ইবনে খালদুনের শিল্পতত্ত্ব ও সাহিত্যের নবনির্মাণ

মুসা আল হাফিজ

বই : অনিবার্য ইবনে খালদুন ও অন্যান্য

লেখক : মুসা আল হাফিজ

প্রকাশক : রূপসী বাংলা

প্রচ্ছদ : আদনান আহমেদ রিজন

পৃষ্ঠা : ২৮৮

সামাজিক বিজ্ঞানের জনক ইবনে খালদুনের বিশ্ববরেণ্য কিতাবুল ইবারের  মুকাদ্দিমা  ইংরেজিতে ‘প্রোলেগোমেনা’ নামে  খ্যাতি পেয়েছে। মুকাদ্দিমার সাহিত্যিক প্রস্তাব, সভ্যতার চক্রাকার প্রকৃতিকে বুঝার ও বিশ্লেষণের এমন দৃষ্টিশক্তি দান করে, যা সাহিত্যিক  সৃষ্টিশক্তিকে দেয় নতুন পথের দিশা। এই পথ, ইতিহাস গঠনে সমাজের ভূমিকাকে উপজীব্য বানায়।   মানবসমাজকে বিচার ও অধ্যয়নে  অভিজ্ঞতামূলক প্রমাণের গুরুত্ব সম্পর্কে গভীর অন্তর্দৃষ্টি প্রদান করে।

ছয় অধ্যায়ে বিভক্ত আল-মুকাদ্দিমার শেষ অধ্যায়ে জ্ঞানানুশীলন, সাহিত্য ও সংস্কৃতিকে আলোচনায় এনেছেন ইবনে খালদুন। সেখানে গণসাহিত্য ও জীবনবাদী সৃষ্টিকর্মের এমন এক পাটাতন তিনি নির্মাণ করেন, যা বাস্তবতার অভিজ্ঞানে সুদৃঢ়। এই অভিজ্ঞান সাহিত্যের ঠিকানাকে নিছক কল্পনার পৃথিবী থেকে বাস্তব জীবনের অভিমুখী করে। কিন্তু কল্পনাও বাস্তবতার ছায়া, সেই সত্যকে ভুলে যায় না। ফলে পশ্চিমে যে রোমান্টিক আন্দোলন হলো, তার বুদ্ধিবৃত্তিক উপাদানগুলিও ইবনে খালদুনের এলাকা ধরে এগিয়ে যায়।  আবেগ ও ব্যক্তিত্ববাদের উপর জোর দিয়েছিল রোমন্টিসিজম। অতীতচারিতা ও প্রকৃতির গৌরবকে সে আলিঙ্গন করেছিল। ইবনে খালদুনের সাহিত্যদৃষ্টি  এই আলিঙ্গনকে অভিনন্দিত করে।

কিন্তু রোমান্টিকতার  জন্যে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ পরামর্শ ছিল ইবনে খালদুনের কাছে, যাকে সে ধারণ করতে পারছিল না। ইবনে খালদুন প্রকৃতির সাথে সংযোগ স্থাপনের পরামর্শ দেন, কারণ প্রকৃতি মানুষের দেহে, আচরণে, রুচিতে গভীর সিগনেচার দিয়ে রাখে, একে বাদ দিয়ে জীবন যেভাবে সম্ভব নয়, মানবকর্মকে উপলব্ধিও সম্ভব নয়।

ইবনে খালদুন  সাধারণ মানুষ ও মাটির গল্প হাজির করতে বলেন। কারণ মানুষ ও মানবসমষ্টি সমাজ-সভ্যতার আসল নির্মাতা, তাদের জীবনই সভ্যতার জীবন, কালের জীবন, সংস্কৃতির জীবন। তিনি নান্দনিকতার প্রতি গুরুত্ব দিতে বলেন। কারণ মানবীয় বৃত্তিসমূহের পরিশীলিত প্রকাশ না ঘটলে মানবীয় সমাজের বিকাশ রুদ্ধ হয়। মানুষ নিজেকে আপন বৈশিষ্ট্য দিয়ে ব্যাখ্যা করতে পারে না। তিনি সৌন্দর্যবোধের ওকালতি করেন। কারণ আল্লাহর  সৌন্দর্যবোধ বিশ্বজগৎকে আকার দিয়েছে, মানুষের মর্মমূলে পুতে দিয়েছে সুন্দরের এমন বীজ, যাকে বিকশিত না করলে মানুষের প্রকৃতির বিকাশ রুদ্ধ হবে।

ইবনে খালদুন চিন্তাকে অনুকারিতা ও বলয়বন্দিত্ব থেকে মুক্ত হতে বলেন। কারণ বাস্তব বিচার ও পরীক্ষা-নিরীক্ষার মাধ্যমে সত্য উপলব্ধি অর্জন করতে হলে আপনাকে জিজ্ঞাসার মধ্য দিয়ে অগ্রসর হতে হবে। শুকনো তথ্য, শুকনো জ্ঞান ও নীরস পাণ্ডিত্যের বদলে কল্পনাশক্তি, আবেগ ও অনুভূতির অনুসন্ধানে উদ্‌বুদ্ধ করেন ইবনে খালদুন।   তিনি ইতিহাস ও উপকথার পার্থক্য গড়ে দেন। এবং ইতিহাসের চর্চার পথ নির্মাণ করেন। অপরদিকে সমাজের অভিজ্ঞতা থেকে জন্ম নেওয়া উপকথাকে তার প্রাপ্য জায়গা বুঝিয়ে দেন। সাহিত্যে দুটোই যার যার অবস্থান পেয়ে যায়।

তিনি মুখর জীবন ও সম্মিলিত জীবনচর্চার ব্যাখ্যা করেও একাকিত্ব, নির্জনতা ও নীরবতাকে সৃষ্টিশীলতায় রূপান্তরিত করেন। তার আল-মুকাদ্দিমা ছিল সমাজ ও কোলাহল থেকে নির্বাসিত, পরিত্যক্ত দুর্গে নীরব ও নির্জন যাপনের সৃষ্টি। সাহিত্যে তিনি একাকী অনুভূতি ও অভিভূতিসমূহকে শৈল্পিক রূপদানের ভালো নজির। ইবনে খালদুন সাহিত্যে বাস্তবতাকে বাস্তবতার মূল্যদানে যত্নবান। কিন্তু অবাস্তবতাকে জীবন থেকে নির্বাসিত করতে রাজি নন। লৌকিকতা ও অতিলৌকিকতার জন্য এখানে আসন নির্ধারিত। উভয় চরিত্রের বিষয়াবলি এখানে হাজির হবে, আপন আপন পথ ধরে।

ইবনে খালদুন আমাদের শেখান শব্দ ও চিত্রের মাধ্যমে দৃশ্যপট তৈরির এমন কলা, যা অভিনব। দৃশ্য, শব্দ, স্পর্শ, গন্ধ, স্বাদ কীভাবে সাহিত্যের বিষয় হয় এবং সাহিত্যের মনে, মেজাজে, চরিত্রে নতুন অনুভূতির বৃষ্টিধারা বইয়ে দেয়! ফুলের গন্ধ তাই পরবর্তী বিশ্বের সাহিত্যে এমন চরিত্র হয়ে উঠলো যা কারো অধীন হয়ে আসে না। স্বতন্ত্র রাজ্য তার, এই রাজ্যের প্রজা সে, রাজাও সে। পাখির ডাক, ফলের স্বাদ ইত্যাদি আগেও ছিল সাহিত্যে, কিন্তু কিটসের কাব্যে তা যেভাবে হাজির হয়, যে মুক্তি নিয়ে, যে স্বাতন্ত্র্য নিয়ে, যে অভিনব উদ্‌গতি নিয়ে; তার শর্ত ইউরোপে তৈরি হয়নি।

ইবনে খালদুন সাহিত্যকে দেন এমন তত্ত্ব, যার ফলে তাকে দেখা হয় শক্তিশালী অনুভূতির স্বতঃস্ফূর্ত বহিঃপ্রকাশ হিসেবে। রোমান্টিসিজম একে অঙ্গীকার করেছিল। কিন্তু রোমান্টিসিজম ইবনে খালদুনের পরামর্শ মানেনি। তিনি জীবনে নন্দন ও সুন্দরের  জায়গা জানতেন এবং জানিয়ে দিয়েছেন। রোমান্টিসিজম তাকে তার জায়গায় রাখেনি। সৌন্দর্যের পূজা শুরু করে দেয়। ফলে কীটসের মতো কবি ঘোষণা করেন- “Beauty is truth, truth is beauty”

ওয়ার্ডসওয়ার্থ, শেলি, বায়রন, কোলরিজের মতো কবি কিংবা ম্যারি শেলি, জন অস্টিন প্রমুখের মতো কথাশিল্পী সৌন্দর্যের উপাসনায় নিবেদিত হন। ইবনে খালদুন বলেছিলেন সৌন্দর্যবোধের কথা,  কোমলতা, কল্পনাশক্তি ইত্যাদি রঙ দিয়ে মননের  মুখ  আঁকার কথা,  যাতে ছিল স্বতন্ত্র, অপূর্ব, অসাধারণ শিল্পসম্ভাবনা, পশ্চিমা সাহিত্য সম্ভাবনাটির মনোহর মুখদর্শন করে আত্মসংবরণে ব্যর্থ হলো। একে বানিয়ে দিলো দেবী আফ্রোদিতি, মানুষ যার পুজারিমাত্র।

ইবনে খালদুন বাস্তবতাকে যে গুরুত্ব দেন আপন ইতিহাসতত্ত্বে, তার প্রভাব সাহিত্যে ছিল অবধারিত। ভিক্টোরীয় যুগের সাহিত্যে Realism এর চিত্র ও চারিত্র্য ইবনে খালদুনের বাস্তবতাবোধের সাথে মিল রাখে, অমিলও রাখে।

ভিক্টোরিয়ান রিয়েলিজম জোর দিয়েছিল জীবনকে ঠিক জীবনের মতো  তুলে ধরার উপর। লেখকরা তাকান  নিজেদের  চারপাশের দুনিয়ায়। একে চিত্রিত করতে চান   নির্ভুলভাবে,   বিস্তারিতভাবে। এজন্য তারা মনোযোগ  দেন আপন  সময়ের সংগ্রাম এবং সামাজিক সমস্যার উপর। কিন্তু এই মনোযোগ দেহ ও আত্মার সমন্বয়ের কথা ভাবেনি, বিচ্ছিন্নতা ও পারস্পরিক লড়াইয়ের দামামা বাজিয়েছে। এর কারণ অবশ্য নিহিত ছিল পশ্চিমা দুনিয়ার নিজস্ব সংকট ও সীমাবদ্ধতায়। সেখানে ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান বিজ্ঞান ও শিল্প-সাহিত্যের সাথে যুদ্ধ করছিল। বিশ্বাস ও আবিষ্কারের মধ্যে চলমান ছিল সংঘাত। মূল্যবোধ ও বৈজ্ঞানিক ধারণার মারামারির মধ্যে মারা যাচ্ছিল জীবনের সেই অবলোকন, যার পরামর্শ দেন ইবনে খালদুন।

বস্তুত এই পরামর্শ কবুল করবার যে মানসিক ও সামাজিক জমি, ইউরোপে তা ছিল অনুপস্থিত। সেখানকার ঐতিহাসিক গতিপথ তখন বিশ্বাসের সাথে বৈরিতার মধ্য দিয়ে প্রগতি সন্ধান করছে। কিন্তু এর মধ্য দিয়ে যে প্রগতি আসে, তা নিজেকে দ্বিখণ্ডিত করে নিজের সত্তা ও বস্তুর মধ্যে নিরন্তর সংঘাতকে অবধারিত করে। যার ফলাফল আত্মবিনাশ। এতে সাহিত্য আকারগত উন্নতি লাভ করে বটে। কিন্তু তা জীবনকে মহিমা দিতে পারে না মোটেও। জীবনকে খণ্ডিত করে মানুষ আনন্দ খুঁজেছে অস্বাভাবিকতায়, উত্তেজনাপূর্ণ বা সাহসী অভিজ্ঞতায়। Adventurous Tendency মানুষের অতৃপ্তির পরিত্রাণ হতে চেয়েছে। কিন্তু তার দানের ক্ষমতা সীমিত। ইবনে খালদুন একে জীবনের জন্য আহ্বান করলেও তার ক্ষেত্র ও পরিধিকে ভুলে যান না। শক্তিশালী  দুঃসাহসিক মনোভাবকে  অভিনন্দন জানান তিনি।

ইবনে খালদুনের জন্য এটা সুন্দর দৃশ্য যে, তখন নতুন এলাকা এবং সংস্কৃতি আবিষ্কারের জন্য লোকেরা  অভিযানে বের হয়েছে। দুঃসাহসিকতার এই চেতনাটি  সাহিত্যের থিমগুলিতে প্রতিফলিত হচ্ছে। কিন্তু তিনি কতক্ষণ খুশি থাকবেন? তিনি অচিরেই বিচলিত ও আহত হবেন। কারণ এই অভিযাত্রা অন্যের স্বাধীনতাকে মূল্য দিচ্ছে না, অন্যের প্রতি অপমানবোধ থেকে তার বিস্তার, এই অভিযাত্রার নাম দেওয়া হয়েছে সভ্য বানানোর অভিযান।  যেন অন্য সকল অপশ্চিমা জাতি অসভ্য, সভ্য একমাত্র পশ্চিমাজগৎ।

এই মনোভাবের গতরে সাম্রাজ্যবাদ, আধিপত্যবাদ ও পরস্বত্তহরণের নির্মম আত্মা দেখতে ইবনে খালদুনের মুহূর্তমাত্র বিলম্ব হচ্ছে না। তিনি পরামর্শ দেবেন অভিযানের প্রেরণা ও মনোবৃত্তিকে সংশোধনের জন্য। এর মধ্যে দস্যুতার যে সব উপাদান, তা থেকে মুক্তির জন্য। কিন্তু ভিক্টোরিয়ান যুগ এতে কান দেয় না। সে রচনা করে  Imperialism এর ভাষা ও ভাষ্য। সাম্রাজ্যবাদ তখনকার সাহিত্যে  একটি প্রভাবশালী আদর্শ।   পশ্চিমা দখলদারির  বিস্তার তখন উদ্‌যাপিত হচ্ছে নানাভাবে, কাব্যে, কথাশিল্পে। সে পশ্চিমা আধিপত্য এবং উপনিবেশের অধিগ্রহণকে মহিমান্বিত করার যুক্তি সরবরাহ করছে এবং তার অন্য সাম্রাজ্যবাদী আদর্শকে চিত্রিত করছে ।

সাফল্যের জন্য মানুষ তখন সম্পদ অর্জন করতে চেয়েছে। ইবনে খালদুন সম্পদকে জরুরি বলেন অবশ্যই। কিন্তু সাফল্য কেবল তার মধ্যে তালাশ করার বিপদও পরিষ্কার করেন। ভিক্টোরীয় যুগের শিল্প-সাহিত্য সাফল্যের সন্ধানে ঘর থেকে বের হয়ে সম্পদের মায়ায় এমনভাবে আচ্ছন্ন হলো, যার অভিশাপে সে বস্তুবাদকে জীবনের চালক বানিয়ে দিল। বস্তুগত অর্জনকে সাফল্যের নিদর্শন বিবেচনা করে বস্তুর দাস-দাসী হলো মানুষ, মানুষের মন। Materialistic Outlook অভিশাপের দিকে চালিত হলো। এই অভিশাপের যাত্রাসঙ্গী ছিল কৌমবোধের ভাঙনের সুর। যা ইবনে খালদুনের কেন্দ্রীয় গুরুত্বের বিষয়।

Industrialization তখন  শিল্প বিপ্লব শিল্প-কারখানার উত্থান, নগরায়ন এবং মধ্যবিত্তের বৃদ্ধির সাথে সমাজে দ্রুত পরিবর্তন আনে। সাহিত্য এর সুর, প্রভাব ও পরিণতিগুলোকে আকার দিতে থাকে। নারীদের ভূমিকা এবং সমাজে তাদের অবস্থান সম্পর্কে নতুন বিতর্ক তৈরি হয়।  ঐতিহ্যগত নারীদের ভূমিকা এবং প্রত্যাশাকে লাঞ্চিত করা হয়। পরিবার ও সামাজিক সংগঠনের উপর হুমকি তৈরি হয় ক্রমে ক্রমে।

চার্লস ডিকেন্সের  অলিভার টুইস্ট, ডেভিড কোপারফিল্ড, হার্ড টাইমস, গ্রেট এক্সপেক্টেশন্স, অস্কার ওয়াইল্ডের দি পিকচার অফ ডোরিয়ান গ্রে, মেরি অ্যান এভান্সের  অ্যাডাম বেডে,  মিডলমার্চ,  উইলিয়াম ম্যাকপিস্ থাকারের ভ্যানিটি ফেয়ার, জর্জ মেরেডিথের দি এগোইস্ট, বেঞ্জামিন ডিসরেলির ভিভিয়ান গ্রে, স্যামুয়েল বাটলারের দি ওয়ে অফ অল ফ্লেশ, এলিজাবেথ গ্যাস্কেলের মেরি বার্টন, ক্র্যানফোর্ড,  আর. এল. স্টিভেনশনের ট্রেসার আইল্যান্ড, কিডন্যাপড এবং ড. জেকিল এন্ড মি. হাইড-এর মতো উপন্যাসগুলো স্বাদে, সৌন্দর্যে, বাকবৈদগ্ধে, কাহিনিনির্মাণে অনুপমা ও মুগ্ধতার দৃশ্যজাল তৈরি করে। কিন্তু  ইবনে খালদুন কেবল সেখানেই দৃষ্টিপাত করবেন না। তিনি কাহিনির শব্দ, বাক্য ও চরিত্র চিত্রণের তলায় নিহিত মূল্যবোধকেও পরখ করবেন। সেখানে দেখা গেল জীবনের এমন সব বিনষ্টি জড়ো হয়েছে, যাকে স্বাগত জানানো যায় না।

আর্থার হেনরি হ্যালামের কবিতা,  টেনিসনের  সাহিত্যকীর্তি। ব্রাউনিংয়ের  ড্রামাটিক কাব্য  কিংবা এলিজাবেথ ব্যারেট ব্রাউনিং, আর্থার হিউ ক্লাউ, ম্যাথু আর্নল্ড প্রমুখের কণ্ঠস্বর অনন্য সৃষ্টিশীল বর্ণিলতার মধ্যেও এই সব প্রবণতাকে অঙ্গীভূত করে নেয়।

একালে ইবনে খালদুনের নিকট বা দূরের  নানামুখী  প্রভাব নিজের মধ্যে ধারণ করে  টমাস কার্লাইল  দি ফ্রেঞ্চ রেভোলিউশন, জন স্টুয়ার্ট মিল দি সাবজেক্শন অফ উইমেন্, জন রাস্কিন মডার্ন পেইন্টার্স, ওয়াল্টার পেটার দি রেনেসাঁস-এর মতো চিন্তাশীল গদ্য রচনা করেন। যা সমাজ, বুদ্ধিবৃত্তি  ও নান্দনিকতার বিবিধ দিকের প্রতি প্রগাঢ় দৃষ্টিদান করে। কার্লাইলের মতো লেখকরা শিল্প বিপ্লবের অমানবিক প্রভাব এবং  যান্ত্রিক যুগ ও তার নানামুখী বিপদ সম্পর্কে দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন।  কবি এলিজাবেথ ব্যারেট ব্রাউনিং,  ঔপন্যাসিক চার্লস ডিকেন্স এবং টমাস হার্ডির মতো লেখকরা এই সচেতনতার দ্বারা উজ্জীবিত ছিলেন। সমস্যাকে তারা নানাভাবে  বয়ান করেন। কিন্তু  কালের অসুখের মুখোমুখি হয়ে এর পরিত্রাণ সন্ধান করার দায়িত্ব পালনে তাদের ক্ষমতা অনুপস্থিত থেকে গেল। তারা নানা অসুখ ও প্রবণতাকে আক্রমণ করেছেন, কিন্তু সেই অসুখকে কি বুঝতে পেরেছেন, যা নিজেদের মন, দৃষ্টি ও চিন্তার গোড়ায় ঘর গড়ে নিয়েছিল?

রয়্যাল অ্যাকাডেমির তিনজন শিল্পী—দান্তে গ্যাব্রিয়েল রোসেটটি, উইলিয়াম হোলমান হান্ট এবং জন এভারেট মিলাই নতুন স্বাদের শিল্পকর্মের মায়াজাল তৈরি করেন তখন।  টমাস উলনার, এফ. জি. স্টিফেন্স প্রমুখ কবি, শিল্পীরা ‘প্রি-রাফেলাইটিসম’ নামের শিল্প আন্দোলনকে করেন বিস্তৃত। কেবলমাত্র নান্দনিকতার বোধ শিল্প-সাহিত্যের মর্মমূলে স্থান করে নেয়। একে  প্রতিষ্ঠিত করার জন্য  অস্কার ওয়াইল্ড, ওয়াল্টার পেটারের  আর্ট ফর আর্ট’স সেক-এর আওয়াজ অচিরেই গর্জনে পরিণত হয়। শিল্প ছিল জীবনকে সুন্দর করবার হাতিয়ার। সে ছিল হৃদয়, মনন ও জীবনের সেবক। কিন্তু পশ্চিমা হৃদয়, মনন ও জীবনকে বানিয়ে দিলো তার সেবক!  ইবনে খালদুনের চোখে শিল্প ও নান্দনিকতা  হচ্ছে কোনো বিষয়ের পূর্ণতার প্রয়োজন, অস্তিত্বের প্রয়োজন নয়। নান্দনিকতার জায়গা বাতলাতে ইবনে খালদুন সেই ধারার একজন, যে ধারা সৃষ্টিজগৎ ও মানুষের স্বার্থ রক্ষার বিচারে আর্টকে দেখে। এই দিক থেকে জীবনের আভ্যন্তরীণ ও বাহ্যিক উপাদানসমূহ তিন পর্যায়ে বিভক্ত। সেগুলো হচ্ছে :

১. ‘জরুরিয়্যাত’ (জীবনের  জন্য যা অবিকল্প   জরুরি)

২. ‘হাজিয়্যাত’ (জীবনের  জন্য যা প্রয়োজনীয়)

৩. ‘তাহসিনাত’ (জীবনের  পূর্ণতা ও সৌন্দর্যের জন্য যা দরকারী।)

এই তিন স্তরে জীবনের দৃশ্য ও অদৃশ্য উপাদানসমূহকে দেখা ও বিচার করার দৃষ্টি গড়ে দেয় ইসলাম। এই দৃষ্টি জীবনের প্রতিটি প্রয়োজন ও চাহিদার মাত্রাকে দেখে ও দেখায় আপন নীতির নির্দেশে। মানবদেহ ও জরুরি বস্তুনিচয় দিয়ে সে বুঝিয়ে দেয় জটিল আলাপকে।  সে  জরুরিয়্যাত নিজের উদাহরণ খুজে নেয় মানবদেহে  মাথা, হৃদপিণ্ড ও কলিজায়, প্রকৃতিতে পানি, বাতাস ও ন্যূনতম খাবারে।  হাজিয়্যতের উদাহরণ খুঁজে নেয় মানবদেহে  চোখ, হাত, পা ইত্যাদিতে, প্রকৃতিতে ঔষধ, মাংস, শাক-সবজি ইত্যাদিতে।  তাহসিনাতের উদাহরণ খুঁজে নেয় মানবদেহে চোখের ডাগর গড়নে, চেহারার মাধুর্যে, দেহের সুগঠিত অবয়বে। প্রকৃতিতে   বৃক্ষের সবুজে, খাদ্যের স্বাদে, ফুলের সুগন্ধিতে।

এই যে তাহসিনাত, তৃতীয় স্তর, তারই এলাকার বিষয় হলো আর্ট। সে জীবন নয়, জীবনের সুন্দরতা, পূর্ণতা। সে জীবনের জন্য।  অতএব ইবনে খালদুনের পরামর্শ হলো শিল্পের উপাসনা শেষ অবধি অবক্ষয়কে ডেকে আনে, সে  জীবনকে মহিমান্বিত করতে পারে না। কিন্তু শিল্প যদি না থাকে, জীবন হয়ে যাবে সবুজরহিত মরুভূমি, স্বাদবর্জিত খাবার, জ্যোতস্নাবিহীন চাঁদ, পাখির গানহীন  বাগিচা। তাই বলে সবুজকেই আমরা বৃক্ষ মনে করব  না, স্বাদকেই খাবার  আর  গানকেই  বাগান ভাবব না। এমন ভাবনা তখনই সম্ভব, যখন বাস্তবতা ও আমাদের অবস্থানের মধ্যে দূরত্ব ঘটে গেছে।

বাস্তবতার সাথে শিল্প-সাহিত্যের দূরত্ব দূর করবার প্রতিশ্রুতি ছিল আধুনিকতার কণ্ঠে।  আধুনিকতাবাদী সাহিত্য  সামনে এলো নতুনের কেতন উড়িয়ে। তার মধ্যে ছিল পরীক্ষা-নিরীক্ষার প্রক্রিয়া।   সে নানা প্রকরণের  উদ্ভাবনী  কৌশল ব্যবহার করেছে,  বর্ণনামূলক স্থাপনার  স্বীকৃত নিয়মকে অস্বীকার করে সে অভূতপূর্ব বিকাশের ক্যানভাস রচনা করেছে। ব্যবহার করেছে মিশ্রচিত্র,  থিম গঠনে এনেছে অনন্যতা। তৈরি করেছে প্রকাশের এমন স্রোত, যা যৌক্তিক যেমন, তেমনি অযৌক্তিক, রৈখিক যেমন, তেমনি অরৈখিক, চেতনাঋদ্ধ যেমন, তেমনি অবচেতনে মুখর। সে ছিল মুক্ত এক স্রোত, সতত প্রবাহিত, প্রকাশপ্রকরণে বৈচিত্রময়, অভ্যন্তরীণ চোরাস্রোত ও মোচড়ে মাতোয়ারা। প্রচলিত কাব্যিক ফর্মের জায়গায়, অনেক আধুনিকতাবাদী কবি মুক্ত শ্লোক বেছে নেন, যেটিতে পুনরাবৃত্ত ছন্দের স্কিম, ছন্দোবদ্ধ কাঠামো বা বাদ্যযন্ত্রের ছন্দের প্রত্যক্ষতা নেই ।

আধুনিকতাবাদীদের অনেকেই নিজের প্রকাশপ্রকরণকে  দেন রূপকতা।   পাঠকের সাথে একটি ভাল বন্ধন তৈরি করতে প্রতীকবাদ এবং চিত্রকল্পের ব্যবহারে নিত্য নতুন পরীক্ষা ও সৃজনকর্ম ছিল চলমান।

সে সামগ্রিকভাবে সমাজকে আলিঙ্গন করার চেয়ে বরং জোর দিয়েছে ব্যক্তিবাদে।  প্রতীক, গল্প, চরিত্র ইত্যাদি ব্যক্তির সেই উন্মোচনে থেকেছে অসংকোচে, যা তার মূল্যবোধকে ত্যক্ত করতেও দ্বিধা করে না।

পরিবর্তনশীল মন ও পরিবেশ, চ্যালেঞ্জিং বিষয়  এবং সমস্যার সাথে বুঝাপড়ার এমন অনুপুঙ্খ প্রকাশকলা সে লাভ করে, যা ছিল অভিনব। বিচিত্র  মনোভাবনা, অভিব্যক্তি, প্রেম, কাম  ইত্যাদির প্রকাশে সে ছিল  নিরাবরণ।

প্রতিটি চরিত্রের বিষয়বস্তুকে হাইলাইট করার জন্য সে উদ্‌যাপন  করেছে স্বেচ্ছাধর্মী  স্বাধীনতা। যার হাতে  প্রচলিত আচার-আচরণ, রীতিনীতি, সামাজিক সম্পর্ক, পূর্ব ঐতিহ্য আক্রান্ত ও রক্তাক্ত হয়। আধুনিক কালখণ্ডে  সামাজিক, রাজনৈতিক বিপর্যয়  মানুষকে হতাশ, ব্যথিত ক্লিষ্ট ও বিষন্ন করে তোলে।  এরই মধ্যে চার ধারে ছড়িয়ে পড়ে   যুক্তির পারস্পরিক বিশৃঙ্খলা।  বিজ্ঞান-প্রযুক্তির বিস্ময়কর উন্নতি  এবং  যান্ত্রিকতার অবিশ্বাস্য অগ্রগতির মধ্যেও মানুষ নিজেকে নিত্য নতুন সংকটের আবর্তন থেকে মুক্ত করার সম্ভাবনাকে এগিয়ে নিতে পারেনি। কারণ তার চারধারে তখন   অভ্যন্তরীণ প্রশ্নে সংকট নেমে এসেছে। সাহিত্য, শিল্প, নান্দনিকতাও সেই সংকটের চারণভূমি হয়ে উঠেছে।

অস্তিত্ববাদ, পরাবাস্তববাদ, কিউবিজম, দাদাবাদ, ভবিষ্যতবাদ,  অভিব্যক্তিবাদ,  ইমাজিজম, প্রতীকবাদ ইত্যাদি মতবাদ আপন প্রস্তাবনা ও রূপকল্পের পরীক্ষা-নীরিক্ষা করেছে। অবচেতনমনের ক্রিয়াকলাপকে উদ্ভট ও আশ্চর্যকর সব রূপকল্প দ্বারা প্রকাশ করা হয়েছে,  ল্যান্ডস্কেপ, বস্তু এবং মানুষের আকারকে পৃথক সমতলে বিভক্ত করা হয়েছে   এবং বিমূর্ত স্বরূপে পুনর্গঠন  করা হয়েছে  জ্যামিতিকসহ নানা আকারে। যুদ্ধ, ধ্বংস, অসাম্য, অত্যাচার এবং হতাশা ও আতঙ্ককে আকার দেওয়া হয়েছে অস্বাভাবিক, খেয়ালের বিবেচনায়। ইচ্ছাকৃত অযৌক্তিকতা এবং ঐতিহ্যগত শৈল্পিক মূল্যবোধের অস্বীকারের উপর ভিত্তি করে তৈরি হয়েছে  শিল্প ও সাহিত্যের  আন্দোলন । তারপর দেখা যাবে নানা প্রবণতা। যেমন,  বাস্তব ও বিশ্বাসযোগ্য উপস্থাপনার পাশাপাশি উদ্ভট কল্পনা ও খেয়ালিপনার কল্পলোক,  বিশ্বযুদ্ধ ও  ফ্যাসিবাদের ভয়ংকর কালোছায়া,  দার্শনিকদের  নৈরাশ্য,  জীবনের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যের অস্পষ্টতা, ভ্রান্তি, অর্থহীনতা, অসন্তোষ,  দ্রোহ, এর ভেতর থেকে ঘোষণা-ঈশ্বর বেঁচে নেই!

বিশ্বশান্তি,  বিশ্বভ্রাতৃত্ব প্রকৃতি ও নিসর্গপ্রীতি,  প্রকৃতির অন্তর্লীন আনন্দ ও প্রশান্তির স্বরূপ সন্ধান,  মৌখিক শব্দের ব্যবহার, গম্ভীর ও অলংকারময় শব্দবর্জন, চিত্রকল্পের নিবিড় রূপদান,   বিষয় নির্বাচনের স্বাধীনতা,  মগ্ন চৈতন্য থেকে চিন্তাকে  আদিম, অবাধ অকৃত্রিম  স্বপ্নালোকে রূপায়িত করা,  জড়বাদী ও বাস্তববাদী সাহিত্যাদর্শ,  বস্তুনিষ্ঠ পর্যবেক্ষণ ও তন্ময় চিত্রণের মাধ্যমে মধ্যবিত্ত, নিম্নবিত্ত মানুষদের জীবন বিশ্লেষণ, বিজ্ঞানের নামে  মানুষের আধ্যাত্মিক ঐতিহ্যকে অস্বীকার ও প্রত্যক্ষ জীবনকেই চরম সত্য হিসেবে গ্রহণ,  নন্দনতত্বের  অর্থনৈতিক ভিত্তি, মার্ক্সবাদের তত্ত্বে  সাহিত্য ও সমাজের মেলবন্ধন, উত্তরাধুনিক সাহিত্য আন্দোলন, জিবাক ধারার বিকাশ ।

গোটা ধারাপরিক্রমায় দেখা যাবে নতুন নতুন চিন্তা ও তত্ত্ব বৃষ্টির মতো বর্ষিত হয়েছে, বিস্তার ঘটেছে ঝড়ের গতিতে,  বর্ণিলতা ও বৈচিত্রের সমাহার ঘটেছে অবিরল। কিন্তু যা ঘটেনি, তা হলো বিষয়বস্তুর সমৃদ্ধি, অগ্রগতি। রূপের জৌলুস প্রাণের দারিদ্রকে আড়াল করতে পারেনি। হৃদয় ও আত্মার প্রয়োজনকে উপেক্ষা করা হয়েছে, মানব প্রকৃতির কণ্ঠস্বর মৃদু হয়েছে এক দিকে, অপরদিকে জোরালো হয়েছে প্রবৃত্তির একচ্ছত্র আওয়াজ। মূল্যবোধ হারিয়েছে নিজের জায়গা, মহাজীবনের অর্থ, মর্ম ও আবেদন হয়েছে তিরস্কৃত। জীবনের ভগ্ন কিন্তু মত্ত ও  ভোগমগ্ন, রুগ্ন কিন্তু সুসজ্জিত অবয়ব প্রতিনিয়ত প্রদর্শিত হয়েছে। আধুনিকতা নিজের শৈল্পিক ও সাহিত্যিক অনুপমা, সাজ ও বৈচিত্রের আয়োজন দিয়েছে প্রত্যহ রূপময়ী সেই যুবতীর সম্মোহনের চিত্রায়ন করেছে, যে যুবতী হারিয়ে ফেলেছে সতিত্ব ও মাতৃত্ব।

ইবনে খালদুনের দৃষ্টি এখানে অনুপস্থিত নয়। তিনি সাহিত্যের  অন্তর্গত সম্পদ, সারসত্তা ও সারসত্যের ঋদ্ধি এবং সাহিত্যের মানবিক উতকর্ষে যে পরামর্শ দেন, তা হচ্ছে :

১. ব্যক্তিসত্তার বিকাশ সমষ্টিতে : ইবনে খালদুন ‘আসাবিয়্যাহ’ ধারণাটি প্রবর্তন করেছিলেন।  যা সামাজিক সংহতি বা গোষ্ঠী সংহতিকে ব্যাখ্যা করে।  যা ব্যক্তির একান্ত নিজস্ব সত্তাকে সমষ্টির সত্তার মধ্যে বিকশিত হবার পথ দেখায়। সাহিত্যে এই ধারণার রূপায়ন অন্বেষণ করা যেতে পারে  সামাজিক গঠন, তার সাথে যুক্ত প্রয়োজন ও মনস্তত্ত্ব এবং ব্যক্তির সত্তা ও সমাজসত্তার যৌথতাকে ভারসাম্যপূর্ণ বিকাশের রূপকল্পের মধ্যে।  এখানে যে সংকট ও দ্বন্দ্ব, এখানে যে ঝুঁকি ও সম্ভাবনা, এখানে যে লড়াই ও প্রাপ্তি,  সমস্ত কিছুকে ভাষা দিতে হবে লেখা ও রেখার মধ্য দিয়ে। কৌমসংহতি ব্যক্তির স্বাধীনতাকে খর্ব করবে না। তার বিকাশের সমস্ত শর্তকে সে মুক্তি দেবে। সাহিত্য এর অভিব্যক্তি  ও দৃশ্যপটকে উন্মোচন করবে, তাকে আমন্ত্রণ করবে। আসাবিয়ার গতিশীলতা একটি কেন্দ্র রচনা করবে। যেখানে মানবীয় যাপনের সমস্ত মাত্রা ও বৈচিত্র আপন স্রোতে প্রবাহিত হবে। সমস্ত স্রোতই মুক্ত, আবার সমষ্টির সাথে যুক্ত।

২. উত্থান-পতনের চক্র এবং সভ্যতার সত্য : ইবনে খালদুন দেখান, সভ্যতাগুলি উত্থান, বৃদ্ধি, অবক্ষয়  এবং শেষ পর্যন্ত পতনের একটি চক্রাকার প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে যায়। এর মধ্যে কাজ করে মানবীয় বৈশিষ্ট, দক্ষতা  ও গুণাবলির এমন সব উপাদান, যা সভ্যতার সারসত্য।  সাহিত্য একে প্রতিফলিত করবে।  সমাজের বিকাশ, সভ্যতার চূড়া  এবং পরবর্তী পতনের  কার্যকারণ পরম্পরার প্রতি দৃষ্টি দেবে। সাম্রাজ্যবাদ, আধিপত্যবাদ, ক্ষমতানেশা, সাংস্কৃতিক একচ্ছত্রতা, পুঁজি ও প্রতিপত্তি  কখন কী ভূমিকা নেয় এবং তার অভিঘাত কোথায় কীভাবে তৈরি হয়, সাহিত্য তার প্রতি নজর রাখবে, তাকে ব্যাখ্যা করবে। এবং ধ্বংসের শর্ত সমূহকে মোকাবেলা করবে বৃহত্তর মানবতার প্রয়োজনে । লেখকরা তাদের কাল্পনিক জগত এবং ইবনে খালদুনের ইতিহাসের চক্রাকার মডেলের মধ্যে সমান্তরাল পরম্পরা  আঁকতে পারেন। যা প্রতিটি সমাজে ও প্রেক্ষাপটে সময় ও জীবনকে ব্যাখ্যা করবার বিশেষায়িত দৃষ্টি ও কৃষ্টি হাজির করে।

৩. পরিবেশ, প্রতিবেশ ও  প্রকৃতির ভূমিকা : ইবনে খালদুন ব্যক্তি ও  সমাজের মনে পরিবেশ, প্রতিবেশের প্রভাবকে গুরুত্ব দিয়েছেন। প্রকৃতি মানুষের প্রভু যেমন নয়, শত্রুও নয়।  পরিবেশ ভালো নয়, আর আপনি ভালো থাকবেন, তা নয়। ভৌগোলিক ও পরিবেশজাত কারণ আমাদের আচরণ গঠন করে।  চরিত্র, সংস্কৃতি এবং সামাজিক নিয়মগুলিকে প্রভাবিত করে।  সাহিত্য একে যখন হাজির করবে, পরিবেশ, প্রকৃতি ও মানুষকে পরস্পর থেকে বিচ্ছিন্ন দেখাবে না। এখন তো মানুষ নিজেদের ভোগ ও সুখের প্রয়োজনে পরিবেশ হত্যা করছে। কিন্তু ইবনে খালদুনের প্রস্তাব সাহিত্যে যে বিবেকের প্রতিষ্ঠা চায়, তা বিশ্বজগৎ ও মানুষের ঐক্যকে ব্যাখ্যা করে। লেখকরা আপন আখ্যানে প্রাকৃতিক ও  ভৌগোলিক উপাদানগুলি বুনতে পারেন মানুষের আচরণ এবং সামাজিক কাঠামোর উপর তাদের প্রভাবকে আন্ডারস্কোর করবার জন্য ।

৪. সামাজিক গতিবিদ্যা অন্বেষণ :

  • ঐতিহাসিক কথাসাহিত্য : লেখকরা ইতিহাস সম্পর্কে ইবনে খালদুনের চক্রাকার দৃষ্টিভঙ্গি ব্যবহার করতে পারেন এমন ন্যারেটিভ তৈরি করতে যা সভ্যতার উত্থানের ছবি, গুণ, প্রকৃতি ও প্রক্রিয়া ব্যাখ্যা করে। পতনের প্রসঙ্গেও  তা করে। ঐতিহাসিক কথাসাহিত্যের মাধ্যমে, লেখক সমাজের বিবর্তন চিত্রিত করতে পারেন, সভ্যতার ভাগ্যের উপর আসাবিয়া, নেতৃত্ব এবং সামাজিক কাঠামোর প্রভাব তুলে ধরতে পারেন।
  • চরিত্রের বিকাশ : সাহিত্যের চরিত্রগুলি আসাবিয়ার নীতিগুলিকে আকার দিতে  পারে, সামাজিক সংহতি বা বিচ্ছিন্নতার বিভিন্ন মাত্রা প্রদর্শন করে মানুষের নিজস্ব ভাঙনের মোকাবেলা করতে পারে, সামাজিক ভাঙনকেও প্রতিহত করতে পারে। ব্যক্তিদের উপর সামাজিক পরিবর্তনের প্রভাব অন্বেষণ করতে পারে,  আবার ব্যক্তি কীভাবে  সমাজের পতনে অবদান রাখে কিংবা পতনকে প্রতিহত করে,  তার অসামান্য ভাষ্য ও চিত্র অঙ্কনের পথ প্রস্তাব করেন ইবনে খালদুন।

৫. ক্ষমতার কাঠামো এবং নেতৃত্বের বিশ্লেষণ :

  • রাজনৈতিক রূপকথা : সাহিত্য সাধারণত  ক্ষমতার লড়াই এবং সমাজের উপর নেতৃত্বের প্রভাব সম্পর্কে মনোযোগী। এখানে  ইবনে খালদুনের ধারণা বৈপ্লবিক।  এর আওতায় রয়েছে   রূপক গল্প, কাব্য, নাট্য  ও রূপকথা নির্মাণের সম্ভাবনা।  সেগুলোর ক্ষেত্র ও পরিধি কোনো সাংস্কৃতিক পরিচয়ের  পরিধি দ্বারা সীমায়িত নয়। পরিবার, সমাজ ও সভ্যতার দীর্ঘায়ু এবং স্থিতিশীলতার উপর বিভিন্ন নেতৃত্বের শৈলীর নানামুখী পরিণতি বিশ্লেষণের প্রকল্প রয়েছে ইবনে খালদুনের চিন্তায়।
  • আধিপত্যের অন্বেষণ : রাষ্ট্র, পরাশক্তি, শাসকগোষ্ঠী বা  রাজবংশের উত্থান এবং পতনকে আপন আলোতে সংজ্ঞায়িত করেন ইবনে খালদুন।  এ বিষয়ে তাঁর  ভাবনাগুলি আধিপত্যের কাঠামো পরীক্ষা করে।  ক্ষমতার লড়াই, পরাশক্তির স্বেচ্ছাচার, যুদ্ধ ও গণহত্যার খেলা, স্বাধীনতা হরণ বনাম স্বাধীনতার লড়াই,    প্রভাবশালী গোষ্ঠী বা ব্যক্তিদের দ্বারা ক্ষমতার একত্রীকরণ এবং চূড়ান্ত ক্ষয় ইত্যাদিকে চিত্রায়নের অন্তর্দৃষ্টি সরবরাহ করে ইবনে খালদুনের প্রকল্প। যা সাম্রাজ্যবাদ ও পরাশক্তিদের তৈরি ন্যারেটিভের বিকল্পে নির্মোহতা তৈরি করে ।

৬.  সাংস্কৃতিক বিবর্তন : ইবনে খালদুন সামাজিক উন্নয়নে সংস্কৃতির ভূমিকা তুলে ধরেন। সাহিত্য সময়ের সাথে সাংস্কৃতিক নিয়ম, ঐতিহ্য এবং ভাষিক চলমানতায়  বিবর্তনকে কামনা করে।  এই বিবর্তন কোন পথরেখা ধরে বিভিন্ন সমাজ, সংস্কৃতি, দেশ, ভাষা, জাতি ইত্যাদিকে চালিত করে, সে বিষয়ে ইবনে খালদুনের প্রস্তাব কোনো বর্ণবাদ, জাতিবাদ কিংবা ভাষিক-ভৌগোলিক শ্রেষ্ঠত্ববাদকে প্রশ্রয় দেয় না।

তা বরং এমন আকর্ষণীয় লেন্স প্রদান করে,  যার মাধ্যমে সামাজিক গতিশীলতা, ঐতিহাসিক চক্র এবং মানুষের অবস্থা পরীক্ষা করা যায়। এখানে প্রতিটি উপাদানের কাজ যেমন আয়নায় ভাসে, তেমনি প্রতিটি শক্তির ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়াকেও নীরিক্ষণ করা যায়। এই প্রকল্পকে সাহিত্য দেবে সেই উদ্‌গতি, যা বিদ্যমান বিনষ্টি ও অবক্ষয়ের প্রতিবিধান সন্ধানে গতিমান শক্তি সরবরাহ করে।

৭. বস্তু ও আত্মা : বস্তুগত সমৃদ্ধির জন্য আত্মা ও আধ্যাত্মিক মূল্যমানকে উপেক্ষা করা চলবে না। এমন রূহানিয়াতও গ্রহণযোগ্য নয়, যা বস্তুগত বাস্তবতা ও পার্থিবতাকে উপেক্ষা করে। উভয়ের সুষম সমন্বয়ের মধ্য দিয়ে সাহিত্যিক থিম আকার লাভ করবে। চরিত্র বিকশিত হবে। পার্থিব-অপার্থিব সত্য, বোধ ও বিভূতি সাহিত্যে পাবে যার যার মূল্য ও অবস্থান। কেউ কাউকে বাদ দিয়ে নয়।

৮. সাহিত্যের বিষয়বস্তু গোটা জগত, সাহিত্যের অভিব্যক্তি গোটা জীবন : সাহিত্যকে কোনো বিশেষ চরিত্রের কারাগারে বন্দি করা চলবে না। সাহিত্য প্রকাশ করবে সকল প্রকাশিতব্যকে। মানব জীবনের সকল অনুভূতি, অভিব্যক্তি তার আলোচ্য। প্রেম-বিরহ, কাম-ক্রোধ,  যুদ্ধ-শান্তি, দারিদ্র-সমৃদ্ধি, ধর্ম-অধর্ম, বিশ্বাস-অবিশ্বাস, স্বপ্ন-বাস্তবতা  সমস্ত কিছুই সাহিত্যিক দৃষ্টিদানের বিষয়।  সাহিত্য গোটা নিখিলকে আপন ক্যানভাস বানাবে, এমনকি সে নিজের প্রতিনিখিলও তৈরি করবে। বিশালতা, বিপুলতা ও ব্যাপ্তি এবং সর্বমুখিতা সাহিত্যের মুক্তির শর্ত। সাহিত্যকে কোথাও বন্দি করে আসবিয়্যা বা সমাজ-সংগঠনের  আজাদি আসতে পারে না।

ইবনে খালদুন সাহিত্যের ভাষিক প্রস্তাবও হাজির করেন। ভাষাকে হতে হবে বিষয়ের সকল মাত্রার প্রকাশক। লোকভাষা শিল্পের শর্ত ছাড়াই শিল্প তৈরি করে। ফলে নিজেই হয়ে উঠে নিজের শর্ত। এই শর্ত নির্ধারণ করে তার প্রবাহের পথ। ফলে এখানেও চলমানতার ব্যাপার রয়েছে। স্থবিরতা এমনকি লোকভাষারও সহযাত্রী হতে পারে না।

ভাষার কাজ কেবলই অনুভূতির প্রকাশ নয়, ভাষিক যোগাযোগ অনুভূতি নির্মাণও করে। ফলে চিন্তা ও ভাবধারার অগ্রগতি ও সমুন্নতির  দায়িত্ব পালনের  প্রধান বাহক ভাষা।

লেখক হচ্ছেন ভাষার চাষি। তিনি বাক্য ও বয়ানে চিন্তা ও  সংস্কৃতিকে ব্যক্ত করেন, আবার চিন্তা ও  সংস্কৃতির জন্য মন রচনা করেন।  বাক্য পাঠ করে সাথে সাথে বুঝে নেবার মধ্যে এক রকম মজা আছে। আর বাক্যের অর্থের বহুত্বে পরোক্ষ মর্ম খুঁজতে থাকার মাঝে মননের আরেক রকম মজা, তুষ্টি ও পুষ্টি আছে। প্রথম মজার চেয়ে দ্বিতীয় মজার স্বাদ, শক্তি ও মহিমা অনেক উঁচু, অনেক গভীর, অনেক তীব্র। কারণ এর মধ্য দিয়ে প্রমাণ থেকে প্রামাণ্যকে জয় করবার আনন্দ থাকে, উল্লাস থাকে। আনন্দ, কিন্তু নামহীন। উল্লাস, কিন্তু শব্দহীন। এই আনন্দের নাম কি আসলেই নেই? না, তার নাম আছে। তার প্রকৃত নাম হলো রসানুভূতি, সাহিত্য।

যে বাণীকে বলা হয় প্রকাশ ও ব্যঞ্জনা, তার রহস্য ও শক্তি নিহিত আছে মনোভাব সঞ্চারণে, নিছক প্রকাশে নয়, সঞ্চালনে, বিস্তারে। ভাষা যদি সেই লক্ষ্যপূরণে সমর্থ না হয়, তাহলে সে হচ্ছে শব্দাবলির এমন লাশ, যার কোনো এক্সপ্রেশন নেই, ব্যঞ্জনা নেই।

আসলে বাকবৈদগ্ধ হলো অর্থের দ্বারা বাণীর অন্তঃসত্তা  হওয়া। একটি বিষয়ের যতগুলো মাত্রা আছে, সমস্ত মাত্রা ও চাহিদাকে প্রকাশ  করবে যে বাণী, সে হচ্ছে বাক্‌শিল্পের সফল রূপ।

পাঠক হলেন সমাজের সাড়া। তার চাহিদার মূল্য আছে। কিন্তু  নিছক পাঠকের চাহিদা আরো বেশি মূল্যবান।  চিন্তা ও  প্রসঙ্গের চাহিদা যেমন হবে, বাণীর আত্মগঠন ও আত্মপ্রকাশ হবে তেমন। এমন বাণী গঠন  খালি খালি শব্দ জড়ো করলেই সম্ভব নয়। এমন বাক্যের ভেতরে প্রবেশ খালি খালি পড়তে পারলেই সম্ভব নয়। বরং তার রয়েছে শর্ত ও নিয়ম। এই সব শর্ত ও নিয়ম যেমন ভাষিক প্রবাহ থেকে তৈরি হবে, তেমনি চিন্তার কেন্দ্রবিন্দু ও শৃঙ্খলা  থেকে যে পথ তৈরি হবে, সে নিজেই নিজেকে জোগান দিতে থাকবে ভাষা; শব্দ-বাক্য। আল-মুকাদ্দিমা রচনায় ইবনে খালদুন এমনই বাস্তবতার হাতে নিজের ভাষারীতিকে সপে দিয়েছিলেন।

জ্ঞান যখন অনুপস্থিত, আপনি ভাব ও চিন্তার দ্বারা গর্ভবর্তী  বাণীর স্রষ্টা হতে পারবেন না, জ্ঞান যখন গরহাজির, আপনি এই বাণীর পাঠক হতে পারবেন না। এর মানে পরিষ্কার। তিনটি বিষয় আছে এখানে। এক.  শব্দ, বাক্য, দুই. বিষয় ও মর্ম, তিন.  উভয়ের সামঞ্জস্য। সামঞ্জস্য যত পূর্ণ, সাহিত্যশিল্প তত পরিণত।

বিজ্ঞাপন

Subscribe
Notify of
guest
1 Comment
Oldest
Newest Most Voted
Inline Feedbacks
View all comments
কমল উদ্দিন
কমল উদ্দিন
1 year ago

ভালো লেগেছে।

স্বত্ব © ২০২৩, যোগাযোগ | ই মেইল : jogajogbd.org@gmail.com

যোগাযোগ-এ প্রকাশিত কোনো লেখা, ছবি কিংবা শিল্পকর্ম লেখক অথবা কর্তৃপক্ষের অনুমতি ছাড়া কোথাও প্রকাশ করা অবৈধ৷