অনুভব করতে পেরেছিলেন এসব শব্দের তাৎপর্য। তাই তো তেজস্ক্রিয় ভাষা এবং বিপ্লবী চরিত্র নির্মাণে একেকটি আরবি-ফারসি শব্দ তাদের হাতে হয়ে উঠেছিল একেকটি শব্দাস্ত্র!
সাহিত্যে মুসলিম ইনকেলাব জিন্দা করবার ক্ষেত্রে উভয়ের ভূমিকাই অতুল্য। তবে ফররুখ একটি বিষয়ে নজরুলকেও ছাড়িয়ে গেছেন–নজরুল কাব্যে নায়কের ভূমিকায় শিবের মতো হিন্দু পুরাণের কিছু চরিত্রের প্রকাশ ঘটেছে কোথাও কোথাও। কিন্তু ফররুখ কাব্যে আমরা নায়ক হিসেবে দেখতে পাই–দুঃসাহসী আরব নাবিক সিন্দাবাদ এবং হাতেম তায়ীকে। ফররুখ এ দুই আরব নায়কের দুঃসাহস এবং বদান্যতার কল্পেগল্পে বাঙালি মুসলমানের মানসে সঞ্চার করেছেন নবজাগরণের জোশ-দুর্বার। হীনমন্যতার কৃষ্ণ-গহ্বর থেকে এক ঝটকায় তুলে এনে বসিয়ে দিয়েছেন ঝড়ো হাওয়ায় পাল তোলা সিন্দবাদের জাহাজে। গাফলতের নিদ্রায় ডুবে থাকা বাঙালি মুসলমানকে জাগিয়ে তুলেছেন আত্মসমালোচনার তীক্ষ্ণ সুরে। বলে উঠেছেন রাত পোহাবার কত দেরী পাঞ্জেরী?
১৮০০ সালের পর থেকেই বাংলা সাহিত্য দুটি ধারায় প্রবাহিত হয়েছে– রামায়ণ মহাভারত আশ্রিত সাম্প্রদায়িক সাহিত্য এবং এর প্রতিক্রিয়ায় সৃষ্ট স্বতন্ত্র মুসলিম সাহিত্য। প্রথম ধারার সাহিত্যের জন্ম এবং বিকাশ কলকাতায়। অপরদিকে মুসলিম সাহিত্যের জন্ম কলকাতায় হলেও এর প্রতিপালন এবং পূর্ণাঙ্গ বিকাশ সাধিত হয়েছে বাংলাদেশে। সুতরাং দেশভাগের পর এই অঞ্চলে চর্চিত সাহিত্যধারা মুসলমানের সাহিত্যধারা। স্বতন্ত্র রাষ্ট্র এবং স্বতন্ত্র সভ্যতা সংস্কৃতি নির্মাণের দাবিতে এ দেশের মুসলমান সাহিত্যে বিশ্বাসের চর্চা করেছেন। গেয়েছেন পূর্বপুরুষের ঐতিহ্যের গান। অন্যায় অস্বীকারের নিচে চাপা পড়তে থাকা সে ঐতিহ্য ফিরিয়ে আনবার লক্ষ্যে করেছেন বুদ্ধির চর্চা। দ্বিজাতিতত্ত্বের যুক্তিতে এসব সত্য ঐতিহাসিকভাবে প্রমাণিত। দেশভাগ-পূর্ব ১৯২৬ সালে ঢাকায় প্রতিষ্ঠিত মুসলিম সাহিত্য সমাজ (শিখা গোষ্ঠী হিসেবে যারা প্রসিদ্ধ) মহাকবি কায়কোবাদ, নজরুল, ফররুখ তার ঐতিহাসিক দলিল।
আমাদের ভাষা থেকে আরবি–ফারসিকে বিদায় করে বাংলাকে রামপন্থি ভাষায় রূপান্তরিত করতে চাওয়া গেরুয়া রঙে রঙিন সুশীলবর্গ কি এসব ঐতিহাসিক দলিলের প্রামাণ্যতা অস্বীকার করতে পারবে? দাদাবাবুদের পেয়ারে দিওয়ানা হয়ে যদি তারা এসব দলিল অস্বীকার করে বসে তাহলে তাদেরকে নেমকহারাম বললে কি আমাদের কোনো গুরু পাপ হবে? আর যদি তারা বাংলাদেশে সাহিত্যচর্চার এ মৌলিক পাটাতনকে স্বীকৃতি দেন তাহলে তাদের জন্য তোলা রইল মোবারকবাদ! তবে তার আগে সুশীলদের পক্ষ থেকে গঙ্গার জলে গেরুয়া প্রেমের প্রতিমা বিসর্জন দিয়ে আরবি-ফারসি শব্দের মাধ্যমে বাংলা ভাষার সমৃদ্ধি লাভ করবার স্বীকৃতিমূলক জবানবন্দি দেয়া আদর্শবাদী বাঙালি মুসলমানের অধিকার বৈকি। অন্যথায় নব্য সাংস্কৃতিক লড়াইয়ের রেড লাইনে দণ্ডায়মান বাঙালি মুসলমান এসব সুশীলের সীমান্তজয়ী প্রেমলীলা এবং সেই প্রেমের আবদার মেটানো যাবতীয় মুসলিমবিদ্বেষী বয়ানের উপর সহনশীলতার পর্দা ছড়িয়ে দিবে কোন সুখে?
মুসলমানের সভ্যতা-সংস্কৃতি তার ধর্ম-আদর্শের ওইসব উপাদানের অন্তর্ভুক্ত যেগুলোর মাধ্যমে সে আন্তর্জাতিক সমাজে মুসলামন পরিচয়ে আত্মপ্রকাশ করে। অবিশ্বাসীদের ভীড়ে নিজেকে বিশ্বাসী হিসেবে চিহ্নিত করে। বাংলাভাষায় মুসলমানের হক সুপ্রতিষ্ঠিত এবং অনস্বীকার্য। এ ভাষার উচ্চারণকার্যে আরবি-ফারসি শব্দের অলংকার উচ্চারণকারীর মুসলমানিত্বের আলামত। সুতরাং মুসলমানের মুসলমানিত্বের নির্দেশ করা আলামতের উপর যখন বিদ্বেষের লালা ঝরে তখন মুসলমানের মুসলমানিত্বের উপরই সেই লালার বিষক্রিয়া দেখা দেয়। আক্রান্ত হয় তার আদর্শ। আশঙ্কাগ্রস্ত হয় তার বিশ্বাস। আর বিশ্বাসের বিলীনে নিহিত অস্তিত্বের লীন। ইসলাম এমন বিলীন হওয়ার পথ রুদ্ধ করে দেয়–‘আল ইসলামু ইয়ালু ওয়ালা ইউলা আলাইহি’–‘সবার উপর ইসলাম শ্রেষ্ঠ তার উপর নাই’ বলে। ইসলাম এই শ্রেষ্ঠত্ব প্রতিষ্ঠার দায়িত্ব দেয় মুসলমানকে। তাই মুসলমানের কর্তব্য ইসলামের শ্রেষ্ঠত্বের জন্যে হানিকর যাবতীয় উল্লম্ফন প্রতিহত করা। বিশ্বাসের নিরাপত্তা বিধানে বাহ্যিক কর্মকাণ্ডের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা।
বাংলাদেশের মুসলমান কিংবা বাংলাভাষী মুসলামান সকলেই একবিংশ শতাব্দীর এই এই অস্থির সময়ে তার বাহ্যিক কর্মকাণ্ডে নানাবিধ হামলার শিকার। বাংলাভাষা থেকে মুসলিম অবদান এবং মুসলমানিত্বের বাহ্যিক আলামত আরবি-ফারসি শব্দ বিতাড়নের প্রয়াস সেসব হামলারই অন্তর্ভুক্ত। বাংলার মুসলমানের অবশ্যকর্তব্য এসব হামলার মোকাবেলা করা। এক্ষেত্রে পূর্বশর্ত–মুসলমান পরিচয়ের সঙ্গে বাঙলি বিশেষণ যুক্ত করবার ক্ষেত্রে কৃত্রিম ধর্মীয় সংকোচ ঝেড়ে ফেলে বাঙালি মুসলমান হিসেবে নিজেকে পরিচয় করিয়ে দেওয়া। বাংলার সভ্যতা সংস্কৃতির যা কিছু আক্ষরিক অর্থেই সভ্যতা-সংস্কৃতি ইতিহাসের পাটাতনে দাঁড়িয়ে তা নিজেদের বলে দাবি করবার বল সঞ্চয় করা। বাংলা ভাষায় নিজেদের হক বুঝে নেওয়া। আরবি-ফারসির দোহাই দিয়ে কোনো পামর বাংলা থেকে ‘আলহামদুলিল্লাহ’ ‘সুবহানাল্লাহ’ মুছে দিতে চাইলে তাকে বলা আরবি-ফারসি বাদ দিয়ে সফেদ কাগজে দুকলম লিখে দিতে।
এসব উটকো সুশীলের পুর্বপুরুষও দু’লাইন সাম্প্রদায়িকতা চর্চার জন্যে আরবি কাজগ-কলমের পদ চুম্বন করেছিল। আর এরা তো অন্যের ধনে পোদ্দার। যাদের ধন তারাই ছোট জাত যবনের আরবি-ফারসি অলংকারের পদ চুম্বন না করে সাহিত্য করতে পারেনি। সুতরাং দাদাবাবু স্টাইলে একই নেপথ্যে বাংলা ভাষায় জমিদারি ফলাতে চাওয়া এসব সুশীলবাবু কি পারবে যবনের ভাষা ছাড়া ওপারের আধুনিক ব্রাহ্মণদের প্রতিনিধিত্ব করতে?
তথ্যসূত্র:
↑1 | বাংলা সাহিত্যে মুসলিম ঐতিহ্য– সৈয়দ আলী আশরাফ পৃ.৪৮ |
---|---|
↑2, ↑3, ↑4 | বাঙ্গালা ভাষার ইতিবৃত্ত–ড.মুহম্মদ শহীদুল্লাহ |
↑5 | বাংলা সাহিত্যে মুসলিম ঐতিহ্য–সৈয়দ আলী আশরাফ পৃ. ১৬ |
↑6 | আল বেরুনীর ভারততত্ত্ব পৃ. ৪৪-৪৫ |
↑7 | ভারতীয় শিক্ষার ইতিহাস– বেবি দত্ত, মধুমালা, দেবিকাগুহ পৃ. ৪৪৫ |
↑8 | বাঙ্গালা ভাষার ইতিবৃত্ত – ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ পৃ. ১৬ |
↑9, ↑10 | বাংলা সাহিত্যে সূফী প্রভাব– মনির উদ্দীন ইউসুফ পৃ. ১১ |
↑11 | মুসলিম বাংলা সাহিত্য–ড.এনামুল হক পৃ. ২০-২১ |
↑12 | ব্রিটিশ আমলে বাংলার মুসলিম শিক্ষা: সমস্যা ও প্রসার– মোহাম্মদ আবদুল্লাহ আল মামুন পৃ. ১২ |
↑13 | বাংলার দেশজ শিক্ষাধারা– পরমেশ আচার্য |
↑14 | বাংলা সাহিত্যে মুসলমান– আবদুল মান্নান সৈয়দ পৃ. ৬১ |
↑15 | বাংলা সাহিত্যে মুসলিম ঐতিহ্য– সৈয়দ আলী আশরাফ পৃ. ৪৮ |
↑16 | বাংলা সাহিত্যে সূফী প্রভাব– মনির উদ্দীন ইউসুফ– পৃ. ২৯ |
↑17 | বাংলা সাহিত্যে মুসলমান – আবদুল মান্নান সৈয়দ পৃ. ৬২ |
↑18 | মুসলিম বাংলা সাহিত্য– ড. এনামুল হক পৃ. ৯ |
↑19 | বাংলা সাহিত্যে মুসলমান–আবদুল মান্নান সৈয়দ পৃ. ৬১ |
↑20, ↑21 | বাংলা সাহিত্যে মুসলিম ঐতিহ্য সৈয়দ আলী আশরাফ পৃ. ৪৭ |
↑22, ↑23 | বংলা সাহিত্যে মুসলমান– আবদুল মান্নান সৈয়দ পৃ. ১০১ |