বাংলা সাহিত্যের শ্রেষ্ঠ কবিদের একজন আল মাহমুদের কবিতার বই পড়েননি এমন সাহিত্যপ্রেমী খুঁজে পাওয়া ভার। গুণী এই কবি একাধারে একজন সাংবাদিক, শিশুসাহিত্যিক, ঔপন্যাসিক ও প্রাবন্ধিক। তবে সবকিছু ছাপিয়ে গেছে তার কবি পরিচয়। আধুনিক বাংলা কবিতা নানা দিক থেকে তার কাছে ঋণী থাকবে। বাচনভঙ্গি আর রচনাশৈলীতে তার কবিতা সমকালীন যেকোনো কবির তুলনায় অনন্য। ‘কবিতাসমগ্র’ (দুই খন্ড) ‘উড়ালকাব্য’, ‘সোনালি কাবিন’, ‘আল মাহমুদের স্বাধীনতার কবিতা’, ‘প্রেমের কবিতা সমগ্র’, ‘আল মাহমুদের শ্রেষ্ঠ কবিতা’ ইত্যাদি কবিতার বই নিয়ে আল মাহমুদ কবিতাসমগ্র। এছাড়াও আল মাহমুদ উপন্যাস সমগ্র প্রকাশিত হয়েছে তিন খণ্ডে। জাতীয় রাজনীতি, অর্থনীতি, সামাজিক টানাপোড়েন, স্বাধীনতা যুদ্ধের পটভূমি ও প্রেক্ষাপটসহ সমাজ ও ব্যক্তি জীবনের দ্বন্দ্ব স্থান পেয়েছে আল মাহমুদ এর বই সমূহ-তে। ‘কালের কলস’, ‘লোক লোকান্তর’, ‘মায়াবী পর্দা দুলে ওঠো’, ‘বখতিয়ারের ঘোড়া’, ‘আরব্য রজনীর রাজহাঁস’, ‘গল্প সমগ্র’, ইত্যাদি তার উল্লেখযোগ্য লেখা। আল মাহমুদের জন্ম ১৯৩৬ সালের ১১ জুলাই ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার মোড়াইল গ্রামে। তার পুরো নাম মীর আবদুস শুকুর আল মাহমুদ। শিক্ষাজীবনেই তিনি লেখালেখির সাথে সম্পৃক্ত হন। রবীন্দ্রনাথ, কাজী নজরুল আর মধ্যযুগের বৈষ্ণব পদাবলী পাঠ করতে করতে নিজের কবি প্রতিভা আবিষ্কার করেন তিনি। ১৯৫৪ সালে সাপ্তাহিক কাফেলা পত্রিকায় লেখালেখি শুরু করেন। কিছুকাল পরই এ পত্রিকার সম্পাদক হিসেবে দায়িত্বপ্রাপ্ত হন। পুরো ৬০-এর দশক জুড়ে তিনি অসংখ্য কবিতা রচনা করেন এবং কবি হিসেবে প্রতিষ্ঠা ও খ্যাতি লাভ করেন। মুক্তিযুদ্ধের সময় তিনি প্রবাসী সরকারের হয়ে দায়িত্ব পালন করেন। পরবর্তীতে দৈনিক গণকণ্ঠ পত্রিকার সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন তিনি। এ পত্রিকায় সরকার বিরোধী লেখালেখির কারণে এক বছরের জন্য কারাদণ্ডও ভোগ করতে হয় তাকে। ১৯৭৫-৯৩ সাল পর্যন্ত শিল্পকলা একাডেমির পরিচালক হিসেবে কাজ করে কর্মজীবন থেকে অবসর গ্রহণ করেন। কবি আল মাহমুদ তার অনবদ্য রচনাশৈলীর জন্য ‘বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কার’, ‘একুশে পদক’, ‘জীবনানন্দ স্মৃতি পুরস্কার’, ‘নাসির উদ্দিন স্বর্ণপদক’ সহ অসংখ্য পদক ও সম্মাননা লাভ করেছেন। ২০১৯ সালের ১৫ই ফেব্রুয়ারি তিনি পরলোকগমন করেন।
গন্ধবণিক তার অনন্য সাধারণ একটি গল্প। গল্পটি পাঠককে রূঢ় এক বাস্তবতার সামনে নিয়ে দাঁড় করিয়ে দেয়। পাঠককে জীবন ও মৃত্যুকে দেখে ওঠে এক ভিন্ন অবয়বে। যা তার অস্তিত্বকে নাড়িয়ে দিয়ে যায়। আল মাহমুদের অনন্য সৃষ্টি এই গল্পটি নেয়া হয়েছে তার ‘গন্ধবণিক’ গল্পগ্রন্থ থেকে।
আমাদের ধারণা, গল্পটি পাঠকের ভালো লাগবে।
ট্রেন থেকে নেমেই মনে হলো, এটা কি আমাদের ব্রাহ্মণবাড়িয়া? চিরপরিচিত স্টেশনটাকেও আমার কেন জানি বড়ই অন্ধকারাচ্ছন্ন, অচেনা মনে হচ্ছে। অথচ কতই না চেনা এই রেলস্টেশন। এর লোকজন, দোকানপাট সবই তো আমার চেনা। এমন নয় যে বহুদিন পর আমি বাড়ি ফিরছি। আমি তো প্রতি মাসের প্রথম সপ্তাহেই বাড়ি ফিরি। যদি কোনো অঘটন বা অ্যাপয়েন্টমেন্ট না থাকে তবে মাসের বেতনটা হাতে নিয়ে আমি আর মুহূর্তমাত্র দেরি করতে চাই না। সোজা ছুটে যাই স্টেশনের দিকে। চাটগাঁ বা সিলেটের দিকে যে গাড়িই যাক, একটা সেকেন্ড ক্লাসের কামরা দেখে উঠে পড়লেই হলো। সাথে কোনো লটবহর বা সঙ্গিসাথির বালাই নেই। যেন ল্যাজ নেই গরুর ঘাগড়া খেত দিয়ে গোপাট।
আজ কেন পরিচিত গন্তব্যে নেমে জায়গাটাকে রহস্যময়, অচেনা আর অন্ধকারাচ্ছন্ন মনে হলো জানি না। পরে এ নিয়ে আমি চিন্তা করে দেখেছি। আমি যে একটু অন্যমনস্ক থাকি এটাই এর কারণ এরকম আমি সহজে ভাবি না। এটাতো আমার অভ্যেসই। সবাই জানে। সবচেয়ে যিনি বেশি জানেন তিনি আমার মা। আমার স্ত্রীও জানেন। তবে মায়ের চেয়ে একজন স্ত্রী কি তার নিত্যকার মানুষটিকে বেশি জানেন? যুক্তি দিয়ে বিচার করলে আধুনিক মনস্তাত্ত্বিকতা অবশ্য স্ত্রীর পক্ষ নেবে। কিন্তু আমি মায়ের পক্ষ নিতে চাই। যদিও আমার স্ত্রীকে আমি ভালোবাসি অনেকটা নির্লজ্জের মতোই। তবুও মায়ের চেয়ে নির্ভর একজন সন্তানের জন্য আর কে আছে?
আমার অন্যমনস্কতার জন্য স্টেশনটা আমার কাছে হঠাৎ অচেনা মনে হয়নি। অনেক সময় যেমন হাঁটতে হাঁটতে আমরা শহরের চিরপরিচিত এভেন্যুকেও অচেনা ভেবে হেঁটে পার হয়ে যাই। কিংবা থমকে দাঁড়িয়ে গিয়ে ভাবি, এ আমি কোথায় এসেছি? তারপর কোন পরিচিত দোকান, ট্রাফিক আইল্যান্ডের ধরন অথবা ওভার ব্রিজ দেখে বলে উঠি, আরে এটাতো গাউছিয়া মার্কেট পার হয়ে যাচ্ছি। আজকের বিভ্রান্তির ধরনটাও তেমনি। আমার চেতনার, পরিচিতির ধারণার মধ্যেকার ছবিটি কীভাবে যেন মাঝেমধ্যে উল্টে যায়। এই উল্টানো ছবিটা আবার ঠিকভাবে বসতে মুহূর্তমাত্র সময় নেয়। আবার ঠিক হয়ে যায়। সব ঠিক হয়ে গেলে বিস্মৃতির ভেতর স্থানকালকে আবার চেনা যায়।
হঠাৎ বিস্মৃতি টুটে ব্রাহ্মণবাড়িয়া স্টেশনকেও আমার বাল্যের চিরচেনা বিচরণ ক্ষেত্র বলেই মনে হলো। মনে হলো, কী আশ্চর্য, আমি আমার বাড়ির পরিবেশটাকেই কীভাবে বিস্মৃতির মধ্যে ডুবিয়ে দিতে পারি। স্টেশনের প্লাটফরম পার হলেই তো আমাদের বাড়ি। গভীর রাত না হলে নিশ্চয়ই এখান থেকেই আমাদের টিনের আটচালা ঘরটা দেখা যেত।
আমি স্টেশনের দিকে, যেখানে টিকেট কালেক্টর একজিটের সামনে দাঁড়িয়ে যাত্রীদের ধাক্কাধাক্কির মধ্যে টিকেট সংগ্রহ করছে সেখানে এসে দাঁড়ালাম। এর মধ্যে টিকেট কালেক্টর একবার চকিতে আমাকে দেখে নিয়ে হাত তুলে সালাম জানাল। আমি হাসলাম। লোকটা আমাকে চেনে। আমি ভিড়ের চাপাচাপি থেকে বাঁচার জন্য গেটের এক পাশে সরে গিয়ে পকেট থেকে সিগ্রেট বের করে ধরালাম। আমার তো কোনো তাড়া নেই। যদিও রাত আড়াইটার চেয়ে কিছু বেশি সময় আমার ঘড়িতে বাজছে। তবুও তাতে কী? আমার বাড়ি তো তিন-চার মিনিটের পথ। যদিও রেল লাইন পেরিয়ে সোজা পুবদিকে হেঁটে গেলে একই সময়ের মধ্যে আমাদের বাড়ির উঠোনে গিয়ে দাঁড়ানো যায়। তবুও আমি সব সময় যা করি, রাতের গাড়িতে বাড়ি ফিরলে, আগে স্টেশনের পাশের চায়ের দোকান থেকে তারিয়ে তারিয়ে এক কাপ চা খেয়ে তবে রিকসায় ওঠা, আজও তার অন্যথা করব না ভাবলাম। আসলে এই বিলম্বটুকু করি কারণ চায়ের দোকানে একটু বসলেই গাঁয়ের গত এক সপ্তাহের সমস্ত খবর, আত্মীয়স্বজন ও বন্ধুবান্ধবদের তত্ত্বতালাশ, গাঁয়ের স্পোটিং ক্লাবের ফুটবল ফাইনালের মারামারি, কলেজের স্ট্রাইক, দুটি সিনেমা হলের চলতি ছবি, বাজার দর, টাউন ক্লাবের মঞ্চে নাটক মঞ্চায়ন ইত্যাকার সমস্ত মফস্বল সন্দেশই চেখে নেওয়া যায়। নতুন ডি.সি. সাহেবের সাংস্কৃতিক ক্রিয়াকাণ্ড থেকে মাছের দাম পর্যন্ত জেনে নিতে পারলে পরদিন ছুটির দিনের আবহাওয়ার মধ্যে যখন বামা কেবিনে শহরের চির আড্ডাবাজদের সাথে চায়ের গুলতানি মারতে যাব তখন এ শহরের কোনো বিষয়ের উপরই মন্তব্য করতে অজ্ঞতার পরিচয় দিতে হবে না।
আমি সিগ্রেটটায় ধীরে সুস্থে দু’চারটে টান দিতেই ভিড়টা খানিকটা পাতলা হয়ে এল। আমি গেটটা পেরুবার জন্য পা বাড়াতেই দেখি আমার পরিচিত একটা রিকশাওয়ালা দৃষ্টি আকর্ষণের জন্য হাতের ইশারা করছে। আমি তার দিকে তাকিয়ে ডাকলাম, ‘আফজাল।’
‘আয়েন সার গেইটেই আমার রিক্সা।’
আমি গেইটটা পার হয়ে এলাম। আফজাল আমার পাশে দাঁড়িয়ে বলল, ‘সারের ব্যাগটেগ কই?’
‘না, কিছু আনিনি।’
‘সার কি খবরটা পাইয়া আইছেন?’
আচমকা জিজ্ঞেস করল আফজাল।
আমি হকচকিয়ে গিয়ে বললাম, ‘কী খবর আফজাল?’
‘তাইলে আপনে হুনেন নাই। মন্তু মিয়া সাব মারা গেছেন।’
আমি ইন্নালিল্লাহ পড়ে তাড়াতাড়ি বললাম, ‘কে, মন্তু নানা মারা গেছেন?’
‘জ্বি হুজুর। আপনাগো পুকুর পাড়ের বাড়ির। আপনের বুঝি নানা লাগতো?’
আমি বললাম, ‘হাঁ। কখন মারা গেলেন? কী হয়েছিল?’
‘সইন্দা রাইতে মারা গেছেন। আমি আপনেগো বাড়ির এক সাবেরে বাজার থিকা নামাইতে গিয়া হুনি কান্নাকাটি লাগছে পছিম পাড়ের বাড়িতে। জিগাইলাম, কার ইন্তেকাল অইল? একজন ছাত্রী কইল মন্তুমিয়া মারা গেছে, আতর যে বেচত।’
বলল আফজাল। আমি খানিকটা সময় স্তম্ভিত হয়ে থাকলাম। আফজালের কথা মিথ্যে হওয়ারতো কোনো কারণ নেই। আফজাল আমাদের মহল্লারই ছেলে। অপরিচিত লোক নয়। আর মন্তু নানাও কোনো অপরিচিত ব্যক্তি নন। এককালের বাংলাদেশের পূর্বাঞ্চলের সবচেয়ে পরিচিত, ধনী, সুখী, সম্ভ্রান্ত ও বিলাসী ব্যক্তি। তার কাছ থেকে আতর কেনেনি কিম্বা তার সদালাপে মুগ্ধ ছিল না এমন খুব কম মানুষই এ জেলায় পাওয়া যাবে। তার শরাফতি চাল-চলন। অনবরত উর্দু ও পারসিতে কথা বলা ও আবৃত্তি। গোঁফে মৃদু মৃদু মোচড় দেওয়া ও পকেট থেকে তুলা আর দুর্লভ গোলাবের শিশি কিম্বা মেশকের পেটমোটা চামড়ার অতিশয় ক্ষুদ্র মশক বের করে মুহূর্তের মধ্যে তুলা ভিজিয়ে কারো কানে গুঁজে দিতে দিতে বলা, ‘শকল তো বহুত খুবসুরত। শাহজাদে কা তারিফ?’
সেই মন্তু নানা মারা গেছেন?
আমি রিকসাওয়ালা আফজালকে বললাম, ‘চলো দোকান থেকে এক কাপ চা খেয়ে যাই।’
‘চলুন সার।’
আমি আফজালের পেছনে পেছনে সামনের একটা চায়ের দোকানে গিয়ে ঢুকলাম। পরিচিত দোকান। আমাদের মহল্লারই চেনা-জানা চাওয়ালা। আমাকে দেখে মৃদু হেসে নিজেই চুলার পাশে চা বানাতে গেল। আমার কুশল জেনে নিয়ে ঢাকার খবর জিজ্ঞেস করল। আমি অন্যান্য দিনের মতো গল্পে না মেতে দায়সারাগোছের জবাব দিয়ে চায়ের কাপে চুমুক দিলাম। মঞ্জু নানার মৃত্যু খবরটা আমার সারাটা মানসিক প্রান্তরে শোকের কালো পতাকা উড়িয়ে দিয়েছে। হরহামেশা বাড়ি আসা-যাওয়া করি কিন্তু বেশ কিছুকাল যাবৎ মন্তু নানার খোঁজ নিই না। অথচ একটা টিনের বেড়া পার হলেই মন্তু নানার জরাজীর্ণ কুঁড়েঘর। এককালে যিনি আগরতলার মহারাজের সাথে সুগন্ধ বিক্রয়ের সুবাদে বন্ধুত্বের দাবি করতেন। যার ঘরবাড়ি ছিল মহল্লার সবচেয়ে সৌখিন ঘরবাড়ি। যিনি শেষ পর্যন্ত দারিদ্র্যের চরমসীমায় নেমেও মুখের হাসি, আতরের শিশি ও শরাফতি চালচলন পরিত্যাগ করতে পারেননি। যার শেষ জীবিকা ছিল আতরভেজা তুলা যুবকদের কানে গুঁজে দিয়ে কিম্বা শহরের কলেজগামী যুবতিদের কবজিতে ঘষে দিতে দিতে সামান্য কিছু পয়সা চাওয়া। যা ছিল প্রকারান্তরে ভিক্ষাবৃত্তি, আজ তার অবসান হলো। আমি মনে মনে আবার ইন্নালিল্লাহ পড়লাম। মনের ভেতর শৈশবের অনেক স্মৃতি ভিড় করে এল। ভাবলাম বাড়ি ফিরেই মন্তু নানাকে আগে দেখতে যাব। মনে পড়ল মন্তু নানা আমাদের পরিবারের লোকজনদের মধ্যে আমাকেই গভীর স্নেহদৃষ্টিতে দেখতেন। ছাত্র বয়সে আমি যখন আমার পড়ার ঘরের সামনে বাগান করতাম, মন্তু নানা আমার রুচির খুব প্রশংসা করতেন। বলতেন, ‘বহুত আচ্ছা বেটা। গুল বাগিচা মে তুম হো গুলবদন।’
আমি চায়ের পেয়ালাটা নামিয়ে আফজালের রিকশায় এসে উঠলাম। লাইটপোস্টের আলোয় দেখলাম আমার ঘড়িতে রাত তিনটা পেরিয়ে যাচ্ছে। আমি বললাম, ‘আফজাল একটু জোরে চালাও।’
‘জী সাব।’
বলে আফজাল রিকশার পেডেলে জোরে চাপ দিল।
খুব অন্ধকারের মধ্যে আমি বাড়ির মসজিদের দরজায় এসে নামলাম। এখানে সব সময় একটা বাতি অর্থাৎ বৈদ্যুতিক বালব জ্বলে। মসজিদের পশ্চিম দিকের একটা থামের গায়ে বাতিটা থাকে। আজ বাতিটা অন্ধকার। সম্ভবত বালবটা ফিউজ হয়ে গেছে। একটা অশুভ অন্ধকার পরিবেশটাকে থমথমে করে রেখেছে। এখানে এলেই আমার কেমন যেন গাটা ছমছম করে। মসজিদের উত্তর-দক্ষিণে দু’পাশে কবরের সারি। আমার পূর্বপুরুষদের কবর। আমি সাধারণত রাতের গাড়িতে ফিরলে এখানে রিকসা থেকে নেমেই ভাড়া মিটিয়ে দিয়ে দ্রুত চত্বরটা পেরিয়ে আমাদের পুকুরের ঘাটলায় এসে দাঁড়াই। আসলে আমি কবরকে আবাল্য ভয় পাই। যেপথে কবর আছে আমি সেসব পথে দিনের বেলাতেও নিতান্ত দায়ে না ঠেকলে হাঁটি না। ছাত্রজীবনে আমি ঘোর নাস্তিক ছিলাম। তখনও এ ধরনের সংস্কার বা ভয় আমাকে ত্যাগ করেনি। এ ধরনের ভয় কেন জন্মায় আমি জানি না। হয়তো মানুষের হৃদয় এমন কিছু উপাদান দিয়ে তৈরি যা অদৃশ্যকে ভয় করে। নাস্তিকগণ অনেকটাই মিথ্যে দাম্ভিকতার কারণে এই পবিত্র ভীতিকে অস্বীকার করতে চায়। অথচ হৃদয় এই অলীক সাহসের বশীভূত থাকে না। শূন্য কবরস্থানের কাছে গেলেই রাতের বেলা অন্ধকারাচ্ছন্ন জায়গাটা দৌড়ে পার হয়ে বাঁচতে চায়। প্রকৃতপক্ষে যুক্তি ও বিজ্ঞানমনস্কের হৃদয় হলো অজ্ঞতাপ্রসূত যে সাহস সেই কুসংস্কারাচ্ছন্ন দুঃসাহসিক হৃদয়। বহুকাল যাবৎ আমি তেমন দুঃসাহসকে পার হয়ে এসেছি। বলা যেতে পারে আমি ভয় পাই। আর যুক্তি দিয়ে এই ভয়কে বোঝা বা বিশ্লেষণ করা আমার পক্ষে সম্ভবপর নয়।
আমি ভাড়া মিটিয়ে দিয়ে আফজালকে বিদেয় করে মসজিদের প্রধান ফটকের কাছে এসে দাঁড়ালাম। এখান থেকে প্রায় একশো গজ দূরে মন্তু নানার কুঁড়েঘরটা চোখে পড়ে। পুকুরের পশ্চিম পাড়েই নানার কুঁড়ে ঘরটা। মন্তু নানা আমার কেমন নানা তা আমি আজও জানি না। আমরা একই মহল্লার লোক হলেও একই গোষ্ঠীর সদস্য নই। আজন্ম দেখেছি আমার বাপ-মা এই আতর বিক্রেতা সৌখিন মানুষটিকে মামু বলে সম্বোধন করেন। এক-আধদিন বাজার করার মানুষ না পেলে দেখতাম আমার আম্মা মন্তু নানার শরণাপন্ন হয়েছেন। মন্তু নানা হাসিমুখে সবারই বাজার করে দিতেন। মহল্লার সব গৃহিণীরাই ছিল মন্তু নানার কেউ ভাগিনী, কেউ বা বোন। আবার কাউকে, যারা তাকে নানা বলে সম্বোধন করত সেইসব কিশোরী বধূদের তিনি নিজের দুলহেন বা জেনানা বলে ঠাট্টা করতে ছাড়তেন না।
মন্তু নানার স্ত্রীকে আমি দেখিনি। আমার কৈশোর কালে মন্তু নানা যখন ছিলেন চরম বিলাসী, আতর অগুরুর গন্ধে ম ম করা মধ্যবয়স্ক নবাবজাদাদের মতো। তখনও তার এক শুশ্রূষাকারিণী বোন ছাড়া তিনি ছিলেন নিঃসঙ্গ। এখন যেখানে তাঁর কুঁড়ে ঘরটা সেখানে ছিল টিনের এক বিরাট চৌচালা। তার একমাত্র বোনটি থাকতেন পাশের অন্য একটা ঘরে। মনে পড়ে সেই সুদূর বাল্যে আমি ভেজা বেড়ালের মতো পা টিপে টিপে সুগন্ধের লোভে তার ঘরে প্রবেশ করতাম। ঘরের বাতাসে, তার ফার্সি হুকোর ধোঁয়ায় আতর ও লোবানের এমন মিষ্টি গন্ধ ভরে থাকত মনে হয় বুকটা বেহেস্তি আঘ্রাণে ভরে গেছে। তার হুকোর পানিতে থাকত নেবুপাতার রস। তার কলকিতে খুশবুদার আম্বরি তামাক। তার বিছানার পাশে উন্মুক্ত হয়ে পড়ে থাকত নকশাকরা লাল-নীল রকমারি আতরের শিশি। শিশির ভেতর রং বেরংয়ের মহার্ঘ সুগন্ধি আতর। তার বিছানাটা দেখতাম সব সময় দামি শাদা বিছানাচাদরে ঢাকা। দুটি উঁচু বালিশ। ওপরকার বালিশের কোনায় টকটকে লাল সুতোয় একটা আধফোটা গোলাপ আঁকা।
বিছানার পাশে একটা জলচৌকিতে বেঢপ সাইজের একগাদা আরবি, উর্দু কিম্বা পারসি কেতাব। নানা রকম সুরমাদানি। একটা গ্রহরত্নের কেসও ছিল সেখানে। তিনি খদ্দেরদের জন্য আংটির পাথরও নির্বাচন করে দিয়ে হাদিয়া আদায় করতেন। তার জলচৌকির ওপর স্তূপীকৃত বেঢপ গ্রন্থকিতাবগুলো সম্বন্ধে আব্বা বলতেন, এসব হলো পুষ্প, গন্ধরস ও মূল্যবান রত্নাদি সম্পর্কীয় প্রাচীন দুর্লভ বইপত্র। বহুকাল যাবৎ মঞ্জু নানা এই সব পুস্তকাদির চর্চা করতেন। এ ধরনের কিতাবাদি আমাদের এলাকার কোনো পণ্ডিতেরই নাকি পড়ার সাধ্য ছিল না। মঞ্জু নানা কখন এসব কিতাব পড়ার ফুরসত পেতেন তা যদিও আমার নজরে পড়তো না তবুও এ পাড়ায় আমিই একমাত্র কিশোর যে সৌরভ-সুগন্ধির লোভে এ ঘরের আশপাশে ঘুরঘুর করতাম। ভেতরে যত পা টিপেই প্রবেশ করি না কেন মন্তু নানার নজরে পড়ে যেতাম। আমাকে দেখলেই মন্তু নানা মৃদু হাসতেন। মোটা গোঁফের কারণে তার চোরা হাসিটা প্রায় দেখাই যেত না। তবুও সুন্দর ঈষৎ পিঙ্গল চোখ জোড়ার ভেতর গবেষকের মতো অনুসন্ধিৎসু অক্ষিগোলক দুটি পুলকে কাঁপতে থাকত। আমি তার এই পুলকটা ধরতে পারতাম বলেই নির্ভয় ও নিঃসংকোচ ছিলাম। আমিও হাসতাম। আমার হাসিটাকে আমি যথাসম্ভব অনধিকার প্রবেশকারীর হাসির থেকে একটু একটু করে বন্ধুত্বের হাসিতে পরিবর্তিত করে ফেলতে পারতাম বলেই, ‘ক্যাও আন্দর আয়া? নিকালো জলদি’-বলে ধমক খেতে হত না। যা আর সব বয়েসী আগন্তুকেরই অহরহ ভাগ্যে জুটত। মন্তু নানা বলতেন, ‘বস মোড়াটায়।’
আমি হাসিমুখেই মোড়াটায় নিঃশব্দে বসে পড়তাম।
মন্তু নানা যাকে খুব ভালোবাসতেন কিম্বা যার সাথে বহুকাল যাবৎ তার স্নেহের সম্পর্ক ছিল তার সাথে দেশী ভাষায় কথা বলতেন। তার বাংলা উচ্চারণেও একটা বিদেশি টান, একটা ভিন্ ভাষার হরকতের গন্ধ পাওয়া যেত।
আমি মোড়াটাতে বসলেই বলতেন, ‘আজ ঘরের বাতাসে কোন্ ফুলের গন্ধ ভাসছে বলত নাতি?’
আমি কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে নিশ্বাস টেনে হঠাৎ জোরে দম ছাড়ার মতো বলতাম ‘যুঁই।’
‘বেশ্ক্।’
খুশি হয়ে বলতেন মন্তু নানা। আমার নাকের ডগায় তার আতরমাখা আঙুলগুলো একটু বুলিয়ে দিতেন। সে গন্ধটা সারাদিন আমার নাকে লেগে থাকত। যার অন্তর্হিত হওয়ার ভয়ে আমি সেদিন অন্তত গোসলের সময়ও গায়ে কিম্বা মুখমণ্ডলে সাবান ছোঁয়াতাম না।
আমি অনেকক্ষণ মন্তু নানার ঘরে থাকার সুযোগ পেতাম। তার সুন্দর পকেট ঘড়িটা, আইভরির কলমদানি, স্ফটিকের ফুলদানি, হরিণের চামড়ার চশমার খাপ, কষ্টি পাথরের পেপারওয়েট, মৃগনাভি রাখার চন্দনকাঠের বাকসো, রুপোর তৈরি জর্দার কৌটো আর সুগন্ধি চুরুটের মুখ কাটার চাকুটা হাত দিয়ে নেড়েচেড়ে দেখে মহা আনন্দ পেতাম। তার ঘরের সব জিনিসই ছিল আমার মতো একজন কৌতূহলী বালকের কাছে লোভনীয় বস্তু। বিশেষ করে চুরুট কাটার ঝকঝক চাকুটাতো ছিল আমার কাছে এক মহার্ঘ জিনিস। পাড়ার সব ছেলেদেরই পকেটে থাকত পেনসিল কাটার ছুরি। এ দিয়ে তারা কচি আম আর চালতার আচার কেটে খেত। কোমরের বেল্টের সাথে সরু শিকলে বেঁধে ছুরিটা ভাঁজ করে পকেটে রেখে তারা বাবুয়ানা করে স্কুলে যেত। আমার তেমন কোনো সম্পত্তি ছিল না। বাড়ি থেকে ছুরি-চাকু নিয়ে চলাফেরা করার ব্যাপারে আমার অভিভাবকদের কঠোর নিষেধ থাকায় আমি এই আনন্দ থেকে বঞ্চিত ছিলাম। মন্তু নানার সুন্দর চাকুটা থেকে আমি চোখ ফেরাতে পারতাম না। মাঝে মধ্যে লোভ হত চুরি করে নিয়ে যাই। আমার বয়সের সব ছেলেই সাধারণত একটু-আধটু চোর হয়। আমিও আমাদের ঘরে আব্বার কুটকাটের বাকসো থেকে পুরনো কাঁচি, মাছ ধরার হুইল, রানি ভিক্টোরিয়ার মস্তক আঁকা পুরনো পয়সা আর ময়ূরের পালক চুরি করতাম। কিন্তু মন্তু নানার কোন জিনিসে আমার লোভ জাগলেও চুরি করার সাহস হতো না। কারণ মন্তু নানা সারাটা মহল্লার ছেলেদের মধ্যে আমাকেই তার ঘরে ঢোকার অনুমতি দিতেন। বিশ্বাস করতেন। নাকেমুখে আর শার্টের বুকের কাছে আদর করে মাখিয়ে দিতেন চন্দনের খাঁটি গন্ধরস। একটা রুপোর তসতরি করে খেতে দিতেন পেস্তাবাদাম। গোলাপজলে ভিজিয়ে নরমকরা আখরোট আর আজোয়া খেজুর। মিষ্টি আরবি তেঁতুলের শুকনো টুকরো আর আলুবোখারা কত যে খেয়েছি, চকিতে এসব স্মৃতি মুহূর্তের মধ্যে মনে পড়ায় আজ চল্লিশ বছর পরও আমার আলজিভ লালা নিঃসরণ করল।
আমি মসজিদের ফটকটা ছাড়িয়ে শৈশবের সেই রহস্যময় মিষ্টি ভয়টার ধুকধুকানি বুকে নিয়েই আমাদের শানবাঁধানো ঘাটলায় এসে দাঁড়ালাম। হঠাৎ অন্ধকারটা আবছা হয়ে এসেছে। আকাশের দিকে তাকিয়ে দেখি মেঘের ওপর উটপাখির ডিমের মতো শাদা চাঁদ ভেসে উঠেছে। আসলে পূর্ণিমার রাতটাকে এতক্ষণ অবাঞ্ছিত মেঘ বুঝি আড়াল করে রেখেছিল। আমার ভয়টা এখনও যায়নি। যদিও অন্যান্য রাতে ঢাকা থেকে বাড়ি ফেরার কালে মসজিদের গেটটা পার হতেই যা আমার একটু গা ছমছম করে। সেখানে রয়েছে আমার সাত পুরুষের কবর। যাদের সাথে আমার নাড়ির বন্ধন রয়েছে কিন্তু তাদের মুখ বা অবয়ব আমি কোনদিন দেখি নি। যাদের রক্ত বইছে আমার শরীরে কিন্তু যাদের বর্তমান অবস্থা বা আমলনামার দায়ভাগ আমি বহন করি না। আমাকে তারা চেনে না আমিও চিনি না। এই জন্যই কি এত ভয় আর গা ছমছম করা? না এই রহস্যজনক ভীতির আরও কোনো গভীরতর অর্থ আছে?
আমি আমার বসতঘরটার দিকে দৃষ্টি ফেরালাম। ঘরটা ঘাটলা থেকে মাত্র পনেরো গজ দূরে। মনে হলো ঘরে লণ্ঠনের আলো জ্বলছে। ভাবলাম, আম্মা হয়তো সিলেট মেলের শব্দে বাতিটা জ্বেলে বসে আছেন। প্রতি মাসের পয়লা তারিখেই শেষরাতের গাড়িতে আমি বাড়ি ফিরি। আড়াইটার গাড়িটা স্টেশন পাস করলেই আম্মা উঠে বাতিটা জ্বালান। পাশের ঘরটায় থাকে আমার স্ত্রী কুলসুম। সে সেই ঘরে ঘুমে বিভোর হয়ে থাকে। আম্মা বউকে এত রাতে আর কষ্ট দিতে চান না। কারণ খাবারের আলমারি আর কেরোসিনের চুলাটা বড় ঘরেই থাকে। আমি ঢাকা থেকে না খেয়েই রওনা দিই বলে আম্মা আমার খাবারটা গরম করে প্লেটে সাজিয়ে বসে থাকেন।
আমি ঘরের দরজায় এসে দাঁড়ালাম। আমার জুতোর শব্দ পেয়েই আম্মা ভেতর থেকে সাড়া দিলেন, ‘কলিম এসেছিস?’
আমার জবাব দেবার আগেই দরজাটা খুলে দিলেন, ‘এসেছিস বাবা?’
আমি বললাম, ‘হ্যাঁ আম্মা। আপনার কাশিটা কমেছে তো?’ আম্মা আমাকে ভেতরে ঢোকার দরজাটা থেকে একটু সরে দাঁড়িয়ে বললেন, ‘কমেছে। তোর পাঠানো অষুধটা বেশ কাজের। বুকটা বেশ একটু হালকা হয়েছে। তুই তাড়াতাড়ি পোশাক ছাড়। আমি একটা সালুন আবার একটু গরম করে নিই। চুলাটা কমানো আছে, দেরি হবে না।’
আমি আলনা থেকে লুঙ্গিটা তুলে আম্মার খাটের ওপর এসে বসলাম। হঠাৎ আম্মা মুখ ফিরিয়ে বললেন, ‘একটা দুঃসংবাদ আছে বাবা।’
‘আমি জানি আম্মা। মন্তু নানা মারা গেছেন।’
আমি কাপড় ছাড়তে ছাড়তে বললাম।
‘এত রাতে এই সংবাদ তুই কার কাছে জানলি রে?’
আমি গাড়ি থেকে নেমেই আমাদের গাঁয়ের আফজাল রিকশাওয়ালাকে পেয়ে যাই। ওর কাছেই শুনলাম। কখন মারা গেলেন মন্তু নানা?’
‘গত সন্ধ্যায়।’
বললেন আম্মা।
আমি জানতাম বার্ধক্য ও অভাব দারিদ্র্যই মন্তু নানার মৃত্যুর কারণ। তবুও জিজ্ঞেস করলাম, ‘মন্তু নানার কী অসুখ হয়েছিল?’
আম্মা বললেন, ‘অসুখ আবার কী, বুড়ো মানুষ কতদিন একবেলা আধপেটা খেয়ে থাকতে পারে। কয়েকদিন আগে জ্বরে পড়েছিল। জ্বর ভালো হয়ে গেলে কাহিল হয়ে বিছানাতেই পড়ে থাকত। বাইরে বেরুতে পারত না। স্টেশনে যেতে পারলে তো এর ওর কাছে চেয়ে পেটটা চালাতে পারত। কাহিল শরীরে সেটাও যখন বন্ধ হয়ে গেল তখন আমাদের বাড়ি থেকে তোর বউ মন্তু মামুকে খাবার দিয়ে আসত। এটা ওটা সাহায্য করত। গতকাল সন্ধ্যায় হঠাৎ কার কাছে যেন শুনলাম মন্তু মামুর জবান বন্ধ হয়ে গেছে। দৌড়ে গিয়ে দেখি মারা গেছেন। শরীরে ক’খানা হাড়মাত্র অবশিষ্ট ছিল। আমার দেখে এত খারাপ লাগল, আমি আর সেখানে দাঁড়াইনি। পাড়ার লোকদের বলে এসেছি কাফনের টাকাটা আমিই দেব। লাশ তো এখনও ঘরেই একা পড়ে আছে। কেউ কি আছে যে মুর্দার ঘরে জেগে রাত কাটাবে?’
আমি জানতাম মন্তু নানার কেউ নেই। এক বোন, যে তাকে দেখাশোনা করত, বহুদিন আগেই মারা গেছেন। বললাম, ‘আসার সময় মন্তু নানার কুঁড়ে ঘরটায় বাতি জ্বলতে দেখলাম।’
‘কেউ হয়তো একটা কুপি জ্বালিয়ে রেখে গেছে।’
বললেন আম্মা। আমি তখন লুঙ্গি পরে হাত-মুখ ধোয়ার জন্য দাঁড়িয়েছি। আম্মা বললেন, ‘তোকে, বদনা দেব?’
আমি বললাম, ‘বাইরে চাঁদের আলো আছে। আমি বরং পুকুর থেকেই হাত মুখ ধুয়ে আসি।’
‘তাই যা। আমি ততক্ষণে বউমাকে জাগিয়ে দিই।’
আমি ঘাটলায় এসে শানের ওপর একটু বসলাম। চাঁদটা এখন মেঘপুঞ্জের অনেক ওপরে ওঠে এসেছে। জোছনায় ঝলমলিয়ে উঠেছে আমাদের পুকুরটা। ছোট ছোট ঢেউ চাঁদের প্রতিবিম্বকে ঘাটলার শেষ সিঁড়িতে এনে টুকরো টুকরো করে ভাঙছে। ঘাটলার পাশের নিমগাছটা থেকে রাতের অশুভ কোনো পাখি ডানা ঝাপটিয়ে পুকুরের ওপর দিয়ে দক্ষিণ দিকে চলে গেল। এটা বর্ষাকাল। প্রবল বৃষ্টির ঋতু। আকাশ ভরা মেঘের ঘনঘটা থাকলেও আজকের রাতটা সম্ভবত ভাগ্যবান। বৃষ্টি ভেজা, কাদাপানি আর শেওলা পিচ্ছিল নয়। বরং কিসের যেন একটা মিষ্টি গন্ধ আসছে ঝিঁঝির শব্দের মতো তীক্ষ্ণ। উদ্ভিদ বা ফুলটার নাম আমি কিছুতেই স্মরণ করতে না পেরে হাতড়ে হাতড়ে কৈশোরের ঘাটপাড়ে এসে দাঁড়ালাম। না, দাঁড়ানো নয় যেন পুকুরে শেওলা পড়া সবুজ পানিতে সাঁতার কাটতে কাটতে ঘাটলায় এসে উঠলাম। এখানে মঞ্জু নানা শেষ সিঁড়িতে বসে তার গন্ধের সাবানে গা ডলছেন। সুন্দর মনমাতানো গন্ধে ভরে গেছে আমাদের ছোট পুকুরটা। মনে হচ্ছে বাতাসে ও পানিতে মন্তু নানার বিলাতি সাবানের গন্ধে পরিবেশটা থমথম করছে। আমি তখন সবেমাত্র নতুন সাঁতার শিখেছি। ন’ দশ বছর বয়স। সারাদিন নেংটো হয়ে পানিতে ঝাঁপাঝাঁপিতে আনন্দ। মন্তু নানার সাবানের সুবাসে আমি থাকতে না পেরে পা টিপে টিপে তার পেছনে এসে দাঁড়ালাম। যেন মন্ত্রমুগ্ধ মাছ। চারের গন্ধে ফুট দিতে লাফিয়ে উঠেছে বাতাসে। মন্তু নানার রুপোর সোপকেসে হাত দেয়ার মতো বুকের পাটা তখনও আমার হয়নি। তখনও আমি নিতান্তই পিচ্চি। মন্তু নানার চোখে পড়ার মতো কেউ নই। তবে মন্তু নানার সুরভি-সাবানের একটু ফেনা তার পিঠ থেকে সাবধানে তুলে এনে নিজের গায়ে মাখার লোভ ও সাহসে কম্পমান। এই গন্ধও গায়ে লেগে থাকত সারাদিন। কত সাবধানেই না পা টিপে টিপে তার পেছন দিকে গিয়ে তার ফর্সা গা থেকে বিলেতি সাবানের একটু ফেনা তুলে এনে নিজেকে ভাগ্যবান মনে করতাম। মন্তু নানা স্নান সেরে চলে গেলে আড়ালে দাঁড়িয়ে থাকা বাড়ির বউঝিরা পুকুরে নামতো। সবাই তাড়াতাড়ি এসে পানিতে নামতো কারণ মন্তু নানার সাবানের সুন্দর গন্ধটা তখনও পানিতে লেগে থাকত। মেয়েরা মন্তু নানার গন্ধের সাবানের তারিফ করত। কেউ বলত মন্তু নানা নাকি জলে ভাসা সাবানের ভেতর আতর মাখিয়ে গোসল করে। আবার কেউ বলত মৃগনাভির গাঁদ অর্থাৎ মেশ্ক দিয়ে তিনি নিজেই সাবান বানাতে পারেন।
আমার অতীত-চারণকে হঠাৎ ফাটিয়ে দিয়ে আমার স্ত্রী চোখ কচলাতে কচলাতে ঘাটে এসে বলল, ‘হাত মুখ ধুতে এসে এখানে বসে কী করছ? ওদিকে যে আম্মা সালুনপাতি গরম করে ভাত বেড়ে বসে আছেন সে খেয়াল নেই?’
আমি বললাম, ‘খেয়াল থাকবে না কেন, এই তো যাচ্ছি। মন্তু নানার কথা, ছেলেবেলার কথা হঠাৎ মনে পড়ল কি না, একটু আনমনা হয়ে গিয়েছিলাম। দ্যাখো, এই সিঁড়িটায় মন্তু নানা বসে গায়ে সাবান মাখাতেন। আর কী সুন্দর খুশবাই ছিল সে সাবানে। তুমি যদি বুঝতে তবে তুমিও একটু আনমনা হতে। তুমি যাও আমি এক্ষুনি মুখটা ধুয়ে আসছি।’
কুলসুম, আমার স্ত্রী একবার মন্তু নানার কুঁড়েটার দিকে তাকিয়ে অন্দরে চলে গেল। কুঁড়েটার বাতিটা তখনও বেড়ার ফাঁক দিয়ে দেখা যাচ্ছে। মন্তু নানার লাশ ঐ ঘরে একাকী হয়তো চাদর ঢাকা পড়ে আছে।
খাওয়া সেরে আমি আমার স্ত্রীর পাশে এসে শুয়ে পড়লাম। রাত আর বেশি নেই। ঝিঁঝির শব্দটা একটু মিইয়ে এসেছে। কুলসুম বলল, ‘এখন আর সিগ্রেট না ধরিয়ে এসো ঘুমোই। সকালে মন্তু নানার দাফনকাফনের ব্যবস্থা তো তোমাকেই করতে হবে।’
আমি বললাম, ‘বাকি সময়টা আমার ঘুম পাবে না কুলসুম। তুমি তো জানো না, মন্তু নানা আমার কতখানি আপন ছিল। তার এই অসহায় মরণে আমার খুব ব্যথা লাগছে। যে লোকটা সবাইকে সাহায্য ও আনন্দ দিত আজ তার জন্য কেউ নেই, এটা ভাবতেও খারাপ লাগছে। একবার এখন যদি তার লাশটা দেখে এসে শুতে পারতাম তাহলেই ভালো ছিল।’
কুলসুম আমার কথায় সায় না দিয়ে খোলা জানালায় জোছনার ঠান্ডা আলো বুকে নিয়ে হঠাৎ বলল, ‘কেয়াফুলের গন্ধ পাচ্ছ?’
আমি আমার স্ত্রীর দাবিটা বুঝি। এতে তো আমি অভ্যস্তই। প্রতিমাসের পয়লা তারিখে ঢাকা থেকে এক মাস পর বাড়ি ফিরলে আমার আর আমার স্ত্রীর জন্য চারপাশে একটু কেয়া, কামিনী বা নেবুফলের গন্ধ তো থাকবেই। কিন্তু এখন এই ন্যায়সংগত কেয়াফুলের গন্ধটাও আমার চিন্তাকে ছাপিয়ে অর্থাৎ মন্তু নানার স্মৃতিকে মুহূর্তের জন্য বিস্মরণে অভিভূত করতে পারল না। কথার জবাব না পেয়ে কুলসুম আবার বলল, ‘ঘুম না পেলে বরং একটা সিগ্রেটই খাও। খাবে?’
সিগ্রেটের প্যাকেট হাতড়াতে গিয়ে তার হাতটা চলে এল আমার বালিশের নিচ দিয়ে পিঠের তলায়। হাতটা উষ্ণ এবং দ্বিধায় থর থর। আমি হাত বাড়িয়ে তার হাতটাকে পিঠের তলা থেকে তুলে এনে কৃতজ্ঞতায় চুম্বন করলাম। ততক্ষণে কেয়াফুলের গন্ধটা বেশ গাঢ় হয়ে আমার নাকে লাগল। বর্ষাকালে বৃষ্টিহীন দিনে বর্ষণঋতুর এই ফুল ফুটলে গন্ধটা একটু তীব্রই হয়ে থাকে। বৃষ্টির মধ্যে ফুটলে গন্ধটা হতো আরও হালকা। আতরের শিশির ধোয়া ছিপির মধ্যে নাক লাগালে যেমন একটা পানসে গন্ধ পাওয়া যায় অনেকটা তেমনি। আমি মন্তু নানার কাছেই গন্ধের রকম ফের, যেমন বিয়ের আতর, ঈদের আতর, ভালোবাসার আতর, বউ বশ করার আতর, আর স্নেহ, মায়ামমতার আতরের ব্যাখ্যা ও কখন কোন্ গন্ধটা ব্যবহার করতে হয় তা শিখেছিলাম। জেনেছিলাম প্রার্থিতজনের সাথে প্রথম সাক্ষাতের সময় নিজের গায়ে কোন্ আতর ব্যবহার করতে হয়। বৃদ্ধদের সাথে, বিশেষ করে যে মুরব্বিদের স্নেহসিক্ত আচরণ আমার একান্ত দরকার তাদের কদমবুচি করতে গেলে কী ধরনের খুশবু গায়ে মাখিয়ে গেলে তারা নমনীয় হন। দিনের পর দিন মন্তু নানার কাছে আমি তা শিখেছিলাম। মন্তু নানা এককালে আমাকে পেয়েছিলেন তার সবচেয়ে মেধাবী শ্রোতা। যে কি না কোনো আতরের গুণাগুণ একবার মাত্র শুনেই তা চিরদিনের জন্য ইয়াদ রাখতে পারত। বিষয়টা যে অনেকটা ধ্রুপদ সংগীতকলা শিক্ষার মতোই কঠিন, মন্তু নানা এ বিষয়েও আমাকে প্রতিনিয়ত সাবধান করতেন। আমি যখন আমার বিয়ের রাতে প্রথম বাসরঘরে যাই মন্তু নানা আমার পাঞ্জাবিতে এক দুর্লভ জাতের খাঁটি গোলাবি আতর মাখিয়ে শিশিটা আমার হাতে তুলে দিয়ে বলেছিলেন, ‘শাদি কা তোহফা।’
আমি শিশিটা হাতে নিয়ে দেখলাম এ এক মহামূল্যবান গন্ধরস। ইরানের সবচেয়ে দুর্লভ জাতের গোলাপের নির্যাস। সাধারণত রাজারাজড়ারাই ব্যবহার করার সুযোগ পান। অর্ধ ইঞ্চি উঁচু সূক্ষ্মদেহী একটা শিশির দাম সেই সময়কার মূল্যে পাঁচশো টাকার কম নয়। মন্তু নানার তখন পড়তি অবস্থা। এ ধরনের গোলাপের ব্যবসায় চালানোর দিন বহু আগেই গত হয়ে গেছে। এক সময় শুনেছি, আগরতলার মহারাজা বা দেশের অন্যান্য জমিদার বিলাসীদের জন্য তিনি আতর সংগ্রহ করতেন। তার ব্যবসা ছিল বেশ জমজমাট। দেশবিদেশের আতর ব্যবসায়ীরা সবসময় তার কাছে ঘোরাফেরা করত। এই সুবাদে আমাদের বা’রবাড়ির বৈঠকখানা ঘরটা উপমহাদেশীয় নানা ভাষার মানুষের কলরবে মুখর হয়ে থাকত। এদের চালচলন ও আদব-কায়দা দেখে মনে হতো পাঠান সুলতানদের যুগ বুঝি এখনও শেষ হয়নি।
আমি শিশিটা হাতে নিয়ে বললাম, ‘নানা, বহুত কিমতি চিজ। তুলায় একটু ভিজিয়ে দিয়ে শিশিটা রেখে দিলে হতো না। আপনার তো এখন দিনকাল ভালো যাচ্ছে না।’
নানা হাসলেন। সেই নবাবি হাসির রেখাটি তার মোটা হলদে গোঁফের আড়ালে ঢাকা পড়তে পড়তে শব্দ করে উঠল, ‘এটা মাঙ্গা চিজ ঠিকই নাতি তবে তোমার জন্যই বহু বছর ধরে বাক্সে পড়েছিল। এটা টাকার দামে লেনদেনের আতর নয়, নানা। আমার বিয়ের আতর। বিয়ের রাতে তোমার নানিকে একটু ছুঁইয়ে বাক্সে রেখে দিয়েছিলাম। এখন আবার তোমার বিয়েতে বার করলাম।’
বেশ রহস্যময় কণ্ঠে কথাগুলো বলে গেলেন মন্তু নানা। একবার আমার কানের কাছে মুখ এনে ফিসফিস করে বললেন, ‘তোমার বউয়ের গলার নিচে একটু আদর করে লাগিয়ে দিয়ো নাতি। রাতটা খুশ হালতে কেটে যাবে। খবরদার জবরদস্তি করো মাৎ।’
আমি মন্তু নানার কথায় লজ্জা পেয়ে হাসলাম। হাতের শিশিটার দিকে তাকিয়ে ভাবলাম, এটা তবে মন্তু নানার বাসররাতের আতর? আমার নওশা সাজের নিচে হৃদয়টা পুলকে নেচে উঠল। ততক্ষণে মন্তু নানা আমাদের বারান্দা পেরিয়ে বাড়ির বাইরে চলে গেছেন। আমি মন্তু নানার উপদেশ বাসররাতে অক্ষরে অক্ষরে পালন করেছিলাম। কুলসুমের কণ্ঠার নিচে ছড়িয়ে দিয়েছিলাম দুর্লভ পারশি গোলাব। রাতটা ভালোই, ভারসাম্য আর সহানুভূতির মধ্যেই কেটেছিল।
পুরনো দিনের কথা মনে পড়ায় আমি কুলসুমের দিকে ফিরে তাকে বুকের কাছে টেনে আনলাম। কপালে চুমু খেয়ে বললাম, ‘কুমু, আমাদের বাসররাতের সুগন্ধির কথা তোমার মনে আছে। সেই যে তোমার বুকের ওপর মাখিয়ে দিয়েছিলাম। তুমি লজ্জা পেয়েছিলে?’
‘মেয়েরা বিয়ের রাতের কোনো ঘটনাই ভোলে না। গন্ধটা চোখ বন্ধ করলে এখনও আমার নাকে লাগে। আজকাল এমন আতর আর হয় না কেন গো!’
বলল কুলসুম। আমি বললাম, ‘আতরটা ছিল মন্তু নানার সংরক্ষিত আতর। তার বিয়ের রাতের দামি গোলাবি খুশবু। তোমাকে আমাদের বিয়ের আসরে মন্তু নানা শিশিটা উপহার দিয়ে বলেছিলেন, তোমার বুকে যেন একবিন্দু গোলাব মেখে দিই। আর তোমার সাথে ভালো ব্যবহার করি, কোনো জবরদস্তি নয়।’
‘মন্তু নানার স্ত্রীকে কি তুমি দেখেছিলে?’
কী ভেবে কুলসুম আমাকে এক আচমকা প্রশ্ন করল।
আমি বললাম, ‘কোত্থেকে দেখব? আমার জন্মের আগেই নাকি তিনি মারা গিয়েছিলেন। আম্মার কাছে শুনেছি তিনি পেশোয়ারের এক আতর বিক্রেতার সুন্দরী কন্যাকে বিয়ে করে বাড়িতে নিয়ে এসেছিলেন। মন্তু নানা স্ত্রীর জন্য পাগল ছিলেন। কিন্তু সুখ বেশিদিন ভাগ্যে সইল না। এক বছর পর মন্তু নানার পাঠান সুন্দরী নাকি এক সপ্তাহের জ্বরে মারা যান। চিকিৎসার কোনো ত্রুটি করেন নি নানা, হায়াত না থাকলে কে কাকে ধরে রাখতে পারে?’
বলতে বলতে আমি বিছানায় উঠে বসলাম। কুলসুম প্যাকেট থেকে একটা সিগারেট বের করে দিলে আমি দেশলাই জ্বালালাম। সিগ্রেট ধরিয়ে দেশলাই কাঠিটার দাহ্যমান অবশিষ্ট আলোয় কুলসুমকে মনে হলো নিবেদন ভরা একটা বাগিচার মতো। আর তার মুখখানা যেন আইলের পাশে জমে থাকা বর্ষার বৃষ্টির নিস্তরঙ্গ ডোবা। টলমল করছে।
আমার অবস্থা বুঝে কুলসুম হঠাৎ বলে বসল, ‘ঘুম তো এ রাতে আর হবেই না। তারচেয়ে চলো টর্চটা নিয়ে গিয়ে মন্তু নানাকে শেষ দেখা দেখেই আসি। সকালবেলা তো লোকজনের ভিড়ে আমি বউমানুষ বেরুতে পারব না। যাবে?’
আমি খুব খুশি হয়ে বললাম, ‘চলো।’
আমরা তাড়াতাড়ি করে বিছানা থেকে নেমে গেলাম। আমি অন্ধকারের মধ্যে আন্দাজ করেই আলনা থেকে একটা শার্ট তুলে এনে গায়ে দিলাম। কুলসুম টর্চটা খুঁজে বের করে দরজা খুলে দরজার সামনে আলো ফেলল। আমরা ঘরের বাইরে এসে দেখি এখন রাতের শেষ প্রহরে চাঁদটা মেঘের একটা বিশাল গম্বুজের আড়ালে গা ঢাকা দেওয়ায় সারা পৃথিবীতে একটা আবছা অন্ধকার ছড়িয়ে পড়েছে। আমরা ঘাটলার দিকে হাঁটা দিলাম। ঘাটলায় পৌঁছে দেখি মন্তু নানার ঘরের বাতিটা আর এখান থেকে দেখা যাচ্ছে না। সম্ভবত কুপিটা বাতাসে কিংবা তেলের অভাবে নিভে গেছে।
আমি মন্তু নানার কুঁড়েটার দিকে হাঁটতে হাঁটতে কুলসুমকে বললাম, ‘রাতে মুর্দার দেখে আবার ভয় পাবে না তো?’
‘ভয় কী, তুমি তো রয়েছ।’
বলে কুলসুম একহাতে টর্চ ও অন্য হাতে সোহাগ করে আমার কোমর জড়িয়ে ধরল।
আমরা অবশ্য মুহূর্তের মধ্যেই মন্তু নানার কুঁড়েটার সামনে এসে দাঁড়ালাম। না, ভেতরের বাতিটা নেই। শুধু কুঁড়েটাকে ঘিরে একদল জোনাকি ঠান্ডা, নকল দাঁতের মতো শাদা আলোর বৃত্ত তৈরি করছে।
কুলসুম দরজায় টর্চের আলো ফেলল। বাইরে থেকে শিকল তুলে বন্ধ দরজাটা। আমি গিয়ে শিকলটা খোলা মাত্র দরজা দুটি আপনা থেকেই হাট করে ভেতরের দিকে সরে গেল। সামনেই মন্তু নানার লাশ। সম্পূর্ণ নগ্ন একটি কংকালমাত্র চাটাইয়ের ওপর ঊর্ধ্বমুখ হয়ে পড়ে আছে। চোখ দুটি খোলা। মৃতের চোখ যে বুজিয়ে দিতে হয় সম্ভবত মন্তু নানার জন্য এটাও কেউ করেনি। করবার আছেই বা কে? একটা নোংরা ছেঁড়া চাদর একপাশে পড়ে আছে। ঘরের ভেতর কোনো আসবাবপত্র নেই। শুধু মাটিতে বিছানো একটা চাটাই আর বেড়ার সাথে লাগানো একটা ঠিলা। ঘরের ভেতরে এখানে-সেখানে পিঁপড়ের ঢিবির ময়লা মাটি ইতস্তত ছড়ানো। আমি কুলসুমকে বললাম, ‘টর্চটা ধরে থাকো। আমি নানার চোখের পাতা দুটি বন্ধ করে আসি।’
বলেই আমি ঘরের ভেতর পা দিলাম। আমার কেমন যেন একটা ভয় হচ্ছিল। যদিও আমার স্ত্রী দরজার ওপরই দাঁড়ানো। পায়ের গোড়ালি থেকে একটা হিমশীতল অনুভূতি মুহূর্তের মধ্যে সারা শরীরে ঠান্ডা স্পর্শ ছড়িয়ে দিল। তবুও সাহস করে এগিয়ে গিয়ে আমি মন্তু নানার লাশের পাশে পড়ে থাকা ময়লা চাদরের ছেঁড়া টুকরোটা দিয়ে তার নগ্নতা ঢেকে দিলাম।
মন্তু নানার মুখের দিকে ফিরে আঙুল দিয়ে তার চোখের পাতি দুটি বন্ধ করতে একটু ঝুঁকতেই একটা উৎকট দুর্গন্ধের ঝাপটা এসে আছড়ে পড়ল আমার নাকে। নাসারন্ধ্র দিয়ে বুকের ভেতর কুৎসিত গন্ধটা ছড়িয়ে পড়ল দ্রুত। আমার নাভিমণ্ডলে অকস্মাৎ মোচড় দিয়ে একটা বমির ভাব ছড়িয়ে পড়ল জিভে। মনে হলো মুহূর্তের মধ্যে আমার সর্বসত্তা অস্তিত্ব অসুস্থ, মুহ্যমান ও বিবমিষায় আক্রান্ত হয়ে পড়েছে। প্লেগের রোগী যখন প্রথম জানতে পারে মহামারীর জীবাণু তার শরীরেও প্রবেশ করেছে তখন তার মানসিক লক্ষণগুলো যেমন মানুষটাকে দুমড়ে মুচড়ে ফ্যালে, আমার অবস্থাও তেমনি। আমি হাতের আঙুলগুলোর একটা ঝটকায় মন্তু নানার বিস্ফারিত চোখ, তার পিঙ্গল অক্ষিগোলক দুটি থাপ্পড় মারার মতো দ্রুত বন্ধ করে দিলাম। ঠিক এসময় কীভাবে যেন কুলসুমের হাতের টর্চটা টিপ নড়ে গিয়ে অকস্মাৎ অন্ধকার হয়ে গেল। আমার মনে হলো কয়লা খনির গভীর খাদের ভেতর কে যেন আমাকে ধাক্কা মেরে ফেলে দিয়েছে। আর মরা মানুষের পচে ওঠা কালো রক্তমাংসের বিগলিত পুঁজ কেউ জোর করে আমার মুখ দিয়ে গলার ভেতর নামিয়ে দিয়েছে। আমি লাফ দিয়ে কুলসুমকে অন্ধকারের ভেতর জড়িয়ে ধরলাম, ‘পালাও, আমি ভয় পেয়েছি। আমার বমি পাচ্ছে। আমায় জলদি ঘাটলায় নিয়ে চলো।’
কুলসুমের হাতের টর্চটা আবার হঠাৎ জ্বলে উঠল। সে আমাকে টেনে হিঁচড়ে ঘাটলায় এসে দাঁড়াবামাত্র আমি ধাক্কা দিয়ে তাকে দূরে সরিয়ে দিয়ে হড়হড় শব্দে বমি করে ঘাটের উপরিভাগস্থ চত্বরটা সম্পূর্ণ ভাসিয়ে দিলাম। তারপর মাথা ঘুরে পড়ে গেলাম বমির ওপর। কুলসুমের চিৎকার করে ওঠার সাথে সাথে আমি জ্ঞান হারিয়ে ফেললাম।
কতক্ষণ এভাবে পড়েছিলাম জানি না। যখন জ্ঞান ফিরল শুনলাম, মসজিদ থেকে আজান ভেসে আসছে। আর আমাকে ঘিরে ধরেছে আমার স্ত্রী, মা আর বাড়ির আত্মীয়-কুটুম্বরা। আমার মা আর স্ত্রী ছাড়া সবাই বমির দুর্গন্ধে নাকেমুখে কাপড় চেপে আছে।
অসাধারণ, জাস্ট অসাধারণ।যোগাযোগ টিমকে ধন্যবাদ আল মাহমুদের এমন অসাধারণ গল্পের সাথে পরিচয় করিয়ে দেওয়ার জন্য
ধন্যবাদ যোগাযোগের সাথে থাকা সকলকে এত সুন্দর একটি গল্প এবারের আয়োজনে রাখার জন্য। তবে মন্তু নাকি মঞ্জু এই শব্দ দুইটি গুলিয়ে ফেলেছি বারবার।
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের আলাওল হল থেকে পড়ছি। ভিন্ন অনুভূতি।
আল মাহমুদ তো আল মাহমুদই। তুলনা চলে না।