গল্প পড়তে এসেছেন ভালো কথা, তবে একটা অনুরোধ আমার গল্পরে আহামরি কিছু মনে করবেন না। একজন লেখকরে বেশি ভরসা করা হল আপনাদের দোষ। আমরা দেখেছি যে খুব আগ্রহ নিয়া, গদগদ তাললয়ে যারা কোনো লেখা পড়তে থাকে, মন্ত্র মুগ্ধকর চাহনিতে একের পর এক পৃষ্ঠা উল্টাতে থাকে তারা মূলত বোকা পাঠক। গল্প পড়তে আসতে হলে এবং নিজেকে বোদ্ধা পাঠক প্রমাণ করতে চাইলে আপনারে কিছু নিয়ম আজ শিখিয়ে দেই। গল্প পাঠ শুরু করার আগে অবশ্যই নিজেরে লেখকের চেয়ে বেশি বুদ্ধিমান চিন্তা করবেন। এই জিনিশটা আপনার পারতে হবে, অবশ্যই নিজের চেয়ে লেখকরে বোকা ভাববেন। পুরা লেখা বিরক্তির দৃষ্টিতে পড়বেন। গড়গড় করে না পড়ে থেমে থেমে পড়বেন। আশেপাশে চিন্তাশীল দৃষ্টি ফেলবেন। এবং গল্পকারের সংজ্ঞাটা দিলে দিলে আওড়াবেন : গল্পকার মানে হল যে একগুচ্ছ বানোয়াটি কথা চটিয়ে বলতে পারে। অনেকগুলি সম্পর্কহীন চিত্র ও চরিত্র জোড়া লাগানোর জানতোড় মেহনত করে। বানোয়াটি তো বানিয়াটিই। জোড়াতালি তো জাড়াতালিই।
আসরের পর আমি আর তেমন পড়ি না। ছোট ক্লাশগুলোতে যখন পড়তাম আসরের পর আমি তুমুল মনযোগে পড়তাম। বড় হয়ে এখন আসরের নামাজের মুসল্লায় প্রধানত যেটা ভাবি, নামাজ শেষে পড়তে বসব নাকি হাঁটতে বের হব? পড়ব না বের হব? অবশেষে কামরায় এসে একটা বই খুলে বসি। দুলাইন না পড়তেই মনটা উইড়া যায় নদীর ধারে কি চায়ের স্টলে। পড়া আরেকটু আগায়, তবে সাথে পাল্লা দিয়ে হাঁটতে যাওয়ার আগ্রহ তীব্র হয়। বৃষ্টি হালায় আরও পড়ে। জলের ঘনত্ব জানলায় দেখা যাওয়া সমস্ত বাড়িঘর ঢাইকা নেয়। কারো কাছে ছাতা পাই না।
সন্ধ্যার আগেই থামে বৃষ্টি। ঝটপট রাস্তায় নেমে পড়ি। বৃষ্টিধোয়া বাতাস গায়ে শীতের দোলা তুলতে চায়। শীত আসার বেশি দিন নাইও। মাদরাসার পিছনে এই গলির বাঁয়ের ঘরবাড়ি ঠিকঠাক আছে, দোতলা পাকা ও টিনছাদ বাড়ি যেটা বুক সমান ভাঙ্গা কাঁচ বসানো দেয়ালে ঘেরা। তারপর রিকশার গ্যারেজ ও রামছাগলের খর। তারপর একতলা ভাঙ্গাচোরা পুরান ঘরগুলি মুরগি টোপার মতো টুপতেছে বৃষ্টিধোয়া বাতাসের তলে, রঙচটায় আর ধূসরতায় ঠিক বোঝা যাচ্ছে না দেয়ালগুলার গাঁথুনি কাদা মাটির না সিমেন্টের। তারপর হাতের ডানে গলি থেকে খানিক তফাতে বিশাল লাল বিল্ডিং। একলাই ঠায় ঝুলতেছে স্থির শূন্যের আংটায়, যেমন এর বারান্দাগুলায় লাল হলুদ নীল জামাকাপড় ঝুলতেছে। এর আশেপাশে একটাও বিল্ডিং নাই। দালানটার রঙ খুবই ঘিনঘিনে। আমরা ছোটবেলায় অনেকগুলি তরমুজ বিচিসহ সড়াত সড়াত গিলে ফেলতাম যখন, এরপরে পায়খানা করলে লক্ষ্য করতাম হুলুদ ও লালের মাঝামাঝি কড়া এক মিশ্র রঙ তৈয়ার হত, তেমনই মিশ্র রঙ এই দালানের।
আমি নদীর তীরে যাচ্ছি। যদি আরাসতু লাইছুর সাথে দেখা হয়ে যায় তো একটা আড্ডা মারব। এলাকার পোলাপাইনগুলি ওর নামটা ভালো করে বলতে পারে না। তাই শর্টকাট বাইর করছে, আলাইছতু। শুধু ওর সাথে দেখা করতেই বাহির হইছি ব্যাপারটা এমনও না। আমি বের হই-ই একাধিক অপশন নিয়ে। তো তারে দেখা না পেলে একটা চা খাব। সেই চা মিলব্যারাকে খেলে ফেরার সময় রাস্তার হিসাব একভাবে করতে হবে আর এই গলির ধারেই খেলে আরেকভাবে করতে হবে। ওদিকে চা খেলে বেশি হাঁটতে হবে তবে সেদিকের চায়ের স্বাদ আছে। আর এখানেই খেলে মাদরাসায় দ্রুত ফেরা যায়। অথবা লাইছুরে না পেলে আমরা তৃতীয় কোনো কাজও করতে পারি। ধরো একটা ঝালমুড়ির ঠোঙ্গা হাতে নিয়ে খেতে খেতে ওর আস্তানার দিকে চলে যাব।
আরাসতু লাইছুরে পেলাম না। এটাই সাধারণত হয়ে থাকে। সমস্ত সন্ধ্যা জুড়ে আমরা এই উলামা পার্কের সরগরমের মাঝে আরাসতু শূন্যতায় ভুগতেছি। নদীর উল্টা তীর অন্ধকার কবুল করার জন্যে উন্মুখ হয়ে আছে। ওপারে জলের তরঙ্গগুলা থমকে আছে কিছুক্ষণ ধরেই। চোখ ফিরিয়ে নেই। কারেন্টের খুঁটিতে কতক কাক বসে আছে। চরম উদ্দেশ্যহীন কোথায় ওরা চাইতেছে বলা কঠিন। কারেন্টের তারে আরেকটা শাদা কাপড় ঝুলতেছে এবং উড়তেছে বেতাল হয়ে। যেভাবে বেতাল হয়ে বালিকার ফ্রক উড়ে উড়ে যায়।
**
বুখারির শেষ হাদিস পর্যন্ত যেতে আর মাত্র কয়েক পৃষ্ঠা বাকি আছে। দানেশ ওই কটা পৃষ্ঠা বারবার উল্টেপাল্টে গুনতেছে। একটু পরে সে বুখারির সব হাদিসের হাফেজ হয়ে যাবে, তবে তার মুখে খুব একটা আনন্দের ছাপ দেখা যাচ্ছে না। সকালে ঘুম থেকে ওঠার পর থেকেই ওর এমন হচ্ছে। আসলেও শুধু বুখারির হাদিস মুখস্থ করায় তেমন একটা লাভ নাই।
যে গলি ধরে সে মাদরাসায় যায় কয়েকদিন ধরে গলির চেনা গন্ধটা পাচ্ছে না। নবীন চন্দ্র গোস্বামী রোডে কাঠমিস্ত্রিরা কি আর কাঠের গুড়া উড়ায় না? অথবা মাথায় সুড় গাঁথা লোহার ভারী মেশিনগুলা কি আর আওয়াজ করে না? সুড়টা ওঠা নামা করতে করতে কাঠের গায়ে বিভিন্ন খাদ ও সাঁচ কি তৈরি করে না? কাঠের কণাগুলির আদিম গন্ধ সে বাতাসে পায় না। মেশিনের শব্দগুলি বাতাসে বাজতে শোনে না।
বাসা থেকে নেমে মসজিদ পার হয়ে নবীন চন্দ্র গলির ঢালুতে পা রাখলেই দানেশের মনে হয়, সে কোনো অনিঃশেষ শূন্যে নামতেছে। তার পা কোনো তলা পাচ্ছে না। নামতে নামতে একসময় নিজেরে আবিষ্কার করে সে একটা পাবলিক বাসের সিটে বসে আছে। বাসটা নড়তেছে না। বাড়িঘর রাস্তা খুঁটি আর তারগুলি চোখের সামনে স্থির ঝুলতেছে। ঝুলতে থাকা বস্তুগুলার গায়ে কিছু প্রাণী কিছু মানুষ নড়াচড়া করতেছে, কেউ ছুটতেছে। আবার তার মনে হয়, না এটা পাবলিক বাস না। সে বসে আছে দূরপাল্লার বড় বাসে। তীব্র স্পিডে গাড়িটা ধ্বংসাত্মক কোনো ঢালুতে আছড়ে পড়তেছে। রাস্তা আর বাড়িঘরের ফাঁক গলে পিঁপড়ার মতোন যে মানুষগুলি পিলপিল চলতেছে সেগুলি ধাক্কাইয়া বাসটা আগায়ে যাইতেছে তেড়েফুঁড়ে। অথবা পিলপিল করা মানুষগুলিই সহসা থেমে যাচ্ছে। নিথর মানুষগুলি পাশে ফেলে বাসভর্তি বাড়িঘর রাস্তাঘাট আর তারখুঁটি তীব্র গতিতে ছুইটা চলে। তারা ধ্বংসাত্মক ঢালুতে নামতে থাকে তীব্র নিশায়। কিন্তু কোনো গন্তব্য পাচ্ছে না। চূড়ান্ত কোনো মৃত্যু-টানেলের মুখ হাতড়ে পাচ্ছে না যে ধ্বংসের মধ্যে লাফাইয়া পড়বে।
কী ব্যাপার, নিত্য পরিচিত এই গলিটা আজ এত নিরামিষ আর নিরানন্দ কেন? চিতাই পিঠার দোকানি চাচা নিরুত্তাপ বসে আছে। ভিড়বাট্টায় চুলা কি হাড়ি কি তাওয়া কি ডালা কি সরষা ভর্তা এলোমেলো হয়ে গেলে চাচা-চাচির কাজিয়া দেখা যাচ্ছে না। ভিড়ই তো নাই। কাঠের গুদামগুলায় আর রাস্তার ধারে এমাথা থেকে ওমাথা পর্যন্ত পড়ে থাকা বৃষ্টিধোয়া কাঠের কণাগুলি থেকে পঁচা মিষ্টি গন্ধও দানেশ পাচ্ছে না৷
দানেশের হাঁটা একরকম ঝুলন্ত হাঁটা বলা যায়। যে পাশে ধাপ ফেলে সে পাশের কাঁধ অনেকটাই ঝুলে যায়। দেখে মনে হয় যে হাঁটার গতি নাই। তবে এই ঝুলন্ত হাঁটার গতি খারাপ নয়। ব্যাপারটা সে লক্ষ্য করে তখন, যখন একটা লোকরে সে স্বাভাবিক গতিতে পাশ কাটল। কিন্তু লোকটা এটা মানতে পারল না। লোকটা তার স্বাভাবিক হাঁটার গতি বাড়িয়ে খুব কসরত করে দানেশের পাশ কাটল। লোকটা শাদা চুস্ত পাজামা আর সুতি পাঞ্জাবি আর তার উপর লাল টকটকা কোট পরেছে। দানেশের কাছে ড্রেসটা বিদঘুটে লাগতেছে। দানেশ ফের ভাবে, না এটা তো ওর পোশাকস্বাধীনতার বিপরীত ভাবতেছি। আমাদের স্বাধীনতাগুলা বরং এমনই হওয়া উচিত। প্রতিটা একক ইনসানের স্বাধীনতা অপর একক ইনসানের কাছে অপছন্দনীয় হওয়া জরুরি। আর এভাবেই আমাদের বাকস্বাধীনতা পোশাকস্বাধীনতা ও মানবাধিকার ইত্যাদি আন্দোলন সামনে আগাইয়া নেয়া উচিত।
গলিটা শেষ হয়। এখান থেকে রাস্তার তিন মাথা বাহির হয়েছে। এতে দানেশের রাগ চড়ে যায়। গলির শেষে এসে যতবার এই তিন মাথা দেখে ততবার মেজাজ তার খিঁচড়ে যায়। কানের নিচে ঝা ঝা করে ওঠে। এ ব্যাপারটা মানা তার পক্ষে খুব কষ্টকর যে একটা পথ একটু এগিয়েই একাধিক হয়ে যাবে। তার দূরপাল্লার বাসভর্তি ঘরবাড়ি রাস্তাঘাট তারতুর খুঁটিনাটি কি এখন ভাগ করে দিতে হবে যে তোরা এই রাস্তায় যা, তোরা এদিকে যা আর তোরা ওদিকে? তার মাথায় এই জড়বস্তুগুলা দাপাদাপি শুরু করে। বুঝতেছে না কোনগুলিরে কোনদিকে এগিয়ে দিবে। কিংবা বাড়িগুলার সাথে রাস্তাগুলার সাথে চিমটে থাকা পিলপিল চলা ছুটন্ত মানুষগুলিরে কারে কোন পথে ভাগ করে দিবে সে পেরেশানিতে পড়ে যায়।
বুখারি শেষ করল না হালায়। কাট্টা কাট্টা দুটা হাদিস রাইখা দিল। পরে মুখস্থ করবে। একটা মার্ল বোরো ধরায় বারান্দায় দাঁড়িয়ে। রশির কাপড়গুলি সরিয়ে নিথর আন্ধারের দিকে নজর ফেলে। স্ট্রিট লাইটগুলির আলোর তীব্রতা নাই। লাইটের প্লাস্টিক ঢাকনা চিরে অনেক পোকা ঢুকেছে, আর নিচে রাস্তায় সারাদিনের ধুলা তো পড়ে আছেই, ফলে ঘোলা আলো ধূসর ধুলায় ধাক্কা খেয়ে আরও ঘোলা হয়ে ছিটকে পড়তেছে দুই ধারে এবং বাড়িগুলির দরজা জানলায় ঝোলা ছোপ ছোপ অন্ধকাররে আরও কালো করে তুলতেছে। আবাসিক সার সার বাড়িগুলির অস্তিত্ব মলিন হয়ে আসে। বিশাল কালো সরোবরে সারি বেঁধে কিছু কালো অস্তিত্ব কোনোরকম মাথা উঁচিয়ে দুলতেছে। আর রাস্তাগুলায় তরল সীসার মতো ঘোলা পদার্থ গলে গলে পড়তেছে, আপন সাঁচে গেঁথে বসতেছে, তলের তরলের উপর উপরের তরল জেঁকে বসতেছে আর মিটিমিটি আলো বিলাচ্ছে।
এটা পুরাটা খাওয়া যাবে না। জিনিশ তো নিজের নয়। অর্ধেক পুড়িয়ে মার্ল বোরোটা নিভিয়ে পকেটে পুরাল। সে আবহওয়া দেখে যেটা বুঝতে পারল, আবাসিক বাড়িগুলা খুব আলো শূন্যতায় ভুগতেছে। বাড়িগুলা তার মাথার ভিতরে জ্বলা দপদপ জ্বালাপোড়াগুলা ধার করে নিলেই তো পারে। শুধু আলোকিত হবে না। সাথে জ্বলবে এবং পুড়বেও।
মাথার দপদপানি ছুটতেছে না। ওই রুমে যাবে কিনা ভাবতেছে দানেশ। ইচ্ছা না থাকলেও ঢোকে। এই শালারা মোভি দেখতেছে। সেও বসে মোভি দেখতে। কাবির সিং দেখতেছে। সে বলে ইংরেজি মোভি ছাড়। কী দেখোস লেউড়ার দল। ওরা বলে, হিন্দি চলে না, ইংরাজি খুব চলে তোর আ? তোর তো আরবি মোভি দেখা উচিত। আরবি গান নিয়া মাইতা থাকিস যেহেতু সেহেতু এর একটা হক আছে না? মোভির বেলায় তাইলে ইংরাজির নাং করোস ক্যান?
লেউড়াগুলির ক্যাচালে সে আর মুখ বাড়ায় না। অর্ধেক মার্ল বোরো পকেটে পুরে দরজা খুলে সে সিঁড়ি বেয়ে নিচে নামা শুরু করে। ঝুলতে ঝুলতে হাঁটে।
**
কারেন্টের তারে ঝোলা বেতাল ওড়া শাদা কাপড় দেখে আমার মনটাও বেতাল হয় কিছুটা। ফরফর করে উড়ে বৃষ্টিধোয়া বাতাসের সাথে তাল দিতে চায়। আমি বেচইন হয়ে আরাসতু লাইছুর আস্তানার দিকে হাঁটা শুরু করি।
হাঁটতে হাঁটতে হাঁটার তোড়ে দৃষ্টি এলোমেলো হয়ে যায়। বেড়িবাঁধের গ্রেট ওয়াল, দূরে ধূসর ঢেউগুলির আলো-রঞ্জিত হওয়া আর ঢেউগুলির উপর আজদহা ব্রিজটার ঝুলতে থাকা, প্রত্যেকটা চিত্র একটা আরেকটার জায়গায় বসে যায়। গ্রেট ওয়াল ঢেউয়ের ভাঁজে দাঁড়িয়ে যায় তো ঢেউগুলা ব্রিজের আকার ধারণ করে শূন্যের উপর ঝুলন্ত জলতরঙ্গ হয়ে বইতে থাকে। আস্ত নাতিদীর্ঘ গাদা গাদা ধুলা পড়া রাস্তা অথৈ জলে ভরে যায় যেভাবে চোখের কোনায় জলের ঝাপসা কণা কেঁপে ওঠে। রাস্তার ধারে সার বান্ধা পিকাপগুলি লঞ্চের রূপ নিয়ে জল কাঁপিয়ে বাতাস কাঁপিয়ে চলা শুরু করে।
রাস্তার ধারে একমণ দুমণ ওজনের গোল করে চাছা কাঠগুলা বৃষ্টিতে ধুয়ে যাওয়ার পর একটা নেশাতুর গন্ধ ছড়াইতেছে। ভারী ভারী কাঠগুলি লাওয়ারিশ পড়ে আছে আরাসতু লাইছুর প্রেমিকাদের মতো। হালায় প্রেমও করে বাপরেহ বড় লোক মাইয়াগুলির লগে। উত্তরার মাইয়া, বসুন্ধরার মাইয়া, ধানমণ্ডির মাইয়া সবগুলির লগে চুটিয়া লুটিয়া পুটিয়া প্রেম করে। বিভিন্ন শিল্প, কলা ও সাহিত্যপ্রেমী ধনী মুরগিগুলি খপ করে ধরে খেয়ে ফেলে দেয় লাওয়ারিশ কাঠগুলির মতো।
ওর আস্তানার ধারে কাছে চলে আসছি। পাওয়া যাবে বলে মনে হচ্ছে না। ঝালমুড়ি অলারে জিগ্যাস করলাম আলাইছতুরে দেখছো? বলল, একটু আগেই ভাত খাইতে গেল। হোটেলে যান পাইতে পারেন।
ভাতের হোটেলে তারে পাওয়া গেছে। আসসালামু আলাইকুম ভাই চুলগুলি কাটবেন না? অনেকটাই তো নজরুল স্টাইল হয়ে গেছে চুল। যদিও চান্দিতে আপনার চুল মেলা ফাঁকা ফাঁকা। এটা খুব বিছরি দেখায়, আমি বললাম।
নাহ চুল এমনই থাকবে। কাটব না।
তাইলে ই করেন, নারকেল তেল চপচপ করে লাগায়ে দেন মাথায়। আছড়ান। আবার চুলে তেল দেয়া মধ্যবিত্তের ছোটলোকি রুচি হয়ে যায় যদি?
হা হা। আমার রুচি মধ্যবিত্তের নয়, তবে আমি মধ্যবিত্ত।
আরাসতুর এলাকাতো ভাই এমডি শামছুল ছুটে আসে আমারে ভাত দেয়ার জন্যে, আলাইছতু ভাই, ভাইরে কি ভাত দিমু?
দে দে, আমি কইলাম, ভাই হারাদিন কই গেছিলেন। নতুন মুরগির কী কাট, বব কাট না কুকিল কাট? মাইয়ার বিলাসবহুল বাড়িতে খাওনদাওন কী হইল?
গেছিলাম আজ একটার লগে। বাসা কই জিগাইতে ভুলে গেছি। ওর গলার ভাঁজগুলা এতটাই মসৃণ আর আদুরে যে ঠিক মাগি শব্দটা ওর ব্যাপারে প্রয়োগ করা যায় না। যেটা কামুক না সেটা ছুঁতে ইচ্ছা করে না।
মাইয়ার বাসায় যান নাই কেন? যেতেন। পোষা কিউট কুত্তাগুলি দেখে আসতেন। বড়লোকি চালে কুত্তারে দুধ কেক খাওয়াবেন.. আমাদের এই গরিব ভাতের হোটেলের সামনে চিরায়ত লেঞ্জা নাড়াতে থাকা পিঠের মধ্যে দগদগা লাল খাউজাঅলা কালা কুত্তাটিরে আপনি খিলাবেন কী, ওর খাউজার দিকে তো ভালো করে তাকাতেই পারেন না!
হা হা। এগুলা বাদ দেন। বড়লোকের সাথে বড়লোকির ভান করতে পারা একটা মৌলিক শিল্প? এগুলা করা এখন আমার ডালভাত। আচ্ছা দানেশ হালার খবর কী? ওই যে বুখারি মুখস্থ করতে এতেকাফে ঢুকল তারপর তো মেলাদিন ওর নাম গন্ধ পাওয়া গেল না।
দানেশের কথা আপনিই বেশি জানেন। আচ্ছা এমডি শামছুল শীত না পড়তেই টাইয়ের মতো ফাঁস দিয়া এভাবে মাফলার পরছে কেন?
ওর কথা কী কমু। মজনু মজনু। গণিকার প্রেমে পড়ছে। বড় ভাই ছোট ভাইদের লগে খাতির করে গায়িকা নাদিয়ার সাথে আলাপ পর্যন্ত করলাম যে, আমাদের এমডি শামছুল দেখা করতে চায় আপনার সাথে। তো কিয়ের কী, নাটকি শালার শরম করে। নাদিয়ার সাথে কথা কওয়ার হিম্মত হয় না।
ভাতের হোটেলের পোষা বিড়াল মিনু আমার পায়ের উপর পা দেয়। খানিকটা লাফিয়ে উঠি। বিড়ালটার রঙ তরল বাদামি। খুঁটে খুঁটে কাটা খায়। বিলাইয়ের ছোঁয়ায় ভয় পেতে দেখে আরাসতু লাইছু আমার দিকে কিছুটা উপহাসের হাসি ঢালে। হলুদ বাল্বের আলো হোটেলের লাল পোস্টারের সাথে মিশে মিশ্র কুসুম রঙা আলো আরাসতুর ফাঁকা-চুলো চান্দিরে বিদঘুটভাবে প্রকাশ করতেছে। যেন-বা মদের সুরাহি হাতে অধীর আগ্রহে একজন চুলপড়া লোক বসে নর্তকির খোলা বুকের দোলাদুলি উপভোগ করতেছে আর আদিম সরাইখানার টিমটিম আলো চুলহীন চান্দিরে একলা শূন্য মাঠের মতো জ্যান্ত করে তুলতেছে অন্য চোখগুলির সামনে। ওর বিদঘুটে চান্দির দিকে আমিও অমন করুণার একটা নজর ফেলতে চাইলাম। কিন্তু ওর উপহাসের হাসিটা এতটা তীব্র ছিল যে আমার করুণার দৃষ্টিটা ওর চাঁদিতে অত মজবুত হয়ে বসতে পারল না।
**
নাদিয়া মাইয়াটা সুন্দরী আছে। কালো ফিতার ঘড়ি মলিন শ্যামলা হাতে ঝোলে। আরেক হাতে মাইক নিয়া গান গাইতে থাকে আর শাড়ির লাল পাড় ঘেঁষে চিকন লম্বা জরির কাজ সারা শরীর জুড়ে চিকমিক করতে থাকে আর সবুজাভ আলোর সাথে তাল মিলায়। মাংসল কাঁধদুটা নরম আলোর নিচে মৃদু ওঠানামা করতে থাকে। ড্রাম ও দোতারার আওয়াজ ভেসে গিয়ে কাঁধের তরঙ্গে তাল মিলানোর মুহুর্মুহু চেষ্টা করতে থাকে, আমি বললাম।
হ্যাঁ মাইয়াটারে ছোট থেকে আমি চিনি। ওদের অভাব আছিল। স্কুলে যাইতে পারলেও ঘরের কাজে সাহায্য করতে বাধ্য ছিল। রুটিরুজির মাসলা তো বোঝেনই। পরিবারের লোকগুলি গানের ব্যাপারটা জানতে পেরে আরও বেশি করে মাজারের গানসমিতির কাছে পাঠাইয়া দেয়। ভাই ব্রাদারদের হাত ধরে একজন শিল্পী পর্যন্ত উন্নিত হতে কিছু উষ্টা কিছু নুকসান তো ওরে ভুগতে হয়ই। শিল্পীরা শিল্প তৈয়ার করে অজানা কিছু কেলেংকারির উপর দিয়ে হেঁটে।
এটা ভালো কইছেন, শিল্পের আড়ালে থেকে যায় শিল্পের সমার্থক কোনো কেলেংকারি। এই যে মাজার ঘিরা দোতারা বাউল সমিতি, এখানে উস্তাদ শাকরেদ ও শিল্পীর মাঝে জালের মতো ছড়ানো চিকন একটা রুহানিয়ত নিহিত আছে, সারকেলটার কাছে কেলেংকারি শব্দটা আলাদা কোনো অর্থ রাখে না। ওরা মনে করে মুহাব্বতের পথে বাঁধা সৃষ্টির জন্যেই মূলত এই শব্দের জন্ম, আমার এমন মনে হয়।
কিন্তু তুই কোন চদু এমডি শামছুল নাদিয়ারে আশা করোস? তোর লগে কি ও যায়? ওর ক্লাশে ওঠার সাহস হয় কিভাবে? তুই বয়ের পাছাত ক লাগাতে পারবি না। তোর প্রতিটা সকাল কাটে কনডেন্স দুধের চায়ের লগে রুটি চুবাইয়া। আর বিকাল হইলে চান্দির চুল লাল রঙ কইরা, কালা চুস প্যান্ট পিন্দা, শাদা গেঞ্জির উপর বোতাম খোলা লাল নাহয় নীল শার্ট মাইরা, কানে ব্লুটুথ ইয়াফোন ঢুকাইয়া, ঝুলতে ঝুলতে গিয়া কার্গো জাহাজের টিকিতে উঠবি আর তিনজন মিলা কর্কশ গান গাইবি। লীগের ছদরুল বদর ভায়ের পিছে সন্ধ্যাটা নেওটামি করে কাটাবি, ওনার ব্যনসনের পুটকি চুষবি, এটা ওটা আগাইয়া দিবি। ইশ তুই যদি একটা গান লিখা নাদিয়ারে দিতে পারতি তাইলেই তো কেল্লা ফতে হইত! কিন্তু তোর বাপও কখনও কলম ধরছে?
গ্রেট ওয়াল সংলগ্ন ড্রেনের সুইচ গেটের ছাদে আমরা বসে আছি। চারকোণা টিয়া রঙের রেলিংগুলি দুহাতে ধরে গাটা হালকা টানা দিলাম। নদীর ওপারে বাঁধা লঞ্চগুলিতে লাল হলুদ ঘোলা শাদা কুসুম ইত্যাদি মেলা টিমটিম আলো জ্বলতেছে। প্রত্যেক রঙের আলো চিকন চিকন দীর্ঘ রেখা ফেলে দিছে জলের বুকে। ছোট-বড় ঢেউগুলির পিঠে আলোর চিকন রেখাগুলি মৃদু ওঠানামা করতেছে কিন্তু এক রেখা আরেক রেখার সাথে মিশতেছে না। এক রঙ আরেক রঙের সাথে মিলে যাচ্ছে না। যদিও জলের তরঙ্গ লালের পর হলুদ, হলুদের পর সবুজ আলোরেখা পার হয়ে যাচ্ছে। মানে জলগুলি একাধিক রঙের সাথে মিক্স হইতেছে। আর লঞ্চগুলির ডেকে যে বিভিন্ন আলো জ্বলতেছে, ওই রঙগুলি একে অপরের সাথে মিশতেছে, কিন্তু মিশতে মিশতে পুরা পেরে উঠতেছে না, অপর বাতির কাছাকাছি গিয়ে সেই আলোর তীব্র ছটায় পরস্পরকে হারাইয়া ফেলতেছে। আমি বললাম,
ভাই লীগের ইন্টেলেকচুয়াল বা ধনী ক্লাশটার আদি প্রজাতি এটা নাকি, এমডি শামছুল? দেখুন আমাদের আরাসতু লাইছু কিভাবে লীগারদের ডাইনোসর প্রজনন আবিষ্কার করলেন, ভাই সকল! নাদিয়ার প্রেমে পড়ছেন নাকি আবার?
ধুর কী বলেন। মনে হয় একটু একটু পড়ছি। শামছুলের জন্যে নাদিয়ার সাথে যখন কথা বলতে গেলাম, তখন বিশ্বাস করেন ওর ঘামে ভিজা বাহু থেকে যে গন্ধ বের হইতেছিল, ওই গানটা মনে পড়তেছিল,
কেমন জানি হইয়া গেছি
তোমারে দেইখা
দয়াল রে।
আলোর চিকন রেখা আর রঙের মেশামিশির চিত্রটা আরাসতুরে খুলে বলতে চাইলাম যে, এই জলগুলি চূড়ান্ত বেশ্যা, তাই বিভিন্ন রঙ মাখতে চায়। লঞ্চের ডেকে বসা আলোর পসরাগুলিও বেশ্যা। লাল আলো সবুজ আলোরে কখনোই মূল থেকে পাল্টাতে পারবে না এটা জেনেও অপর আলোর সাথে মিশতে যায়। নাং করতে চায়। আমরা যখন নিজের ক্লাশ ছেড়ে অন্য ক্লাশের সিফাতগুলি নকল করতে যাই, তখন আমাদের ক্যারেক্টরটাও বেশ্যা হয়ে যায়। একটা ছোটলোক যখন বড়লোকের সাথে চলার সময় বড়লোকির ভান করে ওই মুহূর্তে সে মূলত একটা বেশ্যার চরিত্রে দক্ষতার সাথে কাজ আনজাম দিতে থাকে।
হে দার্শনিক এইবার আপনার দর্শনটি থামান। রাত ঘনিয়ে এসেছে। চলুন রশিদ শাহ মস্তান মাজারে আমরা গান শুনব।
**
আচ্ছা দানেশের হইছে কী আসলে, আমি বললাম।
ওর সাথে পরশুই তো দেখা হল রাস্তায়। দেখে অনেকটা সেন্টি খাওয়া মনে হল।
কী ঘটনা কী ভাই?
হালায় এক বুড়া মুরব্বির হাতে মাইর খাইছে। ওইদিন ছুটি হইছে তো বাড়ি যাবে হালায়। শাদা জামা গায়ে দিয়া আচ্ছামতো একটা ফিটিং নিয়া বাসের অপেক্ষা করতেছে স্টেশনে। তো ওর কোন বন্ধুর সাথে স্টলে বসে আড্ডা মারতেছে। চা বিড়ি খাইতেছে অনেকক্ষণ ধরে। কোত্থেকে পাশে এসে দুই মুরব্বি বসছে বুঝে ওঠে নাই। ওরে জিগায় যে এত সুন্দর পোশাক পরে সিগারেট খাইতেছো বাবা কোন মাদরাসায় পড়ো। সে প্রথমে জবাব দেয় নাই। কয়েকবার জিগ্যাস করার পর বলল, তমুক মাদরাসায়। সে ব্যাপারটা ব্যাখ্যা করতে যাইতেছিল ওমনি ওরা চিল্লায়ে উঠল। সে উঠে যাইতেছে ওমনি ওর ঘাড় ধরে মাথার পিছে কতক থাপ্পড় লাগায়ে দেয়। বাড়ি যাওয়ার আগে রাস্তায় মারমুর খায়া কান লাল কইরা রাস্তার ধারে সেন্টি খায়া বসে আছে দৃশ্যটা কল্পনা করেন।
ভাতের হোটেলের প্লেটের এঁটা পানি ফেলে ফেলে গলিটা পিছলা হয়ে গেছে। বৃটিশ আমলের পরিত্যাক্ত রেল লাইনে পিছলা খেয়ে লাইছু পড়েই যাইতেছিল হাসির দমকে।
ঘটনা তো তাইলে জটিল ভাই।
মাজার প্রাঙ্গন জইমা উঠতেছে। মঞ্চের সামনেটা সবুজ গ্রিল দিয়ে ঘেরা। চকচকা বেনারে বড় শিরোনামটি জ্বলে উঠতেছে, দোতারা বাউল সমিতি। বাদামঅলার কুপি বাতি আরও পষ্ট হয়ে ওঠে আর কুপির ধোঁয়া উপরের দিকে একটা গাঢ় রেখা হয়ে উড়ে যায়। রাতের হাওয়ায় মাতালতা জাগবে জাগবে ভাব। গানের লহরিতে মাথা দুলিয়ে তাল দেয়ার জন্যে শিশু ঝাও গাছগুলির নরম ডগা উন্মুখ হয়ে আছে। মঞ্চে ঢোকার দরজায় নাদিয়াসহ কয়েকজন নারী শিল্পী গানের সূচি নিয়ে আলাপ করে নিচ্ছে। কোন উস্তাদ কারে কী বিশেষ নির্দেশনা ও দোয়া দিল সেগুলি নিয়েও আলাপ করতেছে চটিয়ে।
গান শুরু হয়ে যায়। আমরা এক কোনায় দুটা প্লাস্টিকের চেয়ারে বসে যাই। আউযুবিল্লা বিসমিল্লা পড়ে নাদিয়া শুরু করে,
সবি বুঝিবে বুঝিবে না সে
আমার মনের বেদনা রে
এই ফাঁকে দানেশ কখন সুড়ুত করে এসে আমাদের পাশে বসল বুঝতে পারি নাই।
আরে মৌলভি কথা নাই বার্তা নাই, হঠাৎ আবিষ্কার হইলেন! দানেশ কিছু না বলে অর্ধেক মার্ল বোরো ধরায়, আচ্ছা এই জিনিশটা হয় কেন? ধরেন একটা গলি ধরে হাঁটতেছি, গলির শেষে গিয়ে ওটা তিন মাথা হয়ে গেল। অহন আমি কোনদিকে যাব? শালা এই ব্যাপারটা বারবার ঘটতেইছে শৈশব থিকা।
দানেশের কান দুটা এত লাল হয়ে গেছে যে মাথা থেকে ভাপ উঠবে একটু পরেই।
আরে কিয়ের মধ্যে কী ঢোকান মিয়া। তিন মাথা চার মাথা কী এসব? গলির শেষে মাথা তিনটা পাইছেন শোকরিয়া করেন। একটা গলি থেকে একশো গলির মাথা বের হওয়া উচিত। আপনি সবগুলা দিয়ে একবার পথ চলবেন একই সময়ে। এটাই সই, আরাসতু লাইছু বলল।
আরে নাহ আজ সকালে মনে হইল কী…
দানেশের বাকি কথাগুলি ড্রামের তীব্র বাড়ির তালে শোনা গেল না। দোতারার টুনটান ধীর তাল এখন আর নাদিয়ার কাঁধে নাই। ড্রামের মতোই ওর কাঁধ জোরে ওঠানামা করতেছে। মধ্যবয়স সদ্য পার করা এক আংকেল লুংগির উপর গামছা বাঁইধা রীতিমত বেতাল নাচন শুরু করে দিছে। হাওয়ায় সুর ও কম্পনের উত্তাল ওঠে।
তো বুখারি শেষ হইব কবে? আমি বললাম।
নাদিয়ার গলা বেজে ওঠে,
কী ব্যথা ছি-লো
আমার, কী কথা ছি-লো
আরে আজ রাইতেই শেষ হইত। কিন্তু আজ সকাল থেকে আমার মনে হইতেছিল, এটা তেমন লাভজনক না। হাদিসের মর্ম বোঝায় আমার পারদর্শী হওয়া উচিত বেশি। মুখস্থ ব্যাপারটা তেমন কিছু না।.. তাই শেষের দুটা হাদিস মুখস্থ না করে ইচ্ছা করেই রেখে দিয়ে আসলাম।
আরাসতু মার্ল বোরোর শেষপ্রায় পাছাটা ওর হাত থেকে নিয়ে বলল, ব্যাপার এটা না। আপনি অন্যকিছু বলতে চান। মাথা মুথা নিয়ে কী জানি বলতেছিলেন?…
নাদিয়ার তেজস্বি গলায় দানেশের কথা আবার আধেকেই চাপা পড়ে যায়,
বৃষ্টিবাসের সুরে সুরে
দিয়া হাতটা গাত্তোরে
বলেছিলে ভুলিবে না
সারা-টা জীবন ধরে
মঞ্চের দুধারে দুটা সবুজ বাতির আলো আরও কোমল রোমান্সি হয়ে যায়। নাদিয়ার খালি হাতে টাকাও পড়তে থাকে গোটা কয়েক। লুংগি পরা মাঝবয়সি কালো কয়েকটি মুখ চকচকিয়ে ওঠে। বিড়িতে জোরে টান দেয়। নরম আলোধোয়া পাতলা কুয়াশায় গাঢ় রেখা ফেলে দেয় বিড়ির নীল-কালচে ধোঁয়াগুলি।
জীবন ভরে এত মাথার ভিতর নির্দিষ্ট একটা পথের মাথা ঠিক করতে পারলাম না। আমরা যত কিতাব যত জনের কাছে তালিম নিছি, প্রত্যেক কিতাব ও উস্তাদ সেখান থেকে তিনটা করে গলির মাথা বাতলায়ে দিছে। এবং আমাদের মনে হইছে সবগুলিতেই হাঁটা উচিত। সবটার প্রতিই সবসময় আমাদের সমান আগ্রহ ছিল। আমরা এটা আজও ভাইবা বের করতে পারি নি যে, আমাদের জীবন পথগুলি, পথের মাথাগুলি সব গলিত রাবারের মতো কেন? একটার ভিতর আরেকটা গায়ে গতরে ঢুকে খলত-মলত হয়ে যায়? যখন বুখারি পড়ি ঠিক তখনই কেন মনে হয় যে, না এই সময়টায় মুসলিম পড়া উচিত। আবার এই ধারণাটাও আমাদের মধ্যে কাজ করে যে, শুধু তিরমিজি পড়লেই সব বই পড়ার কাজ একলগে হয়ে যাবে। আমাদের উস্তাদরা সেই গলির মাথাগুলির মাথায় শৈশব থিকাই কিন্তু নিয়োজিত ছিল, এবং প্রত্যেকটা গলিতে হাঁটার প্রতি আমাদেরকে এত এত আগ্রহ তৈয়ার করেছে যে, যেকোনো একটা পথে চললেই মনে হয় সবগুলি পথেই আমি চলতেছি। সবটাই আমার চাখা হয়ে যাচ্ছে। আর বাড়িতে ঢুকলে তো গলির মাথার অভাব নাই। ব্যবসার পথ, চাকরির পথ, উস্তাদগিরির পথ, ওয়াজ ও পলিটিক্সের পথ, সংসারের পথ, কৃষির পথ, হাগুর পথ, মুতের পথ ইত্যাদি পথের মুখে প্রচুর টানাটানি বাঁধে আমার হাত নিয়া, দানেশ বলল।
আরাসতু যোগ করল, ভাই চলেন পথ বানানোর মেশিন তৈরি করি। এটা অনেক লাভজনক প্রজেক্ট হবে। হাজার হাজার পথ বানাইমু আর ভাঙমু। ভাঙার প্রজেক্টে বুল্ডোজার জোগাড় করার দায়িত্ব থাকবে জমিদার সুলাইমান ভায়ের উপর।
গলির মাথা বাড়ানোর কী সুরাহা হবে পিও ভাই? আর এইভাবে দানেশের খিস্তি উড়ায় দিলে কেমন হইল?
গলির মাথা আমরা বাড়াব কেন এতে লাভ কী হয়? গলির মাথার সংখ্যাধিক্য বা অল্পতা আমরা কিছুই চাই না। আমরা চাই গলির মাথা নিয়ে মানুশের চিন্তাভাবনা বিশৃঙ্খল হয়ে যাক। আমরা অস্তিত্বশীল সব মাথা আর স্বপ্ন আর গোলকে ইনকার করি। এগুলো আমাদের মতো করে বানাতে চাই যেভাবে মানুশ চায় না। সামাজিক মানুশের কোনো চাওয়াকেই আমরা গুনি না। আমাদের অসামাজিক মন যেটা চাই যেভাবে সেটাই চূড়ান্ত।
দানেশ বা আরাসতু এখানে কোনো মহান ক্যারেক্টর নয়। পূর্ন তো আরও নয়। তাদের চেয়ে এমডি শামছুল যেহেতু বেশি বিশৃঙ্খল যেহেতু জীবন নিয়ে মাখসুস মাখসুস কোনো গোল তার নাই, তাই তুলনামূলক সেই মূল ক্যারেক্টর। দানেশ হল শামছুলগামী। তার গলিগুলায় বিশৃঙ্খলা দেখা দেয়া শুরু করছে আমরা বিশৃঙ্খলা পর্যন্ত দেখিয়েছি এরচে বেশি দেখতে হলে শামছুলরে ধারণ করতে হবে আমাদের আরেকটা নতুন আনকোরা সভ্যতার আশায় এটাই নিয়ম
গল্পটা আসলেই চমৎকার। পুরোটা না পড়ে তোমাকে ভুল বলেছিলাম। বিশেষ কইরা যেভাবে গাঁথা হইছে গল্পটারে সেটাই মারাত্মক।