এক.
গোটা তিনেক মরা লেবু আর পলিথিনে মোড়ানো কিছু শুকনো খসখসে নানরুটি পাশাপাশি রাখা।
সুপার মার্কেটে সদাই বলতে শুধু এগুলোই আছে।
ক্লান্ত চোখের পাতা মেলে সেদিকে তাকিয়ে থাকি। আমার সমস্ত শরীর ভেঙে আসে হাত তুলে সদাইটুকু নিতে গিয়ে। ধুলোজমা শূন্য সারিগুলো ধরে আরেকবার ঘুরে দেখি, যদি কিছু পাই… অথচ পাওয়া যায় শুধু দূর থেকে ভেসে আসা স্মৃতিগন্ধ। মনে পড়ে সেইসব দুপুরের গল্প, স্কুল শেষে দুই ভাইবোন মিলে দৌড়ে সুপারমার্কেটে ঢোকা আর দুহাত ভরে চকলেট-চিপস নিয়ে বাসায় ফেরা। মনে পড়ে মায়ের মাথা নেড়ে অসম্মতি জানানো। মা খুব চেষ্টা করতেন তার লাল টুকটুকে চেহারার ছেলেমেয়েগুলোর স্বপ্নালু চোখের দিকে তাকিয়ে যেন হেসে না ফেলেন আবার। আমাদের চুলে হাত বুলিয়ে…
সজোরে মাথা নাড়াই।
সংযত করি নিজেকে।
যখন বুঝতে পারি দোকানের প্রতিটা সারি সত্যিকারার্থেই ফাঁকা, ক্লান্ত পা ফেলে কাউন্টারের দিকে এগিয়ে যাই। লেবু আর রুটির মূল্য পরিশোধ করি বাবার রেখে যাওয়া জমানো টাকা থেকে। সেই করুণ দুর্ভাগ্য বয়ে আনা দিনটি আসার আগে বাবা যতটুকু তুলতে পেরেছিলেন, তা-ই এখন আমাদের সম্বল। ষাটোর্ধ্ব বৃদ্ধ দোকানদার খুচরো টাকা ফেরত দিতে দিতে হাসেন সহানুভূতির হাসি।
সুপারমার্কেটের বাইরে আমার জন্য অপেক্ষা করছিল গাঢ় নিস্তব্ধতা। তাতে আমার থোড়াই পরোয়া, এ দৃশ্য তো আমি রোজই দেখি। তবু বুকের ভেতর কোথাও তীব্র যন্ত্রণা শেল হয়ে বিঁধতে থাকে।
ভাঙা রাস্তায় পিচ গলে কেবল পাথরকণা এখন। ধূসর দালানগুলো দেবে গেছে প্রায়। মিলিটারিদের বোমার আঘাতে যে ক্ষয় শুরু হয়েছিল, যেন তারই সমাপ্তির পথে চলছে।
শীতের অবশিষ্ট রেশটুকু শুষে নিচ্ছে সূর্যের আলো, তবু কিছুটা হিম এখনো বাতাসে। যুদ্ধ-বিধ্বস্ত সিরিয়ায় এখন আর বসন্তের সজীবতা পৌঁছোয় না। আমার শহর হোমসে তো না-ই। এখানে কেবল যন্ত্রণার আধিপত্য। গাছের ভারী ভারী মৃত শাখা-প্রশাখায় তাদের বসবাস। মানুষের বুকে বেঁচে থাকা আশাই কেবল যন্ত্রণাকে খানিক ছুটি দিতে পারে।
সংসারে সন্ধ্যাবধূর আগমনী আয়োজন চলছে। পশ্চিমাকাশে লেগে থাকা শেষ বিকেলের স্বর্ণচ্ছায়া ক্রমেই গাঢ় নীলে রূপ নিচ্ছে। আমি আওড়াতে থাকি, ‘ডেইজি। ডেইজি। ডেইজি। মিষ্টিগন্ধা ডেইজি।’
সুপারমার্কেটের বাইরে কিছু মানুষ দাঁড়ানো। তাদের জরাগ্রস্ত চেহারায় চোখগুলো জ্বলজ্বল করছে উজ্জ্বল নক্ষত্রের মতো। পাশ দিয়ে হেঁটে যেতে যেতে তাদের কথা কানে আসে, কিন্তু আমি এড়িয়ে যাই। তাদের আলাপের বিষয়বস্তু আমি জানি। গত নয় মাস ধরে সবাই এই এক আলাপই করছে।
আর কোনো শব্দ কানে আসার আগেই আমি দ্রুতপায়ে এগিয়ে যাই। কারণ, আমি জানি সামরিক অবরোধ মানেই আমাদের মাথার উপর মৃত্যুর হুলিয়া ঝুলে আছে। খাদ্যসংকট বেড়েই চলেছে। খেয়ে না খেয়ে দিনাতিপাত করতে হচ্ছে আমাদের। হাসপাতালগুলোর অবস্থা এতই করুণ যে হয়তো খুব দ্রুতই চিকিৎসা শব্দটাই কিংবদন্তি মনে হবে। এই সবকিছুই আমি জানি, বুঝি। কারণ, এই আজই আমি নিজ হাতে, এনেস্থেশিয়া ছাড়াই সার্জারি করে এসেছি। ইনফেকশনে আর ক্রমাগত রক্তক্ষরণ হয়ে মানুষ মারা যাচ্ছে, অথচ আমি তাদের জন্য কিছুই করতে পারছি না। আমি জানি, ফ্রি সিরিয়ান আর্মি যদি হোমসের মিলিটারিদের কিছু করতে না পারে তাহলে আমাদের পরিণতি মৃত্যুর চেয়েও ভয়ংকর হবে।
বাতাসে হিম বেড়ে যাচ্ছে। গায়ের ওড়নাটা গলার চারপাশে টেনে দিই। আমার সাদা এপ্রোনে ছোপছোপ রক্তের শুকনো দাগ। যতগুলো প্রাণকে আমি পর্যাপ্ত চিকিৎসা দিতে পারিনি, প্রতিটা মৃত্যু রক্তবিন্দু হয়ে আমার ভেতরে মিশে গেছে, আমারই অংশে পরিণত হয়ে গেছে। যত হাজারবারই হাত ধুয়ে পরিষ্কার করি না কেন, শহিদদের রক্ত আমার ত্বকের ভেতর ঢুকে যায়, মিশে যায় প্রতিটি কোষে। এতদিনে হয়তো আমার ডিএনএর সাথেও মিশে গেছে।
আর আজকে… হাড় কাটার জন্য ডাক্তার যিয়াদের ঘরঘর করে ছুরি চালানোর শব্দ সারাটা দিন মাথার ভেতর ক্রমাগত বেজেই চলেছে।
একটা সময় কত স্বপ্ন ছিল। এই হোমস গোটা সতেরটা বছর আমাকে বড় করেছে, লালন করেছে আমার স্বপ্নগুলো—ভালো রেজাল্ট নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বের হওয়া, যাইতুনা হাসপাতালে ফার্মাসিস্ট হিসেবে ভালো একটা পদ পাওয়া আর কোনো একদিন বিশ্বভ্রমণে বেরিয়ে পড়া।
অথচ কেবল কোনোমতে একটা স্বপ্নের নাগাল পেয়েছি আমি। তাও যেভাবে চেয়েছি, সেভাবে যদি পেতাম!
গতবছর যখন আরব বসন্ত শুরু হলো, সিরিয়ার মানুষের মনে আশা জেগে উঠেছিল আর সেই আশা বুকে নিয়ে তারা ডাক দিয়েছিল স্বাধীনতার। সে ডাকের জবাব স্বৈরতান্ত্রিক শাসক দিয়েছিল নরকের দুয়ার খুলে দিয়ে।
মিলিটারিরা যখন খুঁজে খুঁজে ডাক্তারদের মারতে শুরু করে, মানুষের হাসির মতো তাদের অস্তিত্বও দুর্লভ হয়ে পড়ে সিরিয়ায়। তবু বোমাবর্ষণ কি আর থামায় তারা? যাইতুনা হাসপাতালে ডাক্তারদের পরিবর্তে যারা যতটুকু সম্ভব সাহায্য করছে, তাদের অস্তিত্বও মুছে না দেয়া পর্যন্ত মিলিটারিদের হাত থামবে না। হাসপাতালের বর্তমান অবস্থা এতই করুণ যে কর্মচারিরা এখন নার্সের দায়িত্ব পালন করছে। এক বছর ফার্মাসি পড়েই একজন দক্ষ ডাক্তারের সমান কাজ আমাকে করতে হচ্ছে। কারণ, সর্বশেষ যে ফার্মাসিস্ট এখানে ছিলেন, তিনিও চাপা পড়ে গেছেন তার বাড়ির ধ্বংসস্তুপের নিচে।
আমার আঠারও না পেরোনো বয়স, চিকিৎসাশাস্ত্রে আমার জ্ঞান কেবল পাঠ্যবইয়ের শব্দে সীমাবদ্ধ থাকাটা কোনো বিষয়ই না এখন আর। সমস্ত অজ্ঞতা আর সীমাবদ্ধতাকে কাটিয়ে দিতে হয়েছে প্রথম যখন রোগীর দেহ এনে আমার সামনে শুইয়ে দেয়া হয় সেলাই করার জন্য। মৃত্যু সত্যিই দারুণ শিক্ষক!
গত ছয়মাস অগুনতি সার্জারি আমাকে করতে হয়েছে। কখনো কল্পনাও করিনি যে, এত এত মানুষের চোখ নিজের হাতে বুঁজে দিতে হবে।
আমার জীবন তো এমন হওয়ার কথা ছিল না…
বাড়ি ফেরার বাকি পথটুকু আমাকে মনে করিয়ে দেয়, ইতিহাস বইয়ের পাতায় থাকা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তী লন্ডন আর জার্মানির সেই সাদা-কালো ছবিগুলোর কথা যেখানে মাটিতে মিশে যাওয়া ঘরবাড়ি থেকে কাঠ-সিমেন্ট বের হয়ে পড়ে আছে ছিন্ন-বিচ্ছিন্ন হয়ে।
এপ্রোনের ছেঁড়া অংশগুলো দিয়ে ঠান্ডা বাতাস ঢুকে যাচ্ছে শরীরে। শীতে গা কেঁপে কেঁপে উঠছে। আমি ফের আওড়াই, ‘ফিভারফিউ। দেখতে ডেইজির মতো। জ্বর ও বাতের ব্যথা সারায়। ফিভারফিউ। ফিভারফিউ। ফিভারফিউ।’
অবশেষে দৃষ্টির সীমানায় আমার বাসার দৃশ্য স্পষ্ট হয়। যদিও এই বাসা আসলে আমার না। সেই বাড়িটা না যেখানে আমি পরিবারের সাথে ছিলাম। আমাদের বাড়িতে বোমা হামলার পর, লায়লা আমাকে এখানে আশ্রয় দিয়েছে। ও না থাকলে হয়তো রাস্তায় পড়ে থাকতে হতো।
লায়লার বাসা—আমাদের বাসা—আশপাশের আর সব একতলা বাড়ির মতোই একটা বাড়ি। প্রতিটা বাড়ির দেয়ালে বুলেটের আঘাত ফুটে আছে মৃত কোনো শিল্পকর্ম হয়ে। প্রতিটা বাড়ি নিশ্চুপ, বিষণ্ণ আর নিঃসঙ্গ। এই এলাকাটাই হোমসের অল্প কিছু অক্ষত এলাকাগুলোর মধ্যে সর্বশেষ। বাকিসব এলাকায় তো মানুষকে হয় ভাঙা ছাদের নিচে নয় রাস্তায় ঘুমাতে হয়।
জং ধরা তালায় চাবি ঘোরাতে ঘোরাতে আওয়াজ দিই, ‘লায়লা?’
‘এই যে, এখানে!’ লায়লা জবাব দেয়।
আমাদের দুজনের জন্মের সময় ওর আর আমার আম্মু হাসপাতালের একই রুমে ছিল। পৃথিবীতে আমরা একই সময়ে চোখ মেলি। ছোটবেলা থেকে ও আমার প্রিয় বন্ধু, আমার ভরসার জায়গা আর আমার ভাইয়া হামযাকে ভালোবেসে হয়েছে তার স্ত্রী, আমার ভাবী।
আর এখন, জীবনের হাজারটা মোড় বদলানোর পর, এখন লায়লা আমার দায়িত্ব এবং একমাত্র পরিবার।
লায়লা যখন এই বাসাটা প্রথম দেখে, বাড়ির অদ্ভুত নান্দনিকতায় সে মুগ্ধ হয়ে যায়। ভাইয়া তাই ঠিক তখনই বাসাটা ওর জন্য কিনে ফেলে। দুই বেডরুমের ছোট্ট বাসা সদ্য বিবাহিত দম্পতির সংসার পাতানোর জন্য একদম পারফেক্ট। একপাশের দেয়ালে পুরোটা জুড়ে লায়লা সবুজ লতা এঁকেছে। আরেক পাশের দেয়ালে রং-তুলিতে ফুটিয়ে তুলেছে ল্যাভেন্ডার ফুলের পার্পল সৌন্দর্য। মেঝেতে পেতে দিয়েছে ভারী এরাবিয়ান কার্পেট। রান্নাঘরের দেয়ালে লায়লা সাদা রং দিয়েছে আখরোট কাঠের বানানো তাকগুলোর সাথে কন্ট্রাস্ট করার জন্য। সেই তাকগুলোতে ছিল তার নিজের ডিজাইন করা রং-বেরঙের মগ। রান্নাঘর থেকে বসার ঘরটা দেখা যায়। পুরনো দিনগুলোতে ওখানে লায়লার ছবি আঁকার সমস্ত সরঞ্জাম ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকত। রংমাখা আঙুলের ছাপ লেগে যাওয়া কাগজগুলো মেঝেতে গড়াগড়ি খেত। বোতলের রঙ চুয়ে পড়ত তুলির গা থেকে। প্রায় সময়ই, আমি এসে ওকে দেখতাম ইজেলের নিচে গুটিসুটি মেরে শুয়ে ছাতের দিকে তাকিয়ে আছে। লালচে বাদামি চুলগুলো মেঝেতে ছড়িয়ে ফেলে রেখে সে গুনগুন করত কোনো জনপ্রিয় আরবি গান।
এই বাসাটা ছিল লায়লার প্রাণের স্বরুপ।
আজ আর সেসবের কিছুই নেই। লায়লার বাসা পুরনো সেই জৌলুস হারিয়ে ফেলেছে। সমস্ত রং মলিন হয়ে গেছে, পাহারায় রেখে গেছে সমূহ ধূসরতাকে। জায়গাটা এখন কেবলই ঘরের খোলস।
লায়লাকে খোঁজার জন্য রান্নাঘরে ঢুকে ব্যাগ থেকে রুটি বের করে রাখলাম সামনে। ওখান থেকে কাউকে শোয়া দেখতে পাওয়ামাত্র আমার সমস্ত ক্লান্তি মুছে গেল।
‘ডাল গরম করতেছি। তুমি খাবা?’
‘উঁহু, আমি খাইছি।’ ও বলে। লায়লার কণ্ঠে সজীব প্রাণের দৃঢ়তা। যেন মিষ্টি স্মৃতিদের উষ্ণ চাদরে মুড়ে দিচ্ছে আমায়। ‘নৌকার ব্যাপারে কথা হলো?’
ক্র্যাপ…আমি ব্যস্ততার ভান করে পাতিলে ডাল ঢেলে চুলায় বসালাম। ‘তুমি সত্যিই খাবা না?’
সাত মাসের অন্ত্বঃসত্ত্বা লায়লা উঠে বসে। গায়ের গাঢ় নীল জামাটা পেটের কাছে টানটান হয়ে আছে। ‘বল সালামা, কিছু হলো?’
আমি ডালের দিকেই তাকিয়ে থাকি, আগুন জ্বলছে হিসহিস করে।
এখানে এসে ওঠার কিছুদিন পর থেকেই লায়লা বায়না ধরেছে যেন হাসপাতালের ওই আ’ম নামের লোকটার সাথে কথা বলি। সিরিয়ানদের জার্মানিতে নিরাপত্তা পাওয়ার কিছু কিছু ঘটনা ও কোথা থেকে যেন শুনেছে। আমিও যে শুনিনি, তা নয়। আমার পেশেন্টদেরই কেউ কেউ আ’মের মাধ্যমে ভূমধ্যসাগর পাড়ি দিয়ে চলে গেছে। সে কীভাবে নৌকাগুলো জোগাড় করে, আমি ভেবে পাই না। কিন্তু কথায় আছে না, টাকায় কী না হয়!
‘সালামা!’
ভেতর থেকে একটা দীর্ঘশ্বাস বের হয়ে আসে। ডালে আঙুল ছুঁইয়ে দেখি সামান্য গরম হয়েছে। কিন্তু ক্ষুধায় পেট এমন গুড়গুড় করছে যে ভালো করে গরম করার তর সইছে না। চুলা থেকে ডাল নামিয়ে লায়লার পাশে গিয়ে বসি।
ও আমার দিকে ভ্রু তুলে তাকিয়ে আছে। ওর সমুদ্র-নীল চোখজোড়া অসম্ভব রকমের বড়, প্রায় পুরো চেহারাই দখল করে রেখেছে। পিঙ্গলবর্ণ চুলে লালচে-সোনালি আভা আর ফরসা গায়ের রং মিলিয়ে ওকে দেখতে হেমন্তের মতো জাদুময়ী মনে হতো। এখনো, এত সব কষ্ট নিয়েও সেই একই জাদুময়তা ওর চেহারায়। কিন্তু লায়লার হাড় জিরজিরে হাত আর ফোলাফোলা গালগুলোর চিমসে যাওয়া আমার চোখ এড়ায় না।
‘আমি উনাকে জিজ্ঞেস করিনি’, ডাল খেতে খেতে শেষমেশ বলেই ফেলি। জানি, এখনই ও আর্তনাদ করে উঠবে। এবং তাই হলো। ‘কেন? আমাদের কাছে টাকা তো আছে।’
‘হ্যাঁ, সেই টাকা যেটা ওখানে গেলে আমাদের খেয়ে-পরে বাঁচার জন্য লাগবে। উনি কত না কত চায়, সেটা কি আমরা জানি? আর তাছাড়া যেসব ঘটনা…’
লায়লা মাথা নাড়ায়। কয়েকগাছি চুল এসে ওর গালের উপর পড়ে। ‘আচ্ছা, হ্যাঁ। কেউ কেউ হয়তো সমুদ্র পাড়ি দিয়ে পাড়ে উঠতে পারে না, কিন্তু তারচেয়ে বেশি মানুষ তো পারতেছে! সালামা, আমাদের দ্রুত সিদ্ধান্ত নিতে হবে। দ্রুত এই শহর ছেড়ে চলে যেতে হবে। ওর জন্ম হওয়ার আগেই…’
কথা শেষ হওয়ার আগেই ওর নিঃশ্বাস ভারী হয়ে আসে। ‘আর খবরদার! ভুলেও তোমাকে রেখে যাওয়ার কথা বলবা না! যদি যাই দুজনই যাব, না হয় একজনও না। একা গেলে আল্লাহ জানে আমি কই না কই থাকব, তুমি বেঁচে আছো না মরে গেছো সেটাও তো জানার সুযোগ থাকবে না। এটা কোনোভাবেই সম্ভব না! আর পায়ে হেঁটে তুরস্কে যাওয়াও সম্ভব না, তুমি নিজেই বলছিলা। তাছাড়া সীমান্ত বাহিনী আর পিঁপড়ার মতো হাজার হাজার স্নাইপাররা আমাদেরকে ফ্রি সিরিয়ান আর্মিদের এলাকা থেকে বাইরে পা দেয়া মাত্রই গুলি করে মারবে। আমাদের এখন একটাই উপায়। আর কতবার বললে তুমি বুঝবা, সালামা?’
ডালের ঘন তরল আমার গলা বেয়ে পেটের ভেতর পাথরের মতো আছড়ে পড়ে। ওর কথায় ভুল নেই। ওর এখন থার্ড ট্রাইমেস্টার চলছে। পায়ে হেঁটে চারশ মাইল পথ মৃত্যুর সাথে লুকোচুরি খেলে পাড়ি দেয়া আমাদের দুইজনের একজনের পক্ষেও সম্ভব না।
ডালের পাতিল সামনে থাকা কফি-টেবিলের উপর রেখে আমি নিজের হাতের দিকে তাকিয়ে থাকি। মৃত্যু যখন আমার প্রাণ কেড়ে নিতে চেয়ে পারেনি, অগুনতি কাটাকুটির ক্ষতচিহ্ন রেখে সে চলে গেছে। কিছু দাগ অস্পষ্ট, কিছু আবার এখনো দগদগে। নতুন গজানো চামড়াগুলো এখনো তাজা মনে হয়, অথচ সেরে গেছে সেই কবেই। এই প্রতিটা দাগ আমাকে দ্রুত হাত চালানোর তাগিদ দেয়, মনে করিয়ে দেয় সমস্ত গ্লানি ভুলে গিয়ে আরো একটা প্রাণ বাঁচিয়ে তুলতে।
জামার হাতা টেনে দিতে যাব তখনই লায়লা আলতো করে আমার হাতের উপর হাত রাখে। আমি ওর দিকে তাকাই। ‘আমি জানি তুমি কেন উনাকে নৌকার কথা জিজ্ঞেস করতেছো না, আর ব্যাপারটা যে আসলে টাকার জন্য না সেটাও জানি।’
আমি হাত টান দিই।
আমার মাথার ভেতর ভাইয়ার কথাগুলো ফিসফিস করে বাজতে থাকে। ‘সালামা, আমাকে প্রমিস কর। প্রমিস।…’
মাথা নেড়ে ওর স্বর তাড়ানোর চেষ্টা করি। বড় করে শ্বাস নিয়ে বলি, ‘লায়লা, এই গোটা তিনটা এলাকায় আমিই এখন একমাত্র ফার্মাসিস্ট। আমি যদি চলে যাই, ওদের কী হবে? এই যে বাচ্চারা কাঁদতেছে, যারা স্নাইপার শটে আহত হচ্ছে, ক্ষতবিক্ষত মানুষগুলোর কী হবে?’
‘আমি জানি। কিন্তু আমি তোমাকে রেখে যাচ্ছি না, এই বলে দিলাম।’
লায়লাকে চোখ বন্ধ করে কুঁকড়ে উঠতে দেখে আমি কিছু বলতে গিয়েও থেমে যাই। আরেকটু কাছে গিয়ে সাথে সাথে প্রশ্ন করি, ‘বাবু লাথি দিচ্ছে?’ চেষ্টা করি আমার উৎকণ্ঠা যেন ও টের না পায়। অবরোধের কারণে গর্ভকালীন ওষুধ পাওয়া প্রায় অসম্ভব আর ঘনঘন চেকআপ করানোরও সুযোগ নেই।
‘হ্যাঁ, হালকা।’ ও স্বীকার করে।
‘ব্যথা লাগতেছে?’
‘না। শুধু একটু অস্বস্তি।’
‘কিছু করা লাগবে?’
ও মাথা নাড়ায়। ‘আরেহ, ঠিক আছি আমি।’
‘হ্যাঁ, তোমার মিথ্যা কথা আমি এক মাইল দূর থেকেও বুঝতে পারি। ওইপাশ ফিরো।’ আমার কথা শুনে ও হাসে।
যতক্ষণ পর্যন্ত লায়লাকে ভারমুক্ত মনে না হয়, ততক্ষণ ওর কাঁধ মালিশ করে দিই আমি। মেয়েটার চামড়ার নিচে চর্বি বলে কিছু নেই। যতবার আমার আঙুল ওর বাহুর হাড়-মাংস ছোঁয়, আমার গা কেঁপে ওঠে। এটা ঠিক হচ্ছে না। ওকে এখানে রাখা উচিত না।
‘আর লাগবে না রে।’ লায়লা ঘাড় ঘুরিয়ে বলে। ওর মুখে কৃতজ্ঞতার হাসি। ‘থ্যাংকস!’
আমিও ফিরতি হাসি দেয়ার চেষ্টা করে বলি, ‘জানোই তো, আমি ভেতরে-বাইরে সমানভাবে একজন ফার্মাসিস্ট। তোমার খেয়াল রাখা তো আমার মজ্জাগত স্বভাব।’
‘জানি, জানি।’
আমি একটু ঝুঁকে ওর পেটে হাত বুলোতে গিয়ে বাবুকে অনুভব করি।
‘আই লাভ ইয়ু, বাচ্চা। কিন্তু এভাবে আম্মুকে ব্যথা দেয়া যাবে না, বুঝছো? আম্মুকে ঘুমাতে দিতে হবে, হ্যাঁ?’ আদুরে গলায় বাবুটাকে বলি।
লায়লার হাসি আরো গভীর হয়। ও আলতো করে আমার গাল ছুঁয়ে বলে, ‘তুমি এত মিষ্টি করে কথা বলো, সালামা। যে কোনোদিন কেউ এসে তোমাকে আমার কাছ থেকে ছিনিয়ে নিয়ে যাবে।’
‘এএএহ! বিয়েশাদি? এই পরিস্থিতে?’ আমি ঘোঁত করে বলে উঠি। সাথে সাথে মনে পড়ে, সেবার আম্মু যখন বলেছিল যে বিকেলে কফির দাওয়াতে এক আন্টি আসবে তার ছেলেকে নিয়ে। পরিহাসের বিষয় হচ্ছে, তাদের আর আসাই হয়নি। আন্দোলনটা সেদিনই হয়েছিল।
তবে আমার মনে আছে, ভেতরে ভেতরে কী অস্থির হয়ে উঠেছিলাম আমি। এখন ওই দিনটার দিকে তাকালে মনে হয় যেন সে অন্য কোনো সালামাকে দেখছি, যার চেহারা আমারই মতো, কথাও বলে আমারই কণ্ঠে।
লায়লা ভ্রু কুঁচকে তাকায়। ‘হইতেই পারে। এত নিরাশা নিয়ে বাঁচার কিছু নাই।’
ওর বিব্রত চেহারার দিকে তাকিয়ে আমার হাসি পায়। ‘ঠিক আছে, তুমি যা বলো তাই হবে।’
লায়লা একদমই বদলায়নি। সেদিন, আমি যখন ওকে কল দিয়ে মেহমানদের আসার কথা বললাম, তার পনের মিনিটের মাথায় বাসার দরজায় হাজির। জামাকাপড় আর মেকাপভরতি বিশাল এক ব্যাগ হাতে করে এসে ও চেঁচাতে চেঁচাতে পুরো বাসা মাথায় তুলে ফেলেছিল সেদিন।
আমাকে টেনে রুমে ঢুকিয়ে ব্যাগ থেকে আকাশি রঙের একটা কাফতান বের করে ঘোষণা করলো, ‘তুমি এটা পরবা!’ ভারী কাপড়ের জামাটা গায়ে এত মসৃণ লাগছিল! জামার পাড়ে, কোমরে সোনালি সুতায় কাজ করা। এই অদ্ভুত সুন্দর রংটা দেখে আমার স্পিরিটেড এওয়েতে দেখানো সেই সমুদ্রটার কথা মনে পড়ে, যার সৃষ্টি হয়েছে বৃষ্টি থেকে।
‘সাথে নীল আইলাইনার পরবা। তারপর শুধু দেখো, সে তোমার সাথে আরেকবার দেখা করতে না চেয়ে পারবেই না!’ বলে চোখ টিপে লায়লা হেসেছিল। ‘নীল আইলাইনার পরলে তোমাকে যে কী সুন্দর লাগে!’
‘সেটা আমি জানি।’ ভ্রু নাচিয়ে বলি, ‘এটা হচ্ছে গায়ের রং শ্যামলা হওয়ার সুবিধা।’
‘অথচ আমি নীল আইলাইনার দিলে আমাকে দেখে মনে হবে কেউ মেরে ভূত বানিয়ে দিছে’ বলে ও যখন হাত দিয়ে মিছেমিছি চোখের পানি মুছল, তখন ওর হাতের আঙুলে বিয়ের আংটিটা ঝিলমিল করছিল।
‘হইছে, বেশি ঢং করতেছো, লায়লা।’ আমি হেসে হেসে বলেছিলাম।
ওর হাসি তখন শয়তানি রূপ নেয়, জ্বলজ্বলে নীল চোখে তাকিয়ে লায়লা বলে, ‘ঠিক বলছো। হামযা কিন্তু আমার ঢং অনেক পছন্দ করে।’
আমি সাথে সাথে দুই হাতে কান চেপে বলি, ‘এহহে, লায়লা। আমি এগুলা শুনতে মোটেই আগ্রহী না।’
ও খিলখিল করে হেসে উঠে আমার দুই বাহু চেপে ধরে আরো অস্বস্তিতে ফেলার চেষ্টা করেছিল। কিন্তু হাসির দমকে কিছুই বলতে পারছিল না। লায়লার দীর্ঘশ্বাস ফেলার শব্দ আমাকে বাস্তবে নিয়ে আসে।
‘শুধু কোনোমতে বেঁচে থাকাটাকেই জীবন বলে না, সালামা।’ ও বলে।
‘আমি জানি।’ আমাদের খুনসুটির আমেজ চলে গেছে।
ও তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকায় আমার দিকে, ‘আসলেই? তোমার কাজেকর্মে আমার তো তা মনে হয় না। তুমি নিজের সবটুকু হাসপাতালে, কাজে আর আমাকে দিয়ে দিতেছো। কিন্তু নিজের জন্য কী করতেছো তুমি? এই বিপ্লব কেন হইতেছে, সেটা তুমি ভাবতেছো না। আমার তো মনে হয় তুমি এই ব্যাপারে ভাবতেই চাও না।’ ও থামে, আবার বলে, ‘ব্যাপারটা এরকম, যেন তোমার কিচ্ছু যায় আসে না, সালামা। কিন্তু আমি জানি, তুমিও ভাবো। তুমিও জানো বিপ্লবের উদ্দেশ্য আমাদেরকে আমাদের জীবন ফিরিয়ে দেয়া। শুধু কোনোমতে বেঁচে থাকা না। বরং এর উদ্দেশ্য আমাদের লড়ে যাওয়া। তুমি যদি এখানে থেকে লড়াই করতে না পারো, তাহলে কোথাও গিয়েও পারবা না। এমনকি যদি এতদিনে তুমি সিদ্ধান্ত বদলে জার্মানিতে পৌঁছে যেতে, তবুও না।’
আমি উঠে দাঁড়িয়ে দেয়ালের দিকে মুখ করে দাঁড়াই। অবহেলায় মলিন হয়ে যাওয়া দেয়ালচিত্রের দিকে, যেখানে কিছুই নেই। ‘কীসের লড়াই? এখানে থেকে যদি আমরা সম্মানের সাথে মরতে পারি, সেটাই আমাদের জন্য সৌভাগ্যের বিষয়—এটা তুমিও ভালো করে জানো। আমাদের ভাগ্যে হয়তো মিলিটারির হাতে এরেস্ট হওয়া লেখা আছে, নয়তো বোমার আঘাতে মৃত্যু। সংগ্রাম করার মতো কিছু নেই। কারণ আমরা লড়তে পারতেছি না। কেউ আমাদের সাহায্য করতেছে না। হাসপাতালে নিজ ইচ্ছায় খাটতেছি কারণ চোখের সামনে মানুষকে মরে যেতে দেখতে পারব না আমি।’
লায়লা আমার দিকে তাকায়। ওর চোখে কোনো বিরক্তি নেই। কেবল সহানুভূতি সেখানে। ‘এখানে থাকাই আমাদের সংগ্রাম, সালামা। কারণ এটা আমাদের দেশ। এটা তোমার বাবার ভূমি। তারও বাবার ভূমি। তোমাদের ইতিহাস এই মাটিতে খোদাই করা। পৃথিবীর অন্য কোনো দেশ তোমাকে নিজের মাটির মতো ভালোবাসবে না।’
চোখ ফেটে কান্না আসছে আমার। ওর প্রতিটা শব্দ যেন স্কুলের ইতিহাস বইয়ের শব্দগুলোকে প্রতিধ্বনিত করছে। দেশের জন্য ভালোবাসা আমাদের অস্থিমজ্জায় মিশে আছে। আমাদের স্কুলের প্রথম দিন থেকে শুরু করে প্রতিদিন সমস্বরে গাওয়া সেই জাতীয় সংগীতেও মিশে আছে। শব্দগুলো তখন কেবলই শব্দ ছিল। কিন্তু, এই এত সবকিছুর পর প্রতিটা শব্দ এখন আমাদের অমোঘ বাস্তবতায় রূপ নিয়েছে।
আমাদের প্রাণ অনির্বাণ, আমাদের ইতিহাস সমুজ্জ্বল
আমাদের শহিদের আত্মারা আমাদের অদম্য অভিভাবক
অনুশোচনার কবল থেকে বাঁচতে আমি লায়লার দৃষ্টি উপেক্ষা করি। এত অনুশোচনার ভার আমি নিতে পারছি না আর। তিক্তস্বরে বলি, ‘এই যুদ্ধ অনেক কিছু কেড়ে নিয়েছে আমার।’
‘এটা কোনো যুদ্ধ না, সালামা। এটা একটা বিপ্লব।’ ওর কণ্ঠে দৃঢ়তা।
‘একটা হইলেই হইল।’ বলে আমি নিজের ঘরে ফিরে দরজা বন্ধ করে দিলাম। আমার সমস্ত চিন্তা, পৃথিবীতে আমার অবলম্বন এখন লায়লা আর হাসপাতাল। আমি তো অসুর না। এত এত মানুষ কষ্টে আছে, আমি তাদেরকে সাহায্য করছি। এজন্যই তো আমি ফার্মাসিস্ট হতে চেয়েছিলাম। কিন্তু এই মানুষগুলোকে কেন হাসপাতালে আসতে হয় আমি তা ভাবতে চাই না। কেন এই সবকিছু হচ্ছে, যে ‘কেন’ আমার আম্মুকে কেড়ে নিয়েছে। আমার আঙুলের ফাঁকে আম্মুর ঠান্ডা আঙুলগুলোর স্পর্শ মনে পড়ে। এই ‘কেন’ই আমার বাবাকে, ভাইয়াকে কোথায় যে নিয়ে গেছে শুধু খোদা জানে। পেছনের দিনগুলোর দিকে আমি আর তাকাতে চাই না। এই কিশোরী বয়সটা আমার ভাঙা-স্বপ্ন আর দুঃস্বপ্ন ঘেরা রাতকে সঙ্গী করেই কেটে যাবে ভেবে ভেবে আমি আর কাঁদতে চাই না। আমি বাঁচতে চাই। আমার পরিবারকে চাই। আমি আমার পরিবারকে ফেরত চাই। লায়লার কথা যদি সত্য হয়, তবু চাই।
কাপড় বদলে ঘরে পরার একমাত্র জামাটা গায়ে গলিয়ে নিই। কালো, সুতি সোয়েটার আর সালোয়ার। রাতে কখনো পালানোর প্রয়োজন পড়লে তখনকার জন্য এইটুকুই যথেষ্ট। বাথরুমের আয়নায় নিজের বিধ্বস্ত প্রতিবিম্বকে সচেতনভাবে এড়িয়ে যাই। অভ্যাসের বশে কল ছাড়ি। কিছু নেই। সপ্তাহের পর সপ্তাহ পার হয়ে গেছে, এই এলাকায় না আছে পানি, না বিদ্যুৎ। অথচ আগে অবারিত পানি আর বিদ্যুৎ ছিল এখানে। অবরোধে সব বন্ধ। সৌভাগ্যক্রমে গত সপ্তাহে বৃষ্টি হয়েছে। বাইরে বালতি রেখে পানি জমা করেছি। সেখান থেকে একটুখানি নিয়ে অজু সেরে নামাজ পড়ি।
শত আঘাতের দাগপড়া মেঝে থেকে সূর্যের পলকা আলো এখন একেবারেই মিলিয়ে গেছে। সারা হোমস ঢেকে গেছে আঁধারের করুণ চাদরে।
বিছানায় বসে চোখ বন্ধ করে আমি বড় করে শ্বাস নিই। মাথা ঝেড়ে পরিষ্কার করতে হবে। আমার প্রাণে শেকড় গজিয়ে নেয়া ভয় আর বেদনাকে এড়িয়ে অন্য কিছুর দিকে মনোযোগ দিতে হবে।
‘সুইট এলিসাম, নামের মতোই মিষ্টি,’ আমি বিড়বিড় করে বলি আর দুআ করি নার্ভ সিস্টেম যেন ফেইল না করে। ‘সাদা পাপড়ি। ব্যথানাশক হিসেবে ব্যবহার হয়। সর্দি, কাশি আর পেটব্যথায়ও কাজ করে। মিষ্টি, মিষ্টি।’
বুদ্ধিটা কাজে দেয়। ফুসফুস থেকে পুরো শরীরে সমানভাবে অক্সিজনে পরিবাহিত হয়। চোখ মেলে জানালার বাইরে টুকরো মেঘের দিকে তাকাই। জানালার একপাশের কাঁচ ভেঙে কুচিকুচি হয়ে গেছে। কাছাকাছি এলাকায় বোমা হামলার আঘাতের প্রভাব লায়লার বাসায়ও পড়েছিল আর তখনই জানালার এই হাল হয়েছে। আমি যখন এখানে এসে উঠেছি, জানালার শার্সি থেকে রক্ত ধুয়ে পরিষ্কার করতে হয়েছিল।
জানালা বন্ধ করে রাখার পরেও ঠান্ডা একটা বাতাস বয়ে যায় সারা ঘরে। কী হতে যাচ্ছে ভেবে আমার গা কেঁপে ওঠে। আমার আতঙ্ক শুধু হাসপাতালের দৃশ্যে সীমাবদ্ধ না। এই ভয় আমার মস্তিষ্কেরই একটা অংশে পরিণত হয়ে গেছে। এখন তা আমার কাছে রক্ত মাংসের মানুষের মতো, যে নিজের কণ্ঠে ভয় নিয়ে প্রতিরাতে হাজির হয়।
‘আমার সাথে কথা না বলে কতক্ষণ এভাবে বসে থাকবা?’ জানালার পাশ থেকে সেই গভীর পুরুষালি কণ্ঠটা প্রশ্ন ছোঁড়ে। আমার মেরুদণ্ড বেয়ে একটা শীতল স্রোত বয়ে যায়।
লোকটার কণ্ঠ আমাকে মনে করিয়ে দেয়, বরফ শীতল সে পানির কথা যা দিয়ে আমি ঘরে ফিরে শহিদদের রক্ত গা থেকে মুছে ফেলি। এই শীতলতা বুকের ওপর জগদ্দল পাথর হয়ে আমাকে পৃথিবীর অতলে ডুবিয়ে দেয়ার চেষ্টা করে। এই ভার মেঘলা দিনের মতো, এই ভার মিলিটারিদের ছোঁড়া বোমার মতো। এই ভারের উপরই আমাদের হাসপাতালগুলো দাঁড়িয়ে। এই ভার আমাদের সমস্ত যন্ত্রণাকাতরতায় উচ্চারিত অনর্থক শব্দের মত।
‘এখন কী চাও তুমি?’ ধীরে ধীরে ওর দিকে তাকাই আমি।
খওফ তাকিয়ে আছে। ওর গায়ের জামা পরিপাটি। ওর কাঁধের উপরে ছোট ছোট লাল দাগের রেখা আমাকে অস্বস্তিতে ফেলে। সেই প্রথমদিন থেকেই ওর কাঁধে এগুলো দেখছি, কিন্তু এখনো অভ্যস্ত হয়ে উঠতে পারিনি। ওর চোখের দিকে তাকাতেও আমার অসহ্যবোধ হয়—নীল শীতল চোখ। মাথাভরতি কালো চুলে ওকে মানুষ বলে মনে হয় না, যদিও সে আসলেই তা না।
‘তুমি ভালো করেই জানো আমি কী চাই।’ ওর কণ্ঠের কম্পনে আমার গা কেঁপে ওঠে।
উদিত দুঃখের দেশ (দ্বিতীয় পর্ব)
দারুণ লাগলো। ঝরঝরে অনুবাদ… পরবর্তী পর্বের অপেক্ষায় রইলাম।
খুব তাড়াতাড়ি বাকিটা আসুক
নিরবচ্ছিন্ন দ্রুততায় পড়ে উঠলাম
মাশা আল্লাহ আপু৷আল্লাহ বারাকাহ দান করুক৷
ঝরঝরে অনুবাদ।
মাশাআল্লাহ।
ভালো লাগলো।
বাকিটা দ্রুত আসুক।