১.১
রঙ ধরতে থাকার আগে আমার পৃথিবী ছিল সাদা-কালো। এমনিতে থাকার জন্য সাদা-কালো পৃথিবী খুব একটা খারাপ না। যদিও সেই পৃথিবীতে আমার তেমন কেউই ছিল না কখনো। বড় হয়েছিলাম দুঃসম্পর্কের এক মামার কাছে। ইউনিভার্সিটির থার্ড ইয়ারে থাকতে সেই মামা মরে গিয়েছিল। এর বাইরে যে দুয়েকজন আত্মীয়স্বজন ছিল তারাও না থাকার মতো। অল্প কয়েকজন বন্ধু ছাড়া তেমন কোনো কাছের মানুষ ছিল না। ছিল না কোনো ঘর, বাড়ি, গ্রাম অথবা নিজের কোনো মায়াবন। যার কারণে সোনাডাঙার মতো হাফ মফঃস্বল, হাফ গ্রামে পোস্টিং নিয়ে কোনো মাথাব্যথাও ছিল না। জয়েনিংয়ের দুইদিন আগেই ব্যাগ গুছিয়ে চলে এসেছিলাম। এসেই মনে হলো আরে এটাই তো আমার মায়াবন। যেন অনেক অনেক দিন আগে থেকেই এখানে আমি ছিলাম। সোনাডাঙা জায়গাটাই এমন। সবকিছুতেই কোমল আর স্নিগ্ধ ব্যাপার আছে। মনে হলো এখানেই এই জীবন পার করে দেবো। কিন্তু হয় কি, একবার যে ভেসে যায়, সে শুধু ভাসতেই থাকে। হয়তো কিছু সময়ের জন্য কোথাও স্থির থাকে, তারপর আবার ভেসে যায়। এইসব ভাসাভাসির খেলায় জীবনের এক ঢেউ আমাকে সোনাডাঙা থেকেও ভাসিয়ে নিয়েছিল। ভেসে গিয়েছিলাম ঠিক, কিন্তু সোনাডাঙা আমায় কখনো ছাড়েনি। বুঝিনি যে আমার মনটাকে বের করে সেখানে এক কদম গাছের নিচে রেখে শুধু শরীরটা নিয়ে বাকি জীবন পার করে দেবো। আরও অনেক কিছুই বুঝিনি যা কখন কীভাবে বলব এ বিষয়ে আমার কোনো ধারণাই নেই। ধারণার কথা বাদ দিয়ে বরং সোনাডাঙার পথে হাঁটি।
২.১
আমার থাকার ব্যবস্থা হয়েছিল পুরনো ডাকবাংলোয়। গিয়ে আবিষ্কার করলাম দীর্ঘদিন বন্ধ পড়ে থাকা এই বাংলো মানুষ রাখার যোগ্যতা হারিয়েছে বহু আগেই। করণীয় বুঝতে না পেরে ব্যাগপত্র নিয়ে বারান্দায় দাঁড়িয়ে থাকলাম। কিছুক্ষণ পর আমার অফিস থেকে জুনিয়র একজন অফিসার এলো। এসে যা বললো তার মানে দাঁড়াল এই যে এগ্রি ডিপার্টমেন্টের লোকজনের এই দেশে কোনো দাম নাই; তাদের থাকতে দেয়া হয় পুরনো বাংলোয় যেখানে কিনা কুত্তাও থাকবে না। এই সেই বলতে বলতে তার মাথা গরম হয়ে যায় আর গরম মাথায় সিদ্ধান্ত নেয় যে এই চাকরি সে করবে না। তবে চাকরি ছাড়ার আগে আমার থাকার ব্যবস্থা অবশ্যই করে যাবে। এমপি সাহেবের সাথে যোগাযোগ করতে বলল। এমপি বললে নতুন বাংলোয় আব্বা আব্বা করে রাখবে। আগের অফিসার নতুন বাংলোতেই থাকত। এমপির ছেলের গাড়িতে চড়ত। এসব কথা খুব বিরক্ত লাগছিল বলে তাকে বিদায় হতে বললাম। আরও বললাম, এসব এমপি-টেম্পি ধরে কোথাও থাকা আমার পক্ষে সম্ভব না। আমাকে একটু দাঁড়াতে বলে সে কোথায় যেন চলে গেল। কিছুক্ষণ পর সাথে আরেকজনকে নিয়ে এলো। আমার সাথে পরিচয় করিয়ে দিয়ে বলল যে উনার নাম শেখ ওসমান। আমাদেরই একজন কৃষক প্রতিনিধি। উনার বাড়ির সামনে একটা খালি ঘর আছে। আমি চাইলে কিছুদিন সেখানে থাকতে পারি। ততদিনে সে আমার জন্য কোথাও একটা রুমের ব্যবস্থা করে নেবে।
২.২
রুমের ব্যবস্থা আর করার প্রয়োজন হয়নি। কারণ শেখ ওসমান একদিনের মধ্যেই আমার কাছে ওসমান চাচা হয়ে গিয়েছিল। আর দুইদিন বাইরে খাওয়ার পর আমি তার বাড়িতেই খাওয়া শুরু করেছিলাম। এমনিতে বাইরের খাবারে কখনোই আমার কোনো সমস্যা ছিল না। কিন্তু আমার মন চাইছিল আমি বাড়ির খাবার খাই। মায়ের মতো কেউ একজন রান্না করে দিক। আমি সেই খাবার খেয়ে তৃপ্ত হই। আমার এই চাওয়ার কথা কিছু একটা যেন উনাকে গিয়ে বলে দিল। আর উনি এসে বললেন যে দুই দিন ধরে বলি বলি করে আমাকে বলছেন না কারণ আমি হিন্দু হয়ে মুসলমানের ঘরে খাব কিনা এই নিয়ে সংশয়ে ছিলেন। আমি হাসলাম। হেসে বললাম যে উনার বাড়িতে গরুর মাংস রান্না হলে যেন আমাকে আগে দেয়। উনিও হাসলেন। বেশ কিছুদিন আমাদের সম্পর্ক খাবার-দাবার-কেন্দ্রিক ছিল।
২.৩
এই খাবার-কেন্দ্রিক সম্পর্ক আরেক ধাপ এগিয়েছিল যেদিন দরজার সামনে থেকে খুব সহজ গলায় শান্ত সুরে একজন বললেন যে আমার সাথে একটা কথা আছে। আমি না দেখেই বুঝে নিলাম উনি চাচি। আমি বাইরে আসতেই বললেন উনার কদম গাছটা দেখতে। অনেকদিন হয়ে গেল, অনেক বর্ষায় ভিজল, গাছও অনেক বড় হলো কিন্তু কোনো ফুল কেন ধরে না। গিয়ে দেখলাম স্বাভাবিকের চেয়েও বড় এক কদম গাছ। বেশ সতেজ আর দেখে কোনো সমস্যা আছে বলেও মনে হয় না। কিছু বুঝতে না পেরে বললাম সময় হলেই ফুল ধরবে। ঘরের ভেতর থেকে কে একজন বলে উঠল, সময় কখন হবে? আমি চাচির দিকে তাকালাম। উনি বললেন যে এ উনার মেয়ে রুমেজা। কদম গাছটা মূলত তারই। এই গাছ লাগানোর দরকার হয়নি। আরও কয়েক বছর আগে একদিন রুমেজা আবিষ্কার করে যে উঠানের পশ্চিমদিকে একটা ছোট কদম গাছ। সেদিন থেকে এই গাছ তার। কদম গাছ তো তাদের কোনো দরকার নেই তাই বেশ কয়েকবারই এটা কেটে ফেলার ব্যবস্থা হচ্ছিল। কিন্তু রুমেজা কিছুতেই এই গাছ কাটতে দেয় না। কেঁদে কেটে রাগ অভিমান করে সে এই গাছ বাঁচিয়ে রাখে। আবার ভেতর থেকে প্রশ্ন আসে, সময় কখন হবে? সময় যে ঠিক কখন হবে আমি ঠিক করে বলতে পারি না। কিন্তু জীবনের ঠিক এই সময়ে এসে আমার মতো ছেলেদের যা হয় আমারও তাই হয়। ঘরের ভেতরের মানুষটাকে আমার খুব দেখতে মন চায়। সেই মন চাওয়ার বিষয় চেপে আমি বলি, আশেপাশের আগাছাগুলো পরিষ্কার করে কিছু খৈল দিয়ে গোড়ায় কিছুদিন পানি ধরে রেখে দেখা যেতে পারে। ভেতর থেকে আর কোন কথা আসে না। আমি কিছুক্ষণ অপেক্ষা করে আমার ঘরে চলে যাই।
৩.১
বর্ষা আসে, আবার চলেও যায়। এরই মাঝে অনেক অনেক কিছু জানতে পারলেও এটা জানতে পারি না যে সেই বর্ষায়ও রুমেজার কদমগাছে ফুল ফুটেনি। একদিন অফিস থেকে ফিরে দেখি দরজার সামনে বোরকা পরা এক ছিপছিপে তরুণী দাঁড়িয়ে। শুধু মুখটা দেখা যাচ্ছে। কোন রকম বিশেষত্বহীন চেহারা। আমায় দেখে সালাম দিল। মনে পড়ে যে বোরকা পরা একজনকে আগেও কয়েকবার দেখেছি কিন্তু সেভাবে খেয়াল করা হয়নি। জানতে চাইলাম আমার কাছে কী চায়। বলল যে সে রুমেজা আর এই বর্ষায়ও তার কদম গাছে ফুল ফুটেনি। তখন মনে পড়ল একেই তো আমার মন একদিন দেখতে চেয়েছিল। আমি কু বলবো বুঝতে না পেরে কিছুক্ষণ চুপ করে থাকলাম। আবার সে বলল, বাবা বলে কদম গাছে ফুল হয় না তাই কেটে ফেলবে। ফুল হয় না তো হবে, বললাম। আরও বললাম যে চাচাকে বুঝিয়ে বলব যেন গাছটা না কাটে। এবার আমায় অবাক করে দিয়ে একটা দুই টাকা দামের লজেন্স বাড়িয়ে দিল। বললো কলেজ থেকে আসার সময় নিয়েছে। আমি যেন রাখি। নিলাম। আমাকে এই জীবনে প্রথম কোনো নারী লজেন্স দিল বলে বুঝতে পারি না যে কি বলা উচিত। তাই কিছু না বলে দাঁড়িয়ে রইলাম। সেও দাঁড়িয়ে রইল। দুজনের কেউই বুঝতে পারছিলাম না যে আমাদের এখন কী করা উচিত। বুঝতে না পেরে বিব্রত হয়ে দুই দিকে চলে গেলাম।
৩.২
এরপর রুমেজার সাথে আমার বহুবারই দেখা হয়। যতবারই দেখা হতো নতুন নতুন রঙ এসে আমায় খুঁজে পেত। কখনো আমি তাকে দেখতাম বরই গাছের নিচে দাঁড়িয়ে বরই খাচ্ছে লবণ মরিচ দিয়ে আর আমার মনে হতো লবণ মরিচ দিয়ে বরই খাওয়াই জগতের সবচেয়ে সুন্দর দৃশ্য। সেই দৃশ্য থেকে সবুজ আর ইট লাল রঙ উঠে এসে আশেপাশে ঘুরঘুর করতে করতে ঢুকে পড়ত আমার পৃথিবীতে। আবার কখনো সে আমাকে দেখত বিকেলের অবসরে একটা বই নিয়ে বারান্দায় বসে আছি । দেখতে দেখতে তার খোঁপার ফিতা থেকে বেগুনি রঙ ছুঁড়ে দিত। কখনো বা কলেজে যেতে যেতে এক হলুদ পাখির দিকে মুগ্ধ হয়ে চেয়ে থাকত আর সেই হলুদ যেন পেছন থেকে আমার চোখ চেপে ধরত। কখনো একজোড়া গোলাপি স্যান্ডেল পরে কদম গাছের নিচে মাচানের উপর বসে পা দোলাত। তখনই যেন গোলাপি রঙ এসে আমার ঘরের এক কোনায় গিয়ে বসে থাকত। একদিন ছুটির দুপুরে কে যেন দরজায় টোকা দিল। আমি ভেতরে আসতে বললাম। রুমেজা সামনে এলো। আম্মায় আপনার জন্য পায়েস দিল বলে টেবিলের উপর একটা বাটি রাখল। তারপর বলল, ‘আগামী বর্ষায় আমার কদম গাছে ফুল আসবে তো?’ আমি হ্যাঁ বললাম। আবার জিজ্ঞেস করল, ‘সত্যিই আসবে?’ আমি হাসলাম। সে কি বুঝল জানি না। বের হয়ে গেল। তবে যাওয়ার আগে তার কাঁচের চুড়ি থেকে এক পশলা কমলা রঙের বৃষ্টি আমার উপর ঝরে পড়ল।
৩.৩
কয়েকদিন পর চাচি আমায় ডেকে নিয়ে বললেন যে তারা সামান্য এক দরিদ্র কৃষক পরিবার। কোনো রকমে খেয়ে পরে বেঁচে আছে। এই যে এই কোনো রকমে বেঁচে থাকা এর একটা বড় অংশজুড়ে আছে তাদের সম্মান। এসব আমি শুনে যাচ্ছিলাম কিন্তু কিছুই বুঝতে পারছিলাম না। এই সময় কোথা থেকে রুমেজা ঝড়ের মতো এসে তার মায়ের হাত ধরে টানতে টানতে নিয়ে গেল। কিছুক্ষণ পর এসে জিজ্ঞেস করল, তার মা আমাকে কু বলেছেন। আমি বললাম যে তেমন কিছুই না। সে বারবার জিজ্ঞেস করতে থাকল। আমিও তাকে বারবার বোঝানোর চেষ্টা করছিলাম যে আমাকে কিছু বলেননি। এরপর থেকে রুমেজাকে আর তেমন একটা দেখা যায় না। চাচিও আমার সাথে তেমন একটা কথা বলেন না। অনাকাঙ্ক্ষিত এই দূরত্ব আমাকে প্রচণ্ড কষ্ট দেয়। কিছু বলতেও পারি না। একদিন ওসমান চাচাকে ডেকে বলি যে আমি এখান থেকে চলে যেতে চাই। উনি আমার একথা শুনে অবাক হন। জানতে চান আমার কী অসুবিধা। আমি কিছুই বলি না। আসলে বলার কিছু খুঁজে পাই না। সেদিন রাতে চাচা আমার ঘরে আসেন। এসেই ক্ষমা চান। কোনো কারণ ছাড়া ক্ষমা চাওয়ার কারণ জানতে চাইলে বলেন যে তার একটাই মাত্র মেয়ে, এই মেয়েই উনার জীবনের সবকিছু। আরও বলেন চাচির শঙ্কার কথা, তার মেয়ের খাতায় আমার নাম লিখা থাকার কথা। বলেন যে উনি মেয়েকে বা আমাকে কোনো দোষ দিতে চান না কারণ এই বয়সে এটা খুবই স্বাভাবিক ব্যাপার। আমাদের ধর্মের পার্থক্য, সামাজিক অবস্থানের পার্থক্য এইসব বলতে বলতে উনার চোখ ছলছল করে। আকস্মিক প্রকাশিত এসব কথায় আমার ভেতরে অজানা অচেনা এক অনুভূতি হয়। উনি বলেন যে এই অবস্থায় কী করণীয় কিছুই বুঝতে পারছেন না। শুধু বলি, কালই আমি চলে যাব। আমার চলে যাওয়ার কথা উনাকে আহত করে। আহত মন নিয়ে উনি ঘর থেকে বেরিয়ে যান।
৪.১
বেশ কিছুদিন হয় আমি নতুন বাসায় উঠেছি। অফিসের লোকজন খুব সুন্দর বাসা খুঁজে দিয়েছে। ইয়া বড় বাসায় আমি একলা থাকি। নিজে নিজে রান্না করি, খাই-দাই, বই পড়ি। সেকেন্ড হ্যান্ড একটা টিভিরও ব্যবস্থা হয়েছে। রাত জেগে খবর, টক শো এসব দেখি। কিন্তু এসবের কিছুই আমার ভালো লাগে না। আমি জানি কেন আমার কিছুই ভালো লাগে না। কিন্তু জেনেও না জানার ভান করি। হঠাৎ হঠাৎ আমার চোখের সামনে কদম গাছ ভেসে উঠে। ভেসে উঠে কালো বোরকা পরা একজন কলেজে যাচ্ছে। ফিল্ড ভিজিটে গিয়ে অন্যমনস্ক হয়ে কি জানি খুঁজি। চাচির হাতে রান্না করা কইমাছের ঝোল খেতে ইচ্ছে করে। চাচার মুখে শুনতে ইচ্ছে করে, ‘সব ঠিক আছে তো বাবা?’ এইসব ইচ্ছে, ভালো না লাগা, মন খারাপ নিজেদের মতো করে কষ্টে রূপ নেয়। সেই কষ্ট নিয়ে আমি বেঁচে থাকি, চাকরি-বাকরি করি। একদিন অফিসে বসে ফাইলপত্র দেখছিলাম, এসময় হন্তদন্ত হয়ে ওসমান চাচা আসেন। বলেন যে আগের দিন সকালে রুমেজা আর চাচি রুমেজার নানার বাড়ি গিয়েছিল। বিকেলেই ফেরার কথা। কিন্তু ফেরেনি। চাচা গিয়েছিলেন খোঁজ নিতে। সেখান থেকে বলেছে যে তারা বিকেলেই রওনা দিয়েছিল। এখন আর তাদের কোথাও খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। আশেপাশের কয়েক গ্রামে লোক পাঠিয়েছে কিন্তু কোথাও নেই। আমি উনাকে শান্ত হয়ে বসতে বললাম। সামনের চেয়ারে বসলেন। এই সময় উনার মোবাইলে ফোন এলো। কে একজন বলল তাড়াতাড়ি পাশের গ্রামে যেতে। কিছু একটা হয়েছে। গিয়ে দেখলাম গ্রামের যে দিকে পরিত্যক্ত কিছু জমি পড়ে আছে সে জমিগুলো থেকে কিছু মাটি কেটে নেয়ার কারণে ছোটখাটো একটা ডোবার মতো হয়েছে। তাকে ঘিরে মানুষের জটলা। জটলা ঠেলে সামনে গিয়ে দেখলাম চাচি হাত পা বাঁধা অবস্থায় পড়ে আছে। পাশে অচেতন রুমেজা। এই দৃশ্য দেখে চাচা যেন মূর্তি হয়ে গেলেন। আমি ছুটে গেলাম রুমেজার কাছে। তার লেবু রঙের জামা লাল হয়ে আছে। মুহূর্তেই যেন আমার সমস্ত পৃথিবী লাল হয়ে গেল। চারদিকের সবকিছু থেকে যত রকম রঙ আছে উড়ে উড়ে গিয়ে লাল হতে থাকল। সেই লালের তীব্রতায় আমার মাথা ধরে গেল। লাল রঙের এক পুলিশ এসে বলল, স্যার একটু সরে দাঁড়ান, প্লিজ।
৪.২
এই লাল পৃথিবীর এক লাল বিকেলে দেখা গেল ওসমান চাচা, ওসি সাহেব আর আমি এমপি সাহেবের সামনে বসে আছি। এমপি তার এলাকা আর এলাকার মানুষ নিয়ে যে এক মুসিবতের ভেতর আছে তা বলল। আরও যা বলল তার সারমর্ম হলো, সে তার ছেলেপেলেদের খুবই ভালোবাসে আর তারা কেউই আসলে খারাপ ছেলে না, তবে মাঝেমধ্যে ভুল করে ফেলে, এই সেই। আমরা শুনতে থাকলাম। এমপি আমার আর ওসির দিকে তাকিয়ে বলল, ‘আপনারা আসছেন এখানে চাকরি করতে। কারো তো আত্মীয় টাত্মীয় না। চাকরি বাকরি করেন। ঘুরেন ফিরেন। নদীর মাছ খান। অন্য কোন ঝামেলায় জড়ানো উচিত হবে না। কখন কী ঘটে তা তো বলা যায় না। তার উপর আপনি কৃষি অফিসার হইলেন হিন্দু। কিছু একটা হলে তো আবার সাম্প্রদায়িকতার দায় নিতে হবে’। আমরা কিছু বললাম না। ওসমান চাচার দিকে তাকিয়ে বললো, ‘তোমারে তো ভাই নিজের লোক ভাবছিলাম। এইসব মামলা টামলায় না গিয়া আমার কাছে আসলেই বিচার পাইতা। এখন মামলা করছো অসুবিধা নাই। কালই মামলা তুলে নিবা। যা হবার পরে দেখা যাবে। এখন চা খাও।’ আমাদের সামনে চা আর লেক্সাস বিস্কিট দেওয়া হলো। আমরা তিনজনই কলের পুতুলের মতো চায়ের কাপ হাতে নিলাম। চা খেতে গিয়ে মনে হলো কাপে কোন চা নেই তার বদলে কেমন এক লাল রঙের থকথকে জেলি। কাপ রেখে দিলাম। আসার সময় এমপি আমার দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করল আমি কি অসুস্থ নাকি কারণ আমার চোখ টকটকে লাল হয়ে আছে। রাস্তায় নেমে ওসমান চাচা মুখ কালো করে বললেন, ‘এই হারামির বাচ্চার ভোট করতে গিয়া কতদিন না ঘুমা আছিলাম!’ আমি আর ওসি একজন আরেকজনের দিকে তাকালাম। আমাদের কি ইচ্ছে করছিল তা যে কেউ জানে। কিন্তু এই জীবন হলো জীবন, কোন সিনেমা বা নাটক না। তাই আমরা চুপচাপ যে যার পথে চলে গেলাম।
৪.৩
কিছুদিনের মধ্যেই আমার আর ওসির বদলির আদেশ হয়ে গেল। দুই জনকেই অনেক লোভনীয় জায়গায় বদলি করা হয়েছে। সেদিনই ওসির ফোন পেয়ে থানায় যেতে হলো। থানার বারান্দায় ওসমান চাচা বসা। তার কাছে গিয়ে দেখলাম নীরবে কাঁদছেন। উনি মামলা তুলে নিতে চান না। কিন্তু ওসি উনাকে মামলা তুলে নিতে বলছেন। আরও বললেন, আগের রাতে কয়েকজন এসে তাদের মেরে ঘরবাড়ি জ্বালিয়ে দেয়ার কথা বলছিল। তবুও উনি এই মামলা তুলতে চান না। আমি ওসির কাছে যাই। বুঝতে পারি আমরা চলে গেলে রুমেজাদের সাথে যে কোন কিছু ঘটতে পারে তাই ওসি মামলা তুলতে বলছে। আমি গিয়ে বুঝাই। শেষমেশ মামলা তুলে নিলেন। আমি উনাকে এগিয়ে দিতে যাই। চুপচাপ হাঁটতে হাটঁতে বাড়িতে পৌঁছাই। তখন প্রায় সন্ধ্যা। ঘরের দরজা খোলা দেখে চাচা আমাকে বাইরে দাঁড়াতে বলে উনি ভেতরে যান। একটু পরেই এসে বলেন যে ঘরের ভেতর কেউ নেই। উঠানের পশ্চিমে কদম গাছের দিকে আমার চোখ যায়। নিচে চাচি বিপন্ন হয়ে বসে আছেন আর মাঝামাঝি এক ডালে রুমেজা ঝুলে আছে। দুইজনই সেদিকে নির্বাক তাকিয়ে থাকি কিছুক্ষণ। চাচা কোনো রকম দুঃখ না করেই বলেন, ‘ভালোই হইছে। এইটাই তো হওয়ার কথা ছিল। ভালোই হইছে।’ কষ্টে আমার ভেতরের সবকিছু ভেঙেচুরে যায়। ওসমান চাচা লাশ নিজের হাতেই নামায়। আমিও ধরি। পুলিশে খবর দেয়ার কথা বলি। চাচা আমার দিকে তাকিয়ে হাসে। এই হাসির অর্থ আমি বুঝি। তাই আর তাকাতে পারি না। কী করে তাকাই? এই নষ্ট সিস্টেমের একজন তো আমিও। চাচা কদম গাছের দিকে তাকিয়ে বলে, ‘এই গাছটা না থাকলেই ভালো হইত। কত যে কাটতে চাইছি। মাইয়াটা দিল না। এখন কাইটা ফালামু। একটা গাছও রাখমু না। সব কাইটা ফালামু।’
৫.১
আমার আর এই লাল রঙের সোনাডাঙা কিছুতেই ভালো লাগছিল না। কোনোভাবে তিনদিন পার করে দিলাম। প্রথম যেদিন রুমেজাকে দেখেছিলাম, সেই চেহারাটা বারবার চোখের সামনে ভাসে, যেন আমার কাছে জানতে চায় তার কদম গাছে ফুল কবে আসবে। দম আটকে আসে আমার। আবার কোনো দিকে তাকালে দেখি রুমেজার রক্তমাখা সেই দেহ। চোখ বন্ধ করলেই দেখতে পাই কদম গাছে রুমেজার ঝুলন্ত লাশ। এসবের মধ্যেই অফিসের যাবতীয় কাজ শেষ করে দায়িত্ব হস্তান্তর করতে হলো। বাসার মালপত্র সবই একে ওকে দিয়ে দিলাম। শুধু ব্যাগে কিছু কাপড় নিলাম। চলে যাওয়ার আগে ওসমান চাচার সাথে দেখা করতে যাওয়া দরকার ছিল। কিছুতেই মন সায় দিল না ওই বাড়িতে আর যেতে।
৫.২
আমার বাস ছিল সকাল ছ’টায়। কী মনে করে পাঁচটায়ই বের হয়ে পড়ি। ওসমান চাচার বাড়ি যাই। চেনা সেই বাড়ি খুব অচেনা লাগে। চাচাকে ডাকি। কেউ সাড়া দেয় না। ভেতরে ঢুকে দেখি দরজায় চাচি বসে আছে। বাড়ির সব গাছ কেটে ফেলা হয়েছে। সারা বাড়িতে শুধু কাটা গাছের ডালপালা আর পাতা। এরই মাঝে কদমগাছটা দাঁড়িয়ে আছে। নিচে খালি গায়ে বসে আছেন চাচা। আমাকে দেখে খুব স্বাভাবিকভাবে বললেন, ‘এই গাছ তো কাটতে পারতেছি না বাপ।’ এই বলে উপরের দিকে তাকালেন। উনার দৃষ্টি ধরে আমিও তাকালাম। যে ডালে রুমেজা ঝুলেছিল ঠিক সেই ডালে গিয়ে চোখ আটকে গেলো। নিজের চোখে না দেখলে বিশ্বাস হতো না। তাছাড়া তখন বর্ষাকালও ছিল না। তবুও, আমার লাল পৃথিবী ভেদ করে আকাশের দিকে তাকিয়ে হাসছে একটা নীল রঙের কদম ফুল।
“অসাধারণ” এ শব্দটা ছাড়া যদি আমার ঝুলিতে অন্য কোনো বাণী থাকতো, তাহলে সেগুলো দিয়ে আপনার প্রশংসা করতাম।
“… … … আমার লাল পৃথিবী ভেদ করে আকাশের দিকে তাকিয়ে হাসছে একটা নীল রঙের কদম ফুল।”
গল্প: “ লাল পৃথিবীর নীল কদম” -মাহমুদ মাসুদ
-আর এই লাল পৃথিবীর নীল রঙের কদম ফুলটির জন্য আমরা বেঁচে আছি, বেঁচে থাকি…
কিছুই পরিবর্তন হয়নি। এই গল্প এখনেরও। আমরা কবে মানুষ হয়ে উঠবো?