কাগজের ফুল থেকে কাগজের রাজহাঁস

আতিক ফারুক

বই : তথাপি ফুল ফোটে প্রতিদিন

লেখক : আতিক ফারুক

প্রচ্ছদ : সুপ্রসন্ন কুণ্ডু

প্রকাশনী : বুককাম

পৃষ্ঠা : ৯৬

না। আমাদের তেমন কোনো প্রেম ছিল না। আমরা ভেবেছিলাম, এভাবেই বন্ধুত্ব টিকে থাকবে, প্রতিদিনের কাজকর্ম সেরে আমরা শহরের হুল্লোড় ছেড়ে গ্রামের দিকে হেঁটে যেতাম। কোনো নারী আদতে পুরুষের বন্ধু হতে পারে কি না তা নিয়ে আমার যথেষ্ট সংশয় আছে। পৃথিবীর সকল পুরুষই পলিগ্যামি। ঘরে বউ রেখেও অন্য নারীর প্রতি এ আকর্ষণ যেন চিরদিনের, চুম্বকের মতো টেনে নিয়ে যায় তার চোখ এবং বুকের স্ফীত বিন্দুর কাছে।

২.

তার নাম মৌমিতা। নামের অর্থের মতোই সে ছিল মিষ্টি সহচর, বিশ্বাসী বন্ধু। আমার মনে দুঃখ হলে তার সাথে কথা বলি, তার মনে দুঃখ হলে আমার সাথে কথা বলে। মৌদের গ্রামের বাড়ি ছিল সাতক্ষীরা, শ্যামনগর উপজেলার হরিনগর গ্রাম। তার বাবা একজন মৌয়াল—যে মৌচাক থেকে মধু সংগ্রহ করে জীবিকা নির্বাহ করে। বছরের বেশিরভাগ সময়ই তার বাবা বনে বনে ঘুরে বেড়াত, ঘুরে ঘুরে মধু আহরণ করত—কোনো সন্ধ্যায় তার বাবা বাড়ি ফিরে এলে বনের ভেতর কতরকম ঘটনা ঘটেছে, তাদের আগের কোনো মৌয়ালদলের কেউ বাঘের থাবায় পড়েছে, কেউ চুপচাপ দেখেছে বাঘের পায়ের চিহ্ন। কেউবা কুমিরের কঙ্কাল পড়ে থাকতে দেখেছে বনের ভেতর। এরকম নানান ঘটনা যখন সন্ধ্যার পরপর তার বাবা বাড়ির উঠোনে বসে বলত, তখন মৌয়ের বয়স মাত্র সাত বছর।

আমরা যখন ছোটোবেলার গল্প বলতে থাকতাম একে অপরকে—তখন সে-ও তার গ্রাম, পরিবার এবং শৈশবের কথা খুব মায়া নিয়ে বলত আমাকে।

মৌয়ের সাথে আমার ছাড়া-ছাড়া বন্ধুত্ব জমে উঠতে বেশিদিন সময় লাগেনি। আমরা অল্পসময়ের মাঝে পরস্পরের আশ্রয় হয়ে উঠলাম—আমরা পারিপার্শ্বিক আলোচনার বাইরে গিয়ে এবার নিজেদের ভেতরকার কথাগুলো বলতে লাগলাম। কী ঘটেছিল একদিন, অতীতের সকল বিধ্বস্ত ঘটনা তাকে জানালাম। সে-ও জানাল তার কোনো কোনো বন্ধু তাকে ভোগ করতে চেয়েছিল, শুধু তার শরীরের প্রেমে পড়েছিল তারা। আমি যেভাবে তার আশ্রয় হয়ে উঠতে পেরেছি, তা আরকেউ পারেনি। সেজন্য আমার প্রতি তার ধীরগতির দুর্বলতা উপলব্ধি করতে পারি সহজে।

৩.

মৌমিতার চুল ছিল খাটো। লম্বা চুল তার ভালো লাগে না বলে মাসে মাসে সেলুনে গিয়ে চুলের পরিমাপ ঠিক করে নেয় সে। অথচ আমার দীঘল কালো চুল ভালো লাগে—মৌমিতার আরেক দুঃসহ অতীত আছে, যা আমি বুঝতে পারলেও কখনো জিজ্ঞেস করিনি, সে যদি স্মৃতির অতল গহ্বরে তলিয়ে যায়, আবারও যদি মন খারাপ হয় তার, আমাকেই তো সান্ত্বনা দিতে হবে সেজন্য।

স্মোক করার অভ্যাস ছিল মৌয়ের। প্রথমদিন সৌজন্যবশত আমাকে জিজ্ঞেস করেছিল, যদি সে একটা সিগারেট ধরাতে চায়, আমি রাগ করব কি না বা এ বিষয়ে আমার কোনো দ্বিমত আছে কি না। আমি বলেছি, সেটা তোমার স্বাধীনতা মৌ, কারো কোনোকিছুতে আমার কোনো অভিযোগ নেই। কারো স্বাধীনতা হরণ করতে চাই না অন্তত। তোমার জীবনের সিদ্ধান্ত তুমিই নাও। মৌ মৃদু হেসে উঠেছিল আমার এমন কথায়।

৪.

হরিনগরে কখনো যাওয়া হয়নি। মৌ কতবার বলেছে, তার মা’ও বলেছিল তাদের বাড়ি থেকে বেড়িয়ে আসতে—কিন্তু, আমি যাইনি। যাওয়ার আগেই হয়তো মৌয়ের সাথে আমার সবকিছু শেষ হয়ে যায় বা তার সাথে দীর্ঘ অভিমান গড়ে ওঠে আমার।

৫.

কাগুজে ফুল, কাগুজে রাজহাঁস এবং কাগুজে ব্যাঙ বানাতে পারত মৌ। একদিন আমাকে একটা কাগজের ফুল বানিয়ে দিয়েছিল, সে-ফুল এখনো আমি খুব যত্নে রেখে দিয়েছি। আমি তাকে জানাই, স্কুলে পড়ার সময়ে আমিও নানা রঙের কাগজ দিয়ে রাজহাঁস বানাতাম, এছাড়া আর কিছু বানানো শিখিনি, তা-ও শিখিয়েছিল আমার বন্ধু অনল। আহা অনল—ওর কথা মনে পড়ে গেল। কোথায় যে হারিয়ে গেল, কোনো যোগাযোগ নেই।

তো, আমি একদিন একটা রাজহাঁস বানিয়ে মৌ-কে উপহার দিই, সে খুব খুশি মনে তা গ্রহণ করে। তারপর অনেক রাত পেরিয়ে যায়।

৬.

শীতের কোনো এক রাতের কথা। আমরা রিক্সার হুড লাগিয়ে, কুয়াশাজড়ানো পথে পথে ঘুরছি। হঠাৎ মৌয়ের আঙুলে আমার আঙুলের স্পর্শ, উরুর সাথে উরুর সংস্পর্শ লেগে যায়—কেমন আর্দ্রনয়নে তাকায় সে। আমি তার চোখের ইশারা বুঝতে পারি, ঠিক তখনই আমরা আশ্রয় থেকে আরও কাছাকাছি, আরও ঘনিষ্ঠ মিত্র হয়ে উঠি।

মৌয়ের সাথে আমার সে রাতেই শেষ দেখা। তারপর থেকে মৌয়ের উপেক্ষাই পেতে থাকি শুধু। না আমরা বন্ধুত্বের উদ্দেশে যেতে পেরেছি কোথাও, না আমরা পরস্পর তীব্র প্রেমের মতো কোনো ঐশ্বর্যে উপনীত হতে পেরেছি।

৭.

তারপর একদিন, বহুদিন পরের কথা। মৌয়ের উপহৃত কাগজের ফুলটা ভেঙে কাগজের রাজহাঁস বানালাম। রাজহাঁস ভেঙে সেই কাগজে লিখলাম—প্রিয় মৌ, ফিরে এসো।

কিন্তু, কোনোদিন ফিরে এলো না মৌ। ফুল থেকে রাজহাঁসের পিঠে চড়ে আমাদের সুন্দর বন্ধুত্ব ভেসে গেল নদীর মোহনায়।

বিজ্ঞাপন

Subscribe
Notify of
guest
2 Comments
Oldest
Newest Most Voted
Inline Feedbacks
View all comments
জুনাইদ বিন আজিজ
জুনাইদ বিন আজিজ
1 year ago

অসাধারণ!

মাসউদ সরওয়ার
মাসউদ সরওয়ার
22 days ago

আপনার লেখা সবসময় ভালো লাগে।

তবে এটা অসাধারণ ছিল।

স্বত্ব © ২০২৩, যোগাযোগ | ই মেইল : jogajogbd.org@gmail.com

যোগাযোগ-এ প্রকাশিত কোনো লেখা, ছবি কিংবা শিল্পকর্ম লেখক অথবা কর্তৃপক্ষের অনুমতি ছাড়া কোথাও প্রকাশ করা অবৈধ৷